• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৯৯ | জুলাই ২০২৫ | রম্যরচনা
    Share
  • এক্সামই এক্সাম : সংঘমিত্রা ভট্টাচার্য

    আমি কালী। শিবুর বোন। শিবুকে কে না চেনে। ডিডি সেভেনে ওকে দেখিয়েছিল একবার। অংক কষে তার ইয়া ইয়া খ্যাতি। তবে অধম কালীও কিসে কম?! একটা ঘটনাই বলি। তখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স চলতো উচ্চ মাধ্যমিকের প্র‍্যাক্টিকাল পরীক্ষার এক্কেবারে ঘাড়ে ঘাড়ে। সব শেষে বায়োলজি, মেডিক্যাল এন্ট্রান্সের পরীক্ষা। আমার সিট পড়েছিল একটা লাস্ট বেঞ্চে, ঘরের এক্কেবারে কোনায়। প্রশ্নপত্র দেখে বুঝতে পেরেছিলাম প্রশ্নগুলোর ভাবভঙ্গী মোটেই ঠিক না। কিসের জানি অভাব... এসব প্রশ্ন আমার জ্ঞানের সীমাকে যাচাই করতে পারবে না! আমার পেন-ও কেবল পাতায় লুটিয়ে পড়ছিল। এদিকে ১ঘন্টা না গেলে ঘর ছেড়ে বেরোনো যাবে না। অতএব খাতার সাথে আমার বোঝাপড়া শুরু করতেই হল। সরল মাতৃভাষায় স্বরচিত কবিতা, না কবিতা, ছোটো ছোটো অলংকরণ, ধাঁধাঁ... কিছুই বাদ দিইনি। ট্যাক্সোনমি, সাইটোগ্যামি বাদ দিয়ে খাতায় ফুটছে জাপানি টেকাগামি! বল পেনেই বল ডান্স। খাতাও আদর করে ডাকছিল, "আয় খুকু আয়...", আর তখনই ঘন্টা বাধ সাধল। সেদিন টের পেয়েছিলাম, একাকীত্ব কখনও সুখেরও বটে!

    গত সপ্তাহে মাধ্যমিকের অংক পরীক্ষা ছিল। "প্রশ্ন কষাটে। কষানো কঠিন..." এসব হইচই, কাতরানি প্রায়ই কানে আসছিল...তবে টোটোর ভাই টমেটো নাকি ঘাবড়ে যায়নি। হাল ছাড়েনি। টোটো, ইলু পিসির ভাইপো। এই ইলু পিসিই কেবল আমাকে আর দাদাকে কালী, শিবু বলে ডাকেন। পৌরাণিক চরিত্রদের সম্পর্ক নিয়ে এমন বাটি চচ্চড়ি রাঁধা ওঁর পক্ষেই সম্ভব। ইলু পিসি আমাদের পাশের বাড়িতে রান্না করেন, যুগ যুগ ধরে। সেদিন শুক্তো দিতে এসে বললেন "টমেটো আমাগো বংশের সেরা পোলা। পেরাইজ পাবে, পেরাইজ। চাকতি চাকতি সোনা রূপো।" আমি সন্দেহ করিনি, তবু জানতে চাইলাম কেন? ও কি একশোয় একশো পাবে? ইলু পিসির চোখ চকচক করে উঠল। শুরু হল বীরগাথা। তবে অণুগল্প। ও নাকি নিজেই দু চারটে বিকল্প প্রশ্ন বানিয়ে তার আদর্শ উত্তরপত্র কি হওয়া উচিত সেসবও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাতায় লিখে এসেছে।

    শিবু কিন্তু পরীক্ষায় অলোয়েজ প্রথম। কেবল কেলো হয়, পরীক্ষাকেন্দ্রে যাবার পথে। একটা মারাত্মক ঘটনা ওর ডায়েরির পাতা থেকেই তুলে দিচ্ছি।

    শিবুর ডায়রি :

    জানি না আজকের লেখা সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার নাগাল সবটা পাবে কিনা। কারণ আজ সে পরিস্থিতি কাটিয়ে লিখছি। তাই, সে সময়কার মনের অকুস্থলের পরিচয় আজকের গদ্যশৈলীতে খানিক অনুক্ত, অব্যক্ত থাকবেই।

    কানপুর আইআইটির এন্ট্রান্স টেস্ট। কথা ছিল সাথে যাবে টুনির দাদা, দিল্লির অবনী। টিকিট কাটা সেকেন্ড ক্লাসের, কনফার্মড জানি। ১০ই মার্চ রাত ১০টা ১০-এর প্রয়াগরাজ এক্সপ্রেস। রাত আটটায় কথামতো অবনীদের জনকপুরীর বাড়িতে এলাম। ওকে সঙ্গে নিয়ে যাব, ওই ট্যাক্সি বুক করে রাখবে। কলিং বেল বাজালাম। অবনীর মা দেখতে রোগা, ভারী চটা। রাগী স্বর, হাতে ঝাঁটা। দরজা খুলেই ভিজে ধুলো খাওয়া ঝাঁটা চোখের সামনে ঝাড়তে লাগলেন। যে উত্তর শক্তি চাটুজ্যে পাননি, আমি প্রশ্ন না করতেই পেলাম। "অবনী বাড়ি নেই।" দরজা বন্ধ হল। আর খুলল না। কেসটা কি? ডানে গুনে গুনে চারশো কুড়ি পা চালিয়ে চার মাথার মোড়ে এসে একটা টেলিফোন বুথ পেলাম। অবনীর ল্যান্ড ফোনের নাম্বার ডায়াল করলাম। রিং হল। "হ্যালো" শুনতেও পেলাম। স্পষ্ট। চিনতে অসুবিধা হয়নি। ওটা টুনির গলা।

    "আমি শিবুদা, অবনীকে দে, ট্রেন মিস হয়ে যাবে..." ওদিক থেকে কেবল শ্বাসালাপ। টুনি কথা বলে না। "কোথা থাকে মুখ ঢেকে/ কোথা যে ওদের বাসা!/ থাকে ওরা কান পেতে/ লুকানো ঘরের কোণে।" এমন নিদারুণ, নিষ্ঠুর রসিকতা কে করাচ্ছে? পেছন ঘুরতেই দেখি বুথের লাইনে একটা বাচ্চা মেয়ে সহজ পাঠের প্রথম ভাগ থেকে ছড়া বলে চলেছে। আপন মনে। রাত নটা দশ। আর নয়। দশ টাকা বিল মিটিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে শেয়ারে অটো নিলাম। জ্যামের জ্যামিতিতে ফেঁসে গেছি। পেট আর অটোর চাকা দুটোই গোঙাচ্ছে।

    স্টেশনে নামার আগেই অটো দাদার ভাড়া চুকিয়ে Leibnitz এর নাম জপ করতে করতে প্ল্যাটফর্মে উঠছি। ছুটছি। সব আব্দার এখন নিজের শরীরের কাছে। ট্রেনটা না পেলে আমার স্বপ্নসন্ধানী চোখ দুটো একেবারে বুজে যাবে। তবু আশার মশা মনে গুনগুন করছে... "দুটো পায়ের মাঝের দূরত্বটা যদি আরেকটু বাড়ানো যায়, ঠিইইইক ট্রেন পেয়ে যাব।" পাইনি। নিজেকে টেনে হিঁচড়ে তেরো নাম্বার প্ল্যাটফর্মে তুললাম, হাত ঘড়িতে দশটার হাত তেরো তে পা দিল। এখানে সবাই যাচ্ছে... এত ভিড় কিসের? কুম্ভস্নানের? হোলির? আর আমি একা, সিঙ্গলটন। অনুপাত করে অনুতাপ বাড়ছে। 'এ জি ও জি শিব জি মোর হো জি গাইতে গাইতে' ঝাড়ুদারনি বিড়িতে আগুন ধরালো, সেই আগুনে বিড়ি ধরিয়ে রাজস্থানি পাগড়ি মাথায় একজন আমার ডান কাঁধে জোরসে ধাক্কা দিয়ে জেন্টস ওয়াশরুমে ঢুকল। ট্রিপল এক্স ইম্পালসিভ ফোর্সে ভেতরটা ফুঁসফুঁসিয়ে উঠল। জোড়া জঙ্গল ভুরু নাচিয়ে লোকটা জিজ্ঞেস করল, "ট্রেন ছুট গয়ে ক্যায়া?" উত্তর দিইনি। আমার শির ছেঁড়া কান্না amplitude বাড়িয়ে হায়ার অক্টেভ ছুঁয়ে শেষমেশ ইউরিনালের পথে। সবটা ভয়েড, শূন্য। সাদা ফ্লোর টাইলস, ইউরিনাল সব যেন আরও সাদা।

    ইউরিনালে ফ্লাশ করতেই মন চনমন করে উঠল। চ্যাঙের চিনা শিক্ষার কথা মনে এল, "সাদা হল শূন্যতা, আর শূন্যতা সর্বাধিক মূল্যবান।" বেসিনে চোখে-মুখে জল দিচ্ছি। আয়নায় আমার রোগা লুক এখন আরও তোবড়ানো যা আমার মানিব্যাগের উপযুক্ত। ব্যাকগ্রাউন্ডে আবার সেই লোকটাকে দেখলাম, অবিকল মন্দারের দৃষ্টি। চোখে ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি। এবার আধা বাংলায় বললেন, উনি আমায় হেল্প করবেন, পরের ট্রেনের ইমার্জেন্সি উইন্ডো দিয়ে ট্রেনের জেনারেল কামরায় চালান করে দেবেন, ফ্রিতে। রাজি হয়ে গেলাম। ভিড় ট্রেন আসতেই ওঁরা আমায় ফোল্ড করে জানলা দিয়ে ঠুসে দিল একটা ভিড়ে ঠাসা ডিব্বায়। অনুপ্রবেশের উদগ্র প্রচেষ্টা প্রফিটও করল। দুজন লুফেও নিল। আমি সেইফলি ল্যান্ড করতেই ভেতর থেকে উভমুখী বিক্রিয়া রিভার্স ডিরেকশনে আমায় প্ল্যাটফর্মের দিকে ছুঁড়ে দিল। ক্যাচ কট মিস। আমি থেবড়ে মাটিতে। সরণ শূন্য। কোমরে ডান হাত বোলাতে বোলাতে উঠে দাঁড়ালাম, দৃষ্টি প্রায় শূন্য। আমি কে? চলন্ত মিক্সার গ্রাইন্ডারের মাথার ওপর থেকে ফ্র‍্যাৎ করে বেরিয়ে আসা একটা টমেটো সীড? ট্রেনের বাইরে vs ভেতরের বেসামাল কুস্তি তখনও চলছে। ব্যাস আর না। বাড়ি যাব, যেই না ভাবা অমনি যেদিকে ইঞ্জিন অর্থাৎ আমার ডান দিকের দরজার ভেতর থেকে মিলিটারি পোশাকের একজন ফিফটি ফিফটি বাংলা - ইংরেজিতে গর্জে উঠলেন। এই অভাগারই উদ্দেশ্যে। কেমন দেখতে? পুরো প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। "Don’t move! সহি ওয়ক্ত উঠা লেঙ্গে!"

    চলন্ত ট্রেনে আমায় প্রায় চ্যাং-দোলা করে তুলে দেওয়া হল। পরদিন সকালে পরীক্ষা সুসম্পন্ন হল।

    ------

    তারপরের খবরটা সবাই জানি। শিবু সেই পরীক্ষায় দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছিল।

    পরে জেনেছিলাম অবনীর চিঠিতে, ও গিয়েছিল সেই পরীক্ষা দিতে, তবে গাড়িতে। কারণ রাস্তায় আরেকটা পরীক্ষা দেওয়ার ছিল। মেডিকেল টেস্ট। ওর সেই চিঠি আজও যত্নে রাখা...তারই খানিকটা অংশ -

    "তোকে জানাইনি ভাই। জানতাম তুই ঠিক বুঝবি। তখন আমি প্রায় inactive state এ। ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর ফাঁকে একটা মেডিকেল রিপোর্ট। বুড়ো আঙুলটা আর্থ্রাইটিসের ব্যথায় প্রায় অনেক দিন অকেজো, এটা জানতিস। এদিকে বাবার ব্যবসায় ভরাডুবি। অভিজাত বংশে জন্মেছি। অন্নসংস্থানের দুশ্চিন্তা আমার কপালেও ভাঁজ ফেলতে পারে, এটা ভাবতে পারিনি। হায়ার স্টাডির প্রত্যাশা অবাস্তব। তবু শেষচেষ্টা-স্বরূপ পরীক্ষাটা দিতে গেলাম। Double Bonanza-স্বরূপ সদ্য প্রাপ্তি টেস্ট রিপোর্ট। ইংরিজিতে যা লেখা ছিল, তাই তুলে দিলাম - A complex cyst in upper ole of right kidney as described. সময়ের প্যাঁজ পয়জারে ফেঁসে পরীক্ষার খাতার প্রতি খুব বেশি সুবিচার করে উঠতে পারিনি। এলোমেলো মন মেজাজ, ভাষাহীন খাতা। জানিস খাতার শেষ পাতায় রেখাচিত্রে একটা নৌকা আর একটা হাল এঁকেছিলাম। নিদারুণ, নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে স্যারিয়ালিজম?! পেনের ডগা দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়েছিল অমোঘ রসিকতা - হাল ছাড়িয়া দিলাম..."



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments