• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | গল্প
    Share
  • পাখিধরা গাড়ি پرندہ پکڑنے والی گاڑی : গিয়াস আহমদ গদ্দি
    translated from Urdu to Bengali by শুভময় রায়




    [উর্দু গদ্যকার গিয়াস আহমদ গদ্দির (১৯২৮ – ১৯৮৬) জন্ম বর্তমান ঝাড়খণ্ডের ঝরিয়ায়। স্থানীয় গ্রন্থাগারে উর্দু পত্রপত্রিকা পড়ে সাহিত্যে উৎসাহ জাগে। তাঁর যৌবনের রচনায় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক কৃষণ চন্দরের প্রভাব লক্ষণীয়। ‘মিরাস’ নামে ছোট গল্পের একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। তিন দশক ধরে রচনা করেছেন বহু ছোট গল্প। প্রকাশিত ছোট গল্প সংকলন ‘বাবা লোগ’, ‘পরিন্দহ পকড়নেওয়ালি গাড়ি’ ইত্যাদি। এখানে অনূদিত গল্পটি এই শেষোক্ত সংকলনটি থেকে সংগৃহীত। গিয়াস আহমদ গদ্দি ‘সারা দিন ধুপ’ নামে একটি ছোট উপন্যাসও লিখেছিলেন। তাঁর ভাই ইলিয়াস আহমেদ গদ্দিও সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রখ্যাত লেখক।

    —অনুবাদক]



    সকাল হত, দিন এগোত, আর সূর্য যখন ঠিক মধ্য গগনে, তখন একটা গাড়ি এসে শহরের পাখিগুলোকে ধরে নিয়ে যেত -- ঠিক যেমন কুকুর ধরার জন্য মিউনিসিপ্যালিটির গাড়ি আসে। চারদিক রঙিন কাঁচে ঢাকা ভারি সুন্দর সে গাড়ি, চোখ তুলে দেখার মত। গাড়ির চারপাশে ছোট ছোট ঘণ্টা বাঁধা , চলার সময় সেগুলো ধীরে ধীরে বাজত। ঘণ্টির আওয়াজও ছিল অদ্ভুত -- কেউ যেন জাদুবাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে। লম্বা, একটু কুঁজো, ফ্যাকাশে চেহারার একটা লোক গাড়িটাকে টানত। আর ঠিক তেমনই আরেকজন গাড়ির পেছন পেছন যেত, খুব লম্বা একটা বাঁশের লাঠি নিয়ে। তার ডগায় বাঁধা এক গোছা বুরুশের মত জিনিস যাতে গঁদের মত আঠালো কিছু লাগানো। সেটা ছিল পাখি ধরার লাঠি।

    দেওয়াল আর ছাদের ওপর, টেলিফোনের থামে, গাছপালা অথবা মাঠে-ঘাটে দানাপানি ঠোকরাতে থাকা পাখি দেখলেই পেছনের লোকটা হাতের বাঁশটা এগিয়ে ধরত। পাখির পালকে লাঠির ডগার আঠালো জিনিসটার ছোঁয়া লাগলে প্রথমেই তো পাখনার ঝটপটানি লেগে যেত, পাখি ওড়ার চেষ্টা করত। কিন্তু অচিরেই পাখা ঝটপট করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পাখি একদিকে হেলে পড়ত। তখন লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দুহাতে পাখি ধরে ধীরে ধীরে গাড়ির ছোট্ট দরজাটা খুলে তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিত। তারপরে দরজা বন্ধ করে মন দিয়ে কাচের ভেতরে দেখত -- যেখানে পাখিটা ফরফর করতে করতে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। আর সেই দৃশ্য দেখে লোকটার মুখে অদ্ভুত এক হাসি খেলে যেত, চোখ দুটো অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মত জ্বলে উঠত।

    প্রতিদিন সূর্য ওঠার পর আলোর তেজ বাড়তেই পশ্চিমের দরজার কাছে ছোট ছোট ঘণ্টির অস্পষ্ট আওয়াজ শোনা যেত। আর তারপরেই ঢুলুঢুলু চোখ আর কোমরে পাতলা রশি জড়ানো ফ্যাকাশে মুখের সেই লোকটা প্রায় আধঘুমন্ত অবস্থায় গাড়িটাকে টানতে টানতে শহরে ঢুকত। কোমরের কাপড়টার একদিক থাকত গাড়ির সঙ্গে বাঁধা। আর তারপর কোনও চিড়িয়া, কোনও পাখি নজরে পড়লেই লোকটা নিজেই থেমে পেছনের সঙ্গীকে ইশারায় দেখিয়ে দিত।

    এই ছিল রোজের দস্তুর। দোকানদারেরা দোকানে রইত, পথচারীরা পথ চলত, মোটরকার পোঁ-পোঁ আওয়াজ করতে করতে তেজে ছুটে চলত, মুচি জুতো সারাই করতেই থাকত -- কেনাকাটা আর চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায় হত, লেনদেনের বাজারের সে ব্যস্ততায় প্রথমে তো কারও নজরই গাড়িটার ওপর পড়ত না। তবে দৈবাৎ কেউ মুখ তুলে চাইলে সুন্দর গাড়িটা যেন জাদুমন্ত্রে দর্শককে বশ করে নিত, চোখ সরত না।

    কখনও এমনও হয়েছে যে কৌতূহলী পথচারী আশ্চর্য হয়ে সাহস করে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে। গাড়ি টানা লোকটা কাউকে কাছাকাছি আসতে দেখলেই ঝটপট তার বড় পকেটে হাত ঢুকিয়ে দু'চারটে সিকি পয়সা বার করে তার দিকে ছুঁড়ে দিত। পথচারী পয়সাগুলো কুড়োতে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ত যে তার অন্য কিছুর খেয়ালই থাকত না। লোকে বিহ্বল চোখে সে দৃশ্য তাকিয়ে দেখত; তবে সেই বিহ্বলতা দীর্ঘস্থায়ী হত না। কয়েক মিনিটই, বড়জোর দশ-বিশ মিনিট -- আর ক্রমশই এই দৃশ্য দেখতে লোকে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রথমে হয়ত কয়েক সেকেন্ড আর তারপরে ধীরে ধীরে এমন হল যে পাখিধরা গাড়ি আসে যায়, তবে কেউ আর গাড়িটার দিকে ফিরেও তাকায় না। নিজের কাজকর্মেই ব্যস্ত থাকে।

    তেমনই একটা দিন ছিল যেদিন আমি এক দোকানদারকে জিলিপির থালার দিকে দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘এদিকে দেখো, জিলিপির ওপর কত মাছি বসে আছে! .......এই যে শহরে যখন এত রোগ ছড়াচ্ছে, তখন এই মাছি কত বিপদই না ঘটাতে পারে.........’

    ‘মাছি?’ হালুইকর ক্লান্ত হাতে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করল। মাছিগুলো কয়েক মুহূর্ত উড়েই আবার টুপ করে জিলিপির ওপর গিয়ে বসল। ‘হ্যাঁ। মাছিগুলো তো শালা উড়েও পালায় না!’

    তারপরে আমাকে একবার ভালোভাবে ঠাহর করে নিয়ে হালুইকর বলল, ‘কিন্তু তাতে আপনার কী সাহেব, আপনি তো আর কিনবেন না........’

    আমি সত্যিই কিনব না বলাতে সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল। তারপরে খুব কাছে সরে এসে কানে কানে বলল, ‘আর আমারই বা কী সাহেব? আমিও তো আর এসব খাব না.....’

    ব্যস, এতেই আমি বুঝে নিলাম যে আসল ব্যাপারটা কী! পাখিধরা গাড়ি আসে আর শহরের পাখিগুলোকে ধরে নিয়ে যায়। অথচ তারা কেন এ কাজ করছে তা জিজ্ঞেস করার কথা তো ছেড়েই দিন, খোদার রাজ্যে এমন কোনও বান্দা নেই যে একবার চোখ তুলে দেখবে আশপাশে কী হয়ে চলেছে! ব্যাপারটা বুঝলাম, আমার কপালে যে দাগগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই সান্ত্রীদের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে ছিল, তারাও মুছে গেল। আমি হেসে ফেললাম, আর তারপরে হালুইকরকে আড্ডার ছলে বললাম, ‘তো ভাই হালওয়াই, এক কাম করো না! ওই গাড়ির লোকদের নজর যাতে এই মাছিগুলোর ওপর পড়ে তার ব্যবস্থা করো।’

    হালুইকর তো প্রথমে আমার কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। তারপরে কথাটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল। ‘আরে তাই তো..........কিন্তু কেন সাব, এই সব ঝঞ্ঝাট করে আমার ফায়দাটা কী?’

    ‘এই যে মাছিগুলো জিলিপির সব রস.......’

    ‘হ্যাঁ এতো ঠিকই বলেছেন, কমবখতগুলো সব রস চুষে মেরে দেয় .........কিন্তু সাব, এতে আমার লোকসানটাই বা কী? আমার তো লাভই হয়!’

    ‘সেটা কীভাবে?’ আমি হালুইকরের চোখে চোখ রেখে বললাম। ‘তোমার ফায়দা কেমন করে হয়?’

    হালুইকর তো খুব একচোট হেসে নিল। তারপরে বনস্পতি মাখা চকচকে ভুঁড়িটার ওপর হাত বুলিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে এল।

    ‘বাবু, আপনি আর এই জগতের ব্যাপার-স্যাপার কীভাবে জানবেন? এর মধ্যে অনেক গোপন কথা আছে, দুনিয়া ঠিক আপনি যেমন ভাবছেন তেমন ভাবে চলে না।’

    এই বলে হালুইকর চুপ করে গেল। তারপরে আরও গম্ভীর হয়ে আমার দিকে চাইল।

    ‘আপনার তো মায়া-মমতা আছে বলেই মনে হচ্ছে, তাই বলছি। কাউকে এসব বলবেন না বাবু। জিলিপির এই যে রস মাছিগুলো চুষতে থাকে তো শেষ পর্যন্ত। তা ওই রস আর মাছিগুলো কোথায় যায় এটুকু তো আমাকে বলুন?’

    ‘কোথায় যায়? ও ভাই হালুইকর, এ তো আমার জানা নেই তুমিই বলো কোথায় যায়।’

    ‘কোথাও যায় না।’ হালুইকর এমন ভাবে বলল যেন এবারে হেস্তনেস্ত হবে। ‘রস যায় মাছির পেটে আর মাছিগুলো জিলিপি আর আমার ওজনদাঁড়ির পাল্লার সঙ্গে লেগে থাকে .......... বুঝলেন বাবু? এই ভাবেই আমার লাভ হয়।’

    কিন্তু আমি বেশ খানিক সময় কিছুই বুঝতে পারলাম না। বেকুবের মত হালুইকরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হালুইকর আবার হাসল, গোঁফে তা দিল, ‘এখনও বুঝলেন না....?’

    আমাদের কথাবার্তা যখন ঠিক এইরকম চলছে, তখন শহরের পেছনের দরজার দিক থেকে ঘণ্টির আওয়াজ কানে আসায় আমার মনোযোগ সেদিকে চলে গেল। একটু পরেই সেই ফ্যাকাশে চেহারার একটু কুঁজো লোকটাকে দেখতে পাওয়া গেল। রোজকার মত তার কোমরে পাতলা দড়িটা বাঁধা, যার উল্টো দিকটা গাড়ির সঙ্গে লাগানো থাকত। লোকটা তেমনই অলসভাবে সড়কপথে আস্তে আস্তে চলতে চলতে সামনের দিকে এগোচ্ছিল। গাড়ি সামনে আসতে দেখা গেল রঙিন কাঁচের মধ্যে বন্দি দুটো পায়রা আর একটা চড়ুই। পায়রা দুটো তো মাথা নামিয়ে এক দিকে বসেছিল, কখনও সখনও খুব ধীরে ক্লান্ত পায়ে হয়ত একটু পায়চারি করে নিল। কিন্তু চড়ুইটা তেজের সঙ্গে এদিক-ওদিক ফুড়ুৎ-সুড়ুৎ উড়ে বেড়াচ্ছিল -- মনে হচ্ছিল সে সত্যিই বিরক্ত।

    গাড়ি ততক্ষণে চারমাথার মোড়ে পৌঁছেছে। রোজের তুলনায় রোদটা বেশ চড়া, গাড়ি টানা লোকটা এক হাত ভুরুর ওপর রেখে চোখটাকে রোদ থেকে আড়াল করে আশপাশে কড়া নজর রেখেছে। পাশের নালির ধারে একটা তৃষ্ণার্ত পাখিকে ঠোঁট দিয়ে জল খেতে দেখে সে গাড়ি থামাল। পাখিটা ভয়ে ভয়ে ঘাড় তুলে মাঝে মাঝে ইতিউতি চাইছে। চালক লাঠি ধরা সঙ্গীকে ইশারা করতেই সে চুপি চুপি দ্রুত এগিয়ে গিয়েই বাঁশের ডগাটা পাখিটার গায়ে লাগিয়ে দিল।

    একটু পরে গাড়ির রঙিন কাঁচের বাক্সের কপাট খুলে গেল, পাখির জায়গা হলে ভেতরে। নতুন পাখি একদিকে কাত হয়ে পড়তেই ভেতরের চড়ুইটা এমন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়তে আর কাঁচের দেওয়ালে ধাক্কা দিতে শুরু করল যেন সে দেওয়াল ভেঙে কোনও ভাবে পালিয়ে যেতে চায়। হাতে বাঁশ ধরা লোকটা হাসতে হাসতে কাচের বাক্সের ভেতরে চাইল। তার চোখ তখন জ্বলজ্বল করছে, সে কাচের বাক্সে আলতো চাপড় মারতেই দেখা গেল যে চড়ুইটা শান্ত হয়ে গেল।

    গাড়ি আবার তেমনই ধীরগতিতে এগিয়ে চলল। শান্ত পরিবেশে ঘণ্টির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে.....টুং টুং টুং......টুং টুং টুং........

    আস্তে আস্তে গাড়িটা নজরের বাইরে চলে গেল।

    ‘গেল ...........চলে গেল.............’

    ‘হ্যাঁ, চলে গেল। ওই পাখিটাকেও নিয়ে গেল।’

    সকলের ঝিমুনি ভাঙলে দেখা গেল গাড়িটা শহরের উত্তর সীমানার ঢাল বেয়ে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তার ওড়ানো ধুলো তখনও ধীরে ধীরে আবার বাতাসের হাত ছেড়ে ধরণীতে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে। আরও কয়েক মিনিট পরে আশপাশের মানুষের মুখের অবাক ভাবটাও মিলিয়ে গেল। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    ‘আচ্ছা ভাইজান, এই পাখি ধরার গাড়িটা.................’

    আমি ঘুরে দেখার চেষ্টা করলাম কথাটা কে বলল। ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে, মুখটাই একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন যেন।

    ‘এই পাখি ধরার গাড়িটা........’ ছেলেটা এটুকু বলেই আবারও থেমে গেল, যেন সে নিজেই জানে না কি প্রশ্ন করতে চাইছে!

    ‘হাঁ হাঁ মিয়াঁ, কি জানতে চাইছ পাখিধরা গাড়ির ব্যাপারে.......’

    ‘জি ভাইজান, এটুকুই যে পাখিধরা গাড়িটা .................’

    ‘হাঁ মিয়াঁ, আমিও তো তাই ভাবছি যে এটা কি গাড়ি? রোজ দুপুরে আসে, আর শহরে যত পাখি আছে তাদের তুলে নিয়ে চলে যায়.......’

    ‘আচ্ছা ভাইজান……’ কয়েক মুহূর্ত পর ছেলেটা আবার জিজ্ঞেস করল যেন কিছু মনে পড়েছে,

    ‘আচ্ছা ভাইজান, এরা কি তাহলে দিদির লক্কা পায়রাটাকেও নিয়ে যাবে?’

    ‘হ্যাঁ, নিয়ে যাবে তো বটেই। ওদের চোখে পড়ারই যা দেরি!’

    ‘তা হলে দিদি ভালো হয়ে উঠবে কীভাবে? ওর যে মুখটা বেঁকে গেছে। হাকিমজি যে বলেছেন ওষুধের সঙ্গে লক্কা কবুতরের পালকের হাওয়াও জরুর চাই!’

    ছেলেটা এত দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বলল যে আমি তার বিষণ্ণ মুখটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না।

    ‘হ্যাঁ...হ্যাঁ....এটা তো ঠিকই ভাবনার কথা, লক্কা পায়রাটাকে একেবারে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না......’

    ‘তা হলে আমি এখন কী করি .......... আপনি বলুন না ভাইজান, আমি তো অনেক ছোট না....... আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না....’

    ‘আমিও তো কিছু বুঝছি না মিয়াঁ। আর সত্যি কথা জানতে চাও তো বলি ....... আমিও তো আসলে খুবই ছোট.....’

    ‘আপনি ছোট?’ ছেলেটা খিলখিল করে হেসে উঠল। ‘আপনি এত বড় একজন .... বাহ্‌......’ সে আবার হো হো করে হাসল।

    আমি চুপ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। নিজের মনেই বললাম.... ‘মিয়াঁ, তুমি এই কথায় হাসছ?’

    ‘ভাইজান, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করব?’ এবার পরের প্রশ্নটা এল।

    ‘বলো মিয়াঁ, সেটাও বলে ফেলো....’

    ‘আপনি এত দুঃখী ভাইজান…… আপনি কখনও হাসেন না কেন?’

    মন বলছিল সত্যি কথাটাই তাকে বলে দিই। ..... কি করে হাসব মিয়াঁ...... এই কাঁচের কারাগারের মধ্যে কি কেউ হাসতে পারে?.... কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই লক্কা পায়রার চলে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করা ছোট্ট ছেলেটাকে, যে আবার তারপরেই খিলখিল করে হেসে উঠেছিল, কিছু বলতে পারলাম না। শুধু ভালোবেসে তার দিকে চেয়ে রইলাম।

    ‘ভাইজান, আপনাকে হাসাই?’ ছেলেটা খুশি হয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। তারপরে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আপনি বললে আমি আপনাকে হাসাতে পারি।’

    প্রথমে তো ভারি আশ্চর্য হলাম, পরে অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। ছেলেটা এমন কিছু বলছে যাতে তাকে বয়সের থেকে অনেক বড় বলে মনে হচ্ছে। আমিও ভালোবেসেই জোরের সঙ্গে বললাম, ‘মিয়াঁ, আস্তে বলো। কেউ শুনে ফেললে ধরে নিয়ে যেতে পারে। পুলিশকে জানিয়ে দেবে যে এ কেমন অদ্ভুত ছেলে যার দিদি অসুস্থ আর তাদের লক্কা পায়রাটাও গেল বলে ...... তবু সে নিজেও হাসছে আর অন্যদেরও হাসানোর কথা ভাবছে! বুঝেশুনে চলো মিয়াঁ, হুঁশিয়ার হও, বেকার তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।’

    ‘দূর, কে আমাকে ধরবে?’ ছেলেটা সাহস দেখিয়ে বলল। ‘বলেন তো আপনাকে হাসিয়ে দিই.....’

    ‘হাসাও মিয়াঁ, খুব ভালো হবে। বড়ি মেহেরবানি হোগি তুমহারি.....’

    ‘তা হলে বলুন আপনি আমার বন্ধু।’ সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

    ‘তোমার সঙ্গে দোস্তি? আরে তুই একরত্তি.....আমার তোর বয়েসের ছেলে আছে রে..... আমি তো তোর বাপের বয়সী....!’

    ‘তাতে কি? বাবাও তো বন্ধু হয়। আমার মৌলবিজি বলেছেন। ভালো বাপ সন্তানের বন্ধুও হয়।’

    ‘এই কথা? ঠিক আছে, আজ থেকে তোমার বন্ধু হলাম।’ আমি তার ছোট্ট সুন্দর হাতটা নিজের হাতে নিলাম।

    ‘তা হলে আমার সঙ্গে চলুন নদীর দিকে, সেখানে খালি আমি আর আপনি। নদীর ধারে গেলে আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।’

    ছেলেটা আমাকে টানতে টানতে নদীর দিকে নিয়ে গেল। আমি পেছন পেছন, সে চলল আগে আগে। রাস্তার লোকেরা আমাদের এই দোস্তির দিকে চেয়ে রইল। আর আমরাও ফিরে ফিরে তাদের দেখতে লাগলাম। তাদের হয়ত এমন কোনও বন্ধু আছে বা নেই, এমন এক পেয়ারে বেটা আছে বা হয়ত নেই!

    নদীতীরে পৌঁছে ছেলেটা এপাশ ওপাশ সতর্ক দৃষ্টিতে দেখে নিল। সব নির্জন দেখে সে তার নিকারবোকারের পকেট থেকে দেশলাইয়ের একটা ডিবে বার করে হাসল। তারপরে আমার দিকে ফিরে একান্ত গোপনে বলল, ‘এর মধ্যে আছে......’

    আমিও অতি সতর্কভাবে প্রথমে ডাইনে পরে বাঁয়ে তাকিয়ে সব শান্ত দেখে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী আছে?’

    ‘এই আছে....এই আছে....’ বলতে বলতেই ছেলেটা ঝট করে দেশলাইয়ের ভেতরের অংশটা টেনে বার করল। দেশলাই বাক্সটার ভেতরে একটা অতীব সুন্দর প্রজাপতি শুয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছিল তার প্রাণ নেই, কিন্তু বাইরের হাওয়া আর রোদ গায়ে লাগতেই ছোট ছোট পাখনা দুটো ফড়ফড় করতে শুরু করল -- গেরুয়া আর উজ্জ্বল নীল চোখ ধাঁধিয়ে দিল। পাখনার কিনারে যেন রামধনুর ঝলক, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তাকে যেন আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

    আমি বিভোর হয়ে প্রজাপতিটার দিকে তাকিয়ে আছি, রঙের দুনিয়ায় যেন হারিয়ে গেছি। আর ছেলেটা তখন আমার মুখের রেখায় কী যেন একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি প্রজাপতি থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাতে তাকে বিষণ্ণ বলে মনে হল। ‘আপনি তো অদ্ভুত মানুষ ভাইজান? আপনি প্রজাপতি দেখলেও খুশি হন না।’

    ‘হাঁ মিয়াঁ?’ আমি চমকে উঠলাম। দশ বছরের ছেলেটা তো আমার মনের অনেক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ..... ‘এ তুমি কি বলে দিলে মিয়াঁ যে আমি....’

    ‘হ্যাঁ ভাইজান,’ সে আমাকে থামিয়ে দিল। ‘প্রজাপতিও তো আপনাকে আনন্দ দিতে পারে না! তা হলে আমাদের বন্ধুত্ব হবেই বা কী করে?’

    ‘হতে পারে না মিয়াঁ, আমাদের বন্ধুত্ব হতে পারে না।’ বলে আমি এগিয়ে গেলাম কিন্তু ছেলেটা আমার পাশে জোর কদমে হাঁটতে লাগল।

    ‘কিন্তু ভাইজান, আমার ওই লক্কা পায়রাটা?.... আর ওই গাড়ি.......’

    পরদিন বাজারে কতজনকে যে বললাম! সবাইকে গিয়ে ধরলাম শুধু এটুকু জানানোর জন্য যে ওই বাচ্চা ছেলেটার দিদি পক্ষাঘাতের রোগী, আর হাকিম বলেছে ওষুধের সঙ্গে তার লক্কা পায়রার পালকের হাওয়া চাইই চাই। আর এখন যদি পাখিধরা গাড়িটা ওই পায়রাটাকেও নিয়ে যায় তা হলে কী হবে…..? বললাম জুতো সারাই মুচিকে, কাপড়ের দোকানিকে, একগাদা রোগীর ভিড়ের মধ্যে ব্যস্ত ডাক্তারবাবুকে, ডালপুরিওলাকে, পথচারীদের, সাদা পাতলুন পরে দ্রুত গতিতে হেঁটে যাওয়া বাবুদের, যাদের দেখলে মনে হয় এমন ভাবে চলেছে যেন জগৎটাকে মাড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েই ফেলেছে, রাজনীতির দুই পক্ষকে যারা সারাক্ষণ মিথ্যে বলে আর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া চালিয়ে যায়। একেক জনকে ধরে ধরে বললাম, দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকেও থামিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কেউ আমার কথায় কান দিল না।

    কারও কাছেই আমার প্রশ্নের জবাব পেলাম না। সকলেই নিজের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত। তাই আমিও সেই বালকের প্রশ্নটা হজম করে নিলাম, উত্তর জোগাতে পারলাম না। দুঃখে মাথা নিচু করে পথ চলছিলাম, মনে হচ্ছিল পা দুটো যেন আর চলছে না।

    বিকেল পেরিয়ে সন্ধে হয় হয়। একটু পরেই ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। চকের কাছে একটা বাড়ি নজরে এল যার বারান্দায় শহরের নামজাদা বাইজি মুন্নিবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে আর তার সামনে দাঁড়ের ওপর ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে দেখতে থাকা তোতা পাখিটাকে কথা শেখানোর চেষ্টা করছে।

    আমি লুকিয়ে বাইজির কুঠিতে ঢুকে ওপরে চলে গেলাম। ঘরের দরজাটা খুলে ব্যালকনিতে পৌঁছে খোদ মুন্নিবাইয়ের সামনে গিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুন্নিবাই তখনও তোতা পাখিকে পড়াতে ব্যস্ত, আমার উপস্থিতি টেরই পায়নি। ‘বল্‌ মিয়া মিট্‌ঠু ....নবীজি রুজি ভেজো....’

    মিয়াঁ মিট্‌ঠু একটু ডাইনে-বাঁয়ে মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়ের দুদিকে রাখা পেয়ালার দিকে তাকিয়ে, একটা পেয়ালায় রাখা সবুজ লঙ্কাগুলোকে ঠুকরে নিয়ে মুন্নি বাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নবীজি রুজি ভেজো.....’

    আমি মুন্নির পেছনে দাঁড়িয়ে গলা নামিয়ে বলে ফেললাম, ‘তাই তো আমি এসেছি!’ মুন্নি বাই ঘাবড়ে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার আগাপাশতলা দেখে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে কড়া গলায় বলল, ‘আপনি এখানে কীভাবে চলে এলেন? কে আপনি?’

    ‘সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম। আমাকে চিনতে পারলে না মুন্নিবাই? নবীজিই তো আমাকে তোমার কাছে পাঠালেন।’

    ‘মুন্নিবাই আমার কথা শুনে হেসে ফেলল। ‘আচ্ছা, আচ্ছা, জি। চলুন, ওদিকে তক্তপোশের ওপর বসবেন।’ সে চিরুনির দাঁতে জড়িয়ে থাকা সোনালি চুলগুলোকে গুলি পাকিয়ে তার ওপর থুতু দিয়ে নিচে রাস্তায় ফেলে দিল।

    ‘মুন্নিবাই, তুমি তো বড়ই বিশ্বাসঘাতক! তোতাপাখির মতই রং বদলাতে থাকো।’

    জবাবে মুন্নিবাই যেন আবার রং বদলিয়ে হেসে ফেলল। তক্তপোশের ওপর বসে আমি একটা একটা করে গুনে চোদ্দটা এক টাকার নোট মুন্নিবাইয়ের পায়ের কাছে রাখলাম।

    ‘আমার কাছে তো এইটুকু টাকাই আছে। তোমার নবীজি আজ খুবই গরীব এক আদমিকেই তোমার কাছে পাঠিয়েছে।’

    ‘নহিঁ জি, ইয়ে ভি কেয়া কম হ্যায়? আমি তো আমার মনিবদের সেবা করতেই চাই!’

    তবে অনেকটা সময় এইভাবে কাটার পরেও মুন্নিবাইয়ের কাছে কোনও সেবা না চাওয়ায় সে রেগে উঠল। ‘ইহাঁ কাহে কো আয়ে হো জি?....আর এই টাকাই বা দিলেন কেন?’

    ‘মুন্নিবাই কিছু মনে কোরো না, কিন্তু আমি তো তোমার কাছে শুধু একটা কথা জানতেই এসেছি। ভাবলাম তোমাকেও জিজ্ঞেস করে দেখি কোনও উত্তর পাই কিনা।’

    ‘কী জানতে চান?’

    ‘আজকাল রোজ দুপুরবেলায় একটা পাখিধরা গাড়ি আসে দেখেছ?’

    ‘হ্যাঁ কখনও সখনও দেখি তো।’

    ‘তো তোমার কী মনে হয়?’

    ‘ভালোই.....ভালোই তো লাগে জি! হলুদ হলুদ লাল লাল কাচের ঘরের মধ্যে পাখিদের কিচিরমিচির দেখতে তো খারাপ লাগে না।’

    ‘অনেক দূর থেকে দেখো, তাই না? তোমাকে যারা চায় তারা যেমন অনেকটা দূর থেকে দেখে?’

    ‘হাঁ জি, এই ব্যালকনি থেকে....’

    ‘মুন্নিবাই, কোনও দিন নিচে গিয়ে কাছ থেকে দেখো।’

    ‘সে আবার কেন? আমার কি অত ফুরসত আছে নাকি?’

    মুন্নিবাই বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চাইল। তারপরে বোধহয় আমার দেওয়া চোদ্দটা টাকার কথা মনে পড়তে হেসে ফেলল।

    ‘আপনিও আমাকে একটু কাছে এসে দেখুন না......’

    ‘সে তো দেখছিই, মুন্নিবাই। আর তুমি সেই দিন ওই গাড়িটাকে কাছ থেকে দেখবে যেদিন গাড়িওয়ালারা তোমার তোতা পাখিটাকেও নিয়ে যাবে।’

    ‘আমার তোতাটাকে কেন নিতে যাবে জি? মুন্নিবাই ঝাঁজিয়ে উঠল। ওরা তো সড়কের পাশে উড়তে থাকা আওয়ারা পাখিগুলোকেই ধরে নিয়ে যায়। একে কেন ধরবে, এ তো আমার পোষা আদরের হিরামন!’

    ‘হ্যাঁ মুন্নিবাই, প্রথমে তো ওরা রাস্তার ধারের পাখিই ধরবে। কিন্তু তারপর কিছুদিন বাদে ওই লাল লাল হলুদ হলুদ কাচের ভেতরে আরও সব পাখিদের সঙ্গে তোমার এই হিরামনকে দেখতে কী ভালোই না লাগবে! তুমি দেখো বা না দেখো, সড়কের ধারে পসরা সাজিয়ে বসা দোকানিরা তো জরুর দেখবে। আর পাখিধরা গাড়ির লোক দুটো রাস্তার ধারে সিকি পয়সা ছুঁড়ে ছুড়ে দেবে, অন্যদের সঙ্গে তুমিও সেই সিকি পয়সাগুলো কুড়োতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ...... আর এটা ভুলে যাবে যে .......’

    ‘কী ভুলে যাব জি? অনেক সিকি পয়সা যদি মেলে, তা হলে হিরামনের জন্য আবার কে কাঁদবে? ওরা যদি অনেক অনেক পয়সা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় তাহলে আমি যত পারব কুড়িয়ে নেব। আর তারপর বাজারে গিয়ে একটা নতুন তোতা পাখি কিনে আনব।’

    ‘হায় মুন্নিবাই, একটু ভেবেচিন্তে কথাটা বল! এই দুনিয়াটা শালা বড়ই মতলববাজ। ধরো যদি বাজারে তোতা না মেলে, আর যদি মেলেও বা, তাকে যদি তোমার মনে না ধরে? যদি সে তোতা বোবা হয়? এমন কথা না বলে? আর কথা বললেও যদি এমন গুণী না হয়.....গলায় এই আবেগ না থাকে?’

    মুন্নিবাই খিল খিল করে হেসে উঠল। বেশ খানিক হেসে নিয়ে বলল, ‘বাহ্‌, দারুণ বললেন তো! কোথায় থাকেন আপনি? করেনটাই বা কী?’

    ‘গল্প লিখি মুন্নিবাই। আর থাকার কথা যদি বলো, তা হলে যেখানে জায়গা জোটে থেকে যাই, যেখানে ইচ্ছে হয় শুয়ে পড়ি।’

    ‘এই গল্প লেখাটা কি কোনও কাজ হল? আপনি তো আমার চেয়েও অকেজো দেখছি! আপনার কাজটা তো তা হলে আমার কাজের চেয়েও খারাপ মনে হয়? কেন, এমন কেন?’

    ‘হ্যাঁ মুন্নিবাই, তুমি তো চাইলেই চোদ্দটা টাকা বার করে দিতে পারো। কিন্তু আমাকে চোদ্দ টাকা পেতে হলে আটটা গপ্পো লিখতে হয় যে! গপ্পো কেনে যারা তারা একটা গপ্পের জন্যে দুটো টাকাই দেয়।’

    ‘দো রুপয়ে ফি কাহানি? খুব কমই তো হল তা হলে।’ মুন্নিবাই যেন হতাশ হল।

    হঠাৎই যেন তার কোনও কথা মনে পড়ল। ‘কিন্তু একটা গল্পের দাম দুটাকা হলে আটটা গল্পের জন্য তো ষোলো টাকা হওয়ার কথা?..... বাকি দো রুপয়ে নিকালো জি....জলদি করো...!’

    ‘বলেছ ঠিকই, কিন্তু একটা গল্প তো দাঁড়িপাল্লার মাপামাপিতে লেগে যায়!’

    ‘মাপামাপিতে? আরে বাহ্‌,’ মুন্নিবাই আবার হেসে ওঠে, ‘দাঁড়িপাল্লায় কীভাবে চলে যায়?’

    আসলে কি জানো, যখন খদ্দেরের কাছে গিয়ে তাকে আটটা গপ্পো পড়তে দিই, তখন পড়া শেষ হলেই সে ঝটপট ভেতর থেকে একটা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসে।

    ‘দাঁড়িপাল্লা? কাহানি কি পাল্লায় মেপে বিক্রি হয় নাকি?’

    ‘খোদার কৃপা, মুন্নিবাই, যে এখনও পর্যন্ত গল্পগুলো তাও দাঁড়িপাল্লায় ওজন করে বিক্রি হচ্ছে। আরও কিছুদিন যাক, তারপরে দেখবে গল্প না মেপেই বিক্রি করতে হবে।’

    ‘আচ্ছা, আচ্ছা, তা হলে খদ্দের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আসে?’ মুন্নিবাই যেন বাকিটা শুনতে আগ্রহী।

    ‘হ্যাঁ দাঁড়িপাল্লা তো নিয়ে এল, দাঁড়ি সোজা করল, তারপরে একটা গল্পের আদ্ধেকটা ছিঁড়ে নিয়ে পাল্লায় রেখে কাঁটা মিলিয়ে বাটখারা চাপাল, আর অন্য পাল্লায় সাড়ে সাতটা গল্প চাপিয়ে দিল।

    আমি বললাম ওজন করার জন্য তো সাতটা বাটখারা চাপিয়েছো। কিন্তু পাল্লা তো একদিকে ঝুঁকে গেছে, অর্ধেকটা গল্প তো তুমি আগেই নিয়ে নিয়েছো!’

    ‘আগে অর্ধেকটা গল্প নিয়ে আমি কি খেয়ে নিয়েছি? দাঁড়িপাল্লার কাঁটাতো মিলছিল না। আর কীভাবে মেলানো যায়?’ খদ্দের রেগেমেগে জবাব দিল।

    ‘ঠিকই বলেছেন, আমি তাড়াহুড়ো করে বলি। আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি ঠিক বলছেন। কিন্তু গল্পের পাল্লা তো ঝুঁকে আছে?’

    বলবো কি মুন্নি ভাই এই শুনে তো লোকটা ভারি রেগে গেল। অভদ্রভাবে বলল .... এতটা ঝুঁকে আছে যে তোমার জানটাই বোধহয় বেরিয়ে যাচ্ছে তাই না? তুমি কি সোনা ওজন করতে এসেছ? এ গল্পই তো, নাকি আরও দামি কিছু?

    আমাকে একেবারে হতাশ দেখে মুন্নিবাইয়ের বোধহয় খারাপ লাগল, তবু বলল, ‘লোকটার কথাটা হয়ত ঠিক।’ তবে আমার মুখে বিরক্তির ভাব ফুটে উঠতে দেখে সে দুঃখ পেল। ‘সত্যিই আমার কাজটা আপনার কাজের চেয়ে ঢের ভালো।’

    ‘হ্যাঁ মুন্নিবাই, অনেক ভালো। তাই তো মাঝে মাঝে মনে হয় কাগজ-কলম ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তোমারই মত কোনও ধান্দা শুরু করি!’

    মুন্নিবাই আবারও সরলভাবে হেসে ফেলল। তাড়াতাড়ি দুহাতে নিজের মুখটা আড়াল করে বলল, ‘আল্লাহ্‌, অ্যায়সা না কর বৈঠনা জি! বিনা কারণে আমার রুজি-রুটিটা মারবেনই বা কেন?’ আবার হাসতে হাসতে শেষে ক্লান্ত হয়ে যেন কিছু মনে পড়েছে এমন ভাবে বলল, ‘আচ্ছা জি, আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখুন না কেন ?’

    ‘না মুন্নিবাই, তোমাকে নিয়ে তো অনেকেই গল্প লিখেছে। আমি তো তোমার তোতা পাখিটাকে নিয়ে দারুণ একটা গল্প লিখে ফেলতে চাই।’

    ‘লিখো জি, জ়রুর লিখো! আমার তোতাটাকে নিয়েই না হয় লেখো।’ মুন্নিবাই যেন খুব খুশি হল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কী লিখবে?’

    ‘এই লিখব যে পাখিধরা গাড়ি এসে গেল, আর পাখি ধরতে ধরতে বাজারের সব পাখি ধরা হয়ে গেলে রঙিন কাচে ঘেরা গাড়ি-টানা লোক দুটোর বিষাক্ত চাহনি এদিক-ওদিক পাখির খোঁজে ঘুরতে শুরু করল, যদি কোথাও কোনও পাখি চোখে পড়ে। কোথাও কোনও চড়াই, ঘুঘু, বুলবুল, কোনও তিতির, নীলকণ্ঠ, ময়না, কোনও তোতা যদি দেখা যায়। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে সেই চারটি বিষাক্ত দৃষ্টি এসে পড়ল তোমার তোতাটার ওপর, আর পড়তেই যেন দুই শিকারি জেগে উঠল। তখন লম্বা বাঁশধারী লোকটা এগিয়ে এসে আঠা লাগানো বাঁশের ডগাটা তোতার বাঁকাঁধে ছোঁয়াতেই পাখি ফরফর করে পাখা নাড়ালো, তারপরে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ওড়ার চেষ্টা করল। এত বছরের দাঁড়টাকে তখন আর নিরাপদ মনে না হওয়ায় সে ব্যালকনির রেলিংয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু দাঁড়াতে না পেরে নিচে গিয়ে পড়ল, ঠিক সেইখানে যেখানে হাতে বাঁশ নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। সে ঝাঁপ দিয়ে তোতা পাখিটাকে ধরার চেষ্টা করতেই তোতা জোরে আওয়াজ করে ডানা দুটো ফরফর করে উড়তে চাইল। আর কে জানে কোন্ শক্তিতে এত বছরের অনভ্যাসের পরেও সে ওড়ার ক্ষমতা ফিরে পেল। তবে একটু ওপরে উড়েই আবার মাটিতে গিয়ে পড়ল।

    যে লোকটার কোমরের সঙ্গে গাড়িটা দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল সে তার সঙ্গীর দিকে চেয়ে যেন স্বস্তির হাসি হাসল। উত্তরে সঙ্গী একবার তার দিকে আবার মাটিতে পড়ে থাকা পাখিটার দিকে দেখল। তারপরে সেও সঙ্গীর দিকে চেয়ে হেসে এগিয়ে গিয়ে তোতা পাখিটাকে ওঠানোর জন্য ঝুঁকল।

    কিন্তু তোতা তার হাতে ধরা দেবার বদলে লাফিয়ে উঠে লোকটার কান কামড়ে ধরে বেশ কিছুটা মাংস নিল খুবলে। লোকটা ব্যথায় চিৎকার করে উঠতেই তার সঙ্গী লাফিয়ে পাখিটাকে ধরার চেষ্টা করল। পাখির নজর তখন দু নম্বর লোকটার ওপর পড়েছে। তার ছোট ছোট চোখ দুটো রক্তবর্ণ। সে তার পুরো শক্তি দিয়ে অন্য লোকটার দিকে উড়ে গিয়ে তার মুখটাকে আঁচড়ে কামড়ে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। লোকটা চিৎকার করে উঠে তাড়াতাড়ি দুটো হাত দিয়ে তোতা পাখিটাকে সরিয়ে সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল।

    লোকদুটো তখন আশ্চর্য হয়ে দাঁড়িয়ে তোতা পাখিটাকে দেখছে আর তোতা ধীরে ধীরে হেঁটে একবার প্রথম জনের দিকে আবার দুলকিচালে দ্বিতীয় লোকটার দিকে যাচ্ছে, আর দুজনকে রক্তচক্ষুর নজর দিয়ে দেখছে।

    ‘আর এই সুযোগে......’ মুন্নিবাই সুযোগ পেয়ে গল্পের খেই ধরে নিল যেন... ‘আমি আমার তোতা পাখির কাছে ছুটে গেলাম, নিজের চাদরটা তার ওপর ছুঁড়ে দিলাম, আর তাকে ধরে গাড়িওলাদের হাতেই তুলে দিলাম। আর তাদের কাছ থেকে অনেক অনেক........ আচ্ছা বলুন তো যদি অনেক পয়সাই মেলে তা হলে আমি কি আমার তোতা পাখিটাকে এইসব করতে দেব?’

    মুন্নিবাই আমার দিকে ঘৃণায় চেয়ে দেখে মাটিতে থুক করে থুথু ফেলল। ‘এইসব গল্পই কি লেখা হয় নাকি?’

    জবাবে আমি একবার মুন্নিবাই, আবার তার তোতার দিকে চাই। পাখিটা দাঁড়ের ওপর একবার এদিক আবার ওদিক যাচ্ছে।

    শেষমেশ অবশ্য সেই গাড়িওলারা মুন্নিবাইয়ের কাছ থেকে নবীজির কাছে ‘রুজি ভেজো’ মিনতি পাঠানো তোতাপাখিটাকেও নিয়ে গেল। আর ধীরে ধীরে শহরটা পক্ষীশূন্য হয়ে পড়ল। কোথাও কোনও পাখি, কোনও চড়াই, কোনও বুলবুল, ময়না, টিয়া, কোনও মোরগ, বনকপোত, বা ঘুঘু আর চোখে পড়ে না।

    গোধূলিবেলায় কুলায় ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির আর শোনা যায় না। নীল আকাশের গায়ে দুধ-সাদা বকপাঁতি আর চোখে পড়ে না, সারস আর ওড়ে না, এমনকী নিঝুম দুপুরে চিলের দরদী ডাকও আর শোনা যায় না। পায়রার বকম বকম, পাপিয়ার পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা, ময়নার টুঁই টুঁই কানে আসে না। এমনকী মৌলবি সাহেবের মোরগটাও তার কোঁকর-কোঁ ডাক ভুলে গেছে।

    তবু বাজার এলাকা আগের মতই কর্মচঞ্চল -- কেনাবেচা জোর কদমে চলেছে। চিৎকার চেঁচামেচি, এক্কা গাড়ির চাকার খটখট, টমটমের ঘোড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টার আওয়াজ, বড় বড় গাড়ির সড়কের ওপর দিয়ে উড়ে চলা, মানুষের যাওয়া আসা চলছে। কারবারের কোনও কমতি নেই, বাজারের দোকানগুলোতে খদ্দেরের ভিড় তেমনই আছে। আর দোকানিরাও সওদার প্রতি তেমনই মনোযোগী। হৈচৈ, দৌড়ঝাঁপে কোনও ভাটা পড়েনি।

    আগের মতই দিন ঢলে আসে, রাত নামে – বড়-ছোট, সৎ-অসৎ, ব্যস্ত-অলস সকলের চোখেই ঘুম আসে। শান্তির চাদর যেন বিছানো থাকে। আবার সেই রাতও কখনও শেষ হয়ে ভোর হয়, জগৎ আবার জেগে ওঠে।

    ইদানীং পাখিধরা গাড়িটা কম আসে। কখনও দু-চার দিন, আট-দশ দিন বা হয়ত পনেরো-কুড়ি দিন বাদে তাকে দেখা যায়। রঙিন কাঁচের ঘরে এক-আধটা পাখি অবাক বিস্ময়ে বাজারে মানুষের দিকে চেয়ে থাকে। গাড়ি টানা লোক দুটোর তীক্ষ্ণ নজর থাকে আশপাশে। পাখির সন্ধান তারা করতে থাকে। পাখি ধরা শেষ হলে শ্লথ পায়ে বিদায় নেয়। কখনও দু-একটা পাখি পেয়ে যায়, কখনও বা কিছুই মেলে না। কেউ ঘুরে আর তাদের দেখেও না। এমনই একদিন রোদের খুব তেজ ছিল, গরমের হলকা বইছিল, ধুলো উড়ছিল আকাশে, শরীর ঘেমে উঠছিল, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে হাপরের মত গরম হাওয়া বেরোচ্ছিল। এই সময় হঠাৎ পাখিধরা গাড়িটা এসে গেল।

    গাড়ি এসে গেছে.........পাখিধরা গাড়ি এসেছে.......

    গাড়িটা এসে ঠিক চকের সামনে খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ল। রঙিন কাঁচের বাক্সের মধ্যে একটাই মাত্র পাখি ভীরু পায়ে এদিক ওদিক টহল দিচ্ছে। পাখিটার সাদা লেজটা ময়ূরের পেখমের মত। চোখ দুটো উদাসীন। গাড়িটা সবে এসে দাঁড়িয়েছে এমন সময় দৌড়োতে দৌড়োতে সেই বছর দশকের ছেলেটা সেখানে হাজির হল। সে প্রথমে গাড়ির লোক দুটোকে, তারপর কাচের মধ্যে থাকা পাখিটাকে ঠাহর করে দেখল, আর বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে কাচের খাঁচাটার ছোট্ট দরজাটা খুলে দিল!

    তবে ততোধিক ক্ষিপ্রতায় বাঁশ হাতে লোকটা ছেলেটার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল। তারপরেই পকেট থেকে অনেক সিকি পয়সা বার করে সামনে ছোঁড়া শুরু করল। ছেলেটা কিন্তু পয়সাগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না। বাঁশ ধরা লোকটা ছেলেটার হাতটা পাকড়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে আবার পয়সা ছুঁড়ে দিল, কিন্তু এবারও বালক পয়সার দিকে নজরই দিল না। এই ফাঁকে গাড়িটা দ্রুত চলতে শুরু করল, পেছন পেছন হাতে বাঁশ ধরা লোকটাও বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। গাড়িওলারা জোরে পা ফেলে চলায় গাড়ির গতি যেন আরওই বেড়ে গেল। তারা যেন এবার ছুটতে শুরু করেছে।

    ছেলেটা বেশ একটু সময় চুপচাপ অবাক হয়ে উদাস চোখে গাড়িটার দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু, তারপরেই কে জানে কোন্‌ জাদুমন্ত্রে তার পায়ে যেন বিদ্যুতের শক্তি খেলে গেল! সে পালাতে থাকা গাড়িটাকে আরেকবার দেখে নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করল। গাড়ির পাশে পৌঁছে কাচের ঘরে জোরে একটা ঘুসি মারতে যাবে, হাতে বাঁশের লাঠি ধরা লোকটা তার হাত বাড়িয়ে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ছেলেটাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

    সেই ধাক্কায় বালক একটা বলের মত সড়কের ওপর গড়িয়ে গেল, মাথা আর হাঁটুতে লাগল বেদম চোট। চোখে অন্ধকার দেখে রাস্তার ওপরেই অনেকক্ষণ সে গড়াতে থাকল। তারপরে চোখের ওপর থেকে অন্ধকার পর্দাটা সরে গেলে দূরে তাকাতে দেখল পাখিধরা গাড়িটা দ্রুত বেগে ঢাল বেয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, গাড়ির পেছনটা ধুলোর আবরণে অস্পষ্টপ্রায়।

    ওঠার চেষ্টা করলেও সে উঠে দাঁড়াতে পারল না, হাঁটুর চোটের জন্য আবার টলমল করতে করতে রাস্তায় শুয়ে পড়ল। পাখিধরা গাড়ি তখন দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেছে, গাড়িতে লাগানো ছোট ছোট ঘণ্টিগুলোর আওয়াজও বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

    অনেক দেরি হয়ে গেল.......অনেকই দেরি .......

    দীর্ঘক্ষণ পরে শেষমেশ ছেলেটা রাস্তায় উঠে দাঁড়াল, রক্তাক্ত হাঁটু দুটোর দিকে এক নজর তাকিয়ে জামা কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে, জামার আস্তিন দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ধীর পায়ে হেঁটে সে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

    ‘ভাইজান লক্কা পায়রাটাকেও নিয়ে চলে গেল।’ কথাটা এমন ভাবে বলল যেন নিজেই নিজেকে খবরটা দিচ্ছে।

    আমি উদাস স্বরে বললাম, ‘হাঁ মিয়াঁ, লক্কাটাও চলে গেল।’

    বালক আরও কিছুক্ষণ রাস্তার দিকে চেয়ে রইল। তার নজর সেই ঢালের দিকে। সেখানে তখন আর গাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। সে তার নিকারের ফোলা পকেটটার ওপর হাত বুলিয়ে একটা দেশলাইয়ের বাক্স বার করল।

    ‘ভাইজান.... এই .... এই প্রজাপতিটাকেও নিয়ে যাবে, তাই না?’

    আমি নির্বাক।

    ‘প্রজাপতিগুলোও চলে গেলে শহরে আর কীই বা পড়ে থাকবে?’

    আমি চুপ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধুলোমাখা মুখটায় চোখের জলে আঁকা হয়েছে উদাস গম্ভীর কোনও ছবি। ছেলেটা একবার কেঁপে উঠে সামনের বড় বাড়িটার দিকে ইশারা করল....

    ‘ভাইজান......ভাইজান.....ওই দেখুন......’

    সামনের সে বাড়ির দরজার ওপর পাথরের তৈরি একটা পাখি মাথা ঝুঁকিয়ে বসে। দশ বছরের সেই সরল বালক আর আমার দৃষ্টি তখন পাথরের পাখিটার ওপর থেকে যেন সরতে চাইছে না।



    অলংকরণ (Artwork) : অনুবাদক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments