• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গল্প
    Share
  • প্রগতিবাদী ترقی پسند : সাদাত হাসান মান্টো
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়

    নিজের লেখা ছোটগল্পগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় যোগিন্দার সিংয়ের ইচ্ছে হল নামী সাহিত্যিক আর কবিদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ভোজসভার আয়োজন করবে। আশা ছিল তাতে তার খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।

    যোগিন্দার তীক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষ। বিখ্যাত সব সাহিত্যিক আর কবিদের বাড়িতে আপ্যায়ন করে খাতির-সমাদর জানানোর পর বিবি অমৃত কৌরের পাশে বসার ফুরসত হওয়ায় ভুলেই গেল যে তার আসল চাকরিটা হচ্ছে ডাকঘরে চিঠিপত্তরের বিলি বন্দোবস্ত করা। পাতিয়ালা-স্টাইলের তিন-গজি কাপড়ের পাগড়িটা মাথা থেকে নামিয়ে পাশে রাখতেই মনে পড়ল তার কুচকুচে কালো লম্বা চুলের তলায় যে ছোট্ট মাথাটা লুকিয়ে আছে, তা প্রগতিশীল সাহিত্যে টইটম্বুর। তাতে হৃদ-মাঝারে স্নেহ-অনুরাগ জন্মাল। পৃথিবীর সব গল্পকার আর উপন্যাস-লেখকের সঙ্গেই যেন তার ভারি সুন্দর একটা সম্পর্ক আছে এমনও মনে হল।

    অমৃত কৌরের মাথায় ঢুকত না স্বামী কেন ওই সব লোকেদের নেমন্তন্ন করেই তার কাছে এসে বলেন, ‘অমৃত, এই যাঁরা আজ চায়ের আসরে আসছেন, এঁরা সব হিন্দুস্থানের বড় কবি। বুঝলে, খুব বড় কবি! দেখো, ওদের আপ্যায়নে যেন কোনও ত্রুটি না হয়।’

    আমন্ত্রিতরা হতেন কখনও দেশের নামকরা কবি, কখনও-বা শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার। তার চেয়ে কোনও অংশে কম কাউকে যোগিন্দার কখনও সৌজন্য দেখায়নি। ভোজসভায় বড় বড় মাথাদের মধ্যে কী যে সব কথাবার্তা হত, আর তার কীই বা মানে তা তো অমৃত আজ পর্যন্ত বুঝেই উঠতে পারল না! গল্পগুজবের সময় প্রগতিশীলতা নিয়ে আলোচনা হত। কিন্তু সে প্রগতিবাদের অর্থ যে কী তা অমৃত কখনও বোঝেনি।

    এক বার যোগিন্দার সিং খুব বড় এক গল্পকারের সঙ্গে চায়ের আসর শেষ করে ভেতরে রান্নাঘরে এসে বসতে অমৃত কৌর জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা বলো তো, এই হতচ্ছাড়া প্রগতিবাদটা কী জিনিস?’

    পাগড়ি-পরা অবস্থাতেই মাথাটাকে হালকা ঝাঁকিয়ে যোগিন্দার সিং উত্তর দিয়েছিল, ‘প্রগতিবাদের অর্থ তুমি এক্ষুনি অত সহজে বুঝবে না। “তরক্কি-পসন্দ” বা প্রগতিবাদী তাদেরই বলা হয় যারা তরক্কি অর্থাৎ প্রগতি পছন্দ করে। এটা ফারসি শব্দ। ইংরেজিতে তরক্কি-পসন্দরা র‌্যাডিক্যাল নামে পরিচিত। যে গল্পকাররা গল্প রচনায় ‘প্রগতি’র সুলুকসন্ধান করে, তারাই হল গিয়ে প্রগতিবাদী গল্পকার। এই মুহূর্তে হিন্দুস্থানে মাত্র তিন-চারজনই গল্প-লিখিয়ে আছে যারা প্রগতিবাদী, তাদের মধ্যে এই অধমও একজন বটে!’

    যোগিন্দার সিংয়ের অভ্যেস ইংরেজি শব্দ আর বাক্য ব্যবহার করে নিজের মনের কথা বলা। এই বাতিকটা যেন তার স্বভাবের অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখন তো সে ইংরেজির বিখ্যাত সব নভেলিস্টদের ব্যবহার করা দারুণ দারুণ চোস্ত বাক্য আর শব্দ কাজে লাগাতে এতটুকু ইতস্তত করে না। সাধারণ কথাবার্তাতেও পঞ্চাশ শতাংশ ইংরেজি শব্দ আর ইংরেজি বই থেকে চোখাচোখা সব বাক্য তুলে আনে। ‘আফলাতুন’কে হামেশাই ‘প্লেটো’ বলে, ‘অ্যারিস্টো’কে ‘অ্যারিস্টটল’। যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ডক্টর সিগমুন্ড ফ্রয়েড, শোপেনহাওয়ার, নিটশে এই সব নামের উল্লেখ আনে। তবে সাধারণ আলাপে সে ওই সব দার্শনিকের নামও নেয় না। বিশেষত, বিবির সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজি শব্দ আর প্রাজ্ঞ মনীষীদের নাম যাতে ধারে-কাছে ঘেঁষতেও না পারে, তার বিশেষ খেয়াল রাখে।

    প্রগতিশীলতা বলতে কী বোঝায় সেটা যোগিন্দার বোঝাতে, অমৃত কৌর তো বড়ই হতাশ হল। বিবি ভেবেছিল ‘তরক্কি-পসন্দ’ না জানি কী বিশাল জিনিস – যা নিয়ে বড়-বড় কবি আর গল্পকার তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনায় বসেন! কিন্তু তারপর সারা হিন্দুস্থানে কেবল তিন-চারজনই প্রগতিশীল গল্পকার থাকার কথাটা মনে পড়তেই বিবির চোখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই চমক দেখে যোগিন্দারের গোঁফে-ঢাকা ঠোঁটদুটো মৃদু হাসিতে কেঁপে উঠল।

    ‘অমৃত, শুনে খুশি হবে যে হিন্দুস্থানের বিশাল বড় একজন মানুষ আমার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তিনি আমার লেখা গল্প শুধু পড়েননি, সে সব তাঁর খুব পছন্দও হয়েছে।’

    ‘এই বড় মানুষটি কি তেমন কেউকেটা কেউ, না কি তোমার মতই কোনও কাহিনিকার?’

    পকেট থেকে একটা খাম বার করে আর এক হাতের ওপর সেটা দিয়ে আলতো চাপড় মারতে মারতে যোগিন্দার বলল, ‘ইনি বিখ্যাত লোক, আবার গল্পকারও বটে। কিন্তু যে জন্য তাঁর খ্যাতির কোনও সীমা নেই সেটা অন্য কিছু।’

    ’সেটা কী?’

    ‘উনি ভবঘুরে।’

    ‘আওয়ারা?’

    ‘হ্যাঁ, ভবঘুরে – যাযাবর বৃত্তিকেই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে নিয়েছেন। সব সময়ই ঘুরে বেড়ান। কখনও হয়ত কাশ্মীরের হিমশীতল উপত্যকায় তাঁকে পাওয়া গেল, আবার পরক্ষণেই মুলতানের তাপিত ময়দানে – এই লঙ্কায়, তো তারপরেই তিব্বতে।’

    অমৃত কৌর আগ্রহী হল। ‘কিন্তু উনি করেনটা কী?’

    ‘লোকগীতি সংগ্রহ করেন – হিন্দুস্থানের সব জায়গার গান – পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, পেশোয়ারি, সীমান্ত এলাকার, কাশ্মীরি, মাড়োয়ারি – হিন্দুস্থানে যত ভাষায় মানুষ কথা বলে, সেসব ভাষার যত গীত উনি পান, থলেতে ভরে নেন।’

    ‘এত গান জমিয়ে কী করেন?’

    ‘বই ছাপান, প্রবন্ধ লেখেন – যাতে অন্যরাও এইসব গান শোনে। বেশ কটি ইংরেজি পত্রপত্রিকাতেও ওঁর লেখা ছাপা হয়েছে। লোকগান সংগ্রহ করে সেই গানকে দক্ষতার সঙ্গে পেশ করা মামুলি কাজ নয়। উনি খুব বড় মাপের মানুষ, অমৃত! মহান মানুষ। আর দেখো, আমাকে কেমন চিঠি লিখেছেন!’

    বলে যোগিন্দার সিং অমৃত কৌরকে সেই চিঠিটা পড়ে শোনালো যেটা হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী তার গ্রামের ডাকঘরের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন।

    সে চিঠিতে ত্রিপাঠী খুবই মিঠে ভাষায় যোগিন্দারের ছোটগল্পের তারিফ করেছেন। লিখেছেন, ‘আপনি হিন্দুস্থানের প্রগতিবাদী গল্পকারদের একজন।’ এই বাক্যটা পড়ে যোগিন্দার সিং বলল, ‘নাও, দেখো, ত্রিপাঠী সাবও লিখেছেন যে আমি প্রগতিবাদী।’

    পুরো চিঠিটা পড়া শেষ হলে যোগিন্দার সিং দু-এক সেকেন্ড স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে তার মনোভাব জানতে জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’

    স্বামীর চোখের তীব্র দৃষ্টিতে অমৃত কৌর একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আমি আর কী জানি? মহান মানুষদের কথা বড় মানুষরাই বুঝতে পারেন।’

    বিবির তির্যক মন্তব্যটা যোগিন্দার ঠিক ধরতে পারল না। সে হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীকে বাড়িতে আমন্ত্রণ করে কয়েক দিন থাকার কথা বলবে ভাবছিল। ‘অমৃত, আমি বলি কি ত্রিপাঠী সাহেবকে নেমন্তন্ন করি। তোমার কী মত? আবার ভাবছি ডাকলে যদি না বলে দেন? অনেক বড় মাপের মানুষ তো। কে জানে আমাদের আমন্ত্রণকে খোশামোদ ভাবতে পারেন।’

    এইসব সময়ে যোগিন্দার বিবিকেও তার পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকিয়ে নেয় যাতে আপ্যায়নের বোঝাটা দুজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। তাই যোগিন্দার যখন ‘আমাদের’ বলল, তখন স্বামীর মতই সরল, সাদাসিধে মনের মানুষ অমৃত এই ত্রিপাঠী ব্যক্তিটির সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হল – তবে মানুষটার নামটাই অমৃতের কাছে একটা ধাঁধার মত। ভবঘুরে একটা লোক শুধু লোকগীতি কুড়িয়ে কীভাবে মহান মানুষ হয়ে উঠতে পারে তা তো তার মাথায় ঢোকেইনি! হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী লোকগীতির সংগ্রাহক শুনেই স্বামীর বলা একটা কথা অমৃতের মনে পড়ল: বিলেতে নাকি কিছু মানুষ আছে যারা প্রজাপতি ধরেই অনেক আয় করে। তাই মনে হল হতে পারে, হয়ত ত্রিপাঠী সাহেবও লোকগীতি সংগ্রহ করার কাজ বিলেতেরই কারও কাছে শিখেছেন।

    ‘ভয় হচ্ছে উনি আমাদের এই নিমন্ত্রণকে খোশামোদ বলে ভাববেন,’ যোগিন্দার সিং স্ত্রীর কাছে আবার উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেলল।

    ‘এর মধ্যে খোশামোদের কী আছে? কতবারই তো বড় বড় লোক আপনার কাছে এসেছেন। আপনি ওঁকে চিঠি লিখে দিন। মনে হয় উনি আপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন। আর ওঁরও নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে আছে? হ্যাঁ, এটা তো বলবেন যে ওর বিবি-বাচ্চা আছে কি না?’

    ‘বিবি-বাচ্চা?’ যোগিন্দার বিড়বিড় করল। মনে মনে সে তখন ইংরেজিতে আমন্ত্রণপত্রে কী লেখা যায় তাই ভাবছে।

    ‘হবে হয়ত – না, আছে নিশ্চয়ই – হ্যাঁ আছে! আমি ওঁর কোনও প্রবন্ধে এই নিয়ে পড়েছিলাম! ওঁর স্ত্রী তো আছেনই একটা বাচ্চা মেয়েও আছে।’

    যোগিন্দার উঠে দাঁড়াল। চিঠিতে যা লিখবে তা সে মনে মনে সাজিয়ে ফেলেছে। পাশের ঘরে গিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চিঠি লেখার ছোট সাইজের সেই প্যাডটা বার করে হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীর নামে উর্দুতে দাওয়াতনামা লিখল। বিবির সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজিতে যা ভেবে রেখেছিল তারই উর্দু তরজমা হল সেটা।

    তিন দিনের মধ্যেই হরেন্দ্রনাথের জবাব এল। কাঁপা কাঁপা হাতে যোগিন্দার খামটা খুলল। আমন্ত্রণ গৃহীত হয়েছে জেনে হৃৎপিণ্ডের ধকধক যেন আরও বেড়ে গেল। বিবি অমৃত কৌর তখন বাইরে রোদে বসে ছোট বাচ্চাটার চুলে দই লাগিয়ে মালিশ করছে – যোগিন্দার সিং খাম হাতে তার কাছে পৌঁছে গেল।

    ‘দেখো অমৃত, উনি আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। লাহোরে কি একটা জরুরি কাজে নাকি এমনিই আসছেন। নতুন বই ছাপানোর ইচ্ছে আছে বোধহয়। আর হ্যাঁ, উনি তোমাকে প্রণাম জানিয়েছেন।’

    লোকগীতির আহরক এমন একজন মানুষ তাঁকে প্রণাম জানিয়েছেন জেনে অমৃত কৌরের খুশি আর ধরে না! সে মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাল। তাঁরই কৃপায় তো তার বিয়ে এমন একজনের সঙ্গে হয়েছে হিন্দুস্থানের সব বড় বড় মানুষ যাকে চেনে।

    শীতের মরসুম। নভেম্বর মাসের প্রথম দিন সেটা। সকাল সাতটায় যোগিন্দার সিংয়ের ঘুম ভাঙলেও বেলা পর্যন্ত চোখ খুলেই বিছানায় শুয়ে রইল। বিবি আর বাচ্চা তখনও পাশের চারপাইটায় লেপের নিচে ঘুমন্ত। যোগিন্দার ভাবছে ত্রিপাঠী সাহেবের দেখা পাওয়াটা কী আনন্দেরই না হবে! তিনিও নিশ্চয়ই যোগিন্দারের সঙ্গে আলাপ করতে পেরে খুশি হবেন। যোগিন্দারও তো হিন্দুস্থানের উঠতি, প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন গল্পকার – প্রগতিবাদী সাহিত্যিকও বটে! ত্রিপাঠী সাহেবের সঙ্গে হরেক বিষয়ে আলোচনা করা যাবে – লোকগীতি, দেহাতি বুলি, ছোটগল্প, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁকে জানানো যাবে দপ্তরের সাধারণ পরিশ্রমী কেরানি হওয়া সত্ত্বেও সে ভালো গল্পকার হয়ে উঠতে পেরেছে। এটা কি একটা চমকে দেওয়ার মত বিষয় নয় যে যিনি ডাকঘরে চিঠি বিলি করার তত্ত্বাবধান করেন, তিনিই আবার একজন শিল্পী?

    যোগিন্দার সিংয়ের গর্ব ছিল পোস্ট অফিসে মেহনতি মানুষের মত ছ-সাত ঘণ্টা খাটনির পরেও সে এতটা সময় বার করতে পারে যাতে একটা মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করা যায়, আরও দু-তিনটে পত্রিকায় মাসে মাসে ছোটগল্প লেখা যায়। বন্ধুদের ফি হপ্তায় লম্বা লম্বা যে চিঠি লেখা হয় সেগুলো না হয় বাদই দিন।

    আরও বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে যোগিন্দার মনে মনে হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের ছবি আঁকল। যোগিন্দার ত্রিপাঠীজীর লেখা গল্প-প্রবন্ধ পড়েছিল, তার ফটোও দেখেছিল। কারও লেখা গল্প পড়তে পেলে আর তার ছবি দেখতে পেলে যোগিন্দারের মনে হত সেই ব্যক্তিকে বেশ জেনে ফেলা গেছে। কিন্তু হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীর ব্যাপারে নিজের ওপর যেন সে বিশ্বাস ছিল না। কখনও মনে হত ত্রিপাঠী তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা কোনও মানুষ। তার গল্প-লিখিয়ের মনে কখনও এমন ভাবনা এসেছে যে ত্রিপাঠী যেন কাপড়ের বদলে নিজের শরীরটা দিস্তে দিস্তে কাগজ দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। সেই কাগজগুলো যোগিন্দারকে আনারকলি বাজারের সেই দেওয়ালটার কথা মনে করাত। তার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে একের পর এক এত অজস্র সিনেমার বিজ্ঞাপন সাঁটা থাকত যে মনে হত আসল দেওয়ালের সামনে আরেকটা দেওয়াল উঠে গেছে!

    যোগিন্দার সিং বিছানায় শুয়ে শুয়ে দীর্ঘক্ষণ এটাই চিন্তা করতে থাকল যে ত্রিপাঠী যদি সত্যিই সে যা ভাবছে তেমন মানুষ হন, তা হলে তো তাঁকে বোঝা বেশ কঠিন কাজ হবে। পরে, নিজের প্রখর বুদ্ধির কথা মনে পড়ায় যোগিন্দার যেন মুশকিল আসানের সন্ধান পেল। উঠে পড়ে ত্রিপাঠীকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিল।

    চিঠিপত্র চালাচালিতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী নিজেই যোগিন্দার সিংয়ের নিবাসে পৌঁছে যাবেন। ত্রিপাঠী তখনও ফয়সালা করতে পারেননি যে লরিতে আসবেন না ট্রেনে। তবে যোগিন্দার সিং সোমবার ডাকখানা থেকে ছুটি নিয়ে সারাদিনই অতিথির অপেক্ষায় রইবে এটা তো স্থির হয়েই ছিল।

    স্নান সেরে কাপড় বদলে যোগিন্দার অনেকক্ষণ রান্নাঘরে বিবির সঙ্গেই রইল। ত্রিপাঠী এসে পড়বেন এই আশায় দুজনে সময় নিয়ে চা খেল, তবে ত্রিপাঠী না পৌঁছোনোয় কেক ইত্যাদি সযত্নে আলমারিতে তুলে রেখে শুধুই চা খেয়ে অতিথির অপেক্ষায় বসে থাকল।

    শেষমেশ উঠে পড়ে নিজের ঘরে চলে এল যোগিন্দার। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন দাড়িগুলো নিচের দিকে টেনে রাখতে তাতে লোহার ছোট ছোট ক্লিপ আটকাতে ব্যস্ত, তখনই দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে এল। দাড়ি পরিচর্যা অসম্পূর্ণ রেখে দেউড়ির দরজা খুলতে প্রথমেই যোগিন্দারের নজর গিয়ে পড়ল হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীর কালো কুচকুচে দাড়ির ওপর, যা তার নিজের দাড়ির তুলনায় বিশ গুণ বড় তো বটেই, তার বেশিও হতে পারে।

    বড় বড় গোঁফে ঢাকা হরেন্দ্রনাথের মুখে গুঁফো হাসির আভাস ফুটে উঠল। তার সামান্য ট্যারা চোখটা যেন আরও ট্যারা হল। তিনি লম্বা লম্বা চুলগুলোকে একদিকে ঝাঁকিয়ে যোগিন্দার সিংয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ত্রিপাঠীর হাত চাষার হাতের মত খড়খড়ে। যোগিন্দার সিং হাত মেলানোর সময় সে হাতের জোর টের পেল। আর যখন গর্ভবতী মহিলার পেটের মত ফুলে থাকা ত্রিপাঠীর চামড়ার ব্যাগটা নজরে পড়ল, তখন যোগিন্দার অভিভূত হয়ে গেল। ‘ত্রিপাঠী সাব, আপ সে মিল কর মুঝে বেহদ খুশি হুই’ এর বেশি আর কিছু তার মুখ দিয়ে বেরোল না।

    *********************

    হরেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠী আসার পরে পনেরো দিন পেরিয়ে গেল। তাঁর আসার দুদিন পরেই বিবি-বাচ্চা এসে হাজির হয়েছে। এরা ত্রিপাঠীর সঙ্গেই গাঁ থেকে এলেও দুদিন মোজ়়ঙ্গে (লাহোর) কোনও দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলেন। যেহেতু সে বাড়িতে তাদের বেশিদিন থাকা ত্রিপাঠী পছন্দ করেননি, তাই ওদেরও কাছে ডেকে নিয়েছেন।

    প্রথম চার দিন নানা আগ্রহের বিষয় নিয়ে আলোচনায় কেটে গেল। ত্রিপাঠীর মুখে নিজের লেখা ছোটগল্পের তারিফ শুনে যোগিন্দারের সে কী আনন্দ! একটা অপ্রকাশিত গল্প ত্রিপাঠীকে পুরোটা পড়ে শুনিয়ে সে তাঁর তারিফ কুড়িয়েছিল। দুটো অসম্পূর্ণ গল্প শোনালে সেগুলো নিয়েও ত্রিপাঠী প্রশংসাসূচক কথাই বললেন। প্রগতিবাদী সাহিত্য নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছিল। ছোটগল্পকারদের শৈলীর কৌশলগত দুর্বলতা নিয়েও আলোচনা হল। নতুন আর পুরোনো কাব্য-সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনাও বাকি রইল না। মোট কথা চারটে দিন খুব ভালো কাটল – ত্রিপাঠীর ব্যক্তিত্ব যোগিন্দারকে দারুণ আকর্ষণ করেছে। তার কথা বলার ধরন, যার মধ্যে একই সঙ্গে ছেলেমি আর বয়োজ্যেষ্ঠের ভাব ছিল, যোগিন্দারের ভারি পছন্দ। নিজের দাড়ির বিশ গুণ বড় ত্রিপাঠীর লম্বা দাড়ি তার কল্পনায় ছেয়ে রইল। দেহাতী গীতের চলন টের পাওয়া যায় ত্রিপাঠীর এমন ঘন কালো চুলের ঢেউ যোগিন্দারের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ডাকঘরে চিঠির বিলিব্যবস্থার সময়ও ত্রিপাঠীর চুলের শোভা সে ভুলতে পারত না।

    চারদিনেই ত্রিপাঠী যোগিন্দার সিংকে মোহগ্রস্ত করে ফেলল। যোগিন্দার প্রেমের ফাঁদে এমনই বন্দি হল যে ত্রিপাঠীর ট্যারা চোখের দৃষ্টিও তখন সুন্দর মনে হচ্ছিল। একবার তো সে ভেবেই ফেলল যে যদি চোখটা ট্যারা না হত, তা হলে ত্রিপাঠীর মুখে এমন আভিজাত্য ফুটে উঠত না!

    ত্রিপাঠীর মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ঘন গোঁফের আড়ালে নড়লে যোগিন্দারের মনে হত ঝোপঝাড়ে পাখিরা কিচির মিচির করছে। ত্রিপাঠী ধীরে-সুস্থে কথা বলে। কথা বলতে বলতে ত্রিপাঠী তার লম্বা দাড়িতে হাত বোলালে যোগিন্দারের মনে শান্তির ছোঁয়া লাগে। কারও ভালোবাসার হাত যেন তার হৃদয়কে স্পর্শ করছে।

    দিন চারেক এমন অভিভূত অবস্থায় কাটল যে যোগিন্দার চাইলেও কোনও গল্পে তার বিবরণ দিতে পারত না। তবে পঞ্চম দিনে চামড়ার থলে খুলে নিজের লেখা গল্প শোনাতে শুরু করল ত্রিপাঠী। দশ দিন ধরে চলল গল্প শোনানো। এত লেখা যে তাতে বেশ কয়েকটা বই হয়ে যায়।

    এবারে যোগিন্দার সিং বিরক্ত হয়ে উঠল। সে ছোটগল্পকে যেন দারুণ ঘৃণা করতে শুরু করেছে। মহাজনের নাদুস ভুঁড়ির মত ফুলে থাকা ত্রিপাঠীর চামড়ার ঝুলি চিরস্থায়ী শাস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজ সন্ধেয় দপ্তর থেকে বেরোনোর সময় যোগিন্দারের মনে খটকা লেগে থাকে যে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তো ত্রিপাঠীর মুখোমুখি হতে হবে। এধার-ওধারে দু-চারটে কথার পরেই তো চামড়ার থলিটা খুলে যাবে – আর তাকে বসে বসে দীর্ঘ গল্পগুলো শুনতে হবে।

    যোগিন্দার সিং প্রগতিবাদী। এই প্রগতিশীলতা যদি তার মধ্যে না থাকত, তা হলে তো স্পষ্ট কথায় ত্রিপাঠীকে বলেই দেওয়া যেত, ‘ব্যাস... ব্যাস ত্রিপাঠী সাহেব, এই যথেষ্ট! অনেক হয়েছে, আর আপনার গল্প শোনার শক্তি আমার নেই।’ কিন্তু তা না করে সে ভাবতে বসল... আমি তো প্রগতিবাদী। আমার এমন বলা উচিত হবে না। ওর গল্প যে আমার আর ভালো লাগছে না, সেটা তো আমারই দুর্বলতা। ওর লেখার মধ্যে উৎকর্ষ নিশ্চয়ই কিছু আছে। তাই তো প্রথম গল্পটাকে সৌন্দর্যে ভরপুর মনে হয়েছিল। আমি বোধহয় পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ছি।

    হপ্তাভর কী তারও বেশি এই দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের লড়াই যোগিন্দার সিংয়ের প্রগতিবাদী মনকে আচ্ছন্ন করে রাখল। ভাবতে ভাবতে এমন এক মানসিক অবস্থায় সে পৌঁছোল যেখানে বিচার-বিবেচনা করাই সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাবনাচিন্তা মনে এলেও, তা যাচাই করে দেখার ক্ষমতা যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। এই মানসিক অস্থিরতা বেড়ে চলল – মনে হত অজস্র জানলাওলা এক বিশাল বাড়িতে সে একা, আর আঁধি ঝড় উঠেছে। একবার এ জানলা পড়ছে তো পরের বার ও জানলা – আর সে বুঝে উঠতে পারছে না এতগুলো জানলা একসঙ্গে বন্ধ কীভাবে করা যাবে!

    ত্রিপাঠীর আগমনের বিশ দিন অতিক্রান্ত হলে যোগিন্দারের অশান্তি শুরু হল। নতুন গল্প লেখার পর ত্রিপাঠী সন্ধেবেলা তা শোনাতে শুরু করলে যোগিন্দারের মনে হত এক ঝাঁক মাছি যেন কানের আশপাশে ভনভন করে। সে অন্য চিন্তার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলত।

    হঠাৎ একদিন ত্রিপাঠী নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক নিয়ে লেখা টাটকা একটা গল্প শোনাতেই যোগিন্দারের মনে হল যে পুরো একুশটা দিন সে তার স্ত্রীর সাহচর্য থেকে দূরে বড় দাড়িওলা একটা লোকের সঙ্গে একই লেপের তলায় শুচ্ছে! এই চিন্তা এক মুহূর্তে যোগিন্দারের শরীরে-মনে যেন আলোড়ন সৃষ্টি করল। এ কী ধরনের অতিথি যে জোঁকের মত সারাক্ষণ সাপটে লেগে থাকে? এ তো এখান থেকে যাবার নামও করে না, আর ... আর ... আর আমি তো ওর স্ত্রী আর বাচ্চার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম ... এ তো পুরো পরিবার এখানে উঠিয়ে নিয়ে এসেছে!! এতটুকুও চিন্তা নেই যে একটা গরীব লোককে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে! আমি ডাকঘরের সামান্য এক কর্মী, মাস মাইনে মাত্র পঞ্চাশ টাকা। আর কতদিন এইভাবে এদের খাতির-যত্ন করে যেতে হবে?

    আর তারপরে আছে ছোটগল্প . . . এর গল্পের শেষ হওয়ার তো কোনও লক্ষণই নেই! আমিও তো একটা মানুষ – লোহার ট্রাঙ্ক তো নই যে রোজ শুধু ওর গল্প শুনে যাব? আর কী আশ্চর্য এর মধ্যে আমি আমার বউয়ের পাশেও যাইনি। শীতের এই রাতগুলোর কীভাবে অপচয় হয়ে চলেছে!

    একুশ দিনের পরে যোগিন্দার যেন ত্রিপাঠীকে নতুন আলোয় দেখতে শুরু করল। ত্রিপাঠীর সব কিছুই তার কুৎসিত লাগছে। তার ট্যারা চোখ – যার মধ্যে এর আগে যোগিন্দার সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিল – সেটা এখন শুধুই একটা ট্যারা চোখ। তার কালো চুলে যেন আগের সেই নরম মোলায়েম ভাব আর নেই। আর ত্রিপাঠীর দাড়ি দেখে এখন মনে হচ্ছে এত বড় দাড়ি শুধু আহাম্মকরাই রাখে!

    ত্রিপাঠীর আসার পঁচিশ দিন পার হলে এক অদ্ভুত অনুভূতি যোগিন্দারকে ঢেকে ফেলল। নিজেকে যেন কেমন অচেনা ঠেকছে, মনে হচ্ছে সে কখনও যোগিন্দার সিং নামে কাউকে চিনত। এখন আর চেনে না। নিজের স্ত্রীকে নিয়েও সে ভাবত ত্রিপাঠী চলে গেলে যখন সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন বোধহয় আবার আমার নতুন করে বিয়ে হবে। আমার সেই পুরোনো জীবন, যাকে লোকে চটের ছেঁড়া বস্তার মত ব্যবহার করছে, তা আবার আমি ফিরে পাব। আমি আবার আমার স্ত্রীর সঙ্গে শুতে পারব... আর... আর...

    আগামী দিনগুলোর কথা ভাবলে যোগিন্দার সিংয়ের চোখে জল আসে। একটা তেতো কিছু যেন গলায় আটকে যায়। ইচ্ছে হয় দৌড়ে ভেতরে গিয়ে অমৃত কৌরকে, যে কখনও তার স্ত্রী ছিল, বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। কিন্তু প্রগতিশীল ছোটগল্পকার হওয়ার কারণেই সে কাজ করার সাহস যোগিন্দারের ছিল না।

    কখনও সখনও এই চিন্তা যোগিন্দার সিংয়ের মনে দুধের ফেনার মত উঠত যে প্রগতিবাদের যে লেপটা সে শরীরে জড়িয়ে রেখেছে, সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচাতে শুরু করে। . . . ত্রিপাঠীর প্রগতিবাদ চুলোয় যাক! তুমি আর তোমার সংগ্রহ করা ওই গীত সব বুকনি! আমি আমার বউকে চাই, আমার ওপর দয়া করো! তোমার জীবনের ইচ্ছে-অভিলাষ তো সব তোমার ওই গীত শুষে নিয়েছে। কিন্তু আমি তো এখনও যুবক? আমায় দয়া করো, এটুকু তো ভেবে দেখো যে আমার এক মিনিটও বউ ছাড়া চলতো না, সেই আমি পঁচিশ দিন তোমারই সঙ্গে এক লেপের তলায় শুয়ে থাকছি… এটা কি অত্যাচার নয়?

    যোগিন্দার সিং ভেতরে ভেতরে যতই ফুটতে থাকুক না কেন, ত্রিপাঠী যোগিন্দারের অবস্থা ঠাহর করার কোনও চেষ্টা না করে নির্বিকারচিত্তে রোজ সন্ধেয় একটা তাজা গল্প শুনিয়ে দিত। আর রাতে তার পাশে একই লেপের তলায় শুয়ে পড়ত। এইভাবে এক মাস যাওয়ার পরে যোগিন্দারের ধৈর্যের বাঁধ টুটল। সুযোগ বুঝে সে স্নানের ঘরে বউকে গিয়ে ধরল। হৃৎপিণ্ডটা তখন এই ভয়ে ধক ধক করছে যে ত্রিপাঠীর বউ যদি এসে যায়? ডাকঘরে খাম খোলার মত দ্রুত বউয়ের ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে যোগিন্দার বলল, ‘আজ রাতে জেগে থেকো। আমি ত্রিপাঠীকে এই বলে বাইরে যাচ্ছি যে রাত আড়াইটেয় ফিরব। কিন্তু আসলে তার আগেই রাত বারোটার মধ্যে ফিরে আসব। ঠিক বারোটার সময় দরজায় আস্তে আস্তে টোকা মারলে তুমি লুকিয়ে দরজাটা খুলে দেবে। তারপরে আমরা... দেউড়ির দিকটা তো নির্জন – তবু সাবধানের মার নেই – স্নান ঘরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে রেখো।’

    বউকে সব ভালোভাবে বুঝিয়ে যোগিন্দার ত্রিপাঠীর সঙ্গে দেখা করে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। বারোটা বাজতে তখনও শীতের রাতের চারটে ঘণ্টা বাকি। যোগিন্দার দুটো ঘণ্টা সাইকেলে এদিক-ওদিক ঘুরে কাটাল। বউয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার উত্তেজনায় প্রবল শীত যেন তার গায়েই লাগছে না!

    দুঘণ্টা সাইকেলে ঘোরার পর ফিরে এসে যোগিন্দার নিজের বাড়ির লাগোয়া ময়দানে বসে থাকতে থাকতে যেন আবার নতুন করে রোমান্স খুঁজে পেল। শীতের রাতের নির্জনতা আর অস্পষ্টতা যেন তার একান্তই পরিচিত। ওপরে কুয়াশা-ভরা আকাশে তারাগুলো এমন ঝিকমিক করছে যেন জলের বড় বড় ফোঁটা জমে মোতির মালা গাঁথা হয়েছে। কখনও রেল ইঞ্জিনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ নীরবতাকে চিরে দিলে, যোগিন্দার সিংয়ের গল্পকারের হৃদয়ে এই চিন্তা জুড়ে বসছিল যে নিস্তব্ধতা বরফের একটা বড় ঢেলা, আর তার হৃদয়কে চিরে দিচ্ছে হুইসিলের আওয়াজ।

    অনেকক্ষণ এই অদ্ভুত রোম্যান্টিক চিন্তাগুলো যোগিন্দারকে আচ্ছন্ন করে রাখল। রাতের আঁধারের অপার সৌন্দর্য যেন সে গুনে দেখছে। হঠাৎই চমকে উঠে দেখে ঘড়িতে বারোটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। উঠে পড়ে যোগিন্দার বাড়ির দিকে এগোলো। পৌঁছে দরজায় মৃদু টোকা মারার পাঁচ সেকেন্ড পরেও দরজা না খোলায় আবার টোকা দিল।

    দরজা খুলল। যোগিন্দার সিং অস্ফুটে ‘অমৃত’ বলে চোখ তুলেই দেখে অমৃত কৌরের বদলে ত্রিপাঠী দাঁড়িয়ে আছে। আঁধারে মনে হচ্ছিল ত্রিপাঠীর দাড়িগুলো এতই বড় হয়ে গেছে যেন তা মাটিকে ছুঁতে চলেছে। ত্রিপাঠীর কণ্ঠস্বর যোগিন্দারের কানে এল, ‘আরে, তুমি তো তাড়াতাড়িই ফিরে এলে! চলো, ভালোই হল, এই সবে একটা গল্প লিখে শেষ করলাম। এসো, তোমাকে শোনাই. . . ’

    *****************

    [ অনুবাদকের নিবেদন: মূল উর্দু গল্পটা পাওয়া গেল দিল্লির এডুকেশনাল পাবলিশিং হাউস প্রকাশিত ‘কুল্লিয়াত-এ-মান্টো’র প্রথম খণ্ডে, পৃ. ৫৭৯ – ৫৮৪।

    ‘He drops into my easy chair,
    And asks about the news,
    He peers into my manuscript,
    And gives his candid views;
    He tells me where he likes the line,
    And where he's forced to grieve;
    He takes the strangest liberties,--
    But never takes his leave!’

    এ গল্প পড়তে পড়তে সুধী পাঠকদের জন গডফ্রে স্যাক্স-এর ‘মাই ফ্যামিলিয়ার’ কবিতাটি মনে পড়তে পারে। ‘তরক্কি-পসন্দ’ বা প্রগতিবাদী শিরোনামের সরস এই কাহিনিটির পিছনে দুটি বাস্তব চরিত্র আছে। বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে দিল্লির অল ইন্ডিয়া রেডিওতে উর্দু আর হিন্দি সাহিত্যের বহু তারকার সমাগম ঘটেছিল, যাদের মধ্যে ছিলেন রাজিন্দর সিং বেদী আর দেবেন্দ্র সত্যার্থী। মান্টো বেদীর মুখ থেকে সেই সময়ের গল্প শুনেছিলেন যখন লোকগীতির রচনাকার থেকে ছোটগল্পকার হিসেবে সত্যার্থীর রূপান্তর ঘটছে। লাহোরে সপরিবারে বেদীর বাড়িতে থাকাকালীন সত্যার্থী সকাল সন্ধ্যায় চিৎকার করে তাঁর সদ্য-রচিত কাহিনিগুলো পড়তেন আর বেদীকে তা শুনতে বাধ্য করতেন। পরিণামে রাজিন্দর সিং বেদী তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের কোনও সময় দিতে পারতেন না। নিজের কানে শোনা এই ঘটনার ভিত্তিতে মান্টো লিখে ফেলেন এক কাহিনি যাতে দেখানো হচ্ছে কীভাবে উঠতি তরুণ শিখ লেখকের বাড়িটি বরিষ্ঠ প্রগতিবাদী এক লেখক প্রায় জবরদখল করে নিচ্ছে।

    মান্টোর ‘তরক্কি-পসন্দ’ দিল্লির সাহিত্যিক মহলে শোরগোল ফেলে দিলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বেদীর তত্ত্বাবধানে দেবেন্দ্র সত্যার্থী ‘নয়ে দেবতা’ নামে একটি গল্প লেখেন, যার প্রধান চরিত্র নিফাসত হাসানের মধ্যে সাদাত হাসান মান্টোর ছায়া দেখা যায়। পরে অবশ্য তাঁদের মধ্যে এই তিক্ত সম্পর্কের জন্য দেবেন্দ্র সত্যার্থী এক দল লেখকের অতিরিক্ত সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওর অফিসে কাটানোকেই দায়ী করে দাবি করেন যে মান্টোকে তিনি তাঁর হৃদয়ে অত্যন্ত সম্মানের আসনে বসিয়ে রেখেছেন।]

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments