ইস্কুল খুলে যাওয়ার পর দেখলাম হয় আমি আর প্রবুদ্ধ খানিকটা লম্বা হয়েছি, নয় অন্যরা অনেকে বেঁটে হয়ে গেছে। প্রিন্সিপাল মহেন্দ্রবাবুর চুলগুলো আগের চেয়ে কালো, দাঁতও একটা বেশি। গুজব রটে গেল ভ্যাম্পায়ারের মতো আমাদের প্রধান শিক্ষকের বয়স উলটোদিকে ঘুরছে। প্রথমদিনই অবশ্য বুঝলাম ইস্কুলের কালচার অক্ষুণ্ণ। যে নির্মল বাতাবরণে আমরা এতকাল বড়ো হয়েছি তা আমাদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় অচল হয়ে বসে ছিল।
মহেন্দ্রবাবু অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে বললেন – ভয়ঙ্কর বন্যা আসছে। যেদিকে তাকাবে শুধু জল। কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই। গতবার হেলিকপ্টার থেকে পাঁউরুটি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। এবার সরকারী টিভি চ্যানেলে খোলাখুলি বলেছে সেসব করে কোনো লাভ হয় না, সুতরাং সবাই ঝটপট সাঁতার শিখুন। এই দেখা হয়তো আমাদের শেষ দেখা ভেবে দিনগুলোকে পরস্পরের হিতার্থে নিযুক্ত করা যাক।
কালো মেঘ তো ছিলই। মহেন্দ্রবাবুর কথার পিঠে কড়কড় করে একটা বাজও পড়ল। তমসাচ্ছন্ন পৃথিবীর পশ্চাদপটে মহেন্দ্র রায় আকাশের দিকে এমন নাটকীয়ভাবে তাকিয়ে ছিলেন যেন নাটবল্টু খোলা করোগেটের চালার মতো সেটা এক্ষুনি ভেঙে পড়বে আমাদের ঘাড়ে।
প্রথমে প্রাইমারি ক্লাসের একটা ছেলে ব্যা ব্যা করে উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে শুরু করে। তারপর তার দেখাদেখি অ্যাসেম্বলির সেদিক থেকে একসঙ্গে আরো অনেকগুলো কান্নার রোল উঠেছে। ফাইভ-সিক্সের একটু বড়ো ছেলেমেয়েরা ভীষণ বিরক্ত হয়ে ছাগলগুলোকে ঠেলে মাঠ থেকে তাড়াতে চাইছিল। প্রিন্সিপাল দুহাত তুলে সবাইকে থামাবার পর পকেট থেকে কিং জেম্সের বাইবেল বের করে অ্যাপোক্যালিপ্সের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে যেতে অনুরোধ করেন। উদাত্ত কন্ঠে আমাদের সবার আসন্ন মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী শুরু হয় তার পর।
And, behold, I, even I, do bring a flood of waters upon the earth,
to destroy all flesh, wherein is the breath of life, from under heaven;
and every thing that is in the earth shall die.
পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একদিক থেকে প্রমীলা দিদিমণি আর অন্যদিক থেকে মাধবী দিদিমণি মহেন্দ্রবাবুর শরীর ব্লক করে তাঁকে স্টেজ থেকে একপ্রকার হিঁচড়ে বের করে নিয়ে গেলেন।
কিন্তু মহেন্দ্রবাবুর পূর্বাভাস সত্যি প্রমাণ করার জন্যই যেন দিনের পর দিন বৃষ্টি হয়ে চলেছিল। ক্লাসগুলো কেমন মনমরা, বিষণ্ণ, অন্ধকার। একাদশ শ্রেণী তিনভাগে বিভক্ত হবার পর সায়েন্সে রয়ে গেছি মাত্র দশজন। আমাদের পাঁচজন সহপাঠিনী নানারকম অজুহাত দেখিয়ে বাড়িতে বসে গেছে। ছেলেদের মধ্যে একজন অন্য স্কুলে বদলি নেবার জন্য ছোঁক ছোঁক করছে। প্রবুদ্ধ আর আমার পড়াশোনায় কোনো উৎসাহ নেই। আমরা ছায়ার মতো করিডরের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অনবরত বৃষ্টি পড়া দেখতাম।
ক্লাস টুয়েলভের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের বনত না। সব ক্লাসেই কিছু সুবোধ, আর কিছু নির্বোধ ছাত্র থাকে। আমাদের ঠিক উপরের এই ক্লাসটা ব্যতিক্রম – ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে এদের সব কজন সদস্য ছিল আশ্চর্যরকমের বদ। টেনের পরীক্ষায় আমাদের রেজাল্ট তাদের চেয়ে ভালো হওয়ার পর থেকে তারা রাতদিন আমাদের ধ্বংসের ফন্দি এঁটে চলেছে। একদিন ক্লাসে কোনো টিচার সকাল থেকে আসেননি। প্রবুদ্ধ আর আমি দুতলার বারান্দায় বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে পাঁচিল থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। এমন সময়ে ওদের মনীষা (যাকে এককালে আমরা মনীষা-দি বলতাম, কিন্তু পরে তার ব্যবহারে নিরাশ হয়ে ‘দি’ত্ব বর্জন করা হয়) এসে বলল – বোকাচোদার মতো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকিস না। হয় ক্লাসে ঢোক, নয় তোদের মাঠে ছুঁড়ে ফেলার ব্যবস্থা করছি।
প্রবুদ্ধও ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’তে নেমে গিয়ে বলল – যা ভালো বুঝিস কর।
ওদের ক্লাসে সেদিন ছজন ছেলে। এক মিনিটের মধ্যে সবাই বেরিয়ে এল আমাদের চ্যাংদোলা করে ফেলে দেবে বলে। পিছনে পাঁচজন মেয়ে – দিল্লীর বঙ্গললনা, অহিংসার অবতার নয় কেউ। তাদের একজনের হাতে একটা বেঞ্চ থেকে ভেঙে আনা কাঠের তক্তা। আমাদের ক্লাসে প্রবুদ্ধ আর আমি ছাড়া দুটো মাত্র ছেলে সেদিন। মেয়েরা তো আসেইনি, এলেও আমাদের বাঁচাত না। ছেলেদের মধ্যে একজন হল আমাদের মলয় রক্ষিত, যার ভাষায় মালদা’র টান এবং এখনো যার আত্মীয়দের কেউ কেউ চাষ-বাস করে। চতুর্থজন পাঞ্জাবী। তার নাম চিন্তন উপ্পল। ছেলেটার দাড়িগোঁফ হয়নি। একেবারে গোলাপি পেঁপের মতো গোলগাল হলেও ওজনদার চেহারা। আমরা তাকে চিক্না উপ্পল বলে ডাকতাম। কেন চিক্না উপ্পল এই বাংলা ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল কেউ জানে না, কিন্তু শান্তশিষ্ট ছেলেটার পড়াশোনা খুবই ভালো চলছিল বলে বাবা মা তাকে অন্য স্কুলে নিয়ে যাননি। রক্ষিত বা চিক্না কেউ ভীতু নয়। ডাক দিতেই তারা ছুটে এসেছে। টিচার আর স্টাফ ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না এরকম ভৌতিক নিস্তব্ধতার মধ্যে দুতলার করিডরে একটা জমিদখলের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
সেদিন মাথা-গরম রক্ষিত কাঠের তক্তা হাতে আসা মেয়েটার কেড্স জুতোর পিছনে এমন জোরে লাথি কষিয়েছিল যে তার ঠ্যাং উঠে যায় শূন্যে আর বডি দড়াম করে পড়ে মেঝেয়। তখন রক্ষিত তক্তাটা কেড়ে নিয়ে নির্মমভাবে টুয়েলভের ছেলেদের পিছন দিক থেকে কোমরের হাড়ে পেটাতে থাকে। আমি আর চিক্না একটা করে ছেলেকে আটকে দিয়েছি। প্রবুদ্ধ কখনো দুজন, কখনো তিনজনকে সামলাচ্ছিল। একটু পরে চিক্না একজনের হাত মুচড়ে তাকে পঙ্গু করে দেওয়ার পর আরেকজনকে ধরল। এইভাবে মিনিট দশেক চলার পর প্রবুদ্ধ ছাড়া আমাদের সকলের শার্ট-বোতাম সব ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। আমার ফাটা নাকটা দিয়ে আবার রক্ত পড়া শুরু হয়েছিল। মলয় রক্ষিত মেয়েদের ছাড়েনি। মনীষা নামের হাড় বদমাইশ আর চুকলিখোর মেয়েটার দুই নাকের ফুটোয় হুকের মতো দুটো আঙুল ঢুকিয়ে সে জটলা থেকে টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিল। মনীষার নাক থেকেও কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছে।
শেষে রক্ষিত আমাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে তক্তা তুলে যখন বলল – এবার তোদের মুখে মারব, তখন ওরা আস্তে আস্তে সরে যায়। পরে বদমাইশ মনীষা আমাদের পুলিশে দেবে বলে শাসাতে এসেছিল। রক্ষিত বলল – যা, যা। আমাদের বাড়ি থেকে আগেও অনেকে জেল খেটেছে। তোর ছোট ভাইটা স্কুলের পর ক্রিকেট খেলতে যায় তো? একদিন লরির নিচে থেঁৎলে গেলে কী করবি? লাশ চেনা যাবে না। হিট অ্যাণ্ড রানে কেউ ধরা পড়ে?
আর কী? ঘন্টা দুয়েক বাদে নিচ থেকে রক্ষিতের তলব। পরে একজন চাপরাসি তার বইখাতা ভর্তি ঝোলা নেবার জন্য ফিরে আসে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম – স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে? সে আকর্ণ প্রসারিত হাসি দিয়ে বলল – না, মাত্র সাতদিনের সাসপেন। ফিরে এসে আবার যত ইচ্ছে মারামারি করতে পারবে।
রাগের মাথায় আনতাবড়ি হুমকি পুরোনো দিল্লীতে সবাই দেয়। কিন্তু মনীষা ছাড়ার পাত্রী না। আমরা জানালা দিয়ে মলয় রক্ষিতকে তার ব্যাগ সমেত ইস্কুল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখি।
চিক্না এসে বলল – রক্ষিত তো গয়া। এবার কাল ওরা সবাই মিলে আমাদের ধোবীঘাটের মার মারবে। প্রবুদ্ধ বলল – আজকে শুধু ঠেলে সরিয়েছি। কাল যদি লাগতে আসে তো ধরে ধরে সবকটার নাকের ব্রীজ ভেঙে দেব। আমি বললাম – তাহলে তোকে স্কুল থেকে পার্মানেন্টলি তাড়াবে। প্রবুদ্ধ বলল – এই মনীষার জ্যাঠা একটা ফেইল্ড্ ডাক্তার। কোনো পসার নেই। ফ্যামিলির ব্যবসা আছে। সেটা ভাঙিয়ে খায় আর স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে বসে বজ্জাতি করে। কিন্তু আমাকে কিচ্ছু বলবে না।
প্রবুদ্ধ কোন বিশ্বাস থেকে কথাটা বলল জানি না। অবশ্য সে স্ট্যাণ্ড করা ছেলে। তায় তার বাবার ডোনেশানে স্কুলের সবকটা সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম চলে। যাই হোক পরের দিন আমি, প্রবুদ্ধ, আর চিক্না তিনজনেই ক্লাসে হাজির হলাম এবং চিক্নাও আমাদের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেল। আমাদের ক্লাসের মেয়েগুলো আবার একটু বেশি ভালো। দুজন সেদিন ভুল করে এসে পড়েছিল। তারা আগের দিনের খবর শুনে মুখ হাঁড়ি করে বলল – আমরা ঠিক করেছি তোরা যদি আজ আবার মারামারি করিস তাহলে চেঁচিয়ে সবাইকে জড়ো করব। এটা স্কুল, দাঙ্গার জায়গা নয়।
প্রবুদ্ধ বলল – রোজ তো তোরা অ্যালার্ম বাজাতে আসবি না। যেদিন আসবি না সেদিন যা হবার হয়ে যাবে।
অবাক কাণ্ড, তারপর থেকে মেয়েরা নিয়মিত ক্লাসে আসতে লাগল।
এইভাবে গরমের ছুটির পরে ইস্কুলের দিনগুলো কাটছে। মনসুনের দাপট না কমলেও, খুব বেড়ে যায়নি। একেক দিন ইস্কুলে ঢোকার রাস্তাটা ভাখরা নাঙ্গাল থেকে বেরোনো ক্যানালের মতো দেখালেও, চার পাঁচ ঘন্টার মধ্যে তা আবার স্বাভাবিকও হয়ে আসছিল। বোঝা যাচ্ছিল আটাত্তরের বন্যা এ বছরে আর হবার নয়।
আমি দিন গুনছিলাম আমার চণ্ডীগড়ের কলেজে পড়তে যাওয়া বান্ধবীর ফোনের। বিকেলে কিছু করার নেই বলে মনুর সঙ্গে ইংরেজি বই পড়তাম। মাঝে মাঝে দাদুর ডাম্বেলগুলো তুলতাম দুজনে। প্রবুদ্ধ বলত – এই সুযোগে মোপেডটা চালানো শিখে নে ভালো করে। আমার তাও ইচ্ছে করত না। দু-একবার হেঁটে গিয়েছি পম্পাদের বাড়িতে, কোনো খবর এল কিনা জানার জন্য। মাসিমা বলতেন – আসবে আসবে, আমাদের তো ফোন করেছে দুবার। এবার আগে থেকে জানিয়ে রবিবার করবে, যাতে তুইও কথা বলতে পারিস।
কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল পম্পা প্রবুদ্ধদের বাড়িতে কলটা করবে, যাতে আমরা একটু একা হবার সুযোগ পাই।
শেষ পর্যন্ত আমার আন্দাজ নির্ভুল প্রমাণিত করে এক সোমবার প্রবুদ্ধ পম্পার ফোন আসার খবরটা দিল। দুর্ভাগ্যবশত তার ঠাকুরদা রিসিভার তোলার পর দু-আড়াই মিনিট উঁচু স্কেলে হ্যাল্লো হ্যাল্লো করে লং ডিস্টেন্স্ কলের পুরো সময়টা অপচয় করে দেন। প্রবুদ্ধ দুতলার ঘর থেকে তিন লাফে নিচে এসে যন্ত্রটা বুড়োর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল, পম্পা তখন এস-টি-ডি’র মেশিনে তার শেষ দু-টাকার কয়েনটা ঢোকাতে ঢোকাতে শুধু বলতে পেরেছে – লম্বু, পরের রবিবার বেলা চারটে নাগাদ জয়কে এনে রাখিস।
ব্যাস্, বাকি সপ্তাহটা সজাগ আর সাবধান হয়ে কাটাতে থাকি, যাতে কোনো উটকো গণ্ডগোল বেধে রবিবারের রাঁদেভু কেঁচে না যায়। সপ্তাহের মাঝখানে একদিন স্টাফরুমের বাইরে চুকলিখোর মনীষার মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। তার মুখে অনির্বচনীয় পরিতুষ্টির আহ্লাদ। কার নামে লাগিয়ে বেরোচ্ছিল কে জানে। অন্য দিন হলে নাক সিঁটকে পাশ কাটিয়ে যাই। আরেকটা ঝামেলা পাকাব না বলে সেদিন ভদ্রলোকের মতো হাসি ফুটিয়ে রাখতে হল, যেন কিছুই হয়নি। পাজি মেয়েটা অবশ্য তাতে গলেনি। সে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলল – তোকে শিক্ষা দেওয়া এখনো বাকি। আমরা ভুলিনি। যথাসাধ্য ভদ্রতা রক্ষা করে বললাম – তুমি আমার দাদা টোটোকে চেনো? ভালো নাম অরিন্দম। এই বছর স্কুল পাশ করে গেছে।
- অ। তাই বলে তোকে ছেড়ে দেওয়া হবে ভাবছিস?
- টোটোদারা যখন টুয়েলভে ছিল তখন তারা তোমাদের ক্লাসের কাউকে দুতলার বারান্দা থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছে?
- নিজের পথ দেখ। আমাকে আর জ্ঞান দিতে হবে না।
খুবই ইচ্ছে হচ্ছিল জিজ্ঞেস করি – কার নামে লাগিয়ে এলে আজ? নিজেকে সামলে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলাম।
***
এর পরের দিনগুলোতে মোঘল যুগের প্রেতের মতো ইস্কুলে কোনো একটা দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে যেতাম। পড়াশোনায় একটুও মন ছিল না। স্কুলে ঢোকার আগেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। দাড়ি-গোঁফ সবে গজিয়েছে কি গজায়নি, ডি-টি-সি’র বাসে ভিড় হলে মেয়েদের মতো আমাকেও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। প্রায় দিনই নাছোড়বান্দা কড়ে আঙুলের খোঁচা খাবার পর আমি কাউকে কনুই দিয়ে গোঁত্তা মেরে কি জুতো দিয়ে নির্মমভাবে কারো পা মাড়িয়ে জল্লাদের মতো রাগে গরগর করতে করতে বাস থেকে নামতাম আর ভাবতাম পম্পা অন্তত চণ্ডীগড়ে গিয়ে এর হাত থেকে বেঁচেছে।
রক্ষিত ফিরে এসেছিল একটা ফল কাটার ফোল্ডিং চাকু নিয়ে। প্রতিদিন সে দুটো করে আপেল বা পেয়ারা এনে দুতলার করিডরে সবাইকে দেখিয়ে কাটছে। আমরা একটা করে ফালি পাই। লক্ষ্য করতাম তার তেল-জলহীন রুক্ষ চুলগুলো বেড়েই চলেছে। এমনকি মহেন্দ্রবাবুর সাহস হত না সেগুলো ছাঁটতে বলার। মুখে না শাসালেও, টুয়েল্ভের ছেলেমেয়েদের দিকে যেভাবে ঠাণ্ডা লাশের মতো নিথর দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকত সেটাকে আইনের ধারায় ইন্টিমিডেশানই বলে। গুজব রটে গিয়েছিল যে এবার রক্ষিতের হাত উঠলে সে প্রথমে ছুরি দিয়ে চোখ খুবলে নেবে। তার মূর্তি দেখে বস্তুত ক্লাস টুয়েল্ভের ছেলেরা শুধু নয়, আমরাও ভয় পেতে শুরু করেছিলাম।
মনীষা আমাকে একদিন দাঁড় করিয়ে বলল – তোদের উচিত আমাদের সঙ্গে বসে মিটমাট করে নেওয়া। তাতেই তোর মঙ্গল।
আমার মন তখন একেবারে কিছুতে নেই। পম্পার জন্য একটা লেখা শুরু করেছিলাম, সেটাও এগোচ্ছে না। এটুকু বুঝলাম যে রক্ষিত একটা শান্তশিষ্ট বোতলবন্দি জিনের মতো ছিল। মনীষা মনের আনন্দে ছিপি খুলে দেবার পর এখন চাইছে আমি তাকে আবার বোতলে ঢুকিয়ে দিই।
বললাম – একদিন টিফিনের সময়ে চলে এসো না আমাদের ক্লাসে? সবাই মিলে একসঙ্গে ভাইবোনের মতো আপেল খাই?
ঠাট্টা করছি কিনা বুঝতে না পেরে মনীষা একটু চুপ করে থেকে বলল – আচ্ছা, দেখি কী করা যায়।
আমাদের বায়োলজি ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট জয়কিশোর। পাঁচ ফুট উচ্চতা হলে কী হবে, মাথাটা পাকা কাঁঠালের মতো ঢাউশ। কালো পাট করা চুল। স্যাম্পেলটা সারাদিন বিড়ি খায় আর তিরিশ বছরের ছোট ছাত্রদের সঙ্গে বিস্ময়কর রকম নোংরা কথা বলে। তরমুজের ফালির মতো হাসি দিয়ে সে বলল – কুত্তে কী দুম রক্ষিতটাকে এবার তাড়ানো হবে।
থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। জয়কিশোরকে আমি তেমন পছন্দ করি না, যদিও সে নানারকম দুনম্বরি উপায়ে ছেলেদের উপকার করার চেষ্টা করে। পরীক্ষায় টোকাটুকি করার প্রয়োজন নেই যাদের তারাও কেউ কেউ জয়কিশোরকে খুশি করার জন্য তার সাহায্য নিয়ে টুকতে বাধ্য হয়েছে।
- রক্ষিত তো আর কিছু করেনি। শঙ্কিত হয়ে বললাম আমি।
- কাল দেখিস কী হয়। ধরবে ওকে হাতেনাতে।
- কে ধরবে?
- যারা আসছে। বলে জয়কিশোর চোখ নাচিয়ে টুকটুক করে তার বাড়ির পথ ধরল।
আমি আর প্রবুদ্ধ লুডলো ক্যাসেলের জিমনেসিয়ামে টেবিল টেনিস খেলতে গিয়েছিলাম। যাবার পথে প্রবুদ্ধকে ঘটনাটা বললাম। আমার মনে হচ্ছিল রক্ষিতের বাড়ি গিয়ে সাবধান করে দিয়ে আসা উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় যদি সে কাল ইস্কুলেই না আসে। সমস্যা হল কেউই রক্ষিতের ঠিকানা জানি না। সে থাকে লরেন্স রোডের কাছাকাছি কোথাও। সেখানে বিরাট সব সরকারি কলোনি এবং আমাদের ইস্কুল থেকে জায়গাটা বেশ দূরে।
অনেকক্ষণ মাথা ঘামিয়েও আমরা এমন কারো নাম মনে করতে পারলাম না যে রক্ষিতদের বাড়ি দেখিয়ে দিতে পারবে। আর একটা উপায় হল কাল তাড়াতাড়ি এসে তাকে গেটের বাইরে ধরা, যাতে সে বিল্ডিংয়ে পা দেবার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
সেটাই ঠিক করে পরদিন আমি ইস্কুলের পিছনের পাঁচিলের বাইরে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে আছি। প্রবুদ্ধ গিয়েছে সামনের গেটের দিকে। ঘন্টা পড়ার তিন মিনিট আগে সে এসে বলল – চল আর দাঁড়াতে হবে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম – রক্ষিতকে পেলি? প্রবুদ্ধ প্রথমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর বলল – তুইও পাবি।
ক্লাসে গিয়ে দেখি রক্ষিত বাড়ি ফেরার বদলে বুক চিতিয়ে বসে আছে। প্রবুদ্ধ ক্লাসে ঢুকতেই তার মুখটা উপরদিকে চলে গেল। বুঝলাম, রক্ষিত পিছু হটার পাত্র নয়। প্রবুদ্ধ তাকে শুনিয়ে আমায় বলল – সব বল ফ্রন্ট ফুটে খেলা যায় না। বাউন্সার হুক করতে গেলে আগে ব্যাকফুটে আসতে হয়। রক্ষিত আমাদের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে আবার সিলিংয়ের দিকে চোখ তুলে দিল। অর্থাৎ অযাচিত উপদেশ সে এইভাবেই হুক করে মাঠের বাইরে পাঠায়।
প্রথম পিরিয়েডের পর কম্পাউণ্ডে একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ঢুকেছিল। সেটাকে দেখতে পেয়ে বারান্দা থেকে চিক্না আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে। সবার সঙ্গে আমি আর মলয়ও ছুটে গিয়ে দেখলাম ধুতি পরে ফর্সা মোটাসোটা এক ভদ্রলোক নামছেন। পায়ে বাটার স্যাণ্ডাল। আমাদের ক্লাসের অর্পিতা ফিসফিস করে জানায় – মনীষার জ্যাঠা। দিল্লীতে ওরকম বদমাইশ বাঙালি দুটো নেই।
- কী করে? রক্ষিত জিজ্ঞেস করল।
- ব্যবসা ট্যবসা আছে। অর্পিতা বলে। - একটা বইয়ের দোকান, আর একটা ওষুধের দোকান আছে এটুকু জানি। বাঙালিদের মধ্যে আঁত্রেপ্রিনর কম তো, তাই সবাই হাত জোড় করে থাকে।
রক্ষিত ছটফট করে এদিক ওদিক যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম এতক্ষণে তার টনক নড়েছে। কাঁধে একটা হাত রেখে বলি – সেয়ানা, তুই পাইপ বেয়ে নেমে যা। চুপচাপ পাঁচিল টপকে বেরিয়ে যাবি।
রক্ষিত অস্থির হয়ে বলল – অ্যাটেণ্ডেন্স হয়ে গেছে যে। সেটার জন্য ফাঁসিয়ে দেবে তাহলে।
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম – নরহরি বাবু নিয়েছেন তো? নিজেদের লোক, কিচ্ছু হবে না। বলব তুই আসিসইনি। আমি তোর হয়ে প্রক্সি দিয়েছিলাম।
আমাদের ক্লাসের অর্পিতা আর বিদিশা রক্ষিতকে ঘেরাও করে বলল – পাঁঠামো করিস না, রক্ষিত। চলে যা। আমাদের জিজ্ঞেস করলে আমরাও সবাই বলব জয় প্রক্সি দিয়েছে।
এই পুরো আলোচনাটার সময়ে প্রবুদ্ধ উদাসভাবে ক্লাসের ভিতর বসে ছিল। যেন রক্ষিতের ভালোমন্দ নিয়ে তার কোনো দায় নেই। বোঝা যাচ্ছিল ইস্কুলের বাইরে তাদের মধ্যে একটা তু-তু-ম্যাঁয়-ম্যাঁয় হয়ে গেছে। প্রবুদ্ধরও টনটনে আত্মসম্মানবোধ।
মলয় গড়িমসি করে এতটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিল যে পরের ক্লাসের জন্য টিচাররা দেখি আসতে শুরু করেছেন। বিদিশা, অর্পিতারা বলল – চিন্তা করিস না, তৈরি থাক। এই ক্লাসটা হয়ে গেলেই বেরিয়ে যাবি।
যথারীতি বিপদ ঘটল ক্লাস শেষ হওয়ার আগে। দরজার বাইরে পাকা কাঁঠালের মতো বিরাট মাথাটা উঁকি দিতেই আমি প্রমাদ গুনেছি। জয়কিশোর গভীর জলের মাছ। পরেশ নামের চাপরাসিকে সে সঙ্গে করে এনেছে সাক্ষী হিসেবে। রক্ষিতকে ক্লাসে দেখতে পেয়ে আমার দিকে গভীর হতাশার সঙ্গে তাকাল – অর্থাৎ অপদার্থ, তুই বাংলা স্কুলের নাম ডুবিয়ে দিলি। ছেলেটাকে আসতে দিলি কেন?
আমি মনে মনে বললাম – মলয়কে সত্যি বাঁচাতে চাইলে তুমি কাল আমার মুঠোয় তার ঠিকানাটা গুঁজে দিতে পারতে। সেটা তো করোনি, বাঞ্চোত!
রক্ষিতকে তার স্কুলব্যাগ সমেত তোলা হল সীট থেকে। আমরা সবাই এককাট্টা হয়ে জিজ্ঞেস করলাম – কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওকে? কিচ্ছু করেনি তো সে।
জয়কিশোর আমাদের অগ্রাহ্য করে মাস্টারমশাই প্রশান্তবাবুর দিকে ফিরে বলল – ওর ব্যাগটা ম্যানেজিং কমিটির প্রেসিডেন্টের সামনে সার্চ করা হবে। ওনার কাছে অভিযোগ আছে, ছেলেটা ভয় দেখাবার জন্য ক্লাসে অস্ত্র নিয়ে আসে। আমাদের কিছু করার নেই।
ব্যাগ হাতে পরেশ চলল সবার আগে, তার পর রক্ষিত। জয়কিশোর সবার পিছনে। রক্ষিতের জিনিস সে ছোঁয়নি।
মিছিলটা চলে যাওয়ার পর ক্লাস ফেটে পড়েছে। ছাত্রদের নিষ্ফল আক্রোশ গিয়ে পড়ল শান্তশিষ্ট প্রশান্তবাবুর উপর।
- আপনি এটা কেন হতে দিলেন? আমাদের থলে সার্চ করা হলে টুয়েলভের ছেলেদের ব্যাগও সার্চ হবে না কেন?
- ব্যাগে কিছু না থাকলে তোদের ভয় কীসের? প্রশান্তবাবু পান চিবোতে চিবোতে বললেন। - আর যদি থাকে তো ম্যানেজিং কমিটি ডিসিশান নেবে।
- একজন ছাত্রের ভবিষ্যত নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চলছে আর শিক্ষকরা নির্বিকার থাকবেন?
- আরে বাবা, কাজটা তো আমাদের না। কমিটির। এটা যদি মহেন্দ্রবাবুর ক্ষমতার মধ্যে পড়ত তাহলে নিশ্চয়ই কিছু করতে পারতাম। এখন যে আমাদের হাতের বাইরে সেটা তো তোদের বোঝা উচিত।
- ম্যানেজিং কমিটিতে একটা মাফিয়া ক্যাবাল আছে। যা ইচ্ছে তাই প্রস্তাব আনে আর পাশ করে।
- অভিভাবকদের বলিস না কেন কমিটির মীটিংগুলোতে আসতে? তখন তো কারো টিকি দেখা যায় না।
বিদিশার মা কলেজের অধ্যাপিকা। সে অনুযোগ করে বলল – স্যার আমার মা দু-একবার গিয়েছে মীটিংয়ে। সত্যি বলছি ওদের পুরোনো ঘোঁট। কোনো কিছুতে প্রতিবাদ করতে গেলে একজোট হয়ে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করে। পঞ্চাশ-ষাট বছরের বয়স্ক লোকেদের মুখ থেকে কদর্য কথা শুনতে কারো ভালো লাগে? আমার তো বাবা নেই, মা’কে কতবার ওই নোংরামিতে যেতে বলব?
আমার মা’ও একই অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছে। মামা একবার অফিস ফেরত গিয়েছিল এবং প্রশ্ন করেছিল দিল্লীর বেশির ভাগ বাঙালি যখন বাঙাল তখন ইস্কুলে পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষায় কেন তালিম দেওয়া হয় না। সেবার একটাই প্রস্তাব পাশ হয়। মামাকে ডিসরাপ্টিভ বলে ছমাসের জন্য বহিষ্কার। যার মামা স্কুল থেকে বহিষ্কৃত তার জোর কতটুকু?
হাতের চেটো উপর দিকে করে প্রশান্তবাবু বললেন – ডেমোক্রেসি। পার্লামেন্টের ভিতর জামা ছেঁড়াছিঁড়ি হয় জানিস না? নইলে নেতারা এত খরচ করে মোটা খদ্দরের কোর্তা পরে কেন? হাসিমুখে কাদা না মাখতে পারলে গণতন্ত্রের আনন্দ উপভোগ করা যায় না, ভাই। গান্ধীজীও আগে চোস্ত কাটের কোট-প্যান্ট পরতেন। জন্মভূমিতে ফিরে আসার পর ডেমোক্রেসি আটকানো যাবে না বুঝতে পেরে মনের দুঃখে জামা পরাই ছেড়ে দেন।
- হোয়াট ডু ইয়ু মীন? গান্ধীজী ডেমোক্রেসি চাননি? তর্কতোপ রেশমী সিন্হা তেরিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে।
- আমি কিছুই বলছি না। হাত জোড় করে বললেন প্রশান্তবাবু। - ইংরেজদের দফা করে গান্ধীজী দেশে রামরাজ্য আনতে চাননি? তো রামতন্ত্র আর গণতন্ত্র কি এক জিনিস? তোরাই আমায় বুঝিয়ে দে বাবা।
সবাই চুপ মেরে গেলাম। রামরাজ্য মানে কী বোঝাতে কারো ইচ্ছে নেই। মেয়েদের কেউ কেউ প্রসঙ্গটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মাথা নাড়িয়ে ‘ঠিক, ঠিক’ বলল।
প্রশান্তবাবু আমাদের নিভে যেতে দেখে দয়াপরবশ হয়ে বললেন – দাঁড়া, আমি ক্লাসের পর মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে কথা বলি। প্রবুদ্ধ, তোর বাবা তো কমিটিতে আছেন। উনি কিছু করতে পারেন না?
প্রবুদ্ধ সকালের পর থেকে মৌন ধরেছে। সে এমন নিরুত্তাপ গলায় বলল ‘দেখি’ যে আমাদের কারো ভরসা হল না সে কিছু করবে।
প্রশান্তবাবুর ক্লাস শেষ হল। আমরা বারান্দায় বেরিয়ে এসে পায়চারি করছি। সাদা গাড়িটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মলয় রক্ষিতের কোনো পাত্তা নেই। টুয়েল্ভের ছেলেমেয়েরাও ক্লাস থেকে বেরিয়ে আমাদের দিকে দাঁত বের করে দেখাচ্ছিল। তাদের পিছন থেকে মনীষা আমার দিকে টর্চের মতো দুটো উজ্জ্বল চোখের মণি তাক করে রাখে। মানে - দেখলি তো? বলেছিলাম মিটমাট করে নে। পাকামি করে শুনলি না, এবার ফল ভোগ কর। মলয় এই জন্মপাজি মেয়েটার নাকের ফুটো ধরে টেনেছিল বলে আমার একসময়ে বেশ লজ্জা হয়েছিল। এখন সেই লজ্জাটা উড়ে যায়।
রক্ষিতকে হয়তো এর মধ্যেই বার করে দেওয়া হয়েছে বলে যখন নিজেদের মধ্যে জল্পনা করছি তখন একটা অভাবনীয় কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছিল চোখের সামনে। সিঁড়ি দিয়ে লাইন করে উঠে এল প্রথমে পরেশ। তার হাতে রক্ষিতের স্কুলব্যাগ। তার পিছনে গম্ভীর মুখে মলয় রক্ষিত। তারপর জয়কিশোর। এ পর্যন্ত ঠিক যে অনুক্রমে মিছিলটা গিয়েছিল সেভাবেই ফিরেছে বুঝলাম। কিন্তু তার পর এক এক করে আরো মাথা দেখা যেতে শুরু করেছিল। প্রথমে এলেন সেই সাদা গাড়ির মোটাসোটা ভদ্রলোক, বিদিশার মতে যিনি দিল্লীর এক নম্বর বদমাইশ বাঙালি। তাঁর সঙ্গে যে লোকটা হাঁটছিল সে নিশ্চয়ই ড্রাইভার, কারণ এর আগে তাকে আমরা কেউ দেখিনি। তারপর মহেন্দ্রবাবু এবং সবার পিছনে আরো দুজন চাপরাসি। চাপরাসিদের মধ্যে একজন মহিলা, যার নাম দ্রৌপদী। পঞ্চপাণ্ডবের ভাগের বউ দ্রৌপদীর নাম আমি বিশেষভাবে মনে রেখেছিলাম। কারণ এই নামটা বাঙালিদের মধ্যে একেবারে দেখা যায় না, অথচ উত্তরভারতের গ্রামাঞ্চলে দুর্লভ নয়।
প্রবুদ্ধ এতক্ষণ পরে আমার কানে কানে বলল – ফৌজ এসে গেছে। চোর ধরবে।
কে চোর? কীসের চোর? ভাবছি, আর কিছুই বুঝছি না।
আমাদের ক্লাস করিডরের শেষে। টুয়েল্ভের ছেলেমেয়েরা দুদিকে সরে জায়গা করে দিয়েছে। তাদের মাঝখান দিয়ে গট গট করে পরেশ ক্লাসে ঢুকে রক্ষিতের ব্যাগটা যথাস্থানে রাখে। মনীষার বদমাইশ জ্যাঠা আমাদের পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন এবং টিচারের চেয়ারটা নির্লজ্জভাবে দখল করলেন। মহেন্দ্রবাবু আমাদের বললেন – এসো, আমরা ক্লাসে ঢুকি।
সবাই গিয়ে নিজের নিজের সীটে বসলাম। মনীষার জ্যাঠামশাই কারো অনুমতি ছাড়া চাপরাসিদের হুকুম দিলেন – সার্চ করো।
মহেন্দ্রবাবু রুমের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি বললেন – সারপ্রাইজ়! ব্যাগ চেক করে দেখা হচ্ছে ফল কাটার চাকু আছে কিনা। আশা করি সবাই একটা করে এনেছ। যারটা সবচেয়ে ভালো তাকে একটা পুরস্কার দেওয়া হবে। এই বলে নিজের দুর্ভিক্ষপীড়িত ঠাট্টায় নিজেই হিউ-হিউ করে কার্টুনের মতো হাসতে লাগলেন।
সবার সঙ্গে আমিও বসে ভাবছি ব্যাপারটা কী? চাকু থাকলে তো রক্ষিতের থলেতেই থাকার কথা। সেটা এখনো পাওয়া যায়নি কেন? তাহলে কি আইটেমটা আজকে ছুরি আনেনি? কিন্তু সে পান্টার খবর পেল কী করে?
সবার ব্যাগ খোলা হচ্ছে। মেয়েদেরও ছাড়া হবে না। দ্রৌপদীকে আনা হয়েছে সে জন্য। সে একটা করে জিনিস বার করে মনীষার বদমাইশ জ্যাঠামশাইকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। মেয়েরা প্যাঁচার চেয়ে অসন্তুষ্ট মুখে বসে রইল। কাজটা অবশ্য মোটামুটি তাড়াতাড়িই এগোচ্ছিল, কারণ কারো কাছে আপত্তিকর কিছু নেই। ভাগ্য ভালো আমি কোনো ফিল্মী গানের বই নিয়ে আসিনি সেদিন, নইলে সবার সামনে অপদস্থ না করে জ্যাঠামশাই ছাড়তেন না। প্রবুদ্ধর ব্যাগে যখন হাত পড়ল তখন সে হাতটাকে আটকে দিয়ে গমগমে গলায় জানাল – এটা মলয় রক্ষিতের সমস্যা। তার জন্য আমার ব্যাগ ঘাঁটার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? শুনে বদমাইশ জ্যাঠা তড়াং করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন – ওই চ্যাংড়ার ব্যাগটা এখানে নিয়ে এসো তো। ওটা আমি নিজে দেখব।
ক্যানভাসের দুর্দান্ত ব্যাগ। অনেকগুলো খোপ। প্রবুদ্ধ সবকটা খোপে যতটা সম্ভব টাইট করে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে রেখেছে। ফটাস ফটাস করে সব খোলা হতে লাগল। আমার মনে গুড় গুড় করে একটা মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মনীষার জ্যাঠা ব্যাগটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। তারপর সমস্ত বই খাতা উপুড় করে ডেস্কের উপর ফেলে টিপে টিপে তার লাইনিং পরীক্ষা হল। আপত্তিকর বলতে কলেজের স্তরের দুটো পদার্থবিদ্যার বই বেরিয়েছে। প্রায় সাত আট মিনিট ধরে চলার পর যখন অনুসন্ধান সমাধা হল তখনো আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছিল।
শেষ পর্যন্ত একজনের ব্যাগেও যখন বিপজ্জনক কিছু পাওয়া গেল না, মহেন্দ্রবাবু বিমর্ষ মুখ করে বললেন – ছি, ছি, ছি। তোমাদের কারো বাড়িতে একটা হাফ-কাঁচি অবধি নেই? আমাদের সময় হলে গোটা পাঁচেক ক্ষুর অন্তত পাওয়া যেত। কী করতে যে স্কুলে আসো! ধুস্, এরকম গোবেচারা ভেতো বাঙালিদের মধ্যে আর এক মুহূর্তও থাকা যাচ্ছে না। আমি চললাম।
তারপর আর কী? মহেন্দ্রবাবু বুক ফুলিয়ে চাপরাসিদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মনীষার জ্যাঠা কী করবেন বুঝতে পারছেন না। জয়কিশোর সকলকে শুনিয়ে পরম হিতকাঙ্ক্ষীর মতো তাঁকে বলল – বাথরুমটা চেক করবেন স্যার? ছুরি-কাঁচি লুকোবার ভালো ভালো জায়গা আছে সেখানে। প্যানে ফেলে থাকলে আটকে যাবে। পরে বের করে ধুয়ে নিলেই হল। পরামর্শটা শোনার পর ধুতি পাঞ্জাবী পরা স্কাউণ্ড্রেলটির কাঁধ এক ফুট ঝুলে পড়েছিল, কারণ ছেলেদের বাথরুমের পরিবেশ খুব অস্বাস্থ্যকর এবং আমার মামার ভাষায় স্কুলের ওয়ান-পাইস-ফাদার-মাদার ম্যানেজিং কমিটিই সেটাকে বছরের পর বছর সারায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার পর তিনি গোমড়াথেরিয়ামের রূপ ধরে ক্লাস থেকে প্রস্থান করলেন।
যাত্রার পার্টিটা নিষ্ক্রান্ত হবার পর আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি আর বলছি – হলটা কী? উত্তর কারো কাছে নেই। মলয় রক্ষিত নিজে বোকা বোকা একটা হাসি হাসছিল। যেন সে একটা কিছু বলতে গিয়েও চেপে দিয়েছে।
ঘরে ঢুকে আগে দেখে নিলাম আর কেউ আছে কিনা। তারপর চোখ নাচিয়ে শুধোলাম – কী হল বলো তো আজ? আমরা কিস্সু বুঝতে পারিনি।
জয়কিশোর খ্যাঁক খ্যাঁক করে হায়েনার মতো হেসে বলল – তোকেই তো বলেছিলাম মলয়কে সাবধান করে দিতে। ভাগ্যিস চাকু টাকু সে আনেনি। আমি তো আশা করেছিলাম স্কুলেই আসবে না।
- জয়কিশোরজী, আমি কিছু করতে পারিনি। মলয়ের ঠিকানা ছিল না আমার কাছে।
দেখলাম জয়কিশোরের মুখ থেকে হাসি মুছে গেছে। একটু চিন্তিত হয়ে গিয়ে সে বলল - ছিল না? নিজের ক্লাসের ছেলে কোথায় থাকে জানিস না, কী বেওকুফিয়া গাণ্ড্ফোড়ু রে তুই? তার মানে অন্য কেউ ওকে খবরটা দিয়েছে।
এত খারাপ ভাষা এই লোকটার যে শিমলিপুরের বখাটে ছেলে হয়েও আমার দু-কান লাল হয়ে যায়। মনে মনে বললাম কিশোরজী, এতই যদি তুমি চালাক তো ঠিকানা আমার কাছে আছে কিনা জেনে নাওনি কেন? মুখে বললাম - খবরটা কীসের?
- সার্চের। আবার কীসের? প্রিন্সিপালের অফিসে সকালে ওর ব্যাগ খোলা হয়েছে। আমি আর পরেশ সাক্ষী হিসেবে ছিলাম। চাকুটাকু নেই সেটা প্রথমেই বোঝা গিয়েছিল। ম্যানেজিং কমিটির বিজনবাবু বললেন কী বই আনছে স্কুলে একটু দেখি। মহাত্মা গান্ধীর একটা ইংরেজি বই বেরোয় আগে। সেটা আবিষ্কার করার পর মহেন্দ্রবাবু রক্ষিতকে সবার সামনে বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়েছিলেন। দেখে তো বিজনবাবু চটে ব্যোম। আরেকটু ব্যাগ ঘাঁটা হল। এবার বেরোল যুব কংগ্রেসের হ্যাণ্ডবুক। ভয় পেয়ে সবাই বলল আর নয়, ব্যাগ বন্ধ করো। তারপর খুচরো কথাবার্তা হচ্ছিল। সেই কথাবার্তার মাঝখানে বিজনবাবুর মাথায় আসে চাকুটা তাহলে ক্লাসের অন্য কারো কাছে পাচার হয়ে গেছে।
জয়কিশোর আমায় বলল – শোন হিজড়ার লওড়া, খবরটা রক্ষিতকে যেই দিয়ে থাকুক, তুই এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরে আর কাউকে কিছু বলিস না। সার্চের খবরটা গোপন রাখার কথা ছিল, সেটা তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছিস। আর বহনচোদ রক্ষিতটাকে বুঝিয়ে দে, এটাই ওর লাস্ট চান্স। ওরকম ষাঁড়ের নাদার জন্য আমরা আরেকবার চাকরির রিস্ক নেব না।
মনে একটুও সন্দেহ ছিল না যে সার্চের খবরটা আমার কাছেই লীক্ হয়েছিল মহেন্দ্রবাবুর অফিস থেকে। জয়কিশোর নামের দোপেয়ে প্রাণীর কাঁধে চেপে।
আন্দাজ করেছিলাম গান্ধীজীর লেখা ইংরেজি বইটা হল দ্য স্টোরি অফ মাই একস্পেরিমেন্ট্স্ উইথ ট্রুথ। এরকম একটা সদ্গ্রন্থের লেজও রক্ষিতের ব্যাগে থাকার কথা নয়। জিনিসটা অবশ্য আমি একজনের বাড়িতে দেখেছি। সেই ধুরন্ধরের নাম হল মাস্টার প্রবুদ্ধ। প্রবুদ্ধর বই রক্ষিতের ব্যাগে কখন ঢুকল? তখনই কি ফল কাটার ছুরিটা সেখান থেকে বিয়োগ হয়? পরে আমি ভেবেচিন্তে বার করি যে যখন ক্লাসসুদ্ধু সবাই মনীষার জ্যাঠার গাড়ি দেখার জন্য বারান্দা থেকে বাঁদরের মতো উঁকি মারছিলাম তখন একা প্রবুদ্ধ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। রক্ষিতের ব্যাগে হস্তক্ষেপ করার সেটাই ছিল একমাত্র সুযোগ।
প্রবুদ্ধর কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যাবে না বলে আমি কোনোদিন তাকে এই প্রশ্নগুলো করিনি। রক্ষিত এর পর ফল কাটার ছুরিটা আনত না। হয়তো সেটা তার কাছে ফেরত এসেছিল। হয়তো আসেনি। হাইস্কুলের উধাও দিনগুলোর সঙ্গে কিছু রহস্যও কুয়াশায় মিলিয়ে যায়। গোয়েন্দা পুলিশের মতো তাদের পিছনে ধাওয়া করতে ইচ্ছে হত না আমার।
মুডের সুইচ অফই থাকে আজকাল। বললাম – স্যার, এই স্কুলের ইতিহাসে সবচেয়ে মন্দ ক্লাস আমরা। কেউ ভালো বলে মনে রাখবে না। আমাদের মুখ ব্যাজার হবে না তো কার হবে? আর যে কটা দিন আছে কষ্ট করে দেখে যান। কয়েক মাসের ব্যাপার।
মহেন্দ্রবাবু একটুও না ভেবে বললেন – নন্সেন্স! মন্দ হবার ধারে কাছেও নেই তোরা। তোর দাদার ক্লাসের মতো ভদ্র না হলেও একটা বিষয়ে তোরা লাস্ট টেন ইয়ার্সে সবার চেয়ে এগিয়ে। সেইজন্য টিচাররা তোদের এত পছন্দ করেন।
মহেন্দ্রবাবু ঠাট্টা করছেন নাকি? জিজ্ঞেস করলাম – স্যার, সবাই বলে আমরা বোরিং। আমাদের টিচাররা পছন্দ করতে যাবেন কেন?
- বিকজ ইউ আর দা লীস্ট মেটেরিয়ালিস্টিক বাঞ্চ অব দেম অল। তোদের বস্তুজগতের প্রতি আকর্ষণ অন্য শ্রেণীগুলোর চেয়ে কম। মহেন্দ্রবাবু আমার কাছে এসে গলা নামিয়ে বললেন – তোকে একটা প্রাইভেট রিকোয়েস্ট করতে পারি?
আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য প্রকৃতপক্ষে ভয় করেছিলাম মহেন্দ্রবাবু বলবেন রক্ষিতের বাবাকে যে ভাবে হোক স্কুলে নিয়ে আয়। তার বদলে তিনি বললেন – যাবার আগে স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য একটা স্তরের লেখা দিয়ে যা।
স্তরের লেখা! চার বছর ধরে এত পরিশ্রমের পর শুধু কাগজ নোংরা করেছি তাহলে?
অতল তমসার মধ্যে পড়ে যেতে যেতে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বললাম – স্যার, এতগুলো লেখা প্রকাশ হয়েছে আমার, একটাও স্তরের হয়নি?
- হবে না কেন? হয়েছে। হয়েছে। সেই যে ডাণ্ডী মার্চের আগের দিন গান্ধীজীর লাঠি চুরি যাওয়া নিয়ে গল্পটা লিখেছিলি সেটা তো কেউ মন্দ বলেনি। লাঠি ব্রিটিশ জাহাজ থেকে উদ্ধার করা গেলেও বুটজোড়া পাওয়া যায়নি, ফলে গান্ধীজী ‘দূর ছাই’ বলে খালি পায়েই বেরিয়ে পড়েন। কী এমন খারাপ প্লট?
আরো গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলি - স্যার, ওটা গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। আমার বড়োমামার কাছ থেকে শোনা। সে যুগে প্রকাশ করলে সিডিশানের অভিযোগে জেলে যেতে হত। তাই বড়োমামা স্টেট্স্ম্যানে পাঠাতে পারেননি। আমাকে অনুরোধ করেছিলেন ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে লিখে রাখতে।
মহেন্দ্রবাবু বললেন – লাঠিসোটার গল্প রাবিশ বলছি না। কিন্তু এবার সত্যিকারের মানুষ নিয়ে একটা গল্প দিয়ে যা। মানুষের মতো মানুষ।
মহেন্দ্রবাবু নিজে ছদ্মনামে মাথামুণ্ডুহীন থ্রিলার লেখেন। যার একটা চরিত্রও বিশ্বাসযোগ্য নয়। জানতে চাইলাম - মানুষের মতো মানুষ মানে?
- মানে তোরা! তোদের ক্লাস। নিজেদের নিয়ে একটা বাস্তব ঘেঁষা গল্প। ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই লেখ। পরের ক্লাসগুলো তোদের আদর্শ জানুক।
আকাশ থেকে পড়ি। - আমাদের আদর্শ? সেটা আবার কী?
- আমি কী করে বলব? মহেন্দ্রবাবু মাথা চুলকে বললেন। - বস্তুজগতের প্রতি যাদের আকর্ষণ নেই তারা কী চায়? এইটা তোকে গল্পের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
- হয়তো আমাদের ক্লাসের সবাই জাস্ট আলসে। যারা কিচ্ছু চায় না।
মহেন্দ্রবাবু জোরের সঙ্গে তর্জনি নাড়িয়ে বললেন - কিচ্ছু চায় না কখনো হয় না। সবাই কিছু চায়, কিছু খোঁজে। ভালো করে তাকালে দেখবি যেটাকে শূন্যতা বলে মনে হচ্ছিল আসলে তার ভিতরে রয়েছে একটা অন্য কিছু।
- স্যার, শূন্যতার মধ্যে কী করে অন্য কিছু দেখতে হয় আমি বুঝি না।
তো মহেন্দ্রবাবু, প্রিন্সিপাল এবং আমাদের ইস্কুলের কালচারের প্রথম ধারক, আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে সত্বর কেটে পড়ার আগে বললেন – শাবাস! আমার দিকে চেয়ে না থেকে নিজে ভাব। কারণ আমিও বুঝি না।
ব্যাস্, আর কী?
সেখান থেকে সব গল্পের শুরু।