(“রবীন্দ্রনাথ, তুমি ভাগ্যিস ছিলে!
সময়ের স্লোগানটা তুমি বলে দিলে।”– কবীর সুমন।)
(১) সহজপুর
আজ থেকে কয়েক দশক পরের কথা। সহজপুর জঙ্গলের ধারে এক গ্রাম। সেখানে থাকে কিছু সরল মানুষ। শহরের লোক অবশ্য তাদের বলে ‘ফালতু’। তখন দেশে মানবসম্পদ উপযোগের পদ্ধতি খুব উন্নত। অল্প বয়স থেকেই ছাত্রেরা কীসে কীসে পটু, সেসব উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার করে তাদের ভবিষ্যতের দিকনির্ণয় করে ফেলা হয় আর সেইমতো শিক্ষা ও তালিম দিয়ে তাদের উপযুক্ত বৃত্তিতে নিয়োগ করা হয়। নানা ছাঁকনিতে ছাঁকতে ছাঁকতে যারা শেষ অব্দি পড়ে থাকে, তারাই ‘ফালতু’। থাকে ওয়েটিং লিস্টে, যখন যেখানে যা ছুটখাট কাজ তাতে লাগার জন্য।
সহজপুরের লোকেরা এই গোত্রের। শুধু লোকেরা নয়, সহজপুরটাই আসলে ফালতু। এই গ্রাম বা জঙ্গল এমনিতে দেশের কোনো কাজে লাগে না। তবু তা আছে, তার পাশের বিরাট ঘেরা জায়গায় যে মাইক্রোচিপ কমপ্লেক্স সিকতাগড়, তার প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে। অনতিদূরে সমুদ্র, সেখান থেকে ঝড় এলে জঙ্গল তার অনেকটাই রুখে দেয়। আবার জঙ্গল বাতাসকেও নির্মল রাখে, যা ঐ কারখানার পক্ষে অপরিহার্য।
এককালে পৃথিবী ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমুদ্র। সেখানে প্রাণের উন্নততম ধরন ছিল গাছপালা। তারপর সেই গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে অক্সিজেন তৈরি করে উন্নততর স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উদ্ভবের পথ পরিষ্কার করল। সবশেষে এল মানুষ। কিন্তু সেই মানুষ আবার তার শ্বাসপ্রশ্বাস ও জীবনযাত্রার তাগিদে ধীরে ধীরে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাড়াতে লাগল। কিছু চিন্তাবিদ তাই ভেবেছিলেন ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে যন্ত্রমানবদের, যারা কার্বন-দূষিত বাতাসেও অনায়াসে টিঁকে থাকবে।
কিন্তু সে গুড়ে বালি। আধুনিক সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির প্রাণভোমরা ‘মাইক্রোচিপ’। বলতে গেলে, তারা যাবতীয় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত আধুনিক যন্ত্রের জীবকোষ। আধুনিক উন্নত মাইক্রোচিপের সাইজ একটি চুলের প্রস্থের দশ হাজার ভাগের একভাগেরও কম। তাই এগুলো তৈরি বা ‘ফ্যাব’এর সময় সামান্যতম দূষিত বস্তুকণা থাকলে চলে না। তার জন্য চাই অতিশুদ্ধ জল ও বায়ু। অর্থাৎ দূষণহীন পরিবেশ শুধু মানুষের জন্য নয়, তার সৃষ্ট যন্ত্রমানব সহ যাবতীয় অত্যাধুনিক যন্ত্রের জন্যও অপরিহার্য।
দেশে এমনিতেই জলাভাব। বেহিসেবি ব্যবহারে ভূগর্ভস্থ জলস্তর গেছে নেমে। বিবেচনাহীন বাঁধের ধাক্কায় অনেক নদীই হয়েছে ক্ষীণস্রোতা। নগরায়নের তাগিদে শত শত জলাশয় দেওয়া হয়েছে বুজিয়ে। এমতাবস্থায় সিকতাগড় কারখানার দানবিক জলতৃষ্ণা মেটাতে আশপাশের মানুষের যৎসামান্য জলভাণ্ডারেও পড়ল টান। কারখানার বিশাল পাম্পগুলি শুধু নিজেদের এলাকার থেকে নয়, আশপাশের অঞ্চল থেকেও নির্বিচারে ভূগর্ভস্থ জল টানতে লাগল। ফলে কিছু পুকুর শুকিয়ে গেল, টিউবওয়েলেও জল উঠতে চায় না।
সহজপুরের মানুষেরা পড়ল আতান্তরে। কোনোমতে খানাডোবার জল দিয়ে আর আশপাশের গঞ্জ থেকে চেয়েচিন্তে তারা কাজ চালাতে লাগল। কিন্তু কিছুদিন পর উপগ্রহের ছবি দেখে কিছু পরিবেশবিজ্ঞানী আঁতকে উঠলেন। এমনটা চললে শুধু মানুষ নয়, জঙ্গলের ঢালটাও যে ধ্বংস হবে! তাহলে সিকতাগড়ই বা বাঁচবে কীভাবে?
তাঁদের শোরগোলে সমস্যার কিছুটা সুরাহা হল। কারখানার বর্জ্য জল আর সমুদ্রের নোনা জল পরিশোধন করে গ্রামে আর জঙ্গলে ছাড়ার ব্যবস্থা করা হল। গ্রামবাসীরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
শুধু সিধু ছাড়া। সিধু এক আজব পাবলিক। তার ব্রেন স্ক্যান করে দেখা গেছিল সেটা খুব উন্নত। কিন্তু সে পরীক্ষায় বিস্তর ধোঁকাবাজি করে কম্পিউটার পরীক্ষককে ফাঁকি দিয়ে ফেল করে সহজপুরেই ফালতু হয়ে রয়ে গেছে। গ্রাম ছেড়ে দেশবিদেশে গিয়ে খ্যাতি ও অর্থ অর্জনের এই সুবর্ণসুযোগ স্বেচ্ছায় ছেড়ে আসার জন্য গ্রামের লোক তাকে আকাট বলে।
আসলে এই গ্রামের সরল জীবনযাত্রা, জঙ্গল, নদী সিধুর ভালো লাগে। তাছাড়াও একটা কারণ আছে – বিজলি। সেটা পরে আসছে।
সিধুর জ্ঞানের তৃষ্ণা সীমাহীন। একটা গোল থ্রি-ডি মুঠোযন্ত্রে সে নিয়মিত বহির্বিশ্বের খবর রাখে। আকাট বললেও গাঁয়ের লোক তাই ঠেকায় জোকায় সিধুর বুদ্ধি-পরামর্শ নেয়। সিধু গাঁয়ের লোকেদের ডেকে বলল, কোম্পানির জল শোধনের বাজেট সীমিত। তাই তাদের দেওয়া জলে নানা স্বাস্থ্যহানিকর বস্তুকণা থাকে। আপাতত চললেও বেশিদিন এই জল ব্যবহার করা বিপজ্জনক। তাই সহজপুরিদের নিজেদেরই কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। শুনে কেউ মানল, কেউ মানল না।
সিধু সেসবে ভ্রুক্ষেপ না করে যে ক'জনকে সঙ্গে পেল, তার ওপর মুঠোযন্ত্রে যোগাযোগ করে বাইরের কিছু পরিবেশকর্মীদের এনে তার কাজ শুরু করল। বছরখানেকের মধ্যে সে সঙ্গোপনে তৈরি করল কিছু ভূগর্ভস্থ জলাধার, যাতে বৃষ্টির জল জমা হবে। বিশেষ এক ধরনের মাটির সঙ্গে চিনেমাটি গোছের এক বস্তু মিশিয়ে তৈরি তার লাইনিং ভেদ করে বাইরের কোনো পাম্প জল টানতে পারবে না।
সিধুর দুই বন্ধু সুমেধ আর বসন্ত অবশ্য এই গ্রাম থেকে বুদ্ধির পরীক্ষায় উতরে দূর পাঠস্থলীতে গিয়েছিল লেখাপড়া ও ট্রেনিংয়ের জন্য। সেখান থেকে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়ে তারা আবার ফিরে এসেছে এই সিকতাগড়ে, গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব নিয়ে। সহজপুরে আসার ফুরসত অবশ্য তাদের বিশেষ মেলে না। তবে শোনা যায়, সিধুর সঙ্গে তাদের বৈদ্যুতিন যোগাযোগ আছে।
গ্রামের আর এক যুবক বংশী সিধুর খুব বন্ধু। সেও সিধুর মতো আকাট। ব্রেন স্ক্যানে দেখা গিয়েছিল তার যন্ত্রসঙ্গীতে খুব দক্ষতা। তাই তাকে নির্বাচনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গানবাজনা, ছায়াছবি, নাটক প্রভৃতি বিনোদন মাধ্যম বিকাশের কেন্দ্র আনন্দনগরে। কিন্তু সেখানে সে সব পরীক্ষায় ফেল হওয়ায় বিচারকরা তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে কিছু ট্রেনিং প্রোগ্রামের লিঙ্ক দিয়েছেন, যার থেকে শিখে সে ভবিষ্যতে পাশ করতে পারবে বলে তাঁদের আশা।
“চালাকি ছেড়ে এবার পরীক্ষাটা ঠিকমতো দে।” বলেছিল সিধু, “তোর যা প্রতিভা, আনন্দনগরে গিয়ে যন্ত্রসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়ে তুই হয়তো সেরাদের একজন হয়ে ওখানে থাকতে পারবি।”
“আমার বয়ে গেছে!” বংশী বলেছিল, “বিদেশিরা আমাদের কৌটোর খাবার ধরিয়ে দিয়ে গেছে। আনন্দনগর থেকে এখন আনন্দও কৌটোয় পুরে বিলি হচ্ছে। কৌটোর জিনিস কি কখনো স্বাদে, গন্ধে, বর্ণে আসলের মতো হয়?”
“কিন্তু ওখানে তো গুণী শিল্পীদের অজস্র সৃষ্টিকে এ-আই দিয়ে সিনথেসাইজড করে তারপর ঝাড়াইবাছাই করে মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়। সবশেষে, পাবলিকের ফীডব্যাক অনুযায়ী তাকে আবার পরিশীলিত করা হয়। মানুষের যা ভালো লাগে, উন্নত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ওরা তো সেটাই সৃষ্টি করছে।”
“তুই পাঠস্থলীতে গেলি না কেন?”
“কেন?” সিধু মাথা চুলকে বলেছিল, “এই নদী, পাহাড়, বন –”
“হ্যাঁ, এই নদী, পাহাড়, বন। ঐ কৌটোর বাজনা আমি তাদের শুনিয়েছি। তারা কেউ সাড়া দেয় না।”
সিধু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বলেছিল, “তুই পারবি তাদের সাড়া জাগাতে?”
“চেষ্টা তো করব।” বংশীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল, “আসলে, যেমন কৌটোর খাবার খেতে খেতে মানুষ ভুলে গেছে টাটকা শাকসব্জি, ফলের স্বাদ, তেমন বহুদিন কৌটোর গানবাজনা শুনতে শুনতে তারা ভুলে গেছে প্রকৃতি তার নিজের সুরে গান গায়। সেসব মাটিতে কান পেতে শুনতে হয়।”
সিধু উদাস হয়ে বলেছিল, “পারবি কি? এখন বাদ্যযন্ত্র বলতে তো সেই ওমনি সিনথেসাইজার, যা দিয়ে অতীতের সব যন্ত্রের সুর বাজানো যায়। ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রগুলি তো মানুষ অপ্রয়োজনীয় বোধে ত্যাগ করেছে।”
“না।” বংশী রহস্যময় হাসি হেসে বলেছিল, “আমার কাছে আছে বংশ পরম্পরায় পাওয়া দুটো জিনিস। কেউ দেখলে ফেলে দেবে বলে লুকিয়ে রেখেছি।”
“আমাকেও দেখাবি না?”
“সময় হলে ঠিক দেখাব।”
সহজপুরের শেষ চরিত্র সিধুর এককালের বন্ধু্নি বিজলি। সে এখন সৃষ্টিকুঞ্জে – আগেকার দিনে হলে বলা যেত, পাচার হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা হয় না।
ইচ্ছে জিনিসটা অবশ্য জটিল আর স্তরবিন্যস্ত।
দেশের অন্যতম প্রধান সিলিকন ভ্যালি সিকতাগড় যেন দেশের মধ্যে কেটে বসানো একখণ্ড বিদেশ। তাতে সুমেধ ও বসন্তর মতো মেধাবী যুবকরা আছে বটে, কিন্তু সমস্ত কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশিরা। আর কতগুলো ‘ক্রিটিকাল অ্যাকটিভিটি’তে তারা দেশিদের কাছেই ঘেঁষতে দেয় না। কারখানায় সংশ্লিষ্ট লোকজন সবাই সিকতাগড়েই থাকে। চব্বিশ ঘণ্টার যখন তখন ডাক পড়তে পারে, তাই কর্মীদের বাইরে থাকার সুযোগ নেই।
কী হয় এই কমপ্লেক্সে তৈরি মাইক্রোচিপ দিয়ে? এর অধিকাংশই কেনে পৃথিবীর বিভিন্ন অত্যুন্নত দেশ, অল্প অংশ পড়ে থাকে এদেশের জন্য। বলা হয় কম্পিউটার, মুঠোযন্ত্র, মোটর-এরোপ্লেন, গৃহস্থালির গ্যাজেট আরও অজস্র জিনিস এই মাইক্রোচিপের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু এহ বাহ্য! সব কাজের জন্য অত্যুন্নত মাইক্রোচিপ লাগে না, অপেক্ষাকৃত নিরেস জিনিস দিয়েই চলে যায়। তবে উন্নত চিপ তৈরি হওয়ার পর প্রথম দু-এক বছর পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত কম্পিউটার, মুঠোযন্ত্র প্রভৃতিতে লাগানো হয়। তারপর ফীডব্যাকের মাধ্যমে স্থিতিশীল হলে সেগুলি চলে যায় তার মূল খদ্দের অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীর কাছে। তারা সেসব দিয়ে আরও, আরও উন্নত মারণাস্ত্র তৈরি করে। যার যত উন্নত মারণাস্ত্র, সে তত সভ্য। পৃথিবীর আনাচে কানাচে টিঁকে থাকা জনজাতিরা অসভ্য, কারণ তাদের সম্বল বড়জোর বিষতির।
আধুনিক যুদ্ধ কীভাবে হয়? আসলে উন্নত দেশগুলির হাতে যেসব মারণাস্ত্র, তা দিয়ে তারা প্রত্যেকে পৃথিবীকে অজস্রবার ধ্বংস করতে পারে। ওসব নিয়ে যুদ্ধ অবান্তর। তাই শক্তিধরেরা নিজেদের মধ্যে গরম নয়, ঠান্ডা যুদ্ধ করে। কিন্তু আসল যুদ্ধ একদম না হলে অস্ত্রশস্ত্রের কার্যকারিতার পরীক্ষাই বা হয় কীভাবে? তাই তারা বিভিন্ন প্রতিবেশী দেশকে অথবা একই দেশের দুই গোষ্ঠীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কে দেয়, তারপর এক একজনকে বেছে নিয়ে তোল্লাই দেয়। সেসব ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে অবশ্য দু-এক জেনারেশন আগের বিমান, বোমা, মিসাইল, বিস্ফোরক ব্যবহার হয়।
তবে সিকতাগড়ের মাইক্রোচিপ সব উন্নত দেশই কেনে। তাই তার ওপর বোমা পড়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সিকতাগড় সংলগ্ন সহজপুরও তাই নিশ্চিন্ত।
মাইক্রোচিপ তৈরির পদ্ধতি কতগুলো ভাগে বিভক্ত। প্রথমে কোনো নির্দিষ্ট ব্যবহারের জন্য চিপ ডিজাইন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা এই ডিজাইনের কাজ করেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা ‘এ-আই’র সাহায্য নিয়ে। এরপর ডিজাইনে কোনো ফাঁকফোকর রয়েছে কিনা, সেটা দেখা হয় ‘ভেরিফিকেশন’ পর্বে। সেখান থেকে পাস করলে এবার অন্যতম ক্রিটিকাল স্তর ‘ফ্যাব্রিকেশন’ বা ‘ফ্যাব’, যেখানে লিথোগ্রাফিক মেশিনের সাহায্যে লেজার বিম দিয়ে ঐ অতিসূক্ষ্ণ ডিজাইন সিলিকন কণায় খোদাই করা হয়। সিকতাগড়ে ফ্যাবের কাজে বিদেশিরা সাধারণত দেশিদের ঢুকতে দেয় না। এক একটা ব্যাচ তৈরি হতে লাগে বারো থেকে চব্বিশ ঘণ্টা। ঐ সময়টায় ওখানে কর্মীদের ঢোকা বা বেরোনো বন্ধ। কেউ হেঁচে বা কেশে ফেললেও ব্যাচ পণ্ড। কাজেই ঝাড়াই বাছাই করে অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ কিছু মানুষকেই ফ্যাবের কাজে নিযুক্ত করা হয়।
ইন্টারনেটে ছড়ানো বিশাল তথ্যভাণ্ডার মন্থন করেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এ-আইয়ের মানবিক হবার অভিযান। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে শক্তিমান দেশগুলি সামরিক কাজে এ-আইয়ের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এই তথ্যের মহাসমুদ্রকে নিজ নিজ ইলেকট্রনিক চিপের কৌটোয় বন্দি করার এক বেয়াড়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোটি কোটি অতিসূক্ষ্ম মাইক্রোচিপের সমন্বয়ে তৈরি এইসব দানবিক এ-আই চিপ তৈরি করতে বা চালাতে বিপুল পরিমাণ রসদ দরকার। তার চাপে মাইক্রোচিপের অন্যান্য উপযোগের নাভিশ্বাস উঠতে দেখে অবশেষে দেশগুলির আক্কেল ফিরল। বোঝাপড়া করে ডেটা শেয়ারিংয়ের ব্যাপারে একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করা হল।
সিকতাগড়ে তৈরি হয় যন্ত্রসভ্যতার প্রাণভোমরা মাইক্রোচিপ। কিন্তু সৃষ্টিকুঞ্জে উৎপন্ন পদার্থ (অন্তত এখন অবধি) তার চেয়েও মহার্ঘ – মানুষ।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে মানুষ উৎপাদন উদ্বেগজনকভাবে কমে গেছে। কর্মসূত্রে জটিল চিন্তায় নিমগ্ন নরনারীর মিলনেচ্ছা বা লিবিডো কমে যাওয়া এর একটি কারণ। কিন্তু মুখ্য কারণ, নারীদের সন্তানধারণে অনীহা। উন্নত দেশের এক খ্যাতনামা নেত্রী বলেছিলেন – মেয়েরা পেশাগত উন্নতির শীর্ষে পৌঁছোবার লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়ে বিয়ে করার জন্য নয়, মা হবার জন্য। উন্নত দেশের মেয়েরা আজ পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে রাজি নয়। তাই নানা উৎসাহ দিয়েও তাদের এক বড় অংশকে সন্তানধারণে সম্মত করা যাচ্ছে না। ফলে জনসংখ্যা কমছে। তাতে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি নানা সঙ্কটে পড়ছে।
কিছু উন্নত দেশ অভিবাসন মারফত এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছে। কিন্তু সংস্কৃতি ও ভাষার সমস্যার জন্য অন্য অনেক দেশ সেটা পারছে না। তারা যা করছে তাকে সংক্ষেপে বলা যায়, ‘গেস্টেশনাল সারোগেসি'র মারফত প্রজনন ব্যবস্থা ‘আউটসোর্স’ করা। এই ব্যবস্থায় পুরুষের শুক্রাণু আর নারীর ডিম্বাণুর মিলন ‘টেস্ট টিউব'এ ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’ মারফত সংঘটিত হয়। তারপর তাকে গর্ভধারণে সম্মত কোনো নারীর জননেন্দ্রিয়ে স্থাপন করা হয়। প্রথম প্রথম এই ব্যবস্থায় সন্তানধারণে নানা সমস্যা দেখা যেত। উন্নত গবেষণা মারফত এখন এই পদ্ধতির সফলতা প্রায় শতকরা একশোভাগ। এই পদ্ধতিতে যে সন্তান জন্ম নেয় তার সঙ্গে সারোগেট মা'র কোনো জেনেটিক সম্পর্ক থাকে না।
প্রায় অবধারিতভাবেই এখন এই ব্যবস্থায় কোনো উন্নত দেশের মা-বাবার সন্তান গর্ভে ধারণ করে কোনো উন্নয়নশীল দেশের মেয়ে। সেই উদ্দেশ্যেই এই মানুষ তৈরির কারখানা সৃষ্টিকুঞ্জ। বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা মারফত বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই কাজের জন্য যুবতী মেয়েদের বাছা হয়। কাউকে অবশ্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে মা হওয়ানো যায় না। কিন্তু সেই মেয়ে ও তার পরিবারকে যে পরিমাণে অর্থ ও স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তাতে অন্তত পরিবারের চাপে অধিকাংশ নির্বাচিত মেয়ে সারোগেসিতে রাজি হয়ে যায়।
সৃষ্টিকুঞ্জের এমন হাজার হাজার হবু সারোগেট মা'র একজন সহজপুরের বিজলি। সে এখন সন্তানপ্রসবের অপেক্ষায়। তারপর সন্তানকে বুকের দুধ দিয়ে বড় করে একটা সময়ে সম্পূর্ণ অধিকার ছেড়ে তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তার জেনেটিক মা-বাবার কাছে। এই সারোগেট মা'দের মানসিকতা নিয়ে আজকাল অনেক গল্প, উপন্যাস লেখা হচ্ছে আর সেগুলো বাজারে দারুণ কাটছে।
সিধু আর বিজলির পরস্পরের প্রতি এক মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা পরিণতির দিকে এগোবার আগেই বিজলি নির্বাচিত হয়ে গেল সৃষ্টিকঞ্জের জন্য। অবশ্য তাকে কেউ জোর করেনি। কিন্তু অভাবী মা, বাবা, বোনের কথা ভেবে আর সিধুর মতো আকাট চিহ্নিত হবার ভয়ে সে দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে সৃষ্টিকুঞ্জে চলে এসেছিল। ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেলেই যে ফিরে আসবে এমন গ্যারান্টি নেই। ডাক্তাররা তার শরীর উপযুক্ত মনে করলে সে ওখানেই স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে থেকে যাবে। তারপর আবার একদিন হয়তো অন্য কারো সন্তান ধারণ করবে।
সিধুকে অবশ্য সে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, “দেখিস, আমি ঠিক সহজপুরে ফিরে আসব।”
সিধুও সেই আশায় সহজপুরের মাটি কামড়ে পড়ে আছে।
বসন্ত সহজপুরে ফিরে এসেছে। খবরটা পেয়ে সিধু খুব খুশি আবার বিস্মিত। দামি চাকরি আর শহরের প্রাচুর্য ছেড়ে কেউ তো বড় একটা গ্রামে পা দেয় না! কিন্তু বসন্তের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তার বুক ভেঙে গেল। সেই টগবগে, প্রাণোচ্ছল যুবকটি আর নেই। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ক্লান্ত, তিরিশেই ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। কোম্পানি পরিভাষায় নাকি একে বলে ‘বার্ন আউট’, যার কারণ হচ্ছে মাসের পর মাস দিনরাত এক করে প্রচণ্ড চাপে কাজ করা।
সিধুকে দেখে বসন্ত হাসল। কিন্তু সে হাসিতে উত্তাপ নেই। কিছুক্ষণ কথা বলে সিধু বুঝল, বসন্ত কোনো কাজেই আর উৎসাহ পায় না। কিছু করতে গেলে কিছুক্ষণ পর খেই হারিয়ে ফেলে।
বরাবরই অল্প কিছু কর্মীর এই দশা হয়। কিন্তু সুমেধের কাছ থেকে সিধু জেনেছে, সম্প্রতি হয়তো কোথাও যুদ্ধটুদ্ধ হবে দেখে কাজের চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ফলে ‘বার্ন আউট'ও ভীষণ বেড়েছে। কর্তৃপক্ষ অসুস্থদের শহরের এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেখে যোগ্য চিকিৎসক ও মনোবিদদের সাহায্যে আবার সুস্থ করবার অর্থাৎ কাজে উৎসাহী করে তুলবার চেষ্টা করছে।
এই সুব্যবস্থা ছেড়ে বসন্ত ‘ফালতু’দের সহজপুরে এসেছে সুমেধের পরামর্শে। সুমেধ বলেছে, “যা, চেনাজানা সবার সঙ্গে থাকলে তোর ভালো লাগবে। আর সিধু, বংশী তো আছেই, তাদের সঙ্গে কথা বললে দেখবি মন হালকা হয়ে যাবে।”
কিছুটা হয়তো হল, কিন্তু পুরোপুরি নয়। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে বসন্ত কিছুক্ষণ খুশিতেই কাটায় কিন্তু সেই খুশি তার প্রাণের ভেতরটা ছোঁয় না। বোঝা যায়, একটু পরেই সে তার ফেলে আসা পেশার কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছে অথচ কাজের গভীরে ঢোকার মতো মনের জোর ফিরে পাচ্ছে না। এই দোলাচল তার মধ্যে এক অস্থিরতা তৈরি করছে।
“কিছুদিন কাজের কথা ভুলে যা।” বংশী বলল, “তোর কোনো ‘হবি’ নেই? লেখা, পড়া, গান করা বা শোনা?”
“ছিল তো। কিন্তু সেসব কবে ছেড়ে দিয়েছি, ভুলে গেছি। অভ্যাসগুলি ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে।” সলজ্জ হেসে বলল বসন্ত, “কিন্তু তোরা এত উতলা হচ্ছিস কেন? আমি ঠিকই আছি। একটু ক্লান্ত লাগছে। আসলে ওখানে তো ভীষণ চাপ। আমার আর ভালো লাগে না। দেখি, না পারলে অন্য কিছু করার উপায় খুঁজতে হবে।”
বংশী আর সিধু পরামর্শ করে চলেছে। বসন্ত তাদের বন্ধু। শুধু তাই নয়, সে এক বিরাট প্রতিভা। তাকে এভাবে ফুরিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।
দুই বন্ধু মিলে বসন্তকে জঙ্গলে নিয়ে গেল। এক ঝরনার পাশে বসে গল্প করল। হাসিগানে বন্ধুর মন ভরানোর চেষ্টা করল। তাতে কিছুটা কাজ হল। বসন্তকে কিছুটা চনমনে দেখাল। সিধু বলল, “এই ব্যাটা, তুই তো ভালো গান গাইতিস। ছাড় না একখান।”
বসন্তকে উদাস দেখাল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “না রে, হবে না। কাজের জাঁতাকলে পিষে সব গেছে, গলায় আর সুর খেলে না। চল, বাড়ি যাব। টায়ার্ড লাগছে।”
সিধু, বংশী এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে তারপর ফিরে চলল। পরদিন তারা আবার বসন্তকে নিয়ে এল। বংশীর হাতে ‘ওমনি সিন্থেসাইজার’। সে একের পর এক সুর বাজাতে লাগল। বসন্ত কখনো চনমনে আবার কখনো নিস্পৃহ। সিধু ফিসফিসিয়ে বংশীকে বলল, “চালিয়ে যা, ওষুধ কিছুটা ধরেছে।”
বংশী মাথা নাড়ল, “না, রে। এবার আমার গোপন অস্ত্র বের করতে হবে।”
নিশুতি রাত। নদীর ধারে বসে তিন বন্ধু সিধু, বংশী আর বসন্ত। নদী কুলুকুলু বইছে। গাছের ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাস শনশন আওয়াজ তুলছে। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে জেগে উঠছে নিশাচরদের ডাক। শহরের মানুষের এই পরিবেশে গা ছমছমিয়ে উঠত। কিন্তু এই গ্রাম্য যুবকরা এলাকাকে হাতের তালুর মতো চেনে। তারা নির্ভয়ে বসে আছে। এমনকি বসন্তকেও মনে হচ্ছে পরিবেশের ছোঁয়ায় উদাস।
বংশী সন্তর্পণে তার কাঁধের ঝোলা থেকে একটা লম্বামতন জিনিস বের করল।
“বাঁ-শি?” অবাক বসন্ত বলল।
“চিনেছিস!” বংশী খুশি হয়ে বলল, “বাঁশিই, তবে একটু অন্য ডিজাইনের। এটা আমার দাদু নিজের হাতে বানিয়েছিল। শুনলেই বুঝতে পারবি, এর আওয়াজ কত সমৃদ্ধ আর মনকাড়া। দাদু বলত, মোহন বাঁশি।”
“মানে, যা বাজিয়ে যুবকরা যুবতীদের আকৃষ্ট করত?” বলল সিধু।
“সঙ্কীর্ণ অর্থে, তাই। কিন্তু সাধারণভাবে, এই বাঁশি ছেলেবুড়ো, নরনারী সবাইকেই টানে। তাদের মনের ভেতরটা ছুঁয়ে, ভিজিয়ে, ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।”
“তাহলে আর দেরি কেন, শুরু কর।” সিধু বলল।
“তবে শুধু বাঁশিতেই তো হবে না, বাঁশুরিয়াকেও হতে হবে যাদুকর। আমি –”
“নে নে, আর বিনয় করতে হবে না।” অধৈর্য বসন্ত বলল, “তুই এখানে লুকিয়ে থাকলেও তোর নাম সিকতাগড় অব্দি পৌঁছেছে। তুই না পারলে কে পারবে ঐ বাঁশিতে যাদু আনতে?”
দ্বিধা কাটিয়ে বংশী ফুঁ দিল। আর এক অলৌকিক মূর্ছনা কাঁপতে কাঁপতে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। বংশী বাজাতে লাগল এক খুশির সুর। সিধু আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, বসন্তর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। সিধুর ইশারায় বংশী ধীরে ধীরে লয় বাড়িয়ে দিল। দুই বন্ধু তার তালে তালি দিতে লাগল। তারপর শরীর দুলিয়ে নাচতে লাগল।
বংশী বাজিয়ে চলল। তার ইশারায় সবাই পা ডোবাল নদীর জলে, কান পাতল মাটির বুকে, ছুটতে লাগল জংলা পথ ধরে। কতক্ষণ পর কে জানে, বাঁশি থামল আর সিধু ও বসন্ত বংশীকে জড়িয়ে ধরল।
“টের পেয়েছিস – নদী, মাটি, জঙ্গল আমার বাঁশিতে সাড়া দিয়েছে?” রুদ্ধশ্বাস বংশী বলল।
সিধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল, তারপর চোখের ইশারায় বসন্তকে দেখিয়ে দিল। এতক্ষণে বংশীর খেয়াল হল, “বসন্ত!”
“জানিস, আমার মনটা কেমন হালকা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমি হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। যেন আবার সবকিছু করতে পারি।”
“বসন্ত, তুই ভালো হয়ে গেছিস!” বংশী বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “নাচছিস, তাল দিচ্ছিস, ছুটছিস, এবার তুই কিছুদিনের মধ্যেই সিকতাপুরে ফিরে কাজে জয়েন করতে পারবি।”
“কে আর ঐ গোয়ালে ঢুকছে!” বসন্ত ফুটতে ফুটতে বলল, “আমি অন্য কোথাও ঠিক কিছু জুটিয়ে নেব। কিন্তু তা নয়, বংশী। ভাবছি, এমন একটা জিনিস শুধু সহজপুরেই লুকিয়ে থাকবে? সিকতাগড়ে তো আমার মতো আরো কত ‘বার্ন আউট'এর রোগী আছে। এই বাঁশি কি তাদেরও সুস্থ হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে না?”
“বলা শক্ত। কে জানে, সিকতাগড়ের পরিবেশে এই বাঁশির সুরে কোনো কাজ হবে কিনা। তবে চেষ্টা তো করাই যেতে পারে। আমরা বংশীর বাজনা রেকর্ড করে সুমেধের কাছে পাঠিয়ে দেব।” বলল সিধু।
“ঠিক। তবে, শুধু বাঁশি না হয়ে সঙ্গে গানও থাকলে ভালো জমত।” বংশী বলল, “সিধু, তুই চটপট একটা গান লিখে ফেল না। আমি তাতে একটা সহজ সুর বসাচ্ছি। তারপর বসন্ত গাইবে আর আমি বাঁশিতে সঙ্গত করব।”
ততক্ষণে পুব আকাশে ঊষারানি উঁকি মারছেন। সিধু একমনে বসে আধঘণ্টার মধ্যেই তার মুঠোযন্ত্রে লিখে ফেলল:
“নরম আলোর মেঘ দিগন্তরেখায়।
সোনালী ভোর নামে রূপকথার এই গাঁয়।
কার বাঁশিতে উচাটন এই প্রাণ?
আকাশে ছড়ালো লালচে আবির, রাত হল অবসান –
শোনো সূর্যোদয়ের গান।
বাঁশি, চল গা ভাসাই মিঠে রোদ্দুরে।
এ শহর, ও বন্দর, আরো কদ্দুরে।
তোল রে নিঝুমপুরে সুরের কলতান।
আকাশে ছড়ালো লালচে আবির রাত হল অবসান –
শোনো ঘুম ভাঙানোর গান।
দূরে কোন জানালায় আশাহীন মেয়ে,
বাঁশি তার হবে কি স্বপনের নেয়ে?
নিষেধের বেড়ি কি হবে খানখান?
আকাশে ছড়ালো লালচে আবির, রাত হল অবসান –
শোনো নতুন দিনের গান।”
“কেমন হয়েছে, রে?” সে মুঠোযন্ত্রটা বন্ধুদের দিকে এগিয়ে ধরল।
“সিধু, তুই এখনো বিজলিকে –” বসন্ত ওর কাঁধে হাত রাখল।
“ছাড় তো! বল, চলবে? খুব সহজ ভাষায় লিখেছি, কিছু পুরোনো শব্দও ঢুকে গেছে।”
“ফাটাফাটি হয়েছে! আয় বসন্ত, আমরা মিলে গানটা রেকর্ড করে ফেলি। তারপর সুমেধকে পাঠিয়ে দেব।”
ঘণ্টাখানেক কসরতের পর আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করে তিন বন্ধু বিজয়গর্বে বাড়ির পথ ধরল।
“গানটা কেমন চলছে? কী বলব, সিধু – এই গানের ধাক্কায় যা ঘটছে, আদ্যিকালের ভাষায় বললে, কাশিতে ভূমিকম্প! তোদের ঐ মিউজিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট – মোহন বাঁশি, তাই তো? – ওতে যাদু আছে। সঙ্গের যাদুকরী সুর, কথা ও বসন্তের গলার আবেগ – সব মিলিয়ে এ এক অচেনা স্বাদের জিনিস, যাতে রয়েছে জংলা ফুলের গন্ধ আর নদীর কুলুকুলু। পাবলিক পাগলা হয়ে যাচ্ছে। অরিজিনাল লিরিকটা অবশ্য সবাই বুঝছে না। তবে তোরা তো অটোমেটিক ট্রান্সক্রিপশন দিয়ে রেখেছিস। মোদ্দা কথা, সিকতাগড় এখন তোদের বাঁশির তালে নাচছে। প্রথমে ক'জন শুনে নাচছে, তাদের দেখে আগ্রহী হয়ে আরো ক'জন, এভাবে ঢেউয়ের মতো পরিধি বাড়াতে বাড়াতে ছড়িয়ে পড়ছে গানটা। যে একবার শুনছে, তার না নেচে উপায় নেই। দেশি নাচছে, বিদেশি নাচছে, এমনকি রোবটও নাচছে।”
“রোবটও?”
“ঐ আর কী! তা, ওরা বলছিল এই নাচানাচিতে সিকতাগড়ে কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে, ‘ফ্যাব'এর লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা নাকি ভেঙে পড়তে চলেছে। খবর পেয়ে কিছু বিদেশি কর্তা ছুটে এসেছিল। তাদের তর্জনির সামনে কে যেন তোদের গানটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। শুনে তারা মাথাটাথা চুলকে বলল, ‘তোমাদের পয়েন্টটা বুঝতে পারছি। মিউজিকটা সত্যিই ভীষণ সিডাক্টিভ। তবে তোমাদের কাজটাও তো খুব ক্রিটিকাল, ক্ষতি হলেই সর্বনাশ।’
‘কোথায় ক্ষতি হচ্ছে? তবে যত টাকাই দাও, আমরা এমন টুয়েন্টি ফোর বাই সেভেনের জাঁতাকলে পিষে মরতে পারব না। জানো, অমানুষিক চাপে কতজনের বার্ন-আউট হয়ে গেছে? আমরা কি ইউজ অ্যান্ড থ্রো? আমাদেরও ব্রেক চাই, ছুটি চাই। নাচবার, গাইবার, বেড়াবার অবকাশ চাই।’
‘সেসব হবে, আমাদের একটু আলোচনা করার সময় দাও। আর হ্যাঁ – ভিডিওটা ফরোয়ার্ড করে দিও।’ বোধহয় বাড়ি ফিরে নাচবে।
তবেই দ্যাখ, তোদের একটা গান কেমন গোটা সিকতাগড়ের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে।”
“সে কী! কোনোমতে একটা যা-তা ভিডিও করে পাঠালাম, তাতেই এই? এবার তাহলে একটু ভেবেচিন্তে –“
“ঐ কেলোটা করিস না! ওটা ঐ কৌটোবন্দি হবার ট্র্যাপ। বনেবাদাড়ে ঘুরতে ঘুরতে যেসব হাবিজাবি মাথায় আসবে, সেগুলোকেই কথায় আর সুরে গেঁথে পাঠিয়ে দিস। এটাই এখন সময়ের দাবি।
আর শোন, আনন্দনগর থেকে লোক এসেছিল। খুঁজেপেতে ঠিক আমায় ধরেছে। বলল, এসব দারুণ প্রতিভা অ্যাদ্দিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? ঠিকানা দাও, ওদের বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করব।“
“দিসনি তো?”
“পাগল! বলেছি, নো চান্স। তুমি তাহলে তাদের ধরে তোমার খাঁচায় পুরবে। খাঁচার পাখির গলায় কি বনের পাখির জোশ আসে?”
বাঁশির সুর শুধু সিকতাগড়ে নয়, সৃষ্টিকুঞ্জেও পৌঁছেছে। সিধু একদিন বিজলির মেসেজ পেল, “কিছুদিনের মধ্যেই আমি মা হব। ছোটটাকে বুকের দুধ দিয়ে বড় করতে তো কিছু সময় লাগবে। তারপর তাকে তার মা-বাবার কাছে সঁপে দিয়ে আমি তোমার কাছে ফিরে আসব। ঐ ‘মোহন বাঁশি’ কাদের কীর্তি, আমি ধরে ফেলেছি। তোমাদের সঙ্গে আমিও জলেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াব আর নাচব, গাইব।
চিন্তা কোরো না, ডাক্তার বলেছে আমি অন্তত আরো দু'বার মা হতে পারব।”
সিধু তাই আশায় আছে।
“তাহলে কেসটা কী দাঁড়াল?”
“স্রেফ তোকে সুস্থ করে তুলব বলে বাঁশিটা বের করেছিলাম। তারপর তোর কথায় সিকতাগড়ের ফুরোনো মানুষদেরও আবার স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টায় বাঁশির সুরকে কথার সঙ্গে জুড়ে সেখানে পাঠালাম। কিন্তু তাতে যে এমন তোলপাড় হবে, কে জানত!”
“আসলে তোর খাপছাড়া বাঁশির সুর ঐ ‘প্রসেস’এর জোয়ালে বাঁধা মানুষগুলোকে অন্তত ‘ধুত্তোর!’ বলার স্পর্ধা জুগিয়েছে।”
“এবার?”
“এবার ওরাই ঠিক করবে এই স্পর্ধাটাকে চওড়া করবে, নাকি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার যে যার কুঠুরিতে ফিরে যাবে।
কিন্তু বংশী, তুই না বলেছিলি আরো একটা বাজনা তোর কাছে লুকোনো আছে?”
বংশী লাজুক হেসে বলল, “হ্যাঁ, বিউগল। সময় এলে তাও বের করব।”
“বি-উগল? সেটা দিয়ে কী হয়?”
“লড়াইয়ের ডাক দেওয়া হয়।”
“ল-ড়াই? কীসের লড়াই?” বসন্ত ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল।
“মানুষের রোবট না হবার লড়াই।” বলল সিধু, “যে লড়াই আদ্যিকাল থেকেই চলে আসছে।”