বাড়ির গেট খুলে বাগানে ঢোকার আগে দেবযানীর চোখ যথারীতি আটকে গেল গেটের বাইরের দেয়ালে লাগানো শ্বেতপাথরের ফলকটায়, “ডক্টর জুলফিকার শাহ, গ্রিফ কাউন্সিলার।” যদিও প্রতি সপ্তাহেই সে ফলকটা দেখে, প্রায় সবসময়ই শেষের শব্দ দুটো ওকে একটু ভাবিয়ে তোলে। মানুষ কী করে দুঃখ সামলায়? দুঃখ ভুলে যাওয়ার কি কোন নির্দিষ্ট উপায় বা পদ্ধতি আছে? বিভিন্ন মানুষ কি দুঃখ বিভিন্নভাবে সামলায়, না কয়েকটা বিশিষ্ট পন্থায় তাকে জয় করা যায়? অবশ্য সেসব জানার জন্যই কলম পাবলিশার্সের চিফ এডিটার দেবযানী মিত্র প্রতি সপ্তাহে শনিবার সকাল দশটায় এলগিন রোডের এই বাগানে ঘেরা ছোট্ট গোলাপি বাড়িটার সামনে তার ইনোভা থেকে নেমে আসে এই বাড়ির গেটে।
বাড়ির বাগানটা দেবযানীর ভালো লাগে। তার নিজের নিউ টাউনের অ্যাপার্টমেন্টে জায়গা কম, আটতলার ব্যালকনিতে যদিও আলো অনেক, জায়গা বেশি নয়। কাজের লোক মালতী টবে বেলিফুল, ক্রিসন্থিমাম, আর গন্ধরাজ ফুল লাগিয়েছে – সন্ধের দিকে খোলা দরজা দিয়ে ঘরে সুন্দর গন্ধ আসে। ওই বাগান অবশ্য এই বাগানের কাছে কিছু নয়। দেবযানী প্রত্যেক বার ভদ্রলোকের বাগানের এই ফুলের বাহারের প্রশংসা না করে থাকতে পারে না। গোলাপ ফুলের যে এত রং আর বৈচিত্র্য, এই বাগানে না এলে বিশ্বাস করা শক্ত। সকালে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, তাই ফুলগুলো আরও তাজা আর উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। একটা গাঢ় লাল গোলাপ নাকের কাছে এনে দেবযানী বুকভরে দম নিল। মনের গ্লানি অনেকটা যেন কমল।
গেট খোলার পরই ডাক্তারের স্প্যানিয়েল কুকুরটা দৌড়ে এল, যেমন সে সব সময় আসে। তার মাথায় দুবার হাত বুলিয়ে দেবযানী বাড়ির বারান্দায় উঠে এসে আর হাল্কা হাতে কলিং বেলে চাপ দিল। মিষ্টি সুরে বেল বাজতেই ডক্টর শাহ হাসিমুখে দরজা খুললেন। “গুড মর্নিং দেবযানী,” পরিচিত বন্ধুর গলায় আহ্বান জানালেন গ্রিফ কাউন্সিলার।
“গুড মর্নিং ডক্টর,” দেবযানী ঘরে ঢুকে পায়ের চটি দরজার পাশে রেখে ডাক্তারের হাতে হাত মেলাল। বসার ঘর পেরিয়ে করিডোরের মধ্যে দিয়ে ডাক্তারের অফিসে দুজন যখন এসে পৌঁছল, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় দশটা।
“আজ কেমন আছেন বলুন।” – কপালের সামনের কাঁচাপাকা চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে পঞ্চাশোর্ধের মানুষটা নিয়মমত কথোপকথন শুরু করলেন।
এই পরিচিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দেবযানীর সব সময়েই খুব কঠিন হয়ে ওঠে। সে কী বলবে? তার বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে সে অনেক প্রিয় মানুষকে হারিয়েছে। ছোটবেলার সব চেয়ে প্রিয় মানুষ তার বাবা আমেরিকা যাবার পথে প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। প্লেন সাগরের ওপরে ভেঙ্গে পড়ে, দেবযানী বাবার মৃতদেহ দেখেনি। খুব ভেঙ্গে পড়েছিল সে। সেই শোকের সময় অবশ্য মা ছিলেন সঙ্গে – মা বুকে আগলে রেখে দেবযানীকে ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন। দিল্লিতে পড়া শেষ করে কলকাতায় আসার পর দেবযানীর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে দিব্যেন্দুর সঙ্গে পরিচয় হয়। তারপর থেকে প্রায় দশটা বছর দিব্যেন্দু ছিল দেবযানীর সবচেয়ে কাছের মানুষ। বিয়ের দুবছর বাদে অয়নের জন্মের পর দেবযানী সংসার আর তার প্রকাশনার কাজে ডুবে ছিল। দিব্যেন্দু তার অফুরন্ত উৎসাহ আর উদ্দীপনা দিয়ে দেবযানীর বিবাহিত জীবন থেকে দুঃখ শব্দটাকে একেবারে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সব সময়। <ব্র>
দিনটা ছিল শনিবার। দিব্যেন্দু যথারীতি গাড়িতে অয়নকে তার স্কুলে নামিয়ে দিয়ে নিজের অফিসে চলে যায়। দেবযানী বাড়ি থেকে বেরোয় ঠিক তার পরে, তার প্রেসের বাস আসে, অ্যাপার্টমেন্টের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায়। বেলা তিনটেয় দিব্যেন্দু অয়নকে স্কুল থেকে তুলে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়, অয়ন থাকে মালতীর সঙ্গে। সেই শনিবারের মাঝদুপুরে হঠাৎ ভীষণ ঝড় এল, সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। একটা নতুন বইয়ের গেট-আপ ডিজাইন চেক করতে করতে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেবযানীর একটু চিন্তা হল। দিব্যেন্দু ঠিকমত অয়নকে তুলতে পেরেছে কিনা জানার জন্যে মোবাইলে বার কয়েক চেষ্টা করেও সে যোগাযোগ করতে পারল না। অধীর হয়ে যখন সে ছটফট সুরু করেছে, তখনই ফোনটা এল। তবে সে ফোন দিব্যেন্দুর নয়, পুলিসের। অয়নের স্কুল থেকে ফেরার পথে যে ব্রিজটা পড়ে, সেখানে কয়েক মাস ধরে মেরামত চলছে, ব্রিজে ওঠার রাস্তের দুপাশে লোহালক্কড়ের ডাঁই, রাস্তা সারানোর রোলার, আরও হাজার হিজিবিজি। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে আচমকা রাস্তার উল্টোদিক থেকে এক বেপরোয়া যুবকের তীব্র গতিতে আসা মোটরবাইক এড়াতে গিয়ে দিব্যেন্দুর গাড়ি পিছলে ধাক্কা মেরেছে রাস্তার ধারে রাখা সেই লোহালক্কড়ের পাহাড়ে। “মানুষ দুটো বেঁচে আছে?” – দেবযানীর প্রশ্নের উত্তর পুলিস একটু এড়িয়ে গিয়ে শুধু জানাল তার এক্ষুনি টাটা মেডিকেল সেন্টারে যাওয়া দরকার।
দেবযানীর ঠিক মনে নেই সে কীভাবে হাসপাতালে পৌঁছেছিল, হয়ত তার কলিগ শুভাশিস তাকে নিয়ে যায় সেখানে। দুধসাদা বিছানার ওপর সাদা কাপড়ে ঢাকা দেওয়া দুটো বডি, তার মধ্যে একটার নিচে ছোট্ট এক শরীর। এর পর থেকে দেবযানীর সব কিছু আবছা। এখনো ডাক্তারের উত্তর সে ঠিক মত দিতে পারে না।
“আমি কিছুই ঠিক মতো ভাবতে পারছি না,” দেবযানী অধীর স্বরে ডাক্তার শাহকে উত্তর দিল, “প্রায় ছ’মাস হয়ে গেছে, আমি কিছু মনে করতে পারছি না। এই ছ’মাস আমি বেডরুমে বা অয়নের রুমে ঢুকতে পারিনি। বাইরের ঘরের সোফার ওপর ঘুমোবার চেষ্টা করি। কাজে যাইনি এখনও।”
গ্রিফ কাউন্সিলার স্মিত হাসি হেসে দেবযানীর হাতে চাপ দিয়ে বললেন, “ও ঘরে না ঢুকলে আপনি তো কিছুই মনে করতে পারবেন না। গত বারের সেশনে আপনাকে বলেছিলাম, আপনি ওই ঘরে ঢুকে নিজের বিয়ের অ্যালবাম, অয়নের ছবি সব নেড়েচেড়ে দেখবেন। ওদের সাথে কথা না বললে আপনি জানবেন কি করে কী হয়েছিল সেই দিন?”
দেবযানীর চোখ ভেঙ্গে জল এল। ডক্টর শাহ টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলেন, কোন কথা বললেন না। মিনিট খানেকের পর আবার স্নিগ্ধস্বরে বললেন, “আপনি আমার কাছে আসছেন প্রায় দুমাস। তার আগে আপনি ঘর থেকে বেরোননি, খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়েছেন নিজের জীবন থেকে। আপনাকে তো বলেছি, না জানার এরকম চেষ্টা করে চললে আপনার এই পাগল-করা দুঃখের হাত থেকে আপনি মুক্তি পাবেন কী করে?”
“আমি সোজাসুজি কিছু জানতে চাই না। গাড়িটার কন্ডিশন দেখেছি আমি। তার মধ্যের মানুষ দুটোর ইতি দেখার সাহস আমার নেই ডক্টর শাহ।”
একটু ভেবে নিয়ে কাউন্সিলার শান্ত স্বরে বললেন, “দেবযানী, মন থেকে সরিয়ে রাখলেই যদি দুঃখ ভুলে থাকা যেত, তাহলে মানুষের এত দুঃখ থাকত না। আপনি ঘুমের ওষুধ চেয়েছেন, আমি দিয়েছি। ঘুম ভাঙ্গার পর কি একটুও সান্ত্বনা পেয়েছেন?”
“আমার জীবনের গত ছয় মাস কি কোনও ভাবেই মুছে ফেলা যায় না?” দেবযানী অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল। ডক্টর শাহ হাত উঠিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। দেবযানীর চুল রুক্ষ, চোখের কোণে কালি। গত দুমাসে তার শুধু ওজন কমেনি, চোখের দৃষ্টি অনেকটা পাগলের মত হয়ে এসেছে।
“অবুঝ হবেন না। আপনি ভালো কাজ করেন, নামডাক আছে আপনার। একবার চেষ্টা করে দেখুন। আমাদের শাস্ত্র অনুযায়ী আপনার প্রথম স্টেপ হবে, আপনি সেই অ্যাক্সিডেন্টের স্পটে গিয়ে কিছুটা সময় কাটান। ওই জায়গাটাতেই আপনার সেই দিনটার সব কিছু রাখা আছে।”
এবার দেবযানী কেঁপে উঠল, “আমি? আমি যাব ওই ব্রিজের মুখে?”
“একবার চেষ্টা করে দেখুন না, হয়ত ওখানেই অয়ন আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”
খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে দেবযানী সোফা থেকে উঠল। চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে সে সরাসরি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো, “প্রথম দিন থেকেই ভাবছি আপনাকে একটা প্রশ্ন করব। আপনি কি বিবাহিত? নিজের আপনজনকে হারানোর দুঃখ সম্পর্কে আপনি এত কী করে জানেন? বইয়ে কি সব লেখা থাকে?”
ডক্টর শাহ একটু হাসলেন, তারপর দেবযানীকে নিয়ে করিডোরে এসে দেয়ালে টাঙানো দুটো পোর্ট্রেটের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। ছবিদুটো এক মহিলার, এক ছোট্ট মেয়ের সাথে। মহিলা অপূর্ব সুন্দরী, সাজগোজ উত্তর ভারতীয়। মেয়েটাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে।
“আমার স্ত্রী আয়েশা আর আমার মেয়ে সিমরন। কিছুদিনের জন্য আয়েশা ওকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। আমি আছি খানসামা সামসেরের হেফাজতে। বাড়ি তাই একটু চুপচাপ।” ডক্টর শাহ-এর স্মিত হাসি আর চোখে গভীর ভালবাসার ছোঁয়া দেখে দেবযানী অনেকটা ভরসা পেল মানুষটার ওপর। এরপর সে বিদায় নিল তার গ্রিফ কাউন্সিলারের অফিস থেকে।<ব্র>
পরের সপ্তাহের বুধবার, আবার আকাশ মেঘলা। সঙ্গে হাওয়াও আছে। কী ভেবে রাত দশটা নাগাদ দেবযানী গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হল সেই ব্রিজের দিকে। জায়গাটায় পৌঁছনোর পর ব্রিজের একটু আগে একপাশে গাড়ি রেখে সে কাঁপা পায়ে রাস্তার ধারে সেই লোহালক্কড়ের পাহাড়ের সামনে এসে দাঁড়াল। রাস্তা সারানো প্রায় শেষ, যদিও অনেক রিপেয়ারের সরঞ্জাম, কংক্রিট, আর পিচের ড্রাম দুধারে পড়ে আছে। রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। আকাশের মেঘ সরে গেছে, শ্রাবণের চতুর্দশীর চাঁদের আলো আর ভেজা হাওয়া মিলেমিশে এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করেছে শহরতলির সেই ব্রিজের মুখে। ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের কুলকুল শব্দ ছাড়া চারপাশে আর কোন শব্দ নেই। দেবযানী দাঁড়িয়ে আছে ঠিক যেখানে আজ থেকে ছমাস আগে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা তার সব ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। দেবযানীর দুচোখ ভেঙ্গে জল এল। কয়েক বছর আগেও এইরকম চাঁদের আলোয় দিব্যেন্দুর হাত ধরে সে ঘুরে বেড়াত অ্যাকোয়াটিকা ওয়াটার পার্কে। অয়ন সাথে যাবার বায়না ধরলে সেই সপ্তাহের রবিবার দিন দেবযানী তাকে নিকো পার্কে নিয়ে যেত। অনেকবার তারা তিনজন বন্ধুর বাড়িতে ডিনার খেয়ে দিব্যেন্দুর গাড়িতে বাড়ি ফিরেছে এই ব্রিজের ওপর দিয়ে। পেছনের সিটে অয়ন ঘুমিয়ে পড়লে দিব্যেন্দুর অনুরোধে দেবযানী তাকে তার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনাত।
নির্জন রাস্তার ধারে মন্ত্রমুগ্ধ দেবযানী কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার খেয়াল নেই। সংবিৎ আসার পর ধীর পায়ে সে ফিরে গেল তার গাড়িতে। তার অ্যাপার্টমেন্টের ব্যালকনির বাগান থেকে সে কয়েকটা গন্ধরাজ ফুল নিয়ে এসেছে। গন্ধরাজ ফুল বাবা-ছেলে দুজনেরই খুব পছন্দের ছিল। গাড়ি থেকে নেমে এসে সেই লোহালক্কড়ের পাহাড়ের পাশে এক জায়গায় ফুলগুলো সে যত্ন করে সাজিয়ে দিল। তার এখন একটু একটু মনে পড়ছে, এইখানেই দিব্যেন্দুর চুরমার হয়ে যাওয়া গাড়ি উলটে পড়েছিল। বিদায় নেবার আগে গাড়ির জানলা দিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেবযানীর হঠাৎ মনে হল চারপাশে হাল্কা কুয়াশার মধ্যে ফুলের পাশে দিব্যেন্দু আর অয়ন দাঁড়িয়ে তাকে হাত নাড়ছে। চোখের জল চেপে দেবযানী গাড়িতে স্টার্ট দিল।
সেই রাতে বাড়ি ফিরে দেবযানী তার শোয়ার ঘরে ঢুকল, কোন অসুবিধা হল না তার। ড্রেসারের ওপরে রাখা তিনজনের ছবিটা সে বুকে জড়িয়ে ছমাস বাদে তার নিজের বিছানায় শুল। তার মনে হল আজ সে ঘুমোতে পারবে।
ভোরবেলায় মালতীর কলিং বেলের শব্দে দেবযানীর ঘুম ভাঙল। অয়নের বিছানা থেকে ওর স্টাফড জিরাফটা তুলে নিয়ে সে এসে বসল সকালের চায়ের টেবিলে। জিরাফটা বুকে চেপে ধরে দেবযানী বাইরের মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে স্থির করল আজ সে অফিসে যাবে। অবশ্য অফিস যাওয়ার পথে তার একবার ডক্টর শাহ-এর সঙ্গে দেখা করা দরকার। গ্রিফ কাউন্সিলারের প্রেসক্রিপশন তাকে সত্যিই সাহায্য করেছে!
দেবযানীর ইনোভা যখন প্রায় ডক্টর শাহ-এর বাড়ির কাছে এসে পড়েছে তখন তার খেয়াল হল যে আজ বৃহস্পতিবার, কাউন্সিলারের অফ ডে। কাল রাতের ঘটনার পর সে একটু হুড়োহুড়ি করেই চলে এসেছে। গাড়ি ঘোরাবে কিনা ভাবার আগেই দেবযানীর নজরে পড়ল ডক্টর শাহ দু গোছা গাঢ় লালরঙের গোলাপফুল হাতে নিয়ে গেটের বাইরে রাখা তাঁর নীল মারসেডিসে উঠলেন। মানুষটার বউ বাপের বাড়ি গেছে, ফুল নিয়ে সে মানুষ যাচ্ছে কোথায়? কারও জন্মদিন নাকি কোন বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভারসারি! ডাক্তারের গাড়ি চলতে সুরু করলে কৌতূহলী দেবযানী সেই গাড়ির পেছনে রওয়ানা হল। মিনিট কুড়ি বাদে দেবযানীর খেয়াল হল তারা দুজনে এসে থেমেছে টালিগঞ্জ সিমেটরির সামনে। অবাক হয়ে সে দেখল ডক্টর শাহ গাড়ি থেকে নেমে সিমেটরির মধ্যে ফুল হাতে ঢুকে গেলেন। এবার দেবযানী আরও অবাক হয়ে দ্রুত তার গাড়ি থেকে নেমে সিমেটরির গেট পার হয়ে এদিক-ওদিক চেয়ে ডক্টর শাহ কোনদিকে গেছেন দেখার চেষ্টা করল। বেশিদূর খুঁজতে হল না। দুর থেকেই তার চোখে পড়ল ডক্টর শাহ দুটো পাশাপাশি কবরের সামনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন। গাছের আড়াল থেকে দেবযানী দেখল, ফুলের গোছা কবরের ওপর রেখে ডক্টর শাহ কবরের ওপরের শ্বেতপাথরে দুবার চুমু দিলেন। দেবযানী কিছু বুঝতে পারছে না, তার গ্রিফ কাউন্সিলার কার কবরে এই ভালবাসা নিবেদন করছেন? প্রায় পাঁচ মিনিট পর ডক্টর শাহ উঠে দাঁড়ালেন আর রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন। এরপর শান্তমুখে ধীর গতিতে তিনি গেটের দিকে এগোলেন।
কৌতূহল আর সামলাতে না পেরে দেবযানী দৌড়ে এল সেই দুই কবরের সামনে। আর সাথে সাথেই তার বুক ধ্বক করে উঠল। লাল ফুল দিয়ে ঢাকা শ্বেতপাথরের কবরের ওপর নাম লেখা আছে, আয়েশা শাহ আর সিমরন শাহ। একজনের চৌত্রিশ বছরের আর অপরজনের ছ-বছরের জীবন শেষ হয়ে গেছে পনেরো বছর আগে।