অমিত্রাক্ষর এবং--অশোক মিত্র; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ জুলাই, ২০১৫; ISBN 978-93-5040-562-8
ঢাকা আর্মেনিটোলার মিত্তিরবাড়ির বড় ছেলেটি যখন জন্মেছিল তার দু’ মাস আগে ‘সাইমন কমিশন’ এসেছে ভারতে, খুব লেখালেখি চলছে কাগজে কাগজে।
এ’ ১৯২৮ সালের কথা।
স্বদেশীয়ানার চিন্তাধারায় প্রভাবিত বাড়ি। গৃহকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
এর কয়েক বছর পরে সেই শিশুটির যেদিন পোশাকি হাতেখড়ি হল ভূর্জপত্রের উপরে সঠিক বানানে ‘শ্রীশ্রী সরস্বত্যৈ নমঃ’ তো সে ঠিকই লিখে ফেলল, কিন্তু মায়ের মূর্তির সুমুখে গড় হয়ে প্রণাম সে কিছুতেই করবে না!
এই একবগ্গাপনা সারাটা জীবনই ধরে রেখেছিলেন অশোক। তাই আর মিত্র নন, ‘অ-মিত্র’ হিসেবেই কাটিয়ে গেছেন চিরকাল। এতে তাই আশ্চর্য হবার নয় যে ইন্দিরা গান্ধীর মতো মানুষ প্রকাশ্য সরকারি সভায় এই বামপন্থী অর্থমন্ত্রীকে তুলোধোনা করলেও তাঁর লেখার বিশেষ ভক্ত ছিলেন; পিসিমা বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের উপরে অশোকের লেখা এক তির্যক নিবন্ধ পড়ে ইন্দিরা ডগোমগ!
এ’খানি অবশ্যি অশোক মিত্তির মশায়ের আত্মজীবনীটির গ্রন্থ-সমালোচনা নয়, তাঁর শেষ বয়সের দিকে লেখা গোটা পঞ্চাশেক নিবন্ধের আনন্দ-সংকলনের। ধারে-ভারে-পাঠসুখে এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতামালিকা খুব বেশি তো আর লেখা হয়নি বাংলায়; ওঁর ইং-নিবন্ধাবলীও ততোধিক উপাদেয় (যদিও তেমন কোনো সংকলন চোখে পড়েনি)।
সাকুল্যে তিপ্পান্নখানি লেখা রয়েছে এই বইটিতে--আর কী তার রেঞ্জ!
কয়েকটার শিরোনাম পড়িঃ
‘মন দাও চরকায়’,
‘শ্রেণীসংগ্রাম, মাফ করবেন, আরও জরুরি’,
‘পৃথিবীর ধনীরা এক হও’,
‘যাঁর লেখা সবাই ভুলে গেছেন’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেমন প্রাঞ্জল ও গতিময় ভাষা, তেমনি বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে অনায়াস বিচরণ।
তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে সদাই যে একমত হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, কারণ মার্কামারা মার্কিস্ট তিনি, ‘stock market’-এর বাংলা ‘ফাটকা বাজার’ করবেন এবং দেশের অর্থব্যবস্থায় তার ভূমিকা নস্যাৎ করে দেবেন তাতে আশ্চর্যান্বিত হবার কিছু নেই, কিন্তু পাবনা জিলার গপ্পো শোনাতে গিয়ে মিলিয়ে দেবেন সুচিত্রা সেনের সঙ্গে রবিশঙ্কর থেকে শচীন চৌধুরী (EPW)—এটাই উপাদেয়-ও-উপভোগ্য পাঠ (‘কোথাকার জীবন কোথায় গড়ায়’ )।
বা, ধরুন, রামপুরের নবাব মুহ. মুমতাজুদ্দিনের কন্যা শতায়ু অভিনেত্রী জোহরা সেহগলের গল্প, যৌবনে যিনি সহোদরা উজারা-কে সঙ্গী করে উদয়শঙ্করের দলে ‘হরপার্বতী’ সেজে নৃত্যে ইউরোপ কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছিলেন (‘জনৈকা একরোখার কাহিনী’ )।
গল্প করতে বসলে শেষ হবে না।
‘লেনিন তো আরও বখে গিয়েছিলেন’ নিবন্ধটিতে যে সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে নিয়ে নালেঝোলে হবেন সেটাও কি না পড়লে জানা যেত?
বাঙালি মনীষার শেষ যে-দু’একজন কাণ্ডারী গত দশক পর্যন্ত ধ্বজাটা সুউচ্চে তুলে রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন অশোক মিত্র মশায় তাঁদের অন্যতম।
নৈলে, মার্ক্সীয় পথ থেকে বিচ্যুতি ঘটে যাচ্ছে বলে প্রকাশ্য সভায় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পর্যন্ত ধমকে দেবার সাহস আর কে-ই বা দেখাতে পারতেন?
রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন--সমীর সেনগুপ্ত; সাহিত্য সংসদ, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশঃ ২০০৫, দ্বিতীয় সংস্করণ চতুর্থ মুদ্রণ আগস্ট ২০১৮; ISBN 978-81-7955-293-3
সূর্যসম এক জীবন!
তার আলোক, প্রভাব ও ছায়া সুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এতে অবাক হবার কিছু নেই।
অবাক যেটা সেটা হল কী অসাধারণ যত্নে ও নিবেদিতপ্রাণতায় বর্তমান কোষগ্রন্থের লেখক বা সংকলক নির্মাণ করেছেন এটির। বাংলাভাষায় তো নয়ই, ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষাতেও তুলনীয় চরিত্র গান্ধী বা নেহরু বা বিদেশে শেক্সপীয়র বা হুগো-র উপরে এই রকম কোনো কাজ হয়েছে বলে জানি না। সেই অর্থে এটি এক অনন্য কোষ!
*
পিতামহ দ্বারকানাথের পুত্রদের মধ্যে একমাত্র দেবেন্দ্রনাথই দীর্ঘায়ু ছিলেন, যাঁর সন্তানসংখ্যা পনেরো। এঁরা রবীন্দ্রনাথের ভাইবোন। আবার, পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ি ধরলে, মহারাজা যতীন্দ্রমোহনও চলে আসেন যাঁকে পিতৃতূল্য সম্মান করতেন রবীন্দ্রনাথ। মনে রাখতে হবে, শুধু জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটা নয়, চোরবাগান ও কয়লাঘাটাতেও ঠাকুরবংশের উপগোষ্ঠী ছিল, এবং সেখান থেকে জগদিন্দ্রনাথ প্রমুখেরও এন্ট্রি এখানে রয়েছে।
এবং শুধু এন্ট্রি মাত্র নয়। প্রসঙ্গক্রমে অনেক মজার মজার কাহিনীও ঢুকে এসেছে। যেমন, রবীন্দ্রনাথের মামাবাড়ির দিকে বেশি খবর তো পাওয়া যায় না, তবু ছিলেন একজন শ্রী জগদীশচন্দ্র রায়চৌধুরী--কবির মামাতো মামা, যিনি ঠাকুরবাড়ির সেরেস্তায় কাজ করতেন। তাঁর একটা স্কেচ করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ যেখানে তিনি হুঁকো হাতে ঝিমোচ্ছেন। আশি বছর বয়সেও মস্ত খাইয়ে ছিলেন উনি। কোষগ্রন্থে এমন এমন উপাদেয় তথ্য থাকলে পাঠসুখ বাড়ে বৈ কি?
প্রায় সাত শত এন্ট্রি আছে এখানে, যার মধ্যে ‘পরিশিষ্ট’-অংশটি শ্রেষ্ঠ।
কেন?
রবীন্দ্রনাথের আলোকসমান জীবনে যে শুধুমাত্র তাঁর রক্তের আত্মীয় (বা, বৈবাহিক আত্মীয়)-রাই ছিলেন তা তো নয়, জগদীশ বসু থেকে আন্না তড়খড়, সতীশচন্দ্র রায় থেকে মৈত্রেয়ী দেবী বা অজিত চক্রবর্তী থেকে ধূর্জটিপ্রসাদের মতো ব্যক্তিত্ব তো কবির জীবনে নানাভাবে এসেছিলেন বা যুক্ত হয়ে ছিলেন। তাঁদের বাদ দিয়ে কি আর রবির পরিমণ্ডল সম্পূর্ণ হতে পারে? তাই এই পরিশিষ্ট অংশে তাঁরা সসম্মানে স্থান পেয়েছেন। এখানে সৈয়দ মুজতবা আলীর নাম না দেখে অবাক হয়েছি যেমন দেবব্রত বিশ্বাসের ভুক্তি দেখেও। আসলে, এই অংশটা তো যথেষ্ট নমনীয়, তাই ভুক্তিগুলিও তেমন। এখানে ‘সুয়েজ খাল’ বলে একটা এন্ট্রি রয়েছে এবং ফার্দিনান্দ দ লেসেপ্স-কে ফরাসী ‘এঞ্জিনিয়ার’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙালির চালু ভুল।
কবির দিদি স্বর্ণকুমারীর পৌত্র অজিত ঘোষালকে ‘আই সি এস’ বলা হয়েছে যে তথ্যের পুষ্টি অন্যত্র পাইনি।
এ’ কোষগ্রন্থের তো একাসনে বসে পাঠ সমাপ্ত করে ফেলা যায় না, বিভিন্ন প্রয়োজনে বারংবার ফিরে ফিরে আসতে হয় এর কাছে। যেমন, কবিজননী সারদা দেবীর উপরে এত তথ্য এক স্থানে পাওয়া যথেষ্ট কাজের।
সদ্যপ্রয়াত সমীর সেনগুপ্ত মহাশয়ের লেখার সঙ্গে আমরা বহুকাল ধরেই পরিচিত। শুধুমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জীবনীকার হিসেবেই নন, গান-কবিতা নিয়ে ওঁর নানান লেখা ‘পরবাস’-এর পৃষ্ঠাতেই পড়েছি আমরা বহু বছর আগে থেকেই। যদিও ব্লার্বে ঐ যে লেখা রয়েছে এই শ’য়ে শ’য়ে ‘আত্মীয়’ বা ‘পরিজন’--এঁরা সকলেই রবিচরিত্রের উপরে কোন না কোন ভাবে আলোকপাত করেন--সেটা আমরা মানলাম না, কিন্তু নৈর্ব্যক্তিকতার খাতিরে এই এত এত আত্মীয়ের চর্চার প্রয়োজনীয়তা আছে বৈকি?
বর্তমান এই যে কাজটি উনি করে গেছেন, সকল রবীন্দ্রপ্রেমী মনে রাখবে ওঁকে এটার জন্যে।
সাধুবাদ।
দিতার ঘড়ি--দীপেন ভট্টাচার্য; কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস, কলকাতা-৭৪; প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০২৪; ISBN 978-81-967745-6-1
সেই ঘরে সব মিলিয়ে ছিল দুজন লোক, তার মধ্যে একজনের বয়স ছিল আরেকজনের ঠিক দ্বিগুণ।‘আমি আমার মেয়ের কাছে ঘড়িটা গচ্ছিত রেখেছি, অসিতোপল বলল এমন বিষাদপূর্ণ গলায়, যাতে মনে হল সে সব সময়ই এমনভাবে কথা বলে। তার একটা গুরুত্বপূর্ণ পেশা ছিল, এমন পেশা যা সমতল ভূমির খুব কম লোকের পক্ষেই করা সম্ভব ছিল। সেই পেশা ছিল ঘড়ি নির্মাণের, অসিতোপল উদ্ভাবন করত নতুন নকশার ঘড়ি যা সব সময় নিখুঁত সময় দিত আর চলত বহুদিন ধরে। …যতক্ষণ আমার মেয়ে নিরাপদে থাকবে, ততক্ষণ সেই ঘড়িও নিরাপদে থাকবে’,-- অসিতোপল…||
[অধ্যায় ৬, ‘দশ বছর আগে’ ]
না সুধী পাঠক, এটা কোনো এসিমভীয় সাই-ফির বঙ্গানুবাদ পড়ছেন না (বরং এনার বইয়েরই ইঙ্গানুবাদ বেরিয়েছে সম্প্রতি), নিখাদ এক বঙ্গসন্তানের লেখা রোমহর্ষক কল্পবিজ্ঞান কাহিনী এটি। এ’ কাহিনীর নায়িকার নাম দিতা, হরোলজিস্ট অসিতোপলের কন্যা সে। আর আর প্রধান চরিত্রের নাম ত, ত২, ত৩। না না, শুধু যে এমন এমনই নাম তা নয়, প্রান্তিক, আর্ক, আরাত্রিক নামের যোদ্ধারা আছে পার্টিজান বাহিনিতে; এবং চিতা সেনাবাহিনিতে আছে কর্নিক, পদার্থবিদ্ প্রমুখ।
এদের ঘনঘোর লড়াইয়ের কথা পড়তে পড়তে স্মরণ করি চিতা সামরিক বাহিনিকে যারা দখল করে রেখেছিল সমতল ভূমি, যাদের নির্মম অত্যাচারে সমতলভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল। সেই সমতলভূমে অতীতে বাস করতেন মনীষী বিজ্ঞানীগণ যাঁদের ‘যান্ত্রিক’ বলে আখ্যায়িত করা হতো। এই ভয়াবহ সঙ্কট থেকে উদ্ধারের জন্য যান্ত্রিকেরা অতীতেই এক পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছিলেন। সমতলকে জয়ী করতে সেই সমাধানের পথে ভ্রমণ করে পার্টিজান যোদ্ধা ‘ত’, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আর একটি দেশ-কালে (বা মহাবিশ্বে) যে নিজেই কিনা ত২ অথবা ত৩ নাম ধারণ করবে। (সত্যি বলতে কি, এতো আঁটোসাটো ব্লার্ব খুব কম বইতেই পাওয়া যায়।)
বস্তুতঃ, ‘দিতার ঘড়ি’ যত না কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী তার চাইতে বেশি মানুষের লড়াইয়ের গল্প--বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে বিশ্বাসের, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক সত্যের। তাই এর চরিত্রগুলি যেন একেক ‘মানুষিক সৈনিক’—‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে আবার’ জেগে উঠেছে তারা!
পড়তে পড়তে প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল, এ’ কেমনধারা বাং বাক্যগঠন গো? ঃ
“একটা বিশাল আকাশের গায়ে উড়ছিল দু-তিনটি খণ্ড খণ্ড লাল-কমলা মেঘ, যাদের পেছন থেকে শেষ বিকেলের আলো ভেসে এসে আবছা আভায় আমাদের ট্রেনটা ভরিয়ে দিয়েছিল এক উদাস চলন্ত আবেগে।” বা,
সেই ‘ডাইনোসর-যন্ত্র’-এর ওখানে--“অসিতোপল জানত তাকে এর মুখোমুখি হতেই হবে--এক ধরনের পৈশাচিকতা, তার কিছুটা হয়তো মানুষের ধর্ম, বিবর্তনের ফসল, আর কিছুটা প্রাগৈতিহাসিক অবশিষ্টাংশ।”
হ্যাঁ, এ’হেন বাক্যগঠন সারা উপন্যাসখানির অঙ্গ জুড়ে। (তা, কলমকুমারের গদ্যে ফরাসী সিনট্যাক্সের রসাস্বাদন করতে তো বাঙালি পাঠকের পাঁচ-সাত বছর গিয়েছিল প্রথমে।)
পরে বুঝি, এটাই দীপেন ভটচাজের গদ্য-স্টাইল, যেটা পাঠশেষে বুঁদ করে রাখে।
বস্তুতঃ, সাই-ফি লেখক নিজেই যদি হন এক বিজ্ঞানসাধক তাহলে কাহিনীগুলি যে এক বিশেষ উচ্চতায় উঠে যায় সেটা মার্কিনী হাইনলাইন সাহেব থেকে আমাদের দিলীপ রায়চৌধুরীর লেখার মধ্যে দেখতে (থুড়ি, পড়তে) পেয়েছি আমরা। বর্ষীয়ান দীপেন ভটচাজ মশাইও এই গোত্রের এক স্টলওয়ার্ট বলে বিবেচিত হবেন সন্দেহ নেই-- সাবেক সোভিয়েত রাশিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নামী নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদের স্বীকৃতি করতলগত এই বাংলাদেশী স্কলারের, বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়াতে অধ্যাপনারত। এহ বাহ্য, এ’ সব তথ্য কো-ল্যাটারেলি এসে গেল…এ’বছরেই প্রকাশিত এই গ্রন্থখানি যে বাংলা সায়েন্স ফিকশনের জগতে নূতন এক দিগন্ত খুলে দিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই আমাদের, কারণ তাঁর এই সাই-ফি গল্পে যেন শোনা গেছে বাঙালির একাত্তরের বিজয়ের গল্প--সামরিক বাহিনীর কব্জা থেকে সুজলাং সুফলাং সমতলভূমির বিজয় সূচীত হয়েছিল যখন।
(যে একাত্তরকে কেহ কেহ যেন এখন অস্বীকার করতে চাইছে!)
WHOSE RAMAYANA IS IT ANYWAY? --Natasha Sarkar. Mapin Publishing Pvt Ltd, Ahmedabad, PIN 380006. First published in 2024. ISBN 978-93-85360-54-1
আজ থেকে আড়াই হাজার বৎসর আগে অযোধ্যা নামক উত্তরভারতীয় এক ছোট্ট রাজ্যের যুবরাজ পিতৃসত্য পালনার্থে চতুর্দশ বৎসর বনবাসে চলে গিয়েছিলেন সুদূর দাক্ষিণাত্যে।
হ্যাঁ, শুধুমাত্র পিতৃসত্য পালন করবার উদ্দেশ্যে।
পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন।
সেখানে এক মহাপরাক্রমশালী দ্বীপ-নৃপতি নিজ দম্ভের খাতিরে লুঠে নিয়ে গেল তাঁর ধর্মপত্নীকে। সেখানকারই ‘বানর’ নামক আরেক উপজাতিদলের সঙ্গে সখ্য পাতিয়ে সমুদ্রবক্ষে দীর্ঘ এক সেতু গড়ে তুলে সেই যুবক উদ্ধার করে নিয়ে এলেন নিজ পত্নীকে।
এর চাইতে থ্রিলিং এডভেঞ্চারের গল্প আর কী হতে পারে? সারা পৃথিবীতে আর আছে কিনা সন্দেহ।
সুবিশাল এই রাম-কাহিনী নিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশ নানান ভঙ্গীতে নানান রূপে নানান ভাবে গান বাঁধা হতে থাকবে, চলতে থাকবে কাহিনী-বিন্যাস--এতে আর আশ্চর্য কী?
যেমন, বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরের কালে পানিপথ-নিবাসী ফার্সী কবি সা’দ আল্লাহ্ মসীহ্ লিখলেন ‘রামায়ণ-ই-মসীহী’ যেখানে রাম এক মহান প্রেমিক, ভার্যার উদ্ধারে বদ্ধপরিকর।
এর আগেই কিন্তু সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ‘রামচরিতমানস’ গেয়ে গিয়েছেন ভক্তিকুলতিলক গোস্বামী তুলসীদাসজী, যেখানে শৌর্যবীর্য নয়, নিবেদিতপ্রাণতাই মুখ্য।
ওদিকে রাজস্থান গাইছে, ‘মন মেরো রাম হী রাম রটে রে’--পুত্রের বিরহে মাতা কৌশল্যার হাহাকার। আরও কত কত রূপে কত ভাবে!
রামায়ণের এই পাঠ এই গান কি ফুরোবার?
কোন্ রামায়ণ? কার রামায়ণ?
তোমার আমার এর ওর তার।
যে যেভাবে চায়, তেমন ভাবে তার।
যেমন, লেখিকা ও আলংকারিক এই অধ্যাপিকা নাতাশা সরকার।
মার্কিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। কিন্তু তাঁর এই রামায়ণী-গাথার পৃষ্ঠা উল্টোলে মনে হয় কলমের চাইতেও বেশি প্রেমিকা উনি তুলিতে। রামায়ণীগানের। ঐ যেমন ছিলেন ফার্সী কবি সা’দ আল্লাহ্ মসীহ্। নৈলে, যেমন এই ডেড়শ’ পৃষ্ঠার বড় পিকটোরিয়াল বইয়ের প্রতিটি অঙ্গ জুড়ে জুড়ে ওঁর তুলির কাজ! কাংড়া/পাহাড়ি চিত্রে শোভিত রামায়ণীকথার কম ইলাস্ট্রেটেড এডিশন তো দেখা নেই, তবু ওঁর স্টাইল কার প্রভাবে--খুঁজে পাইনি।
যেমন, ১২৫ পৃষ্ঠাতে ঐ যে মাইকেল-বাম’লাল পতাকা-ও-রাজবাড়ির অন্দরমহলের বারান্দার তসবীর এঁকেছেন নাতাশা --মনে পড়ে গেল, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ দেশপ্রেমের খাতিরে বিভীষণকে তিরস্কার করে রক্ষণশীলদিগের থেকে কী প্রকার গঞ্জনা সইতে হয়েছিল মধুকবিকে। নাতাশা এই চিত্রে যেন তাঁকে প্রণিপাত করেছেন। আরও যেমন… ৭৭পৃষ্ঠায় রাবণকে হেঁটমুণ্ডে রেখে এবং সেখানে বীণার সাথে তরবারির দ্বৈরথ এঁকে গোটা রামায়ণের নির্যাস যেন এক চিত্রে ধরতে চেয়েছেন লেখিকা!
***
না, শুধু অলংকরণেই নালেঝোলে হলে চলবে না। টেক্সটবডিতে যে তেরোটি অধ্যায় জুড়ে ‘The Rama Story’, ‘The Ideal Hero’, ‘The Anti-Hero’ বা, ‘From the Margins’ ইত্যাদির মতো অধ্যায়ের পরে অধ্যায় সাজিয়ে সাজিয়ে গিয়েছেন লেখিকা-- সে-সবও অতি সুখপাঠ গো মশয়!
পড়ুন পৃ. ৬৬—([‘The Villain’): ‘দশমুখ’ রাবণের কথায় এসে পড়েছে পুরুলিয়ার ছৌ ও মালদহের গম্ভীরা নৃত্যনাট্যের কথা। এই ক্রশ-রেফারেন্সের পাঠই বড্ড উপযোগী গো! নৈলে নিজে ঘেঁটেঘুঁটে আজকের এই নেট-স্যাভিতার যুগে এ’সব খুঁজে পেয়ে যাওয়াটা তো বিশেষ কঠিন কিছু নয়, কিন্তু নাতাশার মতো লেখিকা তাঁর মুন্সীয়ানা-ভরা কলমে এসব ‘রেঁধেবেড়ে’ দেবেন আর পাঠক আয়েশ করে চামচে করে মুখে তুলবেন, তার জন্যই না ডেড়টি হাজার টাকার বইখানি কেনা সার্থক!
***
সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে রামায়ণের হাজারো প্রভাব আজকেও লক্ষ্য করা যায় কোনো সন্দেহ নেই তাতে, কিন্ত লেখিকা তুর্কিস্তানে রামায়ণের প্রভাবের কথা বলেছেন যদিও ব্যাখ্যান নেই কোনো এই বইটিতে। আমাদেরও জানা নেই কিছু, কেবল একটি রুশ রিপাব্লিক কাল্মিকিয়ার কথা কোথাও যেন পড়েছিলাম যেখানে বুদ্ধধর্মের মাধ্যমে রামায়ণী গল্প ছেয়ে গিয়েছিল। আজও আছে।
থাক্ এই সব কথা।
নবীনা লেখিকা নাতাশা দেবীর এই উচ্চমূল্যের ইলাস্ট্রেটেড কেতাবখানি কিনে ঠকি তো নি-ই, বরং বার বার পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে পড়তে পড়তে ও অসামান্য ছবিগুলির রসাস্বাদন করতে করতে অভিভূত হয়ে পড়ছি ও সাধুবাদ দিচ্ছি লেখিকাকে--এটাই ধরা থাক্।
দশে বারো দিই বইটিকে।
ছবির জন্যে দুই নম্বর বেশি।
রামায়ণের বহু বহু ভাষ্যের কোনো আলোচনা কবি কৃষ্ণস্বামী রামানুজনের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য না জানিয়ে পূর্ণ হতে পারে না। লেখিকা ওঁকেই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন দেখে মন ভরে উঠল।