যাদের বাড়িতে বাবা, মা কেউ নেই তাদের থাকা আর পড়াশোনা করার জন্য একটি বোর্ডিং ইস্কুল আছে কোলকাতা থেকে দূরে ছোট্ট এক শহরে। লোকে বলে আশ্রম। সুবল আর কুশল এখানকার ছাত্র। সুবলের ক্লাস এইট, কুশলের সেভেন। ক্লাস আলাদা হলেও দুজনের খুব ভাব। এই শীতের ছুটিতে স্কুল-হোস্টেলের অনেকে পুরী বেড়াতে গেছে – আসলে এখানে মাসে মাসে ছেলেদের কিছু হাত-খরচা দেওয়া হয় ইস্কুল থেকে, যারা জমাতে পেরেছে তারা গেছে। সুবল, কুশলদের মত যাদের অতটা পয়সা জমেনি তারাই দু-চারজন রয়ে গেছে। বিকেলে সুবল আর কুশল বাগানের দিকে ঘুরছিল।
সুবল বলল, “কুশল, তুই বড় হয়ে কী হবি রে?”
কুশল একটু ভেবে বলল, “জানি না।”
“না জানলেও চলবে। আমি বলে দিচ্ছি। আমি হতে চলেছি গোয়েন্দা আর তুই হবি সহকারী।”
সুবল আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সেখানে নকুলদা এসে হাজির। নকুলদা আশ্রমের কর্মচারী। “এই তো লবকুশ এখানে। ওরে সুবল, হেডস্যার তোকে ডেকেছেন। এখন আপিসে আছেন, দেখা করে নে। তাড়াতাড়ি যা, যা মেঘ করেছে বৃষ্টি এল বলে।”
এরা দুজন সারাক্ষণ একসঙ্গে থাকে তাই এদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে এদের সকলে বলে লবকুশ।
হেডস্যার ডেকেছেন! কী ব্যাপার রে বাবা …
মনে মনে অনেকটা সাহস জমিয়ে সুবল ঢুকল। বাইরে কুশল অপেক্ষা করে রইল। কুশলের মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই। কোথায় যেন বন্যা হয়েছিল, সেখান থেকে গভর্মেন্টের লোকেরা ওকে উদ্ধার করে। মা-বাবাকে পাওয়া যায়নি। ওরা তিন বছরের ছেলেটিকে আশ্রমে দিয়ে যায়। এত বিপদের মধ্যেও ছেলেটা ভালো আছে দেখে হেডস্যার, যিনি আশ্রমের অধ্যক্ষ, ওর নাম রাখেন কুশল।
সুবলের মা অসুখে মারা যান আর তারপর বাবাও। ছোটকাকা সুবলকে রেখেছিলেন কয়েক মাস, ভালোও বাসতেন সুবলকে। কাকা একা মানুষ, তার ওপর কাজে এদিক-ওদিক ঘুরতে হয়। তাই সুবলকে এই আশ্রমে ভর্তি করে দিয়েছেন।
হেডস্যার বললেন, “সুবল, তোর কাকা আমাকে চিঠি লিখেছেন। তোকে চম্পকপুর যেতে বলেছেন এক বেলার জন্য। যা ঘুরে আয়, তবে সন্ধের আগে ফিরবি, নয়ত আশ্রমে ঢুকতে পাবি না। ও হ্যাঁ, তোকেও একটা চিঠিতে কোথায় কার সঙ্গে দেখা করবি সব লিখেছেন। এই নে।
সুবল বলল, “স্যার, আমি আর কুশল দুজনে যাই? আমরা সব সময় একসঙ্গে থাকি তো, তাই।
“কুশলকে নিয়ে যাবি – তা যা। সাবধানে যাবি আর দেরি না করে সন্ধের আগে ফিরে আসবি কিন্তু।”
সুবল খুশি মনে বেরিয়ে এসে কুশলকে বলল, “আমি আর তুই চম্পকপুর যাব, কাকা চিঠি দিয়েছে আর হেডস্যার বললেন যেতে পারো।”
চিঠি হাতে দুজনে হোস্টেলের দিকে যেই না এগিয়েছে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সে একেবারে আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি! দুজনে দৌড়তে লাগলো, কিন্তু যা মুষলধার বৃষ্টি – দুজনেই কাক ভেজা ভিজল। এমন কি চিঠিটাও।
“এই রে, চিঠির লেখাগুলো তো প্রায় সবই ধুয়ে গেছে রে …” সুবল বলল।
দুজনে পোস্টকার্ডটা বিছানায় রেখে পাখার বাতাস করতে লাগল। বাতাসে জল শুকোয়, শুকিয়েও গেল অনেকটা কিন্তু তাতে কী আর ধুয়ে যাওয়া লেখা ফিরে আসে!
যে কটা কথা বা অক্ষর পড়া যাচ্ছিল:
রবিবার স… ট্রেনে …। স্টেশন থেকে …. শি….ন্দির, অপেক্ষা …।
ব্যাস, অনেক চেষ্টা করেও আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। কুশল বলল, “হেডস্যারের চিঠিতে পুরোটা আছে নিশ্চয়ই। গিয়ে বল।”
সুবলের ভরসা হলো না। সাহসও না। যদি উনি বলে বসেন – অ্যাঁ, চিঠি ভিজিয়েছ! এত অসাবধান!! যেতে হবে না তোমাদের।
হেডস্যার তো বললেন চম্পকপুর। তাহলে চম্পকপুর অবধি যাওয়া যাক। ‘অপেক্ষা’ কথাটা আছে মানে কেউ নিশ্চয় আসবে নিতে।
শনিবার রাত্তিরে কুশল খানিকটা ছাতু রান্নাঘর থেকে চেয়ে এনে রেখেছিল। সকালে কাঁচালঙ্কা আর নুন দিয়ে মেখে দুজনে খেয়ে নিল। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল। নকুলদা বলেন ছোলা বা ছাতু খেলে অনেকক্ষণ শরীরে বল পাওয়া যায়। যদি বিশ্বাস না হয় ঘোড়াদের কাছ শেখ – ঘোড়ারা ছোলা খেয়ে সারাদিন কাজ করে যায়।
দুই মূর্তি বেরিয়ে পড়ল ভোর থাকতে। সুবলের কেমন পকেটটা খালি খালি লাগছিল। অভিযানে যাচ্ছে তো, একটা অস্ত্র থাকলে ভালো হতো। কুশল আজকে তার সবচেয়ে ভালো জামা-প্যান্ট পরেছে, শুধু জুতোটা নিয়ে মনটা খুঁতখুঁত করছে, পাশটা একটু ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু কী করবে আর জুতো তো নেই। যা পয়সা ছিল, দুজনে সব নিয়েছে। যাওয়া আসার ভাড়া লাগবে তো।
ভেবেছিল ভোর ভোর ট্রেন ধরবে কিন্তু স্টেশনে গিয়ে শুনল – আজ রবিবার বলে ট্রেন কম। চম্পকপুরের দিকে ট্রেন সাড়ে নটার আগে নেই। টিকিট কেটে দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল। চায়ের দোকানটা খুলল, চা খেতে ওদের কোনো ইচ্ছে নেই তবে কাচের বয়মে রাখা মোটা বিস্কুটগুলো বড় লোভ দেখাচ্ছে। ছোলার ছাতু খেয়ে এসেছে কিন্তু মোটেই ঘোড়াদের মতো মনে হচ্ছে না নিজেদের। বেশ খিদে পেয়ে গেছে। একবার গিয়ে বিস্কুটের দাম জিগেস করে এল। নাহ, কেনা যাবে না। অত পয়সা নেই – ফেরার টিকিট কাটতে হবে তো।
একটা লোক এসে একটা ঝোলানো লোহার ওপর হাতুড়ি মেরে ঘন্টা বাজাল, মানে ট্রেন আসছে। এসেও গেল, দুজনে উঠে লম্বা সীটে পাশাপাশি বসে গেল। জায়গাটা বেশি দূর তো নয়, গোটা পাঁচেক স্টেশন তফাতে। চম্পকপুর আসতেই টুপটুপ নেমে পড়ল দুজনে। এবার স্টেশন থেকে বেরিয়ে শি -ন্দির, মানে বোঝাই যায় কোনো শিব মন্দির হবে, সেটা খুঁজতে হবে। ভাগ্য ভালো, বিশেষ খুঁজতে হলো না। স্টেশন-বাড়ি থেকে বেরিয়েই একটা মন্দির, মাথায় ত্রিশূলের ফলা। তার মানে এটাই সেই শিব মন্দির। এখানে অপেক্ষা করতে হবে।
এ পর্যন্ত ভালোই চলছিল কিন্তু গণ্ডগোলটা হলো একেবারে আচমকা। দুটো ষণ্ডামার্কা লোক এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে মন্দিরের দিকে হনহন করে আসছিল, সুবল চাপা গলায় বলল, “এরা কারা?” কুশলের মনে হলো ছেলেধরা হতে পারে।
সুবল হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, “কুশল, পালা। তোকে ধরতে আসছে …”
কুশল পালাতে গিয়ে সুবিধে করতে পারল না। দু-নম্বর লোকটা মন্দির ঘুরে অন্যদিক থেকে পথ আটকে দাঁড়াল। সুবল কিন্তু দৌড়ে অনেকটা চলে গিয়েছিল কিন্তু তারপর নিজেই থেমে গেল। কুশলকে ছেড়ে সে পালাবে – কিছুতেই না। লোকদুটো কুশলের দুপাশে হাঁটছে, কুশল পালাতে পারবে না। সুবল দূর থেকে ছুটতে ছুটতে চেঁচাতে লাগল, “আমাকেও ধরো, আমাকেও ধরো …”
অতদূর থেকে ওরা অবশ্য শুনতে পেল না।
এবারে সুবল যা দেখল তাতে সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। কুশল দুজনের সঙ্গে একটা জীপ গাড়িতে উঠল – মানে ওকে উঠতে হলো। পালাবার কোনো উপায় রাখেনি ওরা। জীপগাড়িটা ভোঁওও করে ছেড়েও দিল।
কী করা যায় এখন? সুবল দৌড়ে রাস্তায় এসে দেখল একটা মোটরসাইকেল আসছে। মরিয়া হয়ে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে ওটাকে থামাল। কোনো রকমে বলল, “আমাকে নিয়ে চলো, ওই জীপটায় কুশলকে নিয়ে যাচ্ছে, ওদের থামাতে হবে …”
জীপটা তখনো দূরে দেখা যাচ্ছিল। মোটরসাইকেলওয়ালা বলল, “কাকে নিয়ে যাচ্ছে?”
“কুশলকে।”
“কুশল কে?”
“আমরা একসঙ্গে ট্রেনে এসেছি, আমার সহকারী…”
“কী কারী?”
“আজ্ঞে সহকারী।”
লোকটা বুঝল বলে মনে হলো না। তবে বলল, “ওটা তো মহেশদার জীপ। আচ্ছা চল … পেছনে বসে পড় …”
সহকারীর অপহরণ হতে চলেছে। গোয়েন্দা তার পেছনে মোটর-সাইকেলে। গোয়েন্দাকাহিনীর জমজমাট দৃশ্য হলেও সুবলের ভয় করছিল। ভীষণ ভয়। মহেশদার জীপ? মানে এ লোকটা জীপটা চেনে? এও কি ওদের দলের?
জীপগাড়ি থামল একটা বড় মিষ্টির দোকানের সামনে। পাশের তিন তলা বাড়ি থেকে একজন বিরাট চেহারার লোককে দোকানে ঢুকতে দেখা গেল। মোটরসাইকেলে সুবলও সেই মুহূর্তে সেখানে পৌঁছল।
কুশলকে ওরা দোকানের ভেতরে নিয়ে গেছে। দশাসই লোকটার বাজখাঁই গলা সুবল শুনতে পেল বাইরে থেকেই। “নাম কী?”
“কুশল।”
“কু শ ল, এ্যাঁ, কু শ ল!! ওরে তোরা একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পারিস। দুটো গাধা পুষছি মাইনে দিয়ে – সামনের মাস থেকে দুটোকেই ছাড়িয়ে দেব!”
সুবলকে নিয়ে মোটরসাইকেলওয়ালা এবার দোকানে ঢুকল। বলল, “মহেশদা, এ ছেলেটা বলছিল এরা দুজন একসঙ্গে ট্রেনে এসেছে …”
মহেশদা জিগেস করলেন, “এটি আবার কে! তোমার নাম কী?”
“সুবল, সুবল স্যার।”
“হুঁউউউ, এবার বুঝলাম।”
সবাই চলে গেল। দোকানে শুধু মহেশদা আর দুজন দোকানের কর্মচারী। মহেশদা বসলেন একটা গদিআঁটা চেয়ারে। বোঝা গেল ইনিই দোকানের মালিক।
মহেশদার গলার আওয়াজটা এত জোরে যে আস্তে কথা বললেও পেটটা কেমন গুড়গুড় করে ওঠে সুবলের। মহেশদা বললেন, “যে-কোন আট রকমের মিষ্টি যা তোমাদের পছন্দ তা আঙ্গুল দেখিয়ে বলে দাও। কোন বাধা-নিষেধ নেই। আর হেই নুটু, তুই একটা বাক্সে ভরতে থাক। তারপর দুটোকে ওপরে নিয়ে আসবি। আমি চলি।”
মনের ভয় আর পেটের খিদে – কার জোর বেশি? এ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে। তবে এখন সুবল আর কুশলকে দেখে প্রমাণ হয়ে গেল খিদে বেশি শক্তিশালী।
সুবল কোথায় যেন পড়েছিল বলির পাঁঠাদের আগে ভালো করে খাইয়ে দেয়। যাকগে, যা হবে হোক! দুজনে পানতুয়া থেকে শুরু করে বালুসাই ... সব দেখাতে লাগল।
কী যে হচ্ছে তা বুঝতে না পারলেও ওদের নজর চলে গেছিল দোকানের অন্য দিকটায়। ডান দিকের আলাদা শোকেসে ছিল সিঙ্গাড়া আর খাস্তা কচুরি। আর নানা সাইজের কেক। কোনোটার ওপর গোলাপী ফুল কাটা, কোনোটায় চকলেটের ঘন প্রলেপ।
মহেশদা নেই, তাই কুশল সাহস করে নুটুকে জিগেস করলো, “আচ্ছা নুটুদা, এই দিকটা কি বাদ?”
“জানি না। কিন্ত মালিক কিছু বলেননি।”
যখন বলেননি তখন আর কী করা যাবে। সিঙ্গাড়া ঠান্ডা, তবু কুশলের খেতে ইচ্ছে করছিল। আর কেকগুলো এত সুন্দর দেখতে – বাড়িতে সাজিয়ে রাখার মতো।
নুটুর হাতে মিষ্টির বাক্স আর ওর পেছনে সুবল আর কুশল বাড়িতে ঢুকল। ভয় পেলেও দুজনে অবাক হয়ে দেখছিল – বাড়িটা বেশ বড় আর সাজানো। ওরা এরকম কোনো বাড়িতে কখনো ঢোকেনি।
মার্বেল বাঁধানো সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে গোটা দশেক ধাপ উঠলে যে সমতল জায়গাটা থাকে সেখানে কী সুন্দর চিনেমাটির বড় ফুলদানি রাখা আছে। নুটুর সঙ্গে সঙ্গে তারা উঠল দোতলায়। নুটু দরজায় টোকা দিতে ভেতর থেকে এক মহিলার গলা শোনা গেল, “ভেতরে আয়।”
তিনজনে ভেতরে গেল – নুটু বলল, “কাকীমা, আমি যাই। নুটু যাই বলতেই সুবল আর কুশলের প্রাণ ছটফট করে উঠেছিল ঠিকই কিন্তু মিষ্টির বাক্সটা টেবিলে রেখে দেওয়াতে দুজনের আবার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। কাকীমা বললেন, “ও মা, এ কত ছোট ছোট দুটো ছেলেকে এনেছে! একেবারে ইস্কুল থেকে গাড়িতে উঠিয়ে আনলেই তো হতো! এই তোরা বোস... না, না মেঝেতে কেন বসছিস, ওই চেয়ারে বোস।”
আসলে চেয়ারে এত মোটা গদি লাগানো ছিল যে ওদের বসতে বাধোবাধো ঠেকছিল। যাই হোক বসেই পড়ল দুজনে। মিষ্টির ভর্তি বাক্সটা দেখে কুশল বোধ হয় প্রাণে একটু বল পেয়েছিল। সে জিগেস করে বসল, “তোমরা কারা?”
শুনে তো কাকীমার হাসি আর থামে না। দুজনের গাল টিপে দিয়ে বললেন, “কী সুন্দর কথা বলিস রে তোরা, ‘আমরা কারা’ হি হি ‘আমরা কারা’ হো হো …”
“তার আগে তোরা খেয়ে নে। তারপর বুঝতেই পারবি। ওরে বিনু, দুটো প্লেটে মিষ্টিগুলো সাজিয়ে দে, দু গেলাশ জলও দিস। আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।”
এরা যে কারা, এরপর যে কী হবে কিছুই জানা নেই। তবে সেই স্টেশন থেকে এত অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে যে এরা খানিকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ভাবটা ‘খেয়ে তো নিই তারপর দেখা যাবে’।
খাওয়া শেষ হতেই পরদার ওদিক থেকে কাকীমার গলা শোনা গেল। “বিনুউউউ কোথায় গেলি আবার, ছুরিটা নিয়ে আয়। ধুয়েপুঁছে আনিস।”
“কোনটা, কাচের আলমারিতে যেটা আছে সেটা?”
“আরে না না, ওটা বড্ড ছোট। বড়টা আন।”
সুবল আর কুশলের মনে হলো ওরা কি ঠিক শুনল? টেবিলের নিচে দুজনে দুজনের হাত ধরে রইল। দুজনের কাছেই দুজনের হাত কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা ঠেকল। এদিক-ওদিক দেখতে লাগল, এ ঘর থেকে পালাবার রাস্তা আছে কি।
বিনু ঘরে ঢুকল, তার হাতে একটা বড় সাইজের সাদা রঙের থালা। থালার ওপরে একটা বেশ লম্বা ছুরি – হোস্টেলের পাঁউরুটি কাটার ছুরিটার মত।
এমন সময় মহেশকাকার প্রবেশ। সুবল আর কুশলকে দেখে বললেন, “তোরা তো মিষ্টি খেয়েছিস, তবুও তোদের মুখগুলো আমসির মত শুকনো দেখাচ্ছে কেন রে! কাকীমা মহেশকাকাকে বললেন, “আচ্ছা দুজন আছে, একটাতে হয়ে যাবে না আরেকটা আনাবে?”
সুবল মনের উত্তেজনা আর ভয় ধরে না রাখতে পেরে বলে উঠল, “তোমরা কারা? আমাদের কী জন্য ধরে এনেছ?”
কাকীমা আবার হেসে উঠলেন। তখন থেকে এরা ‘তোমরা কারা, তোমরা কারা’ বলে চলেছে। বুঝিয়ে দাও তো, এরা কী জানে না...”
মহেশকাকা বললেন, “কেন তোরা চিঠি পাসনি? উদিত তো বলল চিঠিতে সব লিখে জানিয়েছে।”
কুশল বলল, “চিঠি এসেছে কিন্তু বৃষ্টিতে লেখা ধুয়ে গেছে।”
“তাহলে এখানে এলি কী করে? অ্যাঁ!”
“শুধু রবিবার স, আর শিন্দির পড়া যাচ্ছিল।”
“আর চম্পকপুর?”
“ওটা তো হেডস্যার বলে দিয়েছিলেন।”
“হুঁ, বুঝলাম। তাহলে তো তোরা রহস্য-সন্ধানীদের মতো বুদ্ধি খাটিয়ে লিপি উদ্ধার করে চলে এসেছিস!!!”
সুবল বলল, “আমাদের ডেকে এনেছ কেন তোমরা?” আবহাওয়া অনেকটা ভালো হয়ে যাওয়াতে ‘ধরে এনেছ’ টা ‘ডেকে এনেছ’ হয়ে গেল অবশ্য।
মহেশকাকা খুলে বললেন, “তোর কাকা উদিত আমার খুব কাছের বন্ধু। আমরা একই ক্লাবে ফুটবল খেলতাম। সেদিন উদিত বলছিল সুবলের জন্মদিন আসছে। একটু কিছু করলে হতো। আমি বললাম – ঠিক আছে। তুই কোলকাতায় যাচ্ছিস তো কী হয়েছে, আমি তো আছি।”
এমন সময় পরদা সরিয়ে বিনু ঢুকল, তার হাতে খোলা বাক্সতে ‘শুভ জন্মদিন’ লেখা একটা গোল কেক। কেকটা সে সাদা থালাটার ওপর রাখল। কাকীমা আলমারি থেকে একটা নতুন গল্পের বই বার করলেন। তার ওপর সুন্দর করে লেখা ‘জন্মদিনে, সুবলকে দিলাম’।
কাকীমা বললেন. “কিন্তু, ওরে কুশল, তোর জন্মদিন কবে রে?”
বাবা, মা কাউকে কুশলের একটুও মনে নেই। কত ছোট থাকতে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। সে তার জন্মদিন জানেই না। কুশল চুপ করে রইল।
সুবল চেয়ার থেকে উঠে কুশলের কাঁধে হাত রেখে বলল, “মহেশকাকা, কাকীমা – আমি আর কুশল সব সময় এক সঙ্গে থাকি। আমাদের জন্মদিন নিশ্চয় একই দিনে। তুমি বইটার মলাটে কুশলের নামও লিখে দাও। এই কেকটা আমরা দুজনে মিলে কাটি?”
কাকীমা সুবল আর কুশলকে, মানে লবকুশকে জড়িয়ে ধরলেন। “কী ভালো ছেলেরে তোরা, সোনার ছেলে … এ বাড়িতে প্রত্যেক বার জন্মদিন করা হবে তোদের…”
মহেশকাকা বললেন, “একটু একটু কেক খা বরং। এখন বেশি পেট ভরাস না, কেকের বাক্সটা সঙ্গে নিয়ে যাস। দুপুরে মাংস-ভাত খেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে ট্রেন ধরতে যাবি। ও, তোরা মাংস-ভাত খাস তো?”
সুবল আর কুশল দুজনে একই দিকে ঘাড় হেলিয়ে একই সঙ্গে টেনে টেনে বলল, “হ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ…”
****
একসঙ্গে সারাদিন থাকলে কি হবে, এদের মতের মিল বিশেষ হয় না।
ফেরার সময় ট্রেনে উঠেই কুশল বলল, “আমি কত সাহসী দেখলি। কেমন জীপগাড়িতে গটগট করে উঠলাম…”
“ছাই সাহসী। ভয় পেয়ে উঠেছিলি। আর আমাকে দেখলি, মোটর-সাইকেলে তোকে কী রকম ‘ফলো’ করলাম…এই কেকের বাক্সটা বেশি চাপিস না, কেকটা খুব নরম …”
“বইটা খুব ভালো মনে হয়, অনেক ছবি আর গল্প আছে রে…” কুশল বলল।
“কুশল, তুই একটা বোকা। মিষ্টির দোকানে বোঁদে কী সুন্দর ছিল, তুই বললি না ওটা নিস না… তাই আর খাওয়া হলো না।”
“তুই-ই বোকা। দেখলি না সব মিষ্টি দুটো করে দিচ্ছিল, বোঁদে বললে যদি গুনে গুনে শুধু দুটো দানা তুলে দিত তাহলে …”
“এই, আমাদের স্টেশন এসে গেছে। নেবে পড়…”
দুজনে ঝপ ঝপ নেমে পড়ল। গাছপালার ছায়া গাঢ় হয়ে চারিদিক ছেয়ে ফেলছে, তবু এখনো বিকেল আছে। হেডস্যারের কথামতো সন্ধের আগেই তারা পৌঁছে যাবে। আশ্রমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে কুশল বলল. “আবার কবে জন্মদিন হবে রে?”
“পরের বছর। তুই এইটে আর আমি নাইনে উঠব যখন।”
“সে তো অনেকদিন পরে। জন্মদিন বছরে তিন-চারবার হলে কত ভালো হতো, তাই না?”
এতক্ষণে লবকুশের পুরোপুরি মতের মিল হলো। সুবল বলল, “ঠিক বলেছিস রে, একেবারে ঠিক …”