• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৮ | এপ্রিল ২০২৫ | গল্প
    Share
  • ঘুম : আনন্দিতা চৌধুরী

    দু পা যায় গাড়িটা, আবার দাঁড়ায়। কী কুক্ষণে যে বড় রাস্তার বিরাট মিছিলটাকে এড়াতে এই সরু গলিতে ঢুকেছিল রজত! এখানে তো দেখা যাচ্ছে অবস্থা আরো খারাপ। জলতেষ্টা পেয়েছে, দেখা যাক রাস্তার পাশের দোকানটায় পাওয়া যায় কি না। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হাঁক পাড়তেই যাবে, এমন সময় নজর আটকে যায় দোকানের সামনে দাঁড়ানো এক মহিলার ওপর। এই মুখের মুখোমুখি হবে আজ আবার এতদিন পরে, মনের অগোচরের এমন কোন গোপন ইচ্ছেই কি তাকে এই রাস্তায় আজ এখন টেনে আনলো? এ মুখের ডৌলটা যে বড় চেনা, ঘরে না এলেও মনে যে তার নিত্য আসা-যাওয়া!

    অলোকস্যারের কাছে পড়তে যেত তারা কজন। মানে, বাকিরা যেত পড়তে, রজত অবশ্য যেত শুধু স্যারের মেয়ে সোমাকে দেখতে। বাবার সব ছাত্রের সঙ্গেই সহজভাবে মিশত সোমা, তার সঙ্গেও। ছন্দপতন হল সেই দিন, যেদিন ক্লাস নেই, স্যার বাড়ি নেই জেনেও শুধু সোমার কাছে যাবে বলে গেছিল রজত। তরুণ রজতের সেদিনের কাছে যাওয়ার কাছে পাওয়ার চেষ্টাতে প্রেম কম, জেদ আর গায়ের জোরের প্রকাশই বেশি ছিল বোধহয়। হাত ছাড়িয়ে সরে গিয়ে কিশোরী সোমা বলেছিল, "ছিঃ রজতদা, তুমি তো জানো আমি সিদ্ধার্থকে...! আমি ওকে কিছু বলব না, বাবাকেও না, কিন্তু তুমি আর কোনদিন এখানে এসো না।"

    ডাকবে? নাকি চুপচাপ সরে যাবে? নাহ, আজ এতদিন পরে সামনে পেয়ে কথা না বলে চলে যাওয়ার সংযম নেই রজতের। কিন্তু, সোমার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? এই দোলাচলের মধ্যে ডেকেই ফেলে রজত। ফিরে তাকায়‌ সোমা। ক্ষণিকের বিভ্রান্তি, স্মৃতি হাতড়ানো, পুরোনোকে খুঁজে পাওয়ার খুশি, পর পর সব তার চোখে পড়তে পারে রজত। আগেও তার চোখ তার মনের আয়না ছিল, আজও। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে সোমার! রোগা, চোখের নিচে কালি, সস্তা ছাপা শাড়ি, প্রসাধন বলতে শুধু মাথা-ভরা সিঁদুর। কিন্তু হাসিটা আছে সেই একই রকম।

    সেই গালে টোল ফেলা মিষ্টি হাসিটা হেসে কল কল করে কথা বলে যায় সোমা। সেদিনের কথা তার মনে নেই হয়তো, থাকলেও তার কোন প্রকাশ দেখা যায় না। এই কাছেই সোমার বাড়ি, তাদের পুরোনো পাড়ার সিদ্ধার্থকে বিয়ে করেছে সে, দেখা যখন হয়েই গেছে ছাড়াছাড়ি নেই, রজতদাকে তার বাড়ি যেতেই হবে, বলে চলে সোমা।

    রজত বুঝতে দেয় না যে এসবের অনেকটাই তার জানা। এদের খবর সে রেখে গেছে এত বছরেও। তবে, সোমার পিছন পিছন ঘুপচি আলোআঁধারি ঘরটায় ঢুকে চোখ সইয়ে নিতে নিতে রজত বোঝে, সোমার দারিদ্র্যের এবং সিদ্ধার্থের শারীরিক অবনতির যে খবর সে পেয়েছিল, অবস্থা তার থেকেও সঙ্গীন।

    তেলচিটে বিছানা থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে সিদ্ধার্থ। বহু বছর পর পুরোনো পাড়ার রজতকে দেখে অবাক হয়, খুশিও। সস্তা কাপপ্লেটে মিয়োনো বিস্কুট আর চা আনে সোমা, পুরোনো দিন, পুরোনো চেনা মানুষের কথা হয়। সোমার অনেক প্রশ্ন, রজতের কাজ রজতের পরিবার নিয়ে। ফোনে তার প্রোমোটারিতে বানানো নতুন বিশাল কমপ্লেক্সের বিজ্ঞাপন, তার সাজানো বাড়ি সুন্দরী স্ত্রী ফুটফুটে সন্তানের ছবি দেখায় রজত। সিদ্ধার্থ উচ্ছসিত হয় তার উন্নতিতে, বউদিকে বাচ্চাদের একদিন আলাপ করাতে এনো না রজতদা, বায়না জোড়ে সোমা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও রজত ঈর্ষা দ্বেষের কণামাত্র খুঁজে পায় না ওদের মনখোলা হাসিতে। নিজেদের সমস্যার কথা কিছুতেই বলতে চায় না ওরা, রজত অনেক জোরাজোরি করে জানতে পারে টাকার অভাবে আটকে আছে সিদ্ধার্থের জরুরি অপারেশন। সেই কবে কোন অন্ধকার রাতে একটা গাড়ি নাকি ধাক্কা মেরে গেছিল সিদ্ধার্থকে, তার জের কাটিয়ে পুরোপুরি সেরে উঠতে পারেনি এখনও সে।

    রজতের পরের প্রজেক্টটা চালু করতে হলে বেআইনি জমি দখল করতে হবে, মানে করাতে হবে। আর সেই কাজের পথ মসৃণ করতে উৎকোচ দিতে হবে কিছু স্থানীয় নেতাকে, সেই কাজেই যাচ্ছিল সে আজ, ক্যাশ ভরা ব্যাগ সঙ্গেই আছে। "এটা রাখো তোমরা, অপারেশনটা করিয়ে নাও," বলে সিদ্ধার্থের হাতে সেই ব্যাগ তুলে দেয় রজত। ওরা কিছুতেই নেবে না, কৈশোরের বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে রজত তাদের বাধ্য করে গ্রহণ করতে। নাহয় পরে আস্তে আস্তে শোধ দিয়ে দিও, বলে সে, যদিও জানে এত টাকা এরা কোনদিনও শোধ করতে পারবে না। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে সোমা, রজতের হাত দুটো চেপে ধরে সিদ্ধার্থ।

    গাড়ি অবধি ছাড়তে এসে সোমা বলে, "তুমি আমাদের ভগবান, রজতদা!"

    ফেরার পথে ভাবে রজত, আমি যে সত্যি কী সে কি তুমি জানো সোমা?

    আজও ঘুমের মধ্যে সিদ্ধার্থর আর্তনাদ তার কানে আসে, চোখ বুজলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সিদ্ধার্থর রক্তাক্ত কাতরানি।

    সেদিনের পর থেকে অলোকস্যারের বাড়ি আর যায়নি রজত। পড়াশোনাও বিশেষ হয়নি, এক বন্ধুর সঙ্গে প্রোমোটারিতে নেমে পড়ে। বড়মানুষ হয়ে আবার সোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর, সোমার মন পাল্টানোর স্বপ্ন দেখতে দেখতেই খবর আসে সোমার সিদ্ধার্থর বিয়ের। অসহ্য রাগে হিংসায় অপমানে গাড়ির ধাক্কা দিয়ে সিদ্ধার্থকে অন্ধকার রাস্তায় আধমরা ফেলে রেখে চলে আসার রাতটা আজও রোজ তার স্বপ্নে আসে। ঘেমেনেয়ে উঠে বসে বিনিদ্র রাত কাটায় সে। রাতের পর রাত, বছরের পর বছর।

    আজ তার কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হল কি?

    আজ একটু ঘুম আসবে কি রজতের?

    নাকি আসল শাস্তি এখনও বাকি আছে তার?



    অলংকরণ (Artwork) : রাহুল মজুমদার
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments