এ এক অনন্ত যাত্রা। প্রারব্ধে স্থির থেকে আধার হয়ে ওঠার আলেখ্য। শমে নির্বাণের স্থিতধী অচঞ্চলতা। এ পথের নির্মাতা কে? উত্তর হয়তো বিতর্কিত। কেউ মনে করেন মানুষই জীবনের কারিগর। কারও মতে এ নির্মাণের নিয়ন্তা অলঙ্ঘনীয় অদৃষ্ট— মহামহিম ঈশ্বর। তবে বিতর্ক থাকলেও ব্যক্তির আবেগ, লক্ষ্য, শ্রম ও নিষ্ঠাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেই চলে এই বিনির্মাণ। সুনন্দ বসু তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ “প্রারব্ধ আধার ও নির্বাণ”- এর ১৬০ পাতায় নিজের জীবনের নানা মুহূর্ত ও অভিজ্ঞতার ক্যানভাসে শব্দের রঙতুলিতে ধরতে চেয়েছেন এই ‘হয়ে ওঠার’ কাহিনিকে। তাঁর ব্যক্তি অভিজ্ঞতার ছিন্ন ছবির কোলাজে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আত্মকথনের ভিন্ন রূপ। লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা মুখ্য হলেও,এই বই নিছকই স্মৃতিকথা নয়, জীবন সম্পর্কে ব্যক্তি উপলব্ধির স্বতন্ত্র ভাষ্য। আত্মকথার রসে নিষিক্ত আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্মোপলব্ধির যুগলবন্দি।
তবে “প্রারব্ধ আধার ও নির্বাণ” বিচিত্র অভিজ্ঞতার বর্ণনায় আধারিত কোনো সম্পূর্ণ আত্মজীবনী নয়। লেখকের কথায়, “আত্মজীবনী লেখার মধ্যে কোথাও যেন একটা অহংবোধ কাজ করে। বা একটু আত্মপ্রচারের ইচ্ছে। যেন একটা ধ্বনি ওঠে মনের কোণে, আমার জীবন অন্যের থেকে আলাদা। অন্যরকম। তা সে সুখের বা দুঃখের। পাওয়ার হোক বা হারানোর। ভালোবাসার হোক বা রূপের। অথবা এসব কিছু নিয়ে একটা রহস্যময় মায়ার। আবার এও হতে পারে যে, আমার গল্প শোনার পর তুমি ভাববে— এ হদ্দবোকা না বদ্ধ উন্মাদ। হয়তো দুটোই। তবে ভেবে দেখতে গেলে এই হদ্দবোকা আর বদ্ধ উন্মাদের মধ্যে তফাত নেই খুব একটা। কেননা এরা দু-জনেই জীবনটাকে দেখেছে একটু অন্যচোখে। জীবনকে পেয়েছে অন্যভাবে, তথাকথিত নিয়মের বেড়াজাল টপকে। আমিও টপকেছি অনেকবার। দেখেছি এক আলো-আঁধারি, ভালো-মন্দের মায়ার খেলা। যেখানে ভালো হওয়া, ভালো থাকা আর ভালো রাখাটাও সবসময়ে ভালো না। আবার এর উলটোটাও সত্যি। এখানে সব কিছুরই আছে এক নিজস্ব পরিপ্রেক্ষিত। আর কোথাও-না-কোথাও সমানুপাতিক। হালকা আর সহজভাবে এক গভীরকে ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টা।” (আত্মজীবনী)
এই ”হালকা আর সহজভাবে এক গভীরকে ছুঁয়ে ফেলার চেষ্টা”-ই লক্ষ্য করা যায় ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিষ্ঠিত চিত্রকর দিল্লি প্রবাসী সুনন্দ বসুর প্রথম বইয়ে সংকলিত ৩৯টি নিবন্ধে। অবশ্য এই নিবন্ধগুলির মধ্যে প্রথম দুটি 'প্রাককথন’ও ‘আত্মপক্ষ’ বাকি ৩৭টি নিবন্ধের থেকে কিছুটা ভিন্ন ধরনের। উৎসর্গ, লেখার উদ্দেশ্য ও বিধেয় ইত্যাদি গ্রন্থ নির্মাণের প্রসঙ্গকে গৌরচন্দ্রিকার মতো সূচনায় জায়গা করে দেবার প্রথাগত রীতির অনুসরণ পুরোপুরি না করে লেখক এই দুটি নিবন্ধের মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য হাজির করেছেন পাঠকের সামনে। ‘প্রাককথন‘-এ লেখক এই বই লেখার ও প্রকাশের কারণ ব্যাখ্যা করার গতানুগতিক পথ থেকে সরে এসে সংক্ষেপে ‘প্রারব্ধ’,’আধার’ ও ‘ নির্বাণ’ শব্দ তিনটি তাঁর নিজস্ব বোঝাপড়ায় কোন ব্যঞ্জনা তৈরি করে তা বলতে চেয়েছেন। ‘আত্মপক্ষ’ সম্পূর্ণভাবে একটি সুদীর্ঘ উৎসর্গ পত্র। শুধুই নামের তালিকার সংযোজন না করে সুনন্দ তাঁর জীবনের প্রারব্ধ, আধার ও নির্বাণে যে মানুষরা অনুঘটকের কাজ করছেন তাঁদের কথাকে শব্দের বুননে বেঁধে তৈরি করেছেন এই স্বয়ংসম্পূর্ণ নিবন্ধটি। আদর্শ উৎসর্গ পত্রের মতো গ্রন্থ নিবেদন করেছেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় কাহিনির মোড়কে। ফলে চরিত্রগুলি নামের একমাত্রিক পরিসরকে অতিক্রম করে ত্রিমাত্রিক আয়তনে রক্তমাংসের হয়ে উঠেছে। এই সংকলনের বিভিন্ন নিবন্ধের নানা প্রসঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে এদের কথা লেখকের লেখায় উঠে আসবে। তাই এই বইয়ের প্রেক্ষিতে, অনেকটা নাটকের পরিভাষায় ‘এক্সপজিশান’ গোত্রের রচনা ‘আত্মপক্ষ’।
গ্রন্থনামের অনুষঙ্গে নিবন্ধগুলিকে তিনটি উপবিভাগে সাজানোর সুযোগ থাকলেও লেখক সে পথে হাঁটেননি। পাঠকের পাঠোপলব্ধির উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন বিষয়ের তারতম্যে লেখাগুলিকে প্রারব্ধ, আধার ও নির্বাণ অংশে অন্তর্ভুক্ত করে নেবার দায়িত্ব। প্রগতিমুখি পথরেখাটি চিনে নেবার ভার। স্রষ্টা হিসেবে পাঠককে বিশ্বাস করার এই ভাবনার মধ্যে নিহিত শিল্পী ও শিল্পের স্বাধীনতা বোধ। “আসলে শিল্পী তার কোনো ভালোলাগার মুহূর্ত বা কষ্ট বা প্রতিবাদের মুহূর্তকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে কাগজে বা ক্যানভাসে। আর সেই মুহূর্তটা যখন মিলে যায় অন্য কারুর অবচেতনে লুকিয়ে থাকা কোনো অভিজ্ঞতার সঙ্গে, তখন তৈরি হয় ভালোলাগার সঠিক মাপকাঠি, পাওয়া যায় ছবির আসল মূল্য।” (বিনামূল্যে) এই ‘আসল মূল্য’ প্রাপ্তির লক্ষ্যেই লেখক তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে প্রারব্ধ,আধার ও নির্বাণের মানচিত্র বুঝে নেওয়ার ভার তুলে দিয়েছেন পাঠকের জিম্মায়।
জীবনকে আঁকড়ে ধরে তৈরি হওয়া ছোটো ছোটো লেখাগুলিতে পাঠকের জন্য ছড়ানো রয়েছে অসংখ্য মণিমুক্তো। বিশেষ করে যাদের বেড়ে ওঠার সময় বিগত শতকের আশি ও নব্বইয়ের দশক। কয়লার উনুন থেকে ফেরিওয়ালার পশরা, একান্নবর্তী পরিবার, দূরদর্শনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অমোঘ আকর্ষণ, কম্পিউটারের অলৌকিক আবির্ভাব, এরকম আরো কত কিছু যাদের অধিকাংশই আজ স্মৃতির মহাফেজখানায় সযত্নে রক্ষিত, লেখকের স্বাদু উপস্থাপনায় পাঠকের মনের দেওয়ালে করাঘাত করে যাবে। যেমন লেখকের কৈশোরের সকালের এই বিবরণ “আগে হাত লাগাতাম দাদুর সঙ্গে উনুন ধরানোতে। গুল, কয়লা দিয়ে তারপর পাখার হাওয়া। আমার খুব ভালো লাগত ধীরে-ধীরে কালো কয়লার কমলালাল হয়ে ওঠা দেখতে। আর ততক্ষণে কমলা হয়ে উঠত আকাশও। রান্নাঘর আর ছোটো দালানের জানলা দিয়ে ঢুকে আসত রোদ্দুর। আর সে-রোদ্দুরে নানান নকশা বানিয়ে উড়ে যেত ছাই রঙের ধোঁয়ারা। সেটা দেখার মজাই ছিল অন্যরকম। এছাড়া ছিল স্টোভ। তবে তাতে ঝক্কি বেশি মজা কম। পরিষ্কার করো— পলতে লাগাও, আবার ফেটে যাওয়ার ভয়। হ্যাঁ, কেরোসিন তেলের গন্ধটা বড়ো ভালো লাগত। এই স্টোভ, উনুন ঠিক দারিদ্রের পরিচয় ছিল না তখন, অন্তত আমাদের জন্য। এগুলোই একমাত্র সাধন ছিল রান্নার সেই সময়ে, যা আজকে ভাবতে অবাক লাগে।” (রান্নাঘর)
সার্বজনীন দৈনন্দিনের ছবিই শুধু না শিল্পীর কলমে স্থানিক দৃশ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও পাঠককে আকর্ষণ করবে, বিশেষ করে যাদের শৈশব, কৈশোর, যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে হাওড়া জেলার শিবপুর, মন্দিরতলা অঞ্চলে। বর্তমানে দিল্লিবাসী হলেও গলির গোলকধাঁধায় বেনারসের প্রায় সমতুল্য শিবপুরের গায়ে গা লাগানো ইমারতের নিশ্ছিদ্র চিকের আড়ালে ছায়াছন্ন, শীর্ণকায় এক গলিতে লেখকের জন্ম। এখানেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা, ছবি আঁকার হাতেখড়ি। বিভিন্ন নিবন্ধে নানা প্রসঙ্গে সুনন্দ এই এলাকার শব্দ ছবি এঁকেছেন। তাঁর দক্ষ তুলির টানে এই সংকলনের সম্পদ হয়ে উঠেছে ভাষার ক্যানভাসে আঁকা কয়েকজন স্বজনের শব্দ-প্রতিকৃতি। ‘ছবিকাকা’, ‘সৌমেনদা’, ‘মেহেবুব'- এর মতো ব্যক্তি-নামাঙ্কিত লেখাগুলির পাশাপাশি নিজের ঠাকুমাকে নিয়ে লেখা ‘হরির লুট’ প্রসঙ্গত স্মরণীয়। তবে বেশিরভাগ নিবন্ধেই শেষপর্যন্ত ছায়াপাত ঘটেছে লেখকের আধ্যাত্মিক চেতনার, ঈশ্বর দর্শন-এর। ‘বাঁদরামো’, ’ঝুল’, ‘সারমেয়’ এই ঘরানার অনবদ্য সৃজন। সামান্য ঝুলে অন্য প্রাণীর হ্যালুসিনেশনে বেকুব বনে যাওয়া এক টিকটিকির কাহিনি ‘ঝুল’ এই সংকলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিবন্ধ।
ছবির জগতই লেখকের দৈনন্দিন স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক চারণভূমি। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা, পেশা ও ভালোলাগা ক্যানভাসের বর্ণিল পরিসর। তাই বারবার তাঁর লেখায় ফিরে ফিরে এসেছে ছবি আঁকার নানা প্রসঙ্গ। কখনো কখনো উপমায় ব্যবহৃত হয়েছে রঙতুলির পারিভাষিক শব্দ। ‘কাদাপাড়া’, ‘বোকা’ অকাল প্রয়াত বিখ্যাত চিত্রী শৈবাল ঘোষকে নিয়ে লেখা ‘ছবিকাকা’ নিবন্ধগুলির বিষয় লেখক সুনন্দ বসুর শিল্পী জীবনের কথা। এই ছবির প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণও তাঁরই। পেন এন্ড ইঙ্ক, চারকোল ও জলরঙে আঁকা অসংখ্য ছবি এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। ‘প্রারব্ধ, আধার ও নির্বাণ’ — পাঠ ও একইসঙ্গে লেখকের আঁকা অসাধারণ ছবির সান্নিধ্যে অন্যরকমের এক পাঠ অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করে পাঠক হৃদয়কে।
শিল্পীর গদ্য তার সহজিয়া নির্মেদ স্বাদুতা ও অনুপুঙ্খ বর্ণনার সৌকর্যে লেখার বিষয়ে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। সুনন্দ বসুর গদ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে এইধরনের জীবনকথা ভিত্তিক ছোটোছোটো লেখার সংকলনে একই প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি পাঠের গতিকে কিছুটা রুদ্ধ করে, তৈরি করে একঘেয়েমি। ‘প্রারব্ধ,আধার ও নির্বাণ’ও এই ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। পরবর্তী সংস্করণে লেখক নিশ্চয়ই এই বিষয়ে খেয়াল রাখবেন।