পাতায় পাতায় আমি যেন লেখকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম আমার বেড়ে ওঠার উত্তর কলকাতায়। আমার খেলার মাঠ, আমার স্কুলের পথ, সন্ধ্যের গা ঘেঁসে একছুটে কিনে আনা তেলেভাজা, পথ চলতে থমকে নাটকের মহড়া শোনা, সব স্মৃতি যেন ঘুমন্ত রাজপুরীর থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল।
লেখকের পুরোনো দিনের কথায় মিশে আছে তাঁর মায়ের স্মৃতি আর রবীন্দ্রপ্রেম। বইয়ের শুরুতেই আছে মায়ের কথা: "আমার মা, শ্রীমতি মাধুরী বসু। মা ছিলেন কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা এক শিল্পী, রবীন্দ্রঅনুরাগী, যাঁর প্রতিভা কোনোদিন বিকশিত হতে পারেনি।... পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, বিবাহের এক বছরের মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধি মেনিনজাইটিসে মা আক্রান্ত হন। সেই সময় এই মারাত্মক অসুখের কোনো চিকিৎসা ছিল না। মা পৃথিবীতে রয়ে গেলেন, কিন্তু ঈশ্বরের এক অদ্ভুত খেয়ালিপনায় তাঁর চক্ষু দুটি বিসর্জন দিলেন চিরদিনের জন্য।...হাজার চেষ্টাতেও তা ফিরিয়ে আনা যায়নি। এইসব বাধাবিপত্তি মা হাসিমুখে জয় করেছিলেন। মা ছিলেন এক রুচিবোধসম্পন্না শিক্ষিতা নারী, যার শিক্ষাকে পাথেয় করে আমি আজও এগিয়ে চলেছি।"
মায়ের কাছেই লেখকের রবীন্দ্রচেতনায় হাতেখড়ি হয়েছিল: "ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার কারণে সেইভাবে আমার রবীন্দ্রচর্চা ছিল না, কিন্তু মা বাড়িতে মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর গান, কবিতা আর গল্পের মধ্য দিয়ে।" মা-বাবা চলে যাবার পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন: "রবীন্দ্রনাথের গান আমার দুঃখ, আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার বিষাদের সঙ্গী, আমার আশ্রয়।" অনুভূতিশীল বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ বড়ো ভরসাস্থল।
এই প্রসঙ্গে নানা রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর গান শোনার কথা এসেছে। লেখকের মনে এক স্বল্প-আলোচিত শিল্পীর অনন্য প্রতিভা জেগে আছে: "রবীন্দ্রনাথের মতে কবিতার যেখানে শেষ, গানের সেখানে শুরু। আর এই রবীন্দ্রনাথের গানের এক ভারতীয় মহিলা শিল্পী, সংগীতকে পেশা না করেও বঙ্গদেশে তাঁর গান গেয়ে যশ ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি এক এবং অদ্বিতীয়া শ্রীমতী মালতী ঘোষাল।...শুধু একটাই প্রার্থনা, এই প্রজন্মের যাঁরা গান নিয়ে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে থাকেন, চর্চা করেন, গবেষণা করেন, তারা যেন শ্রীমতী মালতী ঘোষালের গাওয়া গানগুলি একবারটি ভালোভাবে শোনেন - তাহলেই বুঝতে পারবেন, গানগুলির অন্তর্নিহিত রবীন্দ্রনাথের ভাষার কথা।" আবু সয়ীদ আইয়ুব থেকে শঙ্খ ঘোষ, একথা অনেক রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞের লেখাতেই পাই, রবীন্দ্রনাথের গান সুর নয়, ভাষা-নির্ভর। ভাষার গভীরতার মধ্যেই রবীন্দ্রদর্শনের তল পাওয়া যায়, সুর তো সেথায় সুরধুনী মাত্র।
লেখক বেড়ে উঠেছেন উত্তর কলকাতার মানিকতলার কাছে একটি সি আই টি আবাসনে। ছোটবেলায় শোনা রাস্তার 'শিল কাটাও' 'মালাই বরফ', 'মুশকিল আসান' ডাক আর দুপুরে রেডিয়োতে শোনা বেলা দে-র 'মহিলা মহল' লেখক আমাদের মতো পাঠকের স্মৃতিতে ফিরিয়ে এনেছেন। উত্তর কলকাতার অলিতেগলিতে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা নিয়ে উত্তেজনার আঁচ আর খেলার মাঠে গিয়ে ৬০ পয়সার টিকিটের লাইনে 'মাউন্টেট পুলিশ'-এর লাঠির বাড়ি খাওয়ার স্মৃতিও আবার ফিরে এলো। এই বইতে ফুটবল খেলা প্রসঙ্গে এসেছে মাঠের হিরো প্রদীপ ব্যানার্জি, চুনী গোস্বামী, মহম্মদ হাবিব, প্রমুখের কথা। বাংলার প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার ও খেলোয়াড় বানানোর কারিগর কার্তিক বসুকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথাও শুনিয়েছেন লেখক।
শহরের স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে লেখকের মনে পড়েছে কলকাতার হারিয়ে যাওয়া বাস রুটের কথা: "ওই পার্ক সার্কাস অঞ্চল থেকে উত্তর কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটে বাড়ি ফিরব। একটাই তো বাস, ৩৩ নম্বর। চেতলা থেকে পাইকপাড়া আর পাইকপাড়া থেকে চেতলা - এটাই বাসটির রুট।" এমন অনেক বাস শহরের দু প্রান্ত ছুঁয়ে ছুটে বেড়াত আমাদের কৈশোর-যৌবনে। আজকের গতির লড়াইতে হয়তো হার মেনে তারা থেমে গেছে। রয়ে গেছে কেবল আমাদের প্রৌঢ় স্মৃতির ভিতর।
উত্তর কলকাতায় একসময় পাড়ার ক্লাবগুলি সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান ছিল। সেকথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন লেখক: "আমাদের উত্তর কলকাতার পাড়ার সব অঞ্চলে এক-একটি করে ছিল ক্লাব, যা আমাদের জীবনে এক সময় কত যে রেখাপাত করে গেছে! এই মুহূর্তে তা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করি আস্তে-আস্তে নেমে আসা জীবনের সন্ধ্যাবেলায়।... তখন, মুষ্টিমেয় কিছু ছাড়া, ছিল না কোনো সুন্দর ক্লাবঘর। এক-একটা ক্লাবের আন্তরিকতা আর ভালোবাসাই ছিল মূল মন্ত্র।" আজকের ক্লাবগুলি রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিয়েছে। লেখকের ভাষায়: "আজকে এক-একটা সুন্দর-সুন্দর ক্লাবঘরে আছে চাকচিক্য, প্রাচুর্য, পুজোর সময়ে জাদুর বলে হাতে এসে যায় প্রচুর টাকা।" এ অভিজ্ঞতা শুধু কলকাতায় নয়, শহর ছাড়িয়ে শহরতলীতেও। শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পুজোর বাজেট। পুজো করা ছাড়া ক্লাবগুলোর বোধ হয় বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নাই। সামজিক দায়বদ্ধতার কথা তাদের শোনাবে কে!
'মঞ্চ আর পর্দা' অধ্যায়ে লেখক শুনিয়েছেন সাড়াজাগানো 'বারবধূ' নাটকের নায়ক-নায়িকা শ্রী অসীম চক্রবর্তী ও শ্রীমতী কেতকী দত্ত, নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠীর কেয়া চক্রবর্তী এবং অভিনেতা স্বরূপ দত্ত-র জীবনবৃত্তান্ত, কাছ থেকে দেখা বা জানার অভিজ্ঞতা।
'তেরো পার্বণ'-এর কথায় আমরা লেখকের ছোটবেলায় পিকনিক, আকাশপ্রদীপ, বিশ্বকর্মা পুজো, লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো ও শুভ বিজয়া উপভোগ করার স্বাদ পাই। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম নিলেও হিন্দু আচার-অনুষ্ঠানের আনন্দ থেকে তিনি বঞ্চিত হননি।
পরিজনের স্মৃতিচারণে বাবা, মাসিমা, আবাসনের প্রতিবেশির বাচ্চা ছেলে অভ্র-র কথা এসেছে। লেখকের পরিজনের মধ্যে আছেন তাঁর নিজের মেসোমশাই - বিপিনচন্দ্র পালের ছেলে জ্ঞানাঞ্জন পাল- এবং গীতিকার প্রণব রায়।
'নক্ষত্র-কথা'য় এসেছেন 'বাংলার রূপকার' ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়, সংগীতশিল্পী কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায় এবং লেখক ও সংগীতজ্ঞ বুদ্ধদেব গুহ।
'নাছোড় ছেলেবেলা'য় আছে চুল কাটা, চিঠি, শীতকাল, রবিবার, এমন সব মামুলি অথচ মধুর স্মৃতির ঝাঁপি। সি পি এম দলের একসময়ের ডাকসাইটে নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের শ্রম মন্ত্রী কৃষ্ণপদ ঘোষ লেখকের আবাসনে থাকতেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর স্নেহ পাওয়ার কথা লেখক মনে রেখেছেন।
'খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না' শীর্ষক অধ্যায়ে লেখকের ছোটবেলার প্রিয় খাবারের কথা সুস্বাদুভাবে পরিবেশিত হয়েছে। 'প্রায় ১৫০ বছর পার' করে টিকে থাকা উত্তর কলকাতার একটি তেলেভাজার দোকানের উল্লেখ করেছেন লেখক। তিনি জানিয়েছেন দোকানটির অবস্থান 'শ্যামবাজারে'। ভোজনরসিকদের জানিয়ে রাখি- হাতিবাগানের কাছে বিধান সরণীর ওপর অবস্থিত তেলেভাজার দোকানটির আদি নাম ছিল লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ এন্ড সন্স। ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দোকানটির এখনও রমরমা। নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর ২৩শে জানুয়ারি বিনিপয়সায় তেলেভাজা বিলোয় এই দোকান। নেতাজি এই দোকানে তেলেভাজা খেতেন। আমার মতো অনেক পাঠকও সে স্বাদের ভাগ পেয়েছেন।
বইটির শেষ অধ্যায়ের নাম 'নোটবই'। নানা স্বাদের লেখা আছে এখানে। চলে যাওয়া একান্ত প্রিয় ভালোবাসার মানুষদের কথা মনে রেখে 'শেষ দু'কথা'য় লেখক এক বড়ো দার্শনিক প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়েছেন - "কোথাও, কখনও, কবে, কোনো তারা ঝরে গেলে, আকাশ কি মনে রাখে?"
সৌমিত্র বসুর আখ্যানে উত্তর কলকাতায় ফেলে আসা দিনগুলির রূপ-রস-গন্ধ লেগে আছে। বহু পাঠক তার অতীতকে খুঁজে পাবেন 'হারানো দিন'-এর পাতায়, এ কথা হলফ করে বলতে পারি।