• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গল্প
    Share
  • ভূতের লেখা : অনিরুদ্ধ সেন

    আড়চোখে তাকিয়ে দেখল তাপস, নীহার তার খাতা দেখে ঝেড়ে টুকছে।

    অথচ নীহার নাকি ফার্স্ট বয়। ম্যাথস, সায়েন্স, ইংলিশে প্রায় ফুল পায়। আর তাপস টেনেটুনে থার্ড এলেই বাড়িতে উৎসব। তবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ব্রাইট বয় নীহারের ‘বাংলাটা ঠিক আসে না।’ অন্যদিকে মাথায় অঙ্ক, বিজ্ঞান না ঢুকলেও বাংলা তাপসের প্রিয় বিষয়। পাঠ্য, অপাঠ্য যে কোনো বাংলা বই পেলেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফেলে। তার লেখার হাত ভালো, বাংলায় নম্বরও ভালোই পায়। তাই ফার্স্ট বয় নীহার পরীক্ষার সময় সুযোগ পেলেই তাপসের থেকে ঝাড়ে। তাদের রোল নাম্বার কাছাকাছি হওয়ায় সে সুযোগও যথেষ্ট।

    আর শতদল স্যারও তেমন একচোখা। ‘ওপেন ডে'তে যখন তিনি খাতা দেবেন, বেছে বেছে নীহারের খাতার থেকেই রচনাটা পড়বেন। “দ্যাখ, আর শেখ! ছেলেটার বাবা আইএএস, বাড়িতে বাংলা কালচার নেই বললেই চলে। তবু এই স্কুলে এসে ক'বছরে কী উন্নতিটাই না করেছে! শোন, কী ভাব আর ভাষা!” তারপর তিনি যা পড়বেন, সেটা ঐ তাপসের থেকে ঝাড়া মাল।

    অথচ তাপসের খাতা থেকে তিনি কখনো পড়েন না। দোষের মধ্যে, তাপসের হাতের লেখাটা তেমন সুবিধের নয় আর নীহারের গোটা গোটা লেখা পড়তে কোনো অসুবিধে হয় না। তাপসের সন্দেহ, তার খাতা স্যার ভালোভাবে না পড়েই ওপর ওপর দেখে নম্বর দিয়ে দেন।

    তবু তাপস বন্ধুত্বের খাতিরে নীহারকে টুকতে বাধা দেয় না। নীহার মূলত বাংলা রচনাটাই তাক করে, কারণ ওটা ‘আনসীন’। বইয়ের প্রশ্নগুলো ‘গুড বয়’ বারবার পড়ে কোনোমতে গিলে উগরে দেয়। অথচ তার বদলে অঙ্ক পরীক্ষায় উত্তর মেলাতে যাও, হিংসুটেটা না শোনার ভাণ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকবে।

    বাছাধনকে একবার টাইট দিতে হচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? অনেক ভেবে তাপসের মাথায় একটা ফন্দি এল।

    ***

    আবার এক ওপেন ডে। শতদল স্যার যথারীতি নীহারের খাতা খুলে ‘বর্ষার কবি রবীন্দ্রনাথ’ রচনা পড়তে শুরু করলেন। কিছুটা পড়েই তিনি খুশি খুশি মুখে বললেন, “বাঃ, কোটেশন দিয়েছিস দেখছি! এক্কেবারে মানানসই! সবাই শোন,

    “গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

    নিমতলা – অ্যাঁ – (গলা নামিয়ে) নিমতলা বসে আছি, গুরু ভরসা। বাবা, এসব কী লিখেছিস?”

    ক্লাসজুড়ে বিস্মিত মুখ চাওয়া-চাউয়ি। নীহার আড়চোখে তাপসের দিকে তাকাচ্ছে। তাপস নিরীহের মতো বলল, “মিস্টেক, স্যার। আসলে কবিগুরুর দাহটা নিমতলায় হয়েছিল কিনা, তাই গুলিয়ে ফেলেছে।”

    সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে স্যার পড়তে লাগলেন,

    “রাশি রাশি এল –” হঠাৎ স্যার সশব্দে খাতাটা বন্ধ করে রাখলেন। কিন্তু ক্লাসে ততক্ষণে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে, “পড়ুন স্যার, পড়ুন। কমপ্লিট করুন।”

    গণদাবীতে স্যার শেষে খাতাটা আবার তুলে নিলেন:

    “রাশি রাশি এল মড়া,

    নদীতে ভাসিল ঘড়া,

    আঁধারে ছিলিমভরা গাঁজা চরসা।

    কাটিতে কাটিতে কাঠ রাত ফরসা।”

    ক্লাস ততক্ষণে ডিলিরিয়াস। শেষ অবধি স্যার হাতুড়ির অভাবে টেবিলে ঘুষি মেরে 'অর্ডার, অর্ডার’ বলে চেঁচিয়ে ক্লাস কন্ট্রোলে আনলেন।

    নীহারের চোখমুখ লাল, কোপকটাক্ষে তাপসের দিকে চাইছে অথচ কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু ওর বেস্ট ফ্রেন্ড শান্তনু হাণ্ডি ফাঁক করে দিল, “স্যার, আসলে নীহার তো বাংলায় তেমন স্ট্রং নয়, তাই তাপসের থেকে এট্টু হেল্প নিয়েছিল। সে যে এমন ডোবাবে – নইলে আপনিই বলুন, ও কি এসব ইয়ার্কি মারার ছেলে?”

    “হেল্প, মানে, পরীক্ষাটা কি তামাসা নাকি?” স্যার কটমটিয়ে তাপসের দিকে তাকালেন।

    “আমার কী দোষ, স্যার? বাংলার দিন তো আপনি গার্ড ছিলেন। আমার সীট ফার্স্ট বেঞ্চে আপনার চোখের সামনে, ওখানে বসে হেল্প করা যায়? তবে পেছন থেকে কেউ যদি আমারটা দেখে টোকে, আমি কী করব?”

    স্যার ভাবছেন। লাস্ট বেঞ্চ থেকে কে যেন বলল, “স্যার, তাপসের খাতাটাও দেখুন।”

    “হুঁ!” স্যার খুঁজেপেতে তাপসের খাতা বের করলেন। “ইস, হাতের লেখার কী ছিরি! তার মধ্যে গাদাগাদা কাটাকুটি।” অনেক কষ্টে তিনি পড়তে শুরু করলেন:

    “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে,

    জলসিঞ্চিত ক্ষিতি-সৌরভ-রভসে,

    ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা,

    শ্যামগম্ভীর সরসা।

    বাঃ! কিন্তু এ তো একেবারে আলাদা কোটেশন, বর্ষার গান। তবে?”

    তারপর একটু থেমে নীহারের দিকে চেয়ে বললেন, “তোর কবিতার হাতটা ভালো। কিন্তু বাবা, ঐ শ্রদ্ধেয় মানুষটাকে নিয়ে ভবিষ্যতে ছেলেখেলা করতে যাস না।”

    নীহার সেদিন আর মুখ তুলে চাইতে পারল না। ছুটির সময় তাপসের দিকে এমনভাবে তাকাতে তাকাতে গেল যে আগেকার যুগ হলে সে ভস্ম হয়ে যেত।

    আর তাপস নিজের মনে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরল। ঐ ছড়াটা নীহারের টোকা হয়ে গেলে সে সম্পূর্ণ কেটে ঐ বর্ষার গানটা লিখে দিয়েছিল।

    তাপসের বেস্ট ফ্রেন্ড দ্বৈপায়ন অবশ্য ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করেছিল। বলেছিল, “নীহারের সঙ্গে অমনটা করলি, দেখিস ও ঠিক ওর বাবাকে বলে তোকে কেস খাওয়াবে।”

    “দ্যুৎ! সৎ আর নিয়মনিষ্ঠ অফিসার বলে কাকুর বাজারে সুনাম আছে। ব্যাপারটা ওঁর কানে গেলে নীহারের দুঃখ আছে।”

    ***

    অ্যাদ্দিন পর স্কুলবেলার এই কেচ্ছাটা মনে পড়ল, কারণ কাগজে আজ নীহারের ফটো বেরিয়েছে। বাপের সুযোগ্য সন্তান নীহার আইএএস হয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটা জেলার দায়িত্ব নিয়েছে। আর তাপস? বাংলায় স্ট্রং ছেলেটার ইচ্ছে ছিল চাকরিবাকরি না জুটলেও অন্তত সাহিত্যিক হয়ে আহামরি না হোক সংসার চালাবার মতো রোজগার করবে। কিন্তু শেষ অবধি হল কিনা ‘ছায়ালেখক’ বা ঘোস্ট রাইটার! সেটুকুও বরাতজোরেই বলা যায়।

    তখন সে একটা প্রাইভেট স্কুলে বাংলা পড়াচ্ছে। স্কুলটা নড়বড়ে। কখনো মাইনে দেয় কখনো দেয় না। তবে ইংলিশ মিডিয়াম। তাই ছাত্রদের অনেকেরই বাংলায় নজর নেই, কোনোমতে পাশ করলেই চলবে। তার মধ্যেও কয়েকজন বাংলা ভালো করে শিখতে চায়। আশ্চর্য, তাদের দু-একজন অবাঙালি। তাপস তাদের যত্ন করে বাংলা শেখায়।

    আর অবসর সময়ে সে গল্প লেখে। ছোটদের জন্য, বড়দের জন্য। সেগুলি বিভিন্ন পত্রিকা আর ওয়েব ম্যাগাজিনে পাঠায়। কিছু প্রকাশিত হয়, বেশিরভাগই হয় না। প্রকাশিত হলেও পয়সা জোটে না।

    এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন তার একটা গল্প এক প্রচলিত পত্রিকায় ছাপা হবার জন্য সে পাঁচশোটা টাকা পেল। টাকাটা সামান্য, কিন্তু লিখে রোজগারের তৃপ্তিই আলাদা। উৎসাহ পেয়ে তাপস লেখায় জোর দিল। দারুণ না হলেও কিছু টাকা আসতে লাগল। তার চেয়ে বড় কথা, সাহিত্যিক মহলে কিছুটা পরিচিতি হল।

    তার স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড দ্বৈপায়ন এখনো তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সে এইসময় একদিন তাপসকে বলল, “ঘরের খেয়ে বনের মোষ আর কদ্দিন তাড়াবি? এখন হয় লেখার ভূতকে ঘাড় থেকে নামা, নয় দেখ কী করে লেখাটাকেই প্রফেশন করতে পারিস।”

    “লেখা এখন আমার নেশা, ছাড়তে পারব না। লিখে খুচখাচ কিছু হচ্ছে। সেটা আরেকটু বাড়লেই স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে ওদিকে ফুল টাইম দেব।”

    “পারবি না। বাংলা সাহিত্যের ছোট্ট পুকুরে আজ বোধহয় পাঠকের চেয়ে লেখক বেশি। তুই গুঁতোগুঁতি করার পাবলিক নোস, এগোতে পারবি না – যদি না একটা খুঁটি থাকে।”

    “খুঁটি কি চাইলেই মেলে?”

    “অসম্ভব নয়। বাংলায় এমন খুব কম সাহিত্যিকই আছেন যাঁরা শুধু লিখে খাচ্ছেন। সেই অল্প ক'জনের মধ্যে কারো কাছে তোর নাড়া বাঁধতে হবে। হয়তো ছোটখাটো ফাইফরমাশ খেটে দিতে হবে। আর এখন অনেক বয়স্ক লেখকই কম্পিউটারে স্বচ্ছন্দ নন। তাঁদের লেখা হয়তো তোকে কম্পিউটারে উপযুক্ত ফর্মাটে টাইপ করে দিতে হবে। পারবি?”

    “পারব। একজন গুণী মানুষের সাহায্য হয়, এমন কাজ আমি খুশিমনে করে দেব।”

    “তারপর তিনি হয়তো একটু একটু করে সুতো ছাড়তে থাকবেন। কী করে লেখাকে বাজারে চালানো যায়, কিছু হিন্টস দেবেন। হয়তো এখানে সেখানে তোর নাম রেকমেন্ড করবেন। এভাবে তাঁকে ধরে তুই উঠবি। একদিন হয়তো তাঁকেও ছাড়িয়ে যাবি।”

    “কিন্তু সেই ‘তাঁকে’ ধরব কীভাবে? বাড়ির সামনে গিয়ে হত্যে দেব?”

    “দূর! কোনো লাইন না থাকলে কি আমি তোকে বলেছি? কথাসাহিত্যিক মৃদুল দস্তিদারের নাম শুনেছিস?”

    “হ্যাঁ, হ্যাঁ।” তাপস নড়েচড়ে বসল, “বেস্ট সেলার লেখক। ছোট, বড় সবার জন্য অগুন্তি লিখে চলেছেন।”

    “আমার সম্পর্কিত জ্যাঠামশাই। দেখি, বাবাকে বলে ওঁর সঙ্গে তোর যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া যায় কিনা। হ্যাঁ, তোর ‘রাইটার্স বায়ো'টা তৈরি রাখিস।

    দ্বৈপায়ন কথা রেখেছিল। সুতরাং তাপস এক সন্ধেয় দুরু দুরু বুকে মৃদুল দস্তিদারের সামনে।

    “দীপু (দ্বৈপায়নের ডাকনাম) আমায় তোমার কথা বলছিল। আমার সেক্রেটারি অঞ্জনের থ্রুতে তোমার কিছু লেখা আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি। মন্দ নয়, তোমার মধ্যে সম্ভাবনা আছে। তবে তুমি একটু অপরিশীলিত। আমি প্রতি শুক্রবার সন্ধে ছ'টায় তোমাকে ঘণ্টাখানেক করে সময় দেব। চলবে তো? আচ্ছা, আজ তবে এস। সামনের শুক্রবার তোমার অপ্রকাশিত দুটো গল্প নিয়ে আবার আসবে।”

    খুশির বাষ্পে ভাসতে ভাসতে ফিরল তাপস। শুক্রবার যথাসাধ্য ভালো দুটো গল্প নিয়ে সে মৃদুলের দপ্তরে গেল। উনি লেখার ব্যাপারে তাঁকে কিছু উপদেশ দিলেন। তার বেশিরভাগই তাপসের মাথার ওপর দিয়ে গেল। তবে তিনি লেখাদুটো রেখে দিয়ে আবার আসতে বললেন।

    তারপর তাপস যখন আবার গেল, তিনি মৃদু হেসে বললেন, “তোমার লেখাদুটো দেখেছি। ‘জোয়ার’টা বেশ। তুমি ওটা ‘গল্পসল্প’ পত্রিকায় পাঠাতে পারো। আর ‘কাঁচঘর'টাতে একটু হাত লাগাতে হবে। এটা আপাতত আমার কাছে রইল।”

    এত বড় সাহিত্যিক তাঁর লেখা এডিট করছেন জেনে তাপস অভিভূত। তার অবশ্য ধারণা ছিল ‘কাঁচঘর'টাই ভালো। তবে অভিজ্ঞ সাহিত্যিক নিশ্চয়ই বেশি বোঝেন।

    সত্যিই ‘গল্পসল্প’তে পাঠাবার পর তারা ‘জোয়ার’ ছাপল, যদিও সম্মানমূল্য বিশেষ জুটল না। ‘কাঁচঘর’ নিয়ে অবশ্য মৃদুল নীরব। ইতিমধ্যে আরো কিছু লেখাও সে মৃদুলের কথামতো জমা দিয়েছে আর অপেক্ষায় আছে।

    শেষে তাপস একদিন অধীর হয়ে জিগ্যেস করেই ফেলল, “স্যার, আমার ‘কাঁচঘর'টা--”

    “যাওয়ার সময় অঞ্জনের কাছে খোঁজ করে যেও।” বলেই তিনি একটা পাণ্ডুলিপিতে মন দিলেন।

    সেক্রেটারি অঞ্জনকে জিগ্যেস করায় সে মৃদু হেসে একটা পত্রিকা তাপসের দিকে ঠেলে দিল। ‘স্বদেশভূমি’ – তাপসের বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন নামী পত্রিকায় তার লেখা! সূচিপত্র ঘেঁটে কিন্তু সে নিজের নাম পেল না। তবে মৃদুল দস্তিদারের গল্প ‘গ্লাস সিলিং’ রয়েছে। কী সন্দেহ হওয়ায় উল্টে দেখল, এ তারই ‘কাঁচঘর’, শুধু কিছু নামধাম পাল্টানো হয়েছে মাত্র!

    অঞ্জনের দিকে তাকাতে সে একটা খাম এগিয়ে দিল। খুলে দেখল, দু'হাজার টাকা।

    “স্বদেশভূমিতে আপনার লেখা কোনোদিন যেত? আপনাকে কে চেনে? স্যারের নাম থাকায় আপনার লেখা এই পত্রিকায় ছাপাতে পারলেন। আর ঐ পত্রিকায় অযাচিত লেখা দৈবাৎ ছাপা হলেও ওরা এই রেটই দেয়। আপনি তো লিখে টাকা করতে চাইছিলেন?”

    তাপসকে ফ্যালফেলিয়ে চাইতে দেখে অঞ্জন বলল, “আপনি চেনাজানায় এসেছেন, তাই স্যার বলতে লজ্জা পাচ্ছিলেন – স্যারের হয়ে লেখার জন্য একজন ‘ঘোস্টরাইটার’ দরকার। এত লেখার বরাত, তিনি নিজে সামলাতে পারছেন না। তা, এই কাজ করার জন্য দলে দলে উঠতি ছোকরা ঘুরছে। আপনি রেকমেন্ডেশনে এসেছেন আর – চুপি চুপি বলছি, আপনার লেখা স্যারের মনে ধরেছে। বেগড়বাই না করে লেগে থাকুন, আপনার হবে!”

    ***

    সুতরাং, তাপস লেগে আছে। এখন মৃদুল খোলাখুলিই তাকে বলছেন তাঁর হয়ে কী ধরণের, কী স্বাদের, কত দৈর্ঘ্যের গল্প লিখতে হবে। কালক্রমে তাপস একটা উপন্যাস লেখার বরাতও পেল। এসবের জন্য তিনি ভালো দক্ষিণাই দেন। তাঁর লেখা চড়া দামে বিক্রি হয়, তার একাংশও তাপসের আশাতীত। নিজে লিখে এত রোজগার কোনোদিন করতে পারত না।

    মৃদুলের লেখা, মানে তাপসের লেখা, প্রশংসা পায়। আর তাপস অস্থির উত্তেজনায় ছটফট করে। মৃদুল অবশ্য তাপসের কিছু লেখাও বিভিন্ন জায়গায় ছাপাবার ব্যবস্থা করে দেন। তবে এখন তাপস বোঝে, সেগুলো অপেক্ষাকৃত নিরেস লেখা। গুরুর নজর আছে, তাঁর চেলা বা ‘ভূত’ যেন তাঁকে ছাপিয়ে না যায়।

    মৃদুলের অবশ্য বয়স বাড়ছে, লেখার জোশও ক্রমে কমছে। তাপসের প্রয়োজনীয়তাও তাই বাড়ছে। কিন্তু কোনোদিন যে ছায়ার থেকে বেরিয়ে কায়া হতে পারবে, ভরসা নেই।

    যদি না সে নিজে জোর করে কিছু করে। কিন্তু করবেটা কী? একেক বার ইচ্ছে হয় চেঁচিয়ে সবাইকে বলে – তোমরা যে লেখার প্রশংসা করছ তা আমার, আমি এক উদীয়মান সাহিত্যিক। কিন্তু বৃদ্ধ মৃদুলের আজও যা ক্ষমতা, তাপসকে কেউ বিশ্বাস করবে না। বরং লেখক হিসেবে সে ‘ব্ল্যাক লিস্টেড’ হয়ে যাবে।

    এইসব চিন্তায় তার যখন রাতে ভালো ঘুম হয় না, হঠাৎ কিছু আশ্চর্য ঘটনা পরম্পরায় অবস্থার মোড় ঘুরল।

    ***

    তাপস এক সাহিত্যসভায় গল্প পড়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবীণ অফিসার ধূর্জটি সেন প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। তাপসকে দেখেশুনে তিনি বললেন, “এমন স্মার্ট ছেলে, তোমার তো আরো অনেক দূর যাওয়ার কথা!”

    সহানুভূতির ছোঁয়ায় তাপস তার সব কথা মানুষটিকে বলে ফেলেছিল, ‘ঘোস্টরাইটার'এর ব্যাপারটা সহ। শুনে তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, “আগে না দেখলেও তোমাকে আমি চিনি। তোমার ক্লাসফ্রেন্ড নীহারকে মনে পড়ে?”

    “হ্যাঁ। ও তো এখন জেলাশাসক।”

    “আমি ওর বাবা। তুমি একবার ছড়া লিখে ওকে কীভাবে নাকাল করেছিলে, তাও আমি জানি।”

    “কাকু!” তাপস তটস্থ হয়ে বলেছিল।

    “ওর এক বন্ধু আমাকে ব্যাপারটা বলেছিল। ভেবেছিল, তোমাকে আমি উচিত শিক্ষা দেব। কিন্তু আমি উল্টে নীহারকে ডেকে বলেছিলাম, ‘হতভাগা, তুই কী টুকছিস তার মানে বুঝলি না? তোর উচিত এসব না করে তাপসের হাতেপায়ে ধরে বাংলা শেখা। তা যখন পারবি না, আমিই যেভাবে হোক রোজ একঘণ্টা সময় বের করে তোকে বাংলা শেখাব।’ ভাগ্যিস ও শিখেছিল। তাই তো আজ একটা জেলা, যেখানে লোকে বাংলা ছাড়া কিছু জানে না, তার দায়িত্ব অনায়াসে সামলাচ্ছে।”

    একটু থেমে বললেন, “তবে নীহারকে যেমন বলেছিলাম ইংরেজির সঙ্গে বাংলা শিখতে, তোমাকেও বলছি বাংলার সঙ্গে ইংরেজিতেও লেখো। ছোট পুকুর থেকে বড় ঝিলে যাও।”

    “এ বয়সে আমি কি পারব, কাকু?”

    “পারবে। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়েছ, পড়াচ্ছ – আমার বিশ্বাস তুমি ইংরেজি ভালোই জানো, শুধু লেখার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসটা নেই। প্রচুর ইংরেজি পড়ো, লেখো। কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হাত খুলে যাবে।”

    ***

    তারপর বছর দুই কেটেছে। তাপসকে মৃদুল সম্প্রতি একটা বড় গল্প লেখার বরাত দিয়েছেন। তাপস তরতরিয়ে লিখছে আর তার মুখে ফুটে উঠছে মৃদু হাসির রেখা।

    এর আগের অর্ডারটা ছিল একটা ভূতের গল্পের। মৃদুল ছকটা বলে দিয়েছিলেন – গল্পটায় ভূতটা সাজানো। কিন্তু যারা সাজিয়েছিল তারা যখন সবাইকে ভয় পেতে দেখে হাসাহাসি করবে তখন তাদের সামনে আসল ভূত হাজির হবে।

    “স্যার”, তাপস মাথা চুলকে বলেছিল, “এই আইডিয়াটা নিয়ে অজস্র গল্প লেখা হয়েছে। এখনও তো ‘পিজ্জা’ বলে একটা তামিল মুভি আর তার বাংলা ভার্সন বাজারে চলছে।”

    “অত ভাবলে চলে?” মৃদুল উড়িয়ে দিয়েছিলেন, “আজ অব্দি নিশ্চয়ই কোটি কোটি গল্প লেখা হয়েছে। তাদের সবাইকে এড়িয়ে নতুন প্লট তুমি পাবে কোত্থেকে? ঐ পুরোনোর ওপরই কিছু আধুনিকতার রঙ চড়াও।”

    তাপস ঘাড় নেড়ে চলে এসেছিল। তারপর ‘এপার ওপার’ নামে এক জম্পেশ ভূতের গল্প লিখে এনেছিল, যাতে এ-আই, ডীপ ফেক, হলোগ্রাফি সব আছে।

    “বাঃ, দারুণ হয়েছে।” খুশি হয়ে বলেছিলেন মৃদুল, “এটা অঞ্জনকে দিয়ে তোমার পেমেন্টটা নিয়ে যেও।”

    এই সময় তাপস ফস করে বলে বসেছিল, “স্যার, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?”

    মৃদুল কিছু বলার আগে হঠাৎ লোড শেডিং হয়ে গিয়েছিল। দু মিনিটের মধ্যে ইনভার্টার অন হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেই তাপস দেখেছিল, মৃদুল ঘামতে ঘামতে বুকে ও কপালে হাত ঠুকে যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির ক্ষমাভিক্ষা করছেন।

    ***

    তাপস তার, মানে মৃদুলের বড় গল্প ‘শেষ নাহি যে’ শেষ করে মৃদুলকে দেখাল। উনি সাধারণত প্রথমটা আর শেষটা দেখেন। মাঝেরটায় উনি চোখ বোলান। অধিকাংশ পাঠকও তাই করে। এটার মশলা অবশ্য ছোটগল্পের। তবু মৃদুলের নির্দেশে টেনে বড় করতে হল। ছোট ও বড় গল্পের পেমেন্ট আলাদা।

    “বাঃ, শেষটা চমৎকার হয়েছে।” মৃদুল উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়তে লাগলেন:

    “শূন্য ঘরে লুটিয়ে পড়ে অনিন্দ্য হাহাকার করে উঠল, ‘শ্রেয়া, তুমি আমায় ছেড়ে গেলে? যেতে পারলে?’ সঙ্গে সঙ্গে যেন বেজে উঠল এক রিনিরিনি কণ্ঠস্বর, ‘ছিঃ, পুরুষমানুষের কি কাঁদতে আছে? জানো না, আমরা যাই শুধু ফিরে আসার জন্যে?’

    দারুণ, দারুণ খাবে এটা!”

    হ্যাঁ, স্যার জানেন কীসে ভালো ‘খায়’। এবারেও বলে দিয়েছিলেন, পরপর মিলনান্তকে পাঠক হাই তোলে। এটায় অন্যরকম কিছু চাই। তবে ঐ প্যানপেনে কান্না নয়, শেষে একটু নরম ছোঁয়া। তাই তাপস সেই রেশটুকু রেখেছে।

    “তাহলে, এবার আসি? আপনি ‘স্বদেশভূমি’তে ফাইলটা পাঠাতে পারবেন তো?”

    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারব।” ডেস্কটপে খোলা ফাইলটা দেখে মৃদুল বললেন, “বাঃ, ফরোয়ার্ডিং লেটারটাও অ্যাটাচ করে দিয়েছ!”

    “আপনার অবশ্য দরকার হয় না –”

    “তবু আমি ফর্মালিটি মেইনটেইন করা পছন্দ করি। বেশ, এস।”

    ***

    দিন পনেরো পর। তাপস প্রত্যাশিতভাবেই মৃদুলের কল পেল। তুলতেই তাঁর আর্তস্বর, “এসব কী বেরিয়েছে? কী লিখেছ তুমি আমার, মানে তোমার, মানে আমার গল্পের উপসংহারে?”

    “কী, স্যার? আপনি তো পড়ে খুব প্রশংসা করলেন।”

    “কোথায়! শোনো, কী বেরিয়েছে:

    শূন্য ঘরে লুটিয়ে পড়ে অনিন্দ্য হাহাকার করে উঠল, ‘ওগো আমার প্রাণেশ্বরী, কেন দিলে গলায় দড়ি?’ সঙ্গে সঙ্গে যেন বেজে উঠল এক রিনিরিনি কণ্ঠস্বর, ‘রঁক্ত খাঁব, মাঁংস খাঁব, মুঁণ্ডুটা তোঁর চিঁবিয়ে খাঁব।’

    গল্পের তো পিণ্ডি চটকে গেছে। লোকে ছি ছি করছে, মিম ছাড়ছে। বলছে বুড়োর ভিমরতি ধরেছে, এবার ছাড়লেই পারে।”

    “নিশ্চয়ই টাইপসেটিংয়ের সময় কেউ বদমায়েশি করেছে। সোজাপথে তো আপনার সঙ্গে পেরে ওঠে না, তাই –”

    “আমিও তাই ভেবে সম্পাদক দুর্নিবার বাবুকে ঝাড়লাম। উনি পরদিনই ছুটতে ছুটতে এসে দেখিয়ে গেলেন, আমার স্ক্রিপ্টেই ওসব লেখা ছিল। বললাম, ‘এই আপনাদের সাহিত্যবোধ? দেখে বুঝলেন না কিছু গড়বড় হয়েছে?’

    ‘বুঝলেই বা!’ উনি ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘মৃদুল দস্তিদারের লেখায় হাত লাগায় কার সাধ্যি? আপনারা কতরকম হেঁয়ালি করে লেখেন।’ ”

    “কিন্তু স্যার, সেদিন আপনাকে লেখা দেখিয়ে, অ্যাপ্রুভ করিয়ে আমি চলে গেলাম। তারপরেই তো আপনি ফাইলটা পাঠিয়ে দিলেন?”

    কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর মৃদুল বললেন, “হ্যাঁ।”

    “তবে?” তাপসও যেন কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “বুঝেছি স্যার, ভূত!”

    “অ্যাঁ?”

    “ ‘এপার ওপার’ লেখার আগেই আমি আপনাকে বলেছিলাম, কাজটা ভালো হচ্ছে না। ঐ নকলি ভূত নিয়ে গল্প ফাঁদতে গিয়ে আমরাও আসলি পেত্নির খপ্পরে পড়েছি, ইন্টারনেট পেত্নি।”

    “থামো!” মৃদুল চটচলদি ফোন ছেড়ে দিলেন। তাপস মনশ্চক্ষে দেখল, তিনি ঘামতে ঘামতে কপালে, বুকে হাত ঠুকে কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে ক্ষমা চাইছেন।

    ***

    আসলে ফাইলটা তখনই পাঠিয়েছিলেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে মৃদুলের দ্বিধার মধ্যেই এই ভূতের রহস্য নিহিত। তিনি ফাইলটা পাঠাবেন, হঠাৎ এক কৃষ্ণাঙ্গী সুন্দরী হাঁফাতে হাঁফাতে তাঁর ঘরে ঢুকে বলেছিল, “ব্যস্ত, স্যার? প্লীজ, দু'মিনিট। আমি আপনার ‘প্রান্তর’ বইটায় একটা অটোগ্রাফ নেব।”

    প্রসন্ন হেসে মৃদুল বইটা টেনে সই করে দিয়েছিলেন। বয়স হলেও তাঁর ঐ ইয়ের দোষটা একেবারে যায়নি। সাহিত্যিক তো, তাই এখনো নবরসে টাবুটুবু। অনেক ভক্ত তাঁর দর্শনে আসে। গেটে সিকিউরিটিকে কায়দা করে বলা আছে, কোনো মহিলা এলে যেন তেমন জেরাসাবুদ না করেই ছেড়ে দেয়।

    “দুর্দান্ত আপনার উপন্যাসটা! আমি তো পড়েই ফিদা হয়ে গেছি। এ বইয়ের জ্ঞানপীঠ না হলেও আনন্দ তো পাওয়াই উচিত। শুধু কয়েকটি জায়গায় একটু খটকা লেগেছে।”

    “হ্যাঁ, বলো, কোথায়?” যৌবনের গন্ধে চনমন মৃদুল বলে উঠলেন।

    তারপর দুজনের চলল প্রগাঢ় সাহিত্যচর্চা। দু’মিনিটের জায়গায় ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। হঠাৎ মৃদুল বললেন, “এক্সকিউজ মী। একটু বোসো, আমি আসছি।”

    মেয়েটি মৃদু হেসে সম্মতি জানাল।

    হ্যাঁ, তাপস কুহেলিকে তেমনটাই বলেছিল। মৃদুলের একটু বয়সজনিত প্রস্টেটের দোষ আছে। ঘণ্টাখানেক টানতে পারলেই তাঁর ‘বাথরুম’ পাবে আর ডিসচার্জ করতেও বেশ সময় লাগবে। মৃদুলের অনুপস্থিতির সময়টুকুতেই তাপসের আগে থাকতে দেওয়া বিস্তারিত নির্দেশমতো সামনের খোলা ডেস্কটপে গল্পের ফাইলে দুটো ডায়ালগ এডিট করে দিতে কুহেলির কোনো সমস্যা হয়নি।

    ***

    কুহেলির সঙ্গে তাপসের সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে। ধূর্জটি সেনের পরামর্শমতো ইংরেজি পড়বে বলে তাপস ইদানিং প্রায় সন্ধেয় পাড়ার এক পাবলিক লাইব্রেরিতে যাচ্ছে। এক নিরালা কোণে বসে সে পড়ে আর নোট নেয়। আজকাল লাইব্রেরিতে বই পড়ার লোক কম। কিন্তু তাপস যখনই যায়, প্রায়ই একটি কৃষ্ণকলি একটু পরে কোনো বই নিয়ে তার উল্টোদিকে বসে পড়তে শুরু করে। আড়চোখে তাকিয়ে তাপস একদিন লক্ষ করল, সে শুধু মৃদুল দস্তিদারের বই পড়ে। কৌতূহলী তাপস জিগ্যেস করল, “আপনি বুঝি মৃদুল দস্তিদারের ফ্যান?”

    “হ্যাঁ, ওঁর লেখা আমার দা-রুণ লাগে।” মেয়েটি লাজুক হেসে বলেছিল। এই উপলক্ষ্যেই তাদের আলাপের দ্বার খুলে গেল। কিছুদিন পর এক দুর্বল মুহূর্তে তাপস মুখ ফস্কে মৃদুলের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটা বলে ফেলল।

    বলেই ভেবেছিল, মেয়েটি রেগেমেগে তাপসকে গালমন্দ করে কথা বলা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু সে বরং অবাক হয়ে বলল, “তাই বলুন! আমিও অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম ওঁর সব লেখা সমান নয়। এখন বুঝলাম।”

    এরপর তাপসের সঙ্গে মেয়েটির অর্থাৎ কুহেলির অন্তরঙ্গতা বাড়তে লাগল। এক সময় তাপসের মনে হল এ মেয়েকে মন খুলে সব বলা যায়।

    ধূর্জটি সেনের বিশ্বাসের মর্যাদা রেখে তাপস দু'বছরে ইংরেজি লেখায় ছোট হলেও একটা জায়গা করে নিয়েছে। কিছু পত্রপত্রিকায় কলাম লিখছে। এমনকি, এক নামী সংবাদপত্র আয়োজিত গল্প প্রতিযোগিতায় উচ্চ প্রশংসিত তার গল্প ‘অ্যানথলজি’তে স্থান পেয়েছে। তার সঙ্গে বাংলা লেখালিখি তো চলছেই।

    ধূর্জটিও তাকে একটা ভালো কন্টাক্ট ধরিয়ে দিয়েছেন, দূতাবাসের জন্য নিয়মিত ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজ। সব মিলিয়ে, ‘ভূতের বেগার’ আর না খাটলেও চলে।

    ধূর্জটির সর্বশেষ উপদেশ ছিল, “যদি কোনোদিন বাঁধন ছিঁড়তে পারো, চলে আসার আগে পারলে ভদ্রলোককে সামান্য ‘নীহার দাওয়াই’ দিয়ে এস।”

    কিছুদিন দ্বিধার পর তাপস মৃদুলকে সামান্য দাওয়াই দেওয়ার ইচ্ছেটা কুহেলির কাছে প্রকাশ করেছিল। শুনে কুহেলি মৃদু হেসে তাপসের সঙ্গে বসে এই ‘মাস্টার প্ল্যান’টা ফেঁদেছিল। আর সন্দেহ নেই, শেষ অবধি তা নিখুঁতভাবে ‘এক্সিকিউট'ও করেছে।

    কী লিখবে, এ ব্যাপারে তাপস ওকে স্বাধীনতা দিয়েছিল। মানতে হবে, মেয়েটার রসবোধ আছে।

    তবে ‘অপারেশন মৃদুল’এর পর একটা ‘থামস আপ’ মেসেজ দিয়েই কুহেলির লাপতা। লাইব্রেরিতে আসে না। ফোন করলে দেখা যাচ্ছে, ঐ নাম্বারটির অস্তিত্ব নেই। কিছু হল নাকি মেয়েটার?

    কুহেলির ঠিকানাও জেনে রাখা হয়নি। অনেক দ্বিধার পর তাই তাপস লাইব্রেরিয়ান বিশুদাকে জিগ্যেস করল, “দাদা, লাইব্রেরিতে কুহেলি নামে একটি মেয়ে আসত, তার ঠিকানা জানো?”

    বিশুদা খাতা দেখে বলল, “কুহেলি? না, ঐ নামে তো আমাদের কোনো মেম্বার নেই। তবে লাইব্রেরিতে যে কেউ এসে বসে বই পড়তে পারে। কিছু ছাত্রছাত্রী নোটবই দেখে নোট করতে আসে।”

    “ন্‌-না, ছাত্রী নয়। মানে, বাইশ-তেইশ বছরের একটি মেয়ে, বাংলা গল্প-উপন্যাস পড়ে।”

    বিশুদা অবাক হয়ে বলল, “সে কী, অত বুড়ো তো হইনি যে একজন জলজ্যান্ত যুবতী দিনের পর দিন আমার নজর এড়িয়ে আসবে যাবে! তা ভায়া, তুমি তো আবার গল্পটল্প লেখো। এক কোণে বসে খোয়াব টোয়াব দেখোনি তো? কেন, সে কি তোমার কোনো বই ঝেঁপে দিয়েছে, নাকি মন?”

    “না, না – অনেকদিন দেখা নেই, ভাবছিলাম অসুখবিসুখ করল কিনা।” লজ্জায় লাল তাপস এরপর কেটে পড়েছিল।

    তাপস তারপর আর কুহেলির হদিস পায়নি। মৃদুলের সিকিউরিটিতে খোঁজ করেও ‘অপারেশন মৃদুল'এর দিন ঐ সময়ে কোনো মেয়ের এন্ট্রি পায়নি। এক অস্তিত্বহীন ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ছাড়া তার সব চিহ্নই মুছে গেছে।

    মৃদুলকে তো ইন্টারনেট পেত্নির ঢপ দিয়ে দিল। তবে এবার ব্যাপারটা তাপসকেও একটু ভাবাচ্ছে।



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments