আমাদের বাড়ির সামনেই যে পানাভাসা পুকুরটা... সেখান থেকে মাছধরার জালে নাকি একটা প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তি উঠেছে। ইন্দ্র ফোন করে বলল, “চল, একবার দেখে আসি। দিব্যি তো দেবতা জলের নিচে যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। আজ হঠাৎ হাই তুলে জেগে ওঠার ইচ্ছা হল কেন?”
আমাদের মফস্সল শহরটায় যে দু’-চারটে পুকুর ভরাট করে এখনও হাউসিং কমপ্লেক্স ওঠেনি, এই পুকুরটা তাদের মধ্যে একটা। বারো শরিকের সম্পত্তি, তাই বেচারা পুকুরটা কোনওক্রমে নিস্তার পেয়েছে। মালিকানার কাগজপত্র এক হাতে থাকলে কবেই চোখ বুজতে হত। খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, জেলেদের কাছ থেকে পাড়ার ছেলেরা কেসটা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। ক’দিন আগেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে গেছে। গণেশ পুজো দিয়ে বছর শুরু, জগদ্ধাত্রী পুজো দিয়ে শেষ। পাড়ার ছেলেরা নিষ্কর্মা বসেছিল। হুজুগ পেয়ে শ্যাওলা ধরা মূর্তিটার কপালে ফোঁটা-তিলক কেটে পুকুর পাড়ের ঝুরি-নামা বট গাছের নিচে তাকে রীতিমত প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। কয়েকজন ইতিমধ্যে দলবেঁধে চাঁদা তুলতেও বেরিয়ে পড়েছে। ছোটখাটো একটা মন্দির না হলে দৈনন্দিন পুজো কী করে হয়! তাছাড়া পুজোর আয়োজন করতে গেলেও তো কিঞ্চিৎ ক্যাশকড়ি লাগবে। একবার জাগ্রত বলে রটে গেলে তখন নাহয় পাবলিক নিজে থেকেই এসে মাথা ঠুকে প্রণামী দিয়ে যাবে।
ইন্দ্র আমার ছোটবেলার বন্ধু। আমরা একই পাড়ায় বাসিন্দা। এখানে ইন্দ্রর পরিচয় জানিয়ে রাখা জরুরি। তার বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্বাদ-স্পর্শ অনুভবের ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থেকে অনেক সূক্ষ্ম। অনুভবের পরিধিও আমাদের মতো মরণশীল মানুষদের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন সে হাতিদের মতো অনেক দূর থেকে নিচু কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায়। অবসর সময়ে কানে হ্যান্ডস ফ্রি লাগিয়ে তিমি মাছের গান শোনে। যে কোনও গুঁড়ো ওষুধ জিভে ঠেকিয়ে বলে দিতে পারে তার জেনেরিক নাম। গন্ধ শুঁকে শ্যানেলের নম্বর। সব থেকে আশ্চর্যের কথা হল সে ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। অন্তত যা ভবিষ্যদ্বাণী করে তার অধিকাংশই ফলে যায়।
সে যে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী সেই খবরটা সম্প্রতি লোক জানাজানি হতে শুরু করেছে। সৌজন্যে - লোকাল থানার ওসি সুবিনয়বাবু। শিখাবৌদি-জগন্নাথের কেসটায় ইন্দ্রর দেখানো রাস্তায় হেঁটে সুবিনয়বাবু মোটামুটি অবলীলায় অপরাধীদের পাকড়াও করেছিলেন। তারপর থেকে কোনও তদন্তে ফেঁসে গেলেই সুবিনয়বাবু ইন্দ্রর শরণাপন্ন হচ্ছিলেন। তবে ইন্দ্রর আপাত অতিপ্রাকৃত কাজকর্মের কতটা অলৌকিক আর কতটা তার প্রখর বুদ্ধি আর বিশ্লেষণী ক্ষমতা-প্রসূত সেই নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ ছিল। ইন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলে অবশ্য জবাব দিত না। কেবল মিটিমিটি হাসত। গোদের ওপর বিষফোঁড়া ইন্দ্রর বোন স্বাতী। তার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় সে আমায় পুরোপুরি পড়ে ফেলেছে। বস্তুত ভাইবোনকে নিয়ে আমি রীতিমত বিব্রত।
স্বাতীর কথা পরে হবে। যা বলছিলাম, আমি আর ইন্দ্র বটতলায় গিয়ে দেখলাম মনা পাগলা বিষ্ণুমূর্তি আগলে বসে আছে। মনা আমাদের দেখে ডান হাত মুঠি করে মাথার ওপর তুলে বলল, “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!”
ইন্দ্র হেসে বলল, “হ্যাঁ রে মনা, বিপ্লব কোথায়? তোকে এখানে বসিয়ে রেখে কেটে পড়েছে?”
মনা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “তুই কী করে জানলি? বিপু বলল, পাঁচ মিনিটের জন্য বোস, সিঙাড়া-জিলিপি নিয়ে আসছি. . . এক ঘণ্টা হয়ে গেল, খচ্চরটার পাত্তা নেই।”
ইন্দ্র পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বার করে মনার হাতে দিয়ে বলল, “যা মনা, বিশু ময়রার দোকান থেকে সিঙাড়া-জিলিপি নিয়ে আয়। আমরা ততক্ষণ এখানে বসছি।”
মনা হাতে পয়সা পেয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল। দেখলাম ইন্দ্র জ্বলন্ত দৃষ্টিতে বিষ্ণুমূর্তিটাকে নিরীক্ষণ করছে। দু’মিনিট পরে আমার দিকে ঘুরে বলল, “রুদ্র, গত মাসে মহাদেব সাহা খুন হয়েছিল মনে আছে? সুবিনয়বাবুকে ফোন করে বল, মার্ডার-উইপনটা পাওয়া গেছে।”
মহাদেব সাহা এই অঞ্চলের নামকরা ব্যবসায়ী ছিলেন। জুয়েলারির বিজনেস, বাজারের মাঝ-মধ্যিখানে বিরাট শো-রুম। দিন পনেরো আগে নিজের বসতবাড়ি থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। আততায়ী ভারী কোনও বস্তু দিয়ে আঘাত করে মাথাটা থেঁতলে দিয়েছিল। আমি বললাম, “খেপে গেলি নাকি? এই মূর্তিটা মার্ডার উইপন? কে জানে কবে থেকে পুকুরের নিচে পড়ে আছে!”
ইন্দ্র বলল, “ভাল করে তাকিয়ে দেখ। মূর্তিটা বেলে পাথরে তৈরি। এমনিতেও বেলে পাথরে কিছুদিনের মধ্যেই হলুদ ছোপ ধরে। তার ওপর শ্যাওলা পড়েছে বলে আরও পুরনো মনে হচ্ছে। বাঁকুড়ার শুশুনিয়ায় কিছু শিল্পী পরিবার এই ধরণের মূর্তি তৈরি করে। বছর পঞ্চাশ আগে তামিলনাড়ুর মহাবলীপুরম থেকে এক ভাস্কর এসে শুশুনিয়ায় বাসা বাঁধেন। বর্তমানের শিল্পীরা সেই ভাস্করের চ্যালা-চামুণ্ডা বা তাদের বংশধর। তবে অত দূর যেতে হবে না। দেখে মনে হচ্ছে মুর্তিটার বয়স বড় জোর চার বা পাঁচ।”
সুবিনয়বাবুকে ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যেই গলিতে পুলিশের গাড়ির নাক দেখা গেল। মনা পাগলা তখনও সিঙাড়া-জিলিপি শেষ করতে পারেনি। পুলিশ আসছে দেখে একটা আধভাঙা জিলিপি হাতে নিয়েই সে দৌড় দিল। সুবিনয়বাবু সব শুনেটুনে ইন্দ্রকে প্রশ্ন করলেন, “মানছি মূর্তিটা তেমন পুরনো নয়। ইন ফ্যাক্ট, আমারও চেনা-চেনা ঠেকছে, কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু এই মূর্তিটাই যে মার্ডার উইপন তার প্রমাণ কী?”
ইন্দ্র যথারীতি মিচকে হেসে বলল, “প্রমাণ জোগাড় করা আপনাদের কাজ। আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পেলাম খুনি পুকুরপাড়ে সাইকেল থেকে নেমে মূর্তিটা জলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবার সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। তাই বললাম আর কী!”
আমি বললাম, “মার্ডার উইপন কি না সেটা পরে বিচার করলেও চলবে। আমার মনে হয় আপাতত মূর্তিটাকে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া জরুরি। একবার পুজো-আর্চা শুরু হয়ে গেলে উদ্ধার করা মুশকিল হবে। কপালে চন্দন লেপটে তখন তিনি এই বটমূলেই অনন্তকাল বিরাজ করবেন। সাক্ষীগোপাল হতে রাজি হবেন না।”
সুবিনয়বাবু আমার কথা শুনতে পেলেন কি না বুঝলাম না। চিন্তিত মুখে ইন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মূর্তিটা জলে ছুড়ে ফেলতে দেখলে, আর খুনির মুখ দেখতে পেলে না?”
ইন্দ্র বিমর্ষ গলায় বলল, “কী করব? সেদিন গলির মুখের আলোটা জ্বলছিল না যে। তাই মুখটা দেখতে পেলাম না।”
মফস্সলে প্রেম করার উপযুক্ত নির্জন জায়গার বড় অভাব। মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমার টিকিটের আজকাল ভয়ানক দাম। অগত্যা সস্তায় কিছুক্ষণের নিবিড় অন্ধকার পাওয়ার লোভে লোকাল প্রেমিকেরা প্রায়ই ঢিল ছুড়ে গলির লাইট ভেঙে দেয়। সেই নিয়ে অভিযোগ করে লাভ নেই। কেউ করেও না। কর্তৃপক্ষকে বললে বদলে দিয়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা মাঝে-মধ্যে জুভেনাইল অপরাধীদের পাকড়াও করে ধমক-ধামক দেয়। তাতে কিছু কাজ হয় না।
পাড়ার ছেলেরা একজন-দু’জন করে জড়ো হচ্ছিল। অধিকাংশই চেনা মুখ। মনা পাগলার কাছ থেকেই খবর পেয়েছিল মনে হয় যে পুলিশ এসেছে। তাদের চোখে-মুখে চাপা অসন্তোষ। বোধহয় আঁচ করতে পারছিল মূর্তিটা হাতছাড়া হতে চলেছে। সঙ্গে চাঁদার পয়সায় দেদার ফুর্তি করার সুযোগ।
সুবিনয়বাবু এগোচ্ছিলেন, সম্ভবত বিষ্ণুমূর্তিটা বাজেয়াপ্ত করার জন্য। ইন্দ্র তাঁর হাত চেপে ধরল। এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে কানে কানে কী বলল। দেখলাম সুবিনয়বাবু রণে ভঙ্গ দিলেন। মাতব্বর গোছের এক ছোকরাকে ডেকে বললেন, “শোনো, এই মূর্তিটার সঙ্গে একটা খুনের সম্পর্ক থাকতে পারে। আমি এখনই কাস্টডিতে নিচ্ছি না। তবে দরকার পড়লে তুলে নিয়ে যাব। তখন কিন্তু কারও কথা শুনব না। আর হ্যাঁ, যদি শুনি চাঁদা তোলা নিয়ে জোরজুলুম করেছ…” কথাটা শেষ না করেই সুবিনয়বাবু পিছন ফিরলেন।
যদি সত্যিই বিষ্ণুমূর্তিটা মার্ডার উইপন হয় সেটাকে অরক্ষিত ছেড়ে যাওয়া কি ঠিক হল? খুনের কথাটাই বা এত চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলার কী হল বুঝলাম না। ইন্দ্র বোধহয় আমার মনের কথাটা আঁচ করতে পেরেছিল। ফেরার পথে বলল, “রুদ্র, ছিপ ফেলে মাছ ধরেছিস কোনওদিন? গুছিয়ে মাছ ধরতে বসার আগে চার ফেলতে হয়। সুবিনয়বাবুকে সেটাই করার পরামর্শ দিলাম। ভাবিস না, প্লেইন ড্রেসে দু’-একজন কনস্টেবল আশেপাশে থাকবে।”
২
মোবাইল ফোনটা বেজে যাচ্ছিল। রাতে থিসিসের কাজ করছিলাম, শুতে দেরি হয়েছিল। ঘুম কাটেনি, এক চোখ খুলে দেখলাম স্ক্রিনে ইন্দ্রর নাম ভাসছে। সকাল সকাল কী হল আবার? ফোন ধরতেই ইন্দ্র বলল, “চলে আয়। সুবিনয়বাবু আসছেন। বিষ্ণুমূর্তি হাপিশ।”
কোনওমতে চোখে মুখে জল দিয়ে ইন্দ্রদের বাড়ি পৌঁছে দেখি সুবিনয়বাবু ভগ্নদূতের মতো বৈঠকখানা ঘরের সোফায় বসে আছেন। চুল উসকোখুসকো, গালে বাসি দাড়ির প্রলেপ। সামনের টেবিলে রাখা জলের বোতল থেকে গ্লাসে জল ঢেলে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেলেন। ইন্দ্র বলল, “চা-টা খেয়ে একটু সুস্থ হয়ে বসুন। তারপর সব শুনব।”
স্বাতী ট্রে-তে তিনটে কাপ আর প্লেটে ক’খানা থিন এরারুট বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকল। টেবিলের ওপর ট্রে-টা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “রুদ্রদা, কাল কত রাতে শুয়েছ? চোখ লাল হয়ে আছে। তোমার জন্য চিনি ছাড়া কফি এনেছি।”
মেয়েটা কি অন্তর্যামী?
চায়ে চুমুক দিয়ে সুবিনয়বাবু বললেন, “ঘটনাটা ঘটেছে ভোরের দিকে। ওই সময়টায় আজকাল কুয়াশা পড়ছে। সেই সুযোগে কেউ মূর্তিটা নিয়ে চম্পট দিয়েছে।”
ইন্দ্র জিজ্ঞেস করল, “পাহারায় ছিল না কেউ?”
সুবিনয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “দু’জন কনস্টেবল মোতায়েন ছিল। একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পাঁচ মিনিটের জন্য সরে গিয়েছিল। অন্য জন ঝিমচ্ছিল বসে বসে। একটা শব্দ পেয়ে চোখ খুলে দেখে বিষ্ণূমূর্তি হাওয়া, সেই জায়গায় একটা হুতুম পেঁচা বসে আছে।”
ইন্দ্র ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কীসের শব্দ?”
সুবিনয়বাবু আমতা আমতা করে বললেন, “সে তো জিজ্ঞেস করিনি।”
ইন্দ্র বলল, “বেশ করেছেন। আচ্ছা, আপনি বলছিলেন না মূর্তিটা চেনা-চেনা লাগছে? আগে কোথায় দেখেছেন মনে করতে পারেন?”
সুবিনয়বাবু ভেবেচিন্তে বললেন, “দেখেছি কোথাও, কিন্তু…”
ইন্দ্র বলল, “হাল ছাড়বেন না। ভাবুন। মনে পড়বে। ঠিক মনে পড়বে।”
সুবিনয়বাবু হাত ওলটালেন। বললেন, “না হে, কিছুই মনে পড়ছে না।”
ইন্দ্র বলল, “পারসিসট্যান্স অভ ভিশন কাকে বলে জানেন তো? দৃশ্য মুছে গেলেও তার ছায়া আমাদের চোখে লেগে থাকে। ঠিক চোখ নয় অবশ্য। আমাদের মগজ সেই ছায়া ধরে রাখে। প্রত্যক্ষ স্মৃতি একটু একটু করে ক্ষয়ে যায়, ঝাপসা হয়ে আসে কিন্তু সেই ছায়া অনন্ত কাল আমাদের মগজের স্মৃতিকোষের মধ্যে জমা হয়ে থাকে। আপনি চেষ্টা করলেই তাকে উদ্ধার করে আনতে পারবেন।”
সুবিনয় বাবু অসহিষ্ণু গলায় বললেন, “আরে মগজের কোথায় কোন কোষে সেই মূর্তিটার ছায়া ঘাপটি মেরে লুকিয়ে বসে আছে কী করে জানব? একটা ক্লু পেলেও না-হয়…”
ইন্দ্র বলল, “আচ্ছা, দেখি আমি আপনাকে কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারি কি না! ভাল করে ভেবে জবাব দিন। সুবিনয়বাবু, আপনি কি কখনও বাঁকুড়ার শুশুনিয়ায় গেছেন?”
সুবিনয়বাবু ঘাড় নেড়ে বললেন, “কস্মিনকালেও না। কোনও চেনা-পরিচিত বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনও নেই যে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা ছিল। গতকাল তোমার কাছেই প্রথম শুনলাম মূর্তিটা ওখানকার তৈরি।”
ইন্দ্র বলল, “থানায় কেউ মূর্তি চুরির নালিশ জানাতে এসে ছবি-টবি দেখিয়েছিল?”
সুবিনয়বাবু হতাশ ভাবে ঘাড় নাড়লেন।
ইন্দ্র বলল, “মূর্তিটা প্রায় হাত খানেক লম্বা। কোথাও এনকোয়ারি করতে গিয়ে চোখে পড়েছে? হয়তো কারো বৈঠকখানা ঘরে সাজিয়ে রাখা ছিল। অনেকে যেমন দোরগোড়ায় বাঁকুড়ার পাঁচমুড়া গ্রামে তৈরি পোড়ামাটির ঘোড়া সাজিয়ে রাখে।”
সুবিনয়বাবু বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছুদিন আগেই পোড়ামাটির ঘোড়া দেখলাম যেন কার বাড়িতে!”
ইন্দ্র সুবিনয়বাবুর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। একটা অদ্ভুত খসখসে গলায় বলল, “সুবিনয়বাবু, আপনি আমার চোখের দিকে তাকান। ওই বিষ্ণুমূর্তিটার কথা চিন্তা করুন। গভীর ভাবে চিন্তা করুন।”
সুবিনয়বাবু আশ্চর্য হয়ে ইন্দ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানে?”
ইন্দ্রর চোখে কী ছিল কে জানে, সুবিনয়বাবুর চোখ ইন্দ্রর চোখে আটকে রইল। চোখ নয় তো, চুম্বক! দেখলাম সুবিনয়বাবুর চোখের পাতা পড়ছে না। মিনিট খানেকের মধ্যেই অবশ্য সুবিনয়বাবুর চোখের পাতা ঝুঁকে এল। ইন্দ্র ফিসফিস করে বলল, “কী দেখছেন, সুবিনয়বাবু?”
সুবিনয়বাবু বললেন, “সোফায় বসে আছি, সামনে একটা শো-কেস, কাচের তাকের ওপর পুতুল সাজানো রয়েছে, ডোকরা, পোড়ামাটির, আর… আর…”
ইন্দ্র বলল, “আর বিষ্ণূমূর্তি? দেখতে পাচ্ছেন?”
সুবিনয়বাবু চুপ করে রইলেন। জবাব দিলেন না। ইন্দ্র প্রসঙ্গ বদলাল, বলল, “সামনের সোফায় যে বসে আছে তাকে চিনতে পারছেন? তার নাম কী?’
সুবিনয়বাবু নিস্তেজ গলায় বললেন, “সামনের সোফা খালি, কেউ বসে নেই।”
মুহূর্তের জন্য ইন্দ্রর মুখে নৈরাশ্য ফুটল। তবে সে হাল ছাড়ল না, বলল, “এক কাজ করুন। সোফা থেকে উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসুন। দরজার বাইরে কোনও নেমপ্লেট দেখতে পাচ্ছেন?”
সুবিনয়বাবু একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, “পাচ্ছি। পালিশ করা কাঠের দরজা, সোনালি নেমপ্লেট…”
ইন্দ্রর রগের পাশ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছিল। ঝুঁকে পড়ে বলল, “নামটা পড়ুন।”
সুবিনয়বাবু আস্তে আস্তে কেটে কেটে বললেন, “প্রোফেসর… প্রোফেসর এ কর্মকার।”
ইন্দ্র সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু’-আঙুলে চুটকি বাজাল। সুবিনয়বাবু চটকা ভেঙে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলেন। আধ খাওয়া চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে বললেন, “এ হে, জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে।”
বুঝলাম গত পাঁচ-সাত মিনিটের ঘটনাটা তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। ইন্দ্র যে সম্মোহন করতে পারে জানতাম না। ব্যাটা আর কী কী খেল দেখাবে ভগবানই জানেন। ইন্দ্র বলল, “ওটা ছেড়ে দিন। আবার চা দিতে বলছি।”
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সুবিনয়বাবু বললেন, “আশপাশের দু’-চারটে পাড়ায় খোঁজ নিয়ে দেখি গত কয়েক মাসের মধ্যে কারা কারা বাঁকুড়া গেছে। বিশেষ করে শুশুনিয়ায়।”
ইন্দ্র বলল, “ব্যাপারটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো হয়ে যাবে না?”
সুবিনয়বাবু বললেন, “তাছাড়া আর উপায় কী?”
ইন্দ্র বলল, “আচ্ছা, আপনি প্রোফেসর কর্মকার বলে কাউকে চেনেন? প্রোফেসর এ কর্মকার?”
সুবিনয়বাবু চমকে উঠলেন, বললেন, “প্রোফেসর অনিরুদ্ধ কর্মকারের কথা তুমি জানলে কী করে? মহাদেব সাহা হত্যা মামলায় নাম জড়িয়েছিল। তদন্তের জন্য ওঁর বাড়ি গিয়েছিলাম। তাই তো, প্রোফেসর কর্মকারের আদি বাড়ি বাঁকুড়ার শুশুনিয়ায়। কর্মসূত্রে আমাদের মফস্সল শহরের বাসিন্দা। গভর্মেন্ট কলেজে বাংলা পড়ান। তোমাদের পাশের পাড়ায় নিজস্ব বাড়ি বানিয়েছেন। দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে হচ্ছে সেখানেই পোড়ামাটির ঘোড়া দেখেছিলাম।”
ইন্দ্র বলল, “আর বিষ্ণুমূর্তিটা? সেটা দেখেননি? ওঁর বৈঠকখানা ঘরের শো-কেসে?”
সুবিনয়বাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন, বললেন, “হতে পারে, মাস দেড়-দুই আগের কথা... মনে আছে শো-কেসের তাকে অনেক পুতুল রাখা ছিল।”
ইন্দ্র হেসে বলল, “দেখেছিলেন তো নিশ্চয়ই, না হলে আর আমি দেখতে পেলাম কী করে? তবে বিষ্ণূমূর্তিটার সঙ্গে যে মহাদেব সাহার মার্ডারের কোনও সম্পর্ক আছে সেটা হয়তো ভাবেননি।”
ইন্দ্রর কথা শুনে সুবিনয়বাবু ভ্যাবা-গঙ্গারামের মতো চেয়ে রইলেন। ইন্দ্র বলল, “প্রোফেসর অনিরুদ্ধ কর্মকারের বাড়িতে একবার ঢুঁ মারা দরকার। তার আগে অবশ্য মহাদেব সাহা হত্যা মামলার ফাইলটা নিয়ে আপনার সঙ্গে একবার বসতে হবে।”
৩
মহাদেব সাহার বড় ছেলে সহদেবের সঙ্গে বাপের সদ্ভাব নেই। সে পরিবার নিয়ে হায়দ্রাবাদে থাকে। ছোট ছেলের নাম বাসুদেব সাহা। বড়লোক বাপের বখে যাওয়া ছেলে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত দিনভোর একটা স্পোর্টস বাইক নিয়ে উড়ে বেড়াত আর কমবয়সী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে মারত। যদিও ম্যানেজারই ব্যবসা সামলায়, বাপ মরে যাওয়ার পরে সে ইদানীং বাপের ঠাটে গিয়ে বসতে শুরু করেছে। তবে যেখানেই যাক, যে কাজেই থাক, তার জীবনের ব্রত হল শিকার ধরা। প্রোফেসর অনিরুদ্ধ কর্মকারের মেয়ে অনিতাও তার শিকার হয়েছিল। মেয়েটা সাধাসিধে। বাসুকে বিশ্বাস করে ঠকে গিয়েছিল। যখন বুঝতে পেরেছিল বাসু বিয়ে-থার ধার মাড়াবে না ততদিনে পেটের বাচ্চাটার বয়স বেশ কয়েক মাস। বাধ্য হয়ে বাবাকে জানিয়েছিল।
প্রোফেসর কর্মকার মহাদেব সাহার বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মহাদেব সাহার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন। মেন্টাল অ্যাসাইলামের স্থায়ী বাসিন্দা। সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। মহাদেব সাহা তাঁর জন্য মাসিক অর্থ বরাদ্দ করে হাত ঝেড়েছেন। ছোট ছেলে বাসুদেব লায়েক হয়েছে, অর্ধেক সময় বাড়ির বাইরে থাকে। ঠিকে কাজের লোকজন ঘরদোর রান্নাবান্না সামলায়। মহাদেব সাহারও দোকান থেকে ফিরতে রাত হয়। কাজের লোক খাবার ঢাকা দিয়ে চলে যায়। বাপ ছেলে যে যেমন ফেরে নিজেরা খাবার বেড়ে খায়। পাড়ার লোকের কাছ থেকে খবরা-খবর নিয়ে প্রোফেসর কর্মকার একদিন বেশি রাতের দিকে মহাদেব সাহার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।
ছোট ছেলে বাসুদেব যথারীতি বাড়ি ছিল না। প্রোফেসর কর্মকার বাপকেই বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। মহাদেব সাহা টেটিয়া লোক ছিলেন, মানতে চাননি তাঁর আপাদমস্তক ভালমানুষ ছেলে অনিতার গর্ভে বীজ বপন করতে পারে। যা-খুশি-তাই গালমন্দ করে প্রোফেসর কর্মকারকে বাড়ির থেকে বার করে দিয়েছিলেন। প্রতিবেশীরা দু’জনের ঝগড়ার আওয়াজ শুনেছিল। মহাদেব সাহা অনিতার নামেও এক ঝুড়ি আকথা-কুকথা বলেছিলেন। তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি প্রোফেসর কর্মকারের নামে পুলিশের কাছে অহেতুক হয়রানির অভিযোগও করেন। সে সময় একবার সুবিনয়বাবু প্রোফেসর কর্মকারের বাড়ি যান তাঁকে সাবধান করার জন্য। তখনই তিনি প্রোফেসরের বৈঠকখানা ঘরের শো-কেসে বিষ্ণুমূর্তিটা দেখেন।
একতরফা বক্তিমেটা ইন্দ্রই দিচ্ছিল প্রোফেসর কর্মকারের বাড়ির একতলার বৈঠকখানা ঘরের শো-কেসের সামনে দাঁড়িয়ে। শো-কেসের ভিতর বিষ্ণুমূর্তিটা সসম্মানে বিদ্যমান। এখন অবশ্য তার গায়ে আর শ্যাওলা-ট্যাওলা লেগে নেই। আমি, সুবিনয়বাবু আর প্রোফেসর কর্মকার সোফায় বসে ইন্দ্রর কথা শুনছিলাম। বাড়ির সদর দরজার বাইরে দু’জন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে ছিল। যদি কোনও দরকার পড়ে। খোলা জানলায় সন্ধে গড়িয়ে রাত নামছে। দম নেওয়ার জন্য একটু থামল ইন্দ্র। সুবিনয়বাবু পাশের টেবিলে রাখা জলের বোতল তুলে দু’ঢোঁক জল খেলেন। ইন্দ্র আবার কথা বলতে শুরু করল।
প্রোফেসর কর্মকারের সঙ্গে মহাদেব সাহার মোলাকাতের সপ্তাহ দুয়েক পরে অনিতা গলায় দড়ি দেয়। প্রোফেসর কর্মকারের যখন স্ত্রী-বিয়োগ হয়েছিল তখন অনিতা পাঁচ বছরের শিশু। তার পরে আর প্রোফেসর কর্মকার দারপরিগ্রহ করেননি। একাই বাপ-মা দু’জনের দায়িত্ব পালন করে অনিতাকে বড় করে তুলেছিলেন। মেয়েকে অবলম্বন করেই তিনি বেঁচে ছিলেন। বাবা হয়ে মেয়ের আত্মহত্যার ঘটনাটা প্রোফেসর কর্মকার মেনে নিতে পারেননি। শ্মশান থেকে ফিরেই সাইকেল নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন। কাঁধের ব্যাগে কয়েক বছর আগে ঘর সাজানোর জন্য গ্রাম থেকে নিয়ে আসা বিষ্ণুমূর্তিটা ছিল। ঠিক করেছিলেন ছেলে বা বাপ যাকেই হাতের কাছে পাবেন নিকেশ করে দেবেন।
একজন শান্তশিষ্ট বাংলার অধ্যাপক যে কোনও ক্ষতি করতে পারে মহাদেব সাহা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বয়স হলেও প্রোফেসর অনিরুদ্ধ কর্মকার শক্ত-সমর্থ মানুষ। গ্রামের জলহাওয়ায় বড় হয়েছেন। সাংঘাতিক হাড়ের জোর। মহাদেব সাহা নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন। বাড়িতে তিনি একাই ছিলেন। বাসুদেব কোথায় নরক গুলজার করতে গিয়েছিল সে-ই জানে। বিনা বাধায় কাজ সেরে ফেরার সময় আমাদের বাড়ির সামনের পুকুরে মূর্তিটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এসেছিলেন প্রোফেসর কর্মকার। তাই পরের বার তদন্ত করতে গিয়ে সুবিনয়বাবু বিষ্ণুমূর্তিটা আর দেখতে পাননি। ফলত পুকুর থেকে উদ্ধার করা বিষ্ণূমূর্তিটা চেনা-চেনা লাগলেও কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না কোথায় দেখেছেন।
মূর্তিটা উদ্ধার হওয়ার পরেও প্রোফেসর কর্মকার নিশ্চিন্ত হয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু যখন শুনলেন পুলিশ এসেছিল, বলে গেছে কোনও মার্ডারের সঙ্গে মূর্তিটার যোগাযোগ আছে, তখন উদ্বিগ্ন হলেন। একবার যখন হদিশ পেয়েছে, পুলিশ ঠিক গন্ধ শুঁকে শুঁকে পৌঁছে যাবে। অনিতার অপঘাতে মৃত্যুর সময় বাড়িতে পুলিশ এসেছিল। তার আগেও একবার। মূর্তিটা বৈঠকখানা ঘরেই সাজিয়ে রাখা থাকত, হয়তো কারও নজরে পড়েছিল তখন। মহাদেব সাহার খুনটা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সেটা বুঝতে পুলিশের সময় লাগবে না। প্রোফেসর কর্মকার রাতের অন্ধকারে বটতলা থেকে বিষ্ণুমুর্তিটা চুরি করে নিয়ে এলেন। ঘষে ঘষে তার গা পরিষ্কার করে শো-কেসে সাজিয়ে রাখলেন।
ইন্দ্রর কথা শুনতে শুনতে প্রোফেসর কর্মকার জোরে হেসে উঠলেন। তাকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আজগুবি গল্প ফাঁদার আর জায়গা পেলে না ভাই? এই বয়স্ক মানুষটাকে একেবারে খুনের আসামি বানিয়ে দিলে?”
ইন্দ্র ঠোঁট ছুঁচোল করে বলল, “তার মানে আপনি পুরো ঘটনাটাই অস্বীকার করছেন?”
প্রোফেসর কর্মকার বললেন, “মানছি আমার মেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তার জন্য দায়ী ওই স্কাউন্ড্রেলটা। সেই নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে... শোনো ভাই, নিয়তির হাতে মার খেয়েছি। তার সঙ্গে তো আর জোরাজুরি চলে না। মেনে নিতে হয়। গত দু’মাস ধরে সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি। আর কিছু দিন দেখি। না পারলে বিষয়-সম্পত্তি মিশনে দান করে কোনও আশ্রম-টাশ্রমে চলে যাব।”
ইন্দ্র বলল, “দয়া করে জানাবেন কি বিষ্ণুমূর্তিটা কী করে আবার আপনার শো-কেসে ফিরে এল।”
প্রোফেসর কর্মকার বললেন, “শুশুনিয়ার কারিগররা একটাই বিষ্ণুমূর্তি বানিয়েছিল বুঝি?”
সুবিনয়বাবু উসখুস করে উঠলেন, বললেন, “ইন্দ্র, যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষারোপ করা যায় না।”
ইন্দ্র কাঁধ ঝাঁকাল।
*
প্রোফেসর কর্মকারের বাড়ি থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। ঘুম ভাঙতে বেলা গড়িয়ে গেল। ইউনিভার্সিটি না গেলেই নয়, একটা জরুরি আলোচনা আছে গাইডের সঙ্গে। পৌঁছে দেখলাম তিনি বাড়ি গেছেন ভাত খেতে। ফিরলেন কচি করে একটি ভাতঘুম দিয়ে। ফলত কাজ সেরে বেরোতে দেরি হল। হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে ওঠার সময় মনে হল বাড়িতে একটা খবর দেওয়া দরকার। মোবাইল বার করে দেখলাম সেটা ডিসচার্জ হয়ে গেছে। রাতে তাড়াহুড়োয় চার্জে দেওয়ার কথা মনে ছিল না।
ট্রেন থেকে নেমে দেখি প্ল্যাটফর্মে মনা পাগলা দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে বলল, “উফ, কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। এই রুদ্র, এক বান্ডিল বিড়ি কিনে দে না।”
আমি মনাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই এখানে কী করছিস?”
মনা বলল, “তোর জন্যই অপেক্ষা করছি। ইন্দ্র তোকে একবার দেখা করে যেতে বলেছে।”
মনা বিড়ি ধরিয়ে মনের আনন্দে ফুঁকতে ফুঁকতে চলে গেল। পয়সা দিতে দিতে শুনলাম লোকজন বলাবলি করছে সাহা জুয়েলারির ছোট ছেলেটার বাইক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। দিল্লি রোড থেকে ফিরছিল। রাস্তাটা নির্জন। মোটরবাইক স্কিড করে রাস্তার পাশের নালার মধ্যে গিয়ে পড়েছিল। পাথরে ঠোক্কর লেগে বাসুদেব সাহার মাথা ছাতু হয়ে গেছে। নেশা-টেশা করেছিল হয়তো। ক’দিন আগেই বাপ খুন হয়েছিল। এখন ছোট ব্যাটা দুর্ঘটনায় মরল। বড় ব্যাটা যোগাযোগ রাখে না। তাই বাপ বোধ হয় ভালবেসে ছোটটাকে কাছে টেনে নিল।
যাওয়ার পথে ইন্দ্রদের বাড়িতে ঢুকলাম। ইন্দ্রকে বাসুদেবের দুর্ঘটনার খবরটা দিলাম। ইন্দ্র বলল, “জেনে গেছিস তাহলে? ওই খবরটা দেব বলেই মনাকে দিয়ে তোকে ডাকিয়ে আনলাম,” তারপর এক চোখ টিপে বলল, “প্রোফেসর কর্মকার মিশন কমপ্লিট হল।”
আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম, “মিশন? সেটা আবার কী?”
ইন্দ্র হেসে বলল, “কিছু না। সেদিন বলছিলেন না সব কিছু মিশনে দান করে যাবেন। বুঝলি রুদ্র, ভগবান বিষ্ণু নিদ্রাপ্রিয় বটে, কিন্তু যখন জেগে ওঠেন তখন শুভ কাজই করেন। যুগে যুগে দুষ্কৃতির বিনাশের জন্য, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য অবতাররূপে আবির্ভূত হন। সেভাবে দেখলে বাসুদেবের মৃত্যুটা এক রকমের ডিভাইন জাস্টিস...”
শেষ কথা
দুর্ঘটনার পরের দিন সকালে প্রোফেসর কর্মকার নিজে থেকেই থানায় এসে ধরা দিলেন।
সুবিনয়বাবু আমাদের ডেকেছিলেন থানায়। প্রোফেসর কর্মকার আমাদের সামনেই মহাদেব সাহাকে হত্যার অপরাধ অকপটে স্বীকার করে নিলেন। ঠিক যেমন যেমন ইন্দ্র বলেছিল। তিনিই যে মহাদেব সাহাকে খুন করেছেন হাজার মাথা খুঁড়লেও তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যেত না। কিন্তু তিনি নিজে থেকেই সব দোষ মেনে নিলেন। বললেন, “কোর্ট বড়জোর ফাঁসির সাজা দেবে। আমার মেয়েটাও তো ঐ ভাবেই...” তাঁর চোখ ছলছল করে উঠল।
ইন্দ্র প্রোফেসর কর্মকারের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ? গত পরশু রাত পর্যন্ত সব কিছু উড়িয়ে দিচ্ছিলেন?”
প্রোফেসর কর্মকার ইন্দ্রর কথার জবাব না দিয়ে নিজের মনেই বললেন, “মহাদেব সাহার ছেলেটা খেপা ষাঁড়ের মতো চরে বেড়াচ্ছিল। তা শুনলাম গত রাতে দুর্ঘটনায় তার প্রাণ গেছে। গেছে যাক, আপদ চুকেছে। বেঁচে থাকলে আরও কতগুলো মেয়ের সর্বনাশ করত কে জানে!” একটু থেমে ভারী গলায় বললেন, “এবার মরে গেলেও কোনও আপশোস থাকবে না। কার জন্য বাঁচব বলুন তো? মানুষ তো কারও মুখ চেয়েই বাঁচে।”
সুবিনয়বাবু বললেন, “তার মানে বাসুদেব সাহার মৃত্যু দেখার জন্যই আপনি অপেক্ষা করছিলেন?”
প্রোফেসর কর্মকার বললেন, “তা এক রকম বলতে পারেন।”
ইন্দ্র বলল, “আমি একটু ভুল শুধরে দিই। বাসুদেব সাহা দুর্ঘটনায় মরেনি। আসলে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রোফেসর কর্মকার মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। আমরা গত পরশু প্রোফেসর কর্মকারের বাড়ি গিয়ে জানিয়ে এসেছিলাম আমরা তাঁকে সন্দেহ করছি। প্রোফেসর কর্মকার বুঝেছিলেন সময় ফুরিয়ে আসছে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত গত কাল সন্ধেবেলা তাঁর গাড়িই পিছন থেকে টোকা মেরে বাসুদেবের মোটরবাইকটা উড়িয়ে দিয়েছিল। সুবিনয়বাবু, আপনি প্রোফেসর কর্মকারের গ্যারেজে রাখা গাড়িটা পরীক্ষা করলেই প্রমাণ পাবেন। আমার ধারণা প্রোফেসর কর্মকারের গাড়িতে বাসুর মোটরবাইকের পেইন্টের দাগ এখনও লেগে আছে। বাহুল্য বোধে সেই দাগ তিনি আর পরিষ্কার করেননি।”
প্রোফেসর কর্মকার প্রখর চোখে ইন্দ্রর দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে আর যাই থাকুক লেশমাত্র অনুশোচনা ছিল না। সুবিনয়বাবু প্রোফেসর কর্মকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার মেয়ের কথা ভেবে আমারও খারাপ লাগছে। কিন্তু অনিরুদ্ধবাবু, আপনি শিক্ষিত লোক, জানেনই তো আইন অন্ধ।”
প্রোফেসর কর্মকার বললেন, “নিশ্চয়ই। আমার কাজ আমি করেছি। আপনি আইনের রক্ষক। এবার আপনি আপনার কাজ করুন।”
ইন্দ্র বলল, “আইন অন্ধ হতে পারে, কিন্তু তার সেই অন্ধ চোখের পিছনে সব অপরাধের ছবি গচ্ছিত থাকে।”
সুবিনয়বাবু বললেন, “কী যে হেঁয়ালি করো মাঝে মাঝে...”
ইন্দ্র হাসল। কিছু বলল না।