• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • শিল্পভুবনের এক নির্জন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব: পৃথ্বীশ নিয়োগী : অমিত মণ্ডল



    ১৯৪০-এর শান্তিনিকেতন। খোলা আকাশের নিচে ছাত্রদের স্কেচ শেখাচ্ছেন নন্দলাল, দেয়ালে দেয়ালে ম্যুরাল আঁকছেন বিনোদবিহারী, আগানে-বাগানে কাঁকর-সিমেন্টের ভাস্কর্যে বুঁদ হয়ে আছেন রামকিঙ্কর, সংগীতভবনে এসরাজ বাজাচ্ছেন অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, উন্মুক্ত প্রান্তরে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মোহর-নীলিমা-সুচিত্রা। সেসময়ে কলাভবনের ছাত্র হয়ে এলেন পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ নিয়োগী। সেখানে পরিচয় হল দিনকর কৌশিকের সঙ্গে। দিনকর কৌশিকও তখন কলাভবনের ছাত্র। পরিচয় থেকে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন— সত্যজিৎ রায় আর মুত্থুস্বামী। দিনকর কৌশিক আর পৃথ্বীশ নিয়োগী চিত্রকলায় আগ্রহী, মুত্থুস্বামী কেরালার বিখ্যাত আলোকচিত্রী। সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত। কলাশিল্প পৃথ্বীশের রক্তে সুতরাং এ বিষয়ে কথা উঠলেই পৃথ্বীশ বাকসংযম হারিয়ে হয়ে উঠতেন অমিতভাষী। তাঁর শিল্পীসত্তা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। গভীর উপলব্ধি থেকে স্রোতস্বিনী ঝরনার মতো উৎসারিত হতো বিভিন্ন শিল্পী, ভাস্কর ও শিল্প আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর ভাবনার নানা কথন, এ যেন স্মৃতিধার্য ঘটনার বর্ণময় ক্যানভাস। সেজন্যই তো তিনি বিশিষ্ট শিল্পতাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্যতম। আসলে তদানীন্তন শিল্পসমালোচকদের সম্বন্ধে পৃথ্বীশের প্রভূত জ্ঞান অবিসংবাদিত। শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানে ঋদ্ধ পৃথ্বীশ নতুন নতুন শিল্প সমীক্ষার বই পড়ে শোনাতেন বন্ধুদের। তাঁরাও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্প আন্দোলন সম্পর্কে নানা তথ্যে ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ হতেন। রজার ফ্রাই, হার্বার্ট রীড ও আনন্দ কুমারস্বামী প্রমুখদের লেখা পড়ে অনেক শিল্পীদের কাজের সঙ্গে অন্যান্যদের পরিচয় করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে পৃথ্বীশের অসামান্য ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। বার্নাড বেরনসন, অ্যাড্রিয়ান স্টোকস, ওয়ারিঙ্গার, স্টেলা ক্রামরিশ প্রমুখ সম্পর্কে অনায়াস ভাষণে পৃথ্বীশ ছিলেন দক্ষ। অথচ এঁরা আমাদের দেশের শিল্প-সংস্কৃতির জল-হাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা কেউ নন। বার্নাড বেরনসন আমেরিকার বিখ্যাত শিল্প-ঐতিহাসিক, অ্যাড্রিয়ান স্টোকস ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা শিল্পী, ওয়ারিঙ্গার আর স্টেলা ক্রামরিশ দুজনেই শিল্প-ঐতিহাসিক একজন জার্মানির, অন্যজন আমেরিকার। স্টেলা ক্রামরিশ সম্পর্কে আমরা কিছুটা জানি যেহেতু ১৯২১ সালে তিনি কবিগুরুর আমন্ত্রণে কলাভবনে এসেছিলেন এবং কলাভবনে ভারতের শিল্পকলা নিয়ে স্লাইড সহযোগে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

    তরুণ সত্যজিৎ রায়

    দিনকর কৌশিক স্মরণ করিয়েছেন ওয়ারিঙ্গার–এর ‘Abstraction and Empathy’ বইটি সম্পর্কে পৃথ্বীশের নিজের উপলব্ধির কথা। জীবনে যখন প্রাচুর্য ও শান্তি থাকে তখন সেটাই শিল্পে প্রতিফলিত হয় চেনা ও দেখা আকারের মধ্যে দিয়ে। অথচ আত্মদ্বন্দ্বে পীড়িত জীবন যখন তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, বেদনাদীর্ণ হয়ে ওঠে, তখন শিল্প জৈব আকারকে এড়িয়ে জ্যামিতিক ও বিমূর্তের দিকে এগিয়ে যায়। ঝুঁকে পড়ে।


    ওয়ারিঙ্গার–এর ‘Abstraction and Empathy’

    পৃথ্বীশ নিয়োগী আর মুত্থুস্বামীর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটত মাটিতে শুয়ে হস্টেলের ঘরের ছাদে বিনোদবিহারীর সদ্য শেষ করা দেয়ালচিত্রের ফটো তুলে। বীরভূমের গ্রামজীবনের সহজ সরল ছবি, মহিষের স্নান, মহিলাদের ঘরকন্না, ধোপাদের গাধা, খোয়াই, সারি সারি তালগাছ— বিনোদবিহারীর তুলিতে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা স্থানীয় নিসর্গমালা তখন কলাভবনের ছাত্রদের পাঠ বিশেষ। পৃথ্বীশ আর মুত্থুস্বামী ছবিগুলোকে ক্যামেরা বন্দী করার ক্ষেত্রে নিজেদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের বেশ কিছু শিল্পকর্মকে প্রামাণ্য হিসেবে রক্ষা করার কাজে পৃথ্বীশ নিয়োগীর অবদান তুলনারহিত। এভাবেই নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারীর নতুন নতুন কাজগুলো আলোকচিত্রের ফ্রেমের মধ্যে জীবন্ত হয়ে রইলো। এ যেন সিন্দুকে রাখা মূল্যবান রত্ন। পৃথ্বীশ আর মুত্থুস্বামীর মনে হয়েছিল এসব অসামান্য ছবি ফ্রেমবন্দী করে না রাখলে সময়ের গহ্বরে তা হয়তো কোনোদিন হারিয়ে যাবে।


    নন্দলাল বসু-র সাথে ছাত্র রামকিঙ্কর
    রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারী— দুজনেই নন্দলালের অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র। পৃথ্বীশের শিল্পকলাকেন্দ্রিক তাত্ত্বিক আলোচনা নন্দলাল কতটা পছন্দ করতেন বা আদৌ পছন্দ করতেন কিনা সে বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। অবশ্য নন্দলাল বলতেন, ‘ছবি বা মূর্তি হাতে কলমে করবার জিনিস— কথার ইমারত গেঁথে ওসব হয় না। ছবির নিজেরই কথন আছে, সেটি রঙ বা রেখায় প্রতিফলিত হয়।’ প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, পিকাসোর ছবিও নন্দলালের কাছে গুরুত্ব পায়নি— যখন নন্দলালই বলেন, পিকাসো টিকাসো চলবে না বাপু, চোখ দিয়ে দেখতে হয়, প্রাণ দিয়ে বুঝতে হয় আর হাত দিয়ে আয়ত্ত করতে হয়। অমনি অমনি কিছু হয় না’। ইউরোপের নতুন শিল্প আন্দোলন কিউবিজম বা বিমূর্ত শিল্প সম্পর্কে নন্দলালের অজস্র সংশয় ছিল। তবে গোঁড়ামি থাকলেও পাশ্চাত্য শিল্পরীতি সম্বন্ধে নন্দলালের দৃষ্টিভঙ্গী সদর্থক ছিল না সেকথা বলা যায় না।

      
    রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারী


    পৃথ্বীশ নিয়োগীর কাছে বিনোদবিহারী এবং রামকিঙ্কর দুজন দুই ভিন্ন প্রকৃতির শিল্পী। রামকিঙ্কর যত বেশি প্রকট, বিনোদবিহারী যেন অনেকটাই অন্তরালে। রামকিঙ্করের জীবনচর্চা, তাঁর অন্যধারার ভাস্কর্য তাঁকে নিয়ে গেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে, অন্যদিকে বিনোদবিহারীর শিল্পচর্চা অন্তরের নিহিত আলো-ছায়া। তাঁকে ঘিরে যে নৈঃশব্দ্য, যে দূরত্ব বা অন্তরাল তা আসলে শিল্পীরই আপন স্বভাবের অন্তর্গত। তাঁর শিল্প-অনুসন্ধিৎসু মনের আড়ালে তিনি সযত্নে লালন করেছিলেন এক অন্তর্মুখী মন। রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর সঙ্গে শিল্পের আধুনিক চিন্তা ভাবনা নিয়ে পৃথ্বীশ মাঝেমধ্যে আলোচনা করতেন। পৃথ্বীশের ব্যাখ্যায় বিনোদবিহারীর ছবির সূত্রপাত হয় জ্যামিতিক কাঠামোর পথ ধরে। ছবির স্পেসকে তিনি প্রথমে বেঁধে নেন বিবিধ আকারের মধ্যে, তারপর সেই কাঠামোর মধ্যে ফুটিয়ে তলেন গাছ, ফুল, প্রাণী ও মানুষ। মূল কাঠামোর টেনশন বজায় রাখতে তাঁর দৃষ্টি সদাজাগ্রত। এর ঠিক বিপরীতধর্মী রামকিঙ্করের কাজ। তাঁর কাজের মূল স্রোত হল দৃশ্য আকারের প্রাথমিক গতি। সাঁওতাল মেয়ে ধান ঝাড়ছে দেখে তিনি আকারের প্রাণ ও গতি প্রথমে ধরে রাখলেন, পরে ধীরে ধীরে সেই আকারের অনাব্যশক মেদ ঝরাতে ঝরাতে এক ধরণের গতিময় প্রাণস্পন্দনের দিকে, সারল্যের দিকে যাত্রা শুরু করেন। রামকিঙ্কর ফর্মের মধ্যে দিয়ে abstract-এর দিকে যান আর বিনোদবিহারী abstract থেকে বেরিয়ে ফর্মের দিকে আসেন। বলতে গেলে একজন Modeller, অন্যজন Sculptor। পৃথ্বীশের অনবদ্য বিশ্লেষণে ফুটে ওঠে দুই শিল্পীসত্তার অবিরল উন্মোচন।


    দিনকর কৌশিক-এর সাথে রামকিঙ্কর


    পৃথ্বীশ নিয়োগীর শিল্পদৃষ্টি অত্যন্ত ধারালো ও জীবন্ত। তাঁর শিল্প সংক্রান্ত কথাগুলি ভীষণ অর্থবহ ও রূপগ্রাহী। অনন্যসাধারণ বোধশক্তির আধারের মধ্যে ছিল পৃথ্বীশের বিচরণ। শিল্পের অ-চষা জমিতে কর্ষণ করতেই তাঁর যেন আনন্দ। সেই ভুবনেই তাঁর যাপন। কিন্তু মুখের কথা কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে পৃথ্বীশের বড় অনীহা। তিনি তেমন কিছু লিখতে চাইতেন না। কিছু একটা লিখে পরমুহূর্তেই সেটা বর্জন করতেন। এ বিষয়ে একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়েছেন দিনকর কৌশিক। একবার দিল্লির ‘মার্চ অফ ইন্ডিয়া’ নামে ভারত সরকারের একটি পত্রিকার সম্পাদক দিনকর কৌশিককে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে পৃথ্বীশ নিয়োগীর একটা লেখা সংগ্রহের জন্য। পৃথ্বীশকে ব্যাপারটা বলতেই তিনি সে প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তাঁর অভিমত, ‘পুরোটাই অর্থহীন।’ দিনকর কৌশিক তখন পৃথ্বীশকে বলেন, ‘তাহলে তুমি বিনোদদা সম্পর্কে বলবে আর আমি নোট নিয়ে যাব।’ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে পৃথ্বীশ অনর্গল বলে চললেন আর দিনকর নোট নিয়ে গেলেন। এক সপ্তাহ ধরে লেখাটি তৈরি হল। পৃথ্বীশ পনেরো দিন ধরে ক্রমাগত কাটাকুটি এবং সংশোধন করে অবশেষে হতোদ্যম হয়ে লেখাটি বাতিল বলে ঘোষণা করলেন। দিনকর কৌশিক ঐ কাটাকুটিযুক্ত সংশোধিত লেখাটিই পাদটীকা সহ পত্রিকা সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং জানালেন পৃথ্বীশের সঙ্গে বিনোদবিহারী সম্পর্কে আলাপচারিতার ফসল হচ্ছে এই লেখা।


    Artists of Hawaii


    পৃথ্বীশের শিল্পজিজ্ঞাসা ও অনুশীলন এতটাই বিস্তৃত যে তার তল পাওয়া বাস্তবিকই দুরূহ। কিন্তু নিজের লেখার বিষয়ে তাঁর আবেগ বা মনোভাব প্রকাশে অনিচ্ছার কারণে তাঁর শিল্পচিন্তা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর কোনো বই বা দীর্ঘ লেখা আছে বলে জানা নেই। অবশ্য ফ্রান্সিস হার (Francis Haar)-এর সঙ্গে যৌথ ভাবে একটি গ্রন্থের হদিশ পাওয়া গেছে। বইটির নাম, ‘Artists of Hawaii (Nineteen painters & Sculptors)’, September, 1974. পৃথ্বীশের বিশ্বাস, ‘বলা কথা আর হাতে লেখা এক হয় না।’ একবার কলাভবনে তাঁর বক্তৃতা টেপরেকর্ডিং করে, সেটা টাইপ করে ওনাকে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সেটা ঠিকঠাক করে আর কোনোদিনই ফেরত দেননি। পৃথ্বীশ বললেন, ‘আমি যা বলি সেটা লেখাতে ভালো শোনায় না। এজন্য আমি নিরুপায়’। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে পৃথ্বীশের অভিমতটি যেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টির সুনির্দিষ্ট স্বরায়ণ। কবির আঁকা চিত্রগুলি জটিল ব্যক্তিস্বভাবের অন্তর্মুখী যাত্রার অত্যাশ্চর্য একটি অগ্রসৃতির মানচিত্র, ছবিগুলিতে অস্তিত্বের নিবিড় স্বীকৃতি ফুটে উঠেছে।

    শিল্পের তাগিদে ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছিলেন পৃথ্বীশ, দেখেছিলেন অজন্তা-ইলোরার গুহাচিত্র, কোনারক মন্দিরগাত্রের কাজ। অজন্তার গুহাচিত্রে পৃথ্বীশ মুগ্ধ। তাঁর মতে অজন্তার ছবিতে কোনো ফ্রেম নেই। একটি অবাধ কণ্টিনিউয়ম— আমাদের মনে যেমন চিন্তার প্রসার হয়, আশেপাশে-উপরে-নিচে যেতে কোনো বাধা নেই। অজন্তা-ইলোরা-ঔরাঙ্গাবাদ ভ্রমণের সময়ে কৈলাসের মুখে এসে এক অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের অনুভূতি পৃথ্বীশের মনে সঞ্চারিত হল, তাঁর মনে পড়লো আনন্দ কুমারস্বামীর সেই কথা— ‘Fear of Beauty।’ পৃথ্বীশের মনে হয়েছিল কৈলাস মন্দির কোনো স্থাপত্য নয়, একটা বিরাট ভাস্কর্য। একটা আস্ত গ্রানাইট পাহাড়কে মূর্তি রূপে কল্পনা করে তার মধ্যে মন্দির কেটে রূপের সন্ধান করা। হিমাচল প্রদেশের কার্লে গুহার মূল প্রবেশপথের দুপাশে খোদাই করা দম্পতির পূর্ণাবয়ব মৈথুনরত দুটি যুগলমূর্তি দেখে তাঁর মনে হয়েছিল অনির্বচনীয় পার্থিব সুখে তারা মগ্ন। এ বিষয়ে পৃথ্বীশের মন্তব্য— ‘চার অস্তিত্ববাদী সত্য—জন্ম-পীড়া-বার্ধক্য-মৃত্যু সম্পর্কে এরা সম্পূর্ণ উদাসীন। এরা শুধু জীবনের জয়গান গাইতেই ব্যস্ত।’

    কোনারক মন্দিরের ছবি তোলার ক্ষেত্রে পৃথ্বীশ ও মুত্থুস্বামীর অমানুষিক পরিশ্রমের কথা নিজেই জানিয়েছেন পৃথ্বীশ। মন্দিরের উপরের দিকে সারিবদ্ধ মহিলাবাদক ও যন্ত্রীদের ছবি তোলা যে কোনো আলোকচিত্রীর পক্ষে যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ। তা সত্ত্বেও পৃথ্বীশ ও মুত্থুস্বামী নানারকম কৌশল ও তাঁদের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছবিগুলো তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নন্দলাল, রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারী ছবিগুলো দেখেন। তাঁরা শুধু খুশিই হননি, নন্দনের হ্যাভেল হলে ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে নির্মিত হয়েছিল ‘কোনার্ক’ তথ্যচিত্র। পরিচালনা করেছিলেন হরিসাধন দাশগুপ্ত। স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন পৃথ্বীশ নিয়োগী।

    ১৯৬১ সাল। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ। একটা বড় উপলক্ষ দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। ললিতকলা আকাদেমির উদ্যোগে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের অন্যতম কর্মসূচী নির্ধারিত হল রবীন্দ্র চিত্রকলার অবিকল প্রতিলিপি মুদ্রণ। দায়িত্ব অর্পিত হল পৃথ্বীশ নিয়োগীর ওপর। পৃথ্বীশ রবীন্দ্রভবন থেকে চল্লিশটি ছবি নির্বাচন করে লন্ডনের গ্রানিমিড প্রেসে বসে প্রত্যেক ছবির প্রিন্টকে মূল ছবির সঙ্গে মিলিয়ে একটি অসাধারণ পোর্টফোলিও বার করলেন। নামকরণ: Centenary 1861-1961. Drawings & Paintings of Rabindranath Tagore. এমন উন্নতমানের ছাপা বই এর আগে ভারতে প্রকাশিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক ললিতকলা আকাদেমির প্রকাশনাবৃত্তের দায়িত্বে ছিলেন পৃথ্বীশ। এই বিশেষ প্রকাশনাটির ভূমিকা তিনিই লিখে দিয়েছিলেন তাঁর সেই নিজস্ব বাহুল্যবর্জিত ইংরেজিতে, যার ব্যঞ্জনা অত্যন্ত গভীর ও অর্থবহ। গ্রন্থটির মুখবন্ধ সম্পর্কে এক ব্রিটিশ পাঠক নাকি বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, ‘বোধবুদ্ধিহীন কিছু শব্দের সমারোহ যার ভাব বিনিময়ের ক্ষমতা কম।’

    রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলের জন্য একটা মানানসই নকশা প্রয়োজন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ কাজের জন্যে পৃথ্বীশকে অনুরোধ করলেন। যদিও দুনিয়ার প্রখ্যাত সব শিল্পীরা অনেক ডিজাইন ভারত সরকারের কাছে পাঠিয়েছেন। ইন্দিরা গান্ধী পৃথ্বীশকে সেগুলি দেখালেন। পৃথ্বীশ গভীর মনোযোগে সেগুলি দেখলেন, কিন্তু তিনি পছন্দ-অপছন্দ প্রকাশ করলেন না। ইন্দিরা গান্ধী আরও খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলে পৃথ্বীশের সহজ মন্তব্য— মহাত্মাজি সহজ সরল নিষ্পাপ আড়ম্বরহীন অসাধারণ মানুষ। জাঁকজমক তাঁর ক্ষেত্রে শোভা পায়না। অনেক ভেবে পৃথ্বীশ ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, ‘একটা বড় অমসৃণ অরিজিনাল গ্রানাইট পাথরের কিছুটা অংশ পালিশ করে তার ওপর গান্ধীজির কোনো বানী খোদাই করা যেতে পারে।’ পৃথ্বীশের এই প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধীর ভালো লাগলেও সমাধিক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট কমিটি পৃথ্বীশের এই পরিকল্পনায় কোনো আগ্রহ দেখালেন না, বলা যেতে পারে একপ্রকার উদাসীন রইলেন। স্বাভাবিক ভাবেই পৃথ্বীশের সেই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি।

    ষাটের দশকের প্রথম দিকে পৃথ্বীশের ইচ্ছা হয়েছিল পৃথিবীর শিল্পচর্চার কেন্দ্রগুলো এক এক করে ঘুরে দেখার। সে ইচ্ছা কতটুকু পূরণ হয়েছিল তা জানা যায়নি। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানাওতে হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেখানে সব রকমের সুবিধাসম্পন্ন উন্নতমানের ‘ডকুমেন্টেশন সেন্টার’ গড়ে তোলার কাজে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন পৃথ্বীশ। পশ্চিমি দুনিয়ার শিল্প-সমালোচকদের ভারসাম্যহীন দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনায় মুখর ছিলেন তিনি। ১৯৩৬ সালে পৃথ্বীশ জাপানে গিয়েছিলেন। সেখানে জেন দর্শন সম্বন্ধে চর্চা করেছিলেন। দেখেছিলেন দু-চারটে জেন বাগান, মন্দির ও মনাস্ট্রি। তাঁর কাছে জেন বিষয়টি অ-বাক ব্যপার। তুলির আঁচড়ে জেগে ওঠে সবকিছু প্রায় বজ্রপাতের মতো। কথায় কী করে ধরা যায়— এই ভাবনাটাই পৃথ্বীশের মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মধ্যে চলেছিল নিরন্তর অন্বেষণ।

    ১৯৪৪ সালে পৃথ্বীশ কলাভবন ছেড়ে চলে যান। তার আগে কলাভবনের ছাত্রী জয়া আপ্পাস্বামীর সঙ্গে পরিচয় হয় পৃথ্বীশের। দুজনের মধ্যে চলত শিল্প-ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। মনে হয়েছিল পৃথ্বীশ-জয়ার আলোচনায় ঋদ্ধ হবে শিল্প-ইতিহাসের ধারাটি। ওদের বন্ধুরা ভেবেছিল পৃথ্বীশ আর জয়া পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন। এ নিয়ে জয়ার সঙ্গে বন্ধুরা কৌতুকও করত। কিন্তু বাস্তবে ওদের সেই গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভেঙে গেল। জয়া ভালো লিখতেন। লেখার মধ্যে ছিল অসাধারণ সাহিত্যগুণ। পৃথ্বীশের মধ্যে ছিল বিচার-বিশ্লেষণ ও সত্য অন্বেষণের ক্ষমতা। পৃথ্বীশ একজন তাত্ত্বিক ও শিল্পরসিক হিসেবে আর জয়া আপ্পাস্বামী ইংরেজি ভাষায় একজন দক্ষ লেখক হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে জয়া একজন প্রখ্যাত শিল্প সমালোচক এবং দিল্লির ললিতকলা আকাদেমির সম্পাদক হন।

    পৃথ্বীশ চেয়েছিলেন শিল্প-ইতিহাস চর্চায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করতে। ১৯৪৭ সালে আমেরিকায় চললেন ডঃ আনন্দ কুমারস্বামীর কাছে শিল্পের পাঠ নেওয়ার জন্যে। জাহাজ যখন আটলান্টিক পার হচ্ছে তখন তাঁর কাছে এসে পৌঁছাল আনন্দ কুমারস্বামীর মৃত্যু সংবাদ। কুমারস্বামীর অভিভাবকত্বে নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেলেন না পৃথ্বীশ। ভর্তি হলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি দেশে ফেরেন তখন ভারত ব্রিটিশ শাসন মুক্ত। দেশে ফিরে নিজের মতো করে শিল্পচর্চার কাজ করার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশের খোঁজ করছিলেন পৃথ্বীশ। কিছুদিন কাজ করলেন শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে, তারপর চলে গেলেন দিল্লি, যুক্ত হলেন দিল্লির মিউজিয়ামে। অবশ্য বেশিদিনের জন্য নয়। অন্তরের চাহিদার মতো কাজ পাচ্ছিলেন না। মনের মধ্যে অতৃপ্তি ডানা ঝাপটাচ্ছে। শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল পরিকাঠামোর অভাব বোধ করছেন পৃথ্বীশ। এসব কারণেই তিনি ক্রমে ক্রমে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন।

    পৃথ্বীশের পারিবারিক বৃত্তে তাঁর বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ ও বিখ্যাত আইনজীবী। স্বাধীন ভারতের প্রথম ক্যাবিনেট সদস্য। ১৯৫১-তে ফিন্যান্স কমিশনের ও ১৯৫৩-তে প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান হন। এহেন খ্যাতিমান মানুষের জ্যেষ্ঠ পুত্র পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশ বিয়ে করেছিলেন আমেরিকান মহিলা লিলি অ্যাসরকে। বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের তারিখ ও স্থান জানিয়ে উইটনেস হিসেবে থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন দুই বন্ধুকে— দিনকর কৌশিক ও দিল্লির ফ্রি-ল্যান্স শিল্পী কুলকার্নিকে। থাকার ব্যবস্থা ছিল দিল্লির এক হোটেলে। পৃথ্বীশের বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী তখন দিল্লিতেই ছিলেন। তিনি ছেলের বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের তারিখটা জানতেন কিন্তু ঐ দিনটিতে উপস্থিত থাকার জন্যে তাঁকে বলা হয়নি। ক্ষিতীশবাবুর আক্ষেপ ছিল, ‘আমার ছেলের বিয়েতে উইটনেস পর্যন্ত থাকতে পারলাম না।’ এই পারিবারিক ক্লেশ দিনকর কৌশিককে অত্যন্ত ব্যাথিত করেছিল। পৃথ্বীশের এই অসম্ভব নির্লিপ্তির জন্যেই তিনি কারো সঙ্গে গভীর ভাবে অনুরক্ত হতে পারেননি।

    পৃথ্বীশ নিয়োগীর জন্ম ১৯১৮ তে। চলে গেলেন ২৫ মার্চ, ১৯৯১। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। শেষ শয্যা হনোলুলুর এক অতিথিশালায়। অন্তিমক্ষণে নাকি Bach-এর Musical Offerings শুনতে শুনতে তাঁর চোখদুটি বন্ধ হয়ে এসেছিল। জগতের আলো থেকে হারিয়ে গেলেন শিল্পভুবনের নির্জন, প্রাজ্ঞ, অনাড়ম্বর ভ্রামণিক পৃথ্বীশ নিয়োগী। তিয়াত্তর বছরের যাপিত জীবনের (১৯১৮-১৯৯১) সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা মুক্তোর মতো ছড়িয়ে রইলো পৃথিবীর পথে।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments