“গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথরাঙামাটি কাব্যের আঁতুড়ঘর, কবিদের চারণভূমি। যেখানে শহুরে নাগরিক উষ্ণতা মাখা প্রেম, খোঁজে এক টুকরো মাথা গোঁজার আশ্রয়। যেখানে শাল, পিয়াল, পলাশের বনে মাতন তুলে বাতাসের স্রোত বয়ে যায় আড়বাঁধের চরে। সেখানে প্রকৃতি শিল্পীর নিপুণ হাতে জলরঙে আঁকা ছবির মতো। এটি মুদ্রার একটি পিঠ। অপর পিঠে নেই কোনো নরম তুলির আঁচড়। সেখানে জীবন শুধুই নির্মম বাস্তবে জারিত ফাঁকা সাদা-কালো ক্যানভাস। যে ক্যানভাসে মাটির শব্দ ভরেছেন লেখক সত্য মন্ডল। ক্রমশ তা একটি উপন্যাসের আকার নিয়েছে। যার নাম ‘জলাবর্ত’।
আমার মন ভুলায় রে……..”
বাংলাসাহিত্যে আঞ্চলিক উপন্যাসের তালিকা সুদীর্ঘ। ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’, ’তিতাস একটি নদীর নাম’ ‘গঙ্গা’ বা‘গঙ্গা’র স্রষ্টা সমরেশ বসুর বাঁকুড়ার তাঁতিদের নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘টানাপোড়েন’, এমনি আরও কত উজ্জ্বল স্মরণীয় নাম। স্থানিক সাহিত্যের সেই ধারায় নবতম এবং সার্থক সংযোজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক সত্য মন্ডলের উপন্যাস “জলাবর্ত”। বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামীণ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক,অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিমন্ডলের সঙ্গে সেখানকার মানুষজনের জীবন, জীবিকা ও ভাষার সম্পৃক্ততা, এই উপন্যাসটিকে বাংলা আঞ্চলিক সাহিত্যের ধারাবাহিকতার মূল সারিতে জায়গা করে দিয়েছে। উপন্যাসটি মোট ছত্রিশটি শিরোনামাঙ্কিত পর্ব বা অধ্যায়ে বিভক্ত। ব্যতিক্রমী শিরোনামগুলির কতকগুলি যথাক্রমে: ‘জ- এ জন্ম, ল- এ লয়’, ‘খড়কুটো জ্বলে গল্পগাছা চলে’, ‘সাঁঝের বেলা বাঁধের ডাক যে নিবি সে দমে হাঁক’, ‘বসন্তের দিনকাল’ ইত্যাদি। রাঢ়বঙ্গীয় গ্রামীণ এবং আঞ্চলিক ভাষায় লেখকের স্বচ্ছন্দ বিচরণ উপন্যাসটিকে স্বকীয়তার এক অন্য মাত্রায় উপনীত করেছে। চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে আরোপিত কৃত্রিমতা না থাকায় চরিত্রগুলি অত্যন্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গল্পের মূল ভাবটি প্রচ্ছদেও যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী মৃণাল শীল।
চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বৃষ্টির অভাব, ফুটিফাটা মাটি আর এক পেট খিদে এই হল রাঢ়বাংলার প্রান্তিক দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার বারোমাস্যা। দৈনন্দিন দারিদ্রকে সঙ্গী করে, ধরনের দিনে শরীর পুড়িয়ে শুধুমাত্র ঠোঁটের মধ্যে প্রাণ আটকে বেঁচে থাকা। অর্থকরী ভরসা মূলত মীন চাষ এবং চাষাবাদ। এক ফসলী জমি। সারাবছর সেও দু-হাত উপুড় করে না। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে অর্থনীতির এখানে নিবিড় যোগাযোগ। প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাত্রায় নেই কোনো উন্নয়নের ছাপ। অভাব অনটনের জীবনে গরীবগুর্বো মানুষগুলোর কাছে এক ফালি আনন্দ হয়ে আসে উৎসব। বছরভর হরিনাম সংকীর্তন এবং শারদীয়ার মতো ফি-বছর যাত্রাপালা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক যন্ত্রণা জর্জরিত দিনলিপিতে এক ফোঁটা মুক্তির মধু। যদিও এই সমস্ত পেট-ভাতার যাত্রাপার্টিদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গাঁয়ের এক একটি বাড়ির প্রাণান্তকর অবস্থা হত।
আটচালায় বসে গ্রামের মোড়ল মাতব্বরদের জ্যাঠামো, পুকুর ঘাটে মেয়ে-বৌদের কূটকচালী, গ্রামের একমাত্র বাঁধের অধিকারকে ঘিরে শরিকি বিবাদ-বিসম্বাদ — সবই গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের সামাজিক জীবন ও তারই দৈনিক যাপনের খন্ড চিত্র। শুধু বাংলা নয়, গ্রামীণ ভারতবর্ষের বুভুক্ষু মানুষগুলোর বঞ্চনার ইতিহাস খানিকটা হলেও একই রকম। তবে গ্রামীণ রাঢ়বাংলার ভূমিপুত্র হওয়ার কারণে লেখক সেই খন্ড চিত্রগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। চলচ্চিত্রের মতোই চোখের সামনে একটি ছায়াছবিকে উপস্থাপিত করেছেন। যার নাম “জলাবর্ত”। জলাবর্ত শব্দটির আক্ষরিক অর্থ জলের মধ্যে তৈরী হওয়া ঘুর্ণি। এই উপন্যাসটির শরীর জুড়েও রয়েছে একটি জলাশয় এবং সেই জলাশয়কে কেন্দ্র করেই যে লড়াই, রাজনীতি, লোভ এবং প্রেমের জটিল আবর্ত, তাই এ কাহিনির মূল উপজীব্য।
বাঁকুড়া জেলার এই অঞ্চলে লৌকিক ভাষায় বড় জলাশয় বা বিল হল বাঁধ। পাকুড়ডিহি গ্রামের সবচেয়ে বড় বিল, ষোল আনার বাঁধ। সে বাঁধ বহু বছর ধরেই সর্বসাধারণের অধিকারে ছিল। কয়েক বছর আগে শরিকি বিবাদের কারণে মৃতপ্রায় এই বাঁধ গাঁয়েরই ভূমিপুত্র প্রমথর একার চেষ্টায় এবং শ্রমে আবার নতুন জীবন পায়। রাঢ় অঞ্চলে মীন চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। এদিককার পোনা সমগ্র দক্ষিণ বঙ্গে সমাদৃত। এবার বাঁধের নিলাম হলে প্রমথর ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়বে একথা শুধু প্রমথ নয় গোটা গ্রামই বিশ্বাস করত। কিন্তু বে-গাঁয়ের যুবক উলাচাঁদ বিশ হাজার টাকায় প্রমথ এবং গ্রামবাসীদের সমস্ত বিশ্বাসকে পরাস্ত করে মীনচাষের বরাত ছিনিয়ে নেয়। শীতের বিকেলের মতো ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে প্রমথর মনে। এত মোটা অঙ্কের টাকা গরীব মানুষগুলো একসাথে কখনো দেখেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু পর্দার আড়ালে ঘটে যাওয়া রাজনীতির অঙ্কটা বোধ হয় গ্রামের মানুষ আগে থেকেই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল। তাই পাকুড়ডিহি গ্রামের আনাচেকানাচে তখন শুধুই ফিসফিস আর কানাঘুষো। মীনচাষের পরিবর্তে বাঁধের জলে বোরো চাষের সিদ্ধান্ত প্রমথ আর মুরুব্বিদের মাঝখানের তিক্ততা আরও বাড়িয়ে তোলে। সেই তিক্ততাই ক্রমশ উলাচাঁদের প্রতি প্রমথর মনে শত্রতার বীজ বপন করে। শুধু প্রমথ নয় নিজের কাঙ্ক্ষিত বস্তু বা জীবন অধরাই থেকে গিয়েছিল এ গাঁয়ের মেয়ে ফুলির কাছেও। বাবা কুষ্ঠরোগী তায় গ্রাম ছাড়া, তাই মেয়ে পাত্রস্থ হয় না। ভোগ করা গেলেও বিয়ে করা যায় না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন নিষ্ঠুর সামাজিক শাসনে পিষে যায় ফুলির ভবিষ্যৎ বসন্ত। তাই নিজের রূপ যৌবনের টোপ জলে ভাসিয়ে সম্পন্ন মীনচাষী উলাচাঁদের মনের দোরগোড়ায় পৌঁছতে চায় ফুলি। রাঢ়ভূমির রুখাসুখা মাটিতে মনে প্রেম ঝরে না, হিসেবি বৃষ্টির মতো সে শুধু শরীরেই বাসা বাঁধে।
প্রমথ, ফুলি এবং উলাচাঁদ এই তিনটি চরিত্র ছাড়া আরও অনেকগুলো চরিত্রের উপস্থিতি এখানে বেশ উজ্জ্বল ও আকর্ষণের বিষয় । মিলনি বউ, বসন, পন্ডিত, শ্রীধর, শ্রীপতি এদের প্রত্যেককে ছুঁয়েই মূল গল্প তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে এগিয়েছে। প্রমথর স্ত্রী মিলনি বউ চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে গ্রাম বাংলার মেয়ে-বউদের একটি সামগ্রিক রূপ পরিস্ফুট হয়েছে। যারা প্রতিদিনের যে কোনো ছোটবড় ঘটনার ক্ষোভ উগরে দেবার আদর্শ স্থান মনে করে পুকুর ঘাটকে। বাঁধের নিলামে প্রমথর বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রনায় মিলনি বউও ঘাটে বসে মুরুব্বিদের বাপ-চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে ছাড়ে। “ঈরষা করেই মইরল খাল ভরা রা, ঈরষা করেই মইরল……ডি-য়ের বাইদ কে যাবি রে ঘাটের মড়া রা…….লিব্বৈংশোরা - তরা বেটার মাথা খাবি রে…..তদের মুখে পকা প ইড়ব্যাকরে খালভরারা…..” (পৃ-৪৭) খিদে পিতা-পুত্রের সম্পর্ককে কোন আদিমতার চৌকাঠ পেরোতে বাধ্য করে প্রমথর বাবা শ্রীধর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। “আর বেশিদিন বাঁইচব নাই ব। যা জাড় পড়ইচে। খাত্যেও আর তেমন রুচাচ্চে নাই। কবের থাক্যে শালাকে বলচি একদিন একটু মাছ লিয়ে আয়রে। সেদিন এক গাড়ি খেজুর গুড় বিকে আল্যে। যাওয়ার সময় কত করে কান কামড়াই বল্যে দিলাম একটু মাছ লিয়ে আসবি রে। নাঃ হরগিজ আনল্য নাই শালা।” (পৃ-৩০)
গ্রামের মোড়ল মাতব্বরদের মধ্যে ব্যাতিক্রমী চরিত্র শ্রীপতি। লেখকের ভাষায় “গ্রামের মধ্যে এই এক সদাশিব মহাদেব। চালচুলোর মধ্যে নেই। যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো মানুষ। চেলাচামুন্ডা নিয়ে আহার ও আনন্দ আহরন করা তার কাজ। লোকে বলে খেপু। খেপা শ্রীপতি। বর্তমান নিয়ে পড়ে আছে। ভূত ভবিষ্যতের কথা তার মাথায় ঠাঁই পায় না।” (পৃ-৯১) শ্রীপতির সংসার আছে কিন্ত দায়িত্ব নেই। জীবনের তিনটি মূলমন্ত্র– আহার, আমোদ এবং প্রমোদ। যাত্রামোদী মানুষ কিন্তু কেচ্ছা তার পিছু ছাড়ে না। এদের পাশাপাশি এই গল্পে উল্লিখিত একটি চরিত্র খড়ু-গরুবাগাল। এখানে এই চরিত্রটির মধ্যে দিয়ে লেখক রাঢ়বাংলার প্রান্তিক একটি জীবিকা বাগাল প্রথার প্রসঙ্গ পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। মূলত ভাতের বিনিময়ে গরুচরানো ছিল এদের কাজ।
উপন্যাসের শেষাংশে একটি দুর্যোগের রাতে উলাচাঁদের প্রতি প্রতিশোধ স্পৃহায় উন্মুখ হয় প্রমথ। উল্টোদিকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর এমন একটি দুর্যোগের রাতের অপেক্ষায় থাকে উলাচাঁদের মতো মীনচাষীরা। যে রাতে পাকুড়ডিহি গ্রামের আড়বাঁধের সমস্ত জলজ প্রাণ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মাতোয়ারা, সে রাতে প্রকৃতিও মঞ্চ প্রস্তুত করেছিল উলাচাঁদ এবং ফুলির মিলন পর্বের। সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এক হয়ে তারা পাড়ি দেয় নতুন জীবনের উদ্দেশ্যে। পিছনে পড়ে থাকে দৈনন্দিন জীবন চক্রের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব। আসলে এটাই অনন্ত বন্ধনের ঋণ যা এড়ানো যায় না। জলের আবর্তে আবর্তিত হয় একগুচ্ছ মানুষের জীবন। তাদের আশা-নিরাশা, আনন্দ-বেদনা, প্রেম ও শরীরের কামনা। এবং বঞ্চনাও। এ যেন জলের আয়নায় প্রতিবিম্বিত অজানা এক সাদাকালো জীবন।