সেই ষষ্ঠীর দিন থেকে গুড়ের নারকেল নাড়ু, খই বাতাসা, কুচো ফল, ক্ষীরের প্যাঁড়া, সন্দেশ, কালাকাঁদ, অষ্টমীর সকালে লুচি হালুয়া--- আর পারা যায় না, অন্তত লক্ষ্মীর তো তাই মনে হচ্ছে। নাহয় ঠাকুরই, তাই বলে এত মিষ্টিতে মুখ মেরে যাবে না? দাঁত শিরশির করবে না? লক্ষ্মী তাই প্রায় না খেয়েই আছে।
সরো উর্ফ সরস্বতী, কার্তিক (আদর করে দুগগা ডাকেন কাতু) তো ‘মা একটু ঘুরে আসছি’ বলে রোজই প্যান্ডেল খালি করে ভারি রাতে কোথাও দেড় দু ঘণ্টা কাটিয়ে আসছে। মা দুগগার ওই সময় অল্প চোখ লেগে যায়, অত খোঁজ রাখতে পারেন না ছেলেমেয়েদের। আর পুজোর সময় আবার রাত কোথায়, সবই তো আলো ঝলমলে। সরো একফাঁকে মুকুট, নীল সিল্কের শাড়ি ছেড়ে লুকিয়ে আনা লং ফ্রক পরে নেয়, মাথার চুল বাঁধে পিগি টেল করে আর কাতু পরে লাখনো চিকনের পাঞ্জাবি পাজামা। ওদের গন্তব্যস্থল সিটি সেন্টারের বাইরে ফুচকা চাটের স্টল। এই একটা জিনিস হিমালয়ে নেই। নেই তো অনেক কিছুই, রোল, ভেলপুরি, ভাঁড়ের চা, কিন্তু সবচেয়ে অভাব বোধ করে ওরা ফুচকার। সরো কাতু বেশি করে ঝাল দেওয়া আলু্র পুর-ভরা ফুচকা মশলা গোলা তেঁতুল জলে ডুবিয়ে প্রায় দশ বারোটা করে খেয়ে নেয়, প্রণামীর টাকা তো ওদেরই দেয় ভক্তরা, নিতে দোষ কি? মুখটা তো ছাড়ে! আর একটু তেঁতুল জল চুমুক দিয়ে খেয়ে সরো বলে ‘দ্যাখ কাতু লক্ষ্মীদিটা বড় বেশি ভালমানুষ, এত করে বললুম চলো না আমাদের সাথে, তা সেই এক কথা--প্যাণ্ডেল ছেড়ে যাব মার বদনাম হবে না? দরকার নেই আমি থাকি তোরা যা।’
বিজয়ায় মা, দুই ভাই, সরো হিমালয়ে ফিরে গেল। লক্ষ্মীও গেল। কিন্তু ওকে তো আবার ফিরতে হবে পাঁচ দিন পরে। আবার তো সেই খইয়ের মোয়া, কিরকিরে তিল পাটালি, ঘন ক্ষীর, তালের ফোঁপল কাঁচা চিঁড়ে চিনি নারকেল দিয়ে। আচ্ছা ঠাকুর বলে কি কাঁচা চিঁড়েও হজম হয়ে যাবে? কী যে ভাবে মর্ত্যবাসী! কেন যে এমন নিয়ম, লক্ষ্মী প্রমাদ গণে।
তিন্নির মায়েরও সেই একই ভাবনা। বাড়ির সবাই, দিদা থেকে শুরু করে তিন্নিও, কেউই আর মিষ্টিতে নেই। তাহলে উপায়? বাড়ির মিনিটা মিষ্টির ঢেউ দেখে দিশেহারা হয়ে কদিন থেকে হাওয়া হয়ে গেছে, তার দেখা নেই। সর্বমংগলা ভাবলেন, ‘মা তো আমার ঘরের মানুষ, দেখি কি করি।’
কোজাগরীর দিন সন্ধ্যে বেলা পিঁড়িতে চালগুঁড়ির আলপনা পড়ল, আম্রপল্লবের ঘট, দুয়োরে রঙ্গিন ঘটে কলা গাছের নতুন পাতা। ‘ইহ তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ, ইহ সন্নিধেহি,’ মন্ত্র উচ্চারণে পূজো শুরু হল। আর প্রসাদ? বাড়ির গাছের পলতা পাতা, উচ্ছে, ছাঁচি কুমড়ো, মটর ডালের টোপ বড়া দিয়ে শুক্তো, গোবিন্দভোগ চালের ভাত, সোনা মুগের ডাল, ডিম-ভরা মৌরলা মাছ কুড়কুড়ে ভাজা, আর পুঁটি মাছের কালো জিরে দিয়ে পাতলা ঝাল। ব্যাস আর কি, লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে, আরতি করে ‘লক্ষ্মীর কৃপায় সবে বাড়ে ধনে জনে’ বলে পূজো শেষ।
ধনে জনে তিন্নিদের বাড়ি ভরে উঠেছিল কিনা জানা নেই--কিন্তু মা লক্ষ্মীর অরুচি মুখে আবার স্বাদ ফিরেছিল নিশ্চয়। কারণ মায়ের বরেই হয়ত বাড়ির সবার মন একটা অজানা আনন্দে ভরপুর ছিল, ঘরগুলো যেন ইলেকট্রিক আলোর ওপরেও এক না-জানা আলোয় ঝলমল করত তারপর থেকে। তিন্নির পোষা মিনির অজ্ঞাতবাসের পালা শেষ হয়েছিল কদিন পরেই।