এই গ্রন্থের উৎসর্গপত্রটিও আপনাকে পড়তে হবে পাঠক। খুবই স্বাভাবিক যে আপনি ভুলে যাবেন, বরং আসুন একসঙ্গেই পড়ে নিই আমরা – ‘চলমান অক্ষর-বিন্যাসে যাঁরা জ্ঞান, আনন্দ ও প্রজ্ঞার নির্মাণে যোগ্য সঙ্গত করে এসেছেন – তাঁদের বেদনাদীর্ণ জীবনকে – তাঁদের হাতের ছন্দকে’।
‘জ্ঞান, আনন্দ আর প্রজ্ঞার নির্মাণ’ – মাত্র এই পাঁচটি শব্দে গ্রন্থের সংজ্ঞা দিয়েছেন লেখক, এবং আমি অন্তত, গ্রন্থের এর-চাইতে যথার্থ সংজ্ঞা পড়িনি কোথাও। এহ বাহ্য, এই উৎসর্গপত্রেই তিনি ধরেছেন লিখিতব্য গ্রন্থের নির্যাসটুকুও। আরও আছে। আক্ষরিক অর্থেই মসীলিপ্ত জীবনকে তাঁরা(কম্পোজিটররা)অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন গ্রন্থনির্মাণের রোমাঞ্চিত ছন্দের আনন্দ-সঙ্গতের জোরে। প্রেস পরিবারের যে আখ্যানটি মুদ্রণশিল্পের ইতিহাস-ভূগোল-অর্থনীতি-সমাজনীতির গবেষণাধর্মী আলোচনার সমান্তরালে বহমান এই গ্রন্থে, তা এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শুধু তাই নয়, এই আখ্যান সব ধরনের পাঠককে নন্দিতচিত্ত করার পক্ষে যথেষ্ট।
গ্রন্থের চোদ্দটি অধ্যায়ের নাম শুনলেই পাঠক অনেকটা আন্দাজ করতে পারবেন আখ্যানধর্মী তরলতায় কীভাবে দ্রব হয়েছে মুদ্রণ-ইতিহাসের আপাত নীরস বহুমুখী তথ্যাবলিঃ
১) প্রেস পরিবারঃ সে এক জীবন ২) কাঙালের নাতিপুতি ৩) প্রেসযুগ ও যুগন্ধর ৪) লেটারপ্রেসের বিস্ফোরণ ও সংক্ষেপিত বটতলা-বৃত্তান্ত ৫) একটি অভূতপূর্ব প্রেসকথা বা একজন কম্পোজিটরের অন্তরকথা ৬) মুদ্রণ-ব্যবসায় লাভালাভ ৭) উপার্জনের সদুপায়ঃ পুরোনোসূত্র ও নতুন প্রেক্ষিত ৮) লেটার প্রিন্টিংপ্রেসঃ শ্রম খতিয়ান আর শ্রম-সংগ্রাম ৯) প্রেস-কবিতাঃ প্রেস আভিজাত্য ১০) ঘনা বেচারার জীবনপঞ্জী ১১) প্রেস-পরিবারঃ প্রজন্মান্তর ১২) প্রহৃত ফাল্গুনের লিপিমালা ১৩) কম্পোজিটরঃ বঞ্চনার ধারাবাহিকতা ১৪) বিষাদান্ত ইতিহাসের প্রহর
সমরেশ বসুর ‘বেদনাদায়ক প্রতিবাদ’ নামে একটি গল্প আছে, যেখানে ‘সামান্য’ একজন কম্পোজিটর চিঠি লিখছেন এক ‘প্রথিতযশা প্রবীণ ও জনপ্রিয় সাহিত্যিককে’। এই গ্রন্থের লেখক সেই চিঠির প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করেছেন লেটারপ্রেসের ভেতরের ‘বাস্তব চিত্র’টি পাঠকদের কাছে উপস্থাপিত করার উদ্দেশ্যে। ওই গল্পটি যাঁরা পড়েননি, বা পড়লেও স্মৃতিতে ধূসর, প্রাসঙ্গিক বিধায়ে এই আলোচনায় সেই চিঠির উদ্ধৃত অংশটুকু তুলে দিলাম।
পৃথিবীতে এমন ঘটনা বিরল যে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত সুবিখ্যাত সাহিত্যিককে একজন কম্পোজিটর চিঠি লিখছে…। যদি বা এমন ঘটনা ঘটে থাকে, তবে তা কখনো নিশ্চয়ই কম্পোজিটরের প্রায়ান্ধকার ঘর, চারিদিকে কালির ছোপ, সীসার রাশি রাশি অক্ষরের স্তূপ, এবং স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের (আপনি যদি লক্ষ করে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই দেখেছেন অধিকাংশ প্রেসের চেহারাই তাই) ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে সীসারই একটা ধাতব গন্ধ মেশা পরিবেশ ছেড়ে কখনোই বাইরে যায়নি। শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত ক’জন সাহিত্যিক ক’জন কম্পোজিটরকে চোখেই বা দেখেছেন। পাঠক তো দূরের কথা, সত্যের খাতিরে আমি না বলে পারছি না, স্বয়ং আপনারাই যখন পত্রিকায় বা পুস্তকে আপনাদের রচনাগুলো বেশ ঝরঝরে মুদ্রিত অবস্থায় দেখতে পান, তখন ক’জনের কাছেই বা কম্পোজিটরের অস্তিত্ব মনে পড়ে? বোধহয় একজনের কাছেও না। আর আমাদের সঙ্গে সাহিত্যিকের সাক্ষাতের কখনো প্রয়োজনও হয় না। আপনাদের কাছে তো প্রকাশক বা সম্পাদক মহাশয় গ্যালিপ্রুফ পৌঁছে দেন। আপনি সাবধানে লক্ষ করে দেখে দেন, কম্পোজে কি পরিমাণ ভুল আছে। বেশি ভুল থাকলে বিরক্ত হন, কম থাকলে একটু স্বস্তি বোধ করেন, এই পর্যন্ত। তখনো আমার অস্তিত্ব আপনার কাছে থাকে না। তখন কোনো মানুষের অস্তিত্ব অনুভূত হলে, তা সম্পাদক বা প্রকাশকেরই। আমরা অনেক, অনেক দূরে।
এই চিঠি পড়ে পাঠকদের কী মনে হবে জানি না, এই আলোচক কিন্তু সন্দিহান সমরেশ বসুর গল্পটিই লেখক অনন্ত জানাকে কম্পোজিটরদের অবহেলিত পরম্পরাকে ভরকেন্দ্রে রেখে এই গ্রন্থটি রচনা করতে প্রেরণা জুগিয়েছে কি-না।
তথ্য তো আছেই, কিন্তু কেবলই তথ্য নয়, প্রসঙ্গের স্বাভাবিকতায় এই গ্রন্থ প্রেসভুবনের দেশি বিদেশি নক্ষত্রদের সংক্ষিপ্ত অথচ যথাযোগ্য আলোচনায় আলোকিত করেছে মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসকে। লেখক কথিত এইসব ‘যুগন্ধর’রা কেবলই ছাপাখানার জীব নন, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, শিল্প-সংগীত ইত্যাকার কোনো না কোনো ক্ষেত্রে রেখে গেছেন প্রতিভার ছাপ। এ-দেশে চার্লস উইলকিন্স, উইলিয়াম কেরি, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য, রামকমল সেন, ফকিরসা শিবন্নাসা ভান্দাগে, দুর্গাচরন গুপ্ত, কাঙাল হরিনাথ, দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত; বি-দেশে আমেরিকার জনক বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন, আমেরিকান সাহিত্যের জনক মার্ক টোয়েন, ব্রিটেনের হেনরি টিম্পারলি আর ইসিডোর সিরিল ক্যানন। এঁদের সম্মেলন, লেখকের কলমকে ‘লেবার এরিস্টক্রেসি’র আদলে ‘প্রেস আভিজাত্য’ লেখার প্রেরণা দিয়েছে।
উপর্যুক্ত নামগুলিকে সরিয়ে রাখলেও আভিজাত্য থেকে যায় অতি সাধারণ মুদ্রণশিল্পীদের কর্মচেতনায়। এই বিমূর্ত আভিজাত্যকে লেখক কলমের কুশলতায় ছেনে বসিয়েছেন এই গ্রন্থের আখ্যান অংশে। প্রেসকর্মীদের বঞ্চনাকথায়, তাঁদের কর্মপরিবেশের ক্লেদময়তায় যদি বা কিছু ক্লেশ জমে পাঠকের মনে, অচিরেই কৌতুক-পরিহাসে, মানবধর্মের স্নিগ্ধ রসে, সংবেদের গাঢ়তায় স্বাদু ও উজ্জ্বল এই আখ্যান সেই ক্লেশ ধুয়ে নিয়ে চলে যায়। ছাপাখানার ভূতগ্রস্ততায়, প্রহৃত ফাল্গুনের লিপিমালায়, ঘনা বেচারার হয়রানির দিনলিপিতে, বুধোর ঐতিহাসিক শার্ট গেঞ্জিতে বিবিধ রসের ভিয়েন; ‘হস্ত প্রক্ষালন’ স্রষ্টা সুবলবাবুর ও ঠিকানাবিহীন ভূপালবাবুর কম্পোজিটরি উচ্চতায় আবার অন্যতর রসের পাক।
গ্রন্থের প্রথম অংশ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা বাহুল্য হবে। মুদ্রণ শিল্পের ইতিবৃত্তকে দীর্ঘায়িত বা তথ্য-কণ্টকিত না করে তার নির্যাসটুকুই কেবল নিয়েছেন লেখক। বিশিষ্ট যা তা হলো, তথ্যের তেমন জোগান না থাকা সত্ত্বেও প্রিন্টিং প্রেসের শ্রম-সংগ্রামের ইতিহাসকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯০৫ সালে প্রথম ধর্মঘট থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ছাপাখানার কর্মীদের আন্দোলন, ধর্মঘট ও তার ফলাফল নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ আলোচনা উপস্থাপিত করেছেন।
আখ্যান অংশ নিয়ে সবিশেষ হওয়া জরুরি। কারণ, এই অংশের বিশিষ্টতাই গ্রন্থটিকে ব্যতিক্রমীর মর্যাদা দিয়েছে।
এই আখ্যানের কেন্দ্রে কুঠিডাঙ্গা নামের এক মফস্সল শহরে পুস্তক-বলয়ে বসবাস করা এক ‘প্রেস-পরিবার’। আখ্যানকার এই পরিবারেরই বর্তমান প্রজন্ম। তাঁর অব্যবহিত পূর্ব প্রজন্মের এক ভাই কম্পোজিটর। বাকি দুই ভাই বিবিধ পেশায় যাতায়াত করলেও প্রেসের নানাবিধ কাজ, মায় সম্পাদনা কর্মেও অভিজ্ঞ। যিনি কম্পোজিটর, তাঁর একটি ডাকনামও আছে, সেই নামসহ তাঁকে নিয়ে আসছি পরে; আপাতত তাঁর চেহারার বর্ণনা শুনুনঃ
লম্বা মানুষটি টাইপ-কেসের সামনে একটা টুলে বসে স্বল্প আলোয় মোটা কাঁচের চশমা সাঁটিয়ে দিনের মধ্যে প্রায় দশ-বারো ঘণ্টা টাইপ সাজিয়ে চলতেন। আর তার ফলে তাঁর কাঁধ আর পিঠের সংযোগস্থল ঈষৎ গোলাকার।
কর্ম-আভিজাত্যের আর এক রূপকার লিপিমালা প্রেসের অল ইন ওয়ান পঞ্চাদা।
পঞ্চাদা নিজেই কম্পোজ করে, গ্যালিতে কম্পোজ করা ম্যাটার রেখে তাতে রোলারের সাহায্যে কালি মাখিয়ে নিউজ প্রিন্টের ফালি ভিজা ন্যাকড়ার সাহায্যে ভিজিয়ে তার উপরে ভাঁজ-করা কাপড় চাপা দিয়ে পায়ে চেপে প্রুফ তোলে, নিজেই কারেকশন করা প্রুফ ক্যারি আউট করে, নিজেই পায়ে-ঠেলা বা প্যাডেল করা একটা লঝঝরে হাফ-ডিমাই ট্রেডল মেশিনে (মোটর লাগানোর ক্ষমতা হয়নি)হাতে কাগজ দিয়ে ছেপে থাকে। … … … কপিতে যাই থাক না কেন… পরীক্ষা প্রশ্নপত্রে ভ্রম-সংশোধনের জন্য যতগুলি শব্দ দেওয়া হয় এবং যেগুলি সকলে আজীবন ভুল লিখে চলে – তার সবগুলি পঞ্চাদার হাতে সংশোধিত হতো। পঞ্চাদাই উচিত বানান ভুল লেখার জন্য কলকাতার উদীয়মান লেখকের পাণ্ডুলিপিতে গোটা গোটা হরফে লিখে দিয়েছিল – ‘উচিত বানান উচিৎ লেখা উচিত নয়, উচিত বানান উচিত লেখা উচিত, কেননা উচিত বানান উচিত’।
‘মোটা মোটা দেওয়ালের ঈষৎ স্যাঁতস্যাঁতে কুহেলিকা-প্রচ্ছাদিত’ ‘প্রায়ান্ধকার ঘরে’ কনুই পর্যন্ত কালি মেখে ‘অক্ষরের নৈমিষারণ্যে’ বিচরণরত মুদ্রণকর্মীদের যাবতীয় ক্লেদ মুছে যায় সমবেত আহারপর্বের পূর্বাহ্ণে হেড কম্পোজিটর সুবলবাবুর আবিষ্কৃত ‘অর্ধঘণ্টাব্যাপী হস্ত প্রক্ষালনে’। যদিও সিসা মিশ্রিত ছাপার কালি, না-কি কেরোসিনের গন্ধ – কোনটা বেশি উপাদেয় এই হাস্য-মুখরিত বিতর্কে আভিজাত্যের অন্য এক হাওয়া বইতে থাকে সুবলবাবু ও তাঁর মুদ্রণ-সাথীদের হৃদয়ে।
সুলেখা প্রেসের কম্পোজিটর ভুপালবাবুকে জানলে আভিজাত্যের বিমূর্ত রূপ আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়বে।
লম্বা দোহারা চেহারা, টানটান নির্মেদ শরীর, কিন্তু চুলে ধরেছে পাক – বয়স আন্দাজ করা শক্ত। … হাসিখুশি মানুষটি। কম্পোজ ও ডিস্ট্রিবিউশনের কাজ করতেন ঝড়ের গতিতে। কাগজের মাপ, মেশিনে কালির পরিমাণ, বিভিন্ন ফন্টের ধাঁচ-ধরন জানতেন তিনি। তাঁর তত্ত্বাবধানেই সুলেখা প্রেসে একটি সস্তায় কাঠের প্রুফ তোলার মেশিন তৈরি করা হয়েছিল। হাতে চাকা ঘুরিয়ে প্যাড-প্রেসিং করে নিউজ প্রিন্টে তোলা প্রুফ বেশ পরিচ্ছন্ন ও স্পষ্ট হতো। ভূপালবাবু সব দিক দিয়েই অত্যাশ্চর্য মানুষ ছিলেন। পাণ্ডুলিপিতে বাক্যগঠনের ভুল, বানানের ভুল, গল্পের ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ-বিন্যাসে বিভ্রম, কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দের ত্রুটি তিনি চিহ্নিত করে দিতেন। প্রবন্ধের তথ্যভ্রান্তিও ভূপালবাবুর চোখ এড়িয়ে যেতে পারত না।
এবং বুধোদা। পরমার্থ মঠ-এর জাগতিক অর্থের স্বচ্ছলতার কারণে নিজস্ব প্রেস। সেখানে ছাপা হয় কেবলমাত্র ‘পরমার্থ সন্ধান’ নামে মঠেরই একটি পত্রিকা। সেই প্রেসের একমাত্র কর্মী সর্বজনীন বুধোদা। তাঁর পরিচয় শুনুন পূর্বোক্ত ঘনা নামক কম্পোজিটরের লেখনীতে – ‘আমাদের বুধো একশ শতাংশ প্রেসম্যান। সামান্য পয়সায় সে পরমার্থ মঠের প্রেসের সব কাজ করে, অথচ সে নিজে সমার্থ ভিন্ন কোনো রকম পরমার্থের ধার ধারে না।‘ অন্য প্রেস তাকে বেশি পয়সা দিতে চাইলেও সে কদাপি রাজি হয় না। বরং তার অঢেল উদ্বৃত্ত সময়ে সে পঞ্চাদা ইত্যাদি পছন্দের লোকজনের জন্য বাইন্ডিং-এর কাজ করে দেয়। বাকি সময় সে শুধু বই পড়ে – ‘যা বই হাতের সামনে পায়, চেয়ে-চিন্তে জোগাড় করতে পারে – সে বই। … সাধারণের পক্ষে অপ্রবেশ্য মঠের প্রেসের রক্ষণশীল কেন্দ্রিকতার আশ্রয় বুধোকে সারাদিন কুঠিডাঙ্গার কোলাহল থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে থাকে। এই নিভৃতিই বুধোর পাঠের জগৎটাকে এতটা বিস্তৃতি দিয়েছে।‘
যে-আভিজাত্যের কথা বলে চলেছি তা যেন জমাট বেঁধে আছে এই বুধোদারই বাঁধানো একটি খাতায়। তাকে আখ্যানকার বলেছেন ‘ঘনার যাপনপঞ্জী’। তিনি বলছেন, ‘খাতাটা খুলতেই এক স্নিগ্ধ আলো, মৃদু সৌরভের সস্মিতি ছড়িয়ে গেল আমাদের অস্ত্বিত্বেও’। কেন? না ‘খাতাটার কোথাও কোনো সংকীর্ণতার কটুস্পর্শ নেই, নেই অকারণ সমালোচনা, একতরফা বিচার, পক্ষপাতমূলক মন্তব্য’। তো এই ঘনা কে? সেই পরিচয়ও দেওয়া আছে খাতায় –
কত কত শ্যামবর্ণ ছেলেকে মা-ঠাকুমারা গৌরাঙ্গ নাম দিয়ে ‘গোরা’ বলে চালিয়ে দেন, কালো মেয়েকে ফর্সাবাচক নাম দিয়ে ডানা কাটা পরী! কিন্তু বাঙালির ডাকনামের অনাচারে আমি হয়ে গেলাম ঘনা।
খাতার প্রথমে আছে ঘনার একটি দিনের ‘হয়রানির দিনলিপি’। পাঠকদের তাজা আস্বাদনের জন্য এই দিনলিপির বিষয়বস্তু উহ্য রেখে এগিয়ে যাওয়া ভালো। তারপর আরও কিছু বিষয়ের পাশ কাটিয়ে ‘অভিধানের জন্য প্রস্তাবিত লোকার্থবাচক শব্দাবলী সংগ্রহ’-এর কয়েকটি নমুনা দেখাই —
তর্ক --- গলাবাজি।
যুক্তি --- নিজের কোলের দিকে ঝোল টানা।
বক্তৃতা --- নিজের যাতে বিশ্বাস নেই সেটাই লোককে বোঝাবার চেষ্টা করা; এমন চেঁচানি যাতে লোকে প্রচুর হাততালি দেয়।
এই আপাত-লঘুতা পেরিয়ে ঘনার খাতা পৌঁছেছে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবনকথার উদ্দীপক মূল্যায়নে। এই মূল্যায়ন মোটেই ভক্তিরসাপ্লুত নয়, বরং তাঁর আভিজাত্যের মূলে যে চারিত্রিক সদ্গুণের যৌক্তিক অনুশীলন, তাকেই অবলম্বন করে নিজের জন্য একটি যাপনপ্রণালী প্রণয়ন।
ফ্র্যাঙ্কলিন জানতেন যে, আত্মবোধের মহান নাগরিক-উপযোগিতা কতটা! আত্মবোধ অর্জনের লক্ষ্যে সদ্গুণাবলী আয়ত্ত করার ফ্র্যাঙ্কলিন আত্মানুশীলনের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি সম্ভাব্য সদ্গুণাবলীর তালিকা তৈরি করে তাকে দৈনন্দিন পালনীয় কর্মে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য ছক-কেটে সারা দিনের নিরিখে আচরণের পাশে সম্মতি-চিহ্ন দিতেন। তীব্র আত্মজ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য আমাকেও আমার মতো করে সেই চেষ্টাই করতে হলো।
ফলস্বরূপ বিবিধ রসের জারণে প্রস্তুত যে-অভিনব তালিকাটি খাতায় অবস্থান করছে উদ্ধৃতি দিয়ে তা পাঠকের গোচরে আনা অসম্ভব।
গ্রন্থের শেষ পর্যায়ে আছে ‘প্রহৃত ফাল্গুনের লিপিমালা’ – নামের ব্যঞ্জনাতেই প্রতীয়মান যে সে এক মধুর-বিধুর প্রেমকাহিনি। প্রেস-পরিবারের সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যের অনুসারী, বর্তমান প্রজন্মের খুব সম্ভবত সর্বশেষ কম্পোজিটর, আখ্যানকারের ‘ছোটদি’ এই কাহিনির নায়িকা; নায়ক আমাদের পূর্বপরিচিত পঞ্চাদা। এই কাহিনি বিয়োগান্ত হলেও বিয়োগসম্ভব নয় কিছুতেই, তার মধুরতা এবং বিধুরতা মানবহৃদয়ে চির-বহমান। এই কাহিনির পূর্বাপর প্রকাশ করা এই আলোচকের ক্ষমতা-বহির্ভূত।
উপসংহারে আলোচনার জন্য তুলে রেখেছিলাম ছাপাখানার ভূতকে। তার ‘জনবদন্তিসুলভ’ মুদ্রণ-দৌরাত্ম্যের বৃত্তান্তও যথাযোগ্য ভঙ্গীতে উদ্ধৃত করেছেন লেখক। ফলত নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো কম্পোজিটরদের ‘কর্মপরিবেশগত’ এবং ‘অর্থসামর্থ্যগত’ ক্লেশও পাঠকদের কাছে কমিক রিলিফ মনে হতে পারে।
সেকালে ণ ও ল অক্ষর একইভাবে লেখা হইত, এবং কোথায় ণ কোথায় ল হইবে কম্পোজিটরদের বিদ্যায় তাহা কুলাইত না। ক্ষীণদৃষ্টি কম্পোজিটর সঙ্কীর্ণ গলিপথের দিবালোকে তু ও ভু অক্ষরের সূক্ষ্ম তফাৎটুকু দেখিতে পায় না। ম কম পড়িয়া গিয়াছে, সুতরাং কাছাকাছি ষ হরফ বসানো ছাড়া আর উপায় কি। অতএব “সকল কারণ তুমি তুমি সে কারণ” এই কপি ছাপা হইয়া বাহির হইল “শবল কাবল ভুষি ভুষি সে কাবল”।
এই গ্রন্থের আখ্যানকার নিজেও তাঁর কম্পোজিটর জ্যাঠামশায়(ঘনা)-এর এক চিত্তাকর্ষক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেনঃ
একটি গল্পের প্রধান চরিত্র বিয়ের পর কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার সময় নববধূকে জিজ্ঞাসা করেছিল—‘তুমি আমার সঙ্গে যাবে না বলো’। এমন বিচিত্র এবং অত-বেরসিক কথা কোনো সদ্য বিবাহিত নব্য যুবক বলতে পারে তা তো অকল্পনীয়! ফাইন্যাল কারেকশনের সময় মেজো জ্যাঠামশাইয়ের সন্দেহ হওয়ায় তিনি লেখকের মূল পাণ্ডুলিপি তলব করলেন। দেখলেন যে, লেখক আসলে লিখতে চেয়েছিলেন—‘তুমি আমার সঙ্গে যাবে কী না বলো’। এই ‘কী’ শব্দটিতে হ্রস্ব ই না দীর্ঘ ঈ বসাবেন তা স্থির করতে না পেরে ‘কি’ বা ‘কী’ –এর মতো করে বেজায় ধ্যাবড়া করে কিছু একটা লিখেছিলেন। কম্পোজিটর মনে করেছিলেন শব্দটাকে কেটে দেওয়া হয়েছে। মেজো জ্যাঠামশাইয়ের নজরে আসায় বেচারা যুবকটি সেবারের মতো পাঠকের অভিশাপের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এই ধরনের বিচিত্র মুদ্রণপ্রমাদের ভুরি ভুরি উদাহরণ মিলবে মুদ্রণের ইতিহাস ঘাঁটলে। কয়েকটি পত্রিকা এবং গ্রন্থ সম্পাদনার কাজ করতে গিয়ে বর্তমান আলোচকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও এ-বিষয়ে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। সেই অবান্তর গল্প এড়িয়ে এই গ্রন্থ থেকে আরও কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেই এই প্রসঙ্গে ইতি টানা ভালো।
‘ক্ষ্ম’ অক্ষরটির অভাবে ‘লক্ষ্মণ’ হয়েছিলেন লক্ষমণ, স্পেস দেওয়ার গণ্ডগোলে ‘দুই জনপ্রিয়’ হয়ে যান ‘দুই জন প্রিয়’, আবার অনবধনতা ‘সত্যের মতো বদমাশ’কে বানিয়ে দেয় ‘সত্যের মাতা বদমাশ’।
পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি গুটেনবার্গের হাতে ছাপাখানা-যন্ত্রের জন্মের পর থেকেই মানুষের জ্ঞানচর্চা ও তার প্রসার দ্রুত চলমান। কেবলই জ্ঞান নয়, ছাপানো পুস্তক বহুসংখ্যক মানুষের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম হয়ে ওঠে। ছাপাখানা ও পুস্তক ব্যবসা অর্থকরী হয়ে ওঠার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রণযন্ত্র আধুনিক হয়ে উঠতে থাকে। একদা যা ছিল প্রযুক্তির ‘কল্যাণ’, শেষ পর্যন্ত লেটার প্রেসের ক্ষেত্রে তা হয়ে উঠল প্রযুক্তির ‘গ্রাস’। সেই গ্রাসে লেটার প্রেস আজ অবলুপ্ত। গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে লেখকের আক্ষেপ যথোচিত। তার মধ্যেও তিনি কম্পোজিটর শব্দটিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে ভোলেননি।
‘কম্পোজিটর’ শব্দটি অবশ্য পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গেল না। নতুন যন্ত্র-নামের আড়ালে বা ডেস্কটপ অপারেটরের বেশে সে সংখ্যালঘু হয়ে আত্মরক্ষা করল সিসার চলমান টাইপের বদলে বোতাম-টেপা অক্ষরের বিন্যাসে--
লেটার প্রেসের আয়ু হয়তো শেষ হয়েছে কিন্তু থেকে গেছে তার সুদীর্ঘ ইতিহাস। মানবসভ্যতার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সাক্ষী হয়ে থেকে যাবে এই ইতিহাস। বিভিন্ন ভাষায় রচিত এ-সংক্রান্ত গ্রন্থের সংখ্যা অগণিত-প্রায়। এই গ্রন্থের লেখক যে-সহায়কপঞ্জী দিয়েছেন পরিশিষ্টে, তাতেই দেখতে পাচ্ছি ৭৯ টি গ্রন্থনাম। আমার সীমিত জ্ঞান সত্ত্বেও বলতে অসুবিধে নেই বর্তমান বইটি সেই ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার নয়। কেবলমাত্র কম্পোজিটরদের জীবনকে কেন্দ্রে রেখে গ্রন্থ রচনা এর আগে কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই। অনন্ত জানা লিখিত ও সুপ্রকাশ প্রকাশিত এই বই তাই আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এ-গ্রন্থ চিরঞ্জীবী না হোক শতঞ্জীবী হওয়ার আশা করতেই পারে।