<
“এটা আমরা ঠিক করছি না।”
পূজারিণী প্রায় সীট ছেড়ে উঠে পড়ছিল। সম্রাট খপ করে ওর হাতটা টেনে বসিয়ে দিল।
“এতদূর এসে পিছিয়ে যাবে?”
সম্রাটের ঠোঁটে নিগূঢ় হাসি খেলা করছে। ওই হাসি পূজারিণী আগেও অনেকবার দেখেছে। প্রায় ঔদ্ধত্যের সীমানায় পৌঁছনো আত্মবিশ্বাসের হাসি – সম্রাট জানে, পূজারিণী ওর কোন কথা ফেলতে পারবে না।
পূজারিণী ইতস্তত করে। কী উত্তর দেবে তা ভাবার আগেই উর্দি-পরা বেয়ারা এসে মার্জিত স্বরে প্রশ্ন করল,
“ওয়াটার, স্যার? রেগুলার, না বটলড?”
সঙ্গে মেরুন চামড়ায় বাঁধানো দুটো মেনুও ধরিয়ে দিল। এরপর আর পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কথাটা ভেবে এক মুহূর্তের জন্য পূজারিণীর দম আটকে এল।
“বটলড ওয়াটার প্লিজ।” সম্রাট ওদের দু'জনের হয়ে অর্ডার করে দিল। বেয়ারা জল আনতে চলে গেল।
কোলকাতার নামী হোটেলের রেস্তোরাঁ। ক্রীম রঙের দেওয়াল। মেরুন পর্দা। তার সঙ্গে ম্যাচ করানো নরম সোফা। স্তিমিত আলো, মৃদু স্বরে কথা, মৃদু বাজনা। সবকিছু মিলিয়ে একটা আমেজ তৈরি হয়েছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর পূজারিণীর মন শান্ত হয়ে এল।
“পামি জানতে পারলে কিন্তু আমাদের দু'জনকেই খুন করে ফেলবে!”
সম্রাট হেসে ওঠে।
“আগে আমাকে খুন করবে। তুমি সেই সুযোগে পালিয়ে যেয়ো।”
সম্রাট ব্যাপারটা হাল্কাভাবে নিলেও পূজারিণী অতটা স্বচ্ছন্দ হতে পারে না। ও চায় না ওর আর পামি, মানে প্রিয়াঙ্কার, বন্ধুত্বের মাঝে অবিশ্বাসের ফাটল ধরে। অবশ্য এরকম চিন্তা করাটা ভণ্ডামি, কারণ জেনেশুনে বিশ্বাসঘাতকতাটা ও-ই করেছে।
“ভাগ্যিস তোমার পিকলু আমেরিকায় আছে,” সম্রাট ড্রিংকস মেনু খুলে চোখ বোলাতে থাকে, “নাহলে ডবল ধামাকা হয়ে যেত। পুরো কেস জন্ডিস যাকে বলে।”
পূজারিণী অল্প হাসে। কিছু বলে না। সম্রাট ওর দিকে মেনু এগিয়ে দেয়।
“দেখ, কী নেবে। নতুন কিছু ট্রাই করবে? নাকি ওই মার্গারিটা?”
মার্গারিটা পূজারিণীর ফেভারিট ককটেল। সম্রাট ওর কোন পছন্দ ভোলে না। অস্বস্তি কেটে গিয়ে সম্রাটের প্রতি ওর ভালোবাসা আবার গাঢ় হয়ে ফেরত আসে।
পূজারিণী গালে হাত দিয়ে ভাবে, প্রথম যেদিন দু'জনের দেখা হয়েছিল, তখনই ও যে কী মোহে পড়ে গেছিল! অফিসে প্রথম দিন। বাড়ি থেকে কলা আর পাঁউরুটি টিফিন নিয়ে এসেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে দেখে, কলার খোসা ফেলার ডাস্টবিন নেই। অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, এমন সময় কে যেন গম্ভীর গলায় বলল,
“আপনি আমার ডাস্টবিনে কলার খোসা ফেলতে পারেন।”
পূজারিণী তাকিয়ে দেখল – লম্বা, সুঠাম চেহারা, উঁচু নাক, বলিষ্ঠ হাত – ঠিক যেন কোন গ্রীক গড ওর সামনে দাঁড়িয়ে! ও তখনও জানত না যে আকর্ষণটা দু'দিকেই সমান ছিল।
“যারা এক অফিসে কাজ করে তাদের কতজনের প্রেম হয় বলো তো?” সম্রাট হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “প্রচুর কেস হবে, তাই না?”
সম্রাটও বোধহয় পূজারিণীর লাইনেই চিন্তা করছে। একসঙ্গে কাজ করা, ফাইল আদান প্রদান করার সময়ে হাতে হাত ঠেকে যাওয়া, মিটিংয়ের সময় সবার নজর এড়িয়ে চোরা চাউনি লুকনো প্রেমের মজাই আলাদা। স্বামী-স্ত্রী হয়ে সংসার করার মতো একঘেয়ে আর বিরক্তিকর নয়।
“পরকীয়াও চরমে চলছে নিশ্চয়ই!” সম্রাট চোখ মেরে হাসল।
বেয়ারা আবার ফেরত এসেছে, এবার হাতে কাগজ-পেন নিয়ে।
“রেডি টু অর্ডার?”
“জ্যাক ডানিয়েলস লার্জ, প্লিজ,” সম্রাট পূজারিণীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
“ওয়ান মার্গারিটা, প্লিজ।”
“সঙ্গে এক প্লেট ফিশ অ্যান্ড চিপস।”
বেয়ারা চলে গেলে সম্রাট পূজারিণীর হাত নিজের হাতের মধ্যে ভরে নিল। পূজারিণী আজকের জন্যই পার্লার থেকে দাম দিয়ে জেল ম্যানিকিওর করে এসেছে। সম্রাট কি সেটা খেয়াল করেছে? ছেলেরা বোধহয় অত দেখে না।
“রুমে যে নাইটিটা বের করলে, আজ রাতে কি ওটাই পরবে?”
সম্রাট গাঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল। চোখে গভীর ইঙ্গিত। পূজারিণী বুঝতে পারল ওর কান গরম হয়ে যাচ্ছে। ও যেরকম পোশাক পরতে অভ্যস্ত নাইটিটা তার থেকে বেশি উত্তেজক। গত সপ্তাহে পামির সঙ্গে গিয়ে, মূলত ওরই উৎসাহে কিনে এনেছিল। অবশ্য তখন ওকে বলেনি কি উদ্দেশ্য কিনছে।
কিন্তু না, আজ পূজারিণী প্রিয়াঙ্কার কথা ভেবে অপরাধবোধে ভুগবে না। অনেক কষ্টেসৃষ্টে, মিথ্যে কথা বলে, অনেক দিক সামলে সম্রাটের সঙ্গে এইটুকু সময় ও চুরি করে এনেছে। সেই সময়ের সবটা ও সম্রাটকে দেবে। ককটেল আর স্তিমিত আলোর এই মায়াময় দুনিয়ায় নিজেকে হারিয়ে দেবে।
“কাল সৌরভের সঙ্গে কী কথা হল?”
সম্রাটের প্রশ্ন পূজারিণীকে আবার বাস্তব জগতে টেনে নামিয়ে আনল।
“ওই যা হয়,” ও মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নাড়ল। “কেমন আছে, জব কেমন চলছে, ডিনারে কী খাবে... তোমার শুনতে ইন্টারেস্ট হবে না।”
সম্রাটের সঙ্গে সম্পর্ক যতই গভীরে যাক, পিকলুর সঙ্গে বলা কথাগুলো পূজারিণীর শেয়ার করতে ইচ্ছে করে না। ওগুলো ওদের দু'জনের নিজস্ব, ব্যক্তিগত কথা। পাঁচকান করার জিনিস নয়।
“ওখানের কোন মেয়ে পছন্দ-টছন্দ হল নাকি?” সম্রাটের চোখে কৌতুক ঝিলিক দেয়। “হলে তুমিও বাঁচ, আমিও বাঁচি!”
হাসতে হাসতে সম্রাটের চোখে জল চলে এল। কিন্তু পূজারিণী হাসিতে যোগ দিতে পারে না। কোথাও একটা ও এখনো সৌরভকে মিস করে। একদিকে ওর মনে হয় সৌরভ যতদিন আমেরিকায় থাকে ততই ভালো। অপর দিকে মনে হয়, এবার ফিরে এলে ভালো হয়। নিজের সত্যিকারের মনোভাবটা যে ঠিক কী, ও নিজেই বুঝতে পারে না।
“কী হল?” পূজারিণীর নৈঃশব্দ্য সম্রাটের নজর এড়ায় না। “পিকলুর কথা বলে মন খারাপ করে দিলাম?”
পূজারিণী মৃদু হাসে, ককটেলে চুমুক দেয়।
“না, না। সেরকম কিছু না।”
সম্রাট টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে পূজারিণীর চোখে চোখ রাখল।
“তুমি তো জান, পামির দত্তক নেওয়ার অ্যাপ্লিকেশন মঞ্জুর হয়ে গেছে। ওয়ান্স দ্য বেবি কামস, আমরা হয়তো অনেক দিন এভাবে দেখা করতে পারব না। তাই আজ রাতটা আমি সব কিছু ভুলে শুধু তোমার সঙ্গে এনজয় করতে চাই।”
পূজারিণী সম্রাটের হাতে মৃদু চাপ দিল।
“বেবির আসা নিয়ে তুমি একসাইটেড?”
“খুব একসাইটেড!” বলতে বলতে সম্রাটের মুখের ওপর দিয়ে একটা ছায়া চলে গেল। “তবে মাঝেমাঝে ভয় করে, তুমি হয়তো আমার থেকে দূরে চলে যাবে।”
টেবিলের ধারে অতর্কিতে বেয়ারার আবির্ভাব ঘটল। পূজারিণীর মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় ওরা টেবিলের নীচে মাইক্রোফোন লাগিয়ে সবার কথা শোনে। নাহলে মোক্ষম সময়ে কী করে এসে উপস্থিত হয়?
“রেডি টু অর্ডার দ্য মেইন কোর্স?”
“জাস্ট আ মোমেন্ট,” পূজারিণীর হাত ছেড়ে সম্রাট মেনুর দিকে মন দিল।
পূজারিণী চট করে একবার চারপাশটা দেখে নিল। চেনা কেউ নেই তো? থাকলে কেলেংকারি হয়ে যাবে। কিন্তু ও যতদূর দেখতে পেল, কোন চেনা মুখ নেই। পূজারিণী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আবার ও রেস্তোরাঁর স্বপ্নিল পরিবেশে হারিয়ে যেতে থাকল। ইতিমধ্যে দু-তিনটে ককটেল খাওয়া হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে একটা মধুর ঝিমুনির ভাব। সামনে সম্রাট বসে। একবার মনে হল, বলে মেইন কোর্স বাদ দাও, সোজা রুমে চলো।
শুধু যদি মুখ ফুটে কথাটা বলত
ঘড়ির কাঁটা এগোতে থাকে। খাওয়া শেষ করে ডেসার্ট এসে গেল। বেয়ারা বিল দিতে এলে সম্রাট রুম নম্বর বলে দিয়ে উঠে পড়ল। পূজারিণীও উঠে সম্রাটের একেবারে কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। সম্রাট ওর কোমর জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গেল।
“আজ রাতে বোধহয় আমাদের কারুরই ঘুম হবে না।”
পূজারিণী কিশোরীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠল।
দু'জনে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে লবিতে পা দিয়েছে এমন সময়ে –
পামি দাঁড়িয়ে রয়েছে। একদম সামনে।
সম্রাটের হাত বিদ্যুৎবেগে পূজারিণীর কোমর থেকে সরে গেল। পূজারিণী তাকিয়ে দেখল, ওর মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে।
“পা-পা-পামি”
পূজারিণীর বুকে কে যেন দুরমুশ পিটছে। পামির মুখে ফুটে ওঠা পরপর অভিব্যক্তি ও পরিষ্কার বুঝতে পারছে – প্রথমে বিস্ময়, তারপর প্রত্যয় ও শেষে চূড়ান্ত রাগ।
পামি এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এসে একদম ওর সামনে দাঁড়াল।
“বাবা! মা! তোমরা নাকি আজ রাতে পুটুমামার বাড়িতে থাকবে? বোলপুরে?”
“সেটা মানে”
পূজারিণী বা সম্রাট কেউই কী বলবে বুঝতে পারে না। দু'জনেই খাবি খেতে থাকে।
“তোর অফিসের কনফারেন্স ছিল না?” পূজারিণী শুকনো ঠোঁট চাটার চেষ্টা করল, “এখানে কী করছিস?”
“এখানেই কনফারেন্স রুমে হচ্ছিল! আমি তোমাদের মতো মিথ্যুক নই!”
“আহা শোন না কথাটা--”
পামি সম্রাটকে মাঝপথে থামিয়ে দিল।
“একবার আমাকে বলবে তো, যে রাতে এখানে থাকবে!”
“আরে বলে দিলে তুইও আসতে চাইতি। এটা ফ্যামিলি হলিডে হয়ে যেত!”
পূজারিণী দেখল পামির বস আর দু'জন – সম্ভবত কোলিগ – লিফট থেকে বেরোচ্ছে। পামি ওদের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করল।
“কাল বাড়ি এস, তারপর তোমাদের হচ্ছে!”
ফিসফিস করে ধমকি দিয়ে পামি হাসিমুখে বসের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর সকলে মিলে গেটের দিকে রওনা দিল।
ফাঁকা লবিতে সম্রাট কাঠগড়ার আসামীর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। পূজারিণী মনে মনে ভাবে, আজ রাতে ওদের ঘুম আসতে সত্যিই চাপ আছে।