গতকাল পৌষ সংক্রান্তি ছিল। এবছর কলকাতায় শীত আসছে-না আসছে-না করেও এক সপ্তাহ হল ঠাণ্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। পরপর তিন দিন তেমন রোদ ওঠেনি। সকাল সন্ধ্যে দু’বেলাতেই দূরের রাস্তাঘাট, গাছপালা, ঘরবাড়ি ঢেকে যাচ্ছে হাল্কা কুয়াশায়।
এমনিতে সুমনা যে খুব শীতকাতুরে তা নয়। অল্পবয়সে শুধুমাত্র গায়ে আঁচল টেনে বা একটা ক্যাস্মিলন সোয়েটার পরেই কলকাতায় শীতকাল কেটে যেত। কিন্তু এখন তাঁর বয়স হয়েছে। তিনি তো আর কচি খুকিটি নেই। বিরাশি বছরের বৃদ্ধা তিনি। সময়ের সঙ্গে কমেছে রক্তের জোর। আজকাল বড় সহজেই ঠাণ্ডা লেগে যায় তাঁর। বুকে সর্দি বসে কাশি শুরু হলে কিছুতেই সারতে চায় না।
বহুদিন হল সকাল-সন্ধ্যে দু’বেলাতেই সুমনা প্রায় ঘণ্টা দুয়েক করে সময় কাটান ঠাকুর ঘরে। তবে দু’দিন হল কাশিটা এত বেড়েছে যে ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে বসে এক মনে জপ করাই দুরূহ হয়ে উঠেছে। সুমনার ঠাকুরের সিংহাসনে মা-দুর্গা, মা-কালী, লক্ষ্মী, গণেশ, শিব সব ঠাকুরই আছে। তবে সিংহাসন আলো করে ঠিক মাঝখানটিতে আছে পিতলের বালগোপাল। আজকাল পালাপার্বণে পরিবারের সদস্যদের জন্য নয়, তিনি কেনাকাটা করেন ঠাকুর ঘরের সামগ্রী। গোপালের জামা, ঠাকুরের পটের মালা, নতুন ধূপদানি, দামি ধূপ, কর্পূর, চন্দনের গুঁড়ো এইসব কত কী।
আজ সকালেও সুমনা বসেছিলেন ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে। তবে পাঁচ মিনিটও যায় না বুক ফুঁড়ে দমকা কাশি আসে। বাধ্য হয়ে জপ বন্ধ করেন। পাশে রাখা ঢাকা দেওয়া কাচের গ্লাস থেকে এক ঢোঁক জল খান। তাতে স্বরনালীর চিড়বিড়ে ভাব দূর হয়। বন্ধ হয় কাশি। পিঠের উপর আলগা ভাবে ফেলে রাখা মাখন রঙের কাশ্মীরি শালটা টেনেটুনে ভালো করে ঢেকে নেন নিজেকে। আবার শুরু করেন জপ...।
কিন্তু যে কে সেই, কয়েক মিনিটের মধ্যেই আবার শুরু হয়ে যায় কাশি। আবার জপ বন্ধ করতে হয়। আবার সুমনা জলের গ্লাসে চুমুক দেন। আর মুখের জল গলায় নাড়াচাড়া করতে করতে কত হাবিজাবি চিন্তা মাথায় আসে...
উফ, কী কাশি হয়েছে! কিছুতেই সারছে না কেন? এই কাশি সাধারণ কাশি তো? মানে শুধুই বুকে সর্দি বসার কারণে? না কি তার থেকে বেশি কিছু? যেমন হয়েছিল মণিদার?
সুমনার চিন্তায় ছেদ পড়ে মোবাইল ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ প্রবেশের টুংটাং শব্দে। কাচের গ্লাসের পাশেই রাখা মোবাইল ফোন। তিনি ফোনটার দিকে আড়চোখে তাকান। তবে চশমাবিহীন অবস্থায় কিছুই পড়তে পারেন না। আন্দাজে বোঝেন ফুলঝুরির মেসেজ এল। ফুলঝুরি ছাড়া পরপর এতগুলো মেসেজ বুড়ি সুমনাকে আর কেই বা পাঠাবে? মেসেজ নয়, নিশ্চয়ই ছবি।
ফুলঝুরি সুমনার একমাত্র ছেলে বাবুয়ার মেয়ে। নাতনির নাম রেখেছিলেন বাবুয়ার বাবা, অমলেশ। অমলেশ চলে যাওয়ার পর ‘ফুলঝুরি’ নামটা একা সুমনাই এখনও চালু রেখেছেন। নাহলে বিদেশে স্কুল-কলেজ-বাড়ি সর্বত্র ফুলঝুরির একটাই নাম, রায়না।
সুমনাকে ফোন করে ফুলঝুরি যত না কথা বলে তার থেকে ছবি পাঠায় বেশি। বাড়ির, বাগানের, বন্ধুদের সঙ্গে পিকনিকের, দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে, বাবুয়ার, বাবলির, আর নিজের অজস্র সেলফি। আচ্ছা, ফুলঝুরি কি খুব মিস করে সুমনাকে? তাই এত ছবি পাঠায়? না কি পুরোটাই ফুলঝুরির ফটোগ্রাফির শখ?
তবে অত মাটি খুঁড়ে দেখার স্বভাব নয় সুমনার। যা পাচ্ছেন, যতটুকু দেখছেন, তাই নিয়েই তিনি তৃপ্ত। পরিবারকে সুখে রাখতে কিছু আত্মত্যাগ, অনেকটা যত্নের প্রয়োজন। কিন্তু নিজে সুখী হওয়া এক মহান শিল্পের সমান।
আবার দমকা কাশি আসে সুমনার...
বারংবার বাধা পাওয়ায় আজ আর তাঁর দু’ঘন্টা ঠাকুর ঘরে বসা হল না। তিনি তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে ঠাকুর প্রণাম করলেন।
আগে ঠাকুরের সিংহাসন ছিল ঠাকুর ঘরের পুব দিকে সাদা মার্বেলের মেঝের উপর। তিনি মেঝেতে আসন পেতে বসে জপ করতেন। হাঁটুর সমস্যা শুরু হওয়ার পর সিংহাসন উঠেছে টেবিলে, আর তিনি বসেন চেয়ারে। প্রথম প্রথম চেয়ারে বসে জপ করতে মন খুঁতখুঁত করত। তবে যখন যেমন তখন তেমন, পরিস্থিতি মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও তো নেই।
সেগুন কাঠের ভারী চেয়ারটা ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন সুমনা। ধূসর রঙের তসর শাড়ির আঁচল আর গায়ের শাল সামলে সাবধানেই ঠাকুর ঘর থেকে বেরচ্ছিলেন। তবু কেমন করে যেন চৌকাঠে পা আটকে গেল তাঁর। হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন প্রায়। ঠিক সময়ে চব্বিশ ঘণ্টার হেল্পার টিয়া দৌড়ে এসে তাঁকে ধরে নিল বলে, নাহলে এই বয়সে পড়ে গেলে কপালে দুর্ভোগ ছিল।
ফুলঝুরির দেখাদেখি সুমনাকে টিয়াও আম্মা বলে ডাকে। আগে টিয়ার মা রাধা এই বাড়িতে কাজ করত। সকাল ন’টায় আসত আর সন্ধ্যে সাতটায় যেত। তখনও অমলেশ আছেন, সুমনাও বয়সের ভারে এমন নড়বড়ে হয়ে যাননি। স্বামী-স্ত্রী প্রতিদিনের জীবনে পরস্পরের উপর নির্ভর করতেন।
মাঝেমধ্যে রাধার হাত ধরে চলে আসত শিশু টিয়া। ছোট্ট মেয়েটা অমলেশের পিছু পিছু ঘুরঘুর করত বাগানে। পুজোর সময় রাধার শাড়ির সঙ্গে টিয়ার অষ্টমীর ফ্রকটাও কিনে দিতেন সুমনা। অমলেশ চলে যাওয়ার পর এক জন সারাদিনের লোকের প্রয়োজন হল। হাতের কাছে টিয়া ছিল। টিয়াই থাকতে শুরু করল সুমনার সঙ্গে। দু’বছর হল রাধা অন্যত্র কাজ নিয়েছে। আজকাল টিয়া একাই সামলায় সুমনার সংসারের যাবতীয় কাজ।
টিয়ার হাত ধরে ধীরে ধীরে ড্রয়িংরুমে এলেন সুমনা। বড় সোফাটায় বসে একটা লম্বা শ্বাস নিলেন। হাঁফ ধরা গলায় বললেন, “আমার পা দু’টো সোফায় তুলে দে তো টিয়া। দেখিস, সাবধানে। বাঁ পায়ের গোছটায় আবার খুব ব্যথা হয়েছে।”
সুমনার পা দু’টো আস্তে করে সোফায় তুলে টিয়া জিজ্ঞেস করল, “তোমার আবার হাঁটু লক হল না কি গো? ডাক্তারকাকুকে ফোন করব?”
সুমনা মাথা নাড়লেন, “না রে। ডাক্তার কল দেওয়ার মতো কিছু হয়নি। ক’দিন ধরে খুব ঠাণ্ডা পড়েছে না, তাই এমন হয়েছে। তুই বরং ওঘর থেকে সেঁক দেওয়ার ল্যাম্পটা নিয়ে আয়।”
টিয়া চলে যাচ্ছিল। সুমনা পিছু ডাকেন, “শোন, শোওয়ার ঘর থেকে ছাই রঙের কম্বলটা এনে আগে আমার পা দু’টো ঢেকে দিয়ে যা। আর আমার মোবাইলটাও রেখে যা। ঠাকুর ঘরের টিপয়ের উপর আছে।”
ঠাকুর ঘর থেকে মোবাইল ফোনটা এনে সুমনার হাতে দেয় টিয়া। গলায় সামান্য কর্তৃত্বের সুর ঢেলে বলে, “মোবাইল নিলে যে এখন, কার সঙ্গে কথা বলবে? ফুলঝুরি দিদি? এদিকে দশটা বাজে। সে খেয়াল আছে? জলখাবার খাবে কখন?”
সুমনা ভাঙা ভাঙা স্বরে আলতো ধমক দেন টিয়াকে, “সময়ের খেয়াল তোর আছে? তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করেই যাচ্ছিস!”
টিয়া জিজ্ঞেস করে, “আজ কী দেব তোমাকে? কী খাবে তাড়াতাড়ি বলে দাও।”
সুমনা একটু ভেবে বলেন, “এক কাপ চা আর এক মুঠো খই আর মুড়কি দিয়ে যা।”
সুমনার কোমর থেকে পায়ের পাতা অবধি কম্বল দিয়ে ঢেকে কিচেনের দিকে যেতে যেতে টিয়া সাবধানবাণী ছুঁড়ে যায়, “আমাকে বকুনি দিয়ে কী হবে! ফোনে একটু কম গল্প করো, তাতে তোমারই ভালো। অত কথা তোমার আর সয় না।”
টিয়া চলে গেলে সোফায় গা এলিয়ে বসেন সুমনা। চোখ থেকে চশমাটা খুলে কোলের উপর রাখেন। পুব দিকের জানলাটার দিকে তাকান। আজ সুয্যি মামার মুখের আধখানা আলোয়ান দিয়ে ঢাকা। জানলার বাইরে ম্রিয়মাণ দিনের আলো। তার মধ্যেই সামনের লনে ডালিয়া, জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকারা গলা জড়াজড়ি করে হাসছে।
দু’বছর হল রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট উঠেছে। প্রতি ফ্লোরে দু’টো করে ফ্ল্যাট। দোতলার ডান দিকের ফ্ল্যাটটার দস্যি ছেলেটা এখন বারান্দায়। একটা লাল রঙের এরোপ্লেন হাতে বারান্দার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। ছেলেটার দস্যিপনা দেখতে দেখতে ধূসর রঙের সকালটাও কেমন রোদ্দুরে ঝলমল করে ওঠে সুমনার চোখে...। নিজের ছেলেবেলা, বাবুয়ার শৈশব সব মাখামাখি হয়ে ভেসে ওঠে স্মৃতিতে। ফুলঝুরির ছোটবেলা তেমন মনে পড়ে না সুমনার। শিশু ফুলঝুরিকে ক’দিনই বা কাছে পেয়েছেন তিনি? বরং নাতনির কিশোরীবেলা নাচে তাঁর চোখের পাতায়। আসলে ফুলঝুরির দশ-এগারো বছর বয়স থেকে ছুটিছাটায় বাবুয়া মেয়েকে পাঠিয়ে দিত কলকাতায়। তখন বাবুয়া ভীষণ ব্যস্ত। সদ্য নিজের স্টার্টআপ খুলেছে। বাবুয়া দেখে প্রোডাক্ট সাইড আর বাবলি ফাইন্যান্স।
ফুলঝুরির কথা মনে হতেই সুমনার মনে পড়ল সকালে তাঁর ফোনে কতকগুলো হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এসেছে। তাই তো, পায়ের ব্যথার কষ্টে তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন মেসেজ দেখতে। কোলের উপর রাখা চশমা পুনরায় চোখে লাগান। মোবাইল ফোনের স্ক্রিন দেখেন। যা ভেবেছেন ঠিক তাই। অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছে ফুলঝুরি।
ফুলঝুরির পাঠানো ছবিগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কয়েকবার দেখলেন সুমনা। কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ছবি নয়, ফুলঝুরির সেলফিও নয়। তবে ছবির জায়গাটা তিনি চেনেন।
নাসডাক টাওয়ারের ছবি পাঠিয়েছে ফুলঝুরি। বিলবোর্ডে ঝলমল করছে বাবুয়ার স্টার্টআপের নাম। অ্যামেরিকার স্টক মার্কেট নাসডাক অভিনন্দন জানাচ্ছে বাবুয়ার কোম্পানিকে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন অবধি পৌঁছে যাওয়ার কারণে।
এই যে, ছবির সঙ্গে একটা মেসেজও পাঠিয়েছে ফুলঝুরি। লিখেছে, “আম্মা, তোমার ছেলে তো হাইফাই হয়ে গেল। ড্যাড’স স্টার্টআপ ইজ নাউ আ পাবলিক কোম্পানি!”
নিউইয়র্কের টাইমস স্কোয়ার। কী যেন নাম রাস্তাটার? এই মুহূর্তে সঠিক নামটা মনে পড়লো না তাঁর। তবে চোখের সামনে ভেসে উঠলো কত কিছু
বাবুয়া তখন কলেজে। অমলেশ আর সুমনা গিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক বেড়াতে। দু’জনে টাইমস স্কোয়ারে পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন, ব্রডওয়েতে শো দেখেছেন, ছোটখাট শপিং করেছেন। রাস্তার দু’পাশে বিশাল সাইজের সব বিলবোর্ড। সেই তিনি বিলবোর্ড শব্দটা শুনলেন, শিখলেন।
নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারে নাসডাক টাওয়ার। নাসডাক মার্কেট সাইট। সারা পৃথিবীর ব্যবসায়ীদের তীর্থস্থান। নাসডাক টাওয়ারের দিকে আঙুল তুলে অমলেশ বলেছিলেন, “অ্যামেরিকার স্টক মার্কেট। গোটা পৃথিবী এই মার্কেটের ওঠাপড়ার সঙ্গে চলে।”
আজ সেই নাসডাক টাওয়ারের বিলবোর্ডে ঝলমল করছে বাবুয়ার স্টার্টআপের নাম? অমলেশ চলে গেল। দেখে যেতে পারল না। থাকলে কত খুশি হত। সবাইকে গর্ব করে বলে বেড়াতো ছেলের সাকসেস স্টোরি। তা সুমনা খুশি হননি বাবুয়ার সাফল্যে?
খুশি নয়, তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে বুকের গহিনে। সঙ্গে অভিমানের কাঁটাও ফুটছে গলার কাছটায়।
ফোন করলেন সুমনা। আদর মাখা গলায় বললেন, “খুব খুশি হয়েছিস, না?”
ও প্রান্তে কলকল করে উঠল উনিশ বছরের ফুলঝুরি, “আই অ্যাম সো প্রাউড অফ মাই ফাদার, আম্মা! নাউ হি ইজ আ বিগ ম্যান, ভেরি ভেরি বিগ।”
হেসে ফেললেন সুমনা, “হ্যাঁ, বিগ, ভেরি বিগ, আকাশ সমান উঁচু।”
ফুলঝুরি বলল, “ইয়েস। নাসডাক ওয়াজ হিজ ড্রিম। অ্যান্ড হি হ্যাজ রিচড দেয়ার। আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি ফর ড্যাড। আর ইউ নট হ্যাপি আম্মা?”
বুকের গভীর থেকে উত্থিত দীর্ঘশ্বাস চেপে সুমনা বললেন, “বাবুয়া কোথায়? ফোনটা দে। উইশ করে দিই।”
আবার কলকল করে ওঠে ফুলঝুরি, “বিগ ম্যান অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ আর নাউ ইন সিয়াটেল। মর্নিং ফ্লাইটে গেছে। বিজনেস মিটিং ফলোড বাই ডিনার। আমার উপর ইন্সট্রাকশন ছিল, তোমার ওখানে মর্নিং হলেই খবরটা যেন দিই।”
সুমনা বললেন, “ঠিক আছে। বাবুয়া ফিরে এলে ফোন করতে বলিস, কেমন?”
ফোন রেখে সুমনা দু’হাত জোড় করে কপালে ছোঁয়ালেন।
এক কাপ চা আর এক বাটি খই-মুড়কি নিয়ে ঘরে ঢুকল টিয়া। সুমনার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “প্রণাম করছ যে, আবার জপ করছ না কি? এই তো ঠাকুর ঘর থেকে বেরোলে!”
টিয়ার প্রশ্নের কোনও জবাব দেন না সুমনা। শুধু ইঙ্গিতে টেবিলের উপর কাপ আর বাটি নামিয়ে চলে যেতে বলেন।
দু’হাত জড়ো করে জপ নয়, বালগোপালকে প্রণাম করছিলেন সুমনা। এ বাড়ির গোপাল খুব জাগ্রত। গোপালের প্রতি সুমনার শুধু অসীম ভক্তি নয়, মনে মনে তিনি গোপালের কাছে ঋণীও।
বিয়ের পর যখন কিছুতেই কনসিভ করছিলেন না, দোলপূর্ণিমায় গোপালের পুজো দেওয়ার মানত করে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হন। বালগোপাল তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন। বাবুয়ার স্বপ্নও বালগোপালই পূরণ করেছেন।
‘ইচ্ছে পূরণ’ শব্দবন্ধ মনে হওয়ায় সুমনা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যান। কত মানুষের যে কত রকম ইচ্ছে থাকে। তবে মণিদার শেষ ইচ্ছেটা শুনে সত্যিই তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মণিদার শেষ ইচ্ছের কথা মনে পড়তে অতীতের দৃশ্যগুলো সার বেঁধে দুলতে শুরু করে সুমনার সামনে
আসলে বিরাশি বছর বয়সটাই এমন। যখন ভবিষ্যতের থেকে অতীত অনেক অনেক অনেক বেশি লম্বা। তাই বর্তমানে বাস করে ক্ষণে ক্ষণে অতীতে ডুব দেওয়াই ভবিতব্য।
এক তলা বাড়ি। দু’টো শোওয়ার ঘর। শোওয়ার ঘরের লাগোয়া টানা বারান্দা। বারান্দার শেষে রান্নাঘর। রান্নাঘরে কয়লার উনুন, মিটসেফ, লম্বা লম্বা কাঠের তাক। মিটসেফে কালো পাথরের বাটিতে দই। কাঠের তাকে বালি রঙের বয়ামে আমতেল, কুলের আচার, তেঁতুলের আচার। সামনে উঠোন। উঠোনের এক পাশে কলতলা, টিউবওয়েল। কলতলার লাগোয়া বাথরুম। বাথরুমে টিনের চাল। টিনের চালে বৃষ্টি পড়লেই রুমঝুম নূপুরের আওয়াজ। নূপুরের আওয়াজের সঙ্গে ঘটি হাতা ফ্রক পরা সুমনা বারান্দায় লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে আর চেঁচাচ্ছে...
‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে/ ধানের ভেতর পোকা, জামাইবাবু বোকা’
জামাইবাবু অবশ্য তখনও আসেনি। বিনুনি দুলিয়ে বড় বোন কলেজে যায়, ভালো ছাত্রী। নেটের উপর নীল আর সাদা উল দিয়ে মা নিজের হাতে মাফলার করেছে। সেই মাফলার গলায় জড়িয়ে সেজদা যায় যাদবপুর। মেজ বোন হিরোইন টাইপ, পাড়ার ক্লাবের ফাংশনে নিয়মিত নাটক করে। ছোড়দা বখাটে, ফেলুয়া। সেজ বোন, সুমনা আর ছোট ভাই – তারা তিন জনে লুডো খেলে, ক্যারম খেলে। বাগানের এক কোণে সেজদা বেঁধে দিয়েছে তাদের খেলাঘর, নারকেল পাতায় ছাওয়া।
আট ভাইবোন। বাবা সেকেন্ডারি স্কুলের ভূগোলের মাস্টারমশাই। মাস গেলে গোনাগুনতি ক’টা টাকা। এত বড় সংসারের খাঁই তো কম নয়। মাসের পনেরো তারিখের মধ্যেই মাইনের টাকা ফুরিয়ে যায়। নিশ্চয়ই পি সি সরকারের থেকেও অত্যাশ্চর্য ম্যাজিক জানতেন মা। মাসের বাকি পনেরো দিন যে কী উপায়ে মা সংসার চালাতেন সে ইতিহাস সুমনার অজানা।
ভাইবোনদের প্রত্যেকেই স্কুল-কলেজ গেল। শুধু বড় ভাই মনিদার কলেজ যাওয়া হল না। সংসারের চাহিদা মেটাতে মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই মনিদা চাকরিতে ঢুকে যায়। মনিদার উপার্জনে সংসারে কিছুটা সাশ্রয় আসে। পুজোয় তাদের একটার জায়গায় দু’টো জামা হওয়া শুরু হয়। মায়ের হাতে শাখা-পলার পাশে চারগাছি সোনার চুড়ি, বাবার ঘরে রেডিও, দিদির রিষ্টে লেডিজ ওয়াচ, রেস্তোরাঁয় কবিরাজি কাটলেট, এরকম ছোট ছোট সুখ ফিরে আসে তাদের পরিবারে।
মনিদা ছিল সংসারের কল্পতরু। দিদির বিয়ে, সেজদার বিদেশ যাওয়ার প্যাসেজ মানি, সব ওই মনিদা। নিজের বলে কিছু রাখতে জানত না মানুষটা। মনিদার সবকিছুই ছিল বারোয়ারি। প্রত্যেকেরই তাতে অধিকার। শখ করে পেস্তা রঙের একটা কাশ্মীরি শাল কিনেছিল। বাবা থেকে শুরু করে অন্য ভাইরা, যার যখন প্রয়োজন সেই কাশ্মীরি শাল গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে যেত।
আসলে সেই যে দেশ ভাগ হল, তারপর থেকে ভাগাভাগিই হয়ে গিয়েছিল তাদের প্রতিদিনের জীবন। একটা ডিম দু’ভাগ করে দু’জনের পাতে দিতেন মা। সন্ধ্যের পর একটাই আলো জ্বলত ঘরে। একটা বাল্বের আলোর নিচে খাটে, মেঝেতে, টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে লেখাপড়া। একটাই জ্যামিতি বক্স, একটাই অ্যাটলাস। একই মশারির নিচে ঠাসাঠাসি করে চার বোনের রাতের ঘুম। ওদেশের পাঁচমহলা বাড়ি ছেড়ে এদেশের দু’ঘরের বাড়িতে আলো, বাতাস, পরিসর নিয়ে অবিরত ভাগাভাগি আর ভাগাভাগি।
গ্রহের ফেরে এই অভাব অনটনের বৃত্তের বাইরে ছিটকে পড়েছিলেন সুমনা। অমলেশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। আর উঠে বসেন এক ঘোড়ার পিঠে। যে ঘোড়ার লক্ষ্য দিগন্তরেখা। অসম্ভবকে ছোঁয়ার নেশায় পথ অতিক্রম করা।
কতটা পথ চললে সে পথিক হয়? হংকং বা হনলুলু, বার্লিন বা বেইরুট, কোথাওই যাওয়া হয়নি সুমনার। তবে জীবনের পথে তিনি হেঁটেছেন দীর্ঘ পথ। জন্ম বাংলাদেশের খুলনা জেলার দৌলতপুরে। সেখান থেকে কলকাতা। কলকাতা থেকে দিল্লী। দিল্লী থেকে লন্ডন। শেষ বয়সে আবার কলকাতায়।
পুর্ণদাস রোডের এই বাড়িতেই নববধূরূপে এসেছিলেন সুমনা। বাবুয়ার জন্মও এই বাড়িতেই। বাবুয়ার দু’বছর বয়সে তাঁরা দিল্লী চলে যান। অমলেশের তখন কাজ আর কাজ। অফিসই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। লাফ মেরে মেরে উঠছেন উপরে। শেষে সাগরও পার হলেন। পৌঁছে গেলেন লন্ডনে।
দূর দেশে চলে যাওয়ার কারণে বছরে একবার, বড় জোর দু’বার কলকাতায় আসা হত সুমনার। কলকাতায় তাঁর বাপেরবাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। দুই বাড়িতেই বুড়ি ছোঁয়ার মতো কয়েকটা দিন থাকা, তারপর ফিরে যাওয়া।
সেজদা আর সুমনা ব্যতীত অন্য ভাইবোনেরা কলকাতার আশপাশেই সেটল করল। তবু মা-বাবার দায়িত্ব ছিল একা মনিদার। দায়িত্ব পালন করতে করতে মনিদার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেল, বুড়ো হয়ে গেল মানুষটা। মা-বাবা চলে গেলেন। একসময় মনিদাও অবসর নিলেন চাকরি থেকে।
এখন মনিদার দায়িত্ব নেয় কে? আবার শুরু হল ভাগাভাগি...
ভাইবোনেরা কেউ একা মনিদার দায়িত্ব নেয়নি। মনিদা তো সবার। মনিদা প্রত্যেকের জন্য কর্তব্য করেছে। ভাইবোনের সংসারে ঘুরে ঘুরে থাকতেন মনিদা। বিদেশে থাকার কারণে এই দায়িত্ব থেকে ছাড় পেয়েছিল সুমনা।
একদিন চিঠি এল ছোট ভাইয়ের। মনিদা অসুস্থ। রোগ বাসা বেঁধেছে লাংসে। এই রোগের চিকিৎসায় অনেক খরচ। মনিদার চিকিৎসায় কোনওরকম গাফিলতি হওয়া উচিত নয়। যার যেমন ক্ষমতা সে যেন তেমন আর্থিক সাহায্য করে মনিদাকে।
সাধ্যমত টাকা পাঠিয়েছিল সুমনা। আর বাবুয়াকে অমলেশের জিম্মায় রেখে সশরীরে হাজির হয়েছিল কলকাতায়। তবে বেশি সেবা, বেশি অনুগ্রহ নেয়নি মনিদা। খুব তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল। শুধু একটা ঘটনা মনে পড়লে আজও স্তব্ধ হয়ে যান সুমনা। মন ভারী হয়ে ওঠে। নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মনে মনে বিচার করেন।
মনিদার জন্য তখন সবাই উদ্বিগ্ন। বোনেরা, ভাইবউয়েরা প্রত্যেকেই আন্তরিকতার সঙ্গে দাদার সেবা করছে। সুমনা গায়েগতরের বেশি করতে পারত না। সে শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসুস্থ মনিদার পাশে বসে থাকত আর গল্প করত। কথার ফাঁকে ফাঁকে পড়ার চেষ্টা করত মনিদার মন। বুঝতে চাইত প্রকৃত মানুষটিকে। সুমনা জিজ্ঞেস করত, “সারাজীবন সংসারের জন্য এত করলে। ভাইবোনদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেল। এদিকে তোমার চোখের সামনে ছোট ভাইবোনেদের প্রত্যেকের ভরা সংসার। সময়ের সঙ্গে তুমি একা হয়ে গেলে। তোমার দুঃখ হয় না মনিদা?”
মনিদা চিত হয়ে শুয়ে ঘরের সিলিংয়ের দিকে চোখ রেখে চুপচাপ সুমনার কথাগুলো শুনত। একসময় পাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে ছোট্ট উত্তর দিত, “না।”
সুমনা আবার জিজ্ঞেস করত, “কোনও শখ হয় না মনিদা? কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে না? তুমি ভালো হয়ে ওঠো। আমি তোমাকে লন্ডনে নিয়ে যাব।”
সুমনার বারংবার প্রশ্নে একদিন মনিদা বলেছিল, “তোদের বাড়ির বাগানে আপেল গাছ আছে, না? একটা লাল টুকটুকে আস্ত আপেল। কাটাকুটি ভাগাভাগি করে নয়। গোটা আপেলটা আমার হাতে। একটু একটু করে কামড়ে কামড়ে খাব। যতটা পারলাম খেলাম। বাকিটা ফেলে দিলাম। ফেলে দেওয়া নিয়ে কঞ্জুষি নেই। নষ্ট হল বলে হা-হুতাশ নেই। নিজের ইচ্ছেটাই বড় কথা।”
মুহূর্তের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল সুমনার। যোগ নয়, গুন নয়, ভাগ করে করে জীবন অতিবাহিত হল মা, বাবা আর মনিদার।
এদিকে সুমনার জীবনে কী প্রাচুর্য! লন্ডনে তাদের বাগানের আপেল গাছ ঢেকে থাকে আপেলে। সেই আপেলের ক’টা তারা খায়? অধিকাংশই তো মাটিতে পড়ে নষ্ট হয়।
সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল অমলেশের প্রাচুর্য যেন তাঁর লজ্জা। পরে মনে হয়েছিল যে, দেশ ভাগ যেমন বাবা, মা বা মনিদার হাতে ছিল না, অমলেশের চড়াইয়ে ওঠার নেশায় রাশ টানাও সুমনার আয়ত্তের বাইরে ছিল।
তবু মাঝেমধ্যে তাঁর দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বাবুয়ার স্বভাব হয়েছে ঠিক অমলেশের মতন, নতুন কিছু করার নেশায় ছটফট করতে থাকে। বাবুয়া যদি কিছুটা মনিদার ধারাও পেত!
সুমনা একা থাকেন কলকাতায়। আর বাবুয়া সুদূর ক্যালিফোর্নিয়ায়। বাবুয়ার চিন্তা হয় না মায়ের জন্য?
অবশ্য ফুলঝুরি হলে বলত, “এটা গ্লোবালাইজেশনের যুগ আম্মা। দূর আর দূরে নেই। সবই কাছে। তোমার কোনওরকম অসুবিধে হলেই ড্যাড পৌঁছে যায় তোমার কাছে। রেগুলার ফোন করে। তাছাড়া, এখানের ওয়েদার তোমার স্যুট করে না। আই থিংক দিস ইজ বেস্ট। বোথ অফ ইউ আর এনজয়িং ইয়োর ওন স্পেস। বাট ইন নিডস, ড্যাডের জন্য তুমি, তোমার জন্য ড্যাড আছে।”
ঈশ্বরের কৃপায় বাবুয়ার টাকাপয়সার তাঁর প্রয়োজন নেই। অমলেশ যথেষ্ট রেখে গেছেন সুমনার জন্য। কিন্তু প্রতিদিনের যত্ন? অফিস থেকে ফিরে বুড়ো মায়ের পাশে বসা, ওষুধ খাওয়া নিয়ে তদারকি করা, এসব ইচ্ছে করে না বাবুয়ার? যেমনটা মনিদা করত মা-বাবার জন্য?
এতক্ষণে টিয়া আবার ফিরে এসেছে ড্রয়িং রুমে। ডাস্টিং করছে। পিয়ানো, শো কেসের প্রতিটি পুতুলের ধুলো ঝেড়ে এখন সে সেন্টার টেবিলের বেলোয়ারি কাজ করা কাঠের পায়াগুলো এক টুকরো পুরনো কাপড় দিয়ে ঘষছে...
হঠাৎ হাতের কাজ থামিয়ে টিয়া বলল, “আম্মা, তোমার ছেলের কীসের অফিস গো? এদেশে আছে? অনেক লোক কাজ করে?”
হাতের চশমাটা চোখে এঁটে সুমনা তাকালেন টিয়ার দিকে। বললেন, “কেন রে? দাদার কোম্পানির খোঁজে তোর কী দরকার?”
চোখে একটু কিন্তু কিন্তু ভাব টিয়ার। তবু সাহস করে বলে, “কম্পিউটারের অফিস, না? আমি শুনেছি। তুমি সেদিন ডাক্তার কাকুকে বলছিলে।”
সুমনা গম্ভীর মুখে বলেন, “হ্যাঁ, কম্পিউটারের। এদেশে ব্যাঙ্গালোরে বড়ো অফিস করেছে।”
টিয়া বলল, “আমার মাসির ছেলে গো। কত চেষ্টা করে একটা চাকরির। হয় না। লোন নিয়ে কীসব কোর্স করল কম্পিউটারের। দাদার অফিসে মাসির ছেলের একটা কাজ হয় না আম্মা? তুমি বলে দাও না দাদাকে?”
সুমনার চোখে বিরক্তি, “দাদার অফিসে কেন রে? দাদার অফিস ছাড়া কি দেশে চাকরি নেই?”
টিয়া ঝনঝনিয়ে ওঠে, “এত বছর এই বাড়িতে কাজ করছি। আমি জানি দাদাকে। তুমি বললে ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দেবে। সবই বুঝি আম্মা। আসলে দাদার উপরে তোমার অভিমান। তিনশো পঁয়ষট্টি দিন তোমার সঙ্গে থাকে না তাই, ঠিক না? কিন্তু কত বড়ো কাজ করছে বল তো দাদা? এত মানুষের ভাতের জোগাড় দেওয়া কী কম কথা?”
টিয়ার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখেন সুমনা। কান পেতে কথাগুলো শোনেন। বাড়ির পরিচারিকা টিয়া যে কথাটা এত সহজে হৃদয়ঙ্গম করল, মা হয়ে সুমনার তা বুঝতে কেন এত দেরি হল?
সত্যিই তো। টিভিতে, নিউজপেপারে সর্ব ক্ষণ চাকরি নেই নেই রব। সেখানে বাবুয়ার কোম্পানিতে একশো জন এমপ্লয়ি। একশোটা পরিবারের সুখদুঃখের দায়িত্ব বাবুয়ার স্টার্টআপের। সে কী কম কথা!
মনিদা ঘাড় পেতে নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিল। বাবুয়ার মাথায় একশোটা পরিবারের চিন্তা। মনিদার ছিল আত্মত্যাগ। মনিদার কর্ম মহান। বাবুয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষী, পরিশ্রমী। বাবুয়ার পরিশ্রমের ফল আরও বৃহৎ, আরও ব্যাপ্ত।
কী ভেবে সুমনা আবার ফোন করলেন।
ও প্রান্তে ফুলঝুরি জিজ্ঞেস করল, “কী হল ওল্ড লেডি? এনিথিং রঙ? তোমার ছেলে কাল ফিরবে।”
সুমনা হাসলেন, “আমার ছেলে হয়েছে একেবারে তার বাবার মতো। মানে তোর দাদুর মতো। আর শোন, আমার ছেলেটা খেটেখুটে বাড়ি ফেরার পরই যেন আমাকে ফোন করতে বলিস না, বুঝলি? আমি ভালো আছি। দিব্যি আছি। নতুন ওষুধটা খেয়ে আমার হাঁটু এখন ফাস্ট কেলাস। হাতের কাজ সম্পূর্ণ হলে তবেই যেন বাবুয়া আমাকে ফোন করে। নাহলে খুব রাগ করব, বুঝলি?”
ও প্রান্তে দু’বার উম উম করে চুমু খাওয়ার আওয়াজ করে ফুলঝুরি। বলে, “ইউ আর সাচ আ সুইট হার্ট আম্মা!”
কান থেকে মোবাইল ফোনটা সরিয়ে জানলার বাইরে তাকান সুমনা। তাঁর চোখ অকারণে ভিজে ওঠে।
তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন সামনের ফ্ল্যাটের বারান্দায় ছোট্ট ছেলেটাকে। ছেলেটার হাতে ধরা লাল এরোপ্লেনটার ডানা দু’টো হাওয়ায় থিরথির করে কাঁপছে। আর সেই দস্যি ছেলে হাতের প্লেনটা গ্রিলের উপর দিয়ে জোরে চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মুখে শব্দ করছে, হুউউউস...