কল্হন তাঁর ইতিহাস-কাব্য রাজতরঙ্গিণীতে কাশ্মীরের তৎকালীন সমাজের যে পরিচয় তুলে ধরেছেন, সেটাকে এক মিশ্র সমাজ বলা চলে। কাশ্মীরের নিজস্ব নীলমত পুরাণে এবং কল্হনের কাব্যে উল্লেখ রয়েছে যে সুপ্রাচীন কালে নাগবংশীয়েরা সেখানে বসতিস্থাপন করেছিল। পর্বতবেষ্টনীর মধ্যের উপত্যকায় বিশাল জলা ছিল, তারপর ঋষি কশ্যপের উদ্যোগে জলাভূমি থেকে জল নিষ্কাষিত করে যখন কৃষিজমি বের হয়, তখন সেখানে জমি আবাদ করার জন্য আর্যাবর্ত থেকে চতুর্বর্ণের মানুষকে এনে বসতি স্থাপন করানো হয়েছিল। আবার উত্তরদিক থেকে যাযাবর জাতিরাও এখানে ফিবছর শীতে ছ’মাসের জন্য বাস করতে আসত। নাগবংশীয়রা বহিরাগতদের বসবাসের ব্যাপারে আপত্তি করলেও কশ্যপের আদেশে তাদের সকলের সঙ্গে সহযোগিতা করে থাকতে বাধ্য করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কখনও আক্রমণকারী রূপে, কখনো বা ধর্মের টানে মানুষের আগমন হত, এবং রাজারা নিজেদের উদ্যোগে দক্ষিণের সমতল থেকে কর্মদক্ষ এবং পণ্ডিত ব্যক্তিদের এখানে নিয়ে আসতেন। কাশ্মীরে জনবসতি এইভাবে শুরু হয়েছিল এবং এই ভূখণ্ডের জনমানসে ভারতীয় সংস্কৃতির গভীর প্রভাব থাকলেও তার আপন সংস্কৃতির নিজস্বতা অনেকটা অক্ষুণ্ণ ছিল। ভারতীয় হিন্দুসমাজের বহুনিন্দিত জাতিপ্রথার কঠোরতা এখানে বেশ কম ছিল, বরং কিছুটা উদারই বলা যায় ।
অমাত্যপরিবারে জন্ম এবং মানুষ হওয়া কল্হন রাজনীতিকে খুব কাছে থেকে দেখেছিলেন। তিনি নিজে রাজকার্যে অংশ নেননি সম্ভবত, তেমন কোনো উল্লেখ আমরা পাই না। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ঐতিহাসিকের মত অপক্ষপাত, শুধু রাজা ও রাজপুরুষদেরই নয়, অন্যান্য বর্গের মানুষেরও দোষগুণ ত্রুটিবিচ্যুতি আচারব্যবহার তাঁর চোখ এড়ায়নি। তিনি তাঁর রাজাদের সমালোচনা করতে যেমন ইতস্তত করেননি, তেমনি যাঁরা সুশাসক ছিলেন, তাঁদের গুণগান করতেও কার্পণ্য করেননি। কখনো ক্রুদ্ধস্বরে, কখনো হতাশায়, কখনো বা সকৌতুক কটাক্ষে তিনি রাজা থেকে প্রজার দোষগুণের আলোচনা করেছেন, তাদের চরিত্রকে পাঠকের সামনে উন্মোচিত করেছেন।
রাজা তথা শাসকশ্রেণী
সেকালের আরো সব রাজ্যের মত কাশ্মীর রাজ্যেরও শাসক ছিলেন রাজা এবং রাজ্যের সর্বপ্রধান ব্যক্তি। রাজতরঙ্গিণীতে বলা হয়েছে যে প্রথমদিকে দেশে (সম্পদের) ব্যবহার ও ধনাদির উন্নতির অভাবে অন্যান্য দেশের ন্যায় শাসনপ্রণালী প্রচলিত ছিল—
যথাবদ্বৃদ্ধিমপ্রাপ্তে ব্যবহারধনাদিভিঃ।
সামান্যদেশবদ্রাজ্যং তাবদস্মিন্ হি মণ্ডলে।। ১১৮, ১ম তরঙ্গ
তখন শাসনকার্যের জন্য সাতটি কর্মস্থানে (office) সাতজন রাজকীয় পুরুষ ছিলেন, ধর্মাধ্যক্ষ, ধনাধ্যক্ষ, কোষাধ্যক্ষ, সেনাপতি, দূত, পুরোহিত ও দৈবজ্ঞ। প্রথম গোনন্দবংশীয় রাজা জলৌক এই ব্যবস্থার সংস্কার করেন, তিনি পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরের শাসনপ্রথা অনুসারে প্রতি কর্মস্থান অষ্টাদশভাগে বিভক্ত করে শাসনকার্যকে সুগম করেন। লক্ষণীয় যে কল্হন কাশ্মীরে ‘যৌধিষ্ঠিরী’ শাসনের কথা বলেছেন, রামরাজ্যের কথা নয়! তবে এই অষ্টাদশ ভাগ কী কী ছিল তা কিন্তু বলা হয়নি। পরবর্তী কালের অনেক রাজাই নিজেদের সময়ে প্রয়োজনে নূতন কর্মস্থান ও আধিকারিক নিযুক্ত করেছেন।
প্রাচীন ভারতে রাজারা মুখ্যত ক্ষত্রিয়বর্ণের হতেন, যেমন আমরা মহাকাব্যগুলোতে দেখি। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং শূদ্র রাজাও পরবর্তীকালে কখনোসখনো দেখা গিয়েছে। রাজতরঙ্গিণীর রাজাদের মধ্যে প্রথম রাজা গোনন্দকে সুক্ষত্রিয় বলা হয়েছে, এরপর কোনো রাজাকে সু বা কু, কোনো ক্ষত্রিয় বলেই বিশেষিত করা হয়নি। মহাকাব্যগুলো যেমন নানা কথায় ক্ষত্রিয়ের গৌরব গেয়েছে, রাজতরঙ্গিণীতে তা নেই। প্রথম গোনন্দ বংশের পর দ্বিতীয় গোনন্দ বংশের রাজত্বকালে কিছুকাল বহিরাগত ‘তুরুষ্ক’ (কুষাণ)দের হাতে শাসনভার গিয়েছে, কখনো বা ভারতের ইতিহাসে যাদের ‘হুন’ বলা হয় তাদের হাতে গিয়েছে, যদিও কল্হনের কাব্যে এদের সবাই ‘তুরুষ্ক’। তুরুষ্কদের অনেকেই বৌদ্ধ ছিল, এবং সেই সময়কালে তাদের তেমন যুদ্ধবাজ বলে মনে হয় না। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে এদের দেশ হল আজকালকার তুর্কমেনিস্তান, যে দেশ রাজতরঙ্গিণীতে তুঃখার নামে অভিহিত।
গোনন্দ বংশের পর কার্কোটক রাজবংশ কাশ্মীরের সিংহাসনে বসে, তার প্রথম রাজা দুর্লভবর্ধন ছিলেন কায়স্থ অর্থাৎ নিম্নবর্গের রাজকর্মচারী, তাঁর পদ ছিল ‘অশ্বঘাসাধিকারী’, অর্থাৎ এই পদে কর্মরত ব্যক্তির কাজ ছিল রাজার আস্তাবলের ঘোড়ার ঘাস জোগানো। ইনি গোনন্দবংশের শেষ রাজা বালাদিত্যের জামাতা ছিলেন। তখনকার সময়ে কায়স্থ বলতে আজকালকার মত কোনো বিশেষ বর্ণকে বোঝাত না। দিবির, অর্থাৎ হিসাবরক্ষক, গঞ্জবর মানে কোষাধ্যক্ষ, দলিল ইত্যাদির লেখক, এবং কর আদায়কারী সব কর্মচারীদের কায়স্থ বলা হত। এই কায়স্থদের কেউ কেউ বর্ণগতভাবে ব্রাহ্মণ হওয়াও বিচিত্র ছিল না।
রাজার বংশধর না থাকলে অমাত্য ও অন্যান্য ক্ষমতাশালীরা, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাজার আত্মীয়দের থেকে কাউকে নিত অথবা অন্য কোনো জায়গা থেকে যোগ্য কাউকে নিয়ে এসে সিংহাসনে বসাত। অনেক সময়ই এই পছন্দ কার্যকর হত। অযোগ্য, অত্যাচারী, এমন কী অপছন্দ রাজাকে সময় ও সুযোগ বুঝে প্রজারা হত্যাও করত। কল্হন এরকম একাধিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। প্রথম তিনটি তরঙ্গে যে গোনন্দ বংশের কথা আছে, সেই বংশ ধারাবাহিক নয়, মাঝে মাঝে অন্য রাজাদের হাতেও শাসনভার গিয়েছে। এঁদের সকলের চরিত্র সম্পর্কে তেমন বিবরণ নেই।
গোনন্দ বংশের দ্বিতীয় দামোদর ব্রাহ্মণদের ষড়যন্ত্রে মারা গেলে ‘তুরুষ্ক’জাতীয় রাজা, যাঁদের আমরা কুষাণ বলে স্কুলের ইতিহাসে পড়েছি, সেই হুষ্ক(হুবিষ্ক), জুষ্ক, কনিষ্ক সিংহাসনে বসেছিলেন এবং সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মের নীতি অনুসারে কল্যাণকর কাজ করায় প্রজাদের সমর্থন পেয়েছিলেন, কারণ কল্হন তাঁদের প্রশংসা করে ‘পুণ্যাত্মা’ বলেছেন। দ্বিতীয় তরঙ্গে বলা হয়েছে, মন্ত্রীগণ দেশান্তর থেকে বিক্রমাদিত্যের (গুপ্তবংশীয় শকারি বিক্রমাদিত্য নয়) জ্ঞাতি প্রতাপাদিত্যকে আনিয়ে রাজা করেছিলেন।
তৃতীয় তরঙ্গের প্রথমেই যে রাজার সাক্ষাৎ আমরা পাই তিনি মেঘবাহন, তাঁকে মন্ত্রী ও প্রজারা গান্ধারদেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। এই তরঙ্গে আরেক রাজা মাতৃগুপ্তও বাইরের—রাজা তোরমান মারা যাবার পর সিংহাসনে বসবার উপযুক্ত কেউ ছিল না, তখন উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য মাতৃগুপ্তকে কাশ্মীরের রাজা করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যদিও মাতৃগুপ্ত নিজের বংশ প্রতিষ্ঠা করেননি, পূর্বতন রাজবংশের উত্তরাধিকারী প্রবরগুপ্ত ফিরে এলে তাকেই রাজ্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর পঞ্চম তরঙ্গে অবন্তিবর্মা রাজবংশের বাইরে থেকে রাজা হন এবং উৎপল বংশের প্রতিষ্ঠা করেন, তবে তাঁর পিতা ও পিতামহ রাজা না হলেও রাজাদেরই নিযুক্ত ও পরিচালনা করতেন। ষষ্ঠ তরঙ্গে আবার দেখা যায় বহিরাগত যশস্কর রাজা হচ্ছেন, ইনি মন্ত্রীপুত্র ও ব্রাহ্মণ হলেও নিজে নিপাট সাধারণ মানুষ ছিলেন, রাজসিংহাসনের ধারে-কাছে যেতেন না। এভাবে অমাত্য ও প্রজাদের ইচ্ছায় কাশ্মীরের সিংহাসনে বারবার রাজবংশের বাইরের লোক সিংহাসনে বসেছে।
প্রথম দিকে কয়েকজন রাজাকে পাই যারা প্রজার স্বার্থে জীবন পর্যন্ত দিতে রাজি – যেমন দ্বিতীয় তরঙ্গের তুঞ্জীন, তৃতীয় তরঙ্গের মেঘবাহন। কয়েকজন নির্লোভিতার দৃষ্টান্ত—যেমন মাতৃগুপ্ত, প্রবরসেন। কেউ কেউ আবার উৎপীড়ক, ইন্দ্রিয়পরায়ণ —যেমন মিহিরকুল, জয়েন্দ্র, প্রথম যুধিষ্ঠির।
রাজারা উৎখাত হয়েছেন অনেকবার। কয়েকজন রাজা অভিচারে প্রাণ হারিয়েছেন, অভিচার মানে তন্ত্রমন্ত্র জাদুটোনা, যা আসলে বিষপ্রয়োগের নামান্তর, যেমন চন্দ্রাপীড়, শ্রীলেখার পুত্র হরিরাজ, দিদ্দার পৌত্র নন্দিগুপ্ত। রাজা বক সপরিবারে ডাকিনীর হাতে নরবলি হয়েছেন। পুত্রের ষড়যন্ত্রে হত হয়েছেন রাজ্যচ্যুত রাজা পার্থ। কয়েকজন রাজ্য থেকে উৎখাত হয়ে আত্মঘাতীও হয়েছেন, যেমন উৎকর্ষ, অনন্ত। ঘাতকের হাতে প্রাণ গিয়েছে বেশ ক’জন রাজার—জয়াপীড়, হর্ষ, উচ্চল, সুসসল। যুদ্ধ করতে করতে আহত হয়ে প্রাণ গিয়েছে মাত্র একজন রাজার—তিনি রাজা হর্ষের পৌত্র ভিক্ষাচর।
তৃতীয় অঙ্কের পর থেকে, যত এই কাব্য ইতিহাসে পরিণত হচ্ছে, ততই রাজাদের চরিত্র বেশি প্রস্ফূটিত হচ্ছে। অনেক রাজাকেই দেখা যাচ্ছে বয়স্য, অমাত্য ও মন্ত্রীদের ক্রীড়নক হতে। রাজ্য পেয়েই ভোগে নিজেকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে বয়স্যদের সঙ্গে মিলে যথেচ্ছাচার করতে বেশ কিছু রাজাকে দেখা যাচ্ছে। যেমন কার্কোটক বংশের তারাপীড়, বজ্রাদিত্য, পৃথিব্যাপীড়, ললিতাপীড়, চিপ্পট-জয়াপীড়, উৎপল বংশের উন্মত্তাবন্তি, চক্রবর্মা, পর্বগুপ্ত, ক্ষেমগুপ্ত, লোহর বংশের কলস, তাঁর পুত্র হর্ষ—তালিকা আরো দীর্ঘ—এরা সবাই এই প্রকৃতির, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও স্বেচ্ছাচারী। রাজা অনন্তদেব প্রথমদিকে কিছুটা উচ্ছৃঙ্খল হলেও বুদ্ধিমতী সূর্যমতীকে বিয়ের পর নিজেকে পালটে সুশাসক হয়েছিলেন, যদিও পরে সূর্যমতীরই পরামর্শে পুত্র কলসকে রাজ্য ছেড়ে দেন এবং নিজের দুর্দশা ডেকে আনেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ অকথ্য অজাচার অনাচার করেছেন, নির্দিষ্ট রাজস্বেরও অতিরিক্ত করের জন্য প্রজাদের উপর উৎপীড়ন এবং নারীধর্ষণ এঁদের প্রধান আমোদ ছিল।
ধর্মীয় উদারতা বনাম বিবাদ বনাম অবিশ্বাস
রাজতরঙ্গিণীতে উল্লিখিত কালে হিন্দু ও বৌদ্ধ, উভয় ধর্মের রাজা কাশ্মীরে রাজত্ব করেছেন। বৌদ্ধ প্রভাবে অনেক রাজাই বৌদ্ধ না হয়েও বুদ্ধের অহিংসার বাণীকে আত্তীকরণ করেছিলেন এবং জীবনে আচরণ করতেন, প্রজাদেরও অহিংসা আচরণে উদ্বোধিত করতেন। তবে প্রথম তরঙ্গেই ধর্মীয় বিবাদের ঘটনারও উল্লেখ আছে। কণিষ্কের পরে নাগার্জুন নামে বৌদ্ধ শ্রমণের নেতৃত্বে বৌদ্ধেরা প্রবল হয়ে ওঠে এবং কাশ্মীরের পুরাতন ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে প্রচার করতে থাকে। তখন ব্রাহ্মণদের প্ররোচনায় তৎকালীন রাজা প্রথম অভিমন্যু বৌদ্ধ প্রচারকদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেন ও শৈবধর্ম প্রাধান্য পায়। তবে বুদ্ধ ও তাঁর বাণীকে রাজা প্রজা সবাই সম্মান করত, কাশ্মীর উপত্যকায় বৌদ্ধ প্রভাব আরো বহুদিন ধরে টিকেছিল।
চতুর্থ তরঙ্গের থেকে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু রাজারাই সিংহাসনে বসেন, কিন্তু নিজের ধর্মের মন্দির নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অনেকে এবং তাঁদের বহু অমাত্য-পরিজন বৌদ্ধ ধর্মস্থান এবং বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করিয়েছেন, এবং মঠ ও বিহার পরিচালনার জন্য জমি ও অর্থ দান করেছেন। ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের মত পরাক্রান্ত দিগ্বিজয়ী রাজাও শুধু স্বধর্মের মন্দির নির্মাণ করাননি, তিনি জিন অর্থাৎ জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীরের মূর্তি, চৈত্য, বিহার এবং তামা দিয়ে বিশাল বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
কাশ্মীরে শৈবধর্ম প্রধান হলেও বিষ্ণুর উপাসকও যথেষ্ট ছিল, বহু রাজা বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের মন্দির নির্মাণ করাতেন। এমন কী নরবলি দিয়ে শক্তিদেবতার উপাসনাও স্থানে স্থানে প্রচলিত ছিল। তা ছাড়া আদিযুগ থেকেই সর্বত্র, বিশেষ করে প্রাকৃতিক প্রস্রবণগুলোতে নাগদেবতা পূজিত হতেন।
কট্টর ধর্মবিশ্বাস ছিল না ঠিকই, অন্যদিকে দৃঢ় বিশ্বাস বা ভক্তির ভিত্তিও সম্ভবত কম ছিল। রাজা এবং অভিজাতরা মন্দির নির্মাণ করিয়েছেন, দান দিয়েছেন পুণ্যলাভের ইচ্ছায়। আবার নিজেদের ভাণ্ডারে অর্থের অভাব হলে মন্দিরের আয় কেড়ে নিয়েছেন, এমন কী মূল্যবান ধাতুনির্মিত বিগ্রহ অবধি ভেঙে লুট করেছেন এমন নজিরও অনেক আছে। ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় দেবতাকে সাক্ষী রেখে গৌড়রাজকে সন্ধি করতে ডেকেছেন, তারপর তাঁকে হত্যা করেছেন। তাঁর এই কুকীর্তি রামস্বামী বিগ্রহের ধ্বংসের কারণ হয়েছিল। পঞ্চম তরঙ্গে উৎপল বংশের রাজা শঙ্করবর্মা মন্দিরের ধূপ, চন্দন, তেল ইত্যাদি পুজোর দ্রব্যের বিক্রয়ের মূল্যে ভাগ নিতেন, এবং চৌষট্টি দেবমন্দিরের সমস্ত সোনাদানা অপহরণ করেছিলেন। রাজা কলশ তাম্রস্বামী সূর্যমন্দিরের তামার মূর্তি এবং বৌদ্ধবিহার থেকে পিতলের প্রতিমা স্বচ্ছন্দে অপহরণ করেছিলেন। এই কাজে সব চাইতে কুখ্যাত ছিলেন কলসের পুত্র রাজা হর্ষ, তিনি প্রথমটা কোনো নগ্ন বিকলাঙ্গ ভিক্ষুকে দিয়ে প্রতিমা অপবিত্র করাতেন, তারপর সেই বিগ্রহ ভেঙ্গে ধাতু-সহ সমস্ত ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করতেন।
গ্রামে পুরেঽথ নগরে প্রাসাদো ন স কশ্চনঃ।
হর্ষরাজতুরুষ্কেণ ন যো নিষ্প্রতিমীকৃতঃ।। ১০৯৫, ৭ম তরঙ্গ
গ্রামে অথবা নগরে এমন কোনো দেবালয় ছিল না যা তুরুষ্কসদৃশ হর্ষরাজ প্রতিমাশূন্য করেননি।
এই শ্লোক থেকে আরেকটা কথা বোঝা যায়, বহিরাগত শক্তি, যাদের কোথাও তুরুষ্ক বা কোথাও ম্লেচ্ছ বলা হয়েছে, তাদের বিধর্মীর মন্দির ও প্রতিমা ধ্বংস করার খবর কল্হন জানতেন, তাই হর্ষের সঙ্গে তুরুষ্কের তুলনা করেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্পর্কে শাসকের মনেই আলগা ভাব এসেছিল, তাই প্রজাদেরও দায় ছিল না তা রক্ষা করার। মন্দির রক্ষার জন্য পরিষদ ছিল, তারা শর্ত দিয়েছিল, মন্দির খুলে দেবে যদি রাজা তাদের ভার বহনের কাজ থেকে মুক্তি দেন। (রাজারা গ্রাম থেকে সারা বছরের কড়ারে বোঝা বইবার লোক নিযুক্ত করতেন) রাজা তাদের মুক্তি দিলে তারা পালিয়ে গিয়েছিল, রাজার লোকেরা অবাধে মন্দির লুণ্ঠন করল!
রাজাদের এই চরিত্রের ফলে শাসনে দায়িত্বের বালাই ছিল না। বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পক্ষবদল করা খুবই সাধারণ ছিল। রাজারা কানপাতলা ছিলেন; বহু সৎ সেনাপতি বা অমাত্য রাজার কাজ সুসম্পন্ন ও উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার পর ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তিদের রটানো গুজবের জন্য সন্দেহক্রমে নির্বাসিত হতেন। এমন কী পিতাপুত্রের মধ্যেও তৃ্তীয় পক্ষের মন্ত্রণা সন্দেহ ও অবিশ্বাস উৎপন্ন করত। রাজা কলস সন্দেহের বশে পুত্র হর্ষকে কারারুদ্ধ করেছিলেন, রাজা সুস্সল তাঁর পুত্র জয়সিংহকে, যদিও দুজনেই পরে মুক্তি পান। লোহরবংশীয় রাজারা, হর্ষ, উচ্চল, সুস্সল, পর পর দেহরক্ষী ও অমাত্য আততায়ীর হাতে মারা যান। শিশু রাজবংশধরদের প্রায়ই হত্যা করা হত। শাসনব্যবস্থা এক এক সময় প্রায় ভেঙে পড়ত। শেষ রাজা জয়সিংহ বহু আয়াসে আবার রাজ্যে শান্তি আনেন, কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই তাঁর বংশধরদের কালে মুসলমানদের হাতে কাশ্মীরের শাসন হস্তান্তরিত হয়—যদিও রাজতরঙ্গিণীর আলোচনাতে এই ব্যাপার অপ্রাসঙ্গিক।
ব্রাহ্মণসমাজ
রাজার পর দেশের প্রধান মাননীয় শ্রেণী ছিল ব্রাহ্মণসমাজ। রাজাদের মধ্যে অনেকেই কাশ্মীরের বাইরে থেকে অর্থাৎ আর্যাবর্ত থেকে ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণের লোকজন আনাতেন, প্রথম খবর পাই গোনন্দবংশের রাজা জলৌকের রাজত্বে, আরো পরের রাজা গোপাদিত্যের সময়ও আর্যাবর্ত থেকে চতুর্বর্ণের মানুষকে নিয়ে আসা হয় ধর্মাচরণ ও সামাজিক শিক্ষা দানের জন্য, তারপর কার্কোটক বংশের ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের আমলেও এই ধারা দেখি। কাশ্মীর চারদিকে জনজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে আবদ্ধ থাকায় এবং জলবায়ু শীতল হওয়ায় সমতলের মানুষ এখানে স্বাভাবিক ভাবে গমনাগমন করতে পারত না, ফলত রাজারাই ধর্ম, রাজনীতি ও সামাজিক শিক্ষা দেবার জন্য পণ্ডিত ও অভিজ্ঞ মানুষকে আনানোর ভার নিতেন। এঁদের অনেকেই জ্ঞানী ও বিদ্বান ছিলেন, কাশ্মীরে শারদাপীঠের মত উচ্চশ্রেণীর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং সংস্কৃত সাহিত্যের বেশ কিছু বিখ্যাত কবি লেখক কাশ্মীরের বাসিন্দা ছিলেন। রাজারা এঁদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে মন্ত্রী ও অমাত্যের পদে নিযুক্ত করতেন।
প্রত্যেক রাজার আমলেই মঠ-মন্দির স্থাপন হত, তাই দেবতার সেবার জন্য বহু ব্রাহ্মণকে পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করা হত, তারা অগ্রহার অর্থাৎ নিষ্কর ভূ-সম্পত্তি পেত। কোনো কোনো পণ্ডিত ব্রাহ্মণ রাজকার্যে উচ্চপদে আসীন হতেন, যথাসম্ভব রাজকাজ করতেন, কিন্তু সময় সময় রাজ্যের জরুরি অবস্থায় নিজেদের বিতণ্ডার কারণে তাঁরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতেন না। উৎপল বংশের উত্তরাধিকারী বিলোপ হলে যখন নূতন রাজা নিয়োগের দরকার, তখন, কল্হনের বর্ণনায় তীব্র কটাক্ষ—‘স্থূলকম্বলবাহিনঃ’, ‘অশৃঙ্গোক্ষনিভাঃ’, অর্থাৎ মোটা মোটা কম্বল গায়ে, দেখতে শিং-ছাড়া ষাঁড়ের মতন, পরস্পরের সঙ্গে মতান্তর ও বিবাদ করতে করতে নিজেদের ‘ধূমনির্দগ্ধকূর্চ’ অর্থাৎ ধোঁয়াতে পোড়া দাড়ি যা তারা থুথুর ছিটেয় ভিজাচ্ছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারছে না, এমনই সব বিতণ্ডাপরায়ণ ব্রাহ্মণেরা নিজেদের পছন্দসই পাত্রকে রাজা করতে রাজসভায় পৌঁছেছিল, যদিও তাদের প্রস্তাবিত কোনো পাত্রই রাজা হতে পারেনি।
কেউ কেউ রাজার শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে হত্যা করতেও পরাঙ্মুখ হয়নি। হত্যা করার এক উপায় ছিল অভিচার অর্থাৎ মন্ত্রতন্ত্র তুকতাক যা বস্তুত বিষ খাওয়ানোই বলা যেতে পারে, এবং ব্রাহ্মণদের মধ্যে কেউ কেউ এই অসদাচরণেই জীবিকা নির্বাহ করত। রাজা চন্দ্রাপীড় (৪র্থ তরঙ্গ), রাজা গোপাল বর্মা (৫ম তরঙ্গ), হরিরাজ (৭ম তরঙ্গ) এভাবেই মারা গিয়েছিলেন। রাজার উপর রাজ্যের স্বার্থেই হোক বা নিজের স্বার্থে, চাপ দেবার এক প্রধান উপায় ছিল অনশনে বসা। তবে কারো কারো অনশন যুক্তিযুক্ত ছিল, কেউ ঠিক বিচার না পেয়ে, কেউ বা রাজ্যের বিশৃঙ্খলার প্রতিবাদে দলবদ্ধ অনশনে বসত, বিচার না পেলে আগুনে বা নদীতে ঝাঁপ দিত। চতুর্থ তরঙ্গে রাজা জয়াপীড় রাজত্বের শেষভাগে প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিলেন, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য ভাগও তিনি আত্মসাৎ করছিলেন, ব্রাহ্মণদের অগ্রহার অর্থাৎ রাজার দান করা নিষ্কর সম্পত্তি বিনাদোষে বাজেয়াপ্ত করছিলেন এবং প্রতিবাদী অনেককে হত্যাও করেছিলেন। এই কারণে ব্রাহ্মণেরা বিদ্রোহ করে। ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহের পন্থা ছিল রাজার সমালোচনা করে শ্লেষাত্মক শ্লোক রচনা, তারপর অনশনে বসা। রাজা তখন অগ্রহার বাজেয়াপ্ত করা বন্ধ করলেন, কিন্তু কৃষকদের ফসলের ভাগ আত্মসাৎ করা বন্ধ করলেন না। তখন অনশনরত ব্রাহ্মণেরা প্রতিকার না পেয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন। বহু ব্রাহ্মণ এই সময়ে আত্মঘাতী হয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহী ব্রাহ্মণদের হাতেই জয়াপীড়ের মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, রাজত্বের শেষভাগে শত্রুদের হাতে পরাজিত ও বিতাড়িত রাজা হর্ষ যখন পলায়ন করে দ্বারে দ্বারে আশ্রয় ভিক্ষা করছেন, তখন তাঁর বিশ্বাসভাজন ব্রাহ্মণ অমাত্যেরা তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। সে প্রসঙ্গে কল্হনের কথায়—
প্রায়োপবেশকুশলাঃ শক্তাস্ত্বন্তে ন কুত্রচিত।
মিথ্যাসম্ভাবনাভূমিঃ ভূপানাং ব্রহ্মবন্ধবঃ।। ১৬১১, সপ্তম তরঙ্গ।
অনশনকুশল ব্রাহ্মণেরা অন্তকালে কোথাও কার্যদক্ষ নয়, ব্রাহ্মণ বন্ধুরা রাজাদের মিথ্যা বিশ্বাসভাজন।
রাজা সুস্সলও ভিক্ষাচরের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে যখন রাজধানীতে ফিরেছিলেন, তাঁর তখন আরো সৈন্য ও অর্থসংগ্রহের প্রয়োজন ছিল, তেমন সময়ে ব্রাহ্মণ পারিষদ ও পুরোহিতেরা অনশনে বসল। তাদের দাবি ছিল রাজার অমাত্যদের বরখাস্ত করা, কারণ তাদের মতে অমাত্যেরা ঠিকমত যুদ্ধ করছিল না। দীর্ঘ যুদ্ধ হলে তাদের শরতকালীন ফসল তোলা হবে না—এই চিন্তায় তারা এত উদ্বিগ্ন ছিল যে রাজাকে সদর্থক উপদেশ না দিয়ে কটুবাক্যে পালাতে বলল। রাজার বিপদ-সময়ে ‘কর্মস্থানোপজীব্যউগ্রপারিষদ্যাদিসঙ্কুলা’, রাজার কর্মস্থানে (অফিসে) যাদের জীবিকানির্বাহ হয়, সেইসব পারিষদ উগ্র হয়ে রাজার পাশ থেকেও শত্রুসেনার মত আচরণ করল। সুস্সল নিরুপায় হয়ে পলায়ন করেছিলেন।
সমকালীন ও পূর্বতন লেখক-কবিদের সম্বন্ধে কল্হনের টিপ্পনী
কল্হনের তীক্ষ্ণ কটাক্ষ দেশের কবিদের সম্পর্কেও ছিল। একেবারে শুরুতে, প্রথম তরঙ্গে তিনি বলেছেন, তাঁর পূর্বের বড় বড় কবিরা, যাঁরা দেশের রাজাদের ইতিহাস সম্পর্কে লিখতে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কবি সুব্রতের কাব্য ‘রাজাবলী’ ‘স্মৃতৈঃ সংক্ষেপিতো বচঃ’ মনে রাখবার জন্য সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে ’দুষ্ট-বৈদূষ্যে’, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় তথ্য না দিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ বচনে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, পুরোনো লেখাগুলোর উপাদান নিয়ে নিজেদের কাব্য লেখার পর পুরোনো গ্রন্থের প্রতিলিপি সংরক্ষণে মনোযোগী না হওয়াতে সেগুলো বিলোপ হয়ে গিয়েছে। ‘অংশোঽপি নাস্তি নির্দোষঃ ক্ষেমেন্দ্রস্য নৃপাবলৌ’—‘নৃপাবলী’ কাব্যের কবি ক্ষেমেন্দ্রের ঐতিহাসিক কাব্য ‘নৃপাবলী’র কোনো অংশই নির্দোষ নয়। পূর্বতন বিখ্যাত কবিদের সম্পর্কে কল্হনের ধারণা খুব ভাল ছিল না!
একই সুরে অন্য এক জায়গায় কল্হন লিখেছেন—
ন মূর্খগুরবো মৎস্যাপূপযাগ বিধায়িনঃ ।
চক্রিরে স্বকৃতৈঃ গ্রন্থৈঃ তর্কাগমপরীক্ষণম্।। ১১, ষষ্ঠ তরঙ্গ
রাজা যশস্করের শাসনে মূর্খ গুরুরা মৎস্যাপূপ যাগের অধিকারী ছিলেন না এবং নিজেদের রচনাকে গৌরবান্বিত করার জন্য প্রাচীন মহৎ সাহিত্যের ভিতর গুঁজে দিতে পারতেন না।
আজকাল আমরা অনেকসময়ই শুনতে পাই প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে বহু শ্লোক, যা মূল লেখকের রচিত নয়, তা প্রক্ষিপ্ত রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শুরু করে অনেক বড় বড় সমালোচক এমন অভিযোগ করেছেন। দ্বাদশ শতকেই কল্হন বলছেন, কবিরা অন্য রাজাদের আমলে প্রাচীন মহৎ সাহিত্যের ভিতরে নিজেদের লেখা গুঁজে দিতে ইতস্তত করতেন না, তবে যশস্কর নিজে বিদ্বান হওয়ায় তাঁর সময়ে এরকম কাজ কেউ করতে পারেননি। রাজা এ ব্যাপারে সজাগ ছিলেন।
তেমনি,
পরকাব্যেন কবয়ঃ পরদ্রব্যেণ চেশ্বরাঃ।
নির্লোঠিতেন স্বকৃতিং পুষ্ণ্যন্ত্যদ্যতনে ক্ষণে।। ( ১৬০, পঞ্চম তরঙ্গ)
—অর্থাৎ, আজকালকার কবিরা পরের কাব্য এবং রাজারা পরের দ্রব্য লুঠ করে নিজের কাজের পুষ্টি করে থাকে।
সব যুগেই ‘অদ্যতন’ সম্পর্কে কত অসন্তুষ্টি!
বণিক সমাজ
বণিক বা মহাজনদের খাতকদের দ্বারা বঞ্চনার কথা কবি কয়েক জায়গায়ই বলেছেন, আগেই উল্লেখ করেছি।
তৈলস্নিগ্ধমুখঃ স্বল্পালাপো মৃদ্বাকৃতির্ভবন্।
ন্যাসগ্রাসবিবাদোগ্র বণিগ্ব্যাঘ্রাদ্বিশিষ্যতে।। ১২৯, অষ্টম তরঙ্গ
বণিকের তেলচকচকে মুখ, স্বল্পভাষী, ভদ্রলোকের চেহারা, কিন্তু তার কাছে জমা ফেরত দেবার সময় দিতে চায় না, টাকা গ্রাস করার জন্য বিবাদ করে বাঘের চাইতেও উগ্র মূর্তি ধরে। তারা দিচ্ছি দিচ্ছি করে সময় কাটায়, আবারও দিতে বললে এমন সব হিসেব দেয় যে খাতকের মাথায় কিছুই ঢোকে না, ফলে তার টাকা মারা যায়। তারা লিখিত চুক্তিকেও পালটে দেয়, কথার ফেরে লোক ঠকায়। একমাত্র যশস্কর বা উচ্চলের মত বুদ্ধিমান ও নিরপেক্ষ রাজা হলে বণিকের প্রতারণা ধরতে পারে। খাতকের টাকা হাতানোর জন্য বণিক মহাজন যে কেমনতর মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে—আমরা দুই বংশের দুজন রাজার —যশস্কর ও উচ্চলের—দুটো বিচারের গল্প থেকে উদাহরণ পাই। কোনো কোনো বণিক এত বেশি প্রবঞ্চক যে তারা তরুণবয়সি রাজাদের উচ্ছৃঙ্খলায় প্রশ্রয় দিয়ে তাদের ঠকিয়ে টাকা নেয়—যেমন রাজা অনন্তকে এক তাম্বুল-ব্যবসায়ী ঠকিয়েছিল। তাম্বুল ব্যবসায়ী রাজাকে অতিরিক্ত দামে তাম্বুল বিক্রয় করে দেনায় ডুবিয়ে রাজসিংহাসন ও মুকুট বন্ধক জমা নিয়েছিল। মাসের মাঝখানে মাত্র একদিন সেগুলো রাজসভায় নিতে দিত, যতদিন না রানি সূর্যমতী নিজের সঞ্চিত অর্থে সেগুলো ছাড়িয়েছিলেন।
চতুর্থ তরঙ্গ এবং সপ্তম তরঙ্গে আমরা মানুষ ক্রয়বিক্রয়ের খবর পাচ্ছি। চতুর্থ তরঙ্গে রাজা বজ্রাদিত্য বপ্পিয়ক বিদেশি বণিকদের কাছে দেশের মানুষ বিক্রয় করতেন, এবং সপ্তম তরঙ্গে রাজা কলস মধ্য এশিয়া থেকে বিক্রয়ের জন্য আনা নারী কিনতেন!
মন্ত্রী ও অন্যান্য রাজকর্মচারী
মন্ত্রী যেকোনো বর্ণ থেকেই হতেন। মন্ত্রী হলেন সর্বোচ্চ পরামর্শদাতা, অমাত্য রাজার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত থেকে রাজাকে পরামর্শ দেন। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রী, অমাত্য, দ্বারপতি, প্রতিহারী, সন্ধিবিগ্রহিক ইত্যাদি বড় বড় পদে তো ছিলেনই, তাঁরা অনেকে যুদ্ধও করতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ মন্ত্রী হতেন। বৈশ্যবর্ণের মুখ্য অমাত্য পাওয়া যায় রাজা অনন্তদেবের সময়, রানি সূর্যমতীর নিয়োজিত। তাঁর নাম হলধর। তাঁর পিতা একটা মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, সাধারণ প্রজা ছিলেন। হলধরও রাজসভায় সাধারণ পদ থেকে প্রধান অমাত্যের পদে উঠেছিলেন, তাঁর বাস্তববুদ্ধি দিয়ে রাজার যথেচ্ছাচারের ফলে শূন্য হওয়া কোষাগার পূর্ণ করেছিলেন, এবং রাজ্যচালনার ক্ষেত্রেও তাঁর পরামর্শ উপযোগী ছিল। প্রজাদের হিতার্থে এঁর একটা কাজ উল্লেখযোগ্য। আগে প্রজাদের সঞ্চিত সোনারুপোর রঙ এবং মূল্য নিরূপণ রাজার হাতে ছিল। এর ফলে কার কাছে কত সোনারুপো আছে, তা রাজার নজরে থাকত। রাজা দুষ্টপ্রকৃতি হলে কোনো অজুহাতে দণ্ড দিয়ে প্রজার অর্জিত সম্পত্তি কেড়ে নিতে পারতেন। হলধর এই নিয়ম উঠিয়ে দিয়ে প্রজার ধনের নিরাপত্তা কিছুটা নিশ্চিত করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে আরেকজন সাধারণ বৈশ্য মন্ত্রী ক্ষেম প্রজাদের কাছ থেকে নিয়মিত একদ্বাদশাংশ, অর্থাৎ বারোভাগের একভাগ ফসল কর হিসেবে আদায় করে রাজকোষ পূর্ণ করতে সহায়তা করেছিলেন।
বিদেশি ভিন্নধর্মী মানুষও কাশ্মীর রাজ্যে মন্ত্রী হয়েছেন, যেমন চঙ্কুণ, যিনি তুরুষ্ক অর্থাৎ তুর্কমেনিস্তানের লোক এবং ধর্মে বৌদ্ধ ছিলেন এবং ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের প্রধান মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি যথেষ্ট রাজভক্ত এবং বিচক্ষণ ছিলেন। চণ্ডালীর পালিতপুত্র, অজ্ঞাতজন্ম সুয্য রাজা অবন্তিবর্মার সময়ে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্মরণযোগ্য কাজ করে শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছিলেন। তিনি নিজের ও মায়ের নামে নগর, সেতু, গ্রাম ইত্যাদির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পার্বত্য খস জনজাতির মানুষ তুঙ্গ প্রথমজীবনে মহিষ পালক ছিলেন। তিনি রানি দিদ্দার সভায় লেখহারকের পদ থেকে অমাত্যপদে উন্নীত হয়েছিলেন। কাশ্মীরে রাজা থেকে সাধারণ প্রজা জীবনযাপনে জাতপাতের কট্টরতা থেকে অনেকখানিই মুক্ত ছিল বোঝা যায়।
কর্মচারীদের অনেক পদের নাম আমরা পঞ্চম তরঙ্গ থেকে পেতে শুরু করি। গোনন্দবংশের সময়ে যে সাতজন রাজকীয় প্রধানপুরুষ ছিলেন, অর্থাৎ ধর্মাধ্যক্ষ, ধনাধ্যক্ষ, কোষাধ্যক্ষ, সেনাপতি, দূত, পুরোহিত ও দৈবজ্ঞ, রাজা জলৌক শাসনের সুবিধার জন্য তাদের কর্মস্থানকে আঠারো ভাগ করেছিলেন। চতুর্থ তরঙ্গে ললিতাদিত্য মুক্তাপীড়ের সময় দেখা যায় এই সাত উচ্চতম আধিকারিকের সঙ্গে আরো পঞ্চ মহা কর্মস্থান বলে পাঁচটি সর্বোচ্চ বিভাগের কথা। এই পাঁচ সর্বোচ্চ বিভাগ হল মহাপ্রতীহার, মহাসন্ধিবিগ্রহ, মহাশ্বশালা, মহাভাণ্ডাগার ও মহাসাধনভাগ। এইসব বিভাগের কর্মকর্তারা মন্ত্রীর অধীনে ছিলেন। এদের সবার কর্মস্থানে ছিল অষ্টাদশ সংস্থান, মানে কর্মবিভাগ। যত বছর গিয়েছে, রাজারা নতুন নতুন পদের সৃষ্টি করেছেন। জয়াপীড়ের আমলে সৃষ্ট হয় ধর্মাধিকরণ নামে নতুন কর্মস্থান, তাড়াতাড়ি বিচারের জন্য। তাছাড়া চলগঞ্জ নামে চলন্ত কোষাগার, রাজা যুদ্ধে বা ভ্রমণের জন্য রাজধানী থেকে দূরে সরলে —জয়াপীড় অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধ ছাড়াও ছদ্মবেশে অন্য রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসতেন— সেরকম অবস্থায় টাকার দরকার পড়লে এই চলগঞ্জ কোষাগার থেকে টাকা নিতে পারতেন।
মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ের রাজকর্মচারীদের বলা হত কায়স্থ। তারাই কৃষকের থেকে রাজস্ব আদায় করত, এবং তাদের উচ্চতর কর্মচারীর কাছে জমা দিত। এই কায়স্থরা কৃষকের কাছে ভীতিপ্রদ ছিল, কারণ রাজার পাওনাটুকু আদায়ে তারা সন্তুষ্ট থাকত না। ভয় দেখিয়ে তারা ঘুষ আদায় করত, ওদিকে রাজার রাজস্ব থেকেও গোপনে ভাগ বসাত। চাকরির মাইনে তো পেতই। যখনই রাজার বাড়তি অর্থের দরকার পড়ত, রাজা কায়স্থদের পাঠাতেন প্রজাদের কাছ থেকে আদায়ের জন্য। কায়স্থরা তখন অত্যাচারে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলত। কল্হন কাব্যের অনেক জায়গায়ই কায়স্থদের নিন্দা করেছেন, সুনাম করেছেন খুব কম।
কায়স্থরা যেন নিজেদের মধ্যে বিবাহসম্বন্ধে মিলিত না হয়—এও রাজা ললিতাদিত্যের উপদেশ ছিল। তারা একত্রিত হলে রাজকার্য ঠিক মত নির্বাহ করবে না, কর আদায় করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরাই নিয়ে নেবে। তাই রাজা তাদের কাজে লাগাবেন, তাদের কাজ কখনো করবেন না।
ডামর
‘ডামর’ শব্দটি শুধু রাজতরঙ্গিণীতেই দেখতে পাওয়া যায়। কল্হনও শব্দটির অর্থ বলেননি, কিন্তু বর্ণনা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সমাজের একটা প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিল ডামরকুল। এরা ছিল মূলত কৃষক, শহরের বাইরে ছোট ছোট পার্বত্য উপত্যকায় বাস করত, তাই তাদের ‘গহ্বরবাসী’ও বলা হত। তাদের মুখ্য জীবিকা ছিল কৃষি। কিন্তু তাদের কেউ কেউ ব্যবসাও করত, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যের। জমি আবাদ করে নিজেদের জমির পরিমাণ বাড়াত, তবে তাদের বাসভূমির একান্ততার কারণে অনেক সময় রাজস্ব দিত না। যে যত সম্পদ বাড়াত, তার প্রভাবও তত বাড়ত, এবং একজন কৃষক তখন ডামর পদবী লাভ করত। তখন তার নিজস্ব অনুচর হত, সৈন্যদল গঠন করত, রাজাদের পক্ষে বা বিপক্ষে যোগ দিয়ে অনেক সময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়ত। এই ব্যাপার অবশ্য সারা দেশেই ছিল, ছোট ভূম্যধিকারীর চেষ্টাচরিত্র করে বড় ভূম্যধিকারীতে পরিণত হওয়া, তারপর রাজশক্তির সঙ্গে প্রতিস্পর্ধা করার মত ক্ষমতাশালী হওয়া সেই সময়ে প্রচুর ঘটত। কথাটি মনে রেখে কার্কোটক বংশীয় রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় তাঁর উত্তরাধিকারীর উদ্দেশ্যে উপদেশ দিয়েছিলেন,—
বর্ষোপভোগ্যান্যন্নানি ক্ষেত্রভুসংমিতা বৃষাঃ।
গ্রাম্যাণাং নাতিরিচ্যন্তে যথা কার্যং তথা সকৃৎ ।।৩৪৭
অধিকীভূতবিত্তা হি বৎসরেণৈব তে ভৃশম্।
ভবেয়ুঃ ডামরাঃ ক্রুরাঃ নৃপাজ্ঞাতিক্রমক্ষমাঃ।।৩৪৮ চতুর্থ তরঙ্গ
অর্থাৎ,
কৃষকদের বড়জোর বাৎসরিক খাদ্যের পরিমাণমত শস্য, পরবর্তী ফসলের জন্য বীজ এবং ক্ষেতের জমির মাপ অনুসারে চাষের প্রয়োজনমত ষাঁড় রাখতে দেওয়া যাবে। (কারণ) বছর বছর উদ্বৃত্ত বেশি জমলে কৃষকেরা রাজার আজ্ঞা লঙ্ঘন করার ক্ষমতা অর্জন করে ভয়ঙ্কর ডামরে পরিণত হয় !
চতুর্থ তরঙ্গ থেকে ডামরদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। তারপর থেকে কাশ্মীরের ইতিহাসে এদের ভূমিকা প্রবল হয়ে ওঠে, অনেক রাজাই শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রভাবশালী ডামরপতির সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তামূলক মিত্রতা করতেন। এজন্য একটি বিশেষ কৃত্য করতে হত। দুই সম্ভাব্য মিত্র কোনো দেবমূর্তি অথবা রাজাকে সাক্ষী রেখে একটি রক্তাক্ত মেষচর্মের উপর দাঁড়িয়ে পরস্পরের কোশ পান করে, অর্থাৎ তরোয়ালের খাপে চুম্বন করে এই মিত্রতা সম্পাদন করত।
ললিতাদিত্যের মতে, গ্রামবাসিদের কাছে যদি নগরবাসিদের মত নারী, বস্ত্র, কম্বল, ভোজ্য, অলংকার, ঘোড়া, ও বাড়ি থাকে, রাজা যদি দুর্গ রক্ষা করতে উপেক্ষা করেন, রাজপুরুষদের যদি বিচারহীন মনে হয়, কায়স্থকুল পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঐক্যসূত্রে মিলিত হয়, যদি সৈন্যদের জীবিকা একই জায়গা থেকে সংগ্রহ হয়, রাজা যদি কায়স্থের ন্যায় কর্মস্থল পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে প্রজার ভাগ্যবিপর্যয় হতে পারে।
পঞ্চম তরঙ্গে রাজা অবন্তিবর্মার সময়ে একজন ডামরের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। রাজা একবার একটা মন্দিরে গিয়ে দেখলেন, মন্দিরের দৈন্যদশা। দেবতাকে পূজা করার উপকরণ নেই। পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, একজন ডামর মন্দিরের অগ্রহার জমি গ্রাস করে নিয়েছে, তাই মন্দিরে ভোগসামগ্রী নিবেদন বন্ধ হয়ে গেছে। রাজা সেই ডামরকে ডেকে পাঠালেন। রাজা তিনবার ডাকবার পর সে এল না, চতুর্থবার এলো তো সশস্ত্র লোকলস্কর নিয়ে। সে তার আচরণের কোনো কৈফিয়তও দিল না। তার ঔদ্ধত্য দেখে তার পৃষ্ঠপোষক, যিনি রাজার মন্ত্রী ছিলেন, তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে হত্যা করলেন।
ডামরদের প্রভাব লোহর রাজবংশের সময় অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল। উৎপল রাজবংশের প্রথম রাজা অবন্তিবর্মা ছিলেন সুশাসক। কিন্তু তাঁর পর তাঁর পুত্র শঙ্করবর্মা থেকে শুরু করে কাশ্মীরের সিংহাসনে পর পর স্বেচ্ছাচারী ও উৎপীড়ক রাজারা বসেন, এঁরা নিজের ভোগসুখের জন্য প্রজাপীড়ন করে রাজস্ব আদায় করতেন। কিন্তু দূরে বা দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে যারা বাস করত, তাদের খোঁজখবর কমই রাখতেন। প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে এইসব দূরস্থ প্রজাদের ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী হয়ে ডামরে পরিণত হওয়া অসম্ভব ছিল না।
ষষ্ঠ তরঙ্গের শেষে দেখা যায় নিঃসন্তান রানি দিদ্দার ভাইদের বংশের দুটো প্রধান ধারা ছিল। এই দুটো ধারাই লোহর রাজবংশ হিসেবে কাশ্মীরে রাজত্ব করেছিল। তাদের প্রথম রাজা দিদ্দার ভাইপো সংগ্রামদেব কাশ্মীরের রাজা হবার সময় নিজের সুরক্ষার জন্য দিদ্দার বিশ্বাসভাজন খশ উপজাতির সর্দার তুঙ্গের সঙ্গে কোশপান করে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। এর পর থেকে প্রায় প্রত্যেক রাজাই একদিকে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য ডামরদের সাহায্য নিতেন, আবার কাজ শেষ হলে তাদের ছলেবলে কৌশলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতেন। ডামরেরাও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে রাজার বিরোধীদের সঙ্গে যোগ দিত, দুপক্ষেরই পারস্পরিক কোনো দীর্ঘস্থায়ী আনুগত্য ছিল না। প্রায়ই অর্থের বিনিময়ে তারা পক্ষ বদলাত। সংগ্রামরাজের পর উল্লেখযোগ্য রাজা অনন্তদেব, কলস, হর্ষ, উচ্চল, সুস্সল, ভিক্ষাচর এবং জয়সিংহ – প্রত্যেকের রাজত্বেই প্রায় এইধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। এঁদের মধ্যে কলস এবং সর্বশেষ জয়সিংহ ছাড়া সকলেরই অপমৃত্যু ঘটেছিল, অনন্তদেব আত্মহত্যা করে, ভিক্ষাচর যুদ্ধ করতে করতে এবং বাকিরা আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। ডামরদের সাহায্যে এঁদের শত্রুদের বলবৃদ্ধি হয়েছিল। রাজা উচ্চল ডামরদের শক্তি ক্ষয় করতে তাদের মধ্যে একজনকে উচ্চপদে নিযুক্ত করে অন্যদের ইর্ষা উৎপাদন করিয়ে ভেদবুদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন, যাতে তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরে। তিনি প্রথমটায় কিছুটা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেই ষড়যন্ত্রের বলি হন।
গ্রামবাসী কৃষক এবং নিম্নবর্গের মানুষের অবস্থা
রাজ্যে সবচাইতে উৎপীড়িত ছিল গ্রামবাসী কৃষকেরা। কল্হন ‘শূদ্র’ বলে তাদের চিহ্নিত করেননি। মনে হয় তারা ছিল জনজাতীয় মানুষ, দরদ, খশ, লবণ্য ইত্যাদি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী চাষীদের সঙ্গে রাজাদের দ্বারা কাশ্মীরে আনীত শূদ্রবর্ণের মানুষ। তবে বাকি ভারতে যাদের শূদ্র বলা হয় সেরকম কোনো বর্ণগত গোষ্ঠীর উল্লেখ কল্হনের লেখায় পাই না। জাতিপ্রথার সবচাইতে নিম্ন ধাপে ছিল চণ্ডালেরা। কিন্তু তারাও সময় সময় রাজার কাছে গুরুত্ব পেয়েছে। সুয্যা নামে চণ্ডালীর পালিতপুত্র মঠে পড়াশুনো করেছিল এবং পরবর্তীকালে রাজা অবন্তিবর্মার রাজত্বকালে প্রকৌশলী হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিল। উৎপলবংশীয় রাজা চক্রবর্মা ও লোহরবংশীয় রাজা হর্ষকে চণ্ডালের সঙ্গে মিত্রতা করতে দেখি। হয়তো বৌদ্ধধর্মের প্রভাবের জন্য জাতিভেদপ্রথা কাশ্মীরে তত কট্টর ছিল না।
এই প্রজাদের মধ্য থেকেই রাজার সৈন্যদলে সাধারণ সৈনিক সংগ্রহ হত। তবে প্রত্যক্ষভাবে নয়। রাজা, সেনাপতি ও অমাত্যেরা নিজেদের অস্ত্রধারী রক্ষীদল রাখতেন। সামন্তরাজারা ও ডামর মুখ্যরাও সশস্ত্র রক্ষী রাখত। কোনো যুদ্ধ উপস্থিত হলে রাজা সামন্তরাজা ও ডামরদের সসৈন্যে নিজ পক্ষে যোগ দিতে আহ্বান করতেন, তারা অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ করত। তবে তারা সময় ও সুযোগ বুঝে রাজার সঙ্গে বেতন বৃদ্ধির জন্য দরকষাকষি করত, এমন নজিরও আছে।
রাজা যখন অতিরিক্ত ভোগবিলাসী হতেন, যখন খরচ রাজস্বকে ছাড়িয়ে যেত, তখন সমমনা বয়স্যদের পরামর্শে প্রজাদের ফসল কেড়ে নিতে দ্বিধা করতেন না। যুদ্ধের সময় স্বাভাবিকভাবেই খরচ বেশি, সেক্ষেত্রেও প্রজাদের আয়ের উপর রাজা অতিরিক্ত কর বসাতেন, যদিও সাধারণভাবে রাজস্ব ছিল ফসলের বারো ভাগের একভাগ। কায়স্থরা রাজকর আদায় করতে এসে যা নেবার তার চাইতে অনেক বেশি আদায় করত ভয় দেখিয়ে, ফলে প্রজাদের কাছে কিছুই থাকত না, তাদের অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাতে হত। তাছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টি, বরফপাত, পাহাড়ি ধস ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট, বাড়িঘর ভেঙ্গে প্রাণহানি হত। সহানুভূতিশীল রাজারা প্রজাদের সেরকম ক্ষেত্রে সহায়তা করতেন, নিজের ও রাজপুরুষদের শস্যভাণ্ডার থেকে অতি কম দামে অথবা বিনামূল্যে শস্য সহায়তা দেওয়া হত। কিন্তু রাজা অত্যাচারী হলে প্রজাদের দুর্দশার অন্ত থাকত না।
দারিদ্রের খবর আমরা প্রথম তরঙ্গেই পাই, যেখানে এক দূরাগত পথিক ব্রাহ্মণের সঙ্গে দুজন নাগবংশীয় কন্যার দেখা হয়েছিল। মেয়েদুটো খিদের জ্বালায় সরোবরের কাছের জলাভূমিতে স্বাভাবিকভাবে গজানো বুনো শিম তুলে কাঁচাই খাচ্ছিল। কারণ তাদের সমাজের নিয়ম ছিল যে তাদের সমাজের মুখ্য ব্যক্তি, যে শস্যরক্ষক বলে মান্য হত, সে প্রথম নতুন শস্য না খেলে কেউ তার ক্ষেতের ফসল খেতে পারবে না। ফলে কৃত্রিম অভাবের সৃষ্টি হত এবং সমাজের লোকজন ক্ষুধার্ত থেকে যেত। ব্রাহ্মণ পথিক মেয়েদুটোকে নিজের জন্য বানানো ছাতুর পিণ্ড খেতে দিয়েছিল, সবার তো তত সৌভাগ্য হত না। লোকে দারিদ্রদশা ঘুচোতে বিদেশে অর্থ উপার্জন করতে গিয়েছে, তারপর কিছু রোজগার হলে দেশে ফিরেছে, এমন একাধিক উদাহরণ এই কাব্যে পাওয়া যায়।
রাজতরঙ্গিণীতে অনেক দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায়। বিশেষ করে শারদ শস্য গোলাজাত করবার সময় বৃষ্টি বা বরফ পড়লে ফসল নষ্ট হয়ে যেত। পার্বত্য অঞ্চলে হড়পা বান হয়ে নদীর বন্যায় গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যেত। বন্যাপীড়িতের অভাবের কথা মাথায় রেখেই সূয্য নদীবাঁধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বন্যার্তদের প্রথমেই কিছু উপার্জনের জন্য নদীতে দীনারের ভাণ্ড ফেলে দিয়েছিলেন, যাতে তারা জল থেকে ধসে পড়া পাথর উঠাতে বাধ্য হয়।
কাশ্মীরে নারীর অবস্থান
প্রাচীন ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় থেকে কাশ্মীরে নারীদের অবস্থান সামান্য ভাল ছিল বলা যায়। কল্হন নীলমতপুরাণকে অনুসরণ করে কিছু কাহিনি তাঁর কাব্যে যুক্ত করেছেন, সেই কাহিনি অনুসারে গোনন্দ বংশের দ্বিতীয় রাজা দামোদর যুদ্ধে নিহত হলে শ্রীকৃষ্ণের উদ্যোগে দামোদরের রানি যশোবতী রাজসিংহাসনে বসেছিলেন। নারীর সিংহাসনে আরোহণ ভারতের ইতিহাসে বা পুরাণেও এর আগে শোনা যায় না। পরেও আরো ক’জন নারী সিংহাসনে বসেছিলেন। একজন সিংহাসনে বসেছিলেন বছর দুয়েকের জন্য, তিনি উৎপল বংশীয় রাজা শঙ্করবর্মার রানি সুগন্ধা, যদিও এঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হয়, যার ফলে আততায়ীর হাতে এঁর মৃত্যু ঘটে। আরেকজন হলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ দিদ্দা, যিনি পুত্রের মৃত্যুর পর পৌত্রদের অকর্মণ্য ভেবে তাদের সরিয়ে নিজে সিংহাসনে বসেন, এবং কূটনীতি ও হিংস্রতায় কোনো পুরুষ শাসকের চাইতে কম ছিলেন না। নিজে দীর্ঘদিন রাজত্ব করার পর তিনি যোগ্যতা পরীক্ষা করে নিজের ভাইপোকে সিংহাসনে বসান ও লোহর রাজবংশের সূচনা করেন। সংগ্রামরাজের রানি শ্রীলেখাও স্বামী-পুত্রের মৃত্যুর পর সিংহাসনে স্বল্পদিনের জন্য বসেছিলেন, কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপে অমাত্যেরা বাধা দেন, এবং তারপর তিনি ধর্মকর্মে মন দিয়ে সিংহাসন ত্যাগ করেন। দুজন রানি, গোনন্দ বংশের রাজা তুঞ্জীনের পত্নী বাকপুষ্টা এবং লোহর বংশের অনন্তদেবের পত্নী সূর্যমতী স্বামীর সঙ্গে মিলে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজ্য চালিয়েছিলেন। রাজা জয়সিংহের রানি কল্হনিকা দূত হিসেবে জয়সিংহ ও রাজপুত্র ভোজের মধ্যে সন্ধির প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাছাড়া অনেক রাজমহিষী মঠমন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। তবে শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে নারীদের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায় না।
সাধারণ ভারতীয় সতীত্বের আদর্শ কাশ্মীরের সমাজেও আদর্শ বলে ধরা হত, বাস্তবে তেমন মান্যতা পায়নি। যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর বেশ উদার ছিল। কার্কোটক বংশীয় রাজা দুর্লভ বর্ধনের পত্নী অনঙ্গলেখা স্বামী বর্তমানেই অন্য পুরুষকে ভালবাসতেন, দুর্লভবর্ধন ব্যাপারটি জানবার পরও পত্নীর কোনো শাস্তি বিধান করেননি, শুধু প্রেমিক অমাত্য মংখকে সাবধান করেছিলেন। রাজা দুর্লভক নরেন্দ্রপ্রভা নামে এক বণিকপত্নীকে তার স্বামীর অনুমতিতে বিয়ে করে পাটরানি বানিয়েছিলেন। রাজা উৎকর্ষ সহজা নামে নর্তকীকে এবং রাজা উচ্চল জয়মতী নামে নর্তকী, যে আগে আনন্দ নামে সামন্তের উপপত্নী ছিল, তাকেই বিয়ে করে পাটরানি করেছিলেন। আজকালকার সমাজে এইধরনের সম্পর্ক আকছার দেখা যায়, কিন্তু সেই যুগে ভারতে নারীর চরিত্রে যৌন বিশুদ্ধতার উপর এত গুরুত্ব আরোপ করা হত যে অন্যপূর্বা নারীর সসম্মান বিবাহ ভাবনার অতীত ছিল। কাশ্মীর খানিকটা আলাদা থাকায় হয়তো এখানে এত কঠোরতা ছিল না। তবে সহমরণপ্রথা প্রথমদিকে চালু না থাকলেও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, এবং পঞ্চম তরঙ্গের উৎপল বংশ থেকে নিয়মিত সহমরণ এবং অনুমরণের ঘটনা দেখা যায়। রাজপরিবারের কন্যাদের প্রায়ই বিপক্ষের রাজা কিংবা সামন্তের বিদ্রোহ প্রশমিত করতে বা তাদের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা পাবার জন্য তাদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত, অনেক সময়ই এরকম ক্ষেত্রে বয়স্ক রাজার সঙ্গে কিশোরী রাজকন্যাকে বিয়ে দেওয়ার ঘটনা আকছার ঘটত। অভিজাত পুরুষেরা বহুবিবাহ করত। বহু সপত্নীর মধ্যে মেয়েদের অবস্থা যে খুব ভাল থাকত না তা সহজেই অনুমেয়। রাজার পত্নীদের মধ্যে যার পুত্র থাকত তার প্রতিপত্তি বেশি থাকত, বাকিদের নয়। রাজা মারা গেলে কিংবা তাঁর ক্ষমতা চলে গেলে তাঁর স্ত্রীদের অবস্থা খারাপ হত। রাজা উৎকর্ষ তাঁর বিধবা বিমাতাদের স্বৈরিণী অপবাদের জন্য শুধু মুগডাল মেশানো ভাত খেতে দিতেন। কিছুদিনের জন্য নামমাত্র রাজা হয়ে থাকা কলসের পত্নীদের শাশুড়ি সূর্যমতীর নির্দেশে সমস্ত ঘরের কাজ, এমন কী ঘরমোছা পর্যন্ত করতে হত! সাধারণ নারীদের স্বামীর অবর্তমানে দুঃখদুর্দশায়, দাসীবৃত্তি করে দিন কাটাতে হত, দু-একটা ছোট পার্শ্বকথায় দেখা যায়। দুর্দশা কাটাতে কোনো কোনো উচ্চবংশীয় বিধবা নারী অনভিজাত ব্যক্তির উপপত্নীত্ব স্বীকার করে সমাজে নিন্দিতও হতেন।
খাদ্য
কাশ্মীরীদের প্রধান ফসল ছিল ধান। তারা উড়িধান ও যবের ছাতুও খেত, পিণ্ড করে। ধনীরা দই সহযোগে ছাতু খেত। ফলের মধ্যে দ্রাক্ষা ছিল প্রধান, কল্হন প্রথম তরঙ্গেই কাশ্মীরের স্বাদু দ্রাক্ষার কথা বলেছেন। পালেবত অর্থাৎ আপেলের খবর পাই এক জায়গায়, রানি দিদ্দা তাঁর রাজপুত্র ভাইপোদের রাজা হবার যোগ্যতা আছে কি না পরীক্ষা করবার জন্য কয়েকটা ফল গড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই ফল বোধ হয় তখন বেশি হত না, কিংবা অন্য জায়গা থেকে আসত। কাশ্মীরে অনেক নদী, হ্রদ বা জলাভূমি থাকাতে মাছও খাদ্যের তালিকায় ছিল, যদিও প্রথমদিকে জীবহিংসাকে উৎসাহিত করা হত না। পাঠীন নামে বিশেষ একপ্রকার মাছের নাম পাই। পাখির মধ্যে পায়রার মাংস খাওয়া হত। ‘ভৃষ্টমাংস’ অর্থাৎ মাংসভাজা রাজভোগ্য খাবার বলে বিবেচনা করা হত। রাজা হর্ষ গ্রাম্য শূকরের মাংস খেতেন বলে নিন্দিত হয়েছেন। অপূপ অর্থাৎ পিঠেও খাওয়া হত, মৎস্যাপূপ যজ্ঞে মাছ ও অপূপ আহুতি দেওয়া হত, যজ্ঞশেষে ব্রাহ্মণেরাও হুতাবশেষ প্রসাদ খেতেন। কল্হনের কথায়, কাশ্মীরদেশীয় মৃদু ও স্নিগ্ধ ভোজ্যদ্রব্য তুষারশুভ্র জলপান দ্বারা সুজীর্ণ হত। বহু রাজার তাম্বুল খাওয়ার অভ্যাস ছিল, এবং তার জন্য ভালমত খরচ হত, কারণ তাম্বুলের উপকরণ পান ও অন্যান্য মশলা বাইরে থেকে আসত।
বিনোদন
রাজারা রাজসভায় অবসরমত নর্তক নর্তকীদের নাচগান উপভোগ করতেন। তবে পেশাগতভাবে নর্তক ও গায়কেরা সম্মানিত ছিল না। কবি ও পণ্ডিতেরা রাজসভায় আসতেন, গুণগ্রাহী রাজা তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। রাজা অবন্তিবর্মার রাজসভা মুক্তাকণ, শিবস্বামী, কবি আনন্দবর্দ্ধন, রত্নাকর প্রভৃতি বিখ্যাত গুণীজন অলঙ্কৃত করতেন। অভিজাতরা তাম্বুলচর্বণ অর্থাৎ পান চিবোনো, এবং মদ্যপান করতেন। রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপীড় মদ্যপানের নেশায় বোধশূন্য হয়ে পূর্বতন রাজার নির্মিত শহর প্রবরপুর নগর জ্বালিয়ে দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। যদিও এই কারণে পরে তাঁর অনুশোচনা হয়। রাজা হর্ষ দিনের অর্ধেক ভাগ শেষ হলে ঘুম থেকে উঠতেন, আর রাতের বেলা হাজারো প্রদীপে উজ্জ্বল নাট্যশালায় নাচ দেখতেন অনেক রাত পর্যন্ত, না হলে কবিদের কবিতা শুনতেন। হর্ষ নিজেও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। কল্হনের কাকা কনক তাঁর কাছে গান শিখতেন। এবং আশ্চর্যের বিষয়, শিক্ষার্থী গুরুকে কিছু দেননি, উলটে কনককে রাজা এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিয়েছিলেন! সাধারণ লোকের জন্য দুটো সর্বজনীন উৎসবের খবর পাই, জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশীতে তক্ষকের উৎসব, আর শিবচতুর্দশী।
তবে বিনোদন মাত্র কাব্য সঙ্গীত নৃত্যকলা এবং উৎসবে সীমাবদ্ধ ছিল না। সাধারণের এক বড় বিনোদন ছিল গুজব শোনা ও প্রচারে। অষ্টম তরঙ্গে কল্হন সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা গুজব রটনা করে তাদের সম্পর্কে এক তীক্ষ্ণ অথচ সরস বর্ণনা দিয়েছেন। রাজা সুস্সলের রাজত্বের প্রথম দিকে তাঁকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করে বিদ্রোহী ডামর ও সামন্তেরা পূর্বতন রাজা হর্ষের পৌত্র নির্বাসিত ভিক্ষাচরকে ফিরিয়ে আনে, ভিক্ষাচর তাদের সাহায্যে কাশ্মীরে এসে পৌঁছন। তাঁকে তখন পর্যন্ত রাজ্যবাসী দেখেনি, তবে নাম ও পরিচয় শুনেছিল। কোনো রাজার প্রতিই তাদের তেমন ভক্তি ছিল না, তবে সেটা তাদের দোষ বলা যায় না, রাজারা প্রথম প্রথম সুশাসন দেখালেও ধীরে ধীরে অত্যাচারীতে পরিণত হতেন। ভিক্ষাচর এসে পড়েছেন শুনে ‘কর্ণোপকর্ণিকা’ অর্থাৎ কানাকানি চলতে লাগল, ‘তিনি (ভিক্ষাচর) অসংস্কৃত কথা বলেন না, একটি শরে দশটি শিলা ভেদ করতে পারেন, ক্লান্ত না হয়ে একশত যোজন চলতে পারেন’—এমন কী সমস্ত ‘লম্বকূর্চ পলিতকেশ’—লম্বাদাড়ি পাকাচুল বুড়োরাও এইসব বলে লোকের কৌতুক উৎপাদন করল। যাদের রাজকাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই তারাও এমনভাবে কথাগুলো বলছিল যেন রাজ্যের অর্ধেক ভাগ পাবে—যেমন নদীতীরের স্নানঘরে স্নান করে আসা অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ রাজপুরুষেরা, প্রাসাদবাসী অগণিত নামেমাত্র রাজকুমার, ভাল ঘোড়া পেতে ইচ্ছুক দুষ্ট যোদ্ধা, শিষ্যদের নখ দ্বারা পশ্চাদ্দেশ কণ্ডুয়নকারী উপাধ্যায়বর্গ, দেবমন্দিরের পালিকা বৃদ্ধা নর্তকীকুল, অন্যের জমা টাকা গ্রাস করা মহাজন যারা শাস্ত্রপাঠ শুনে ধর্মের ভান করে, অনশনপটু ব্রাহ্মণেরা, নগর প্রান্তবাসী ডামরেরা যাদের দেখে কৃষক বেশি যোদ্ধা কম মনে হয়—এই সব ধরনের মানুষ দেশে রাষ্ট্রবিপ্লব প্রিয় এবং দ্রোহবার্তা প্রচার দ্বারা স্বকীয় ও পরকীয় প্রীতি উৎপাদন করে থাকে।’ (৮ম তরঙ্গ, ৭০৩-৭১০)
উপসংহার
বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভারতভ্রমণের প্রথম দুবছর কাল কাশ্মীরে বৌদ্ধশাস্ত্র শিক্ষার জন্য অবস্থান করেছিলেন। সেই সময় তিনি কাশ্মীরের মানুষের কথা যা লিখেছিলেন, সেটাই প্রথম অকাশ্মীরী কারো চোখে কাশ্মীরীদের ব্যাপারে কিছু লেখা। বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক Sir M A Stein তাঁর বই Kalhan’s Rajatarangini – a Chronicle of the Kings of Kashmir এর ভূমিকায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন,
The inhabitants seem to have changed as little as the soil since Hiuen Tsiang's days. It is still easy to recognize in them the people whom he described as "light and frivolous, and of a weak, pusillanimous disposition. The people are handsome in appearance, but they are given to cunning. They love learning and are well instructed.”… “Since centuries learning has been held in great respect in this kingdom," and Huen Tsang dwells with evident pleasure on the recollection of the Iearned conferences he had with the Kashmir doctors of the sacred law.
(Introduction, Sec. ii. Chinese Record, Kalhana’s Rajatarangini, M.A.Stein]
রাজতরঙ্গিণীতে বর্ণিত সমকালীন কাশ্মীরের রাজা সহ জনগণের চরিত্র অনুধাবন করলে এই ধারণা মিথ্যে মনে হয় না।
———————
উৎস
Kalhana’s Rajatarangini; Sir M. A. Stein
রাজতরঙ্গিণী (সংস্কৃত); পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ সম্পাদিত
কবিবর কল্হন প্রণীত রাজতরঙ্গিণী (বাংলা); অধ্যাপক হরিলাল চট্টোপাধ্যায়