মোটর সাইকেলের পেছনের সীট থেকে নেমে, হাফ প্যান্টের পকেটের ওপর হাত রেখেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ ক’রে উঠলো। ফোন কোথায়? পকেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভালো করে দেখলাম। বাঁ দিকের পকেট, ডান দিকের পকেট, সামনের পকেট, পেছনের পকেট। কোথাও নেই। আমার সাধের আই-ফোন লোপাট হয়েছে।
“বিভোর, আমার ফোন নেই!”
বিভোর বুঝলো না। “ফোন নেই মানে?”
বিভোর-এর কাছে বেড়াতে এসেছি দশ দিনের জন্য। আজ শনিবার। কাল বাড়ি ফিরবো।
জায়গাটার নাম ভোর। বিভোর মারাঠি, কিন্তু এখানকার নয়। এখানে একটা ছোট বাড়ি ভাড়া করে থাকে মাস ছয়েক হল। মহারাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটা ছোট্ট জায়গা। বাস যাবার পাকা রাস্তা আছে, ইলেক্ট্রিসিটি আছে, কলে জল আছে। তবু গ্রাম মনে হয়। একটাও হোটেল নেই। রেস্তোরাঁ বলতে একটা ধাবা-জাতীয় দোকান। সিনেমা থিয়েটারের তো প্রশ্নই ওঠে না। যত্র তত্র গাধা আর গরু ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোজকার বাজারটা দেখে হাট মনে হয়।
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “মানে ফোনটা নেই। পকেটে নিয়ে বেরিয়ে ছিলাম। কোথাও পড়ে গেছে।”
“তুমি ঠিক ফোন নিয়ে গেছিলে? ওপরে নেই তো?”
একটা ছোট আশা ঝিলিক মেরে উঠলো বুকের মধ্যে। ফোনটা কি দোতলার ফ্ল্যাটে আছে? সেটা সম্ভব। কিন্তু মন বলছে – না। আচ্ছা, একবার খুঁজে দেখি!
তাড়াতাড়ি করে দু’জনে দোতলায় উঠে এলাম। বসার ঘর। শোবার ঘর। বারান্দা। না, কোথাও ফোন নেই।
“তার মানে মোটর সাইকেলে যেতে যেতে তোমার পকেট থেকে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই।”
“টেরও পেলাম না?!”
আমরা বেরিয়েছিলাম মোটরসাইকেলে তেল ভরতে। গেছিলাম শুধু পেট্রোল পাম্পে। আর কোথাও যাইনি।
বিভোর বললো, “চলো। আবার পেট্রোল পাম্পে যাই। হয়তো পথে কোথাও পড়ে গেছে। হয়তো পেয়ে যাবো।”
আমার বুকের মধ্যে একটা হাহাকার শুরু হয়েছে। বললাম, “এবার হেঁটে হেঁটে চল্। তাহলে ভালো করে দেখতে পাবো।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছোট রাস্তা দিয়ে খানিকটা গিয়ে, কয়েকবার ডান দিক বাঁ-দিক করে, তিন মিনিটে বড় রাস্তা। সাবধানে মাটির দিকে তাকিয়ে চলতে থাকলাম। ঠিক যে পথ দিয়ে একটু আগে মোটরসাইকেলে গেছি। রাস্তার ধার দেখছি, যেখানে নর্দমা সেখানে তাকাচ্ছি, যেখানে ফুটপাথ সেখানে তাকাচ্ছি। বড় রাস্তায় পৌঁছোনো অবধি কিছুই পেলাম না।
এই রাস্তায় বাস গাড়ি চলে। সবই দূরপাল্লার। চওড়া রাস্তা। ধারে অনেকটা প্রশস্ত না-বাঁধানো জায়গা। সেখানে ঘাস। খাবারের ছেঁড়া প্যাকেট, প্লাস্টিক বোতল, ইত্যাদি আবর্জনা। একটু পরেই একটা পুলিশ-স্টেশন পেরোলাম। হাঁটতে থাকলাম পেট্রোল পাম্পের উদ্দেশে। দু’জনের চোখই মাটির দিকে। ওতপ্রোতভাবে দেখতে দেখতে চলেছি। কেউ কোনো কথা বলছি না। আমার বুকের মধ্যে একটা আঁট বেঁধে আছে।
হঠাৎ মনে হল একটা ফোন করলে হয় না? হয়তো কেউ পেয়েছে। বিভোরকে বললাম।
ও নিজের ফোন থেকে ডায়াল করলো।
“বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না।”
হাঁটতে থাকলাম। মাটির দিকে স্থির দৃষ্টি। খানিক পর বিভোর আবার ফোনে চেষ্টা করলো। সেই একই ব্যাপার। বেজে যাচ্ছে।
আরো খানিকক্ষণ পর পেট্রোল পাম্পে পৌঁছে গেলাম। এখানে প্রথমবার এসে পাম্পিং মেশিনের পাশে বিভোর যখন মোটরসাইকেল থামিয়ে ছিল, ওর সাথে আমিও নেমে ছিলাম। তখন ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, কোথাও যাইনি। এখন আমরা দু’জনে আশপাশ দেখলাম।
পাম্পের লোকটা জিজ্ঞেস করলো কী ব্যাপার।
“পকেট থেকে ফোন পড়ে গেছে। কিছু দেখেছেন? কোনো ফোন পাওয়া গেছে?”
লোকটা বললো, “না।”
হতাশা বাড়ছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে, ইতস্তত করে, কী করবো বুঝতে না পেরে, আমি বললাম, “চল্! আবার বাড়ির দিকে যাই। আরেকবার দেখি।”
সেই এক পথে ফেরা। এক রাস্তা। এক আবর্জনা। এক ঘাস। আর ফোন করলে সেই এক রিং করে যাওয়ার শব্দ। পুলিশ স্টেশন পেরিয়ে গিয়ে ছোট রাস্তায় ঢুকলাম। তারপর বাড়ি ফিরবার গলিতে।
যতক্ষণে বাড়ি পৌঁছলাম আমি সব আশা হারিয়ে ফেলেছি। কী হবে চিন্তা করতে করতে শোকে ক্লান্ত হয়ে গেছি।
আজ শনিবার। কাল আমার বাড়ি ফেরার দিন। বাসে করে পুনে অবধি গিয়ে প্লেন ধরার কথা। ফোনে আমার সর্বস্ব! কয়েক শ’ ফোন নাম্বার, যার একটাও আমার মুখস্থ নেই। কয়েক হাজার ছবি, গান, ভিডিও, দরকারি ডকুমেন্ট। খাবার অর্ডার করার অ্যাপ, ট্যাক্সি ডাকার অ্যাপ, ব্যাঙ্কের অ্যাপ।
কাল রবিবার। সব দোকান বন্ধ। ভোরবেলা পুনে গিয়ে যে নতুন ফোন কিনবো, তাও সম্ভব নয়। দোকান বন্ধ থাকবে। আর সম্ভব হলেও বা কিনবো কী করে? পকেটে টাকা নেই। ইউপিআই করবো? জি-পে, ফোন-পে কিছুই হবে না ফোন ছাড়া। ডেবিট কার্ড সাথে নেই। একমাত্র ভরসা ক্রেডিট কার্ড।
দোতলায় উঠে আমি সটান বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কান্না পাচ্ছে।
ছোটবেলায় রূপকথায় পড়েছিলাম কোনো এক দৈত্যের প্রাণ রাখা থাকতো অন্য কারু কাছে, একটা বাক্সের মধ্যে। আমার প্রাণটা যে কবে আমার ফোনে ধরা পড়েছে এর আগে এই ভাবে টের পাইনি।
এই তো ক’দিন আগেই শ্রী যোশীর সাথে কথা হচ্ছিল মোবাইল ফোন সম্বন্ধে। সেদিন আমি বাসে করে পুনে থেকে ভোর-এ আসছিলাম। সেই বাসেই যোশীর সাথে আলাপ।
উনি বলছিলেন, “আমার ছোটবেলায় ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। আমরা দোতলায়, বাড়িওয়ালা একতলায়। সারা বাড়িতে একটাই ফোন ছিল। সেটা একতলায়, বাড়িওয়ালার কাছে। খুব এমার্জেন্সি হলে ফোন আসতো। বাড়িওয়ালা সাক্সেনা সাহেব সিঁড়ির নীচ থেকে চিৎকার করে ডাকতেন। কোনোদিনও আমরা ফোন করেছি বলে মনে পড়ে না। আর এখন সবার পকেটে ফোন। ভাবতে পারেন? ভারতবর্ষে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের মোবাইল আছে এখন।”
শ্রী যোশী সাংবাদিক। মধ্যবয়স্ক, সুন্দর স্বাস্থ্য, উজ্জল দু’জোড়া চোখ, মাথায় একরাশ কাঁচা-পাকা চুল। পরনে সাধারণ খদ্দরের হাফ শার্ট আর ফুল প্যান্ট। সুশিক্ষিত। কথা বলেন সব বাহুল্য বর্জন করে, যথাযথ শব্দ ব্যবহার করে। অনেক বছর কাটিয়েছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন দরিদ্র জায়গায়। গরীব মানুষদের নানান কষ্ট ও সমস্যা নিয়ে লেখালেখি করেন। পুনে গিয়েছিলেন কাজে, কোনো সরকারি অফিসে।
আমি বললাম, “হ্যাঁ সত্যিই। সবারই এখন ফোন।”
“না। ঠিক সবার না।”
বাসের সামনের একটা সীটে ওনার সঙ্গী বসে ছিল। যোশী ইঙ্গিতে দেখালেন। একটা বুড়ো লোক, কুচকুচে কালো।
যোশী বললেন, “ওই যে লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন, ওর নাম বিভূতি। ওর ফোন নেই।”
“ওঃ।”
“ওকে নিয়ে গেছিলাম আদিবাসী মন্ত্রক বিভাগে। এখন ওকে ফিরিয়ে দিতে চলেছি ওর বাড়িতে।”
“আদিবাসী মন্ত্রকে কি কাজ ছিল?”
“জানতে চান? তাহলে একটা গল্প শুনতে হবে।”
আমি বললাম, “মন্দ কী? বাস ভোর-এ পৌঁছতে দেরি আছে। হাতে অনেক সময়।”
“বেশ।” যোশী কয়েক মিনিট নিঃশব্দে চিন্তা করলেন। তারপর শুরু করলেন।
“বিভূতির বয়স কত কেউ জানে না। বিভূতিও না। ও হল ওড়িশার গড়াবা প্রজাতির লোক। আদিবাসী। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ওকে সপরিবারে ওর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল একটা বর্ষার রাত। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, অন্ধকারে, বৃষ্টির মধ্যে, বউ আর পাঁচটা ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে ও পালিয়েছিল। সবার মাথায় ছিল বাড়ির জিনিসপত্র আর জামাকাপড়।”
“কেন? তাড়ালো কে?”
“তাড়ালো কে?” মুচকি হাসলেন যোশী। “সরকার, মশাই! সরকার। ভারতবর্ষের বিমানবাহিনী। বিভূতিরা থাকতো চিকাপুর নামে একটা গ্রামে। মীগ (MiG) জেট প্লেন বানানোর প্রোজেক্টের জন্য হিন্দুস্তান এয়ারোনটিক্স্ লিমিটেড সেই গ্রাম অধিগ্রহণ করে। তাই এক ঘোর বর্ষার রাতে বিভূতির উৎখাত হয়েছিল।”
“ওদের আগাম নোটিস দেয়নি? ক্ষতিপূরণ?”
“সেই প্রথম উৎখাতের আগে নোটিস দিয়েছিল কিনা সঠিক জানি না – তারপর তিরিশ বছর কেটে গেছে। তবে গ্রামের প্রায় পাঁচশ পরিবারের বেশিরভাগই কেউ কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।”
“প্রথম? আপনি প্রথম উৎখাত বললেন?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। চিকাপুর হল আমার জানা পৃথিবীর একমাত্র গ্রাম যেখানকার মানুষদের তিনবার বাস্তুহারা হতে হয়েছে। আর তিনবারই ‘উন্নয়ন’-এর নামে।”
“বলেন কী!”
“হ্যাঁ,” বললেন যোশী। “চিকাপুরের মানুষরা কিন্তু অতিরিক্ত গরীব ছিল না। বেশিরভাগই ছিল গড়াবা আর পরোজা আদিবাসী প্রজাতির, কিছু ডোম বা দলিত্, আর বাকিরা হল যাকে সরকার বলে ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণী’। তাদের অল্প কিছু জমিজমা ছিল। এবং উৎখাত করে যেখানে তাদের পাঠানো হয়েছিল, সেই জমিও ছিল তাদেরই। সরকার যে জমি ওদের খেকে কেড়ে নিয়েছিল তার জন্য কেউ কেউ যৎসামান্য টাকা পেয়েছিল, তাও অনেক বছর পর। বেশিরভাগ মানুষ কিছুই পায়নি।”
ফোন হারানোর ভয়ানক দুঃখ থেকে কী করে যে আমি মনে মনে যোশীর সাথে কথোপকথনে ফিরে গিয়েছিলাম, জানি না। হঠাৎ বিভোর কিছু একটা বললো আমায়। সংবিৎ ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী?”
বিভোর বললো, “ফাইন্ড মাই ফোন চেষ্টা করলে হয় না?”
তাই তো! আমার মাথাতেই আসেনি!
তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলাম। ম্যাকবুক কম্পিউটারটা টেনে নিয়ে খুললাম।
বললাম, “মনে নেই ‘ফাইন্ড মাই ফোন’-টা এনেব্ল করা আছে কিনা…”
ফোনের সেটিংসে কোথাও একটা কোনো একটা বাট্ন টিপতে হয় বা বাক্সোয় চেক-চিহ্ন রাখতে হয়। তাহলেই ‘ফাইন্ড মাই ফোন’ কাজ করে। সেটা করা ছিল কিনা ছাই মনে নেই। কার মনে থাকে? কয়েক মাস আগে দোকানে দিয়েছিলাম ব্যাটারি পালটাতে। ওরা সেটিংস কিছু বদলেছে কিনা ভগবান জানে।
দুরু দুরু বক্ষে ম্যাকবুক ল্যাপটপে অনেক খুঁজে-টুঁজে, পনেরো মিনিট পর, অবশেষে একটা ম্যাপ খুললো। তাতে দেখাচ্ছে যে ভোর-এর কাছাকাছিই কোনো একটা রাস্তা দিয়ে আমার ফোনটা যাচ্ছে!
আমি স্তম্ভিত হয়ে বিরাট একটা হাঁ ক’রে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বিভোরও উত্তেজিত। ও আবার আমার ফোন নাম্বারে কল করলো। আবার বেজে গেল, কেউ তুললো না।
আমরা দু’জনে ল্যাপটপের স্ক্রীনে দেখতে থাকলাম যে ফোনটা – মানে যে গাড়ি বা মোটরসাইকেল-এ ফোনটা রয়েছে, সেটা – রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ভোর থেকে বেশি দূরে নেই। খানিক পর ফোনটা এক জায়গায় থামলো। থেমেই রইল অনেকক্ষণ। আমি দেখলাম ম্যাপে একটা স্যাটেলাইট ভিউ-ও আছে। সেখানে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ফোটোগ্রাফে সবুজ মাঠ, কালচে গাছ ইত্যাদি দেখা যায়। দেখলাম ফোনটা দাঁড়িয়ে আছে একটা নীল-সবুজ চালার পাশে। যে রকম টিনের ছাদ-ওয়ালা ঘর হয় গ্রামে গঞ্জে, সে রকমই কোনো ঘর হয়তো। রাস্তার ঠিক গা’য়। ফোনটা ওখানে কী করছে?
খানিক পর ফোনটা আবার চলতে শুরু করলো। চলছে। চলছে। তারপর এক জায়গায় বাঁ-দিকের একটা রাস্তায় বাঁক নিল। আগের রাস্তাটা মোটামুটি সোজা ছিলো। নতুন রাস্তাটা ঘোরানো। আগে যেমন ফোনটা আস্তে আস্তে ভোর থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল, এখন বোধহয় তা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন ভোর-এর থেকে দূরত্ব তেমন বাড়ছে না, বা একই থাকছে। ভোর-এর পরিপ্রেক্ষিতে একটা বৃত্তাকার পথ।
আবার একটা জায়গায় ফোনটা থামলো। আবার চললো। বিভোর আর ফোনে ডায়াল করছে না। আমরা অসহায় ও উদগ্রীব দুই দর্শক। আমার সমস্ত শরীর লোহার মত শক্ত। পেশীগুলো সব টানটান।
সামনে একটা মোড়। যদি বাঁ-দিকে যায়, তাহলে ফোনটা ভোর-এর দিকে ফিরে আসবে। তখন কী করবো অবশ্য জানি না। আর যদি ডান দিকে যায়, তাহলে ফোনটা ভোর ছেড়ে দূরে চলে যাবে। হয়তো কোনো দিন আর ফিরবে না।
আমরা তাকিয়ে রয়েছি স্ক্রীনের দিকে। ঘরে টানটান উত্তেজনা। মোড়ে এসে গেছে। গতি খুব আস্তে হয়ে গেল। হয়তো থেমেই গেল দু’এক মুহূর্তের জন্য। তারপর ঘুরলো।
ডান দিকে।
আমি আবার শুয়ে পড়লাম।
বড় কষ্ট! ফোনটা আর কোনোদিনও পাবো না।
বিভোর তখনও দাঁড়িয়ে ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করলাম শরীরে আর শক্তি নেই। টানটান ভাবটা কেটে গিয়ে যেন সমস্ত শরীর ছেড়ে দিয়েছে। সব পেশী শিথিল। কী করবো জানি না। কিছু করার নেই। কোনো উপায় নেই। অন্ধকার, সব অন্ধকার। নিস্তেজ, মৃতপ্রায় পড়ে রইলাম বিছানায়।
মাথার ভেতরে চিন্তাগুলো সব মিলিয়ে গিয়ে চারিদিক ফাঁকা হয়ে গেল কয়েক মিনিটে। একা। আমি একা। কেন এত একা লাগছে?
জীবনে কখনো এরকম হয়নি। এই প্রথম ফোন হারালাম। শেষ কবে দরকারি কিছু হারিয়েছি?
আর এ তো শুধু হারানো নয়। ফিরে পাবার আশাও নেই। এটা হচ্ছে সেই চরম হারানো, যেখানে পুনরুদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিশ্চয়ই পকেট থেকে পড়ে গিয়ে ছিল। কেউ কুড়িয়ে পেয়েছে। কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ!
নতুন ফোন কিনতে হবে। কত ফোন নাম্বার, কত ছবি, কত অ্যাপ, কত ডকুমেন্ট - সব জোগাড় করতে হবে!
শক্তি আমার রইল না আর কিছু!
নতুন ফোন লাগবে। নতুন।
শ্রী যোশী বলেছিলেন যে চিকাপুর থেকে বিভূতিদের যখন তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওরা যে নতুন জায়গায় নতুন করে বসতি বানিয়েছিল, সেই জায়গার নামও ওরা চিকাপুর-ই রেখে ছিল। নতুন এক চিকাপুর।
আমি বলেছিলাম, “সেখান থেকেও ওদের উৎখাত হয়েছিল?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। সে আজ থেকে এগারো বছর আগে। সেই বারও রাত্তির বেলা। সেই বারও বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য বিভূতি সপরিবারে সেই বার একটা ব্রিজের তলায় কয়েকটা রাত কাটাতে বাধ্য হয়।”
“সেই বার উৎখাতের কারণ কী ছিল?”
“একটা সেচ ও বিদ্যুৎ প্রকল্প। এবং ভারতীয় নৌবিভাগের গোলাবারুদ ডিপো।”
“সে বারেও কি আগাম নোটিস আর ক্ষতিপূরণ-এর একই গল্প?”
শ্রী যোশী সম্মতি জানিয়ে হেসেছিলেন। “সরকারের নৌবিভাগ থেকে চাকরি দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তাদের ইন্টারভিউয়ের ডাক পড়েছিল কোথায় জানেন?”
“কোথায়?”
“বিশাখাপত্তনমে। ওদের অতদূর যাওয়ার সামর্থ্য ছিলো না।”
“আশ্চর্য।”
“আর কয়েকটা ইন্টারভিউ হয়েছিল চিকাপুরেই – মানে তৃতীয় চিকাপুরে। সেই চাকরিগুলো ওরা পায়নি - পেয়েছিল বাইরে থেকে আসা অন্য লোকেরা।”
তারপর যোশী আরো বলেছিলেন, “দু’একটা পরিবার দ্বিতীয় চিকাপুর ছাড়েইনি। তাদের জমি ছিল উঁচুতে, সেখানে বাঁধের জল যাওয়ার আশঙ্কা কম। বাকি পরিবারগুলো চলে যাবার পর, তারা একা প’ড়ে গিয়েছিল। তারপর ডাকাতের হামলা।”
“আসছে! আসছে!”
হঠাৎ বিভোরের কথা শুনে চমকে উঠে বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কে আসছে?”
বিভোরের দৃষ্টি তখনো সটান ল্যাপটপের স্ক্রীনে। তাকিয়ে দেখি, স্যাটেলাইট ভিউতে দেখা যাচ্ছে, ফোনটা এবার একটা রাস্তা দিয়ে ভোর-এর দিকে আসছে। ফোনটা ফিরে আসছে।
ভোর থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল ফোনটা। এখন আস্তে আস্তে দূরত্ব কমছে। কয়েক মিনিট পরে বুঝতে পারলাম কোন্ রাস্তা দিয়ে আসছে। চিনতে পারলাম। এটা সেই বড় রাস্তাটা যার উপর পুলিশ স্টেশন, যার উপর পেট্রল পাম্প।
বিভোর বললো, “চলো, পুলিশ স্টেশন চলো।”
আমি বললাম, “সেখানে কী হবে?”
“ওদের এই ‘ফাইন্ড মাই ফোন’-এর ম্যাপটা দেখাবো। বোঝাই যাচ্ছে কেউ ফোন চুরি করেছে। পুলিশের সাহায্য লাগবে।”
“কিন্তু এখানে বাড়ির মধ্যে ওয়াইফাই আছে। বাড়ি থেকে বেরোলে তো ল্যাপটপে ‘ফাইন্ড্ মাই ফোন’ কাজ করবে না।”
“কেন কাজ করবে না? আমার ফোনে হট স্পট অন্ করছি। তাই দিয়ে ল্যাপটপ কানেক্ট করবো।”
আবার দু’জনে বেরোলাম। এবারও পায়ে হেঁটে। আমাদের দু’জনের পরনেই হাফ প্যান্ট আর হাফ শার্ট। পায়ে চটি। বিভোরের হাতে ধরা আছে খোলা ল্যাপটপ। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমার হারানো ফোন ধীর কিন্তু স্থির গতিতে ভোর-এর দিকে আসছে।
রাস্তায় দুয়েক জন লোক অবাক হয়ে তাকাচ্ছে খোলা ল্যাপটপের দিকে। কী ভাবছে কে জানে। আমাদের সে বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
চটপট হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে পুলিশ স্টেশন পৌঁছলাম। একজন মহিলা অফিসার বসে রয়েছেন। বয়স তিরিশের কোঠায়। ঝকঝকে চেহারা। পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম – ইস্তিরি করা পরিষ্কার খাকি শার্ট-প্যান্ট, চামড়ার বেল্ট, কোমরে পিস্তল, মাথায় টুপি। পেছনে, টুপির নিচ থেকে, ছোট বেণী ঝুলছে। বিভোর তাঁকে মারাঠি ভাষায় ব্যাপারটা বোঝালো। আমরা ল্যাপটপে স্যাটেলাইট ভিউ দেখালাম, ম্যাপ দেখালাম। ভদ্রমহিলা চটপট বুঝে ফেললেন। এবং এই আধুনিক প্রযুক্তির অভিনবতায় মনে হল চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আমাদের নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তার কাছে এলেন।
বললেন, “মনে তো হচ্ছে এই রাস্তাতেই আসছে। যদি তাই হয়, তাহলে আমরা সব গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি নিতে পারি। কিন্তু যদি কোথাও বাঁক নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়, তাহলে আমি কিছু করতে পারবো না। আমাদের এই মুহূর্তে বেশি লোকবল নেই।”
আমার মনের মধ্যে তখন নিরাশার থেকে আশার ভাগ অনেকটাই বেশি। আমরা তিনজন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ল্যাপটপ দেখতে থাকলাম। দু’একটা কনস্টেবল সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তাদের কৌতূহল সংবরণ করে থাকলো।
হঠাৎ দেখি — নাঃ নাঃ, এ হতে পারে না!
ফোনটা বাঁক নিয়ে অন্য দিকে চলেছে। এদিকে আসবে না।
আধ মিনিট পর পুলিশ অফিসার বললেন, “এইখান দিয়ে আসবে না। সরি, আমার কিছু করার নেই।”
বিভোর আর আমি চুপ করে রইলাম। কী বলবো? আমার মনের মধ্যে আশার থেকে নিরাশার ভাগ বেশি। আবার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। অসহায় ভাবে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছি।
বিভোর জিজ্ঞেস করলো, “কোন্ দিকে যাচ্ছে ফোনটা?”
আমি জানি না। আমার জানার কোনো উপায় নেই। আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
দু’মিনিট পরে অফিসার বললেন, “ওটা বাস ডিপোর দিকে যাচ্ছে।”
একদিকে আঙুল তুলে বিভোর বললো, “ওই দিকে?”
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলো, “হ্যাঁ, মার্কেটের অন্য দিকে, যেখানে পুনের বাস থেকে তুমি নেমেছিলে।”
অফিসার বললেন, “আপনারা চটপট বাস ডিপো চলে যান। সময় আছে। ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যাবেন। সরি, আমি আর কোনো সাহায্য করতে পারবো না।”
আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে ডিপোর উদ্দেশে রওনা হলাম।
আবার হন্তদন্ত হয়ে হাঁটছি। এবার আমার হাতে খোলা ল্যাপটপ। বিস্মিত পথিক দর্শকদের উপেক্ষা করে ভোর-এর রাস্তা-গলি দিয়ে এগিয়ে চলেছি। হাঁটতে হাঁটতেই বিভোর আবার আমার ফোন নাম্বার ডায়াল করলো।
এইবার কেউ একটা ফোনটা ধরলো। বিভোর দাঁড়িয়ে পড়লো। আমিও।
কিন্তু যে-ই ফোন ধরে থাকুক না কেন, কোনো কথা না বলেই লাইন কেটে দিলো।
বিভোর বললো, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। আমি কোথাও পড়েছিলাম যে হারানো ফোন-এ মেসেজ পাঠানো যায়। যদি না ফোনটা অফ্ করা থাকে। আমরা এখন জানি যে ফোনটা অন্ আছে।”
আমি বললাম, “কিন্তু অন্ থাকলেও, ফোনটা তো লক্ড, স্ক্রীনটা তো লক্ড্! তুই মেসেজ পাঠালেও সেটা তো দেখা যাবে না!”
“এটা অন্যরকম মেসেজ। এস এম এস নয়। লক্ করা থাকলেও মেসেজটা ফোনের স্ক্রীনে ভেসে উঠবে। আমি সেই রকমই পড়েছিলাম।”
“মেসেজটা পাঠায় কী করে?”
“ওই ল্যাপটপ থেকে পাঠাতে হবে। আমাকে দাও।”
বিভোর ল্যাপটপটা নিয়ে নিল। খানিকক্ষণ ঘাঁটার পর চেঁচিয়ে উঠলো, “পেয়েছি!”
আমার মনের মধ্যে আবার নিরাশার থেকে আশার ভাগটা বেশি হল। বললাম, “কী মেসেজ পাঠাবি?”
বিভোর একটু ভাবলো। “বলবো যে আমরা পুলিশ। আমরা জানি ওর কাছে চোরাই ফোন আছে। আমরা আসছি। এক্ষুনি এই নম্বরে যেন ফোন করে। নাহলে পরিণতি ভালো হবে না।”
আমি বললাম, ‘দারুণ আইডিয়া। তুই ইংরিজি হরফে কিন্তু মারাঠি ভাষায় লেখ্।”
“রাইট্,” ব’লে বিভোর মেসেজ টাইপ করলো। শেষে নিজের ফোন নম্বরটা মেসেজে দিয়ে দিলো।
আমরা আবার হাঁটতে থাকলাম।
উত্তেজনায় কারুরই মনে নেই যে বিভোর সকালে ওর ফোনটা মিউট্ করে রেখেছিল প্রথমবার পেট্রল পাম্পে গিয়ে। তার কারণ কেউ একটা ওকে বার বার ফোন করে উত্যক্ত করছিলো। সেই থেকে ফোনটা সাইলেন্টেই আছে।
আমরা জানি না যে এখন যদি চোর ফোন করেও, আমরা হয়তো টেরই পাবো না।
হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবছিলাম যে যদি আদৌ ফোনটা ফেরত পাওয়া যায়, তাহলে হয়তো টাকা লাগবে। যে বা যারা ফোনটা নিয়েছে, তারা হয়তো টাকা চাইবে। পকেটে হাজার দুয়েক আছে। তাতে নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
বিভোরকে জিজ্ঞেস করলাম।
ও বললো দু হাজার টাকা যথেষ্ট।
মনে মনে বললাম, “দু হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ।”
বলেই খটকা লাগলো। ক্ষতিপূরণ? কেন? কার ক্ষতি? কীসের ক্ষতি? আমার ফোন আমি নেবো, সেটা তো আমার ন্যায্য! বরঞ্চ বকশিস বলতে পারি। অথবা সেরকম লোক হলে, তারা জুলুম আদায় করবে আমার কাছ থেকে। সেটা কোনো অর্থেই ক্ষতিপূরণ নয়। বোকার মত আমি নিজের মনেই ভুল শব্দ প্রয়োগ করছি। ক্ষতিপূরণ নয়।
ক্ষতিপূরণ বরং আদিবাসী বিভূতির পাওয়া উচিত ছিল। পায়নি।
শ্রী যোশীর শেষ কথাগুলো মনে পড়লো।
“দু’বছর আগে বিভূতিদের তৃতীয়বার উৎখাত হতে হয় চিকাপুর থেকে। মানে তৃতীয় চিকাপুর থেকে। এইবার কী কারণ ছিল জানেন?”
“কী কারণ?”
“এবার ওরা আগাম নোটিস পেয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো কারণ নির্দিষ্ট ছিল না। এক মন্ত্রী সর্বসমক্ষে বলেছিলেন যে সেখানে নাকি সরকার এক মুরগির খামার মানে পোল্ট্রি বানাবে। কিন্তু অন্য সূত্রে খবর পেয়েছি যে তৃতীয় চিকাপুরে মানুষের বসতি নাকি কোনো সামরিক প্রকৌশল পরিষেবার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
“মানে?”
“মানে আর কী বলবো? যদি ওই সামরিক পরিষেবার গল্পটা সত্যি হয়, তাহলে দেখা যাবে যে চিকাপুরের মানুষগুলোকে তিন তিন বার তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালো ভারতবর্ষের এয়ার ফোর্স, নেভি আর আর্মি।”
“আজব ব্যাপার! তারপর কী হল?”
“চিকাপুরের সবার খবর জানি না। তবে ওরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বিভূতি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। ও ছিল একা। স্ত্রী মারা গিয়েছিল আগেই। ছেলেমেয়েরা একে একে দূরে চলে গিয়েছিল। এক ছেলে ওড়িশা ছেড়ে মহারাষ্ট্রে চলে আসে মজুরগিরি করতে। সে-ই তখন জোর করে বিভূতিকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।”
“বুঝলাম। এই জন্যই বিভূতি এখানে।”
“হ্যাঁ। ও মাঝে মাঝে ভুলে যায় যে ওর কোনো ভিটে নেই। তখন চিকাপুরের খোঁজে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কোন্ চিকাপুর কে জানে! ওর জীবনে তো তিন তিনটে চিকাপুর!”
“গল্পটা বিশ্বাস করা যায় না!”
“কিন্তু সম্পূর্ণ সত্যি। আদিবাসী, মশাই। আদি বাসী। মোগল পাঠান তো হালের ব্যাপার। তথাকথিত সনাতন হিন্দু ধর্ম যে আর্যরা বয়ে এনেছিল এই দেশে, তাদের থেকেও পুরোনো এরা। আমাদের সংবিধানে অবশ্য ‘আদিবাসী’ শব্দটা নেই, তার বদলে আছে তফসিলি উপজাতি ইত্যাদি ইত্যাদি। সে যাই হোক। আর অ্যান্থ্রোপোলজিতে কী বলে জানি না, কিন্তু আমার চোখে ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বাসিন্দা ছিল এদের পূর্বপুরুষ। বিভূতি এখন বাস্তুহারা হতে পারে, কিন্তু ওর ধমনীতে বইছে সেই প্রথম বাসিন্দার রক্ত।”
হাঁটতে হাঁটতে বিভোর আর আমি বাস ডিপো পৌঁছলাম। বিভোরের হাতে তখনো খোলা ল্যাপটপ। আমরা পৌঁছনোর পর পরই ‘ফাইন্ড মাই ফোন্’-এ দেখলাম আমার ফোনটাও ডিপোতে ঢুকছে। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একই সময়ে সরকারি একটা বাস ডিপোতে ঢুকলো।
দুয়ে দুয়ে চার করলাম – ওই বাসেই আমার ফোন আছে!
বাস থামবার পর, কোনো প্যাসেঞ্জার নামার আগেই, বিভোর আর আমি তড়িঘড়ি বাসে উঠে পড়লাম। বিভোর মারাঠিতে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “ফোন কার কাছে?”
সবাই তাকিয়ে আছে। আমরাও একে একে সব মুখগুলো দেখছি। গরীব, গ্রাম্য, সাধারণ ভারতবর্ষের ধুলোমাখা নাগরিক। মহিলারা সব শাড়ি পরা। পুরুষরা বেশিরভাগই শার্ট-প্যান্ট, দু’একজন ধুতি-কুরতা পরে আছে।
বিভোর ল্যাপটপ বন্ধ করলো। ওর নিজের ফোনটা খুলে দেখলো দু’টো মিস্ড্ কল্ – দু’টোই একই নম্বর থেকে। আমাকে দেখালো।
আরেকবার জিজ্ঞেস করলো, “ফোন কার কাছে?”
কোনো উত্তর নেই।
বিভোর মিস্ড কলের নাম্বারে ডায়াল করলো। কয়েক সেকেন্ড পরে বাসের মধ্যে একটা মোবাইলের রিং করার শব্দ শোনা গেল।
আমরা দু’জনে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম।
মধ্যবয়স্ক, রোগা একটা লোক। সাধারণ শার্ট-প্যান্ট পরা। পাতলা আধপাকা চুল। লোকটা বুক পকেটে হাত ঢুকিয়ে রিং করে যাওয়া মোবাইলটা থামালো। তারপর প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা বার করলো।
এইবার আমাদের দিকে হাত বাড়ালো। হাতে আমার হারিয়ে যাওয়া ফোন। মারাঠিতে বললো যে সে নাকি ফোনটা কোথাও রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে।
বিভোর বললো, “তাহলে বাস ডিপোর অফিসে জমা দাওনি কেন? পুলিশে জমা দাওনি কেন?”
লোকটা এবার মিনমিন করে জবাব দিলো, “সুযোগ পাইনি, স্যার। সময় পাইনি।”
বুঝলাম ভয় পেয়েছে। সরকারি চাকরি করে। প্রযুক্তির জাদুতে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। চাকরিটা খোয়ালে কপালে দুর্ভোগ আছে।
আমার মনের মধ্যে তখন রীতিমত কালীপুজো। আনন্দের তুবড়ি ফুটছে, স্বস্তির ফুলঝুরি জ্বলছে, খুশির চরকিবাজি ঘুরপাক খাচ্ছে।
একজন প্যাসেঞ্জার হেঁড়ে গলায় চাহিদা জানালো, “ও গরীব লোক, বাবু। ওকে একটু ইনাম দিয়ে দিন।”
আরেকজন প্যাসেঞ্জার তাতে সায় দিলো। তারপর আরেক জন।
প্যাসেঞ্জারদের গলায় সমীহ নেই। আছে ঝাঁজ। পাড়ার মস্তানদের অন্যায্য চাঁদা-চাওয়ার সুর।
বিভোর একটা ঝগড়া শুরু করতে যাচ্ছিল। আমি থামিয়ে দিলাম। এরা সবাই এখানকার লোক। আমরা হাফ প্যান্ট পরিহিত বিদেশী। আর ফোন তো শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছি – সেটাই বড় কথা। পকেট থেকে একটা পাঁচশ’ টাকার নোট বার করে ড্রাইভারকে দিলাম।
তারপর দরজার দিকে ঘুরে গিয়ে, বাস থেকে নেমে যেতে পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ চোখে পড়লো, সামনের থেকে তিন-চারটে রো-এর পর একটা কালো কুচকুচে বয়স্ক লোক বসে আছে। বিভূতি না? ও কী করছে এখানে?
সারা বাস-এ চোখ বুলিয়ে শ্রী যোশীকে কোথাও দেখলাম না। বিভূতি জানলা দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখলোও না। বোধহয় চিকাপুর খুঁজতে বেরিয়েছে।
বাস থেকে নেমে পড়লাম বিভোর আর আমি।
বিভোরের বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম আমার কোনো ওজন নেই। একদম হালকা লাগছে। একটা শান্তির হাওয়ায় ভেসে ভেসে চলেছি যেন।
বুক ভরে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে বিভোরকে বললাম, “আজ আর কোথাও বেড়াতে যাবো না। চল্, মাংস কিনবো। আজ কষিয়ে মাংস রান্না করবো। তারপর তোর বারান্দার দোলনায় বসে মাল খাবো। পরশুর উইস্কিটা এখনো খানিকটা বাকি আছে না?”
লেখকের টীকা—
ওড়িশার চিকাপুরের মানুষদের তিনবার উৎখাতের ঘটনা বিশদভাবে জানতে চাইলে P Sainath-এর Everyone Loves a Good Drought (1996) বইটা পড়তে পারেন।