• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৮ | অক্টোবর ১৯৯৮ | রম্যরচনা
    Share
  • দেশ : অমিতাভ সমাজপতি

    দেশ। আহা আমার দেশ। ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেকাই মাথা- যুদ্ধ, বিগ্রহ, স্বদেশী সবই এই দেশের জন্য। জননী ‘জন্মভূমিশ্চ’ স্বর্গাদপি গরীয়সী’ ইত্যাদি দিয়ে ছেলেবেলা জমজমাট। দেশের জিনিস দেশী। দেশী খেলেই শরীর একটু বেহেড টলমল। উন্নাসিকরা নাক কোঁচকান- প্রতিজ্ঞা, আর যা খাই দেশী খাব না। ভরা থাক বিলিতি সুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি…

    দেশ কী? এটা একটা নিদারুণ সমস্যা। আমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রশ্নটা। অংলিশ মিডিয়ামের ছাওয়াল, ক্যুইজের মাস্টার। উইদিন অ্যা সেকেন্ড উত্তর- ‘দেশ’ একটি বাংলা ম্যাগাজিন। আমি আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম; তারপর আবার প্রশ্ন করলাম তাহলে ‘বিদেশ’? এবার খানিকক্ষণ ভেবে বলল, বিদেশ, মোহনবাগানের লেফ্‌ট আউট, নাইনটিন সেভেন্টি সিক্স টু নাইনটিন…

    আমি ‘থ’; উত্তর নির্ভুল। টেন ফুল মার্কস। ক্ষেপে উঠলাম সাংঘাতিক। আমাদের সময় এইরকম হলে বাবা দরজার ডাসা দিয়ে ঘন্টাখানেক পিটতেন, খাওয়া বন্ধ হতো অন্তত দু দিন। এখন আর ওসব হয় না। এখন চেপে যেতে হয়। ভাবতে বসতে হয়। তাই ভাবতে বসলাম আমি। আগে পিতার কোনও মন্তব্যে পুত্র ভাবতে বসত; এখন ঠিক উল্টো। গালে হাত দিয়ে বসে গেলাম-

    সত্যিই তো! দেশ মানে কী? দেশ ব্যাপারটা অবশ্য আমার কাছে যতটা মানবিক তার থেকে অনেক বেশি ভৌগোলিক। ‘ভূগোল’ সাবজেক্ট হিসেবে আবার আমার কাছে যমের মত। ম্যাপের উত্তর থেকে দক্ষিণে যেভাবে বরাবর আঁকা হয়েছে, একটা ডালডায় ভাজা পরোটার মত-- সেটাই আমার দেশ। পরোটা চিনি আমার প্রিয় খাদ্য। তবু পরোটার ওই ডানদিকের বাড়ানো অংশটা খেতে গেলেই আজও পুরনো কথা মনে পড়ে--‘আমাগো দ্যাশের কথা’। বাকি অংশটা খাবার সময় কিছুই মনে হয় না। কেন হয় না? কলকাতা থেকে মেদিনীপুর যাবার সময় এখনও বঙ্গসন্তানরা বলে ‘দেশে’ যাচ্ছি। বিহারিরা তো বড়বাজার অঞ্চলে হাঁকডাক দিয়েই রাস্তায় জড়িয়ে ধরে বলে দেশওয়াল হো- এর মানে কী? এই দেশের মধ্যেই দেশ, আবার এখানেই বিদেশ।

    ‘দেশকে ভালো করিয়া চিনিলাম বিদেশ গিয়া’ বিভূতিভূষণ কলকাতা থেকে বিহারের লবটুলিয়ায় গিয়েছিলেন। এরপর ভবানীপুর থেকে চিৎপুর দেশ-বিদেশ হয়ে যাবে নাকি? যাই হোক, দেশের কোন সংজ্ঞা নেই। কাল যে আমার দেশ ছিল আজ ক্যান্‌সেল্‌ হয়ে গেল। আবার পরশু দেশের সীমারেখা বৃদ্ধি পেল সেই ভূমি আমার পিতৃভূমি; উসকে লিয়ে জান কসম। তার চেয়ে তলদেশ, পশ্চাৎদেশ উপদেশ- এ শব্দগুলোর সঠিক মানে আছে। শুধু অনামী দেশের বেলায় যত গন্ডগোল।

    এবার দেশী--এরও কোন অর্থ নেই। দেশী মানে দেশজ, যাহা দেশে তৈরি হয় কিন্তু মুদি দোকানদারের কাছে দেশের বিপরীতার্থক শব্দ হলো পোলট্রি অথবা হাঁস। দেশী মুরগি মানে যেগুলো রোগা টিন্‌টিনে, কেবলই ঝিমোয় আহা কী শ্রদ্ধা দেশের উপর! যা কিছু বাজে রদ্দিমার্কা তার নাম দাও দেশী। বাজারের সব চাইতে বাজে আমের নাম দাও দেশী আম। অথচ ছেলেবেলায় স্কুলে বাধ্যতামূলক ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ এই গানটা গাইতে হতো। আমার এই দেশেও জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি- ভাগ্যিস বিষ্ণুপুরাণ অনুযায়ী পুনর্জন্ম নাকি কখনই এক জায়গায় হয় না। সে ক্ষেত্রে বিয়ের প্রথম রাতে সব বর-বউ যা প্রতিজ্ঞা করে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার যুগে যুগে আমি তোমারই,’ স্রেফ ফাল্‌তু কথা। চিন্তা করলেই গা চমকে চমকে ওঠে এই সেন্ট্রাল এভিনিউ এই চিৎপুর এই রাজাবাজার ওরে বাবারে বাবারে বাবা তার থেকে জন্মাব আমি নিউইয়র্কের আশিতলা বিল্ডিং-এ। আহা আমি সাদা, বউ সাদা, পোলাপান সাদা। আমার হাতে অত্যাধুনিক গাড়ির স্টিয়ারিং সামনে নীল সমুদ্র। সে বিচে বিকিনি পরা সাদা সাদা মহিলা- এই চিন্তা আমার বরাবরের; শুধু লেখায় বক্তৃতায় আমার যত দেশপ্রেম উপচে উপচে পড়ছে। নাকে রুমাল চাপা দিয়ে দেশভ্রমণ; বাসে ট্রামে কারণে অকারণে অকথ্য ভাষায় দেশ উদ্ধার। আবার সন্ধ্যে হলেই হারমোনিয়াম নিয়ে আদা কুঁচিয়ে গলায় টোকা মেরে গান ধরি- ‘এত দেশ এই দেশ আমার এই দেশ, এই মাটিতে…’।

    না না এসব কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভড়ংবাজি নয়। ব্যাপারটা জাতিকেন্দ্রিক। টিভি-তে রেডিয়োয় গানে গানে ছয়লাপ-- ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ আর ‘সারে জাহাঁসে আচ্ছা- আজ পর্যন্ত সেখানে এমন কোন বাচ্চাকাচ্চাকে তো দেখলাম না যে ছেঁড়া প্যান্ট-জামা পরে গাইছে গানগুলো! টিপটপ ড্রেস মাখনের মত শরীর- একযোগে গাইছে- হিন্দুস্তান হামারা’ এরা ভূগোলটা পর্যন্ত আগে গ্রেট ব্রিটেনের পড়ে তারপরে সময় থাকলে… খোঁচা খেলে বলে আউচ। অথচ ভারত একটা গরীব দেশ।

    তবে ব্যতিক্রম সব জায়গাতেই আছে। এক শ্রেণীর দেশভক্ত এখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। নিজেদের এরা সোস্যাল ওয়ার্কার বলেন। যেন আর সবাই এ্যান্টিসোস্যাল ওয়ার্কার। এরা হল টপ্‌ ক্লাস বিজনেস ম্যান অথবা এক্সিকিউটিভ আমলাদের বয়েজ কাট স্ত্রীরা। এদের দেশপ্রেম দেখলে রাণা প্রতাপ চমকে চমকে উঠবেন। শিবাজী ডিগবাজি খেয়ে পাগড়ি হারিয়ে ফেলবেন, নেহাত গান্ধীজীর বস্ত্র কম না হলে দুত্তোর বলে ওটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দৌড় দেবেন…. সে যাই হোক সক্কালবেলা রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে এদের দিন শুরু হয় স্বামীজী অফিসে বেরোলে। ছেলে অথবা মেয়ে (এদের হিন্দি সিনেমার মত। দুটো একসঙ্গে থাকে না) স্কুলে। এ পর্যন্ত আমরি বাংলা ভাষার একটি শব্দও ব্যবহার নয়। এর পর স্নান শৃংগার। শাড়িটা পেনসিলভানিয়া থেকে কাকু পাঠিয়েছেন। লিপস্টিক পাউডার সবই বিলিতি। বড়দা কাস্টম্‌স অফিসার, এর পর বিদেশী গাড়িটা নিয়ে বেরোলেন সতেরো নম্বর বস্তির উদ্দেশ্যে। তার আগে এক জায়গায় মিট-টুগেদার বাসু, ঘাসু, রে, মিটার, জোসেফ, অ্যাব্রাহাম। অতি সন্তর্পণে জামাকাপড় বাঁচিয়ে বস্তিতে প্রবেশ। মাঝে মাঝে টিভি-তে ইনটারভিউ। পেপারে ছবি। রাতে কিঞ্চিৎ মদ্যপান। স্বামীর বন্ধুর সাথে অথবা খলখল করে জড়ানো গলায় উত্তর দেবে রম্যারল্যাঁর কোন দেশ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ এই লাইনও পড়ান। অ্যা ম্যান ইজ ইউনিভারস্যাল… কোন নির্দিষ্ট সীমারেখায় বাঁধা যায় না তাকে… বিশ্বমানবতা… চুপি চুপি কানে কানে বলো, আমেরিকায় যাবে?

    যাব! গ্রিন কার্ড ম্যানেজ হবে?

    হবে।

    আ-আ-আ! হোয়াটা লাইফ। হোয়াটা অ্যা ল্যান্ড!! চালাও মাইকেল জ্যাকসন সে সে সে সে….

    অতএব দেশ কথাটার কোন মানে নেই এবং দেশপ্রেমের কোন ডেমনস্ট্রেশন নেই। এক সর্বভারতীয় নেতা একসময় বক্তৃতা করতে করতে নাকি প্রায়শই কেঁদে ফেলতেন। এই কদিন আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবার পর সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, আপনি আর আগের মত কাঁদছেন না কেন? –‘আমি এখন আর পারি না জানেন। ব্যক্তিগত জীবনে রাজনীতির মারপ্যাঁচে এমন কাঁদতে হচ্ছে- মানে সত্যি সত্যি আর কি…’

    আমার মা যেকোন ছাতাওয়ালা গুড়ওয়ালা দেখলেই ডেকে এখনও ভাত খাইয়ে ছাড়েন- আমাগো দ্যাশের লোক, ফরিদপুরের লোক আহারে কী দ্যাশ যে আছিল- যেন তিনি নিজে বিদেশে আছেন। তাঁর সন্তানসন্ততিরাও সব বিদেশী- হায় দেশ, তোমার কোন সন্তান নেই, কোন ঠিকানা নেই, কোন প্রেমিক নেই, কোন মানেও নেই।

    তবে আমি তো ভাববই। আমি জন্মভাবুক। ভাবতে ভাবতে দেশের একটা উপযুক্ত সংজ্ঞা আমি ঠিক করে ফেলেছি- যেকোন লোকের জন্মকর্মের এক কিলোমিটার ব্যাসার্ধ-ই তার দেশ। সে ক্ষেত্রে মেটিয়াব্রুজ-ও কারো কাছে দেশ আবার কৃষ্ণনগর-ও আর এক জনের কাছে দেশ। শুধু শুধুই একটা বিশাল মানচিত্র নিয়ে কলেবর বাড়ানো। ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি আমি দেশে’- মানে কী? মানে হল ভাগ্যিস জোড়াসাঁকোয় জন্মেছি। সুন্দরবন অথবা বসিরহাটে জন্মালে কি এ ক্যারিয়ার আমার হতো?

    তাই দেশ নিয়ে আর ভাবনা নয় নয় নয়। প্রতিজ্ঞা। বরং জীবন নিয়ে ভাবি। তাই ভাল। জীবন। জীবনবোধ। জীবনাদর্শ। ভাবতে তো হবেই, নাহলে আবার দুর্ভাবনা এসে যায়। জীবন নিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে তারপর নাহয় আবার দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা যাবে। ওটা ভাল সাবজেক্ট। অনেকক্ষণ পর আবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম হ্যাঁরে, হোয়াট ইজ লাইফ? উত্তর- ইটস্‌ অ্যান অ্যামেরিকান ম্যাগাজিন। আমি স্থির হয়ে বসে রইলাম ইজি চেয়ারে। চারদিক ঘুরতে লাগল আমার। হা ঈশ্বর কী শুনছি আমি! কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া গিয়া আকুল করিল মোর প্রাণ- এ কি মায়া। মুখ ফস্কে বেরিয়ে এল মায়া মায়া- এরও উত্তর এল ‘মায়া’ অ্যা হিন্দি মুভি দেবানন্দ মালা সিনহা নাইন্টিন সিক্সটি…

    আমি চোখ বুজলাম। সামনে বসে আছে দেশের ভবিষ্যৎ। ভেবেছিলাম দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবব। সে চিন্তা সশব্দে ছেঁটে ফেলার সাহস এবং শক্তি কোনটাই আমার নেই; তাই নিঃশব্দে ছেঁটে ফেললাম। যাই হোক তাই হোক নিজের ছেলেকে তো আর শ্যালক বলা যায় না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘সত্য সেলকুস কী বিচিত্র এই দেশ।’

    প্লাটো লেখা ছেড়ে একদিন বোধহয় এই কারণেই ডায়লগে চলে গিয়েছিলেন। তৈরি হয়েছিল ডায়লগস্‌ অব প্লাটো। আমি ডায়লগ ছেড়ে মনে মনে চললাম। আমার যে কী তৈরি হবে কে জানে- মন চল নিজে নিকেতন…

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments