দিনকর কৌশিক স্মরণ করিয়েছেন ওয়ারিঙ্গার–এর ‘Abstraction and Empathy’ বইটি সম্পর্কে পৃথ্বীশের নিজের উপলব্ধির কথা। জীবনে যখন প্রাচুর্য ও শান্তি থাকে তখন সেটাই শিল্পে প্রতিফলিত হয় চেনা ও দেখা আকারের মধ্যে দিয়ে। অথচ আত্মদ্বন্দ্বে পীড়িত জীবন যখন তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, বেদনাদীর্ণ হয়ে ওঠে, তখন শিল্প জৈব আকারকে এড়িয়ে জ্যামিতিক ও বিমূর্তের দিকে এগিয়ে যায়। ঝুঁকে পড়ে।
পৃথ্বীশ নিয়োগী আর মুত্থুস্বামীর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটত মাটিতে শুয়ে হস্টেলের ঘরের ছাদে বিনোদবিহারীর সদ্য শেষ করা দেয়ালচিত্রের ফটো তুলে। বীরভূমের গ্রামজীবনের সহজ সরল ছবি, মহিষের স্নান, মহিলাদের ঘরকন্না, ধোপাদের গাধা, খোয়াই, সারি সারি তালগাছ— বিনোদবিহারীর তুলিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা স্থানীয় নিসর্গমালা তখন কলাভবনের ছাত্রদের পাঠ বিশেষ। পৃথ্বীশ আর মুত্থুস্বামী ছবিগুলোকে ক্যামেরা বন্দী করার ক্ষেত্রে নিজেদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু শিল্পকর্মকে প্রামাণ্য হিসেবে রক্ষা করার কাজে পৃথ্বীশ নিয়োগীর অবদান তুলনারহিত। এভাবেই নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারীর নতুন নতুন কাজগুলো আলোকচিত্রের ফ্রেমের মধ্যে জীবন্ত হয়ে রইলো। এ যেন সিন্দুকে রাখা মূল্যবান রত্ন। পৃথ্বীশ আর মুত্থুস্বামীর মনে হয়েছিল এসব অসামান্য ছবি ফ্রেমবন্দী করে না রাখলে সময়ের গহ্বরে তা হয়তো কোনোদিন হারিয়ে যাবে।
শিল্পের তাগিদে ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছিলেন পৃথ্বীশ, দেখেছিলেন অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র, কোনারক মন্দিরগাত্রের কাজ। অজন্তার গুহাচিত্রে পৃথ্বীশ মুগ্ধ। তাঁর মতে অজন্তার ছবিতে কোনো ফ্রেম নেই। একটি অবাধ কণ্টিনিউয়ম— আমাদের মনে যেমন চিন্তার প্রসার হয়, আশেপাশে-উপরে-নিচে যেতে কোনো বাধা নেই। অজন্তা-ইলোরা-ঔরাঙ্গাবাদ ভ্রমণের সময়ে কৈলাসের মুখে এসে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের অনুভূতি পৃথ্বীশের মনে সঞ্চারিত হল, তাঁর মনে পড়লো আনন্দ কুমারস্বামীর সেই কথা— ‘Fear of Beauty।’ পৃথ্বীশের মনে হয়েছিল কৈলাস মন্দির কোনো স্থাপত্য নয়, একটা বিরাট ভাস্কর্য। একটা আস্ত গ্রানাইট পাহাড়কে মূর্তি রূপে কল্পনা করে তার মধ্যে মন্দির কেটে রূপের সন্ধান করা। হিমাচল প্রদেশের কার্লে গুহার মূল প্রবেশপথের দুপাশে খোদাই করা দম্পতির পূর্ণাবয়ব মৈথুনরত দুটি যুগলমূর্তি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল অনির্বচনীয় পার্থিব সুখে তারা মগ্ন। এ বিষয়ে পৃথ্বীশের মন্তব্য— ‘চার অস্তিত্ববাদী সত্য—জন্ম-পীড়া-বার্ধক্য-মৃত্যু সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ উদাসীন। এরা শুধু জীবনের জয়গান গাইতেই ব্যস্ত।’
কোনারক মন্দিরের ছবি তোলার ক্ষেত্রে পৃথ্বীশ ও মুত্থুস্বামীর অমানুষিক পরিশ্রমের কথা নিজেই জানিয়েছেন পৃথ্বীশ। মন্দিরের উপরের দিকে সারিবদ্ধ মহিলাবাদক ও যন্ত্রীদের ছবি তোলা যে কোনো আলোকচিত্রীর পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ। তা সত্ত্বেও পৃথ্বীশ ও মুত্থুস্বামী নানারকম কৌশল ও তাঁদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছবিগুলো তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নন্দলাল, রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারী ছবিগুলো দেখেন। তাঁরা শুধু খুশিই হননি, নন্দনের হ্যাভেল হলে ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে নির্মিত হয়েছিল ‘কোনার্ক’ তথ্যচিত্র। পরিচালনা করেছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন পৃথ্বীশ নিয়োগী।
১৯৬১ সাল। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ। একটা বড় উপলক্ষ দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। ললিতকলা আকাদেমির উদ্যোগে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অন্যতম কর্মসূচী নির্ধারিত হল রবীন্দ্র চিত্রকলার অবিকল প্রতিলিপি মুদ্রণ। দায়িত্ব অর্পিত হল পৃথ্বীশ নিয়োগীর ওপর। পৃথ্বীশ রবীন্দ্রভবন থেকে চল্লিশটি ছবি নির্বাচন করে লন্ডনের গ্রানিমিড প্রেসে বসে প্রত্যেক ছবির প্রিন্টকে মূল ছবির সঙ্গে মিলিয়ে একটি অসাধারণ পোর্টফোলিও বার করলেন। নামকরণ: Centenary 1861-1961. Drawings & Paintings of Rabindranath Tagore. এমন উন্নতমানের ছাপা বই এর আগে ভারতে প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক ললিতকলা আকাদেমির প্রকাশনাবৃত্তের দায়িত্বে ছিলেন পৃথ্বীশ। এই বিশেষ প্রকাশনাটির ভূমিকা তিনিই লিখে দিয়েছিলেন তাঁর সেই নিজস্ব বাহুল্যবর্জিত ইংরেজিতে, যার ব্যঞ্জনা অত্যন্ত গভীর ও অর্থবহ। গ্রন্থটির মুখবন্ধ সম্পর্কে এক ব্রিটিশ পাঠক নাকি বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ‘বোধবুদ্ধিহীন কিছু শব্দের সমারোহ যার ভাব বিনিময়ের ক্ষমতা কম।’
রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলের জন্য একটা মানানসই নকশা প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ কাজের জন্যে পৃথ্বীশকে অনুরোধ করলেন। যদিও দুনিয়ার প্রখ্যাত সব শিল্পীরা অনেক ডিজাইন ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী পৃথ্বীশকে সেগুলি দেখালেন। পৃথ্বীশ গভীর মনোযোগে সেগুলি দেখলেন, কিন্তু তিনি পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করলেন না। ইন্দিরা গান্ধী আরও খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলে পৃথ্বীশের সহজ মন্তব্য— মহাত্মাজি সহজ সরল নিষ্পাপ আড়ম্বরহীন অসাধারণ মানুষ। জাঁকজমক তাঁর ক্ষেত্রে শোভা পায়না। অনেক ভেবে পৃথ্বীশ ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, ‘একটা বড় অমসৃণ অরিজিনাল গ্রানাইট পাথরের কিছুটা অংশ পালিশ করে তার ওপর গান্ধীজির কোনো বানী খোদাই করা যেতে পারে।’ পৃথ্বীশের এই প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধীর ভালো লাগলেও সমাধিক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট কমিটি পৃথ্বীশের এই পরিকল্পনায় কোনো আগ্রহ দেখালেন না, বলা যেতে পারে একপ্রকার উদাসীন রইলেন। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথ্বীশের সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে পৃথ্বীশের ইচ্ছা হয়েছিল পৃথিবীর শিল্পচর্চার কেন্দ্রগুলো এক এক করে ঘুরে দেখার। সে ইচ্ছা কতটুকু পূরণ হয়েছিল তা জানা যায়নি। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানাওতে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে সব রকমের সুবিধাসম্পন্ন উন্নতমানের ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার’ গড়ে তোলার কাজে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন পৃথ্বীশ। পশ্চিমি দুনিয়ার শিল্প-সমালোচকদের ভারসাম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। ১৯৩৬ সালে পৃথ্বীশ জাপানে গিয়েছিলেন। সেখানে জেন দর্শন সম্বন্ধে চর্চা করেছিলেন। দেখেছিলেন দু-চারটে জেন বাগান, মন্দির ও মনাস্ট্রি। তাঁর কাছে জেন বিষয়টি অ-বাক ব্যপার। তুলির আঁচড়ে জেগে ওঠে সবকিছু প্রায় বজ্রপাতের মতো। কথায় কী করে ধরা যায়— এই ভাবনাটাই পৃথ্বীশের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মধ্যে চলেছিল নিরন্তর অন্বেষণ।
১৯৪৪ সালে পৃথ্বীশ কলাভবন ছেড়ে চলে যান। তার আগে কলাভবনের ছাত্রী জয়া আপ্পাস্বামীর সঙ্গে পরিচয় হয় পৃথ্বীশের। দুজনের মধ্যে চলত শিল্প-ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। মনে হয়েছিল পৃথ্বীশ-জয়ার আলোচনায় ঋদ্ধ হবে শিল্প-ইতিহাসের ধারাটি। ওদের বন্ধুরা ভেবেছিল পৃথ্বীশ আর জয়া পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। এ নিয়ে জয়ার সঙ্গে বন্ধুরা কৌতুকও করত। কিন্তু বাস্তবে ওদের সেই গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভেঙে গেল। জয়া ভালো লিখতেন। লেখার মধ্যে ছিল অসাধারণ সাহিত্যগুণ। পৃথ্বীশের মধ্যে ছিল বিচার-বিশ্লেষণ ও সত্য অন্বেষণের ক্ষমতা। পৃথ্বীশ একজন তাত্ত্বিক ও শিল্পরসিক হিসেবে আর জয়া আপ্পাস্বামী ইংরেজি ভাষায় একজন দক্ষ লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জয়া একজন প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং দিল্লির ললিতকলা আকাদেমির সম্পাদক হন।
পৃথ্বীশ চেয়েছিলেন শিল্প-ইতিহাস চর্চায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করতে। ১৯৪৭ সালে আমেরিকায় চললেন ডঃ আনন্দ কুমারস্বামীর কাছে শিল্পের পাঠ নেওয়ার জন্যে। জাহাজ যখন আটলান্টিক পার হচ্ছে তখন তাঁর কাছে এসে পৌঁছাল আনন্দ কুমারস্বামীর মৃত্যু সংবাদ। কুমারস্বামীর অভিভাবকত্বে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেলেন না পৃথ্বীশ। ভর্তি হলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি দেশে ফেরেন তখন ভারত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত। দেশে ফিরে নিজের মতো করে শিল্পচর্চার কাজ করার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশের খোঁজ করছিলেন পৃথ্বীশ। কিছুদিন কাজ করলেন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে, তারপর চলে গেলেন দিল্লি, যুক্ত হলেন দিল্লির মিউজিয়ামে। অবশ্য বেশিদিনের জন্য নয়। অন্তরের চাহিদার মতো কাজ পাচ্ছিলেন না। মনের মধ্যে অতৃপ্তি ডানা ঝাপটাচ্ছে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল পরিকাঠামোর অভাব বোধ করছেন পৃথ্বীশ। এসব কারণেই তিনি ক্রমে ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন।
পৃথ্বীশের পারিবারিক বৃত্তে তাঁর বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ ও বিখ্যাত আইনজীবী। স্বাধীন ভারতের প্রথম ক্যাবিনেট সদস্য। ১৯৫১-তে ফিন্যান্স কমিশনের ও ১৯৫৩-তে প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান হন। এহেন খ্যাতিমান মানুষের জ্যেষ্ঠ পুত্র পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ বিয়ে করেছিলেন আমেরিকান মহিলা লিলি অ্যাসরকে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের তারিখ ও স্থান জানিয়ে উইটনেস হিসেবে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন দুই বন্ধুকে— দিনকর কৌশিক ও দিল্লির ফ্রি-ল্যান্স শিল্পী কুলকার্নিকে। থাকার ব্যবস্থা ছিল দিল্লির এক হোটেলে। পৃথ্বীশের বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী তখন দিল্লিতেই ছিলেন। তিনি ছেলের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের তারিখটা জানতেন কিন্তু ঐ দিনটিতে উপস্থিত থাকার জন্যে তাঁকে বলা হয়নি। ক্ষিতীশবাবুর আক্ষেপ ছিল, ‘আমার ছেলের বিয়েতে উইটনেস পর্যন্ত থাকতে পারলাম না।’ এই পারিবারিক ক্লেশ দিনকর কৌশিককে অত্যন্ত ব্যাথিত করেছিল। পৃথ্বীশের এই অসম্ভব নির্লিপ্তির জন্যেই তিনি কারো সঙ্গে গভীর ভাবে অনুরক্ত হতে পারেননি।
পৃথ্বীশ নিয়োগীর জন্ম ১৯১৮ তে। চলে গেলেন ২৫ মার্চ, ১৯৯১। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। শেষ শয্যা হনোলুলুর এক অতিথিশালায়। অন্তিমক্ষণে নাকি Bach-এর Musical Offerings শুনতে শুনতে তাঁর চোখদুটি বন্ধ হয়ে এসেছিল। জগতের আলো থেকে হারিয়ে গেলেন শিল্পভুবনের নির্জন, প্রাজ্ঞ, অনাড়ম্বর ভ্রামণিক পৃথ্বীশ নিয়োগী। তিয়াত্তর বছরের যাপিত জীবনের (১৯১৮-১৯৯১) সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা মুক্তোর মতো ছড়িয়ে রইলো পৃথিবীর পথে।