• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৭ | জানুয়ারি ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • একটি গল্পগ্রন্থ ও মেঘমালা দে মহন্ত : সাধন চট্টোপাধ্যায়

    কাগজের স্বদেশ — মেঘমালা দে মহন্ত ; প্রচ্ছদ- তৌশিফ হক; প্রকাশক- ছাপাখানা, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ- এপ্রিল ২০২৪;

    অসমের বরাক উপত্যকার সাম্প্রতিক বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের যে-উজ্জ্বল ধারাটি গড়ে উঠেছে — রণবীর পুরকায়স্থ, শ্যামলকৃষ্ণ, মিথিলেশ ভট্টাচার্য, শেখর দাশ, স্বপ্না ভট্টাচার্য থেকে ঝুমুর পান্ডে, আদিমা মজুমদার প্রমুখ — সেখানে মেঘমালা দে মহন্ত অন্তর্ভুক্ত একটি উজ্জ্বল নাম। মেঘমালা গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য গদ্যচর্চাতেও সাবলীল। কবিতাও লেখেন, যদিও তাঁর কাব্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি আমার।

    সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটি 'কাগজের স্বদেশ' মাত্র ৬ টি গল্পের সংকলন, পাঠকদের চমকে দেবে। বিশেষত, যে সব পাঠক ক্ষমতা, রাষ্ট্র-কর্তৃত্ব, আইন- নাগরিকতা বনাম ব্যক্তিস্বাধীনতার দ্বন্দ্বের যে নিত্যনতুন বয়ান গড়ে তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে সচেতন ও কৌতূহলী — কাগজের স্বদেশ তাঁদের চেতনায় নতুন একটি দিগন্ত খুলে দেবে। সংবাদপত্র, দূরদর্শন, টিভি চ্যানেল বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমসকল যে-ধারায় সমস্যার নানা ভাষ্য তৈরি করে, সাহিত্যের মাধ্যম তুলনায় অনেক বেশি বিস্তারী, নিবিড় ও মানবিক রসে জারিত। ‘ডি-মানুষ’, ‘কাগজের স্বদেশ’, ‘সালেমা বেগমকে নিয়ে দু-চারটি মামুলি ফিসফিসানি’ বা ‘মধুবালা’-র মতো গল্প পড়তে পড়তে মেরুদণ্ড সোজা হয়ে থাকতে চায়।

    ডি-ভোটার বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের পাঠক তত্ত্বগতভাবে জানতেও পারেন, যেহেতু এখানে আজও লাগু হয়নি, আইনি প্রয়োগ ঘটলে, অসংখ্য সাধারণের বিড়ম্বিত জীবনকথা কলকাতার সাহিত্যে আসেনি। অসমে এর আইনি প্রয়োগ হয়েছে এবং অসংখ্য ডি-ভোটার অর্থাৎ ডাউটফুল ভোটার — সন্দেহজনক নাগরিকত্ব হিসেবে সনাক্ত হয়ে চলে যাচ্ছে নির্বাসনে। জার্মানিতে হিটলার যেমন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়ে, হাজার হাজার ইহুদী নর-নারীদের গ্যাসচেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল, এখানে গ্যাসচেম্বার না হলেও, এক ধরনের তৈরি ক্যাম্পে, পুরুষ মহিলাদের খোঁয়াড়ের পশুর মতো ঢুকিয়ে দিয়ে, যে- রাষ্ট্রীয় নরক তৈরি, তাতে প্রতি মুহূর্তে মানবিকতা দলিত। গল্পগুলির মধ্যে যেমন যন্ত্রণা, তেমনই স্যাটায়ার — এমন কি সবকিছুর শেষেও শুভ্র মানবিকতার পতাকাকেও তুলে ধরা হয়েছে।

    গ্রন্থের অন্যতম উৎকৃষ্ট গল্পের মধ্যে একটি ‘সালেমা বেগমকে নিয়ে দু-চারটে মামুলি ফিসফিসানি’। সালেমা ডি-ভোটার। সালেমার বাবা গ্রামের পাঠশালার শিক্ষক, যেবার সালেমা ম্যাট্রিক ফেল করে, সেবার সালেমার বাবার কাছে ডি-ভোটার নোটিশ আসে। মেঘমালা পরিস্থিতিটা বোঝাচ্ছে এভাবে: ‘... সেই বছরই আসে বাবার নামে নোটিশটা। বাবা নাকি বিদেশী। বাংলাদেশী। রিফ্যুজি। হঠাৎ করে রাতারাতি পালটে গেল সব কিছু। গ্রামে এরকম নোটিশ আরও এসেছে দু’একখানা। থানা, উকিল, আদালতের বহু দৌড়ঝাঁপের পরেও তারা সবাই এখন ডিটেনশন ক্যাম্পে, মানে এক কথায় জেলে।’ সালেমার বাব-মা এই ট্রমায় মারা গেলেও, রেহাই পায় না সালেমা। ‘ডি ভোটার’ হিসেবে তাকেও জেলে ঢুকতে হয়।

    ঢোকার মুহূর্তটি দিয়ে মেঘমালা এ আখ্যান শুরু করছে। ‘প্রথম যেদিন এখানে আসে সালেমা, তার পরদিন ভোরবেলা এই গাছটা দেখে সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিল।’ আবার আখ্যান শেষ হচ্ছে প্রতীকী ওই চাঁপা গাছটি দেখে। আগের রাতের ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাতে পোড়া গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। দুটি প্রান্তবিন্দুর মাঝে আছে ডি-ভোটার ক্যাম্প বা রৌরবের অমানবিক দৃশ্য। নিছক ক্লেদাক্ত শব্দটি প্রয়োগ করলে যথেষ্টভাবে বাস্তবতাটি ফোটে না । '... শরীরটা টানতে পারছিল না আর সালেম। তবু সামনে এগিয়ে চলা ছায়ার মতো সেপাইটার পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছিল,

    — ও মাগো ... শালা কুত্তা...

    শুকিয়ে খরখরে পাথরের মতো হয়ে থাকা গলা চিরে একটা আর্ত চিৎকারের প্রাণপণ চেষ্টা করে সালেমা। অন্ধকারের মধ্যে একটা শক্ত পুরুষালি হাত গায়ের জোরে খামছে ধরেছে বুকের বাঁ-দিকটা। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির সুরেলা রিমঝিম আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নিজের কানেই ঠিকঠাক পৌঁছাতে পারে না সালেমার। গায়ের জোরে দু’হাতে লোকটাকে ঠেলে নিজেকে মুক্ত করে,

    —শালি! রেন্ডির বাচ্চা!

    সেপাইটা দ্রুত এগিয়ে যায় বেশ খানিকটা। ব্যথায় দু’হাতে বুকের বাঁ পাশটা ডলতে ডলতে মেঝেতে বসে পড়ে সালেমা। সেপাইটা চেঁচিয়ে ডাকছে,

    —জলদি আয়। ছেনালিপনা পরে করিছ। ডিউটি শেষ করিয়া ঘরো যাইতাম আমি। এই গালিগালাজগুলো গত কয়েক মাসে অজস্রবার শুনতে-শুনতে এখন আর গায়ে লাগে না সালেমার। নিজেও রপ্ত করে ফেলেছে বেশ। কিন্তু যখন তখন শরীরে হাত দেওয়াটা একদম বরদাস্ত করতে পারে না। এই কুৎসিৎ জেলজীবন ও সনাতন অতীত — দুয়ের কুরুশ বুননের মতো আখ্যান গড়ে উঠেছে। পড়তে পড়তে ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘নোটস্‌ ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ এর অনুভব জেগে ওঠে (মাফ করবেন! মহান এই লেখকটির শুধু প্রসঙ্গই তুললাম)।

    লেখকের এই গ্রন্থটির প্রাক্‌কথন লিখেছেন বরাকেরই পুরোধা লেখক রণবীর পুরকায়স্থ । তিনি গল্পগুলোর প্রসঙ্গ এবং ডি-ভোটারত্বর বিশেষ রাজনৈতিক পটভূমিটি তুলে ধরেছেন। এই ব্যাকগ্রাউন্ড-বিস্তৃতিটুকু অজানা থাকলে, গল্পের ভেতরের শক্তিটুকুকে যথাযোগ্য অনুভব সম্ভব নয়।

    ‘ভারতের নির্বাচন কমিশনের আদেশ অনুসারে আসাম সরকার দেশের নাগরিক নয় এমন নির্বাচক শনাক্ত করে ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলত সরকার ধরে এবং বেঁধে আনে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে অনুপস্থিত ভোটার থেকে শুরু করে এমনকি ভাড়াবাড়ি বদল করা ভোটার সহ নানা ধরনের অনেকানেক নাগরিকের নামের পাশে লিখে দেয় ডি, মানে ডাউটফুল, সন্দেহজনক। তাদের বিচার হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এবং তাদের রাখা হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে। অর্থাৎ, নাৎসি জমানার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে এক খোঁয়াড়, যেখানে বিচারের প্রহসনে এবং বিনাবিচারে যাবজ্জীবন মনুষ্যেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয় সাধারণ নাগরিককে।

    ১৯৮৫ তে রাজীব গান্ধী আসাম আন্দোলনকারীদের সঙ্গে চুক্তি করেন। সেই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আসামে ‘ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স’ (N.R.C) তৈরি হয়। এক কথায় ১৯৭১-এর পরে অবৈধভাবে যারা এসেছে তাদের শনাক্তকরণ। এই প্রক্রিয়া শুধু আসাম রাজ্যেই প্রযোজ্য আপাতত। সোয়া এক হাজার কোটি টাকা খরচ করে এক ভুল এন. আর. সি তৈরি হয়েছে। এ-সব তো গেল অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংবিধানিক নানা প্রশ্ন। অর্থাৎ জল, জমি, জন্ম, মানুষ, ঐতিহ্য, মানবিকতার বাইরে কোনটা মানুষের প্রকৃত স্বদেশ, তা নির্মিত হচ্ছে নিছক কাগজের ওপর। তাই ‘কাগজের স্বদেশ’।

    এ-গ্রন্থের আর একটি গল্প ‘মধুবালা’। পাঠকের কৌতূহল জন্মাতে পারে, এ-গল্পের কাহিনিটা কি? জানিয়ে রাখা দরকার, মেঘমালা গল্প বা কাহিনি রচনা করেন না; আখ্যান লেখে। নির্মেদ ভাষায় থাকে হৃদয় ও মস্তিষ্কের যুগল অবস্থান। পরিস্থিতি ও চারিত্রিক অবস্থান অনুসারে ভাষার দাপট আমাদের চেতনায় সশব্দে চাবুক কষায়। ধরা যাক, ‘মধুবালা’ গল্পের শুরুয়াতটুকু।

    আমার নাম মধুবালা, ওরফে রিফ্যুজিলতা দাস। সাং আমড়াঘাট।

    বাবা নাম রেখেছিলেন লতা দাস। রিফ্যুজিটা আমি জুড়ে নিয়েছি। গত সাত বছর শালারা এতবার রিফ্যুজি বলেছে যে আমি নিজেই ভুলে গেছি যে আমার নাম শুধু লতা দাস। বলছি ঠিকই আমার নাম রিফ্যুজিলতা দাস, কিন্তু আমি তো জানি আমি রিফ্যুজি নই। ধুর শালা, রিফ্যুজি মানে কী, তাই তো জানলাম না ঠিকঠাক। কত কিসিমের রিফ্যুজি যে দেখলাম এই ক’বছরে। আমার জন্ম এই শহরে। এছাড়া বাপ-দাদা-কাকা সবারই তো জন্ম, কর্ম, হাগা-মুতা সব এই দেশেই, ওই আমড়াঘাটে। তারপরেও বলে শালারা আমার জন্মের ঠিক নেই। এই আর একর গড়ের ব্যাপার। জন্মের বাপ ঠিক আছে কিন্তু বাপের কাগজের ঠিক নেই তাই আমি রিফ্যুজি। এই দেশে রিফ্যুজি মানে হচ্ছে নতুন কিসিমের সরকারি বেজন্মা।’

    এই গদ্যের নিহিত ব্যঙ্গ এবং সিস্টেমের প্রতি ঘৃণা পাঠকের আত্মস্থ করতে অসুবিধা হয় না। বর্তমান দেশের নানা রঙের রাজনৈতিক দলের ভন্ডামি কয়েকটি শব্দের আঁচড়ে মেঘমালা তুলে আনতে জানে।

    ‘... শিবুদাই তখন আমার ডিরেক্টর। মাঝেমাঝে কখনও ছোট্ট ঘরটার কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা ওদের পার্টির নেতার ছবির দিকে হাত বাড়িয়ে বলত শিবুদা,

    --- গুরুর কসম, আমি ট্রাই করছি লতু!

    এক হাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকা হাসিমুখ নেতার ছবিটার দিকে তাকাতাম আমি। মনে হত শিবুদার গুরুদেব নেতাবাবুও বলছেন হমপে ভরোসা করো, হম হ্যায় না!’

    না, ডি-ভোটার হয়ে লতা দাস, যার সিনেমায় মারানার মধুবালার স্বপ্ন চোখে শিবুদার শারীরিক গন্ধ ভালো লাগত, ডি-ভোটার তালিকায় নাম হয়ে যখন জেলে স্থান হয়, কোথায় যে কেটে পড়ে শিবুদা!

    ‘দীনদয়াল চর্মকারের লাশ ভেসে চলেছে অন্নপূর্ণা ঘাটের দিকে’ গল্পটি অবশ্য ডি-ভোটার সংক্রান্ত নয়। কর্পোরেট পুঁজির রমরমার যুগে দেশে শ্রমনিবিড় শিল্পগুলো একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে - ছাঁটাই শ্রমিক দীনদয়াল চামার-এর করুণ কাহিনি এটি।

    অনেক সময়, সমাজচেতনা, ক্রোধ ব্যঙ্গ প্রকাশের প্রয়াসে লেখকদের আখ্যান কখনো ‘জ্ঞান’ বা কখনো একঘেয়ে হয়ে ওঠে। মেঘমালার গদ্যের বৈচিত্র এখানেই, পাঠককে অদ্ভুত টানে জড়িয়ে নিতে সক্ষম।

    এবার প্রাক্‌কথক রণবীর-এর লেখা ধার করে, আমার কলম থামিয়ে দেব। কারণ, মেঘমালা যে অভিজ্ঞতার আলোড়নে গল্পগুলো লিখেছে, তা কিন্তু অসমের বাঙালি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রত্যক্ষ ক্ষত নয়। রণবীরও বরাকের ভূমিপুত্র। রণবীর প্রাক্‌কথন শেষ করেছে, এ ভাবে: ‘... আসামে বাঙালির অস্তিত্ব সংকটের নির্মম চিত্র এবং প্রতিবাদ মুখর এন. আর. সি. সংক্রান্ত গল্পগুলিতে যেমন লিপিবদ্ধ হয়েছে তেমনটি অন্য কোনও সংকলনে হয়নি, বলা যায়, আসামের বাঙালির দুর্দশার রোজনামচায় পাঠক একাত্ম হতে পারবেন এই সংকলন পাঠে। তাই পিছিয়ে পড়তে হলেও পড়তে হবে পাঠককে ‘কাগজের স্বদেশ’।

    শুধু উত্তর-পূর্ব নয়, আমি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের বলয়ে মেঘমালা দে মহন্তকে কেন্দ্রের অন্যতম কুশীলব হিসেবে দেখতে চাই।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments