আমাদের বাড়িতে একটা পুতুল আছে, সেটার নাম ‘আমি করিনি’। পুতুলটা আসলে একটা জাপানি পুতুল। কোয়েলমাসি জাপান থেকে এনে দিয়েছিল সেটাকে। ওর নামটা কীভাবে আমি করিনি হল সেটা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। আসলে আমি খুব দুষ্টু তো, সব সময় কিছু না কিছু দুষ্টুমি করি।
কিন্তু মা যদি জিজ্ঞেস করেন, “রুটাই ছাদের টবের গাছের ফুল কে ছিঁড়ে নষ্ট করেছে?”
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে দিই, “আমি করিনি!”
“বালতির জলে রং গুলে কে নোংরা করেছে?”
“আমি করিনি!”
“কাচের প্লেট কে ভেঙে টুকরো করেছে?”
“আমি করিনি!”
আমি যে কিছু ভেবে বলি তাও না। যেন আপনিই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় কথাটা!
আমি সব সময় ওই কথাটা বলি বলে বাবা একদিন মজা করে বললেন, “আমি করিনি নামটা বেশ জাপানি জাপানি শোনাচ্ছে!” কোয়েল মাসির উপহার দেওয়া জাপানি পুতুলটা হাতে নিয়ে বললেন, “এর নাম আমি করিনি হতেই পারে!” তারপর একটা কাগজে আমি করিনি লিখে পুতুলটার জামায় আটকে দিয়ে বললেন, “এই হল আমি করিনি! বাড়ির সব দুষ্টুমি এই করে! লোকে কেন যে মিছি মিছি রুটাইয়ের নামে দোষ দেয় জানি না বাপু! শুধু শুধু রুটাইকে বিরক্ত করে কী লাভ যখন জানে সবাই যে আমি করিনিই সব কাজগুলোকে উলটো-পালটা করে!”
বাবার কথা শুনে মা আর দিদি তো হেসেই খুন! আমিও ফিকফিক করে হাসছিলাম।
এর পর কিন্তু বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন, বললেন, “দেখো আমি করিনির হাত পা সবই আছে কিন্তু সে তো নড়তে চড়তে পারে না! তাই ওর নামে মিথ্যে দোষ দেওয়াটাও কি ঠিক হচ্ছে? দোষ করলে সেটা স্বীকার করে নেওয়াটাই তো ভালো, তাই না? তারপর সরি বলে মাফ চেয়ে নিলে সব চুকেবুকে গেল। শুধু শুধু আমি করিনির ঘাড়ে দোষটা চাপালে তার মনে কত দুঃখ হয় কারণ দুষ্টুমিটা তো সত্যি সত্যি সে করেনি! এর পর কিন্তু আমি করিনি খুব রেগে যাবে। তখন কী হবে আমি বলতে পারব না!”
আমি সব বুঝেছি এমন করে মাথা নাড়লাম কিন্তু একটু পর থেকেই আবার বলতে শুরু করলাম আমি করিনি!
তারপর একদিন আমি শরীরটা খারাপ বলে স্কুলে গেলাম না। মানে সাংঘাতিক কিছু না, একটু পেটে ব্যথা আর গা বমি ভাব। স্কুলে বমিটমি হয়ে গেলে মুশকিল তাই মঙ্গলামাসির সঙ্গে রয়ে গেলাম আমি আর মা-বাবা দুজনেই অফিসে চলে গেলেন। একটু পরেই ব্যথা চলে গেল। তখন আমি ছাদে গেলাম। ছাদে অনেক ফুল ফুটেছে। সব রায় দিদার লাগানো। রায় দিদা অবশ্য আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। তার কারণ আমি মাঝে মাঝেই ওনার টবের ফুল পেড়ে নিতাম। নিজের জন্যে নিতাম না বা নষ্টও করতাম না, ফুল পেড়ে নীচের তলার ঘোষ দিদাকে দিয়ে আসতাম ওনার পুজোর জন্যে। সে জন্যে রায় দিদার আমার ওপর অত রাগ। ঘোষ দিদার সঙ্গে ওনার ঝগড়া যে! একবার ফুল পেড়েছিলাম বলে রায় দিদা খুব চেঁচামেচি করেছিলেন। তখন আমার রাগ হয়ে যেতে আমি জল দেওয়া টব থেকে কাদা তুলে রায় দিদার যে সব শাড়ি শুকোচ্ছিল সেগুলোতে কাদা মাখিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন মা-বাবা অফিস থেকে ফিরে আসতে রায় দিদা একেবারে হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়েছিলেন! খুব বকুনি খেয়েছিলাম সবার কাছে সেদিন। মুখ ভার করে বসেছিলাম। রাতে খেতেও যাচ্ছিলাম না অভিমান করে। তারপর দিদি এসে কাতুকুতু দিয়ে হাসাল শেষমেশ। সেই ঘটনার পর থেকে আমি আর দিদার গাছে হাত দিই না!
যাই হোক, পেটের ব্যথা সেরে যাওয়ার পর ছাদে গিয়ে দেখলাম অবাক কাণ্ড, রায় দিদার টবের ফুল কে যেন সব তুলে নিয়ে গেছে! আমি বুঝলাম এবার ঝামেলা হবে। হলও তাই। বিকেলবেলা মা-বাবা অফিস থেকে ফিরতেই রায় দিদা এসে হাজির। বললেন, “রুটাই তো আবার আমার গাছের ফুল চুরি করেছে সব!”
আমি বললাম, “আমি করিনি!”
কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না! সবাই মিথ্যে কথা বলার জন্যে বকাবকি করতে লাগল।
আমি কঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, “এবার আমি সত্যিই ফুল পাড়িনি!”
দিদি বলল, “সেই মিথ্যেবাদী রাখাল ছেলেটার গল্প শুনিসনি? সব সময় মিথ্যে মিথ্যে বলত যে নেকড়ে ওর পশুদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর যেদিন সত্যিই নেকড়ে এল সেদিন আর কেউ ওর কথা বিশ্বাস করল না! তোরও সেই রকম হয়েছে। আমি করিনি, আমি করিনি করে এত মিথ্যে বলেছিস যে এবার আর কেউ তোর কথা বিশ্বাস করছে না!”
আমি রেগে গিয়ে বললাম, “আমি সে সব জানি না! ফুল আমি ছিঁড়িনি!”
দিদি মুখ টিপে হেসে বলল, “তাহলে কে ছিঁড়েছে? ওই জাপানি পুতুলটা বুঝি?” বলে দিদি অন্য ঘরে চলে গেল।
আমি কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম তারপর কাচের আলমারি থেকে আমি করিনিকে বার করে রেগে ছুঁড়ে ঘরের এক কোণে ফেলে দিলাম। সেখানেই পড়ে রইল পুতুলটা; আমি তুললামও না ওটাকে আর তার পর থেকেই গন্ডগোলটা শুরু হয়ে গেল।
পরদিন স্কুলে গেলাম। টিচার ক্লাসে আসার আগে সুন্দর করে বোর্ডটা মুছে তারিখ লিখে রেখেছিলাম। মিস ক্লাসে ঢুকে খুব খুশি হয়ে বললেন, “বাহ আমার জন্যে বোর্ড কে রেডি করে রেখেছে?”
আমি উঠে দাঁড়ালাম আমি করেছি বলব বলে কিন্তু মুখ দিয়ে বের হল, “আমি করিনি!”
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। বাড়িতে ফিরেও একই অবস্থা। পড়ার টেবিল গুছিয়ে সব ঠিকঠাক করে রাখলাম। মা দেখে খুব বললেন, “বাহ, এটা আবার কে করল?”
আমার মুখ দিয়ে বের হল, “আমি করিনি!”
এর পর যা ঘটতে লাগল তা আমার কাছে খুবই ভয়ের। যা কিছু ভালো কাজ করছিলাম আমি কিছুতেই আর বলতে পারছিলাম না আমি করেছি। যতবার মুখ খুলছি শুধু বেরোচ্ছে ‘আমি করিনি!’ খুব খারাপ অবস্থা। বাড়িতে যত খেলনাপাতি গাড়িটাড়ি ছড়িয়ে রেখেছিলাম সব তুলে নিয়ে গিয়ে খেলনার বাক্সে রাখলাম। মা আর দিদি জিগ্যেস করতে মুখ দিয়ে বেরোলো ‘আমি করিনি’। ওরা তখন ভাবল বুঝি বা মঙ্গলামাসি করেছে!
মনের দুঃখে ছাদে গিয়ে বসেছিলাম এক কোণে। ওমা একটু পরে দেখি ২বি-র সন্তু চুপি চুপি ছাদে এল। ও আমাকে দেখতে পেল না আমি বড়ো ট্যাঙ্কের তলায় লুকিয়ে বসেছিলাম বলে। দুপুরের খাঁখাঁ রোদে কেউ নেই ছাদে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে সোজা রায় দিদার ফুলের টবগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে পটাপট ফুল ছিঁড়তে লাগল। ওমা এ যে দিনে ডাকাতি! তার মানে ফুল ওই চুরি করছিল আর দিদা আমার ওপর রাগ করছিলেন! আমি আর থাকতে না পেরে এক ছুটে বেরিয়ে সন্তুকে বললাম, “এই তুমি টবের গাছের ফুল নিচ্ছ কেন? রায় দিদার গাছের ফুল তুললে দিদা রাগ করেন খুব! তুমি চুরি করছ আর আমি বকুনি খাচ্ছি!”
সন্তু কিছু না বলে ধাঁ করে আমাকে মারল এক ঘুঁসি। আমি পড়ে গেলাম আর ও আমার বুকের ওপর চেপে বসে আমাকে মারতে লাগল, আর বলতে লাগল, “বেশ করেছি ফুল চুরি করেছি। তুই মিথ্যেবাদী এখন তুই বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না! তাই তুই চুরি করেছিস, তুই চুরি করেছিস!”
আমি পরিত্রাহি চিৎকার জুড়ে দিলাম আমি করিনি, আমি করিনি বলে!
আর তখনই দিদির প্রবল ঠেলা খেয়ে আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। উফ্ কী দুঃস্বপ্ন রে বাবা!
দিদি বলতে লাগল, “কী হচ্ছে রুটাই! এই গরমে ছাদে এসে ঘুমোচ্ছিস আর আমরা তোকে চারদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি! পুতুলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিস কেন? যদি ভেঙে যেত, অত দামি পুতুল!”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “ভেঙেছে নাকি?” ভাঙলে তো আরেক প্রস্থ বকুনি!
দিদি বলল, “না, ভাঙেনি, তবে ভাঙতেও তো পারত! যাই হোক রায় দিদা এসে বলে গেছেন যে ফুল চোর ধরা পড়েছে। ২বি-র সন্তু রোজ খুব ভোরে এসে ফুল নিয়ে পালাচ্ছিল। দিদা তোর জন্যে চকোলেট এনেছেন তোকে মিছিমিছি দোষ দিয়েছিলেন বলে! চল বাড়ি চল। মা খেতে ডাকছেন।”
আমি বাড়ি গিয়ে আলমারিতে তুলে রাখা আমি করিনিকে দেখলাম। সে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে দেখল। কতটা স্বপ্ন আর কতটা সত্যি কে জানে বাবা, তাই আমি কাছে গিয়ে তাকে ফিসফিস করে বললাম, “সরি তোমাকে ছুঁড়ে ফেলেছিলাম বলে। খুব রাগ হয়ে গিয়েছিল। তবে আমি আর মিথ্যে বলব না। কিছু করলে আমি করেছি বলব। তাহলে তুমি ওই সব কিছুতে আমি করিনি বেরিয়ে যাওটা ফিরিয়ে নেবে তো?” আমি করিনি ঠিক তেমন ভাবে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে চেয়ে রইল। বিকেলেই দিদি নিজের আঁকাটা নিয়ে এসে হাজির, বলল, “আমার আঁকাটাতে কে সবার চোখ এঁকে টিপ পরিয়ে দিল?”
আমি মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে বললাম, “আমি করেছি! চোখ ছাড়া কেমন যেন ভয় লাগছিল ওগুলোকে দেখে!”
দিদি হেসে ফেলে বলল, “দূর বোকা ওগুলো মডার্ন আর্ট করছিলাম। যাক আঁকাটা আমারও খুব একটা পছন্দের নয় তাই ছেড়ে দিলাম তবে আর কখনও আমার আঁকায় হাত দিবি না বলে দিচ্ছি!”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম।
পরদিন সকালে বাবা জুতো পরতে গিয়ে বললেন, “আরে আমার জুতোটা কে পালিশ করে দিল?”
আমি বুক ফুলিয়ে বললাম, “আমি করেছি!”
বাবা তো সেটা শুনে খুব খুশি। আমারও ঠিক কথাটা বলতে পেরে খুব আনন্দ হল। কাচের আলমারিতে বসে থাকা পুতুলটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মনে হল সেও যেন আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে!