ঘাটে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটি লাল কুকুর আর শ্রাবণের ভারি বাতাস। কুকুরটি জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
এই বাতাসের কারণেই কিনা জানি না, ঘাটে একটিও পাখি নেই। অন্যদিন গিজগিজ করে পায়রা, শালিক ও কাকের দল। চড়ুই আসে দু-একটা। খানিক আগে বৃষ্টিতে নদীঘাট ভিজে গেছে।
ঘাটে আমি একা।
অনেকক্ষণ পরে একটা নৌকা দেখা গেল। ব্যারাকপুরের ওদিক থেকে এদিকে ভেসে আসছে।
কুকুরটাও কোথাও যেন চলে গেছে। এদিকে কাদার মধ্যে আরও যেন দেবে যাচ্ছে সেই শিবলিঙ্গটি। এক বৃহৎ শিবলিঙ্গ, একহাত উচ্চতার।
গঙ্গার জল তেমনিভাবে নেমে যাচ্ছে।
হু-হু করে বয়ে চলেছে শ্রাবণের জলজ বাতাস। চটকলের কার্নিশে বসে একটা কাক ডেকে উঠল। ঘাটের একদিকে একপাটি চটি পড়ে আছে।
ঘাট নির্জন।
উইলিয়ম কেরি রোড এখন চুপ। একটা কোকিল ভেজা গলায় ডেকে উঠল। একটি লোক গঙ্গামাটি নিতে এল। সে উবু হয়ে বসে কাদার মধ্যে হাত ডোবাচ্ছে।
আজ সারাদিন রোদ ওঠেনি।
এক ব্রাহ্মণ এল। কানে পাকানো পৈতা। ঘাটে দাঁড়িয়ে ভাবছে কোনদিক দিয়ে গঙ্গায় নামবে। সে জল দেখছে। প্রবল বাতাস শুরু হল। গাছপালার মাথা দুলছে। শ্রীরামপুর কলেজের একটি মেয়ে তার সহপাঠীকে ঘাটের ভেজা সিঁড়িতে বসে ভেজা কন্ঠে বলছে, সেই তো আবার, আমার কাছেই আসতে হবে।
ভাইরাল জ্বরের মরসুম চলছে। তার উপর আছে মশাবাহিত রোগ। পুরসভার লোক দল বেঁধে লোকের ঘরে ঘরে যাচ্ছে।
জল ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘাটের শেষ ধাপ।
কানে পৈতা পাকানো বৃদ্ধটি ঘাটে নেমে কাদা ঘাঁটতে ঘাঁটতে কিছু একটা পেয়েছে। তার মুখে উল্লাস।
কাদার মধ্যে কত কী পড়ে থাকে! কতদিন ধরে এই গঙ্গাকে দেখছি আমি। কখনও সে স্রোতস্বিনী আবার কোনোদিন বা সে সব জল হারিয়ে জৌলুসহীন। জল এত নেমে যায় যে, নদীর মাড়ি অবদি যেন বেরিয়ে আসে। তখন গঙ্গাকে দেখে খুব কষ্ট হয়। না থাকে তার বুকে কোনো নৌকা, না কোনো জেলে।
বৃদ্ধ মানুষটি যে জিনিস হাতে নিয়ে উঠে আসছে, ঘাটের মাথায় বসে মনে হয়, তা হল এক মাটির পিদিম। কাছে এলে দেখা গেল, বৃদ্ধের হাতে রয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। সাইজে এই এতটুকু। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, লিঙ্গটি কোমর থেকে ভাঙা! এমনি নিষ্টুরভাবে ভাঙা শিবলিঙ্গ আমি কখনও দেখিনি! কোনো ভারী বস্তু দিয়ে এক ঘায়ে লিঙ্গটিকে ভাঙা হয়েছে। দেখে ভারি কষ্ট হল। নিজের কোমরেই যেন ব্যথা পেলাম। ভেঙেছে আর নদীতে ফেলে দিয়ে গেছে।
গতকাল গঙ্গার জল যখন নেমে গেছিল তখন দেখেছিলাম কাদামাটির মধ্যে গেঁথে আছে কতগুলি ছোট ছোট মূর্তি। নানা দেবদেবীর সেই মূর্তিগুলির কারুকাজ ও রং অসাধারণ। দেখলে চোখ, মন দুই-ই জুড়ায়। এগুলিকে কেউ যে তুলে আনতে পারে, তা জানা ছিল না।
বৃদ্ধ বলল, এটা পাথরের নয়, সিমেন্টের শিবলিঙ্গ।
আমার ধারণা ছিল, শিবলিঙ্গ মানেই পাথরের। কিন্তু সিমেন্টেরও যে শিবলিঙ্গ হয়, জানা ছিল না। ব্যাপারটা আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গেল।
বৃদ্ধটি বললে, এই দুনিয়ায় শিবলিঙ্গ যা আছে, তার বেশিরভাগ সিমেন্টের। পাথরের শিবলিঙ্গ কজনই বা কিনতে পারে! দামও প্রচুর।
বললাম, ঘাটের ওপাশে একটা বড় শিবলিঙ্গ গঙ্গার কাদার মধ্যে পড়ে আছে দেখেছেন?
হ্যাঁ। ওটি রবারের।
মানে?
হ্যাঁ, রবারের শিব। কিন্তু দেখলে মনে হবে, পাথরের।
কয়েক ধাপ নেমে গতকাল-দেখা সেই শিবলিঙ্গ আবার দেখতে যাই। কিন্তু গিয়ে দেখি, সেখানে কোনো শিবলিঙ্গ নেই! বদলে জোড়হাত-করা এক অপূর্ব মূর্তি বসে রয়েছে। তেমনি এক হাত উচ্চতার। আরও কয়েকটা সিঁড়ি নেমে কাছে গিয়ে দেখি, তিনি শিব নন। তিনি বজরঙ্গবলী। ভারি অবাক হয়ে গেলাম।
লোকটা বলল, হ্যাঁ, ওখানে শিব ছিল। আবার ছিল না।
তার মানে!
এমন হয়। গঙ্গাতে, গঙ্গার ঘাটে এমনি ধারার কত কিছুই ঘটে, ঘটে চলে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আপনার হাতে। নদীতে, পাথরে, মাটির কাদায়—এদিক-ওদিকে, লক্ষ্মীঘাটে, জগন্নাথঘাটে—যত শিবলিঙ্গ আমার চোখে পড়ে; সব আমি তুলে নিই আর বটগাছের নিচে জমা করি। ওই যে বটগাছের নিচটা বাঁধানো আছে দেখছেন, আগে এমন ছিল না। কাউন্সিলরকে বলে আমিই তার ব্যবস্থা করেছি। ওখানে, যত পাথর রাখা, সব আমিই গঙ্গা থেকে কুড়িয়ে ওখানে রেখেছি। গতকালই একটা বড় পাথর রাখলাম। পাথর মানেই শিবলিঙ্গ।
গঙ্গার ঘাটে বসে আর কত বিস্মিত হব! কদিন আগে এক সাধু এসেছিলেন। তিনি ঘাটের মাথায় দাঁড়ালেন। একটি কুকুর ছুটে এল। প্রথমে খুব ভৌ-ভৌ করে ডাকল। সাধু বললেন, আস্তে বৎস, ধীরে বও। অতি বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, কুকুরটি মাটিতে মাথা রেখে সাধুকে প্রণাম করল!
বৃদ্ধ বলে, আমার আদি বাড়ি আরামবাগ। এদিকে স্টেডিয়ামের ওখানে থাকি। সরকারি চাকরি করতাম। এখন রিটায়ার্ড করে গেছি। আপনার বাড়ি কোথায়--আরামবাগ?
না। ডানকুনিতে।
ডানকুনি! তোজন বিশ্বাসকে চেনেন?
না, চিনি না।
বৃদ্ধ আমার কথায় কর্ণপাত করলেন না। বার বার মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন, নিশ্চয় চেনেন আপনি, অবশ্যই চেনেন।
বললাম, দেখুন, ডানকুনি খুব বড় জায়গা। সেখানে প্রতিটি ব্যক্তিকে চেনা সম্ভব নয়।
প্রতিটি ব্যক্তিকে চেনার কথা বলছি না। তোজনের কথা বলছি। খুব পপুলার লোক। ডানকুনি শহরে তাকে চেনে না, এমন লোক নেই।
একে বোঝানো বৃথা! চুপ করে বসে রইলুম।
বৃদ্ধ বলে চলে, তোজন আমার জামাই। আবার ঠিক আমার নয়।
তাহলে!
আমি বিয়ে করিনি। আমার সেজো ভাইয়ের মেয়ের সঙ্গে তোজনের বিয়ে হয়েছে। একবার গিয়ে খবর নিয়ে আসবেন? ওদের কোনো খবর পাচ্ছি না!
আপনারা খবর নিন।
সেটা সম্ভব নয়।
কেন?
ওরা বাড়িতে তালা দিয়ে চলে গেছে।
অদ্ভুত! তাহলে আমি কীভাবে খবর পাব?
সে আপনি পারবেন। কারণ আপনি তোজন বিশ্বাসকে চেনেন।
ঘাটে আমি রোজই আসি। বিকেলে আমার অফিস ছুটি হয়, তখন ঘাটে এসে বসি। এই সময়টা আমার নিজস্ব। ঘাটে বসে নিজের সঙ্গে আমি কথা বলি। নিজেকে দেখতে চাই, চিনতে চাই, জানতে চাই। নিজেকে যেন প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চাই।
বৃদ্ধ বললেন, আমার ভাইয়ের মেয়ের এখন ডিভোর্সের মামলা চলছে। কারণ মেয়েটির মাথায় গোলযোগ আছে। ওরা আমাদের মেয়েকে নেবে না। এরা মামলা করেছে। ওরা বাড়ির পাট গুটিয়ে, গেটে তালা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে!
কেউ-ই যখন বাড়িতে নেই, তোজনের খবরটা পাব কোত্থেকে?
পাবেন পাবেন, ঠিক পাবেন।
তা কী খবর আনতে হবে?
এই, তারা কবে ফিরবে।
আর?
তারা কোথায় গেছে।
বৃদ্ধ বললেন, আমরা চার ভাই। আমাদের দুই ভাই মারা গেছে। আমরা বাকি দুজন টিঁকে আছি। ডানকুনিতে বাড়ি যখন তখন তোজনের বাড়ি গিয়ে একবারএকটা খবরযদি তালাটা ধরেও টানাটানি করেন, কেউ না-কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবেই!
উপায় নেই। পালাতে হবে। আমি স্কুটারে উঠে পড়লাম। বৃদ্ধ দৌড়ে স্কুটারের পাশে।
আপনার নামটা?
নাম দিয়ে কী হবে?
নইলে আপনাকে খুঁজব কী করে?
আমাকে খুঁজে কী করবেন?
তোজন যখন আমার কাছে জানতে চাইবে কাকে আমি দায়িত্ব দিয়েছি তাকে খুঁজে বের করার, উত্তরে আমি কী বলব?
তোজন সেটা জানতে আসবে কেন?
আমাদের মেয়েকে তোজন ভুলে যাবে, এমনি ছেলে সে নয়।
স্কুটার চালিয়ে দিলাম। প্রবল বাতাস শুরু হয়েছে। বৃষ্টির আগে ঝড় আসছে আজকাল। ওপারে গান্ধীঘাটের আকাশ চোখ পাকিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। প্রবল বৃষ্টি শুরু হবে।
যাবেন না, দাঁড়ান—
চিৎকার শুনে পিছু ফিরে একঝলক তাকালাম। গঙ্গায় বান এসেছে। বৃদ্ধ কানে পৈতা পাকিয়ে বানের মাথায় চেপে, হাতের মুঠোয় আধখানা শিবলিঙ্গ নিয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছে।