বিশ শতকের তিরিশের দশকে সেবাগ্রামে গান্ধীর সান্নিধ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন নন্দলাল: "সামান্য ও অল্প জিনিস দিয়ে কিরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি হতে পারে, সু-ভাবের প্রতি ও শিল্পীর প্রতি একজন দরদির কিরূপ আকর্ষণ হতে পারে - তাহার একটি নিদর্শন দিব। ...আমি (তাঁর পাশে) ঘটির উপর রাখা লোহার পাতের অশ্বত্থপাতার ঢাকনাটা লক্ষ্য করছি দেখে বললেন 'ইহা সুন্দর নয় কি? একে তো স্বভাবের ছাপ ইহাতে রয়েছে, আবার ইহা এই গ্রামেরই এক লোহারের দ্বারা তৈয়ারি এবং সে আমায় ভালোবেসে ইহা উপহার দিয়াছে আমার কাছে ইহা বহুমূল্য জিনিস।'"
গান্ধীজির শিল্পবোধের ওপর কীভাবে তাঁর আস্থা তৈরি হয়েছিলো, তা নন্দলাল লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর 'বাপুজি' নামক লেখায় (১৯৪০): 'পূর্বে শুনেছিলাম তিনি শিল্পকলা বিষয়ে অনুরাগী নন, কিন্তু সে ভুল ধারণা ভেঙে গেল - যখন লক্ষ্ণৌ Exhibition-এর প্রত্যেকটা ছবি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে একজন কলারসিকের মতোই দেখলেন।' এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা উচিৎ যে ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌ কংগ্রেসের অধিবেশনে একটা ভারতীয় ছবির প্রদর্শনী সংগঠিত করার জন্য গান্ধীজি নন্দলালকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
১৯৩৭ সালে ফৈজপুর কংগ্রেস অধিবেশনে নন্দলালকে মণ্ডপ সাজাবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন গান্ধীজি। এই প্রসঙ্গে গান্ধীজির নির্দেশের কথা নন্দলাল তাঁর স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেছেন: 'মহাত্মা বললেন, কংগ্রেসের এই অধিবেশনটা আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট। এটা হচ্ছে ভিলেজ কংগ্রেস। এতে যা যা হবে সব নির্দেশ দিলেন। গ্রামের জিনিস নিয়ে, গ্রামের লোক দিয়ে সব কাজ করতে হবে। গ্রামের জিনিস দিয়ে সাজাতে হবে।'
হরিপুরা কংগ্রেস-এর (১৯৩৮) নান্দনিক-ভাবনায় নন্দলালের ভূমিকা কী ছিল? তাঁর নিজের কথায় — 'হরিপুরাতে আমাকে ডেকেছিলেন গান্ধীজি। প্রথম কাজ ছিল প্যান্ডেল সাজানো আর দ্বিতীয় হলো একজিবিশন করা। প্যান্ডেলের ভার রইলো আমার ওপর। একজিবিশনের ভার রবিশঙ্কর নিতে চাইলেন। গ্রামে গ্রামে শিল্পবস্তু সংগ্রহ করতে হবে - সেইজন্যে। তাতে লাভবান হলেনও। শিল্পবস্তু সংগ্রহ তিনিই করলেন। এগজিবিশন, প্যান্ডেল আর গেট সাজিয়েছিলুম আমি।'
এই বইতে গান্ধীজির ঘনিষ্ট অনেককে নিয়ে নন্দলালের 'টুকরো কথা' সংকলিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন মহাদেব দেশাই, যমুনালাল বাজাজ, মণিবেন, প্রমুখ।
গান্ধীজি ও নন্দলাল বিষয়ক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা সংযোজিত হয়েছে বর্তমান সংকলনে। শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের 'গান্ধীজি ও নন্দলাল' এই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিনোদবিহারী লিখেছিলেন : "হরিপুরা কংগ্রেস (১৯৩৮) নন্দলালের অন্যতম কীর্তি। হরিপুরা কংগ্রেসের বিরাট পরিকল্পনা নন্দলাল তাঁর ছাত্রদের সাহায্যে সম্পন্ন করেন। এই মণ্ডপ-সজ্জার আদর্শ পরবর্তী কালের কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠানের সজ্জার আদর্শরূপে গৃহীত হয়। নন্দলাল ও তাঁর সহকারীদের অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা অপর দিকে সর্বসাধারণের সঙ্গে অনায়াসে মিলবার শক্তি ও নন্দলালের কর্মক্ষমতা যুগপৎ তৎকালীন নেতাদের মনে শিল্পীদের সম্বন্ধে নূতন চেতনা জাগিয়েছিল। ... শিল্পীরা দেশের কাজে হাত লাগাতে পারল এবং বৃহৎ জনতার সামনে শিল্পের সম্ভার উপস্থিত করা গেল - এই দিক দিয়ে নন্দলাল গান্ধীজির দাবি পূরণ করেছিলেন।" এই প্রসঙ্গে বিনোদবিহারী জানিয়েছিলেন: 'সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কোনো উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা পাওয়া যায় না। গান্ধীজির মধ্যস্থতায় শিল্পীসমাজের সঙ্গে রাজনীতিজ্ঞদের যোগাযোগের পথ মুক্ত হলো। নন্দলাল হলেন যোগসূত্র স্থাপনের প্রধান ও প্রথম প্রতিনিধি।'
বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালির শিল্পসংস্কৃতির নানা শাখার বিকাশের যোগ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে। সেই তুলনায় গান্ধীর নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালির শিল্পভাবনার যোগ নিয়ে চর্চা অনেক কম। সুশোভন অধিকারী সম্পাদিত বইটি সেই দিক থেকে অন্য ভাবনার সাক্ষ্য বহন করছে। জানি না বইটি বর্তমানে বাজারে সংগ্রহযোগ্য কিনা! তা না হলে বইটি অবশ্যই পুনর্মুদ্রিত হওয়া জরুরি।