• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | কবিতা
    Share
  • গজল: দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া : মীর তকী মীর
    translated from Urdu to Bengali by ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত

    অনুবাদের প্রসঙ্গে

    উর্দু সাহিত্যের খুদা-এ-সুখন বা কাব্যের ঈশ্বর যাঁকে বলা হয় সেই মীর তকী মীরের জন্ম হয়েছিল ১৭২২ (বা ১৭২৩) সালে। মীরের দীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে মোঘলদের রাজধানী দিল্লীতে, যদিও আহমেদ শাহ আবদালীর আক্রমণের পর যখন দিল্লীতে অরাজকতা শুরু হয় তখন মীরকে লক্ষ্ণৌ-প্রবাসী হতে হয়।

    বাংলায় উর্দু থেকে অনুবাদ বেশি হয় না। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা গজল কী জানতে ইচ্ছুক তাঁদের সুবিধের জন্য একটা সংক্ষিপ্ততম পরিচয় দেওয়া যাক। গজল হল পাঁচ বা তার বেশি সংখ্যার দ্বিপদী দিয়ে তৈরি কবিতার একটা বিশেষ ধাঁচ বা ধরন। এর এক একটি দ্বিপদী অংশকে বলা হয় শের। গজল শব্দ আরবী এবং এই ধরনের কবিতা উর্দুতে ফারসী সাহিত্যের অনুকরণে লেখা শুরু হয়েছিল। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে দিল্লী সুলতানত এবং মোঘল কবিরা ফারসীতেই গজল লিখতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে গজলের ভাষায় ক্রমশ হিন্দী শব্দের ব্যবহার বাড়তে থাকে এবং মীরের সময়ে সে ভাষা যে রূপ নেয় তাকে বলা হত রেখ্‌তা। রেখ্‌তা আজও ভারত উপমহাদেশে ক্লাসিকাল বা শাস্ত্রীয় গজলের মাধ্যম।

    গজলের কিছু বৈশিষ্ট্য সহজেই চিহ্নিত করা যায়। প্রথম হল রদিফ, বা ধুয়ো। প্রত্যেক শেরের অন্তিমে এই ধুয়ো অবিকৃতভাবে ব্যবহার করা হয়। যেমন এই গজলের রদিফ হল ‘কর চলে’। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল কাফিয়া বা মধ্যমিল। বাংলায় মিত্রাক্ষর বলতে যা বোঝায় কাফিয়া ঠিক তাই, শুধু তার অবস্থান ছত্রের শেষে নয়, রদিফের ঠিক আগে। এই গজলের কাফিয়া হল ‘আ’ এবং এই অক্ষরটি ‘দুআ’, ‘ওয়ফা’, ‘দওয়া’, ‘জলা’ ইত্যাদি শব্দগুলির শেষে রয়েছে। গজলের প্রথম ও অন্ত্য শের-এর নিজস্ব বিশিষ্টতা আছে। অন্ত্য শেরটিকে বলে মক্‌তা যাতে কবির নাম এবং গুণের পরিচয় থাকে। এই গজলের ১৪ নং শের-এ যথারীতি মীরের নাম পাওয়া যাবে। প্রথম শের-এর দুই ছত্রেই রদিফ এবং কাফিয়া লাগানো হয়। এই শেরটিকে বলা হয় মৎলা। বলা বাহুল্য গজলের সব কটা শের একই ছন্দে লেখা হওয়া চাই। এই ছন্দকে বলে গজলের বহর্‌।

    মীরের গজল শুনতে মধুর, কারণ তিনি মধুর ছন্দ ব্যবহার করতে ভালোবাসতেন। অনুবাদের সময়ে আমি ছন্দ অক্ষুণ্ণ রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাংলা রূপান্তরেও একটি প্রায়-রদিফ শব্দবন্ধ এবং তার কাফিয়াকে পাওয়া যাবে (করে চলি/করে চলে, আর যাচন/পালন/দহন জাতীয় 'অন' ভাগান্ত শব্দ)। অনুবাদটি আক্ষরিক নয় দুটি কারণে। প্রথমত আরবী ও ফারসী শব্দের ভাণ্ডার অফুরন্ত। সব শব্দের যুৎসই প্রতিশব্দ নেই। দ্বিতীয়ত ছন্দ বাঁচাতে গেলে অনেক সময় আক্ষরিক প্রতিশব্দ বর্জন করা ছাড়া উপায় থাকে না। বাংলায় অপ্রচলিত যে আরবী ও ফারসী শব্দ এই গজলে ব্যবহৃত হয়েছে, বাংলা প্রতিশব্দ সমেত তাদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা আমি কবিতার নিচে জুড়ে দিয়েছি। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা কৌতূহলী তাঁরা হয়তো এই টীকা ব্যবহার করে মূল গজলের বিকল্প ভাষান্তর করতে পারবেন।

    হিন্দী ছায়াছবির গানে মীরের প্রভাব বিস্ময়কর রকমের ব্যাপক। খুদা-এ-সুখন-এর লেখা গোটা শের যেখানে ব্যবহার হয়নি সেখানে পরিচিত গজল থেকে মুক্তো ছিঁড়ে এনে যেখানে সেখানে বসানো। মীরের প্রথম দিওয়ান বা কাব্যগ্রন্থের এই গজলটির অংশবিশেষ হুবহু হিন্দী ছায়াছবিতে গান হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার সবচেয়ে বিখ্যাত ছত্রদুটি (৮ নং শের) ভারতে জাতীয় সঙ্গীতের চেয়ে কম জনপ্রিয় নয়।

    দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া
    হমেঁ আপ সে ভী, জুদা কর চলে।


        দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া
        হমেঁ আপ সে ভী, জুদা কর চলে।


    গজলের কোনো নাম হয় না। আমি এই শের-এর একটি ছত্র ব্যবহার করে সেই সমস্যার সমাধান করেছি।



    দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া

    ১)
    ফকিরানা আয়ে সদা কর চলে
    কি মিঁঞা খুশ রহো তুম, দুআ কর চলে।

    ২)
    যো তুঝ বিন ন জীনে কো কহতে থে হম
    সো ইস অহদ কো অব, ওয়ফা কর চলে।

    ৩)
    শিফা অপনী তকদীর হী মেঁ ন থী
    কি মকদূর তক তো, দওয়া কর চলে।

    ৪)
    পড়ে অ্যায়সে অসবাব-এ পায়ান-এ-কার
    কি নাচার ইয়ুঁ জী, জলা কর চলে।

    ৫)
    উয়ো কেয়া চীজ হ্যায় আহ্‌ জিস কে লিয়ে
    হর ইক চীজ সে দিল, উঠা কর চলে।

    ৬)
    কোই না-উমীদানা করতে নিগাহ
    সো তুম হম সে মুঁহ ভী, ছুপা কর চলে।

    ৭)
    বহুত আরজ়ু থী গলি কী তেরী
    সো ইয়াঁ সে লহু মেঁ, নহা কর চলে।

    ৮)
    দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া
    হমেঁ আপ সে ভী, জুদা কর চলে।

    ৯)
    জবীঁ সিজদা করতে হী করতে গঈ
    হক-এ-বন্দগী হম, নিভা কর চলে।

    ১০)
    পরস্তিশ কী ইয়াঁ তক কি অ্যায় বুত তুঝে
    নজর মেঁ সভোঁ কী, খুদা কর চলে।

    ১১)
    ঝড়ে ফুল জিস রঙ্গ্‌ গুলবুন সে ইয়ুঁ
    চমন মেঁ জহাঁ কে, হম আ কর চলে।

    ১২)
    ন দেখা গম-এ-দোস্তাঁ শুকর সে
    হমীঁ দাগ অপনা, দিখা কর চলে।

    ১৩)
    গঈ উমর দর-বন্দ-এ ফিকর-এ-গজল
    সো ইস ফন কো অ্যায়সা, বড়া কর চলে।

    ১৪)
    কহেঁ কেয়া যো পুছে কোই হম সে মীর
    জহাঁ মেঁ তুম আয়ে থে, কেয়া কর চলে।

       ফকির হয়ে এসেছি সম্ভাষণ করে - চলি
       মশাই সুখে থাকুন, এই যাচন করে - চলি।


       তোমায় ছাড়া বাঁচার নয় বলেছি এককালে
       সেই প্রতিশ্রুতিকে আজ, পালন করে - চলি।


       সুস্থ হয়ে ওঠা আমার কপালে নেই লেখা
       চিকিৎসা যা করার তা, সমাপন করে - চলি।


       এমন হয়ে দাঁড়াল যে সর্বনাশ আশু
       উপায়হীন হৃদয় শেষে, দহন করে - চলি।


       কী সেই পাওয়া হায় রে যার প্রত্যাশায় আজ
       সব পাওনার উপর বিমুখ, এ মন করে - চলি।


       পাছে আমার নিরাশ চোখের চাহনি যায় দেখা
       সে ভয়ে যাও তোমার মুখ, গোপন করে - চলে।


       তোমার গলির তৃষ্ণা আমার মেটেনি কোনোদিন
       সেই পথে তাই রক্তে অবগাহন করে - চলি।


       এমন রূপে দিয়েছ দেখা, আত্মহারা হই
       গেলে আমায় আমারই থেকে, হরণ করে - চলে।


       কপাল ভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়েই কাটাল সারা বেলা
       গোলাম হওয়ার এই অধিকার, বরণ করে - চলি।


       মৃৎপ্রতিমা, এমন ছিল আমার উপাসনা
       সবার চোখে তোমায় খোদার, মতন করে - চলি।


       বীতরঙ্গ শাখার ফুল যেমন যায় ঝরে
       পৃথিবীর উদ্যানে আমার, ভ্রমণ করে - চলি।


       বরাত জোরে বন্ধুদের দরুন পাইনি শোক
       তাদের মনে আমার ব্যথাই, রোপণ করে - চলি।


       জীবন গেছে গজল লেখার প্রয়াস বন্ধনে
       সে শিল্পকে তার শিখরে, স্থাপন করে - চলি।


       কী বলি কেউ প্রশ্ন যদি, হঠাৎ তোলে, মীর
       মর্ত্যে এসে যাচ্ছ কী কাজ, সাধন করে - চলে?


    দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া


    ১)

       ফকিরানা আয়ে সদা কর চলে
       কি মিঁঞা খুশ রহো তুম, দুআ কর চলে।

       ফকির হয়ে এসেছি সম্ভাষণ করে - চলি
       মশাই সুখে থাকুন, এই যাচন করে - চলি।

    ২)

       যো তুঝ বিন ন জীনে কো কহতে থে হম
       সো ইস অহদ কো অব, ওয়ফা কর চলে।

       তোমায় ছাড়া বাঁচার নয় বলেছি এককালে
       সেই প্রতিশ্রুতিকে আজ, পালন করে - চলি।

    ৩)

       শিফা অপনী তকদীর হী মেঁ ন থী
       কি মকদূর তক তো, দওয়া কর চলে।

       সুস্থ হয়ে ওঠা আমার কপালে নেই লেখা
       চিকিৎসা যা করার তা, সমাপন করে - চলি।

    ৪)

       পড়ে অ্যায়সে অসবাব-এ পায়ান-এ-কার
       কি নাচার ইয়ুঁ জী, জলা কর চলে।

       এমন হয়ে দাঁড়াল যে সর্বনাশ আশু
       উপায়হীন হৃদয় শেষে, দহন করে - চলি।

    ৫)

       উয়ো কেয়া চীজ হ্যায় আহ্‌ জিস কে লিয়ে
       হর ইক চীজ সে দিল, উঠা কর চলে।

       কী সেই পাওয়া হায় রে যার প্রত্যাশায় আজ
       সব পাওনার উপর বিমুখ, এ মন করে - চলি।

    ৬)

       কোই না-উমীদানা করতে নিগাহ
       সো তুম হম সে মুঁহ ভী, ছুপা কর চলে।

       পাছে আমার নিরাশ চোখের চাহনি যায় দেখা
       সে ভয়ে যাও তোমার মুখ, গোপন করে - চলে।

    ৭)

       বহুত আরজ়ু থী গলি কী তেরী
       সো ইয়াঁ সে লহু মেঁ, নহা কর চলে।

       তোমার গলির তৃষ্ণা আমার মেটেনি কোনোদিন
       সেই পথে তাই রক্তে অবগাহন করে - চলি।

    ৮)

       দিখাই দিয়ে ইয়ুঁ কি বেখুদ কিয়া
       হমেঁ আপ সে ভী, জুদা কর চলে।

       এমন রূপে দিয়েছ দেখা, আত্মহারা হই
       গেলে আমায় আমারই থেকে, হরণ করে - চলে।

       জবীঁ সিজদা করতে হী করতে গঈ
       হক-এ-বন্দগী হম, নিভা কর চলে।

       কপাল ভূমি ছুঁয়ে ছুঁয়েই কাটাল সারা বেলা
       গোলাম হওয়ার এই অধিকার, বরণ করে - চলি।

    ১০)

       পরস্তিশ কী ইয়াঁ তক কি অ্যায় বুত তুঝে
       নজর মেঁ সভোঁ কী, খুদা কর চলে।

       মৃৎপ্রতিমা, এমন ছিল আমার উপাসনা
       সবার চোখে তোমায় খোদার, মতন করে - চলি।

    ১১)

       ঝড়ে ফুল জিস রঙ্গ্‌ গুলবুন সে ইয়ুঁ
       চমন মেঁ জহাঁ কে, হম আ কর চলে।

       বীতরঙ্গ শাখার ফুল যেমন যায় ঝরে
       পৃথিবীর উদ্যানে আমার, ভ্রমণ করে - চলি।

    ১২)

       ন দেখা গম-এ-দোস্তাঁ শুকর সে
       হমীঁ দাগ অপনা, দিখা কর চলে।

       বরাত জোরে বন্ধুদের দরুন পাইনি শোক
       তাদের মনে আমার ব্যথাই, রোপণ করে - চলি।

    ১৩)

       গঈ উমর দর-বন্দ-এ ফিকর-এ-গজল
       সো ইস ফন কো অ্যায়সা, বড়া কর চলে।

       জীবন গেছে গজল লেখার প্রয়াস বন্ধনে
       সে শিল্পকে তার শিখরে, স্থাপন করে - চলি।

    ১৪)

       কহেঁ কেয়া যো পুছে কোই হম সে মীর
       জহাঁ মেঁ তুম আয়ে থে, কেয়া কর চলে।

       কী বলি কেউ প্রশ্ন যদি, হঠাৎ তোলে, মীর
       মর্ত্যে এসে যাচ্ছ কী কাজ, সাধন করে - চলে?



    প্রতিশব্দাবলী

    ১) ফকিরানা = ফকিরের মতো, সদা = আওয়াজ/ডাক
    ২) অহদ = প্রতিশ্রুতি, ওয়ফা = বিশ্বস্ততা
    ৩) শিফা = আরোগ্য, তকদীর = ভাগ্য, মকদূর = ক্ষমতা/সাধ্য, দওয়া = ওষুধ
    ৪) অসবাব = কারণ/হেতু, পায়ান-এ-কার = কাজের শেষ, জী = হৃদয়
    ৬) না-উমীদানা = নিরাশা, নিগাহ = চাহনি
    ৭) আরজ়ু = অভিলাষ, লহু = রক্ত
    ৮) বেখুদ = আত্মহারা/বিমোহিত, জুদা = পৃথক/ভিন্ন
    ৯) জবীঁ = কপাল, সিজদা = কপাল দিয়ে ভূমি স্পর্শ করে প্রণাম, হক-এ-বন্দগী = গোলাম হওয়ার অধিকার, নিভা = নির্বাহ/পালন/চরিতার্থ
    ১০) পরস্তিশ = উপাসনা, বুত = প্রতিমা/মূর্তি, সভোঁ = সবার
    ১১) গুলবুন = বাগান/গোলাপের ঝাড়, চমন = বাগান/উদ্যান, জহাঁ = পৃথিবী
    ১২) গম-এ-দোস্তাঁ = বন্ধুদের শোক, শুকর সে = সৌভাগ্যবশত
    ১৩) উমর = আয়ুষ্কাল/বয়স, দর-বন্দ-এ = বন্ধ দরজার ভিতরে/কারাগারে, ফিকর-এ-গজল = গজলের উদ্বেগে/প্রয়াসে, ফন = শিল্প




  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments