• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • মুদ্রণ ও প্রচ্ছদভাবনা: ইতিহাসের সন্ধানে : অরূপ সেন

    বাংলা বই ও তার প্রচ্ছদ-বৃত্তান্ত — সোমব্রত সরকার; প্রচ্ছদ-- অভিজিৎ নাথ; প্রকাশক- নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা-৭০০০০৯; প্রথম প্রকাশ- ২০১৫; ISBN: 978-81-7819-122-5

    ১. সম্প্রতি হাতে এল মুদ্রণ ও প্রচ্ছদ ভাবনা নিয়ে সোমব্রত সরকারের 'বাংলা বই ও তার প্রচ্ছদ-বৃত্তান্ত'। প্রকাশকাল খুব সম্প্রতি না হলেও, বিষয় গুরুত্বের নিরিখে এই বইয়ের প্রাসঙ্গিকতা সময়ের সমান্তরাল। বইটিতে পাঠক পাবেন নানা জাতের বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও প্রচ্ছদভাবনার দীর্ঘ ইতিহাস। বইয়ের ভূমিকাতেই লেখক তাঁর প্রচ্ছদভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন: "বইয়ের বাহ্যিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে তার ছাপা ও বাঁধাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচ্ছদ-ভাবনার অনন্যতা আজ আর কোনওভাবে অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষত বইয়ের প্রচ্ছদ... বইকে করে তুলছে অনেকাংশেই অর্থবহ সম্পূর্ণতার আধার।"

    বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করতে গিয়ে লেখক ১৭৭৮ সালে কলকাতায় প্রকাশিত হালেদ (Halhed)-এর 'আ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ' প্রসঙ্গে বলছেন, "১৭৭৮ সালে হালেদের বইয়েরই নামপত্র বা প্রচ্ছদ বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-ভাবনার একটা ব্যাকরণ মেনে চলার নির্দেশ দিল। সেই নির্দেশ মেনেই তৈরি হয়ে উঠল ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত বাংলা ভাষার প্রথম বইটির প্রচ্ছদ।... বইটির নাম ইংরেজি হরফে নয় পর্বে লেখা। এ বই বাংলাতে হলেও প্রচ্ছদপাতাতে একটি অক্ষরও বাংলায় নেই। সমস্তটাই ইংরেজি বড় হাতের অক্ষরে ছাপা।" আলোচ্য বইটি হল, 'Regulations for the Administration of Justice...' - এর জোনাথন ডানকান-কৃত বাংলা অনুবাদ।

    হালেদ-এর ব্যাকরণ বইটি নিয়ে লেখকের মত হল — ইংরেজিতে রচিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ একুশ শতকেও বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-ভাবনার প্রধান ব্যাকরণ হয়ে রইল।

    শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রকাশিত বই নিয়ে লেখক আলাদাভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি বলছেন, "...মিশন প্রকাশিত সমস্ত বইগুলিতেই প্রচ্ছদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি নকশাই ব্যবহার করা হত। টাইপোগ্রাফির সাহায্যে বইয়ের নাম, লেখকের নাম লেখা হত ঠিকই কিন্তু আঠারো শতকের বাংলা বইপত্তরে ব্যবহৃত প্রকাশনীর সিলমোহর এখানে ভীষণভাবেই অনুপস্থিত। প্রচ্ছদে বিশেষ প্রাধান্য সহকারে লেখা হত বইয়ের প্রকাশস্থান ও প্রকাশকাল। প্রচ্ছদের একেবারে নীচে একটা কখনও বা দুটো সরু লাইন টেনে নীচে এক পঙক্তিতেই লেখা হত: 'শ্রীরামপুরে ছাপা হইল'...শ্রীরামপুর মিশন এভাবেই তাদের রচিত বইতে প্রচ্ছদের একটি ট্রেডমার্ক তৈরি করেছিল।"

    লেখক উনিশশতকীয় প্রচ্ছদভাবনা থেকে মুক্তির সন্ধান পেয়েছেন শ্রীরামপুরে ছাপা একটি বিশেষ বইয়ের প্রচ্ছদ-এ: "মনোহর (কর্মকার) প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুরের এই চন্দ্রোদয় যন্ত্র থেকেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ছেপে বের হয় প্রাণকৃষ্ণ মিত্রের লেখা 'গোলে বকাঅলি'।...এই 'গোলে বকাঅলি'-তে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ যেন সেই উনিশ শতকের একঘেয়ে প্রচ্ছদ-ভাবনা থেকে খানিকটা মুক্তি পেল। প্রচ্ছদের চারধারে চওড়া সুন্দর বর্ডার এল 'গোলে বকাঅলি'-তে। লোকায়ত সংস্কৃতির ধারাকে প্রাধান্য দিয়েই বাংলার ব্রত ও অন্যান্য মঙ্গলানুষ্ঠানের আলপনার গড়নে চওড়া বর্ডারটি চিত্রিত করে দেওয়া হল। বর্ডারে এল ছোট ফুল, লতা।" এই প্রসঙ্গে লেখক জানাতে ভোলেননি যে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের প্রবাদপ্রতিম হরফশিল্পী পঞ্চানন কর্মকারের মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্য ও জামাতা মনোহর কর্মকারের ওপর ওই প্রেসের দায়িত্ব বর্তায়। মিশন প্রেসের বাইরে শ্রীরামপুরে উল্লেখযোগ্য ছাপাখানা ছিল মনোহর-পুত্র কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের ছাপাখানা।

    ২.

    সচিত্র বাংলা বইয়ের আলোচনাকালে লেখক উল্লেখ করেছেন: "১৮১৬ সালে কলকাতার ফেরিস এন্ড কোম্পানির প্রেস থেকে ছেপে বের হল বাংলায় মুদ্রিত প্রথম সচিত্র বই 'অন্নদামঙ্গল'।... ১৮১৬-র 'অন্নদামঙ্গল'-এর প্রচ্ছদ বা নামপৃষ্ঠা ইংরেজি ভার্সানেই ছাপা।...ইংরেজি নামপত্র পরবর্তীর বটতলা থেকে প্রকাশিত 'অন্নদামঙ্গল'-গুলিতে ছিল না ঠিকই তথাপি সেইসব নামপত্র বা প্রচ্ছদও উনিশ শতকের বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-ভাষা থেকে যে কোনওভাবেই বেরোতে পারেনি এটা বলাই যায়।"

    ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত 'ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি' বাংলা বইয়ের মুদ্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৮৫১ সালে সোসাইটি প্রকাশিত 'ঠাকুরদাদার হস্তিবিষয়ক ইতিহাস' বইটির প্রচ্ছদ লেখকের বিচারে নান্দনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ - "এই বইয়ের প্রচ্ছদে দেখা মেলে কাঠখোদাইয়ে ছাপা সুদৃশ্য এক বর্ডারের। যার ভেতরে মানানসই বড় হরফে লেখা বইটির নাম। নীচে বেশ খানিকটা ফাঁক দিয়ে আবারও সুন্দর বর্ডার বা ফ্রেম করে তার ভেতর ছাপা হয়েছে 'CALCUTTA SCHOOL BOOK SOCIETY'-র সিলমোহর বা লোগোটি।"

    লেখক 'গুপ্তকথা' নামক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি সিরিজের বই নিয়েও আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন — "গুপ্তচর্চার বইতে লিথো উঠে এসেছিল নারীর দেহাঙ্গের সুষুমা নিয়ে। এইসব ছবি প্রচ্ছদ হিসেবেও স্থান পেয়েছিল। তবে সেসব পুরনো প্রচ্ছদের এখন খোঁজ পাওয়া অতি দুর্লভ ব্যাপার।...যে কটা আছে তা ঐ নামপত্রই।"

    বাংলা ধর্মগ্রন্থের প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা আছে এই বইয়ে। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য 'দেবীযুদ্ধ': "১২৮৩ সালে প্রকাশিত 'দেবীযুদ্ধ'-র প্রচ্ছদ বইটির বিষয়বস্তু ঘিরে আবর্তিত। বইয়ের নামটির পর সেখানে কাঠের ব্লকের প্রায় সাড়ে চার সেন্টিমিটারের এক নৃত্যরত গনেশমূর্তির দেখা মেলে। চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মে সুসজ্জিত গনেশ নাচের মুদ্রায় শোভিত হয়েছেন। তাঁর দু'ধারে পুষ্পলতা। নীচে বাহন। মূর্তির চারধারে হালকা সরলরেখার বর্ডার রয়েছে। নীচের বর্ডারে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে N. L. D.। N. L. D. হলেন বটতলার প্রখ্যাত কাঠখোদাই শিল্পী নৃত্যলাল দত্ত।" লেখক মনে করেন যে উনিশ শতকের শেষভাগে প্রকাশিত ধর্মগ্রন্থের প্রচ্ছদ "বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ-ভাবনাটিকে যথাযথ শৈল্পিক রহস্যের দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিল।"

    ৩.

    বটতলা প্রকাশিত বাংলা প্রহসন নিয়ে লেখকের আলোচনা তৎকালীন বঙ্গসমাজের রুচি ও মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়: "১৮৬০ থেকে ১৮৮০ - এই দুই দশক জুড়ে বটতলা থেকে অসংখ্য ছোট বই প্রকাশিত হয়েছিল, যার মধ্যে প্রহসনের সংখ্যাও ছিল প্রচুর।... ১৯০২ সালে প্রকাশিত হল রাধাবিনোদ হালদারের সামাজিক প্রহসন 'পাশকরা মাগ'। প্রচ্ছদে উঠে এল নগ্ন নারীমূর্তি। চারধারে চওড়া মানানসই বর্ডারের মাঝখানে শোভিত এই নগ্ন নারী। আলুলায়িত চুল। দু'হাতে অনেকটা বরাভয় মুদ্রার গড়ন। গলা রত্নখচিত। হাতেও কঙ্কণ। চুল দিয়েই তার যোনিদেশ ঢাকা। দাঁড়ানোর ভঙ্গিটি মা কালীর মূর্তিকেই মনে করায়।...মূর্তির নীচের দু'পঙক্তি লেখাতে সনাতনপন্থার ছায়া রয়েছে। 'স্ত্রী স্বাধীনের এই ফল। / পতি হয় পায়ের তল।।'" লেখক এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন- "খ্যাতনামা প্রহসন লিখিয়েদের তুলনায় অজ্ঞাতনামা প্রহসন লেখকরা বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, কৌলীন্যপ্রথার বিরুদ্ধাচরণই করেছেন।"

    পুজো-পুস্তিকার প্রচ্ছদের ওপরও লেখক আলো ফেলেছেন: "১৮৯৫-তে প্রকাশিত...একটি পুজো-পুস্তিকার মলাটে ছাপা হয়েছিল স্বপরিবারে দেবী দুর্গার ছবি। আটচালার ডাকের সাজে সজ্জিতা দেবী। পেছনের চালিতেও নকশাদার কাজ। প্রচ্ছদের মাঝখানে এই কাঠখোদাই ছবি।... নীচে লেখক ও প্রকাশকের নামের পর ইংরেজিতে রয়েছে প্রেসের নাম-ঠিকানা ও পুস্তিকার প্রকাশসাল আর ওপরে পুস্তিকার বিষয়বস্তু লেখা রয়েছে পদ্যে...কাঠখোদাই ছবির দু'ধারেও সমান মাপের জায়গায় লেখা রয়েছে একটি করে পদ্য-পঙক্তি। ডান ধারে লেখা: 'দুর্গাপূজার রং তামাসা'। বাম ধারে লেখা: 'পড় দিয়ে একটী পয়সা।।'" এই প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় বাঙালির রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। লেখক মনে করেন, "প্রচ্ছদের উৎসারিত রসই উদবুদ্ধ করত সাধারণ ক্রেতাকে এইসব বইয়ের দিকে টেনে নিতে।"

    ৪.

    বিশ শতকের বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা করার সময় লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের নজরে এনেছেন: "১৯২৯ সালে এম. সি. সরকার থেকে ছাপা হল শিবরাম চক্রবর্তীর কবিতার বই। নামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রচ্ছদে উঠে এল এক রঙা হাফটোন ব্লকে ছাপা রঁদার ভাস্কর্য 'The Kiss'। শিবরামের বইটির নাম 'চুম্বন'।" বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ ভাবনায় এইভাবে সরাসরি ইউরোপীয় ভাস্কর্য উঠে আসা সত্যিই চমকপ্রদ ঘটনা।

    বিশ্বভারতী প্রকাশিত বই ও তার প্রচ্ছদ নিয়ে লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন: "বিশ্বভারতী প্রকাশন বাংলা গ্রন্থশিল্পকে একটা রুচিই আসলে উপহার দিয়েছিল। প্রচ্ছদের রং যার প্রধান সহায়ক ছিল।... বাঙালির বোধিচর্চার অংশই হয়ে উঠেছে বিশ্বভারতীর বইয়ের প্রচ্ছদ।"

    উপেন্দ্রকিশোরের বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়ে আলোচনা করার সময় লেখক একটি বিশেষ বইয়ের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন: "...উপেন্দ্রকিশোরের উল্লেখযোগ্য বই 'সেকালের কথা' (১৯০৩)।…প্রচ্ছদে কালো রঙে ছাপা একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী সমুদ্র থেকে গলা উঁচিয়ে সোনার জলে এমবস করা টেরাডাকটিল ধরছে। দেখলে মনে হবে যে, ক্যামেরাতে তোলা ছবি। প্রচ্ছদশিল্পীর নামের জায়গাতে লেখা রয়েছে শিল্পীর নামের আদ্যাক্ষর U.R.। ... বাংলা বইতে হাফটোন ব্লকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।"

    সোমব্রত-র বইটিতে ঠাকুর পরিবার ও বিশ্বভারতীর কলাভবনের শিল্পীদের শিল্প ও প্রচ্ছদ ভাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। ১৯১২ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের 'ছিন্নপত্র'-র প্রচ্ছদ সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন: "এই বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন নন্দলাল বসু। সবুজের ওপর এমবস করে সোনার রঙে ছাপা হল একটি ঝরে যাওয়া পদ্মফুলের পাপড়ির ছবি।" নন্দলাল বসু কৃত রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য বইয়ের প্রচ্ছদ সম্পর্কেও লেখক আলোকপাত করেছেন: "'চয়নিকা' বেরিয়েছিল গাছের মোটিফে আঁকা প্রচ্ছদ নিয়ে।...বাংলার আলপনার লতা-ফুলের আঙ্গিক ছিল নন্দলালের 'চয়নিকা'-র প্রচ্ছদে।...'সহজ পাঠ'(১৯৩০)-এর প্রচ্ছদ ও অলংকরণ সবই নন্দলাল বসুর করা। এই বইতে করা নন্দলালের ছবি আজ ক্লাসিকে পরিণত হয়েছে।"

    রবীন্দ্রনাথের নিজের করা প্রচ্ছদ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'মহুয়া'। কী রূপ ছিল সেই প্রচ্ছদের? লেখকের ভাষায়— "অক্ষরের নিজস্ব কৌনিক ছাঁচ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজেই গড়ে তুললেন 'মহুয়া' কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ। ১৩৩৬ আশ্বিনে প্রচ্ছদ ও রঙিন নামপত্রে ভূষিত হয়ে 'মহুয়া'-র প্রকাশ যখন ঘটল তখন রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথে পরিণত হয়ে বসেছেন।...গাঢ় বাদামি, লাল, কালো ও হালকা হলুদের খেলায় রবীন্দ্রনাথ নামাঙ্কন করেছেন 'মহুয়া'-র।"

    অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ সৃষ্ট প্রচ্ছদ নিয়ে একটি অধ্যায় আছে বইয়ে। অবন ঠাকুরের 'বুড়ো আংলা' বইয়ের প্রচ্ছদের অভিনবত্ব সম্পর্কে লেখক বলেছেন — "বইয়ের প্রচ্ছদে যে খড়ের পুতুলের ব্যবহার তা সুইডিশ ছায়াজাত ঠিকই তবুও তার বসবার আদল, পুতুলের মাথার টোকাতে দেশীয় আবহাওয়া বেশ ভালভাবে মিশে আছে। এটা স্পষ্ট, অবনীন্দ্রনাথ নিজস্ব চিন্তার প্রয়োগে বিদেশী খড়ের পুতুলকে বাংলার পুতুলে রূপান্তরিত করে দিতে পেরেছিলেন অনায়াসে।"

    ১৯২৬ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'-র প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই প্রচ্ছদেও 'নতুনত্বের ছোঁয়া' দেখেছেন লেখক: "নতুন নিরীক্ষার এই নাটকের প্রচ্ছদপটেও এল নতুনত্বের ছোঁয়া। ছবি আঁকলেন গগনেন্দ্রনাথ কিউবিজম ঘরানাতে। তবে ভারতীয় রীতিও বজায় থাকল ছবিতে। সাদা কালো আলো-ছায়ার ঠাস জ্যামিতিক বুনোটে 'রক্তকরবী'-র একরঙা প্রচ্ছদ। নাটকের মূল বিষয়বস্তু যক্ষপুরীর সেই 'রাজপ্রসাদের জালাবরণ'-ই প্রচ্ছদের বক্তব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন গগনেন্দ্রনাথ।"

    আলোচ্য বইয়ের শেষ অধ্যায়ের শিরোনাম - 'নন্দলাল বসু ও শান্তিনিকেতনশৈলীর প্রচ্ছদ'। নন্দলাল বসু কৃত একটি অসামান্য প্রচ্ছদ পাঠকের নজরে এনেছেন লেখক: "নন্দলালের আঁকা আরেক অসামান্য প্রচ্ছদচিত্র গুরুসদয় দত্তের 'ভজার বাঁশী'-তে রয়েছে। সেখানে বইয়ের নামাঙ্কনকে এমনভাবে রঙ-তুলিতে লিখেছেন নন্দলাল, দেখে মনে হচ্ছে পুরো প্রচ্ছদপাতাতে বাঁশির সুর ছড়িয়ে গিয়ে তরঙ্গমালা দূর-দূরান্তরে চলে যাচ্ছে।"

    সোমব্রত সরকারের বইটি আসলে বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও শিল্প এবং প্রচ্ছদ ভাবনার দীর্ঘ ইতিহাসকে বোঝার প্রচেষ্টা। পাঠক তাঁর বইতে এই সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাবেন। তবে বাংলা বইয়ের মুদ্রণ ও প্রচ্ছদ ভাবনার ইতিহাসকে একসূত্রে গাঁথতে গিয়ে অনেকক্ষেত্রে প্রচ্ছদের শিল্পভাবনা মুদ্রণের ইতিহাসের ভিড়ে মুখ লুকিয়েছে। লেখকের কাছে বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদের শিল্পভাবনার ইতিহাস নিয়ে একটি স্বতন্ত্র বই রচনার প্রত্যাশা রইল।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments