অরিন্দমদা!
কি ব্যাপার ডার্লিং? অরিন্দম মুখার্জী কি তোমার ‘প্রিয়’ তালিকায় থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে?
ধ্যাৎ! কি যে বল! ওয়াশরুমে ছিলাম।
হাগছিলি মুতছিলি বললে কি জাত যাবে?
ওঃ! তুমি না একইরকম আগলখোলাই রয়ে গেলে!
আহা! আরেকবার বল্। ওই ‘আগলখোলাই’টা…‘লা’টাকে প্রলম্বিত করে, ‘ই’এর খেয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে...যেন উপেক্ষার অন্তরালে থাকা শান্ত নদীটার পাতলা ঠোঁটের পাপড়ি মুচড়ে সংবেদী চুমু রেখে গেল সকালের হাওয়া। কেঁপে উঠল পাশের ঝোপের অনামী গুল্ম লতারাও। চারপাশ সুরেলা বৃন্দগানের অনুরণনে মুখর হল। নিবিড় মায়ায় রসিয়ে উঠল চরাচর।
অসাম! অরিন্দম দা, সত্যিই শব্দের জাগলারিতে তুমি আজও ইউনিক।
শুধু জাগলারিটাই দেখলি! বালিয়াড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল স্রোত, গভীরগামী আশ্লেষে লিপ্ত হতে হতে ভুলে গেল যাকিছু অবশিষ্ট রাখার কথা ছিল...সেই আর্তিটা বুঝি কিছুই না?
কী যে বল? আমরা কি আর সমকালীন সাহিত্যের অন্যতম স্তম্ভ অরিন্দম মুখার্জীর মত শব্দের লাগাম ধরার লোক! আজকাল বেশ আর্লি রাইজার হয়ে উঠেছ!
তোকেই স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল। বিছানা থেকেই তোকে ফোন করছি।
রিয়েলি! ব্লাশিং!
সন্ধ্যেয় ফ্রি হচ্ছিস কখন?
মোটামুটি সাড়ে ছটা নাগাদ। আসছ? তুলে আনব তোমায়?
অত তাড়াতাড়ি নয়। কিছু কাজকর্ম আছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ পৌঁছব।
ডান। এখানে ডিনার করে যাবে।
#
এবার তো দুটো উপন্যাস, তিনটে কবিতা, দুটো গল্প আর একটা নভেলা আসছে?
তাই নাকি!
মানে! তুমি না অলরেডি অ্যাসাইন্ড?
ধ্যুস্! কিসের অ্যাসাইনমেন্ট? শরীর ভালো না। কিছু লিখতে পারছি না এবার।
কি বলছ!
আচ্ছা আমি কি তোর সাথে এসব আলোচনা করতে এলাম?
না...তবুও...
অরিন্দম আর কিছুই বলতে না দিয়ে সুস্মিতাকে একহাতে টেনে নিল। অপেক্ষমান বরফের টুকরোটা যেন গলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই ছিল...স্রোতকে নিরুদ্দেশের ঠিকানায় পাঠানোর খেলায় বয়ে যেতে শুরু করল দুটো শরীর...দামী স্কচ ততক্ষণে শিরায় শিরায় আগুন জ্বেলেছে...শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের প্রভাব উপেক্ষা করেও স্বেদবিন্দু ফুটে উঠছে সুখারোহী ট্রেকিংয়ে ব্যস্ত শরীরে। শরীর এক্সপ্লোর করার ক্ষেত্রে অরিন্দম বরাবরই এক দুঃসাহসী অভিযাত্রী। ওর লেখার মতই। সুস্মিতা জানেও। তবু মোনোটনি আসে না।
ভোরের স্বপ্নকে সত্যি করতে হয়, নাহলে তার নাজুক তনু ভরে ওঠে অভিমানে। তা কি হতে দেওয়া যায়? দুচোখ বুজে মুখে একটা স্বর্গীয় হাসি মেখে স্বগতোক্তির মত বলা অরিন্দমের কথাগুলো যেন রিনরিন করে বাজতে থাকে সারা ঘর জুড়ে। ওর রোমশ বুকের ওপর উপুড় হয়ে থাকা সুস্মিতা আধো গলায় জিজ্ঞাসা করে, এবার তুমি সত্যিই লিখছ না?
অরিন্দমের হাসি রহস্যময় হয়ে ওঠে।
পুজোসংখ্যার চার্মটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে, অরিন্দমদা।
তা কেন? আর সবাই তো লিখছে। একসময় কলম তুলে রাখতে হয় রে। নাহলে পুরোনো খ্যাতির ঘিয়ে ব্যর্থতা ভাজতে হবে। তোদের সো কল্ড প্রথিতযশারা যা লিখছে...
সুস্মিতা বুঝতে পারে অরিন্দম কি মিন করতে চাইছে। ও না বোঝার ভান করে কিশোরীর মত আদুরে গলায় বলে, কম লেখো, তবু একেবারে অফ হয়ে গেলে তো সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড হবে অরিন্দমদা। কাল ফাইনাল নোটি বেরোনোর কথা।
তোর প্রবলেমটা কোথায় বলতো?
আমিই এবার পুজোবার্ষিকীগুলোর অ্যাডভাইসরি বোর্ডের চেয়ারপার্সন। আর এবারই তুমি...
অরিন্দম মনে মনে বলল, তোদের এলিট স্যোসাইটির কত মেয়ে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের সাথে একরাত শুতে পেলে বর্তে যায়। তুই তার সাথে চালাকি করে বেরিয়ে যাবি, তা কি হয় মামনি!
কিন্তু মুখে কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সুস্মিতাকে আষাঢ়ের মেঘের মত ভরাট এক চুম্বনে পিষে দিতে দিতে বলল – ‘স্থিতি মুছে গিয়ে কিছুই থাকার মত অর্জিত নেই/ বিশ্বস্ত মুহূর্তের কাছে কোজাগর আশরীর ঋণ/প্রতিটি আঁচড়ে বৃত লগ্ন হয়ে থাকার দ্যোতনা’ মনে আছে?
সুস্মিতা মাথা নাড়ল, যার অর্থ ভীষণভাবে মনে আছে।
অ্যাডভাইসরি বোর্ডের চেয়ারপার্সনকে কনগ্র্যাটস! ইন ফ্যাক্ট তোর থেকে ট্রিটটা আমিই প্রথম নিলাম সম্ভবত! কাল মেল করে দেব। ডোন্ট ওরি।
অরিন্দম ঠোঁটে একটা হাসি রেখে লিফটে ঢুকে যেতেই সুস্মিতা ঋতমকে ধরল। ঋতম রিসিভ করল রেকর্ডিং মোড অন করে।
#
বিগ হাউস তো। তোমার ওপর চাপ আসবে কিন্তু। পারবে তো সামলাতে?
সিদ্ধার্থ প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালো, উইল ট্রাই মাই বেস্ট, দাদা।
চেষ্টা নয়, সিদ্ধার্থ। পারতেই হবে। অ্যাডের স্টেটমেন্ট আমিই লিখে দেব। আর প্রচার এমনভাবে করতে হবে যে ওখানেই বাজিমাত করতে হবে। কোনভাবেই লিক করা যাবে না ‘ইন্দ্রজিৎ’ ছদ্মনামে কে লিখছে। ঋতমের নাম্বারটা রইল। হি ইজ অ্যান এফিসিয়েন্ট গাই।
অরিন্দম বেরিয়ে এল ‘সংবাদ’-এর অফিস থেকে। গাঢ় বেগুনী রঙের হুডি জ্যাকেট, ক্রীম কালার ট্রাউজার্স ও রে-ব্যান সানগ্লাসে অরিন্দমকে একঝলক দেখে চিনবে কার সাধ্য! তার ওপর এক বন্ধুর গাড়ি নিয়ে এসেছে। কিন্তু যখন গাড়িতে উঠছে, রাস্তার উল্টোদিকে বহুতলের সাত তলার জানলা থেকে একজোড়া সন্ধানী চোখে ঠিকই ধরা পড়ে গেল নকল সাজ।
অরিন্দম মুখার্জী ‘সংবাদ’এর অফিস থেকে বেরোল। কি ব্যাপার বস্?
ডোন্ট বি ফানি। কাকে দেখতে কাকে দেখেছিস। ডেসক্রিপশন দে।
পোশাক ও গাড়ির ডেসক্রিপশন শুনে ফোনের ওপারে হাসির ফোয়ারা ছুটছে। তোর মাথাটা খারাপই হয়ে গেছে। এই এপ্রিলে চিরকাল হাফশার্ট-পরা মানুষটা পরবে হুডি জ্যাকেট! তাও ডিপ ভায়োলেট! রিয়েলি ইয়্যু আর ক্রেজি! আর মাইনাস পাওয়ার ছেড়ে রে-ব্যান! হ্যাজাস না। আমার প্রচুর কাজ আছে।
কিন্তু সুস্মিতার খটকাটা গেল না। চার্লির কাছে অলওয়েজ পাক্কা ইনফর্মেশন থাকে। সুস্মিতা আবার রিং ব্যাক করল। সুইচড অফ। ইতিমধ্যে ডঃ সুদর্শন বসুর ফেবু নোটি চলে এল। বিখ্যাত সাহিত্যিক অরিন্দম মুখোপোধ্যায় ডঃ বসুর চেম্বার থেকে বেরোচ্ছেন। সাদার ওপর আকাশী কালারের স্ট্রাইপড হাফ শার্ট ও ব্ল্যাক ট্রাউজার্স, চোখে রিমলেস গ্লাসের অরিন্দমদা! চার্লি, সত্যিই ভুল দেখেছিস রে।
সুস্মিতা ডঃ বসুকে ফোনে ধরল, কি হয়েছে সুদর্শনদা?
কেন তুমি জানো না?
কি?
অরিন্দমকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে এসেছিস, কেউ জানে? বলল, শুধু সুস্মি জানে।
কি হয়েছে?
প্যাংক্রিয়াসে একটা ক্রিটিকাল ইনফেকশন পাওয়া গেছে। ওকে বলিনি, তোমায় বলি, ইট মে বি ক্যানসারাস।
ও মাই গড!
আমিই তোমাকে কল করতাম। আমার এক বন্ধুর নার্সিংহোমে অ্যাডমিটেড হতে বলেছি। কোয়াইট আউটস্কার্ট। এখানে মিডিয়া আসবে, ক্রাউড হবে - ট্রিটমেন্ট ডিসটার্বড হবে। তবে তোমাকে পার্সোনালি আমি আপডেট দিতে থাকব।
সুস্মিতা এরপরই অরিন্দমকে ফোনে ধরল। তুমি সুদর্শনদাকে বলেছ যে আমি জানি?
অরিন্দম হাসতে হাসতেই বললেন, আরে ডাক্তারদের কাছে একটু-আধটু মিথ্যে বলতে হয়। জানিস সুস্মি, এভরিথিং ইজ আনসার্টেন। তাই তোর সাথে দেখা করে এলাম সেদিন।
প্লীজ শাট আপ। প্লীজ! এখন কোথায় আছ?
আছি এক জায়গায়। একা। তুই আসতে চাস না। তোকে না বলতেও আমার খারাপ লাগবে, আবার এলেও...
#
বসের সঙ্গে শুলে প্রোমোশন তাড়াতাড়ি হয়, কে না জানে। সুস্মিতা সুন্দরী, বিদূষী, বুদ্ধিমতী - ও জানবে না!
ঋতম বুঝতে পারে অরিন্দম বেশ টিপসি হয়ে পড়েছে। চরিত্র বাঁকাত্যাড়া হলেও শুধু লেখার জন্যই অরিন্দমদার প্রতি ভালোবাসা এক জীবনে ফুরোয় না। কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং আরো অজস্র মিলিয়ে সৃষ্টির এই অফুরান সম্ভার যেন আশ্চর্য করে দেয়। গোটা দুনিয়া জানে ঋতম অরিন্দমের খাস চ্যালা। আজ যখন সুস্মিতার রেকর্ডেড ভয়েসটা ও শোনাচ্ছিল, অরিন্দমের মুখে ফুটে উঠেছিল এক চিলতে ধারালো হাসি।
আচ্ছা অরিন্দমদা, সুস্মিতা তোমার একজন স্পেশাল অ্যাডমায়ারার, এ তো ওপেন সিক্রেট। ওর ওপরে তোমার রাগটা কিসের?
রাগ! শুধু রাগ বললে বোধহয় সবটা বোঝানো যায় না। আমি হাউসের সবচেয়ে পুরোনো লোক। এত দিন ধরে কোত্থাও লিখিনি। নওলকিশোরের বাপের আমল থেকে আছি। এরা আমাকে অনেক দিয়েছে। ইন রিটার্ন আমিও কি কম দিলাম এতদিন ধরে? এখনো আমার বই কলেজ স্ট্রীটে দীর্ঘ সময় ধরে বেস্ট সেলার থাকে। শারদীয়া সংখ্যায় লিখছি কিনা জানতে চেয়ে ফোন আসে পাঠকের। বইমেলায় যেদিন স্টলে থাকি, সেদিন সেরা বিক্রি হয়। এসব তো তোদেরই ডেটা। সাহিত্য আকাদেমী, আনন্দ, রবীন্দ্র এবং আরো অজস্র পুরস্কারের পর অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ব্র্যান্ড ভ্যালু নেহাত কম নয়, এটা তো মানবি? যদি এটা অহঙ্কার বলিস সেটা তোদের ভিউ, আমি বলি আমার ইন্সপিরেশন। রোজ সকালে যখন লিখতে বসি, এই শক্তিই আমাকে আরো ভালো লিখতে বুস্ট আপ করে। আর যেদিন আমার লেখা নিজেরই পছন্দ হবে না, সেদিন বন্ধ করে দেব। চর্বিতচর্বণ করব না, সেল্ফ কমিটমেন্ট।
‘রাশভারী পাহাড়, লঘুছন্দে হাওয়া, স্নানঘরের আকাশ, অফুরান আলোর একঘেয়ে আবর্তে/তুমিই উন্মোচনের কারণ হ’লে যুগে যুগে জন্মসম্ভব হয়.../এসব বোঝনি ব’লে রাজকীয়তা ইতিহাসের পৃষ্ঠাতেই রয়ে গেল’...
‘মায়াবী রাতের ঈশ্বর’...আহা! অরিন্দমদা, তোমার সেরা সৃষ্টি, আই থিংক। তুমি বোধহয় মূল প্রশ্ন থেকে সরে গেলে।
বলছি। বেহেড হয়ে গেছি ভাবছিস?
কি যে বল!
নন্দনকিশোর যখন ছেলেকে এম.ডি. করবে ঠিক করেই ফেলেছে, একদিন আমাকে, বাপ্পাদাকে আর ঋতাকে ওর চেম্বারে ডাকল। ওদের মধ্যে এটা আছে। নেক্সট জেনারেশনের হাতে ব্যবসা তুলে দিয়ে ট্রাডিশন কনটিনিউ করে যেতে চাওয়া। নন্দনদার বাবা যদিও এ ব্যবসায় ছিল না। যাইহোক সব শুনে বাপ্পাদা বলল, নন্দন তুই যদি একেবারে সরে যাস, তাহলে কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান আর থাকবে না। ওর মাড়োয়ারী রক্তে ব্যবসাটা থাকলেও বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের কাছের লোক হয়ে ওঠার আর্জটা তো নেই, যেটা অ্যাবনর্মালি তোর মধ্যে ছিল। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই নওল ওর কাছের লোকদের আননেসেসারি প্রায়োরিটি দিতে শুরু করবে। পুরোনোদের সাথে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
পুরোনো দিনের কথা তুই কি বলেছিস নওলকে? কফি হাউসে বসে আমি আর সৌমেন্দু একটা পত্রিকা করার কথা আলোচনা করছি কিন্তু টাকা যোগাড়ের চিন্তায় ডুবে আছি, পাশের টেবিল থেকে তুই উঠে এসে বললি, আমি ফাইনান্স করব। সেই পথচলা শুরু, তারপর আস্তে আস্তে আজ এ জায়গায় এসে পৌঁছনো। নওল এসব জানতে ইন্টারেস্টেড নয় বোধহয়। ব্যবসার সঙ্গে প্যাশন থাকাটা যে কতটা দরকার, এ তোর চেয়ে ভালো কে জানে, নন্দন?
“আমার আর কিছু করার নেই, বাপ্পা।“ নন্দনকিশোরের বাপ্পাদাকে বলা সেই কথায় যে শূন্যের প্রতিফলন ঘটেছিল, তা থেকে যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলাম আমরা। এরপর বাপ্পাদা আর ঢোকেনি এখানে। আশ্চর্যভাবে অন বিহাফ অফ অথরিটি কোন প্রশ্নও তোলা হয়নি।
নওল এসেই কিন্তু আমাকে ঘাঁটালো না। প্রথমদিন ওর সাথে মিটিংয়ে আমি ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমায় কি তোমাকে ‘স্যার’ ডাকতে হবে? চালাক ছেলে তো! হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলেছিল, না না আপনি বাবার বন্ধু। আমায় নাম ধরেই ডাকবেন। তবুও আমার আসাটা কমে গিয়েছিল। দায়িত্ব ঠিকই সামলে গেছি। লেখাও চলছিল। পেমেন্ট নিয়েও কোন ঝামেলা হয়নি। শুধু নন্দনদার ঘরে দুপুরের আড্ডাগুলো মিস করতাম।
হঠাৎ একদিন সুস্মিতা ফোন করল। অরিন্দমদা, তোমায় রবিবারের গল্প সেকশনের এডিটর পোস্টে আনা হচ্ছে। নওল আসার পর থেকে সবাইকে টপকে সুস্মিতা যে সেকেন্ড পজিশনে চলে গেছে, এ তো হাউসের সবাই জানে। প্রায় সব ব্যাপারে ও তখন অনেক ডিসিশনই নিচ্ছে। ঋতাকে ‘নারী’ থেকে সরিয়ে ‘কুসুম’এ নিয়ে আসা, বাপ্পাদার জায়গায় অতনুকে আনা, ‘স্বদেশ’কে মান্থলি থেকে ফোর্টনাইটলি করা সবকিছু তো সুস্মিতারই ইনফ্লুয়েন্স। তোকে হয়ত জানাতো, কিন্তু সাজেশন নিতে নয়। ঠিক বললাম কি? ঋতম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো, যার মধ্যে স্পষ্ট একটা যন্ত্রণার ছাপ।
যাইহোক আমি ওকে বললাম, দুটো ম্যাগের দায়িত্ব দিয়েও আরো চাপাবি? বুঝিসই তো আমার লেখালেখি হ্যাম্পার্ড হয় এতে।
আসলে অরিন্দমদা, ডোন্ট টেক ইট আদারওয়েজ, ফ্রম দ্য বিজনেস পার্সপেক্টিভ, দ্য হাউস থিংক্স ইয়্যু আর মাচ হাইলি পেইড। কি আর বলি!
নাঃ! কিছুই বলার নেই, ঠিকই বলেছিস।
জীবনে এত বড় ধাক্কা খাইনি, জানিস। নিজে হাতে যাকে লেখা শেখালাম, এডিটিং-এর নাড়িনক্ষত্র যার আমার কাছেই শেখা, এমনকি সাক্ষাৎকার নেওয়ার বেসিকও যে আমার কাছ থেকেই শিখল, সে আমাকে বিজনেস পার্সপেক্টিভ দেখাচ্ছে! ও যদি স্ট্রেটওয়ে নওলের এক্সকিউজ দিত, আমার এতটা লাগত না, কারণ বিলেত-ফেরত গাধাটা এমন বলতেই পারে। কিন্তু ‘হাউস’ কথাটায় এমন এক মগ্নমায়া আছে, এমন এক স্মৃতি রোমন্থনের মেদুর বারান্দা আছে, যে আমি এই শব্দটা সারা জীবনের অভিধানে রেখে দিয়েছি। এই হাউসের সাথে আমার সম্পর্ক...শব্দে কুলোয় না! আর সুস্মিও যেহেতু হাউসের বিশেষ একজন, তাই আমি এটা নিতে পারিনি রে, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং। এই ডিসিশনে ওরও যে সায় ছিল, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
তুমি যথেষ্ট আহত হয়েছিলে, জানি।
আসলে এক জীবনেই সব দেনাপাওনার হিসেব মিটিয়ে যেতে হয়। সাহিলকে আচমকা একদিন বলা হয়েছিল, এবার শারদীয় ‘স্বদেশ’এ ওর উপন্যাস থাকবে না, ওটা আসবে ‘নারী’তে, ও উপন্যাসটা মাঝপথে থামিয়ে দেয়। তারপর জার্মানী চলে গেল। দেবযানীকে যেদিন ‘শনিবারের পাতা’র ‘রান্না’র দায়িত্ব দেওয়া হল, ও কেঁদে ফেলেছিল। ‘স্বদেশ’-এর কবিতাবিভাগ ওর সম্পাদনায় যে স্ট্যান্ডার্ডে উঠেছিল, সেই স্টেটাস আর রাখতে পারল কই। দেবযানী কয়েক মাসের মধ্যেই হাউস ছেড়ে দিয়ে শিক্ষকতায় ফিরে গেল। এখন তো ইউনেস্কোর কোর কমিটি মেম্বার হয়ে বোস্টনে থাকে শুনেছি।
বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্ত যে পার্শিয়ালিটি শুরু করেছিলেন, আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। তখন একমাত্র আমিই এ সবকিছুর কারণ জানতে চাইতে পারতাম নন্দনদার কাছে। বলতে পারতাম, বাপ্পাদা ভুল করছে, তুমি স্টেপ নেবে না? কিন্তু বন্ধুদের অপমানের সময় নিজেকে স্বার্থপরের মত সুরক্ষিত করতে চেয়েছি। টুঁ শব্দ করিনি। সাহিলের সময় কুড়ি দিনের ট্যুরে রাজস্থান চলে গেছিলাম। আর দেবযানীর সময় তো প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল পোয়েটস মিট-এ ভারতের প্রতিনিধি।
‘আঘাত আমার পাওয়ার কথাই ছিল/আঘাত আসুক আরক্তনীল খামে/আঘাত যেন অপেক্ষমান খেয়া/আঘাত আলিঙ্গনের কাছে থামে’...অরিন্দমের বুক মুচড়ে কি এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল! ঋতমের মনখারাপ হয়ে যায়। ‘একা কিংখাব’ কাব্যগ্রন্থের এই বিখ্যাত কবিতাটির নাম ছিল ‘বালিঘড়ি’!
অরিন্দমদা, চল আজ ওঠা যাক।
এবার একটা আজব খেলা ঘটবে।
তোমার মেইল নিয়ে তো আজ হৈচৈ পড়ে গেছে। অরিন্দম মুখোপাধ্যায় শারদীয়া সংখ্যায় লিখছেন না, স্মরণাতীত কালে তো এমন ঘটনা ঘটেনি! সুস্মি বুঝতে পেরেছে বিপদ আসন্ন। একে কমপেনসেট করার মত বিকল্প ওর হাতে ইনস্ট্যান্ট নেই। জানার পর নওলের প্রথম জিজ্ঞাসা, অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের এগেনস্টে লিগাল স্টেপ নেওয়া যায় কিনা। যখন জানানো হল ডক্টর্স প্রেসক্রিপশন অ্যাটাচড মেইলটা এসেছে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই। ও চোখটা ছোট করে কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বলেছিলো, হাউ ডিড ড্যাড রিলাই অন দিস ইরেসপন্সেবল এলিমেন্টস? সুস্মি চুপ...মাথা নীচু...
বাই দ্য ওয়ে তুমি নার্সিংহোমে ভর্তি হচ্ছ কবে, অরিন্দমদা?
উত্তর না দিয়ে অট্টহাসিতে বিশাল শরীরটা কাঁপিয়ে অরিন্দম মুখোপাধ্যায় বেরিয়ে যাচ্ছেন পানশালার স্যুইং ডোর ঠেলে...ঋতম ছুটল পেছন পেছন। সবকটা চোখ এদিকেই তাকিয়ে। ঋতমের মনে হল কোন মোবাইলের ক্যামেরায় দৃশ্যটা বন্দী হয়ে রইল না তো!
‘নিয়ন আলোর রোশনাইয়ের নীচে শহরেরও কি এমন একটা লুকোনো মনখারাপের নদী আছে?’ ওঃ অরিন্দমদা!
#
আচ্ছা সুদর্শন, আমার সব কথা তুই শুনছিস কেন?
মানে!
মানে এ তো তোর এথিক্সের বিরোধী। আমি শালা একটা পার্ভার্টেড মাতাল। আমাকে এত ভালোবাসা দিয়ে ঋণী করছিস কেন? ফেরাতে পারব না তো।
ফিরিয়ে তো দিয়েছিস অলরেডি। ‘যতটুকু দৃষ্টিগ্রাহ্য ধরে নাও ততটাই দুঃখের মাপ। বাকিটা বাষ্প হয়ে থেকে গেছে ভেতরে কোথাও। প্রার্থিত উষ্ণতায় বাষ্পীভূত হওয়ার কথা থাকে। সেই উষ্ণতার খোঁজে এক জীবন কেটে যায়...কয়েক জীবন কেটে যায়। বাষ্পের জীবাশ্মছাপ আঁকা হয়ে ওঠে পাথরের বুকে। ক্ষয়ের নিক্তি মেপে প্রস্তরীভূত প্রণয়পরিধি সময়ের বহু বাঁক পার হতে হতে চলে যায় উদ্দেশ্যবিহীন অভিমুখে। এভাবেই ছোঁয়াচের কারণ হয়ে উঠে দুঃখ মুছে আসার বোধের গভীরে কখন যে তলিয়ে যাওয়া...খেয়াল থাকে না।’
তুই ‘সীমানা ছাড়িয়ে’ উপন্যাসের এই অংশটা মোবাইলে রেখে দিয়েছিস!
মাঝেমাঝেই পড়ি। এগঝস্টেড স্টেট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এ আমার কাছে ম্যাজিকাল হিলারের মত কাজ করে। অবাক হয়ে যখন ভাবি এই লেখা আমারই প্রিয় বন্ধুর, অরিন্দম, আই ফিল মাইসেল্ফ প্রাইজড। আর তাছাড়া যে কারণে তুই এই ছলচাতুরী করবি বলে ডিসাইড করেছিস, আমি তাকে মরাল সাপোর্ট দিচ্ছি। সে জন্যই এথিক্সের প্রশ্ন আসছে না।
‘তোর হাতের লাটাই থেকে আমার সুতোর টানে যে ঘুড়িটা উড়েছিল/সে চেনে একটাই আকাশ...উন্মুক্ত হাওয়ায় ভেসে যাওয়া/বন্ধুতা নামে শব্দটির জন্মসম্ভব হয়ে উঠছে।’ অরিন্দম নিজের মনেই বলে উঠল।
কাল ঠিক সময়ে চলে আসিস। গাড়ি পাঠাব। শুধু মোবাইলটা আনবি। ওখানে বাকি সব ব্যবস্থা থাকবে। অরিন্দম হেসে কাঁধ ঝাঁকালো।
পরদিন সাড়ে সাতটায় গাড়ি এল। অরিন্দম একটা ছোট্ট কাঁধব্যাগে টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র ভরে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসল। যেতে যেতেই সিমটা বদলে নিয়ে সুদর্শনকে হোয়াটসঅ্যাপ করল ‘আমার নতুন নাম্বার’। দশটা নাগাদ পৌঁছে গেল গন্তব্যে। দারুণ একটা রিসর্ট। খোলামেলা, পরিচ্ছন্ন, প্রকৃতির মাঝেই। একটা ল্যাপটপ রয়েছে উইথ মেল ফেসিলিটি। প্রিন্টার, স্ক্যানার এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের, দেওয়াল আলমারিতে প্রচুর বই।
অরিন্দম নতুন জিমেইল আইডি খুলে সিদ্ধার্থকে মেল করল – ‘কষ্ট করে নজরটাকে একবার ঘোরান।’ সঙ্গে লিখে দিল এটা প্রথম ক্যাচলাইন। সারা শহর ভরিয়ে দাও, প্রিন্ট মিডিয়া, সোসাল মিডিয়া ছেয়ে ফেল। শুধু এই কথাটুকু। ‘বার্তা’তেও যেন যায় অ্যাডটা।
সিদ্ধার্থ কাজের ছেলে। বিনা চেষ্টায় জয়ের গন্ধ পেয়ে ও ক্যাচলাইনটা দারুণভাবে প্রজেক্ট করল।
সুস্মিতা অরিন্দমকে ফোনে পাচ্ছে না। সুদর্শনকেই কনট্যক্ট করে। সুদর্শনও ডে-ওয়াইজ রিপোর্ট দিতে থাকেন। ‘বার্তা’র সবকটি শারদীয়া সংখ্যার অ্যাড এসে গেছে মার্কেটে। এবার অ্যাডে বৈচিত্র্য এসেছে। লেখা হচ্ছে ‘দিকপালদের সঙ্গে রয়েছেন এইসব তরুণ কলম’ ব’লে একঝাঁক তরুণ লেখক-লেখিকার নাম। বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ প্রতিষ্ঠানটি যেন অখ্যাত প্রতিভা তুলে আনার কাজে ব্রতী, এমন একটা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার মরীয়া চেষ্টা। কিন্তু এরপর ইনকামিং টেলিফোন কলগুলোয় শুধু একটাই জিজ্ঞাসা ‘এবার অরিন্দম মুখোপাধ্যায় লিখছেন না?’ সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গেল - ‘অরিন্দম মুখোপাধ্যায় এবার ‘বার্তা’র কোন শারদীয় সংখ্যায় নেই’।
বাধ্য হয়ে নতুন অ্যাড এল –‘প্রখ্যাত সাহিত্যিক অরিন্দম মুখোপাধ্যায় গুরুতর অসুস্থ। সে কারণে তিনি চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রামে আছেন। প্রিয় পাঠক, আপনি অবগত, প্রতিষ্ঠার দিন থেকে ‘বার্তা’ কখনো মানের সঙ্গে আপোস করেনি। অতিমারীর দিনগুলিতেও আমরা প্রিন্ট মিডিয়ার বদলে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি। প্রতিশ্রুতি রইল এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না।’
#
‘সংবাদ’-এর বিভিন্ন পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যা নতুনভাবে সেজে উঠল ‘ইন্দ্রজিৎ’ লিখিত দুটটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস, তিনটি কবিতা, দুটি বড়গল্প আর একটি নভেলায়।
দ্বিতীয় ক্যাচলাইন এল –‘যা হারিয়ে গিয়েছে ভাবছেন, তা হয়ত রয়েছে কাছেই কোথাও।’
মহালয়ার অনেক আগেই ‘সংবাদ’-এর পাঁচটি শারদীয় সংখ্যা একসাথে লঞ্চ করল মার্কেটে। ‘বার্তা’র এত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্যে যা কখনোই হয়নি। সংবাদপত্র বিক্রেতাদের কমিশন এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হল যে তারা ‘সংবাদ’-এর শারদীয় সংখ্যাগুলি বিক্রির ব্যাপারেই বেশি উৎসাহী হয়ে পড়ল।
কিভাবে যেন লুকিয়ে রাখতে চাওয়া তথ্য প্রকাশিত হয়ে পড়ল যে ‘ইন্দ্রজিৎ’ ছদ্মনামে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ই লিখেছেন। অ্যাডভার্টাইজিং, মার্কেটিং ও কনটেন্ট-এর ত্রিফলা অপ্রত্যাশিত আঘাতে ‘বার্তা’র শারদীয় সংখ্যাগুলির ব্যবসা বিধ্বস্ত করে দিল। পাঠক মহলে ইন্দ্রজিতের লেখায় অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ছায়াকে আবিষ্কার করে জল্পনা ঘনিয়ে উঠল যে, অরিন্দম মুখোপাধ্যায় ‘বার্তা’ ছেড়ে ‘সংবাদ’-এ এসেছেন।
হ্যালো। দিস ইজ সুস্মিতা রায়চৌধুরী ফ্রম বার্তা গ্রুপ অফ কমিউনিকেশন্স। মে আই স্পিক টু মিস্টার সিদ্ধার্থ ভট্টাচারিয়া?
প্লিজ হোল্ড দ্য লাইন ম্যাম।
স্যার ‘বার্তা’ থেকে সুস্মিতা রায়চৌধুরী লাইনে আছেন। দেব আপনাকে?
সন্ধ্যে সাতটার পর কল করতে বল।
হ্যালো ম্যাম, স্যার একটা ইমপরট্যান্ট মিটিংয়ে আছেন। আপনি সন্ধ্যে সাতটার পর কল করুন প্লীজ।
ইটস ওকে।
পরের ফোনটা করল ডক্টর সুদর্শন বাসুকে। সুদর্শনদা, চেম্বারে? আসছি ঘন্টাখানেকের মধ্যে। একটু সময় হবে তো?
সুদর্শন রিসেপশনে ফোন করে জানালো, এই মুহূর্ত থেকে নিয়ম হল ফোন নিয়ে কেউ চেম্বারে ঢুকবে না। সে যেই হোক। অ্যারেঞ্জ ইট ইমিডিয়েটলি।
সুস্মিতা চেম্বারের বাইরে থেকে জানতে চাইল, ফোন কি সত্যিই রেখে ঢুকতে হবে, সুদর্শনদা?
প্লীজ, মাই ডিয়ার।
সুদর্শনদা, পেশেন্ট কেমন আছে জানতে আমি আসিনি। তুমি শুধু বলে দিও আমাদের জেনারেশনটা কিন্তু ওঁর লেখাতেই বেড়ে উঠেছি। সে লেখার ঘ্রাণ বোধহয় লুকিয়ে রাখা যায় না।
সুদর্শনের বুকপকেটে মোবাইলের রেকর্ডিং মোড অন করে রাখা। সুদর্শন বললেন, আর কিছু বলব না তো?
নাঃ, আর কি রইল বলার মত?
‘জানতে চাইছো ও বলতে চাইছির মাঝখানে যে ফাঁকটুকু/সেখানেই আমাদের কথোপকথনের সারসত্য বিমূর্ত হয়ে আছে’ সুদর্শন বলে উঠলেন সুস্মিতার চোখে চোখ রেখে।
‘এরপর জানতে ভুলে গেছো, আমিও বলতে ভুলে গেছি/তবু পার পেয়ে গেলাম/ভাগ্যিস নৈঃশব্দটুকু ছিল...’ সুস্মিতা খেই ধরল যেন এক সম্মোহিত ঘোরে। থেমে যাওয়ার পর ও চোখ বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ।
এই স্তরের কবি, লেখককে বোধহয় নিছক লেনদেনের মাপকাঠিতে মাপা যায় না। তাই না? সমকালীন সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ল্যান্ডমার্ককে পজেস করাই তো একটা বিরাট ব্যাপার।
সুদর্শনের কথায় সুস্মিতা চমকে উঠল। কিছুই বলল না। চুপ করে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সুদর্শন রেকর্ডিংটা হোয়াটসঅ্যাপ করল অরিন্দমের নতুন নাম্বারে।
#
দাদা, বইমেলায় উপন্যাস দুটো বই করছি?
কর।
বলছিলাম, একটা ছোটগল্প সংকলনের ইচ্ছে ছিল।
দেব।
সিদ্ধার্থ বুঝতে পারছে অরিন্দম কেমন যেন দায়সারা গোছের উত্তর দিচ্ছে। ও জিজ্ঞাসা না করে পারল না, আপনার কি শরীরটা ভালো নেই, দাদা?
প্লিজ কল সুদর্শন...আর কোন শব্দ নেই ফোনে।
সিদ্ধার্থ গাড়ি বের করেই হু-হু করে ছুটল। যেতে যেতেই ডক্টর সুদর্শন বসুকে ফোনে যতটা সম্ভব ব্যাপারটা বলল। ঋতমকেও জানালো।
সিদ্ধার্থ জ্যামে আটকে পড়ায় ঋতম ও সুদর্শন আগেই পৌঁছেছেন। অ্যাটাক হওয়ার পর গোল্ডেন মোমেন্টস পেরিয়ে যাওয়াটাই ডিসিসিভ ফ্যাক্টর হয়ে যেতে পারে, সুদর্শন চিন্তিত ছিলেন এ নিয়েই। নিজের নার্সিংহোমেই নিয়ে গেছেন প্রিয় বন্ধুকে এবং অন্যান্য কার্ডিওলজিস্ট বন্ধুদের এসে দেখে যেতে অনুরোধ করেছেন। কিন্তু যখন মহাদেশের অন্যতম সেরা কার্ডিওলজিস্ট ডক্টর কৌশিক সেন বলে দিলেন, জাস্ট ফর ফিউ আওয়ার্স...সুদর্শন বুঝে গেলেন অরিন্দম না-ফেরার দেশের দিকে পা বাড়িয়েছে…
ঋতম সুস্মিতাকে জানিয়েছিল। কিন্তু সুস্মিতা এসে পৌঁছনোর আগেই সব শেষ। অকৃতদার মানুষটার কেউ ছিল না বললে ভুল বলা হবে। মিডিয়া এবং সোসাল মিডিয়া মারফত খবরটা জানাজানি হয়ে যেতেই অনুরাগী, পাঠকদের ঢল নেমেছিল। সরকারের তরফে জানানো হল, প্রখ্যাত সাহিত্যিকের মরদেহের পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সুদর্শন বাধা দিতে পারলেন না।
#
‘বার্তা’র কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন ‘স্বদেশ’-এর বিশেষ অরিন্দম মুখোপাধ্যায় শোকসংখ্যা বেরোবে। নওলকিশোর আগরওয়াল এই সংক্রান্ত বৈঠকে বললেন, মিঃ মুখার্জী লাস্টলি আমাদের সঙ্গে যা করেছেন, তাতে ওনাকে নিয়ে স্পেশাল ইস্যু করার একদমই ইচ্ছে আমার নেই। বাট বিজনেস ম্যাটার্স। সো দিস ইস্যু উইল হ্যাভ টু বি দ্য মোস্ট এক্সক্লুসিভ। লেটস পুট ডাউন ‘সংবাদ’ দিস টাইম। সুস্মিতা তুমিই তাহলে এই দায়িত্বটা নাও।
স্যার, আই থিংক ঋতম ইজ দ্য পারফেক্ট ওয়ান ফর দিস। অল অফ আস উইল কোঅপারেট উইথ হিম। নওলকিশোর রাজি হয়ে গেল।
ঋতমকে স্পেশাল ইস্যুর চিফ এডিটর করা হল।
কেস খাওয়ালি তো? আগে একবার জানালি না পর্যন্ত? ঋতম সুস্মিতাকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
আমি এসব কিছুই জানতাম না। বিশ্বাস করবি কিনা তোর ব্যাপার।
আর্কাইভ ঘাঁটা শুরু হল। সমসাময়িক লোকজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া চলতে লাগল। ডক্টর সুদর্শন বসু লেখা দেবেন জানালেন। প্রিয় অরিন্দমদাকে নিয়ে ঋতমের স্মৃতিচারণ পড়ে সুস্মিতা কেঁদে ফেলল।
আমি কি লিখব, ঋতম? কতটা লিখব? এখনো পর্যন্ত শুরুই করতে পারিনি। পারছি না রে।
তুই লেখা না দিলে দৃষ্টিকটু হবে, সুস্মি। প্লীজ ট্রাই। স্কেলিটনটা খাড়া করে দে, তারপর আমি দেখছি।
বিজনেস ম্যাটার্স! বাস্টার্ড!
ঋতম অবাক হয়ে তাকালো সুস্মিতার দিকে। ও যেন একটা চেনা মেঘকে আবার আকাশ ছেয়ে ফেলতে দেখছে। বৃষ্টি হতে পারে!
#
অরিন্দমদাকে নিয়ে আপনাদের বিশেষ সংখ্যার কাজ কতদূর এগোল?
এই চলছে আর কি। সবাই রিসার্চ ওয়ার্কটা খুব ভালো করছে। সাহিল আনোয়ার এবং দেবযানী তরফদারও লেখা দেবেন বলেছেন। আপনারা তো ওঁদের অফার করেননি শুনলাম।
না, করা হয়নি। আমি এসেছি একটা বিশেষ ব্যাপারে আপনাকে রিকোয়েস্ট করতে। সু্স্মিতা কাতর গলায় বলল সিদ্ধার্থকে।
বলুন।
অরিন্দমদার সঙ্গে আমার একটা সুন্দর সম্পর্ক ছিল। হয়ত শুনে থাকবেন। অরিন্দমদার বেশ কয়েকটা লেখা আমার কাছে আছে। এই লেখাগুলো কোন সংকলনেই নেই, কারণ উনি চেয়েছিলেন এগুলো শুধু আমার কাছেই থাকুক। কিন্তু আজ যখন মানুষটা নেই, আমার মনে হচ্ছে পাঠক এই অপ্রকাশিত লেখা পড়ুন। কবিকে নাহয় আমি আরো একটু উন্মোচিত করলাম। শুধু একটাই অনুরোধ...
বলুন না!
উৎস হিসেবে যেন লেখা থাকে : বিশেষ সূত্র মারফত!