১
গাছটার বৈজ্ঞানিক নাম টাবেবুইয়া রোসিয়া। চলতি কথায় রোজ় ট্রাম্পেট বা পিঙ্ক পোই। উত্তর থেকে দক্ষিণে সমুদ্রের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় নিরত এই শহরতলির পূর্ব দিকের হাইওয়ের প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার অংশের দুধারে এই ফুল গাছের সারি। শুধু হাইওয়ে না, দু-পাশের সার্ভিস রোডের ধার বরাবরও।
ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই ফুলের মরশুম। তখন এই পথ দিয়ে যেতে যেতে অতি বড় বেরসিকেরও মনে হয় জাপানের চেরি-মরশুমের পুষ্পশোভা এই দেশে কোথা থেকে এল! রাস্তার দুপাশে যতদূর চোখ যায়, দেখা যায় হাল্কা গোলাপি রঙের ফুলে গাছ ছেয়ে আছে।
তারপর মার্চ আসে। দিনের তাপমাত্রা একটু একটু করে বাড়তে থাকে। ভ্যাপসা ভাবও। অফিস-ফেরতা সুদীপ লক্ষ্য করে গাড়ির শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণকে কলা দেখিয়ে জামার নিচে গেঞ্জিটি একটু একটু পিঠে সেঁটে যাচ্ছে। গরম পড়ছে। রোজ় ট্রাম্পেটের ঝরে পড়ার সময়।
মারও খুব প্রিয় এই পথটুকু। আজকে যেতে যেতে দুপাশের গাছগুলি দেখতে দেখতে সুদীপের হঠাৎ মনে পড়ে গেল। সেই কবে এক রবিবারের সকালে মাকে নিয়ে বেরিয়েছিল সে, দাদারের বিখ্যাত গণেশ মন্দিরটি দর্শন করিয়ে আনবে। মা তার আগের রাত্রে খাবার টেবিলে বসে আস্তে আস্তে বলেছিল, কতদিন যাই না, গেলে হয় একবার, কিন্তু হাঁটতে কি আর পারবো অত?
পরের দিন সকালে মাকে বলাতে একটু অবাক হল, খুশিও। তৈরি হয়ে নিল চটপট। সুতপা সাহায্য করেছিল শাড়িটা পরিয়ে দিতে। কিন্তু সে নিজে মন্দিরে বড় একটা যায় না, মা আর ছেলেতে বেরিয়ে পড়েছিল তারা। রাস্তায় কী মনে হতে ড্রাইভার সচিনকে বলেছিল হাইওয়ে ধরে নিতে। গাড়ি জায়গামত পৌঁছতেই মার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিল, মা দেখো, কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে!
মা দেখেছিল, কোনো মন্তব্য করেনি। বাইরে বেরনোর পুরো সময়টাকে যেন আত্মস্থ করছিল মনে মনে। মন্দির দর্শন সেরে ফেরার সময় শুধু বলেছিল, যে রাস্তা দিয়ে এলাম সেদিক দিয়েই যাবি তো? সুদীপ জানত মার ভাবগতিক, মুচকি হেসে সচিনকে বলল একই রাস্তা নিতে। ঘাটকোপার পার হতেই মাকে বলল, মা, সেই ফুলের রাস্তা আসছে। মা নিজের মোবাইলে ক্যামেরা বাগিয়ে তৈরি হয়ে থাকল। যদিও সেসব ছবি খুব একটা ভাল না হওয়ায় সুদীপকে বলল কয়েকটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিতে। ছবি দিয়ে কী হবে জিজ্ঞেস করাতে চোখ কপালে তুলে বলল, কেন! আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই বুঝি। সে তো অবশ্যই আছে, নাতনি বানিয়ে দিয়েছে, সুদীপ জানে। কিন্তু সে অ্যাকাউন্ট মা শেষ কবে খুলেছে তা মনেই পড়ে না যে! যাই হোক, মার ছেলেমানুষের মত খুশি দেখে সুদীপের মজাই লাগছিল। হাতে সময় থাকলে আরেকবার গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেও হয়, ভেবেছিল একবার। তারপর ভেবেছিল পরে কখনো করা যাবে। সত্যিই অনেক বেলা হয়ে গেছিল সেদিন।
আজ কিন্তু গাড়ি ঘোরালো সে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে অনেকদিন বাদে এই পথ ধরে আসছে। সচিন নেই। নিজেই ড্রাইভ করছে আজকাল, নতুন ড্রাইভার আর রাখেনি। এখানে গাড়ি ইউ টার্ন করা মানে আবার সাত-আট কিলোমিটার তেল পোড়ানো, তবুও কেউ যেন ঘেঁটি ধরে কাজটা করিয়ে নিচ্ছে তাকে দিয়ে।
গাড়ি ঘুরিয়ে সার্ভিস রোড ধরল সুদীপ। রাস্তায়, পাশের যত্ন-লালিত ঘাসে পড়ে আছে শত শত রোজ় ট্রাম্পেট। একটা গাছের নিচে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে সে নামল গাড়ি থেকে। কার্ব থেকে গাছতলাতে পৌঁছনোর সময়টুকুতেও ঝরে পড়ল আরো কয়েকটি ফুল...আশ্চর্য অনাসক্তির সঙ্গে। যেন এইরকমই কথা ছিল, তারা ফুটবে, গাছ আলো করে থাকবে মাস দুই, তারপর খেলা গুটিয়ে ঝরে পড়বে...অনুষ্ঠান শেষে মাইকওয়ালা যেমন তার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিতে থাকে, সফল অনুষ্ঠানের আনন্দ, ব্যর্থ অনুষ্ঠানের আক্ষেপ তাকে স্পর্শ করে না।
ছোট ঘাসের লনটা হাইওয়ে আর সার্ভিস রোডের মধ্যিখানে। ফলে দুই দিকের চলতি যানবাহন থেকে কৌতূহলী দৃষ্টি ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। পকেটে মার ফোনটা একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করল সুদীপ। তার অ্যালবাম খুললেই চোখে পড়বে দু-বছর আগের একই পুষ্পশোভা।
২
শহরটা যেন সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।
কে বলবে মাত্র ছয়-সাত মাস আগেও আশপাশে কেউ একবার গলা ঝেড়ে কাশলেই বাকিরা চমকে চমকে উঠত! কাশির সঙ্গে জ্বর থাকলে তো কথাই নেই। পারিবারিক ডাক্তার ফোন ধরে না, প্রতিবেশিরা দরজা এঁটে বসে থাকে, যেচে ফোন করে হাসপাতালে যাবার পরামর্শ দেয়।
সচিনের বৌ ফোন করেছিল, ত্যালা তাপ আলা সায়েব। খোকলা পণ আহে। (সাহেব, সচিনের জ্বর এসেছে। কাশিও হচ্ছে।) প্রথমেই সুদীপ মনে করার চেষ্টা করেছিল, সে কি আগের দিন সামনে, সচিনের পাশে বসেছিল, না পিছনের সীটে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে ধমক দিয়েছিল, মনে মনেই। মুখে বলেছিল, ভাবিজি, ম্যায় দেখতা হুঁ, অগর কোঈ ডক্টর মিল জায়ে তো।
তারপর ফোন করেছিল ডাক্তার বন্দুকবালাকে। কর্পোরেট প্যানেলে থাকার দরুন অসুখ-বিসুখে তো সচরাচর এঁর কাছেই যাওয়া...তাছাড়া বেশ কয়েকটা হাসপাতালের সঙ্গে উনি যুক্ত। যদি সচিনকে হাসপাতালে নেবার দরকার পড়ে। সরকারি ব্যবস্থাগুলি ইতিমধ্যেই উপচে পড়ছে। অক্সিজেন সিলিন্ডার দিনে চল্লিশ হাজার টাকা ভাড়া হাঁকছে। বেডও নেই যথেষ্ট।
তাও বেসরকারি হাসপাতালে কিছু বেড সরকারি নিয়ন্ত্রণে গরিব লোকেদের জন্য সংরক্ষিত আছে। সে বেড পাওয়াও প্রায় লটারি, তবু বন্দুকবালা আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি চেষ্টা করবেন।
তখনো পাশের ঘরে মার হাল্কা কাশির আওয়াজ আসছে, একটু আগেই ভাবছিল মাকে একবার সোয়াব টেস্ট করাতে নিয়ে যাবে কি না। কেমন আছো জিজ্ঞেস করাতে অবশ্য বলল, ফাসক্লাস। যেমন বলে।
সচিনটা আর সময় পেল না অসুস্থ হবার...ফুল ঝরে পড়ছে গোলাপি বৃষ্টির মত। মনে পড়ল সব মিটে যাবার পর সচিনের বৌ বাচ্চাটাকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাচ্চাটার হাল্কা গোলাপি রঙের ফ্রক। অনেকটা যেন এই ফুলেরই মত।
নাঃ, ভুলতে দেবে না, কিছুতেই ভুলতে দেবে না। সুদীপ বিড়বিড় করে। বন্দুকবালা বলেছেন, ভুলে যাবার চেষ্টা করুন মিস্টার মিত্র। কিছু ডিটেইলস টক্সিক। সী ইয়োর স্পেশালিস্ট এগেইন। আই থিঙ্ক ইউ নিড আ কনশাস এফার্ট টু লুজ় দোজ় স্টাফ, ক্যানট লীন অন অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টস ফর আ লাইফটাইম।
--অ ইয়েস, বাট হাও? কথাটা বলতে গিয়েও বলেনি। সব কথা সবাই বোঝে না, বললেও বোঝে না।
সচিন শেষমেশ যখন সরকারি বেড পেল, ওর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। বন্দুকবালা পর্যন্ত মুখ কালো করে বললেন, ম্যাটার অভ ডেজ়। যদি আগের বেডটা ওকে দেওয়া যেত।
শালিনী, ওর বৌ শুধু বলেছিল, এই পরীক্ষার দিন দেখানোর জন্যই ভগবান আমাদের বাঁচিয়ে রেখে দিল সায়েব।
৩
আজকে সচিনের মেয়েটার পাঁচ বছরের জন্মদিন।
বাড়ি ফিরে সুতপাকে নিয়ে যাবার কথা সুদীপের। একটা টিলার ওপর বস্তিতে ওদের বাসা। বড় রাস্তায় গাড়ি রেখে অনেকটা চড়াই। তবু যাবেই, পুতুল কেনা হয়েছে, গিফ্ট প্যাক করে গাড়িতেই রাখা আছে। অনেক দিন পরে একটা জন্মদিন এল। ছাড়া যাবে না।
আসলে গত দুটো বছর মৃত্যুর মিছিল যেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মী মনোজ নায়ার, সাপ্লাই চেইনের বাবু কদম..ডিরেক্টর সায়েবের সেক্রেটারি বেলিন্ডা ডি সিলভা...মনোজের না হয় কো-মর্বিডিটি ছিল, কিন্ত বছর তেইশের ঝকঝকে তরুণ কদম? লোকে যখন ঘরে বসে টিভিতে দেখছে মারণ ভাইরাসের নাচ, তখন লজিসটিক্সের মনোজ, বাবু এরা কাজ করছে কাস্টমস এজেন্টের অফিসে... গোডাউনে। প্রাণদায়ী ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে রিটেলারের কাছে... কিন্তু নিজের জন্য হাসপাতালে একটা জায়গা পেতে অনেক দেরি করে ফেলল।
আর মা? বাইপ্যাপ চলছিল, সাড়া দিচ্ছিল না...তাও ডাক্তার যখন এসে বলল, ব্রাডিকার্ডিয়া...আমরা আধঘন্টা চেষ্টা করেছি... রিভাইভ করলেন না। উই আর ..পুরোটা শুনতে পেল না সুদীপ...সুতপা ওর হাতটা শক্ত করে ধরে আছে।
স্ক্র্যাপবুকের পাতার পর পাতা উল্টে যায় যেন...সরকারি প্রোটোকলে দাহকার্য সেরে ফেলতে হবে তাড়াতাড়ি...এই তারা পুলিশ স্টেশনে এসেছে, দাহকার্যের অনুমতি নিতে... এই তারা রাত তিনটের সময় জনহীন শ্মশানে... খুব তাড়াতাড়িই সময় এসে গেল, আষ্টেপৃষ্ঠে নীল চাদরে মোড়া মার দেহ গিলে নিল ইলেকট্রিক চুল্লি... দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগে লকলকে আগুনের শিখা দেখে একবার শিউরে উঠেছিল সে।
৪
এই গোলাপি ফুলের সঙ্গে মার সুখস্মৃতি। বন্দুকবালা বলেছিল হ্যাপি মেমরির বোকে তৈরি করতে। হ্যাপিনেস এক্সারসাইজ়। কিন্তু সচিনের মেয়ের ফ্রকটাও ঠিক এই গোলাপি রঙের...অবিমিশ্র হ্যাপিনেসের আর জায়গা নেই এ জীবনে।
সুদীপ একটা গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে ঘাসের ওপর। শার্টে, মাথায় একটা দুটো পিঙ্ক পোই। মনে দুটো বিপরীত ভাবনার জট, একটা বলছিল, ওঠো, এবার রওনা হও। অন্যটা বলছিল, এত তাড়া কিসের...
সুতপাও বলেছিল, মামুলি কাশিও তো হতে পারে। এত তাড়া কিসের? আর একটা দিন দেখলে হত না?
কিন্তু সচিনের তো আরটি পিসিআর পজ়িটিভ এসেছে। তার থেকে সুদীপ মারফত যদি মার সংক্রমণ হয়ে থাকে? মাকে হাসপাতালে নেবার পর টেস্টে যে পজিটিভ এসেছিল!
যদিও তখন অনেক ফলস পজিটিভ আসছিল। আবার হাসপাতালে যাবার পরেও সংক্রমণ হয়ে থাকতে পারে...কে জানে, কে নিশ্চিত করে বলবে! অনেকগুলো হোয়াট-ইফ...
কিন্তু মার বুক থেকে একটা মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ কি নিঃশ্বাসের আওয়াজের সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছিল? বন্দুকবালা সেদিন দুপুর তিনটে নাগাদ ফোন করেছিলেন...বললেন, তাড়াতাড়ি ভেবে বলুন, আমি কিন্তু আপাততঃ একটাই বেড অ্যারেঞ্জ করতে পারি। মেল, থার্টি এইট অর ফিমেল, এইট্টি টু।
একটা দীর্ঘ নীরবতা, তারপর ফিমেল, এইট্টি টু বলতে বলতে গলা কেঁপে গেল সুদীপের... হোয়াট ইফ...