সাফারির গল্প তো অনেক পড়েছি ও শুনেছি। কিন্তু প্রথমবার হাতেকলমে সাফারি করার সুযোগ পেলাম কেনিয়াতে। প্রায় পঁচিশ বছর আগে। তাই খুঁটিনাটি বিবরণে যাব না। সেগুলো নিশ্চয়ই অনেক অদলবদল হয়েছে। তাছাড়া পঁচিশ বছর পরে স্মৃতিও ক্ষীণ। কিন্তু অনেক দৃশ্য মনের কোঠায় এখনো উজ্জ্বল। এত বছরেও তা ভোলার নয়।
ম্যাডাগাস্কারে ভলান্টিয়ার কাজের শেষে ফেরার পথে মনে হল নিজেকে একটা পুরস্কার দিলে কেমন হয়? ঠিক করলাম আফ্রিকার সাফারির এত নাম, এক সপ্তাহের জন্য একটা ছোট্ট সাফারি নেওয়া যাক। কিন্তু কেনিয়ায় পৌঁছোবার আগেই বিপত্তি। আমাদের 'ম্যাড' এয়ারপ্লেন কয়েক ঘণ্টা লেট ছিল। নাইরোবির জোমো কেনিয়াট্টা এয়ারপোর্টে নামলাম বেশ রাত্রে, দোকানপাট সব বন্ধ। সুনসান এয়ারপোর্ট। কোনো বাস-ট্যাক্সিও দেখলাম না। তাই বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটাব ভাবছি এমন সময়ে এক বিরাটকায় মূর্তি এসে ডাকল, 'চলো, তোমায় শহরে পৌঁছে দিতে পারি।' আমি বিপদ গণে দোনামনা করছি দেখে বলল, 'আমার ট্যাক্সিই শেষ গাড়ি, কাল সকাল পর্যন্ত আর কিছু পাবে না। এখানে শুয়ে থাকাটা খুব নিরাপদ নয়।' আমি আর চিন্তা না করে 'যা হয় হোক' ভেবে ওর গাড়িতে উঠলাম। সেও খুব নিরাপদে আমায় হোটেলে পৌঁছে দিল। এরকম অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। আপাত বিপজ্জনক অবস্থায় অনেক সময় অচেনা লোকের সাহায্য পেয়েছি। কখনো বিপদআপদ হয়নি।
হোটেলটা মাঝারি সাইজের, বেশ ভালো বন্দোবস্ত। অনেক শ্বেতাঙ্গ টুরিস্ট দেখলাম বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ছুটি কাটাচ্ছে। আমি প্রথম দুদিন শহরে মিউজিয়ামটা দেখলাম, বিখ্যাত লিকী পরিবারের আবিষ্কৃত আদিম মানুষের ফসিল হাড়গোড় সংরক্ষিত আছে। অনেকদিন থেকেই আমার আসল জিনিশগুলো দেখার ইচ্ছা ছিল। ৩.৫ মিলিয়ন বছরের australopithecus afarensis-এর ফসিল! বইয়ে কত ছবি দেখেছি। পরিবারে লুই লিকী, মা মেরী লিকী ও ছেলে রিচার্ড লিকী সবাই নৃতত্ত্ব ও ফসিল বিদ্যায় পারদর্শী। লুই-এর তিন ছাত্রী মানুষের পূর্বপুরুষ ‘এপ’ (ape) নিয়ে গবেষণা করেছেন। রোয়ান্দায় বিখ্যাত গরিলা গবেষক ডায়ান ফসি, টানজানিয়ায় শিম্পাঞ্জী পারদর্শী জেন গুডাল ও বোরনিও-তে ওরাং বিশেষজ্ঞ বিরুতে গালদিকাস --সবাই লুই লিকির ছাত্রী ও উত্তরসূরী।
রিচার্ড লিকী একবার ওমাহায় ভাষণ দিতে এসেছিলেন। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা এই মিউজিয়ামটা দেখার। তিনি প্রথমেই বললেন, 'আমরা মানুষেরা গরিলা ও শিম্পাঞ্জীর মতো প্রাণীদের থেকে উদ্ভূত হয়েছি। যদি এই সত্যটায় কারুর আপত্তি বা মনোকষ্ট হয় তো তিনি এখনি বেরিয়ে যেতে পারেন।’ আমি অবাক হয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেলেন!
মিউজিয়াম ছাড়াও বিখ্যাত 'আউট অফ আফ্রিকা' লেখিকা কারেন ব্লিক্সেনের বাড়িটা দেখার ইচ্ছা ছিল। ১৯১২ সালে তৈরি বাড়িটা শহরের একটু বাইরে, সুন্দর ফুলবাগানে ঘেরা, ও সরকারিভাবে সংরক্ষিত। খেতখামার অবশ্য অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে। কিন্তু ভিতরে সবকিছু এখনো নিখুঁতভাবে সাজানো।
নাইরোবির সব হোটেলেই চটপট সাফারির আয়োজন করা যায়। এসব বিষয়ে ওদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতা। গাইড, গাড়ি সব ভাড়া করে আপনি যতদিন ইচ্ছা, যেখানে ইচ্ছা বেড়াতে পারেন। থাকতে পারেন পাকা হোটেলে বা লাক্সারি তাঁবুতে। দামও খুব সস্তা--আমেরিকা থেকে আয়োজন করলে আমার অনেক বেশি খরচ হতো। আমি নিজেই ঠিক করেছিলাম এক সপ্তাহের মধ্যে কোথায় কোথায় যাব আর দেখলাম প্রথম সাফারির জন্য এক সপ্তাহ যথেষ্ট সময়।
'সাফারি' শব্দটা এসেছে আরবি 'সফর' বা ভ্রমণ থেকে। সে হিসেবে সব ভ্রমণই সাফারি। আফ্রিকায় (প্রথমে শ্বেতাঙ্গদের নেতৃত্বে) জঙ্গলে বন্য প্রাণী দেখার ও শিকার করার ট্রিপকেই 'সাফারি' নাম দেওয়া হল। তখনকার দিনে--'আউট অফ আফ্রিকা' সিনেমাটা মনে করুন-- খাকি পোশাক, শোলার টুপি ও বুট পরিহিত সাদা শিকারিরা বন্দুক, ক্যামেরা ও কম্পাস হাতে কৃষ্ণাঙ্গ গাইডদের নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে শিকারে বেরোতেন, আর সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ চাকররা তাঁবু, খাবারদাবার ইত্যাদি বইত। আধুনিক সাফারিতে এসব কাজ আগেই করে রাখা। খোলা জীপে যাওয়ার ব্যবস্থা। গাইড ছাড়া এক পা-ও বেরুনো মানা। পথের মাঝে মাঝে জঙ্গলের মধ্যেই সুন্দর হোটেল বা তাঁবুর শিবির। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও সব শহুরে ভালো হোটেলের মতোই। বাড়িগুলো বনের মধ্যে পাহাড়ে গুহার মতো দেখতে, প্রকৃতির শোভা নষ্ট না করে বনের সঙ্গে মিশে আছে। আর চারদিকে কতই না পাখির সমারোহ! আমি তো সাফারি ছেড়ে হোটেলেই মনের আনন্দে পাখি দেখে দিন কাটাতে পারতাম। সাহারার দক্ষিণে পুরো আফ্রিকা মহাদেশটাই পাখিতে ভর্তি। ব্যস্ত শহরের মধ্যেও গাছে গাছে, ঝোপেঝাড়ে এত পাখি খুব কম দেশেই দেখা যায়।
নাইরোবি থেকে আমরা একটা ছোট্ট বাই-প্লেনে গেলাম প্রতিবেশী দেশ টানজানিয়ার আরুশি শহরে। ছোট্ট শহর, সাফারি টুরিস্টদের প্রধান কেন্দ্র। প্লেন থেকেই আমরা সোজা সাফারির জীপে চড়লাম। ভিসা, পাসপোর্টের কোনো অসুবিধা নেই। দুই দেশই সাফারির সুবিধার জন্য সব বাধা দূর করে রেখেছে। ট্যুরিজম দুই দেশেরই প্রধান অর্থনৈতিক সহায়। প্ল্যান করেছিলাম টানজানিয়ায় টারাঙ্গিরে পার্ক, এনগরংগরো, সেরেঙ্গেটি ও কেনিয়ার মাসাইমারা পার্ক হয়ে নাইরোবি ফিরব। মাঝখানে আমি একটা অ-সাফারি জায়গা অলদুপাই গর্জ জুড়ে দিয়েছিলাম। আমার এই খাপছাড়া প্রোগ্রামের জন্য কয়েকবার জীপ ও গাইড বদল করতে হয়েছিল। এমনিতে এক পার্টি সারা সফর এক জীপে, এক গাইডের সঙ্গে থাকেন। কিন্তু আমি একলা ও শেষ মুহূর্তের যাত্রী বলে আমাকে যেখানে সুবিধা সে দলে বা গাড়িতে ঢুকিয়ে দিত। আমার কোন আপত্তি ছিল না। অনেক রকম লোকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আর সেইসঙ্গে সাফারির খরচও কম পড়েছিল।
কিছু জিনিশ সাফারির ঝকমকে বিজ্ঞাপনে লেখা থাকে না। প্রথম হল ধুলো। পার্কের বাইরে সাফারির রাস্তা ধুলোয় ধুলোক্কার। দু-মিনিটে আপনার কাপড়চোপড়, চোখ, নাক, চুল সব ধুলোয় ভরতি হয়ে যাবে। এমনকি মালপত্র, ক্যামেরা, দূরবিনও। আমি হাল ছেড়ে শুধু ক্যামেরাটা বাঁচিয়ে রেখেছিলাম। আর সব তো হোপলেস। আর একটা ব্যাপার--বাথরুমের। লম্বা সফরে জঙ্গলে কদাচিৎ খাটা পায়খানা পাওয়া যায়। বেশিরভাগই ঝোপের আড়ালে কাজ সারেন কিন্তু সেখানেও বুনো পশু বা সাপখোপের দিকে চোখ রাখতে হয়। রাস্তা বেশ খারাপ। সারাদিন খানাখন্দ আর ঝাঁকুনি। অবশ্য এসব অসুবিধা একটু-আধটু না হলে আর সাফারির মজা কোথায়? ঘরে বসে থাকলেই হয়।
আরুশা থেকে প্রথম পার্ক টারাংগিরে--বুনো হাতি ও সিংহের জন্য বিখ্যাত। একটাই সমস্যা--দিনে ও রাতে সেট-সে ( tse tse) মাছির উপদ্রব। দিনের বেলায় জঙ্গলের মধ্যে তেমন মাছি ছিল না কিন্তু সন্ধ্যে থেকেই হোটেলে সব ঘরে নেট দেওয়া জানলা টেনে, মশারি টাঙ্গিয়ে, মাছি মারার স্প্রে ব্যবহার করতে হতো। এই প্রথম সেট-সে মাছি দেখে একটু ভয় করেছিল ঠিকই। বইয়ে পড়েছি এই মাছির কামড়ের দরুন স্লিপিং সিকনেসের কোন ওষুধ নেই। মৃত্যু অবধারিত। মানুষের চেয়েও বেশি আক্রান্ত হয় গরু-ছাগল।
সব আফ্রিকান সাফারিতে গাইডরা 'বড়ো দশটি পশু' দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেন--হাতি, জেব্রা, জিরাফ, সিংহ, চিতা, লেপার্ড, নু বা উইলডাবিস্ট, হিপো, হায়েনা, আর বুনো মোষ। তাছাড়া বুনো শুয়োর, রাইনো, গেজেল, ইম্পালা, ও আরও অনেক রকম হরিণ তো আছেই। একধরনের ছোট্ট হরিণ দেখেছিলাম, ডিক ডিক নাম, কী সুন্দর বড়ো বড়ো মায়াভরা চোখ তাদের!
একদিন বিকেলে এক দল হাতির সঙ্গে ভারী সুন্দর মোলাকাত হল। আমাদের রাস্তা আটকে তারা আরামসে গাছের পাতা চিবুচ্ছিল, যেন কোন তাড়াহুড়ো নেই। মা, দিদি, মাসি, পিসি, আর কয়েকটি টিন-এজার ও বাচ্চা হাতি। ওরা জীপে টুরিস্ট দেখতে অভ্যস্ত, গা করে না। একটা ছোট্ট বাচ্চা হাতি--দাঁতও বেরোয়নি-- দুই কান খাড়া করে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। একটুক্ষণ ছবি তোলার পর গাইড গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে দেখল পিছনে আরও কয়েকটি হাতি। আমরা হাতি ঘেরাও-এর মাঝখানে। গাইড বলল নিঃশব্দে বসে থাকতে, ক্যামেরার শাটারের আওয়াজও মানা। আমার তো শুনেই নাক সুড়সুড় করে উঠল। কোনমতে হাঁচি চাপা দিই। চারিদিকে শুধু গাছপাতা ভাঙার শব্দ, আর একটা খুব নিচু, গুড়গুড় শব্দ-- হাতিরা নিজেদের মধ্যে নিচুস্বরে কথাবার্তা বলছিল। হঠাৎ আমার মনে হল আমি যেন মা-মাসিদের কোলে নিশ্চিন্ত আরামে বসে আছি আরে আমাকে ঘিরে শুভার্থী মাসি-পিসির দল আদর করে কিছু বলছে। এরকম নিরাপত্তার অনুভূতি আমার আগে কখনো হয়নি--তা-ও এক দল বুনো হাতির মধ্যে! আচমকা এক দৈব আশীর্বাদের মতোই আমাকে ধন্য করে দিল।
টারাংগিরে থেকে গেলাম এনগরংগোরো ক্রেটার। এটা একটা হাজার বছরের পুরনো মৃত আগ্নেয়গিরির মুখ। বিরাট বাটির মতো। এখন সবুজ ঘাসে ঢাকা। ভিতরে দেখলাম প্রচুর উইলডাবিস্ট, এদের বার্ষিক মাইগ্রেশন তখনো মাস খানেক পরে, তাই আমার দেখার সৌভাগ্য হল না। ওসব দেখার জন্য অনেক প্ল্যান করে আসতে হয়।
তবে অন্যান্য প্রাণী প্রচুর দেখেছি সব পার্কেই--চিতাবাঘ, জেব্রা, জিরাফ, নানা রকম হরিণের দল। আর পাখি। তারা সর্বত্র। বড়ো পাখি--অসট্রিচ, সেক্রেটারি পাখি--কানে পেন্সিল গোঁজা ব্যস্ত চেহারা, বিরাট মারিবু স্টর্ক--যারা আসলে শকুনের মতোই, ঈগল, প্যাঁচা, টার্কির মতো সাইজের গিনি ফাউল, হলুদ ঠোঁটের হর্ন বিল, আর হাজার রকম রংবেরঙের ছোট পাখি। গাইডরা অনেকেই পাখিবিশারদ কিন্তু বেশিরভাগ টুরিস্ট পাখির তোয়াক্কা করেন না। ওই বড়ো দশটি প্রাণী দেখেই সন্তুষ্ট। তাই আমাকে পেয়ে গাইডরা ভীষণ খুশি। আমাকে সামনে বসিয়ে, ট্রাংক থেকে পাখির বইগুলো বের করে লেকচার শুরু করে দিল। পেছনের সিটে নববিবাহিত যুগল মধুচন্দ্রিমায় ব্যস্ত। সামনে সিংহ, হাতি কিছুতেই ওদের নজর ছিল না--পাখি তো দূরের কথা। অন্যরা হিপোর ছবি তুলছে আর গাইড ও আমি হিপোর মাথায় বসা পাখিটি নিয়ে তর্ক করছি।
এইসব জায়গা আফ্রিকার গ্রেট রীফট ভ্যালির অন্তর্গত। কাছেই ওলদুপাই গর্জ, নানারকম মানবেতর ফসিলের জন্য বিখ্যাত। নৃতত্ত্ববিদদের স্বর্গ। সেখান থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ কি.মি. দক্ষিণে লেয়েটলি নামক এক বিখ্যাত জায়গা--সেখানে পৃথিবীর সবথেকে পুরনো মানুষের পদচিহ্ন দেখা গেছে। প্রথম আধুনিক মানুষের বিবর্তন এখানেই হয়েছিল। প্রায় তিন মিলিয়ন বছর আগে (লুসির সময়, Austalopithecus afarensis) দুটি আদিম মানুষ আগ্নেয়গিরির ভেজা ছাইয়ের উপর তাদের পায়ের ছাপ রেখে গেছিল। পরে আগ্নেয়গিরির তাপে কঠিন হয়ে গিয়ে সেই ছাপ এত বছর ধরে অক্ষয় হয়ে আছে। মানুষের প্রথম সোজা হয়ে দাঁড়ানোর প্রমাণ। পশুপাখির চেয়েও এই জায়গাটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। লুই লিকীর স্ত্রী মেরী ১৯৭৮ সালে এটা প্রথম আবিষ্কার করেন। পূর্বপুরুষের পদচিহ্ন তো তীর্থস্থানের মতোই পুণ্য।
আরেক দিন, আরেকটি পার্কে, আরেক জীপে একদল অল্পবয়সীদের সঙ্গে চলেছি, জঙ্গলে সিংহের শিকার খাবার দৃশ্য দেখে সবাই ফোটো তুলতে ব্যস্ত। আমার হাতে সেকেলে ফিল্ম ক্যামেরা (ডিজিটাল সবেমাত্র উঠেছে)। তক্ষুনি আমার ক্যামেরাটার ফিল্ম ফুরিয়ে গেল। আমি অভ্যস্ত হাতে চটপট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরনো রোলটা বের করে নতুন ফিল্ম ভরছি, দেখি সবাই কাজ থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। এরা কখনো ফিল্ম ক্যামেরা দেখেনি। একজন বলে উঠল, "আই সী! তোমরা এইভাবে ফিল্ম বদলাও?" সামনে সিংহের চেয়েও আমার ক্যামেরাটায় তাদের বেশি কৌতূহল।
এবার এল সেরেঙ্গেটির বিশাল, খোলা প্রান্তর। গেজেল, ইম্পালা, জেব্রা, জিরাফে ভরা। আমাদের সারাদিনের সাফারির জন্য হোটেল থেকে টিফিন লাঞ্চ দিয়ে দিত। একটা অ্যালুমিনাম ফয়েল মোড়া চিকেন, এক টুকরো রুটি, একটি আপেল বা কলা আর খাবার জল। দুপুরে এক চালাঘরের ছাউনিতে গাড়ি দাঁড় করালো, আমরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাবার নিয়ে ব্যস্ত। আমি বাক্স খুলে চিকেনটা বার করতেই একটা দশাসই বিরাট হনুমান লাফিয়ে নেমে চিকেনটা ধরে টানাটানি শুরু করল। আমিও একদিকে ধরে আছি, ছাড়তে চাই না। হঠাৎ মনে হল এই আদিম মহাদেশে, জঙ্গলের মধ্যে, একটি মানুষ তার পূর্বপুরুষের সঙ্গে খাবার নিয়ে লড়াই করছে! আহা, এমন অর্থপূর্ণ ‘কোডাক মুহূর্ত’-টা মাঠেই মারা গেল। আশপাশে ক্যামেরাধারী কেউ ছিল না যে একটা ফোটো তুলে রাখে। এইসব ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলাম হয়তো, বাঁদরটা এই সুযোগে আমার খাবার ছিনিয়ে নিয়ে এক লাফে চালায় চড়ে বসল। তারপর খুব যত্ন করে ফয়েলের খোসা ছাড়িয়ে চিকেন খেতে শুরু করল। টুরিস্ট দেখে দেখে ওদের এসব অভ্যেস হয়ে গেছে। আমাকে আর গ্রাহ্যও করল না।
আমাদের শেষ পার্কটি ছিল মাসাইমারা। বন্য পশু তো আছেই, তারই সঙ্গে পার্কের মধ্যেই বিখ্যাত মাসাই উপজাতিদের বাস। গাইড আমাদের একটা মাসাই কুটিরে নিয়ে গেছিল। ওরা টুরিস্টদের সুভেনির বিক্রি করে কিছু পয়সা কামায়। কেনিয়ায় অনেক উপজাতি বা ট্রাইব। আমাদের গাইড অন্য ট্রাইবের লোক আর মাসাইদের উপর ওর বেশ অবজ্ঞার ভাব দেখলাম--এরা এখনো বনে পড়ে আছে। সভ্যভব্য হয়নি, ইত্যাদি।
দক্ষিণ কেনিয়ায় মাসাইরা এক প্রধান ট্রাইব। মাথায় খুব লম্বা, ছ'ফুটের উপর। কালো কুচকুচে রং, পরনে উজ্জ্বল লাল, নীল, বেগুনি রঙের plaid প্যাটার্নের কাপড় ( শুকা), ঠিক স্কটিশ কিলটের মতো। হয়তো স্কটদের থেকেই শিখেছে। উজ্জ্বল রং এদের খুব প্রিয়। পার্কের মধ্যে বা আশপাশে এদের বাস। আগে শিকার করে পেট ভরাত, এখন গরুছাগল চরিয়ে উপার্জন করে। এদের খড়ের কুটিরে (বোমা) সরু, বাঁকানো করিডোর দিয়ে ঢুকতে হয় যাতে বন্য পশু সোজাসুজি আক্রমণ না করতে পারে।
কুটিরের চারদিকে খোলা অঙ্গন। সেখানেই এরা সারাদিন কাটায়। অতিথি অভ্যর্থনা, ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, খোলা আগুনে রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সব কিছুই বাইরে। কুটিরের ভিতরে শুধু রাতে ঘুমোবার সময়। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কয়েকটা হাঁড়িকুঁড়ি আর একটা তক্তপোশের মতো পাটাতন, সেখানেই বসলাম। কিন্তু খুব সাবধানে। আমি যে আগেই ভুল করে কয়েকটা আরশোলার মতো পোকা দেখে ফেলেছিলাম!
বাইরে সবাই ধাতুর তৈরি গয়নাগাটি কিনতে ব্যস্ত। একটি সদ্য বিবাহিত মেয়ে প্রচুর গয়না গায়ে ছবি তোলাচ্ছিল। আমিও মেয়েদের দলে ভিড়ে গেলাম।
আমি বাচ্চাদের জন্য কিছু লজেন্স নিয়ে গেছিলাম। সেগুলো তাদের হাতে দিতেই আরেক বিপত্তি। লজেন্সগুলো রাংতায় মোড়া, বাচ্চারা সেটা শুদ্ধু চিবোচ্ছে। আমি বলি রাংতা খুলে নিতে, সেটা ওরা বুঝতে পারে না। আমি ওদের মুখে হাত দিয়ে রাংতার টুকরো বার করার চেষ্টা করতে ওরা ভয় পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
শেষে গাইড আর একজন মহিলা সব বুঝিয়ে শান্ত করে। আমারই ভুল, রাংতা আগে খুলে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পরিচ্ছন্নতার জন্য সেটা ভুলে গেছিলাম। এর পর আমি আর কোনো দেশে বাচ্চাদের লজেন্স দিই না। কী হবে বেচারাদের দাঁত খারাপ করে। এখন সবাইকে শুধু পেন্সিল, কাগজ, ডটপেন, এইসব দিই।
এই আমার প্রথম সাফারি কাহিনী। এর পর তো আরও কত জায়গায় সাফারি করেছি--পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। এখন তো ভারতেও কত ন্যাশনাল পার্কে জীপ সাফারির ব্যবস্থা। তবে পূর্ব আফ্রিকায় প্রথম একলা সাফারির অভিজ্ঞতাটা চিরকাল মনে থাকবে।