• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | রম্যরচনা
    Share
  • বিশ্বাস : উদয় চট্টোপাধ্যায়

    শীতের সকাল। পৌষ সংক্রান্তির আশেপাশে। প্রাত্যহিক রুটিনে বাজার সেরে বাড়ি ফেরার পথে এক সাধুর মুখোমুখি। প্রবীণ নয়, চুলদাড়ি কালোই, হৃষ্টপুষ্ট --- মাঝবয়সীই বলা চলে। মনে হল, গঙ্গাসাগরে সমাগত সাধুসন্ন্যাসীদেরই একজন। স্বাভাবিক সহবতে মাথা নত করে নমস্কার জানাই। কোন প্রতিনমস্কার নয়, সাধু সরাসরি হিন্দিতে জানালেন তোমাকে কারোর উপর নির্ভর করতে হবে না। আমি অশীতিপর, মোটামুটি সচল, এবং কোনোভাবেই ভাগ্যবাদী নই। তবু সাধুর এই অযাচিত আশ্বাসবাণীতে সচকিত হলুম। কোন দক্ষিণার প্রত্যাশা না-করেই তিনি অগ্রসর হলেন। গৃহ প্রত্যাবর্তনের পথে সাধুর আশীর্বাণী স্মরণ করতে করতে হঠাৎই মনে হল আমি যেন এই আশীর্বাণী বিশ্বাস করতে চাইছি, এবং পরক্ষণেই মনে হল এটা কি আমার যুক্তিবাদিতার পরাজয়?

    এর উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই হতে পারে। না-এর দাবি কিছুটা দুর্বল। একটা বয়সের পর, যখন শারীরিক ক্ষমতা নিম্নগামী, তখন স্বভাবতই মনে আসে দুশ্চিন্তা—জীবনের শেষ পর্বে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে না তো, অথবা সীমিত আর্থিক পরিস্থিতিতে দুমুঠো খাওয়ার এবং আবশ্যিক চিকিৎসার খরচ জোগাতে পারা যাবে তো? দায়িত্বশীল ছেলেমেয়ে থাকলে দ্বিতীয়টার ভার কমে, কিন্তু প্রথমটা তো সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত – রোগ আর জরার কাছে আমরা নিতান্তই পরাভূত। সেইজন্যে প্রায় সবারই একান্ত কামনা রোগ আর জরার কারণে যেন পরনির্ভর হয়ে পড়তে না হয়। এই কামনা সাধুর আশ্বাসবাণীতে ভরসা পায়, তাই আসে সেটা বিশ্বাস করার তাগিদ।

    বিশ্বাস হতে পারে নানারকমের – ভগবানে বিশ্বাস, ধর্মে বিশ্বাস, দৈবে বিশ্বাস, লোকাচারে বিশ্বাস, ভূতে বিশ্বাস, আপ্তবাক্যে বিশ্বাস, মানুষকে বিশ্বাস ইত্যাদি ইত্যাদি, এবং সর্বশেষে আত্মবিশ্বাস। তালিকায় যদিও ভগবানে বিশ্বাসকে শীর্ষস্থানে রাখা হয়েছে, তবু নির্দ্বিধায় বলা চলে দৈবে বিশ্বাসই মানুষের আদিমতম বিশ্বাস। গুহাবাসী অরণ্যচারী আমাদের পূর্বপুরুষেরা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করেছে সূর্যের উদয়াস্ত, ঋতুপর্ব, বৃষ্টির দাক্ষিণ্য, এবং একই সঙ্গে খরা ঝড় প্লাবনের রুদ্ররূপ। কল্পনায় এসেছে এইসবের নিয়ন্ত্রক হিসাবে শক্তিশালী দেবতাদের। এর অনেক অনেক যুগ পরের বৈদিক সভ্যতায় এইসব দেবতাদের নামকরণ হয়েছে – ইন্দ্র, বরুণ, অর্যমা, মিত্র, পর্জন্য। পৃথিবীর অন্যান্য আদিম সভ্যতায় এঁরাই বিরাজ করেছেন ভিন্নতর নামে।

    এই বিশ্বাসের উপর ভর করেই উদ্‌ভাবিত হয়েছে এইসব দেবতাদের প্রসন্ন রাখতে আর তাঁদের দাক্ষিণ্যকামনায় পূজাপাঠ যাগযজ্ঞাদি। বহুদেববাদ বা বহুঈশ্বরবাদের যখন একেশ্বরবাদে উত্তরণ ঘটল তখনও – এবং এখনও পর্যন্ত – একেশ্বরের কাছে প্রার্থনা বলবৎ রইল সেই একই বিশ্বাসের উপর ভর করে। কার্ল মার্কস যতই বলুন ‘ধর্ম জনসাধারণের আফিং’, এবং আমরা যতই যুক্তি দিয়ে অনুভব করি সব ধর্মের সাম্প্রদায়িক সংঘবদ্ধতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে আর্থিক এবং সামাজিক শক্তিলাভের লালসা, জনসাধারণের এক বিপুল অংশ বিশ্বাস করে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’।

    তবু প্রশ্ন এসে যায় ‘বিশ্বাসে কি সব বস্তু মেলে?’ আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা তো অন্য কথাই বলে। ব্যাধিআর্তির নিরাময় কামনায়, বিপদ থেকে রক্ষা কামনায়, পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের কামনায়, কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির কামনায়, বহুল সঞ্চয় কামনায়, এমন কী শত্রুনিধন কামনায় মানুষ যে অহরহ দৈবশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করে চলেছে – কেউ কি হিসাব রেখেছে তার কত অংশ চরিতার্থ হয়েছে?

    বনফুলের একটা গল্পের অবতারণা করা যাক। গৃহস্থ রাত্রে শুতে যাবার আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তার বাড়িতে যেন চুরি না হয়। সেই মুহূর্তেই চুরি করতে বেরোনোর আগে চোরের প্রার্থনা চৌর্যকার্যে যেন তার সিদ্ধিলাভ হয়। রোগী প্রার্থনা করে রোগ নিরাময়ের জন্য, ডাক্তার প্রার্থনা করে তার পসার আরও বৃদ্ধির কামনায়। এইরকম পরস্পরবিরোধী নানা আরজি শোনার পর ঈশ্বর নারদকে ডেকে এক টিন সরষের তেল আনার আদেশ দিলেন। সেই তেল নাকে দিয়ে ঈশ্বর নিদ্রাভূত হলেন --এবং বনফুল জানাচ্ছেন -- ‘সেই ঘুম এখনও ভাঙে নাই’। ঈশ্বর বেচারার কী আর করার ছিল!

    তবু ঈশ্বরের উপর মানুষের বিশ্বাস যায় না। পরিবহনের উন্নতির কল্যাণে সাম্প্রতিক কালে ধর্মীয় স্থানগুলোতে পূর্বের তুলনায় লোকসমাগম ঘটছে বিপুলতর সংখ্যায়। ভিড়ে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে, কিন্তু তা পরবর্তী জনসমাগমকে ব্যাহত করছে না। ঈশ্বর তো দৃশ্যমান নন, তাই ‘গড ম্যান’দের আখড়ায় একই দৃশ্য এবং অভিজ্ঞতা। শুধু বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে এই জনসমাগম। কী সেই বিশ্বাস? এই তীর্থ বা গুরু দর্শনে তাদের মনস্কাম সিদ্ধ হবে – জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক মনস্কাম। আপাত ফললাভ না-হলেও ভবিষ্যতে হবে – এ আশাও বলবতী থাকে। ‘ধন্য আশা কুহকিনি! তোমার মায়ায়/ মুগ্ধ মানবের মন, মুগ্ধ ত্রিভুবন’।

    বিশ্বাস জোগায় আশ্বাস। সদা সংঘাতময় জীবনে এই আশ্বাসের মূল্য কম নয়। গীতায় কর্মবাদকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কর্ম ব্যতীত জীবন নেই – মানবদেহধারী ভগবান কৃষ্ণকেও সেই কর্মসম্পাদন করে যেতে হয়েছে। অর্জুনকে উদ্‌বুদ্ধ করেছেন তাঁর ক্ষত্রিয়োচিত কর্ম করে যেতে – যদিও শুনিয়েছেন এক সতর্কবাণী – কর্মেই তোমার অধিকার, তার ফলে নয়। এই সতর্কবাণী কি নিরুৎসাহ করবে মানুষকে? তাই গীতার পরবর্তী অধ্যায়ে ভক্তিবাদ প্রবল হয়ে উঠেছে। ভগবান কৃষ্ণ আশ্বস্ত করে বলছেনঃ ‘অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং‌ যে জনাঃ পর্য্যুপাসতে তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্‌’ – ‘যে সকল লোক অনন্যমনে আমার উপাসনা করে, সর্বদা অভিযুক্ত থেকে আমি তাদের যোগক্ষেম (অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি ও প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষা) বহন করি’।

    ভারতবর্ষের মরমী সাধকেরা – মীরাবাই, কবীর, নামদেব, তুকারাম, শ্রীচৈতন্য – ভক্তির স্রোতে ভেসেছেন আর ভাসিয়েছেন দেশের আপামর জনসাধারণকে। সাম্প্রতিক কালের রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবও তাই। মানুষ আশ্বাসবাণী পেয়েছে তাঁদের কাছ থেকে, আর সেই বিশ্বাসের ধারা আজও প্রবহমান।

    রবীন্দ্রনাথকেও আমরা বলতে শুনেছি –
       সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে,
       যাক-না গো সুখ জ্বলে;
       যাক-না পায়ের তলার মাটি, তুমি তখন ধরবে আঁটি,
        তুলে নিয়ে দুলাবে ওই বাহুদোলার দোলে।

    এই বিশ্বাসের জোরেই তিনি কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ব্যক্তিগত শোকের আঘাত, তুচ্ছ করতে পেরেছেন অজস্র অসূয়াপূর্ণ নিন্দাবাদকে। জীবনের অন্তিমপর্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত, কিন্তু সমগ্র মানবজাতির শুভ চেতনার উপর তিনি বিশ্বাসী। তাই ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধের উপসংহারে তিনি বলতে পেরেছেন ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’।

    বিশ্বাস ভঙ্গ হয়, আবার ফিরে আসতে হয় বিশ্বাসে। হয়তো নতুন কোন বিশ্বাসে। আবার বনফুলের এক গল্প। দুই অকৃতদার জেঠার কাছে মানুষ হচ্ছে মা বাপ হারানো একটি বালক। সে তাদের নয়নমণি। বড়ো জেঠা ধর্মবিশ্বাসী, ছোটো জেঠা যুক্তিবাদী। বালকটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে বড়ো জেঠা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন, চরণামৃত এনে বালকটিকে খাওয়ান। ছোটজন ডাক্তার ডেকে এনে দেখান, ওষুধ খাওয়ান। অবস্থার কিন্তু অবনতি হতেই থাকে। বড়ো জেঠা মন্দিরে গিয়ে হত্যে দেন, ছোটো জেঠা আরও বড়ো ডাক্তার দেখান। কিছুতেই কিছু হয় না। অন্তিম কাল এগিয়ে আসে। তখন দেখা গেল বড়ো জেঠা ওষুধের গ্লাস নিয়ে আর ছোটো জেঠা চরণামৃতের গ্লাস নিয়ে বালকটির মুখের কাছে ধরে অনুনয় করছেন ‘বাবা, এটা খেয়ে নে’।

    বিশ্বাসই আমাদের অসহায় মানবজীবনের শেষ সম্বল।



    অলংকরণ (Artwork) : অনন্যা দাশ
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments