• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৬ | অক্টোবর ২০২৪ | গল্প
    Share
  • অবিকল্প : দিবাকর ভট্টাচার্য





    —পারবেন?

    —আপনি পারবেন?

    — সেই মুহূর্তটির দিকে যেতে?

    যদি পারেন তাহলে দেখতে পাবেন ওই গভীর বনের ভিতর - ঠিক সেই জায়গাটিতে - সেই গাছটির সামনে - পূর্ণিমার রাতে - প্রকাণ্ড চাঁদটাকে ...

    আর তখনই শুনতে পাবেন - খুব স্পষ্টভাবেই শুনতে পাবেন একটানা একটা বাঁশির আওয়াজ - আর বুঝতে পারবেন যে সেটা কোনো সাধারণ বাঁশি নয় - সাপুড়ের বাঁশি...

    আর ওই গাছটা - হ্যাঁ ওই গাছটাই যেন একটা সাপুড়ে হয়ে শরীর দুলিয়ে বাজাচ্ছে বাঁশিটা। ঠিক ওই মুহূর্তেই...

    এইসব - হ্যাঁ এইসব‌ই দেখতে পাবেন আপনি - যদি যেতে পারেন সেই মুহূর্তটির দিকে।

    সেই মুহূর্তটি তো অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য।

    কারণ -

    কতকাল আগে কে জানে - এইরকম এক পূর্ণিমার রাতে এক উদ্ভ্রান্ত যুবক একমনে বাজাচ্ছিল এক সাপুড়ের বাঁশি - এক নাগাড়ে - সেই সকাল থেকে। এছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার । ওই বাঁশিটি বাজানো থামালেই তার মৃত্যু ছিল অবধারিত। কারণ ওই বাঁশির সুরে তার খুব কাছেই এসে ফণা দোলাচ্ছিল একটি ভয়ংকর কালসাপ —

    — না না - এটা কোনো কল্পনা নয় -এটা ঘটনা - অতি বাস্তব - ঘটেছিল অনেককাল আগে - এই গভীর অরণ্যে - ঠিক এই জায়গায় –

    তখন সেই সময়ে এই অরণ্য ছিল আরো গভীর - আরো ভয়ংকর - অজস্র হিংস্র পশু আর বিষধর সাপেদের ডেরা। সেই ঘন সবুজ রাজ্যে মুক্তো মালার মতো ছড়ানো ছিল অজস্র ছোটো ছোটো খরস্রোতা নদীনালা। এদের জন্যই এখানে আসত কিছু কঠিন কষ্টসিদ্ধ মানুষ। শিকার যাদের জীবিকা। অর্থাৎ ব্যাধ, বেদে ইত্যাদিরা। এমন একটি বেদেকে নিয়ে এই কাহিনীর সূত্রপাত।

    সে ছিল এক অরণ্যচারী যুবক। সাপের সঙ্গে বিজড়িত তার জীবন। তার কাজ একেকটি বিষধর সাপকে বাঁশি বাজিয়ে গভীর গর্ত থেকে বের করে আনা। তারপর সেই বাঁশির সুরে ওই সাপকে নাচিয়ে কোনো এক মোক্ষম মুহূর্তে তাকে ক্ষিপ্র হাতে ধরে তার ঝাঁপির ভিতরে পুরে ফেলা। এরপর সময়মতো ওই সাপের বিষদাঁত উপড়ে নেওয়া। ওই সাপের বিষ থেকেই নানা রকমের জংলী ওষুধ বিষুধ তৈরি করে বিক্রি করা। এটাই তার জীবিকা। তার বাপ-ঠাকুর্দার দেখানো পথে।

    এই গহন অরণ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক যুবতীর। দেখা হয়েছিল একটা সাপের গর্তের সামনেই। সেই মেয়েটিও এসেছিল তারই মতো উঞ্ছবৃত্তির জন্য। মেয়েটির হাতেও একটা বিচিত্র বাঁশি। যার আওয়াজে ওই গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটা প্রকাণ্ড বিষধর সাপ। মুহূর্তের মধ্যেই এক আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় মেয়েটি ওই সাপটিকে এক হাতে ধরে পুরে ফেলেছিল তার ঝাঁপিতে। কারণ জাতে সেও বেদেনী।

    সেই সাক্ষাৎ থেকে ওদের পরিচয় হয়ে গেল সহজেই। এরপর শুরু হলো গভীর জঙ্গলে একসঙ্গে পথ চলা। সাপের গর্তের খোঁজে দিন কাটে দুজনেরই। অর্থাৎ মৃত্যুকুঠুরির দোরগোড়ায় ঘুরে ঘুরে জীবনযাপন। এইভাবে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর পাশাপাশি চলতে চলতে হঠাৎ এক চন্দ্রমধুর রাত এল তাদের জীবনে। আর তার ফলেই কুসুমিত হলো আরেকটি প্রাণ। বেদেনীর গর্ভে। যথাসময়ে জন্ম হলো ওই বেদে আর বেদেনীর একটি কন্যাসন্তান।

    জন্ম থেকেই শিশুটির কানে এসেছিল সাপুড়ের বাঁশির আওয়াজ। আর তার রক্তে তো প্রবলভাবে ব‌ইছিলই সাপুড়ের বাঁশির সুর। তাই বালিকাবয়স থেকেই সে হয়ে উঠছিল বাপ-মায়ের জীবিকায় অতি নিপুণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে যেন এক দীপ্ত রমণী হয়ে উঠল। তার ওই বিকশিত তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে প্রায়শই চিন্তা হতো বেদেনী মায়ের — "এই মেয়েকে নিরাপদে রাখব কী করে? আর কেই বা এক বেদেনী মেয়ের গলায় মালা দিতে আসবে?" বেদেনী মায়ের স্বামী বেদেটির‌ও মাঝে মাঝেই রাতে ঘুম ভেঙে যেত দুশ্চিন্তায়। তখন সে একা আবছায়ায় বসে মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবত — “কেন যে তুই জন্মেছিস আমার মতো দুর্ভাগার ঘরে।"

    বেদে আর বেদেনীর এই প্রবল দুশ্চিন্তা বোধহয় অলক্ষ্যে দেখেছিলেন ভবিতব্য নামের অজ্ঞাতপুরুষটি। অর্থাৎ সেই পরমার্থকৌতুকী। তাই কোনো দিনান্তের মায়াবী আলোয় ওই গভীর অরণ্যে সেই বেদের কন্যাকে চোখে পড়ল এক যুবকের। আর সেই মুহূর্তের দর্শনেই মুগ্ধ হলো ওই যুবক। বেদেনী-কন্যাও সেই যুবককে দেখেছিল এক রমণীয় আলোয়। মুগ্ধ হয়ে শুনেছিল তার বাঁশির সুর। যে সুর সে শোনেনি কোনোদিন।

    সেই যুবক ছিল এক খেয়ালী ভবঘুরে। আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে গান গেয়ে সে ঘুরে বেড়াত এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। গভীর অরণ্য থেকে নির্জন পর্বত অবধি তার অক্লান্ত যাতায়াত। এইবার সে ওই গভীর অরণ্যে সেই বেদেনীকন্যার মায়ায় ডুবে গেল। আর ওই বেদের মেয়েও অবাক হয়ে শুনল যুবকটির বাঁশির সুর। যে সুর সে শোনেনি কোনোদিন। সহজেই হলো তাদের পরিচয়। তারপর তৈরি হলো তাদের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক এক গভীর ভালোবাসার।

    ঘটনাটা বেদের কানে গেল যথাসময়ে। তখনই সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে কথাটা জানাল তার বৌকে। বেদে-বৌ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল —"তাহলে কী হবে?" বেদে দাঁতে দাঁত চিপে বলল — "এবার ব্যাপারটা আমি বুঝে নেব।"

    এরপর সে ডেকে পাঠাল সেই যুবকটিকে। যুবকটি তার সামনে এসে দাঁড়াতেই বেদে তাকে সরাসরি প্রশ্ন করল —"বেদের মেয়েকে বিয়ে করতে চাও? জানো কী দিতে হয় এর জন্য?" 'দিতে হয়? কিছু দিতে হয়?' — এই কথাগুলো হঠাৎ ধাক্কা মারল যুবকটির মনে। কিন্তু কিছু দে‌ওয়ার মতো কোনো সামর্থ্য বা সঙ্গতি তো তার নেই। এইকথা ভেবে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর সে তার এই অক্ষমতার কথাটা খুব নম্রভাবে জানাল ওই বেদের মেয়ের বাপকে।

    "নাহ্। কোনো সোনাদানা ধনরত্ন তোমায় দিতে বলিনি আমি।" — উত্তর দিল সেই বেদের মেয়ের বাপ। "তাহলে?" — আরো আশঙ্কা নিয়ে প্রশ্ন করেছিল যুবকটি।

    "আমি বলছি যোগ্যতার কথা। বেদের মেয়ের স্বামী হ‌ওয়ার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে তো তোমাকে। না পারলে এ সম্পর্কের কিন্তু এখানেই শেষ।" — কথাগুলো খুব কঠিন গলায় বলল বেদের মেয়ের বাপ।

    "যোগ্যতা প্রমাণ? কীভাবে?" — খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল যুবকটি। বেদেটি উত্তর দিয়েছিল — "পুবদিকের ঘন জঙ্গলটায় যাও। নদীর ধার ঘেঁষে। দেখতে পাবে পর পর অনেকগুলো খুব লম্বা লম্বা গাছ। তার পরেই একটা বিরাট বড়ো অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছের গুঁড়ির সামনেই একটা বিরাট গর্ত। আর ওই গর্তে থাকে একটা কালসাপ।" এই কথাগুলো বলে বেদেটি একটু থামল। আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল যুবকটির মুখের দিকে। যুবকটিও অপলকে তাকিয়ে ছিল বেদের মুখের দিকে।

    এইবার বেদেটি অতি শীতলকন্ঠে বললো — "আমার মেয়ের থেকে তার সাপুড়ের বাঁশিটা নিয়ে যে‌ও। ওই গর্তের সামনে গিয়ে বাঁশি বাজিয়ে গর্ত থেকে বের এনো সেই কালসাপটাকে। সাপটা বেরিয়ে এলে তাকে দুহাতে ধরে আছড়ে মেরে ফেলো। তারপর ওই মরা সাপটাকে নিয়ে এসে আমার মেয়ের গলায় মালা করে পরিয়ে দিও। তাহলেই আমার মেয়েকে পেতে গেলে তোমার যা দেওয়ার তা মিটে যাবে।"

    যুবকটি বেদের ওই কথাগুলো শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে কল্পনাও করতে পারেনি যে এই ধরনের কোনো যোগ্যতার প্রমাণ তাকে দিতে হবে। সে যে বাঁশি বাজায় সে তো একেবারেই অন্যরকম। যুবকটি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বেদের সামনে। "আর যদি তার না পারো তাহলে এই এলাকা ছেড়ে এই আমার মেয়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেড়ে চলে যাবে সাতদিনের মধ্যেই। না গেলে ওই অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির সঙ্গে বেঁধে রেখে দেব তোমাকে। কেন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ।" — এবার খুব কর্কশ কন্ঠে বলল বেদেটি।

    যুবকটি কয়েক মুহূর্ত নিশ্চুপ হয়ে র‌ইল। তারপর দূরের আকাশে স্থির হয়ে থাকা মেঘের দিকে তাকিয়ে যেন এক পাথরশীতল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করল — "এই কাজের জন্য আমাকে কয়েকদিন সময় দেওয়া যাবে?" বেদেটি বলল — "নিশ্চয়ই। আগামী মাসের পূর্ণিমার রাতে তুমি আসবে। আমার মেয়ের জন্য ওই মালাটা হাতে নিয়ে।"

    যুবকটি চলে গেলে বেদেটি বাড়ি ফিরে সব কথা বললো তার বেদেনী বৌকে। বেদেনী বৌ বললো — "ঠিক বলেছ। বেদের মেয়েকে বিয়ে করার সাধ হয়েছে যখন তখন তো তাকে তার যোগ্য কিনা প্রমাণ দিতে হবে।" বেদেনীর মেয়ে আড়াল থেকে সব কথাগুলো শুনে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল কী ভয়ঙ্কর চক্রান্ত করে তার যুবক বন্ধুটিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে যমের মুখে। তার মনে হলো এর কারণ সে নিজেই। তাই পরের দিন ভোর হতেই সে র‌ওনা দিল ওই যুবকের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর সেই যুবকের সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল — "চলে যাও। তুমি চলে যাও এখুনি। এরা তোমায় মেরে ফেলতে চাইছে। আর কক্ষনো এস না আমার কাছে।"

    যুবকটি ম্লান হেসে বলল — "অত ভয়ের কী আছে? আমি তো বাঁশি বাজাতে জানি।" বেদেনী মেয়েটি যুবকটির হাত দুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো — "এই হাতের বাঁশি দিয়ে তুমি ওই ভয়ঙ্কর সাপকে ভোলাবে? এই হাত দিয়ে তুমি ওই যমদূতকে ধরবে?" তারপর হাউ হাউ করে কেঁদে বলল — "নিজের এতবড়ো সর্বনাশ তুমি করতে যেও না। চলে যাও। আমায় ছেড়ে এই জঙ্গল ছেড়ে চলে যাও এখুনি।"

    যুবকটি বলল — "অত ভেবো না। এখনো কিছুদিন সময় আছে। এর মধ্যে আমি নিজেকে তৈরি করে নেব। তুমি যা ভাবছ তার কখনোই হবে না।" বেদেনী মেয়েটি হাজারবার বারণ করেও যুবকটিকে নিরস্ত করতে পারল না।

    "তোমার বাঁশিটা দাও। আর এরপর তোমার সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে সামনের পূর্ণিমার রাতে।" — এক অদ্ভুত স্বরে কথাগুলো বলে বেদেনী মেয়েটির হাত থেকে সেই সাপুড়ের বাঁশিটা নিয়ে ঘন অরণ্যের আড়ালে চলে গেল ওই যুবকটি। বেদেনী মেয়েটিও চোখের জল ফেলতে ফেলতে র‌ওনা দিল তার বাড়ির দিকে।

    এরপর থেকে প্রতিটি দিন যেন এক পা এক পা করে যমের দুয়ারে যাওয়ার মতো এগিয়ে আসতে লাগল ওই বেদেনী মেয়েটির দিকে। তারপর এল সেই দিন। সকাল হতে না হতেই সেই যুবক বেরিয়ে পড়ল কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে। সেই ঝোলায় তার সাপুড়ের বাঁশিটি। সে চলতে থাকল পুবদিকের গভীর জঙ্গলের পথে। এইভাবে চলতে চলতে সে এসে হাজির হলো সেই অশ্বত্থ গাছটার নিচে। দেখতে পেল সেই গাছের গুঁড়িতে একটা বিশাল গর্ত। যুবকটি বুঝতে পারল যে সে ঠিক জায়গায় এসে পৌঁছেছে।

    চারদিকে গভীর অরণ্যের নিস্তব্ধতা। সকালের আলো চারি দিকের ঘন পাতার ভিতর দিয়ে অল্পই এসে পড়েছে ওই অশ্বত্থ গাছের নীচে। একটা আশ্চর্য আলো-আঁধারিতে যেন স্থির হয়ে আছে গোটা জায়গাটা। যুবকটি তার ঝোলা থেকে সাপুড়ের বাঁশিটি বের করে চারিদিকে একবার তাকাল। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওই অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় গর্তটির দিকে। যেখানে লুকিয়ে আছে তার নিয়তি।

    ঠিক সেইসময় যুবকটি শুনতে পেলো — "কী? তৈরি হয়ে এসেছো তো?" অর্থাৎ সেই বেদেনী-মেয়ের বাবার কন্ঠস্বর। যুবকটি দেখতে পেল তার খানিক পিছনে একটা বিরাট গাছের আড়ালে কঠিন পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই লোকটি। যুবকটি উত্তর দিল — "অবশ্যই।" বেদেটি বলল — "তাহলে আর সময় নষ্ট না করে শুরু করো।" যুবকটি বেদের চোখের দিকে তাকিয়ে খুব নম্রভাবে বলল — "নিশ্চয়ই।" তারপর যেন অতি যত্নে অতি সন্তর্পণে দুহাতে বের করে আনল কাঁধের ঝোলা থেকে সেই বেদেনী-মেয়ের দেওয়া সাপুড়ের বাঁশিটা। তারপর পরম মমতায় হাত বোলালো সেই বাড়িটির গায়ে। যেন সেই বাঁশিটাই তার প্রিয়া।

    আর তার সত্যিকারের প্রিয়া তখন সবার অলক্ষ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ওই ঘন বনের আড়ালে। যুবকটি ওই বাঁশিটি বাজাতে আরম্ভ করলো। সেই সুর যেমন তীব্র তেমন‌ই যেন মাতাল করা। খানিকক্ষণের মধ্যেই ওই গর্ত থেকে বেরিয়ে এল একটা বিরাট কালসাপ। বাঁশির সুরে হেলেদুলে সে তার প্রকাণ্ড ফণাটাকে দোলাতে শুরু করল। বেদেটি এই দৃশ্যটা দেখে নিজের বুদ্ধিকে তারিফ করল মনে মনে। আর নিজের মনেই বললো — “এইতো সবে শুরু। এরপর যা ঘটবে সে তো আমি জানিই।”

    বেদের মেয়েটি কিন্তু এই দৃশ্যটা ‌দেখে ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। আর তখনই মনে মনে ওই যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে বলল — “এইভাবে নিজের যমকে ডেকে আনলে তুমি! তোমাকে শেষ করার পর ওই সাপের ফণাটা যেন আমার উপরেই আছড়ে পড়ে।”

    যুবকটি আপ্রাণ চেষ্টায় বাঁশি বাজিয়ে যেতে লাগল আর সেই কালসাপটা ওই বাঁশির সুরে দোলাতে লাগল তার গোটা শরীরটা। মাথার উপর সূর্যের আলো ক্রমশ তীব্র হতে থাকল। বেদেটি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল। বেদেনী-মেয়েটি একটি গাছের গুঁড়ির উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আর যুবকটি যেন তার নিজের শরীরের সমস্ত প্রাণবায়ু ওই সাপুড়ের বাঁশিটিতে পুরে ছড়িয়ে দিতে লাগল ‌ওই ভয়ঙ্কর সাপটির মুখের সামনে।

    কিন্তু কতক্ষণ? কতক্ষণ চলবে এই মারণ খেলা? কারণ এভাবে প্রতি মুহূর্তে নিজেকে নিংড়ে কতক্ষণ এই বাঁশি বাজিয়ে যেতে পারবে এই যুবকটি? কিন্তু বাঁশিটা বাজিয়ে যেতে তো তাকে হবেই। কারণ বাঁশির আওয়াজ থামলেই ওই ভয়ঙ্কর সাপটি তার বিশাল ফণা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে যুবকটির শরীরের উপর। যাকে আয়ত্তে আনার কোনো ক্ষমতাই নেই তার।

    আর এই ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই জানা আছে ওই বেদেটির। তাই সে অতি নিশ্চিন্তে এই কৌশলটি প্রয়োগ করেছে তার মেয়ের প্রেমিক ছেলেটিকে পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য সরিয়ে দেওয়ার জন্য। ব্যাপারটায় তার বেদে-বৌয়ের‌ও আড়াল থেকে সমান সায় আর উ‌ৎসাহ। আর তাদের একমাত্র মেয়েটিকে সব জেনে বুঝেও অতি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সমস্ত ঘটনাটির সামনে - ভয়ঙ্কর ভবিতব্যের অপেক্ষায়।

    কারণ একসময়ে সেই মারাত্মক মুহূর্তটি তো আসবেই - খানিকক্ষণ বাদে, অথবা হতে পারে বহুক্ষণ বাদে - যখন ওই যুবকটি ক্লান্ত হয়ে যাবে - তার হাত থেকে খসে পড়বে সেই সাপুড়ের বাঁশিটা - আর তখনই - তখনই মুহূর্তের মধ্যে ওই বিরাট কালনাগিনীটি তার বিষধর ফণাটি তুলে আছড়ে পড়বে যুবকটির বুকে। আর বেদেটি সেই মুহূর্তের প্রতীক্ষাতেই উদগ্রীব হয়ে আছে।

    যুবকটি চোখ বন্ধ করে আপনমনে বাঁশি বাজিয়ে যেতে লাগল - কালসাপটি তার সামনে হেলে দুলে নেচে যেতে থাকল - ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসা হলুদ আলো ছড়িয়ে সূর্য বনের পিছনে হেলে পড়তে থাকল –

    কিন্তু কতক্ষণ? এই বাঁশির দম আর কতক্ষণ?

    যতক্ষণই হোক না কেন এই কাহিনীর শেষটা তো অবধারিত। এবং তা মর্মান্তিক।

    আপনি কি সেই অবধারিত মর্মান্তিক মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করবেন?

    অথবা —

    অথবা চলে যাবেন?

    চলে যাবেন নাকি আপনার জন্য যে অপেক্ষা করে আছে তার দিকে?

    কারণ যে আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে সে হলো একটি মুহূর্ত। একটি অবিকল্প মুহূর্ত।

    যে মুহূর্তে বেদেটি হতবাক হয়ে দেখল —

    তার একমাত্র সন্তান মেয়েটি এগিয়ে চলেছে ওই যুবকের দিকে ...

    কিন্তু মানুষের মতো হেঁটে নয় - কেমন যেন আশ্চর্যভাবে হেলেদুলে ...

    বেদেটি আরো ভালো করে দেখতে গিয়ে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না — কারণ সে দেখতে পাচ্ছিল —

    তার মেয়েটি ক্রমশ বদলে গিয়ে একটা বিরাট কালনাগিনী সাপ হয়ে গেল ...

    তারপর ওই কালসাপটির পাশে এসে দুটিতে মিলে হেলেদুলে নাচতে লাগল ওই বাঁশির সুরে...

    বেদেটি এই সবকিছুই দেখতে পাচ্ছিল কিন্তু কিছুই করতে পারছিল না - এমনকি তার গলা দিয়ে সামান্যতম আওয়াজও বেরোচ্ছিল না - নিজের শরীরের কোনো অংশই বিন্দুমাত্র নাড়ানোর ক্ষমতা ছিল না তার--

    কারণ ততক্ষণে সে নিজেই একটা পাথরের স্তূপে বদলে গিয়ে পড়েছিল সামনের ঘাসজমির উপর...

    এরপরেই ওই কালসাপ আর কালনাগিনীটি একসঙ্গে জড়াজড়ি করে চলে গেল ওই অশ্বত্থগাছের গোড়ায় সেই গর্তের মধ্যে... আর সেই যুবকটি?

    সেই যুবকটির জায়গায় সেই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে একটি লম্বা গাছ...

    তার শুধু মাথার দিকটায় এক ঝাঁকড়া পাতা...

    সেই পাতাগুলো যেন উন্মত্তের মতো আছাড়পাছাড় খাচ্ছে উত্তাল হাওয়ায়...

    ওই প্রকাণ্ড চাঁদটির নিচে...

    তখনই একটা আশ্চর্য বাঁশির আওয়াজ ভেসে আসছে ওই ঝাঁকড়া পাতাগুলোর ভিতর থেকে...

    আর গাছটা দুলছে ...

    দুলছে দুলছে দুলছে ...

    ওই বাঁশির আওয়াজে...

    - সেই অবিকল্প মুহূর্তটিতে।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments