১.
ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ! নামটা শুনলেই কেমন সাহেব-সুবোদের মুলুক মনে হয় না? সাহেবই তো! তবে কিনা আধা। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সাহেবদের গড়া গঞ্জ এটি। রাঁচি থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি কিলোমিটার উত্তর-পূবে ছোটনাগপুর মালভূমির জঙ্গলঘেরা ঢেউ খেলানো রাস্তা আপনাকে পৌঁছে দেবে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জে। ২০০০ সালে ঝাড়খন্ডের জন্ম হলে এ গঞ্জের ঠিকানা বদলে যায়। চারপাশে ছোটো-বড়-মাঝারি টিলা। টিলার গায়ে লেগে আছে ঘন জঙ্গল। যেন গাঢ় সবুজ চাদর। লালচে কাঁকুরে মাটির পথ বেয়ে এগোতে থাকলে মাঝে মাঝেই চোখে পড়বে পুরোনো দিনের সব বাংলো বাড়ি। কোনোটা ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটা বা জঙ্গলে ঢাকা পড়ে গেছে। কোনোটা আবার মাটির সঙ্গে মিশতে আর সিকি ভাগ বাকি। খুব কম বাড়িতেই মানুষের বাস। তবে গোটা গঞ্জ জুড়েই জমিয়ে বাস করে অতীত। ঔপনিবেশিক সময়ের এক ব্যর্থ পরিকল্পনার কাহিনী মিশে আছে এই আধা-সাহেবী শহরতলীতে। অনেক স্বপ্নের ভাঙা-গড়ার সাক্ষী এ মায়াবী গ্রাম, যার ডাক নাম 'মিনি ইংল্যান্ড'।
১৯৩৩ সাল। কলকাতার এক প্রভাবশালী রিয়েল এস্টেট ব্যাবসায়ী এবং ইন্স্যুরেন্স এজেন্ট, আরনেস্ট টিমোথি ম্যাক্লাস্কি (১৮৭২-১৯৩৫) 'কলোনাইজেশন সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড' নামে এক কোম্পানী খোলেন। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল-এ তিনি অ্যাংলো প্রতিনিধিও ছিলেন। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে শ' চারেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান এই কোম্পানীর শেয়ার কেনেন। উদ্দেশ্য একটাই। অ্যাংলোদের একটা নিজস্ব 'মুলুক' গড়ে তোলা। পাহাড়ের কোলে, নিরিবিলিতে গড়ে উঠবে সে মুলুক। ছোটনাগপুরের এই অঞ্চলটি ভারি পছন্দ হল ম্যাক্লাস্কি সাহেবের। এই অঞ্চল তখন বিহারের রতু রাজবংশের অধীনে ছিল, যে রাজবংশ নাকি কোনদিন যুদ্ধ করেনি, কোন প্রজার থেকে খাজনাও নেয়নি; বরং উদারভাবে দান খয়রাত আর সমাজ সেবা করে গেছে। অথচ কোথাও নামের ফলক লাগায়নি রাঁচীর এই প্রচার-বিমুখ উপজাতি রাজপরিবার। যাইহোক, ম্যাক্লাস্কি সাহেব রতুর তৎকালীন মহারাজার কাছ থেকে দশ হাজার একর জমি ইজারা নেন। সব মিলিয়ে ন'টি গ্রাম। শর্ত ছিল, এই নতুন জনপদ থেকে ওই ন'টি পাহাড়ি গ্রামের আদিবাসী ও উপজাতি বাসিন্দাদের কোনভাবেই উৎখাত করা চলবে না। শর্তমতো প্রান্তিক জনজাতিদের পাশে নিয়েই গড়ে ওঠে নতুন অ্যাংলো জনপদ। জীর্ণ কুঁড়েঘর আর সাহেবী বাংলো মিলেমিশে থাকল ছোটনাগপুরের এই পাহাড়ি উপত্যকায়, ঔপনিবেশিক ভারতের এক অকিঞ্চিৎকর অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে।
২.
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ভারতে রেল পথ এবং টেলিফোন লাইন পাতার কাজে প্রযুক্তি-জ্ঞান সম্পন্ন ইউরোপীয়দের ডাক দেয় ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার। ১৮৬৯-এ সুয়েজ খাল কাটার আগে পর্যন্ত খুব কম বৃটিশ মহিলাই তাদের স্বামীদের সঙ্গে ভারতে এসেছেন। বিভিন্ন আর্কাইভ বলছে, বৃটিশ মেয়েরা পাত্র হিসেবে ভারতে সিভিল সার্ভিসে, সেনাবাহিনীতে বা অন্যান্য কাজে নিযুক্ত বৃটিশ পুরুষদের তেমন একটা পছন্দ করত না। এ হেন বৃটিশ পুরুষেরা অগত্যা নেটিভ মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে, বিয়ে করে কিংবা না করে। তাদের সন্তানদের নিয়েই 'অ্যাংলো ইন্ডিয়ান' নামে নতুন জাতিগত পরিচয়ের সূত্রপাত। বেশিরভাগ অ্যাংলো পরিবারই যেহেতু রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল, প্রথম প্রজন্মের এই অ্যাংলো ছেলেমেয়েদের তাই 'রেলওয়ে চিল্ড্রেন' বলা হতো। দেখতে প্রায় বৃটিশদের মতো, ভাষা ইংরেজি, অথচ পুরোপুরি ইংরেজ নয়। অ্যাংলোদের এ এক আত্মপরিচয়ের সংকট। অ্যাংলোরা সাধারণত নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যেই মেলামেশা করত। ঔপনিবেশিক ভারতে বৃটিশদের থেকে আড়ালে সরে এসে নির্জনে নিজেদের কলোনী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ম্যাক্লাস্কি। গোষ্ঠীবদ্ধতাকেই কি তাহলে আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার পথ ভেবেছিলেন তিনি! চারশো জন অ্যাংলো সোসাইটির শেয়ার কিনলেও, সাকুল্যে কিন্তু আড়াইশো পরিবার থিতু হয়েছিল ম্যাক্লাস্কিগঞ্জে। তাদের সঙ্গে এসেছিল তাদের অভ্যস্থ জীবনধারা এবং যাপনের উপাদান সামগ্রীও। নিঝুম গ্রামের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল এলাহী সব বাংলো। ঢালু ছাদ, সামনে প্রশস্ত বাগান, লিভিং রুমে ফায়ারপ্লেস, ছিল পোস্টঅফিস, বেকারি, চার্চ এবং কবরখানাও। বল ডান্স, পিয়ানোর সুর আর সুরা পাহাড়ি গ্রামখানিকে বাস্তবিকই 'মিনি ইংল্যান্ড' বানিয়ে তুলেছিল।
বৃটিশদের মতো জাতিগত আভিজাত্য তাদের নেই, আবার নেটিভদের সঙ্গে মিশে যাওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এক অর্থে তারা সামাজিকভাবে প্রান্তিক। সেই প্রান্তিকতার থেকেই হয়তো ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা জাগে অ্যাংলোদের। সংবিধানের আর্টিকেল ৩৩১ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সুবিধে দিয়েছিল, যার বলে রাষ্ট্রপতি দুজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানকে লোকসভায় মনোনীত করতে পারতেন। ২০১১ সালের জনগননা বলছে দেশে অ্যাংলো জনসংখ্যা নাকি ২৯৬, যার মধ্যে ২২৫ জন শহরে এবং ৭১ জন গ্রামে বাস করেন। এ হেন ক্ষীণ জনসংখ্যার সত্যতা নিয়ে অ্যংলোদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ আছে। কিন্তু সে অসন্তোষে পাত্তা না দিয়ে সরকার ২০১৯-এ সংবিধানের ১০৪ নং সংশোধনী পাশ করিয়ে পার্লামেন্টে অ্যাংলোদের সংরক্ষিত আসন দুটি তুলে দেয়। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রান্তিকীকরণের ইতিহাস তো ছিলই, এখন নতুন করে রাজনৈতিক প্রান্তিকীকরণ ঘটল এই সংখ্যালঘু সমাজের।
৩.
যে উদ্দীপনা নিয়ে এই গঞ্জের বর্ণময় যাত্রা শুরু হয়েছিল, বছর দশ পনেরোর মধ্যেই তা বিবর্ণ হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ভারত স্বাধীন হল। ১৯৫০ সালে কলোনাইজেশন সোসাইটি উঠে গেল। তার অনেক আগেই তিমোথি ম্যাক্লাস্কি মারা গেছেন। ১৯৭০ সালের মধ্যে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের বেশিরভাগ অ্যাংলো পরিবারই দেশ ছেড়ে চলে যায়। জনপদ গড়ে উঠলেও এখানে ছিল না কোন স্কুল-কলেজ, না কোন কাজের সুযোগ। এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিল না তেমন রাস্তাঘাট এবং যোগাযোগের মাধ্যমও। তাই নতুন প্রজন্মকে ধরে রাখতে পারেনি গঞ্জ। ফাঁকা হতে থাকে একের পর এক বাংলো। কেউ জলের দরে বেচে দেন, ভবিষ্যতে কোনদিন ফেরার আশায় কেউ কেউ স্থানীয় গ্রামবাসীর হাতে দেখাশোনার ভার দিয়ে চলে যান। ফেরা হয় না তাদের আর কোনদিনই। কালে দিনে অনেক বাংলোই কেয়ারটেকারদের বসতবাড়ি হয়ে গেছে। বৈধ বা অবৈধ মালিকানা নিয়ে তারাই জাগিয়ে রেখেছেন অ্যাংলো সাহেব-মেমসাহেবদের স্মৃতি। কোথাও বা উদ্যমী স্থানীয় যুবক বাংলো কিনে নিয়ে গেস্টহাউস বা রিসর্ট বানিয়ে ফেলেছে। তার দৌলতে আজকাল ছোট ছুটির ছুতোয় সপ্তাহান্তে বেড়ানোর ঠিকানা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জ। ডেনিস মেরেডিথ বা ম্যালকম হরিগ্যান এর মতো যে গুটিকয় অ্যাংলো সদস্য গঞ্জে এখনো রয়ে গেছেন, তাদের চোখে সেই ঝলমলে দিনের স্মৃতি জেগে আছে আজও। বাপ-ঠাকুরদার স্বপ্নের মৃত্যু ঘটেছে যে গঞ্জে, সেখানেই নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা ।
'কিটি মেমসাহেব'-কে বাদ দিয়ে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের গল্প অসম্পূর্ন থেকে যাবে। ক্যাথরিন টেক্সেরা, ডাক নাম 'কিটি'। তিনিই ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের প্রবীনতম অ্যাংলো বাসিন্দা। সত্তর পেরোনো কিটি মেমসাহেব কথায় কথায় পিছিয়ে যান তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোয়। "মনে আছে রবিবার চার্চে যেতে খুব মজা হতো। একবার তো আমি তিন পায়ে পোট্যাটো রেস এ আঠেরো টাকা জিতেছিলাম। ও! আর একবার ফ্যান্সি ড্রেস প্রতিযোগীতায় ছ টাকা"। এমন আনন্দ উচ্ছল দিন কিটির জীবন থেকে মুছে যায় তার কৈশোরেই। কলোনাইজেশন সোসাইটিতে টাকা লাগিয়ে স্বর্বসান্ত হন কিটির বাবা। বাবা মারা যাওয়ার পর উঠতি বয়সের কিটিকে নিয়ে চিন্তায় পড়েন মা মার্জোরি রবার্টস। মা যথেষ্ট শিক্ষিত ও রুচিশীল হলেও মেয়ে কিটি লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি। এমন নিঝুম গ্রামে কিটিকে কিভাবে নিরাপদে আগলে রাখবেন, কিভাবেই বা পাত্রস্থ করবেন সেই চিন্তায় আকুল হন মার্জোরি। স্থানীয় এক আদিবাসী যুবক কিটিকে বিয়ে করে। সে বিয়ে সুখের হয় নি। সন্তানদের নিয়ে তার জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। এখন গঞ্জে বেড়াতে আসা মানুষদের কাছে, 'কিটি মেমসাহেব' বেশ কৌতুহল জাগানো এক নাম, এক জীবন্ত দ্রষ্টব্যও। পাহাড়ের কোল ঘেঁসে ছোট্ট এক বাড়ি। না, বাংলো টাংলো না। নিতান্ত জৌলুশহীন, নিম্ন মধ্যবিত্তের মাথা গোঁজার ঠাঁই। গেলে হয়ত দেখাও পাবেন না তাঁর। হয়ত তিনি তখন রেলস্টেশনে ফল বিক্রি করতে গেছেন। বিগত পাঁচ দশক ধরে এটাই তাঁর পেশা। নয়তো বা ছাগল চরাতে গেছেন কোনো পাহাড়ের ঢালে। সত্যি বলতে কি, তাঁকে দেখতে আসা শহুরে পর্যটকদের তিনি এড়িয়ে চলতেই ভালবাসেন। সত্তর পেরোনো কিটি মেমসাহেবের ছিপছিপে চেহারায় ব্যাক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করছে অতীত। চোস্ত ইংরাজীতে সাহেবী উচ্চারণে কিটি মেমসাহেব উজাড় করে দেন স্মৃতির ঝাঁপি। যদি অবশ্য তাঁর বলতে ইচ্ছে হয়।
ডন বস্কো স্কুলের দৌলতে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের জীবনে এখন ব্যস্ততা এসেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল ফিরেছে। এসেছে খানিক অর্থনৈতিক সচ্ছলতাও। তবু যেন এক রাশ বিষণ্ণতা মিশে আছে পাহাড়তলীর পথে পথে। আজকের অসহিষ্ণু সময়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের 'সর্বধর্ম স্থল' বিষ্ময় জাগায়। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদোয়ারা এক চত্বরে গড়ার উদারতা দেখতে পেরেছিলেন এই সংখালঘু প্রান্তিক অ্যাংলোরা। সেন্ট জনস চার্চে আজও মানুষ জড়ো হয়, সাপ্তাহিক প্রার্থনায় বা বড়দিনে। গির্জার খসে পড়া পলেস্তারা মনে করিয়ে দেয়, বার্ধক্য একটু যত্ন চায়। গঞ্জের মাঝখান দিয়ে ডুগাডুগি নদী পাহাড়ের ধাপ কেটে বয়ে চলে। এখনো বর্ষায় তার উদ্দামতা আগের মতোই। তবে সেই উদ্দামতা যেন ভেসে যায় নদীর স্রোতেই; তার ছোঁয়া এসে লাগে না গঞ্জের বাংলোয়। জীর্ণ সব বাংলো জুড়ে কেবল ধুলো মাটি, লতানে আগাছা, নীরবতা আর মনখারাপের প্রলেপ। সন্ধের গা ছুঁয়ে যখন আবছা অন্ধকার নামে, মনে হয় এখুনি পিয়ানো বেজে উঠবে, ফায়ার প্লেসে কাঠের আগুন উষ্ণতা ছড়াবে, ঝাড়বাতির আলোয় ঝলসে উঠবে বাংলোর অন্দর। না, তা আর হবার নয়। সময়ের সাথে সাথে লেখা হয়ে গেছে এপিট্যাফ। 'আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ' নয়, 'দ্য ডেথ অফ আ গঞ্জ'। ম্যাক্লাস্কিগঞ্জের স্বপ্নেরা ঘুমের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি অ্যাংলো মুলুক। ছেড়ে যাওয়া বাংলোর নিঃসঙ্গ গরাদ যেন ফিসফিসিয়ে বলে "কেউ কথা রাখেনি"।