• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • ভারতবন্ধু অ্যান্ডরুজ ও পিয়র্সন : গোপা দত্তভৌমিক

      


    ১.

    ইংরেজের সঙ্গে আমাদের ঔপনিবেশিক সম্পর্কের রূঢ়তা, কর্কশ ও নির্বিবেক অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক অভীপ্সার নিষ্ঠুর দমনের রক্তাক্ত রেখাচিত্রের মধ্যে কয়েকজন ইংরেজের স্বার্থপরতার লেশহীন ভারতপ্রেম একেবারে বিপরীত ছবি তৈরি করে। এঁদের নামের তালিকা খুব ছোটো নয়, এবং অনেককেই আমরা বিস্মৃতির কোঠায় ঠেলে দিয়েছি। চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্‌রুজ ও উইলিয়ম উইনস্ট্যানলি পিয়র্সন সেই প্রায় ভুলে যাওয়া দুজন ভারতবন্ধু। দুজনের নাম একসঙ্গে আনা হচ্ছে তার কারণ এঁরা ছিলেন পরস্পরের বন্ধু এবং একসঙ্গে জনহিতব্রতে ঝাঁপিয়েছিলেন। অ্যান্ড্‌রুজ যে রবীন্দ্রনাথ ও মহাত্মা গান্ধী দুজনেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন এবং শান্তিনিকেতনের সঙ্গে এই দুই বিদেশীরই অন্তর ও বাহিরের যোগ ছিল এসব তথ্য সকলেরই জানা। এই প্রবন্ধে এঁদের কম আলোচিত কয়েকটি কাজে আলো ফেলার চেষ্টা করব। প্রধানত ফিজি ও আফ্রিকায় তাঁরা যেসব কাজ করেছিলেন — সুদূরপ্রসারী তার সুফল।

    ১৯২১ সালে জানুয়ারি মাসে অ্যান্ড্‌রুজ অসুস্থ হয়ে পড়লে গান্ধীজি তাঁকে লেখেন, ‘You had no business to get ill,’ এবং মার্চেও অ্যান্ড্‌রুজ সুস্থ না হলে লেখেন, ‘My dearest Charlie, must it not be a crime for God’s soldier to be bedridden?’ এই 'God’s soldier' বিশেষণটি যথার্থ কারণ যাজক পরিবারের সন্তান অ্যান্ড্‌রুজ ছিলেন সেবাধর্মে খ্রীস্টের একনিষ্ঠ শিষ্য। কেম্ব্রিজে পড়ার সময় (১৮৯০–১৮৯৫) তাঁর লেখা গবেষণাপত্র ‘The Relation of Christianity to the Conflict between Capital and Labour’ ধর্ম বিষয়ে দশবছরের মধ্যে সেরা রচনা। গোটা জীবনের সমস্ত কাজে খ্রীস্টের বাণীকে তিনি ফলিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন—ধর্মপ্রচার নয়, গীর্জার বেদী থেকে ধর্মদেশনা নয়, দরিদ্র, পীড়িত, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে। কেম্ব্রিজে পড়ার সময়ে তিনি খ্রীস্টান সোসাল ইউনিয়ন দলে যোগ দেন এবং টেমস্‌ নদীর দক্ষিণে লন্ডনের বস্তি এলাকায় তখন কাজ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে পাঁচবছর ইংল্যান্ডে দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করেছেন। জাহাজ নির্মাণের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। তিনি স্পষ্ট লিখেছেন যে এইসব অভিজ্ঞতা তাঁকে পুঁজিবাদবিরোধী করে তুলেছিল। ধর্মযাজক হিসেবে নিযুক্ত হয়ে (সাউথওয়ার্ক ক্যাথিড্রালে) অ্যান্ড্‌রুজ ধর্মীয় দায়িত্ব ও দরিদ্রদের সেবার মধ্যে দোটানায় পড়েন এবং শিক্ষার জগতে চলে আসেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডিতে বদ্ধ থাকেননি।

    কলেজজীবনেই অ্যান্ড্‌রুজ ভারতের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর সমধর্মী বন্ধু বেসিল ওয়েস্টকট কেম্‌ব্রিজ মিশন ব্রাদারহুডের হয়ে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে অধ্যাপনা করতে এসেছিলেন। সেখানে অসুস্থ রোগীর সেবা করতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই খবর জানার পর অ্যান্ড্‌রুজ ঠিক করেন তিনি ভারতে আসবেন। তিনি মনে করেছিলেন ভারত তাঁকে ডাকছে। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন ‘আমার জীবনে দ্বিতীয় এক জন্মদিন আছে, সেই দিনটা হল ২০ মার্চ। কারণ ১৯০৪ সালের ঐ দিনে আমি ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম এবং প্রাচ্যে আমার নতুন জীবন শুরু করেছিলাম।’

    দিল্লিতে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে অধ্যাপনার সময় তাঁর বন্ধু ছিলেন কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল সুশীল রুদ্র। অ্যান্ড্‌রুজ লিখেছেন যে ইংল্যান্ডে বাস করার কালে তাঁর কিছু ভুল ধারণা ও সংস্কার ছিল, সুশীল সেইসব জাতিগত ও সাম্রাজ্য সংক্রান্ত ধারণা ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সহায়ক হয়েছিলেন। শ্বেতাঙ্গরা কীভাবে ভারতীয়দের নিয়ত অপমান করে তাও সুশীলের কাছেই তিনি প্রথম জানেন। তিনি এই সময় উর্দু শিখতে শুরু করেন। নিজেকে ভারতের সেবার জন্য এইসময় থেকে তিনি প্রস্তুত করতে থাকেন। আর্যসমাজের নেতা লালা মুন্সিরামের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ হন। এই মুন্সিরামই পরবর্তী জীবনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। মুসলমান পণ্ডিত মুন্সি জাকা উল্লাহের সঙ্গেও তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। সাইকেল নিয়ে দিল্লির প্রান্তিক মানুষ, চামার, ও অন্যান্যদের সঙ্গে ছাত্রদের নিয়ে সময় কাটাতে যেতেন অ্যান্ড্‌রুজ। নিজের ছাত্রদের মনে চিরস্থায়ীভাবে সমাজসেবার বীজ রোপণ করে দিয়েছিলেন তিনি।

    ১৯০৬ সালে লাহোরের দৈনিক পত্র সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে প্রকাশিত একটি চিঠিতে ভারতীয় নেতাদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়। অ্যান্ড্‌রুজ ঐ চিঠির উত্তরে ভারতীয় নেতাদের সমর্থন করে লেখেন যে পত্রলেখক অত্যন্ত অন্যায্য কথা বলেছেন। এই চিঠির ফলেই ভারতীয় নেতারা তাঁকে বন্ধু মনে করতে থাকেন। তাঁকে ১৯০৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ‘অবজারভার’ হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই অধিবেশনে দাদাভাই নওরোজি স্বরাজের জন্য যা বলেন, অ্যান্ড্‌রুজ তা সমর্থন করেন। তবে ঐ অধিবেশনে ভারতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ সমস্যা, জাতপাতের বিভেদ নিয়ে আলোচনা হয়নি বলে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। এর পরই তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলেকে জানান যে তিনি জাতীয় কাজে সাহায্য করতে চান। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছেন।

    ১৯০৭ সালে জমির অধিকার নিয়ে নতুন আইনের বিরোধিতা করায় লালা লাজপত রাইকে গ্রেফতার করা হয়। অ্যান্ড্‌রুজ তাঁর কেম্ব্রিজের বন্ধু দিল্লির তখনকার ডেপুটি কমিশনার রবার্ট হামফ্রেসকে ব্রিটিশ সরকারের উৎপীড়নমূলক শাসননীতির বিষয়ে সতর্ক করেন। এরপর থেকেই সি. আই. ডি. অ্যান্ড্‌রুজকে অনুসরণ করতে থাকে। তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁর অগোচরে কাগজপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু অ্যান্ড্‌রুজ থেমে থাকার লোক ছিলেন না। তিনি ভারতে ব্রিটিশ উৎপীড়নের কুফল বিষয়ে লেখালেখি করতে থাকেন। ব্রিটিশ সামরিক অফিসারদের জাতিবিদ্বেষী মনোভাবের বিষয়ে সেনাপ্রধান কিচেনারকে চিহ্নিত করে চিঠি লেখেন। ফলে বিষয়টা নিয়ে নাড়া পড়ে। শাসকের কাছে তিনি অপ্রিয়ও হন।

    অ্যান্ড্‌রুজের জীবনে জুলাই ১৯১২ থেকে জানুয়ারি ১৯১৪ পর্যন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজির সরাসরি সান্নিধ্যে আসেন। ৭ জুলাই ১৯১২, লন্ডনে উইলিয়ম রোদেনস্টাইনের বাড়িতে রবীন্দ্রকবিতার কবিকৃত ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করেছিলেন ডব্লু. বি. ইয়েটস। এই তথ্য আমাদের জানা। সেদিন যে গুণিজনরা কবিতাপাঠ শুনতে সমবেত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অ্যান্ড্‌রুজ। সেই রাতটিকে তিনি ‘অন্তর আলোকিত’ করার রাত বলেছেন। পরের দিন অর্থাৎ ৮ জুলাই অ্যান্ড্‌রুজ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা অ্যান্ড্‌রুজ মডার্ন রিভিউতে দুটি সংখ্যায় লিখেছেন, ‘An Evening with Rabindra’ এবং ‘With Rabindra in England.’ এরপর কবির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে যা আজীবন স্থায়ী ছিল। রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় গিয়েছিলেন; সেই সময় অ্যান্ড্‌রুজ প্রথমবার শান্তিনিকেতনে আসেন। এরপর দিল্লির চাকরি ছেড়ে বোলপুরে চলে আসার জন্য ব্যবস্থা করতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি লিখেছিলেন সংকীর্ণ মিশনারি প্রতিষ্ঠানের বাঁধন কেটে তিনি পূর্ণ ভালোবাসা ভারতকে দিতে চান। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সুগভীর প্রীতির সম্পর্ক কোন সুরে বাঁধা ছিল তার আভাস নানা চিঠিপত্রে বিধৃত হয়ে আছে। অ্যান্ড্‌রুজ রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, ‘I need the human side of love so much and you have given it to me.’ শুধু শান্তিনিকেতনে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আশ্রমজীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া নয়, বিদ্যালয়ের জন্য ও বিশ্বভারতীর জন্য অর্থসংগ্রহ করার কাজে তিনি রবীন্দ্রনাথকে বহু সাহায্য করেছেন। ১৯২০ সালে এপ্রিলে রবীন্দ্রনাথ যখন আমেরিকা ও ইওরোপে যান তখন আশ্রমবিদ্যালয়ের দায়িত্ব পূর্ণভাবে অ্যান্ড্‌রুজের উপর দিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সময় তিনি উপাচার্য পদে বৃত হন। সবসময় দীর্ঘদিনের জন্য বোলপুরে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না, আর্ত মানুষের সেবার জন্য নানা জায়গায় ছুটে ছুটে যেতেন। তবু শান্তিনিকেতনে যেন তাঁর একটি স্থায়ী নীড় ছিল। নিজের কয়েকটি বইয়ের রয়্যালটি বিশ্বভারতীকে দিয়ে গিয়েছেন অ্যান্ড্‌রুজ। ১৯৩২ সালে মীরা দেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথ জার্মানির লিপজিগে প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়ার সময় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে কবি কন্যাকে জার্মানিতে পাঠান। অ্যান্ড্‌রুজকে লেখেন, – ‘সব কিছু সামলাবার জন্য আমি তোমার উপর নির্ভর করব। ... মীরা খুব স্বস্তিবোধ করবে যদি তুমি ওর সঙ্গে দেখা কর এবং ওকে সাহায্য কর।’ অ্যান্ড্‌রুজ ছুটে যান কিন্তু নীতুর শয্যাপার্শ্বে দুসপ্তাহও থাকতে পারেননি। কারণ ৭ আগস্ট নীতুর মৃত্যু হয়। বোঝা যায় দুঃখে-সুখে তিনি আশ্রম ও রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় হয়ে উঠেছিলেন। অ্যান্ড্‌রুজকে লেখা চিঠিপত্রে (Letters to a Friend) রবীন্দ্রনাথ একটি বিরল অন্তরঙ্গতায় ধরা দিয়েছেন।

    গান্ধীজিকে অ্যান্ড্‌রুজ প্রথম দেখেন দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে ১৯১৪ সালের পয়লা জানুয়ারি। উমটালি জাহাজ থেকে ডারবানে নামার পর অ্যান্ড্‌রুজ খুঁজছিলেন কে তাঁদের নিতে এসেছেন। অ্যান্ড্‌রুজের সঙ্গে ছিলেন পিয়র্সন। পূর্বপরিচিত হেনরি পোলক একজন নেড়ামাথা, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মতো মোটা কাপড়ের সাদা ধুতি ও কুর্তা-পরিহিত এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দিলেন। তিনিই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। অ্যান্ড্‌রুজ বয়সে গান্ধীজির থেকে বছর দুয়েকের ছোটো, কিন্তু পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। এর ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী ইংরেজরা প্রচণ্ড চটে যায় কারণ তিনি একজন এশীয়র পা ছুঁয়েছেন। অ্যান্ড্‌রুজ তাদের মনে করিয়ে দেন খ্রীস্ট, সেন্ট পল, সেন্ট জনও এশীয় ছিলেন। গান্ধীজি তখন নাটালে কয়লাখনিতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলছিলেন। এর আগে ট্রান্সভাল গভর্নমেন্টের ১৯০৬ সালের এশিয়াটিক ল অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিনান্স ও অন্য দমনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গান্ধীজি সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন। নাটালের কয়লাখনিতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের জড়ো করে দুহাজার পুরুষ, মহিলা ও শিশুসহ ট্রান্সভালের দিকে এগোতে থাকলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এই খবরে উদ্বিগ্ন হয়েই গোখলে অ্যান্ড্‌রুজ ও পিয়র্সনকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গান্ধীজি ও অ্যান্ড্‌রুজ ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। অ্যান্ড্‌রুজ হয়ে গেলেন গান্ধীজির চার্লি, আর গান্ধীজি অ্যান্ড্‌রুজের মোহন। দক্ষিণ আফ্রিকার জঘন্য বর্ণবৈষম্য গোড়া থেকেই অ্যান্ড্‌রুজকে প্রচণ্ড পীড়িত করেছিল। রবীন্দ্রনাথকে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন ‘এখানে কেবল দুই ঈশ্বরের — অর্থ এবং জাতির পুজো হয়।’ নাটালে অ্যান্ড্‌রুজকে প্রার্থনায় যোগ দিতে ও উপদেশ দিতে আহ্বান করা হয়, পিয়র্সন গান্ধীজিকে নিয়ে তা শুনতে এসেছিলেন কিন্তু শ্বেতাঙ্গদের জন্য সংরক্ষিত গীর্জায় গান্ধীজিকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। মর্মাহত হন অ্যান্ড্‌রুজ। তবে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান প্রশাসক জেনারেল স্মাটসের সঙ্গে গান্ধীজির সাক্ষাৎ করাতে পেরেছিলেন। ফলে বরফ গলে মতৈক্যে পৌঁছনো সম্ভব হয়।

    অ্যান্ড্‌রুজের আগ্রহের ফলেই দক্ষিণ আফ্রিকার ফিনিক্স স্কুল গান্ধীজি গুটিয়ে নেবার পর দুই শিক্ষক-সহ ১৬ জন ছাত্র ভারতে এসে সোজা শান্তিনিকেতনে উঠেছিলেন ১৯১৪ সালের অক্টোবর মাসে। চার মাস বাদে ফেব্রুয়ারি ১৯১৫তে গান্ধীজি ও কস্তুরবা শান্তিনিকেতনে এলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন আশ্রমে ছিলেন না, ফলে গান্ধীজিকে বরণ করার দায়িত্ব ছিল অ্যান্ড্‌রুজের উপর। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজি আর রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অ্যান্ড্‌রুজের অবস্থানকে ‘হাইফেন’ বলতেন। আজীবন এই দুইজনের নিঃশর্ত ভালোবাসা পেয়েছিলেন অ্যান্ড্‌রুজ, সমতা সাধন করবার চেষ্টা করেছিলেন দুই প্রবল ব্যক্তিত্বের। ভিন্ন মতের, এই দুই বিরাট মনীষীর বন্ধুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখবার সেতু হয়ে থাকতে চেষ্টা করেছেন।

    ২.

    অ্যান্ড্‌রুজের সবচেয়ে বড়ো কাজ বোধহয় indentured labour বা চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা একক প্রচেষ্টায় রদ করা। এই ব্যাপারে ভারতের দরিদ্র মানুষের জন্য অ্যান্ড্‌রুজ এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ইংরেজ খেতমালিকরা ফিজি, জামাইকা, ত্রিনিদাদ, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি স্থানে আখের খেতে কাজ করার জন্য দরিদ্র ভারতীয়দের পাঁচ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ করে নিয়ে যেত। এই চুক্তির শর্ত এমনই ছিল যে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে সর্বার্থে ক্রীতদাসে পরিণত হত। সম্প্রতি ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষ এই শ্রমিকদের জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এই শ্রমিকদের অনেকেই খিদিরপুর বন্দর থেকে জাহাজে যাত্রা করতেন। আসামের চা বাগানের কুলিদের জন্য উনিশ শতকে ব্রাহ্ম সমাজসংস্কারকরা কাজ করেন। কিন্তু বিদেশের এই শ্রমিকদের কথা তেমন জানা ছিল না। গোখলে ১৯১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে এঁদের দেখেন আর গান্ধীজি তাঁদের কাছেই ছিলেন বলে জানতেন। ১৮৬০ সালে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের প্রথম দলটি দক্ষিণ আফ্রিকায় যান। ১৯১৩ সালে তোতিরাম সনাধ্যায় নামে এক চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের লেখা হিন্দি বই ‘ফিজি দ্বীপমে মেরে ইক্কিস বর্ষ’ প্রকাশ পায়। অ্যান্ড্‌রুজের চোখ এড়ায়নি সেই লেখা। রেভারেন্ড জে. ডব্লু বার্টনের লেখা, ‘ফিজি অব টুডে’ পড়েও তিনি চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁদের বাঁচাবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ১৯১৪ সালেই তাঁর ‘ইন্ডেনচার্ড কুলি’ নামে কবিতাটি বেরোয় মডার্ন রিভিউতে।

    ঐ সে ভয়ে জড়সড়
    পিঠে, হাতে ক্ষতচিহ্ন, যেন শিকারের জীব,
    আতঙ্কিত।
    আমার অন্তর উত্তাল হল তার প্রতি
    আর ছুটল চোখের জল।
    তারপরে এল এক পরিবর্তন,
    তার চোখে দেখলাম তোমার উজ্জ্বল মুখ—
    ওহ্‌ কী বিস্ময়!
    শান্ত, মৃত্যুহীন সৌন্দর্য, উন্মোচিত,
    হে দুঃখের দেবতা।
    চুক্তিবদ্ধ শ্রমব্যবস্থা নিয়ে লেখা সব সরকারি রিপোর্ট অ্যান্ড্‌রুজ অনুপুঙ্খসহ পড়েছিলেন। যেসব জায়গা থেকে তাদের নিয়োগ করা হত সেখানেও গিয়েছিলেন। নিয়োগকেন্দ্রগুলি ছিল যেন জীবন্ত নরক। গরিব মানুষদের নানা সুযোগ সুবিধে ও মজুরির মিথ্যা প্রতিশ্রুতির প্রলোভন দেখানো হত। ফিজির উদ্দেশ্যে অ্যান্ড্‌রুজ বন্ধু পিয়র্সনকে নিয়ে ১৯১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যাত্রা করেন। ফিজির গভর্নর আয়ার হাটসন যদিও অ্যান্ড্‌রুজের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে যান, তবে কথা আদায় করে নেন কোনো জনসভা করা যাবে না বা প্রেসের সঙ্গে বসা যাবে না। ফিজির কলোনিয়াল সুগার রিফাইনিং কোম্পানির ম্যানেজার এডওয়ার্ড নক্সের সঙ্গেও অ্যান্ড্‌রুজ দেখা করেন। নক্সকে তাঁর এক পাশবিক চরিত্র মনে হয়েছিল। নক্স রটিয়ে দেন অ্যান্ড্‌রুজ ভারতীয় শ্রমিকদের খেপাতে এসেছেন। Emigration Committee এবং খেতমালিকদের সংগঠনের সঙ্গেও কিন্তু অ্যান্ড্‌রুজ আলোচনা করেছিলেন। সবথেকে বেশি করে তিনি দেখেন শ্রমিক বসতিগুলির নিদারুণ অবস্থা। ফিজি ১৮৭৪ সাল থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশ হয়। ওখানে গড়ে উঠেছিল চিনির কল। ১৯১০ সালের মধ্যে চিনির কলে ত্রিশ লক্ষ পাউন্ড বিনিয়োগ হয়। বোঝা যায় খুবই লাভের ব্যবসা হয়ে উঠেছিল। চিনির কল, আখের খেত — সব জায়গাতে চুক্তিবদ্ধ ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়োগ করা হত। প্রথমে চিনির কলের কর্তারা এবং শ্রমিকরাও অ্যান্ড্‌রুজ, পিয়র্সনকে গুপ্তচর মনে করেছিলেন। অন্যদিকে ভারতীয় শ্রমিকদের মুখপাত্র মণিলালকে অ্যান্ড্‌রুজের মালিকপক্ষের চর মনে হয়েছিল। শ্রমিকরা অবশ্য পরে ভুল বুঝতে পারেন। তাঁরাই অ্যান্ড্‌রুজকে দীনবন্ধু উপাধি দিয়েছিল।

    ফেরার পথে জাহাজেই অ্যান্ড্‌রুজ তাঁর বিখ্যাত রিপোর্ট লিখতে শুরু করেন। কী ধরনের অত্যাচার শ্রমিকদের উপর করা হচ্ছে রিপোর্টে পুরো প্রকাশ পায়। একশো জন পুরুষ পিছু চল্লিশ জন মহিলা শ্রমিক নিয়োগ করা হত। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তাঁরা বারাঙ্গনায় পরিণত হতেন। অ্যান্ড্‌রুজ লেখেন একজন চুক্তিবদ্ধ মহিলাকে যখন তিন জন চুক্তিবদ্ধ পুরুষ ও বাইরের লোকদের সেবা করতে হয় তখন সিফিলিস বা গনোরিয়ার মতো রোগ দেখা দেবে সন্দেহ নেই। ১৯১৪ সালে কুড়ি হাজার বাষট্টি জন পুরুষ শ্রমিকের সঙ্গে মাত্র আট হাজার সাতশো পঁচাশি জন মহিলা শ্রমিক ছিলেন। শ্রমিকদের পরিবার নিয়ে আসতে দেওয়া হত না। অ্যান্ড্‌রুজ লক্ষ্য করেছিলেন শ্রমিকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। প্রতি দশ হাজারে ন’শো ছাব্বিশ জন শ্রমিকের আত্মহত্যার হিসেব দিয়ে অ্যান্ড্‌রুজ নিয়োগপ্রক্রিয়ার ছলনা ও প্রতারণার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিয়োগ হত পাঁচ বছরের জন্য, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাধ্যতামূলক শ্রম। অ্যান্ড্‌রুজ একে ক্রীতদাস প্রথার সঙ্গে তুলনা করেছেন। চুক্তির সময়ে স্থিরীকৃত মজুরি আর বাড়ত না — তা সে জিনিসপত্রের দাম বাজারে যতই বাড়ুক। শ্রমিকদের বাসস্থানগুলি ঘোড়ার নোংরা আস্তাবলের মতোই ছিল, মনুষ্যবাসযোগ্য নয়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল ছিল অতি খারাপ।

    ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ রিপোর্টটি পড়ে লন্ডনে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন। ভারত সচিবের কাছে পাঠানোর জন্য কাগজপত্র তৈরি করতে অ্যান্ড্‌রুজ সাহায্য করেন। তিনি চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ করার প্রস্তাব রাখেন। এর মধ্যে হার্ডিঞ্জের কার্যকাল শেষ হয়ে ভাইসরয় হলেন চেমসফোর্ড। তিনি এই ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না এবং অ্যান্ড্‌রুজকে পছন্দও করতেন না। হার্ডিঞ্জ জানিয়েছিলেন ব্রিটিশ সরকার এই প্রথা রদ করতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু সেই ঘোষণার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকার আরো পাঁচ বছরের চুক্তির অনুমোদন দেয়। চেমসফোর্ড অ্যান্ড্‌রুজের চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অ্যান্ড্‌রুজ তখন গান্ধীজির সহায়তায় ভারত জুড়ে সভা করে বলেন যে সরকার কথার খেলাপ করেছে। অবশেষে ১৯১৬ সালের ২৫ মে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন হাউস অফ কমন্সে চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা রদ করার কথা ঘোষণা করেন। কিন্তু আরো পাঁচ বছরের চুক্তি আগেই করা হয়েছিল। তার মেয়াদ শেষ না হওয়া নিয়ে সংশয় রয়ে গেল। ১৯১৭ সালে অ্যান্ড্‌রুজ আবার ফিজিতে গেলেন সমাধানসূত্র বার করার জন্য। সরকারি অফিসার ও খেতমালিকরা এবার তাঁর সঙ্গে শত্রুর মতো ব্যবহার করে। শ্রমিকদের জন্য বেশ কয়েকটি স্কুল স্থাপন করেন অ্যান্ড্‌রুজ, চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের মজুরি ২৫% বাড়ানোর ব্যবস্থা করেন। সব চুক্তি পয়লা জানুয়ারি ১৯২০ শেষ হবার ব্যবস্থা হয়।

    প্রচণ্ড পরিশ্রমে অ্যান্ড্‌রুজ সে বার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফেরার পথে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে সুস্থ হয়ে ভারতে ফেরার পর ফিজির অসহনীয় অবস্থা বিষয়ে জনমত জাগাবার জন্য আরেকটি রিপোর্ট তৈরি করেন। মডার্ন রিভিউর প্রতি সংখ্যায় ফিজি নিয়ে তাঁর লেখা বেরোতে থাকে। চেমসফোর্ডের ব্যক্তিগত সচিবের কাছে তিনি ফিজির ভারতীয়দের রোগ, আত্মহত্যা ও অন্যান্য পরিসংখ্যানসহ চিঠি লিখতে থাকেন। মদনমোহন মালব্যকে লেজিসলেটিভ্‌ কাউন্সিলে চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা রদ করার প্রস্তাব আনার অনুরোধ করেন। মদনমোহন মালব্য প্রস্তাবটি আনেন। সরকার প্রস্তাব মেনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে রাজি হন। এইভাবে চুক্তিবদ্ধ শ্রমপ্রথা অ্যান্ড্‌রুজের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় শেষ হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি শেষবার ফিজি যান। বিগত দিনের কুলিরা তখন ভাড়াটে চাষি। শিক্ষার তেমন অগ্রগতি হয়নি। অ্যান্ড্‌রুজ স্ত্রীশিক্ষা ও বিবাহের বয়স বাড়াবার উপর জোর দেন। ফিজি নিয়ে একটি বই লেখেন ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’। ব্রিটিশ গায়নাতেও তিনি কাজ করেছেন। বহু বছর পর অমিয় চক্রবর্তী ফিজিতে গিয়ে দেখেছিলেন শ্রমজীবী পরিবারগুলি তখনো সেই শ্বেতাঙ্গের কথা মনে রেখেছে—যিনি ভারতীয়দের মতো পোশাক পরতেন, তাদের খাবার খেতেন, সমব্যথীর মতো মিশতেন।

    বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে অ্যান্ড্‌রুজের লড়াই ছিল আজীবন। যেকোনোরকম জাতিভেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। সেক্ষেত্রে ভারতীয় ও আফ্রিকার নিগ্রোর মধ্যে পার্থক্য করতে স্বভাবতই তিনি রাজি ছিলেন না। ফলে আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গরা তাঁর উদ্দেশ্যে নানা বিষোদ্‌গার করত। তাঁকে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত বলে প্রচার করত। কেনিয়া, উগান্ডা, জাঞ্জিবারে ভারতীয়দের বাস বহুকাল ধরে। উগান্ডার রেলপথও তৈরি করেছে ভারতীয় শ্রমিকরা। ইওরোপীয়রা কেনিয়ার উর্বর হাইল্যান্ড থেকে ভারতীয়দের উচ্ছেদ করতে চাইত। পূর্ব আফ্রিকার প্রতিটি প্রদেশে গিয়ে অ্যান্ড্‌রুজ তথ্যসংগ্রহ করে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে অপপ্রচারকে প্রতিহত করেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্য করেন ধনী ভারতীয়রা নিজেদের মুনাফা অর্জনেই ব্যস্ত, স্থানীয় কালো মানুষের জীবন ও লড়াই বিষয়ে আগ্রহহীন। এটি তাঁকে খুব দুঃখ দেয়। অ্যান্ড্‌রুজ ভারতীয়দের শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠ না করে প্রকৃত ধার্মিক জীবন দ্বারা অনুপ্রাণিত হবার জন্য বলেছেন। কেনিয়ার প্রশাসন ইওরোপীয়, এশীয় ও আফ্রিকানদের জন্য আলাদা আলাদা বাসক্ষেত্র ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্ধারণ করতে চাইছিল। অ্যান্ড্‌রুজ এই খবর পেয়ে ১৯২০ অক্টোবরে আবার পূর্ব-আফ্রিকায় যান। এবার তিনি নাইরোবি থেকে উগান্ডা যাবার সময় ট্রেনে একদল ইংরেজের দ্বারা আক্রান্ত হলেন। গুরুতর আহত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। যদিও প্রকৃত খ্রীস্টানের মতো অ্যান্ড্‌রুজ তাঁর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেননি। ১৯২৩ সালে ঐ পৃথকীকরণের বিরুদ্ধে বলতে তিনি ভারত থেকে লন্ডন যান। তাঁকে ব্রিটিশ সরকার একটি চিঠি ধরায় তাতে ছিল কেনিয়ার মোম্বাসায় যেন তিনি না নামেন, খবর আছে শ্বেতাঙ্গরা তাঁর উপর আঘাত হানার চক্রান্ত করেছে। জাহাজে ইওরোপীয় যাত্রীরা তাঁকে প্রায় একঘরে করে রেখেছিল। একদিকে নিজের জাতের লোকের বিদ্বেষ, অন্য দিকে অর্থসংগ্রহে বিবেকহীন কেনিয়ার এক শ্রেণীর ভারতীয়ের কাছে তিনি অপ্রিয় হলেন কারণ তিনি বলতে দ্বিধা করেননি যে ভারতীয়রাও ব্যবসা ও টাকা ধার দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের শোষণ করছে। এই স্পষ্ট উক্তির জন্য তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলা হল এবং নাইরোবির ভারতীয়দের পত্রিকা ডেমোক্র্যাট-এ লেখা হয়, ‘আমাদের আর এক ধরনের শত্রু আছে, যারা প্রতারক, মাথা নোয়ানো, সাদা চামড়ার খালি পা সাধু, যারা আমাদের পক্ষ নেয় আমাদের হারাবার জন্য।’ এই অপবাদে অ্যান্ড্‌রুজ মর্মাহত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন পৃথিবীর কোনো স্থানে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো অবাধ বর্ণবিদ্বেষ নেই। সেই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বিবাদ, উপনিবেশে জন্মগ্রহণ করা ভারতীয় ও চাষে যুক্ত ভারত থেকে আসা শ্রমিকদের কলহও কম নয়।

    ১৯২৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে বসন্ত মহামারী দেখা দেওয়ায় অ্যান্ড্‌রুজকে আমরা দেখানে শুশ্রুষাকর্মে ব্যস্ত দেখি। ১৯২৭ সালে কেপটাউন চুক্তিতে ভারতীয়দের দক্ষিণ আফ্রিকায় শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা হয়। অভিনন্দনের উত্তরে অ্যান্ড্‌রুজ খুব জরুরি কথা বলেছিলেন, ভারতীয়দের উপার্জনের অর্থ আফ্রিকাতেই ব্যয় হওয়া উচিত এবং দেশাত্মবোধের মন নিয়ে তাদের আফ্রিকাকে ভালোবাসা উচিত। অবশ্য দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকার ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এই সৎ পরামর্শের মূল্য দেয়নি। স্থানীয় মানুষের থেকে বরাবর বিচ্ছিন্ন থেকেছে। জাঞ্জিবারে ভারতীয়দের বসবাসের সমসায় নিয়েও অ্যান্ড্‌রুজ কাজ করেন। তাঁদের জমির অধিকার ও লবঙ্গর ব্যবসার অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করছিল শ্বেতাঙ্গরা।


    ৩.

    ভারতে ড্রাগের নেশা নিয়ে অ্যান্ড্‌রুজ অসাধারণ কাজ করেছিলেন। আফিমের নেশা কীভাবে ছড়িয়েছে এবং তা কীভাবে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করছে তা তিনি তুলে ধরেন। বিস্তারিত ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে তিনি ১৯২০–২৬ পর্যন্ত সমানে পত্রিকায় লিখে গেছেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল ব্রিটিশ সরকারের আফিম নীতিই ভারতীয়দের নেশাগ্রস্ত করছে। আবগারি শুল্কে লাভ বাড়ানোর জন্য আফিমের ব্যবসাতে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। তিনি দেখিয়েছেন বম্বের মিলের শ্রমিক বাবা-মা সন্তানদের আফিম খাইয়ে ঘরে রেখে কাজে চলে যায়। আসামে চা বাগানের মালিকরা বাগানের শ্রমিকদের ধরে রাখার জন্য আফিমের দোকান খুলেছিল। জাতিসংঘ যেখানে প্রতি দশ হাজার মানুষের জন্য ১২ পাউন্ড আফিম সেবন স্বাভাবিক বলে সুপারিশ করেছে সেখানে ভারতের প্রধান শহরগুলিতে তা বিপদজনক অবস্থায় পৌঁছেছিল। কলকাতা – ২৮৮ পাউন্ড, লাহোর, অমৃতসর, লুধিয়ানা, ফিরোজপুরে ১০০ পাউন্ড, বম্বে, সুরাট, আহমেদাবাদ ও ব্রোচে ৮৮ পাউন্ড, করাচি ৯৫ পাউন্ড, মাদ্রাজ ৫২ পাউন্ড ও কানপুরে ৫৬ পাউন্ড। সুতোকলে যে মায়েরা দীর্ঘসময় কাজ করত তারা শিশুসন্তানদের আফিম খাইয়ে যেত। বম্বের বস্তিতে অ্যান্ড্‌রুজ আফিম খাওয়া শিশুদের দেখেছেন, ক্লান্ত, নির্জীব, হঠাৎ বুড়ো হয়ে যাওয়া মানুষের মতো। ১৯২৬-এ অ্যান্ড্‌রুজ Opium Evil in India নামে একটি বইও লেখেন। তাঁর উদ্যমেই কংগ্রেস আফিমবিরোধী আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। ক্রমাগত আন্দোলনের ফলে ভারতে আফিমের নেশা কমতে থাকে।

    ভারতের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনেও তাঁর দান উল্লেখযোগ্য। ১৯২০ সালে মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন গড়ার সময় থেকে তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হন। মিলমালিকরা ইউনিয়ন ভেঙে দেবার জন্য লকআউট ঘোষণা করে। অ্যান্ড্‌রুজ ইউনিয়নের স্বীকৃতির জন্য কাজে ঝাঁপ দেন। রেলের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরাও যখন আন্দোলন করে অচল অবস্থায় পড়েছে তাঁকে মধ্যস্থতা করতে ডেকেছে। তবে অ্যান্ড্‌রুজ কঠোরভাবে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে থাকতেন। রেলের নানা ধর্মঘটে তিনি সমাধানসূত্র বার করেছেন। জামশেদপুর স্টিল ফ্যাক্টরির ধর্মঘটে এবং ট্রেড-ইউনিয়নের স্বীকৃতিতে তাঁর ভূমিকা ছিল। তিনি ঐ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতিও ছিলেন। পরে ব্যস্ততার কারণে অ্যান্ড্‌রুজ ঐ পদ ত্যাগ করলে সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র বসু। শ্রমিক নেতা মণি ঘোষ লিখেছেন পরেও যখন অ্যান্ড্‌রুজ জামশেদপুরে যেতেন, অ্যাসোসিয়েশনের অফিস ঘরেই থাকতেন, দড়ির খাটিয়ায় শুতেন, কোনো শ্রমিকের বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন, বড়ো মিটিং-এ বক্তব্য শোনার সময় অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে মাটিতে বসতেন। ১৯২৫ সালে বোম্বাইতে ও ১৯২৭ সালে কানপুরে অ্যান্ড্‌রুজ সারা ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯২৬ সালেও তাঁর প্রেসিডেন্ট হবার কথা ছিল, তখন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকায় ভি. ভি. গিরি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন।

    অ্যান্ড্‌রুজ যে সময় শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ান তখন শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার আইন ছিল না। পুলিশ ও সরকার মালিক-পরিচালকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তৈরি থাকত। মার্জোরি সাইকস লিখেছেন যে কী নিখুঁতভাবে অ্যান্ড্‌রুজ তথ্যসংগ্রহ করতেন, যাচাই করতেন, যুক্তিসমূহ স্বচ্ছ ও সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপিত করতেন। পরে যখনই তিনি চতুর ব্যবসায়ী অথবা কপট অফিসারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক বা রেলকর্মীদের হয়ে কথা বলেছেন তখন তাঁর আঙুলের ডগায় সব তথ্য থেকেছে। তাঁর জবাবের প্রত্যুত্তর দেওয়া সুকঠিন হত, যদিও সহজাত বিনয় তিনি কখনো হারাতেন না।

    গান্ধীজির কাজ ও আন্দোলনে তিনি কীভাবে জড়িয়েছিলেন, কীভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তা বহু আলোচিত। কিন্তু গান্ধীজির সব মত তিনি মোটেই সমর্থন করতেন না। ১৯১৮ সালে দিল্লির ইম্পিরিয়াল ওয়ার কনফারেন্সে যোগ দিয়ে গান্ধীজি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য লোকসংগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। অ্যান্ড্‌রুজ তাঁর অহিংসার বাণীর সঙ্গে একে মেলাতে পারেননি। তা বলতে দ্বিধাও করেননি। খিলাফৎ বা অটোমান তুরস্কের সাম্রাজ্য অটুট রাখার ডাকেও যোগ দিতে পারেননি। বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোও সমর্থন করেননি। গান্ধীজির শপথ নেওয়ার অভ্যাসও তিনি অনুমোদন করেননি। অ্যান্ড্‌রুজ বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস রামের গল্প, যে কোনো মূল্যে প্রতিজ্ঞারক্ষার উপর অতিমাত্রায় জোর দিয়ে ভারতে অনেক ক্ষতি করেছে।’ কিন্তু মতপার্থক্য সত্ত্বেও গান্ধীজি ও অ্যান্ড্‌রুজ ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একে অপরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। কলকাতার অ্যান্ড্‌রুজের শেষ শয্যায় দুই বন্ধুর কথোপকথন আমাদের চোখে জল এনে দেয়। দুই বন্ধু মুখোমুখি হলেন —

    ‘মোহন, স্বরাজ আসছে। আমি দেখতে পাচ্ছি — আসছে। ভারত স্বাধীন হবে।’

    গান্ধীজি উত্তর দিলেন, ‘আমি জানি।’ নিঃশব্দে চার্লির মোহন সম্বলহীন এই সন্ন্যাসীর হাসপাতালের ও অন্যান্য খরচ মেটাবার ব্যবস্থা করেন।


    ৪.

    অ্যান্ড্‌রুজের তুমুল কর্মময় জীবনের পাশে উইলিয়ম উইনস্ট্যানলি পিয়র্সনকে (জন্ম ১৮৮১) হয়তো স্বল্পায়ু এক মানবপ্রেমিকরূপেই অনেকে চিহ্নিত করবেন। শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণের অঙ্গনে পিয়র্সন একটি বিদেশি গাছের চারা রোপণ করেন। তার বিদেশি নাম ‘পেট্রিয়া’, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ‘নীলমণিলতা’। এই নামে ‘বনবাণী’ কাব্যগ্রন্থের এই নামের কবিতাটি খুবই বিখ্যাত। ‘পিয়র্সন পল্লী’ বা ‘পিয়র্সন মেমোরিয়াল হাসপাতাল’-এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। পিয়র্সনের জীবনীকার প্রণতি মুখোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থসূচনায় মূল্যবান একটি আলোকপাত করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে খুব বড়ো কোনো কাজ করেননি পিয়র্সন। যুদ্ধ করেননি, বড়ো কারখানা গড়েননি, মিশনারির কাজও তাঁর ধাতে সয়নি। শান্তিনিকেতন ও কাছের গ্রামের সাঁওতাল শিশুদের নিয়ে কালক্ষেপণেই ছিল তাঁর আনন্দও। তবু এই মানুষ সম্বন্ধেই রমাঁ রলাঁ আশ্চর্য প্রশ্ন তুলেছিলেন, যাঁরা বীর, সাধুত্বের সাধনায় সিদ্ধ, যাঁরা জগৎকে আলোকিত করেন, তাঁদের অনেক সময় চিনতে আমাদের ভুল হয়। আমাদের ছোটো ছোটো মনের অক্ষমতার ঢাকাটি মৃত্যু যখন এসে দূরে সরিয়ে দেয় তখন আমরা অনেকসময় অনুভব করি যে সেই মৃত বীর এবং সাধকরা আমাদের জীবন ফুলের সুবাসে ভরিয়ে রেখেছেন। খ্রীস্টান জগতে ক্যাথলিক চার্চ নিজের সীমানার মধ্যে প্রয়াত মহাত্মাদের কারুকে কারুকে সন্ত বা সেন্ট বলে সম্মানিত করে। অ্যান্ড্‌রুজ ও পিয়র্সনের নীরব আত্মনিবেদনের কঠিন শক্তিকে সম্মান জানিয়ে রলাঁ প্রশ্ন করেছিলেন যে এঁদের জন্য সন্তত্বের দাবি জানাবে কে?

    পিয়র্সনের বাবা ধর্মযাজক, আদর্শবাদী। মা কোয়েকার পরিবারের মেয়ে। ছেলেমেয়েদের মনোগঠনে তাঁর গভীর প্রভাব ছিল। মেধাবী ছাত্র পিয়র্সন বিজ্ঞান পড়েছেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারত তাঁকেও ডেকে নিয়েছিল। ১৯০৭ সালে পিয়র্সন কলকাতার ভবানীপুরে লন্ডন মিশন সোসাইটির কলেজে বটানি বিভাগে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। বাংলা শিখতেও শুরু করেন। তবে মিশনের গোঁড়ামি ও ক্ষুদ্রতা তাঁকে বিরূপ করে তোলে। গরম দেশের আবহাওয়াও বারবার তাঁকে অসুস্থ করত। দেশে ফিরে যাবার পর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়ের দিনটি ছিল ১৯ জুন ১৯১২। পিয়র্সন তখন ইংল্যান্ডে। হ্যাম্পস্টেড্‌ হীথে তাঁর আমন্ত্রণেই তাঁর বাড়িতে একটি ছোটো সভা হয়, বাংলা সাহিত্য বিষয়ে নিবন্ধ পাঠ করেন বিলেতপ্রবাসী ছাত্র সুকুমার রায়। সেইদিন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পিয়র্সন নীচু হয়ে তাঁর পায়ের ধুলো নেন। অ্যান্ড্‌রুজ ও পিয়র্সন দুজনেই বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং রবীন্দ্রনাথ দেশে ফেরার আগেই তাঁরা ভারতে আসেন।

    দিল্লিতে লালা সুলতান সিংহের ছেলে রঘুবীরের গৃহ-শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন পিয়র্সন। ডিসেম্বরে এলেন বোলপুরে, যা পরে হবে তাঁর আশ্রয় ও কর্মক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ তখনো ফেরেননি কিন্তু অভ্যর্থনার অভাব হয়নি। আশ্রমবাসীদের সঙ্গে মিশে, মন্দিরে উপাসনা দেখে, পারুলবনে বেড়িয়ে আশ্রমের পরিবেশ ও রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তিনি মুগ্ধ হন। এই সময়েই তাঁকে চিঠি লেখেন ‘My dear Guru’ সম্বোধন করে। তাঁর মুখে বর্ণনা শুনে অ্যান্ড্‌রুজও শান্তিনিকেতনে যাবার জন্য উৎসুক হন। আশ্রমের কাজে বিনম্রভাবে যোগ দিতে চান পিয়র্সন, রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সাদরে গ্রহণ করেন। তবে তখনই কাজে যোগ দিতে পারেননি কারণ অ্যান্ড্‌রুজের সঙ্গে তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে হয়। শ্রমজীবীদের মধ্যে কাজ করার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল পিয়র্সনের। কলকাতায় থাকার সময় ব্রাহ্মনেতা শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। নাটালে তিনি চিনির কলগুলিতে ভারতীয় শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ডারবানে কোর্টে গিয়ে তিনি মামলার শুনানি শুনতেন, তাতে ভারতীয় শ্রমিকদের অপমান, দুর্দশা ও দৈহিক নির্যাতনের বহু ঘটনা তিনি জানতে পারেন। অত্যাচারিত কালো মানুষ ও ভারতীয়দের হাতের তৈরি নানা জিনিস তাঁরা দুই বন্ধু আগ্রহভরে সংগ্রহ করেন। তাঁদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন তাঁরা। পিয়র্সন তাঁর বক্তৃতায় জানিয়েছেন কীভাবে ইংরেজরা এঁদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়।

    ভারতে ফিরে পিয়র্সন যোগ দিলেন আশ্রমের কাজে। ছোটোদের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে তাঁর দেরি হত না। মন খুলে মিশতেন, তাদের নিয়ে বেড়াতে যেতেন। তাঁর অকালমৃত্যুর পর স্মৃতিচারণে অ্যান্ড্রুজ জানিয়েছিলেন, ‘In India, where racial feelings have grown strong of late, no one ever thought of him as a foreigner or an intruder. He was made a welcome member of every family where he stayed; and it was always his greatest wish and happiness to dwell in Indian homes. In every possible way he would conform to their manners and dress and custom.

    শান্তিনিকেতনের চারপাশের গ্রামে যে সব সাঁওতাল বাস করেন তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়বৎ সম্পর্ক ছিল তাঁর। আশ্রমের ছেলেদের নিয়ে তিনি ঐসব গ্রামে যেতেন। নিজের খরচে একটি স্কুল চালাতেন তাদের জন্য। আশ্রমের কর্মী ও ছাত্ররাও সাঁওতালদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় চালাত ভুবনডাঙা ও সুরুল গ্রামে। পিয়র্সনের চিঠিপত্রে সাঁওতাল বালকদের উল্লেখ আছে। তাদের লেখাপড়া ও হাতের কাজ শেখানোর উৎসাহ ছিল তাঁর। বিলেতে গিয়েও নিজের ও রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে সাঁওতাল ছেলেদের ভোজ খাওয়াবার টাকা পাঠিয়েছেন। এল্‌মহার্স্ট শ্রীনিকেতন ডায়ারিতে আতাবুদ্দি নামে একজন গ্রামবাসীর কথা লিখেছেন। আতাবুদ্দি যখন শুনলেন এল্‌মহার্স্ট পিয়র্সনের সঙ্গে এক জাহাজে এসেছেন, তাঁর মূল্যই বেড়ে গেল। কারণ পিয়র্সন সাহেবের মতো মানুষ হয় না। সাঁওতাল গ্রামে কুয়ো খোঁড়ানোর ব্যাপারে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডকে রাজি করানো, কিংবা গাছ পোঁতায় পিয়র্সনের উদ্যোগ ছিল স্মরণীয়।

    ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ব্যাপারে দুটি বালক যাদব আর জিতেনের কথা মনে পড়ে। মাত্র এগারো বছর বয়সে কঠিন রোগে ভুগে আশ্রম বিদ্যালয়ের বালক ছাত্র যাদবের মৃত্যু হয়। পিয়র্সনের গভীর স্নেহ ছিল তার প্রতি। তাঁর নেচার স্টাডি ক্লাসে যাদবের উৎসাহ ছিল দেখবার মতো। ১৯১৬ সালে প্রকাশিত পিয়র্সনের ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে অক্ষয় হয়ে রয়েছে বিদেশি শিক্ষকের স্নেহার্ত বিচ্ছেদ বেদনা — ‘To Jadav’। জিতেন নামে একটি ছেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে বাড়ি গেছে। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পিয়র্সন তাঁর মায়ের কাছে এক গোছা টেলিগ্রাম ফর্ম পাঠিয়ে দিয়েছেন, ফর্মে ডাকটিকিট লাগানো, ঠিকানা লেখা, ‘পিয়র্সন, শান্তিনিকেতন।’ অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন মা যেন রোজ ছেলেটি কেমন আছে জানিয়ে টেলিগ্রাম করেন। জিতেন ফিরে আসার পর তাকে নিজের বাড়িতে সতর্ক নজরদারিতে রেখেছেন। প্রতিদানে আশ্রমের ছেলেরাও উজাড় করে দিয়েছে ভালোবাসা। পিয়র্সনের বাংলা তারা করে নিয়েছিল ‘প্রিয় সেন’। সবার হৃদয় জয় করার সহজ ক্ষমতা ছিল তাঁর। আশ্রমে ‘দ্বারিক’ নামে বাড়িটি নির্মাণে তিনি অংশত ব্যয় বহন করেছেন। এটি ছিল তাঁর প্রিয় আশ্রয়।

    ফিজির শ্রমিকদের চুক্তিবদ্ধ করে চালানের শোষণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করার জন্য অ্যান্ড্‌রুজের সঙ্গী হলেন পিয়র্সন। জাহাজে আপন দেশের লোকেদের মধ্যে নিজেদের পরবাসী পরদেশী মনে হচ্ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেছেন,

    ‘আমরা এত বাঙ্গালী হইয়া গিয়াছি যে নিজের দেশের লোক আমাদের বুঝিতে পারে না। এর মানে কি? বিদেশের জন্য খুব ভালোবাসা থাকলে থাকলে স্বদেশ আমার কাছ হইতে কি দূরে যাইবে? ঠিক সেই রকম বোধ হচ্ছে। ঠিক যেমন একজন বাঙ্গালী এই সকল ইংরাজীদের মধ্যে খুব একলা অনুভব করিতেন, তেমনি আমি একাকী অনুভব করি। যা হোক এইটি ভালো, কেননা এইটি একটা প্রমাণ আছে যে আমি বাঙ্গালা দেশকে এত ভালোবাসি যে, বাঙ্গালা আমার জন্মদেশের মতো।

    ‘এমন দেশটি কোথায় খুঁজে পাবে নাকো তুমি
    সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’

    সিডনি, মেলবোর্ন, ফিজিতে সব স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন তাঁরা। কুলি ব্যারাকের চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর পঙ্কিল পরিবেশ দেখেছেন। পাঁচ সপ্তাহ ধরে রিপোর্ট তৈরি হল। আমাদের মনে পড়ে ১৯২৩ সালে ‘রক্তকরবী’ নাটকে শ্রমশক্তি শুষে নিয়ে মানুষকে ছিবড়ে করে দেওয়ার বীভৎস কায়দাকানুনের কথা লিখবেন রবীন্দ্রনাথ। মহারাষ্ট্র ও গুজরাটের কাপড়ের কারখানার শ্রমিকদের দুর্দশার কথা তিনি জেনেছিলেন। তাছাড়া অ্যান্ড্‌রুজ ও পিয়র্সনের কাছে ফিজির শ্রমিকদের কথাও তো জেনেছিলেন। এই সব অভিজ্ঞতাই সক্রিয় থাকতে পারে রক্তকরবীর মর্মবস্তু নির্মাণে।

    শান্তিনিকেতনে বিভিন্ন নাটকে যোগ দিয়েছেন পিয়র্সন, অচলায়তন বা ফাল্গুনীতে। রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত আস্থাভাজন সহকারী হয়ে উঠেছিলেন তিনি জাপান ও আমেরিকা ভ্রমণে। আমেরিকাতে পিয়র্সন শান্তিনিকেতনে হাসপাতালের জন্য অর্থসংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগকে সম্মান দিয়ে হাসপাতালটি পিয়র্সনের নামে চিহ্নিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘চেলা’ বলে নিজেকে পরিচিত করতেন পিয়র্সন তবে অরবিন্দের প্রভাবও তাঁর উপর ছিল। জাপানে পল রিশার ও মীরা রিশার (পরে পন্ডিচেরির শ্রীমা)-এর সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। পরে পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সম্ভবত পল রিশারের প্রভাবেই পিয়র্সন For India (১৯৯৭) বইটি লেখেন। রিশার বইটির ভূমিকা লিখেছিলেন। আটটি প্রবন্ধে পিয়র্সন ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ভারতের তৎকালীন দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে হোমরুলের দাবির যথার্থতা তুলে ধরেছিলেন। দেখিয়েছিলেন গাল-ভরা প্রতিশ্রুতির তলায় ভারতকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসন। দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি বিপর্যয়ে গণমৃত্যু রোধের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। স্বভাবতই এই বই প্রকাশের পর চুপ করে থাকেনি ব্রিটিশ সরকার। বইটি ভারতে নিষিদ্ধ হল। পিয়র্সনের রাজদ্রোহী চরিত্র সম্পর্কে লম্বা রিপোর্ট তৈরি হল। পিকিঙে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, কোথাও নামতে না দিয়ে পাঠানো হল দেশে। জাহাজে তাঁর সহযাত্রীরাও রাজবন্দীর সংসর্গ এড়িয়ে চলতেন। অ্যান্ড্‌রুজ ও রবীন্দ্রনাথ তাঁর শাস্তি মকুবের চেষ্টা যথেষ্ট করেছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। কারাগারে রাখা হয়নি তাঁকে, তবে ম্যাঞ্চেস্টারে ব্রাইটন পার্কের বাড়িতে তাঁকে অন্তরীণ করে রাখা হয়। এরপর তাঁকে যুদ্ধে যোগ দিতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। পিয়র্সনের ট্রেনিং হয় অ্যাম্বুল্যান্স আর হাসপাতালের কাজে। তিনি এই ট্রেনিং নেবার সময় ভেবেছেন ফিরে এসে শান্তিনিকেতনে শুশ্রুষার কাজ ভালোভাবে শেখাতে পারবেন। রবীন্দ্রনাথকে আইরিশ চিন্তাবিদ জর্জ উইলিয়ম রাসেল বা A E-র বইপত্র পাঠিয়েছেন তিনি।

    শাস্তিপর্ব মিটলে, যুদ্ধ শেষে নানা কাজে কবির সঙ্গী হয়েছেন পিয়র্সন। রবীন্দ্রনাথ আয়ার্ল্যান্ডে সমবায় আন্দোলনের ব্যাপারে স্যার হোরেস প্ল্যাঙ্কেটের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সঙ্গী হয়েছেন পিয়র্সন ও রথীন্দ্রনাথ। কবির আমেরিকা সফরে পিয়র্সন সেক্রেটারির কাজ করেছেন। তারপর আমেরিকাতেই আবার যোগ দিয়েছেন অপরাধী বালকদের সংশোধনের প্রতিষ্ঠান স্টার কমনওয়েলথে। আসলে ছোটোদের সঙ্গ তাঁকে চিরকাল টানত। তাদের জন্য তিনি কাজ করতে চাইতেন।

    ১৯২১ সালে পাঁচ বছর পর পিয়র্সন ফিরেছেন শান্তিনিকেতনে। এই সময় উত্তরবঙ্গে বন্যাপীড়িতদের কাজে তাঁকে যেতে দেখি। এই সময় সম্ভবত পন্ডিচেরিও গিয়েছিলেন। মনে পড়ে যায় আশ্রমের গোড়ার দিকের ছাত্র প্রমথনাথ বিশীর মন্তব্য: ‘মিস্টার এন্ড্রুজকে আমরা ভক্তি করিতাম, আর মিস্টার পিয়র্সনকে আমরা ভালোবাসিতাম।’

    ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৩, বন্ধু বেটম্যানের সঙ্গে ট্রেনে মিলান থেকে ফ্লোরেন্স যাচ্ছিলেন পিয়র্সন। ঝুঁকে বাইরে দেখতে গিয়ে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। কামরার দরজার ছিটকিনি ঠিকভাবে আটকানো ছিল না। পিয়র্সন ট্রেন থেকে নীচে পড়ে গেলেন। বেটম্যান ইতালিয় ভাষা না জানাতে সহযাত্রীদের বোঝাতে পারেননি কী ঘটেছে। অ্যালার্ম সিগন্যালও বুঝতে পারেননি। কয়েকজন শ্রমিক অচৈতন্য পিয়র্সনকে কোনমতে করসিনির কাছে এক অভিজাত ব্যক্তির ভিলায় তুলে আনেন। পরে নিয়ে যাওয়া হয় পিসতোয়িয়া হাসপাতালে। মেরুদণ্ডে আঘাত, শরীরের নিম্নাংশ অসাড়। ক্লোরোফর্ম করা যায়নি তাঁকে। আশ্চর্য সাহসে পিয়র্সন অপারেশনের যন্ত্রণা সহ্য করেন। ইংরেজ নার্স ছিলেন শুশ্রুষায়। মৃত্যুর আগের রাতে তিনি শোনেন আচ্ছন্ন অবস্থায় পিয়র্সন বলছেন, ‘My one and only love — India.’

    অনন্য এই দুই ভারতবন্ধুর স্মৃতির প্রতি প্রণতি জানিয়ে আমার এই অকিঞ্চিৎকর লেখা এখানে শেষ করলাম।

    [২০২৪ কলকাতা বইমেলায় ‘জিজ্ঞাসা’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে পঠিত]

    তথ্যসূত্র:

    . চার্লস ফ্রিয়ার এন্ডরুজ : ভারতে ঈশ্বর প্রেরিত ঈশ্বরতুল্য মানুষ; (সুশান্ত নাগ, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিট্যুট ২০২৩)

    . উইলিয়াম উইনস্টানলি পিয়র্সন; (প্রণতি মুখোপাধ্যায়, টেগোর রিসার্চ ইনস্টিট্যুট ১৯৮৪)

    . Centenary Volume. C. F. Andrews 1871&endash;1971, Published by Ananda Gopal Sengupta; Deenabandhu Andrews Centenary Committee 1972



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments