'মুখোশ খুলে ফেলুন।'
'আসলে লেখাটাই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লব করা আর সেটাই করে যেতে হয়।'
সন্দীপন মুখোশটা খুলতে পেরেছিলেন। অকপট, নির্লজ্জ হতে পেরেছিলেন আত্মবিশ্লেষণে। এই 'আত্ম'-র অন্বেষণে, আদর্শ, লোভ, স্পৃহা ইত্যাদি যা কিছু অন্তর্ভুক্তি হতে পারে সন্দীপন তার পরিমার্জনা করতে চাননি। তাই পরতে পরতে আপাত রক্ষণশীল গ্রহণযোগ্যতায় বারবার আঘাত করেছে তার দস্তখত। যদি শুধুমাত্র অশ্লীলতাই হতো তাহলে সন্দীপনের লেখা সাধারণ মানুষ আরও বেশি পড়ত। কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা যুক্ত হয়ে সন্দীপনের সাহিত্যরীতিকে কিছুটা ঘোলাটে করে তুলেছে সাধারণী মনকে। এটাই তার বিপ্লব। গোপনীয়তাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলা তার স্ব ধর্ম যা অন্যের কাছে উচ্ছৃঙ্খলতা।
অথচ চরিত্রের বিন্যাসবিধি অনুযায়ী তাকে ব্যক্ত করতে কার্পণ্য করেননি সন্দীপন এবং সেখানেই আত্ম-র সংযুক্তি হয়েছে।
'আমি ও বনবিহারী' উপন্যাসে এই আত্ম-র দ্বিত্বকরণকে ফুটিয়ে তুলেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। ম্যাজিক অথচ দৃশ্যত যে জাদুভঙ্গিমা স্বচ্ছ এবং স্বাভাবিক। ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময়সীমার মধ্যে বিস্তৃত বামপন্থী রাজনীতির ভাবধারা এবং তার ভিতরকার মতবিরোধের পাশাপাশি বেঁচে থাকার ভঙ্গিমাগুলির নির্মাণ এবং ভাঙনপ্রক্রিয়া নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে 'আমি ও বনবিহারী'। এই 'আমি' বনবিহারী নিজেই। অথবা এই 'আমি' 'বনবিহারী' চরিত্র থেকে তৈরি এক শাখাস্রোত। কালক্রমে সে হয়ত নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বতন্ত্র নদীপথ অথবা বিচ্ছিন্ন একটি হ্রদ। তবু তার উৎস যেহেতু বনবিহারী তাই উপন্যাসটিতে কোথাও 'বনবিহারী' আর 'আমি'-র ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়নি। বরং 'আমি' হয়ে উঠেছে প্রাণ। সন্দীপন উপন্যাসের শুরুতেই বলেছেন পাঠক আমাকে 'প্রাণ' বলে ডাকুন। এখানে 'আত্ম' এবং উপন্যাসের 'আমি' ওতপ্ৰত জড়িয়ে। এবং যেহেতু 'আত্ম'-র প্রতি সচেতনতা লেখকের স্বাভাবিক ধর্ম তাই উপন্যাসের শরীরজুড়ে বনবিহারী ও প্রাণের যাতায়াত এবং জীবনপ্রণালীতে চোখ রাখলে কলম যে প্রাণের দিকে ঝুঁকে পড়েছে স্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু প্রাণ কোনমতেই একক অস্তিত্ব বহন করতে পারে না। সে বনবিহারীর পেরিকার্ডিয়াম। চিত্তের বিবশতা, ঘূর্ণজাল, বায়ুর বিপ্রতীপ গতি অথবা নিছক কবিতাংশ। পাঠক যদি ভেবে নেন প্রাণ বনবিহারীর 'আত্ম'-র ভিতরে আত্মগোপন করে থাকা ব্রহ্ম তাহলে বড় কিছু ভাঙচুর বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না। কারণ বনবিহারীর জন্মের বহু পূর্বের বক্রজীবনের কথা প্রাণ জানত। জন্ম-যৌনতা-পশ্বাচার– জানত। ঘুলঘুলির ভিতরে পূর্ণকুম্ভ– প্রাণ জানত। সন্দীপন কি তাহলে যৌনতা এবং সাহিত্যের সঙ্গমক্ষণকে নিরূপিত করতে চাইলেন প্রাণের মুখোশ নিয়ে? হয়ত স্বগোতোক্তি 'আমি ও বনবিহারী' -র জন্য আত্মধ্বংসী হয়ে উঠত। হয়ত গদ্যের ভিতরে কবিতাকে স্থাপন করতে হলে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে হত। দেহ রইল, হৃদয়বৃত্তি রইল, আবশ্যক যৌনতা মর্মার্থ পেল। প্রাণপণে নিজেকে লুকোতে চেয়ে সন্দীপন নিজেকে বিযুক্ত করলেন নিজের থেকে। আত্ম-র সমর্যাদাসহ আত্মরহিত হল। বনবিহারীর শহুরে শরীর থেকে অর্ধাংশ পেল প্রাণ।
এই উপন্যাসকে কোনভাবেই রাজনৈতিক উপন্যাস কিন্তু বলা যাবে না। রাজনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক ঠিক ততটাই যতটা ক্যানভাস এর সঙ্গে ছবির। বামপন্থা এখানে আবহ সঙ্গীত যার টিউনের মধ্যে উপন্যাসের তিনটি চরিত্র বয়ে গেছে । প্রাণ বনবিহারী এবং প্রতিভার গতিময় প্রবাহ এই উপন্যাসের ধারাবিবরণী। উপন্যাসের শুরুতে স্পষ্ট বলে দেওয়া রয়েছে যে এই উপন্যাস লেখা হয়েছে এমন একটি গদ্য রচনা করার জন্য যা কিনা হয়ে উঠবে একটি কবিতার মুখপাত্র। অর্থাৎ কবিতা যেভাবে জড়িয়ে আছে জীবনে তার ছন্দকে উপন্যাসও যে ধারণ করতে পারে সেকথাই সন্দীপন বলতে চেয়েছেন। বাস্তব, কালখণ্ড, যৌনতা এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের পরিবর্তিত জীবন এই উপন্যাসের বিবৃতি।
Meet me for the last time একথা প্রাণের। কিন্তু বহন করেছিল বনবিহারী। বনবিহারী বাহক ছিল যে বার্তার তাকে সে দেখেনি, জানেনি। কিন্তু প্রাণ দেখেছে বনবিহারী বহন করেছিল বার্তাকে। Meet me for the last time 'এল নাইন' বাসের জানলা দিয়ে গলে সোজা বাইরে। সমূহ ঘটনায় প্রাণ বনবিহারীকে দেখছে সর্বত্র। প্রতিভাকে দেখছে। দেখছে এবং লিখছে কিন্তু বনবিহারী প্রাণকে দেখতে পায় না। সে বুঝতে পারে না তার হৃদয়ের পাশে প্রাণের অবস্থান।
প্রাণ বলেছে, 'ইউরোপের গোটা ঊনবিংশ শতাব্দীটা মার্কস বলেছিলেন, বিপ্লবের লিট-মোটিফ।'
উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে সন্দীপন পরীক্ষাধর্মী এই লেখাকে জাস্টিফাই করতে চেয়েছেন হয়ত। বারবার তাই বিপ্লবের প্রসঙ্গ এনে প্রাণের মারফত মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন, সাহিত্যের অস্ত্রধারণ করার প্রসঙ্গ। যেমন প্রাণ বলেছে
'আসল এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধিতা হল ক্রিয়েটিভ লেখা দিয়ে। বিরোধী রচনারীতি মনন ও মেধা দিয়ে। একমাত্র লিখেই লেখক হওয়া যায়…।'
এই প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসি এবার। প্রাণ অথবা বনবিহারী নয়, প্রতিভার কাছে যাই। প্রতিভাকে কীভাবে মনে রেখেছেন পাঠক? কাহিনির মধ্যগতিতে প্রাণের সঙ্গে প্রতিভাকে meet me for the last time বাক্যে জুড়ে নিয়েছিলেন পাঠক। বনবিহারী তখন যেন অনেকটাই পার্শ্বচরিত্র হয়ে পড়েছে। এখানেই বোঝা যায় সন্দীপন একমাত্র লিখেই লেখক হতে চেয়েছেন। প্রাণের সঙ্গে ঔপন্যাসিককে মিশিয়ে দিয়েছেন, আত্মকে নির্বাসিত করতে চাননি।
এইসব কিছুর মধ্যেই প্রতিভার চোখের রেটিনায় একদিন বর্ণবিপর্যয় ঘটেছিল। সন্দীপন দেখা না দেখার পৃথিবীকে সাঁতরে পার হতে চাইলেন প্রতিভাকে নির্মাণ করে। প্রতিভা প্রাণের হাত স্পর্শ করল দৃষ্টি হারিয়ে। তখন বনবিহারী হয়ত ঘুলঘুলির স্কোয়ার ফিটের অন্ধকারে যৌনতার প্রসঙ্গ খুঁজে পেয়েছিল হাতড়ে। ভাঙা লাইন, জেলির মতো সান্দ্র একটি স্তরে মনের অবস্থান যেখানে বাক্যগুলো পুরো হতে হতে একটি লাইনে এসে থেমে যায়। পাঠক খুঁজতে থাকেন উপন্যাসের বাস্তবায়ন। সন্দীপন প্রমাণ করে দেন একটি গদ্যরেখা যা আসলে কবিতা হয়ে জন্মেছিল।
প্রাণ বলেছিল, 'বিপ্লবের জন্য কোনও প্রয়াসই কখনও ব্যর্থ হয় না প্রতিভা। কোনও না-কোনও দিক থেকে তার সার্থকতা জেগে থাকে। ওই যে বলে না, দে গরুর গা ধুইয়ে! ঠিক তাই। মাঝে মাঝে ধুইয়ে দেবার দরকার হয়। আর সেটাই বিপ্লব। পার্টি মরে যায়, স্পার্টাকাস থেকে চারু মজুমদার–চে গুয়েভারা– সবাই মরে। এম্পিডোক্লেসের মৃত্যু হয়। শুধু বিপ্লব মরে না।'
তাই হয়েছিল। চোখ হারিয়েও প্রতিভা দেখতে পেত। প্রাণের হাত খুঁজে পেত। চা বানিয়ে নিত, পুরোনো অ্যালবামে কোথায় কী ছবি আছে বলে দিতে পারত। প্রতিভার রেটিনার রক্তপাতের দরুণ পাওয়া অন্ধত্বের বিরুদ্ধে এটাই হয়ত তার বিপ্লব ছিল।
এই কাহিনি কিন্তু প্রতিভার 'অন্ধ স্কুলের ঘন্টা' বাজানো কোনও দৃষ্টিহীনতার সঙ্গে ফুরায়নি। বস্তুত কোনো মেলানকলি বা মেলোড্রামা তৈরি করার চেষ্টাই করেননি সন্দীপন। তার রাজনৈতিক প্রাণের ভিতর থেকে তিনি টেনে বার করতে চেয়েছেন বনবিহারী নামক কম্যুনিস্টকে, সেই পশ্বাচারপ্রিয় কম্যুনিস্টকে যার বিপ্লবের ভেদবমি থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল শিক্ষিত আভিজাত্যবোধের মুখোশ। প্রাণ স্বাতন্ত্র্যে বাঁচেনি। কথাও ছিল না তার বেঁচে থাকার। প্রাণ বনবিহারীর বুকের পর্দার নীচে বেঁচে থাকা বিপ্লবী। ধুকপুক করেছে প্রতিভার অন্ধ দৃষ্টিকে বুকে টেনে নেওয়ার আগে পর্যন্ত। পার্শ্বচরিত্রের সঙ্গে মিশে সে এক এবং প্রধান হয়ে উঠেছে। এরপর কল্পচরিত্রকে গল্পচরিত্র বানালেন সন্দীপন। মাও সে তুং আর লেনিনের আদল। ডিং-ডং, যুগ্মশরীর। তারা বলল, নিপাত যাও। তারা পিছমোড়া করে বাঁধল। অতঃপর দাউদাউ করে জ্বলে উঠল শাস্তি। জ্বলন্ত চুল্লিতে নির্বাণ হল গেরিলাবাহিনির ঠান্ডা স্মৃতি। সন্দীপন নিজেও হয়ত ফিরে গেলেন যেখান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে। 'আত্ম'-র কাছে। আত্ম-কে মুক্ত করে, নাঙ্গা করে, শ্লীল-অশ্লীলের হোঁচট ডিঙিয়ে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। এখানেই তার চূড়ান্ত সততা এবং সাফল্য।