শাস্ত্রে আছে ‘গানাৎ পরতরং ন হি’, অর্থাৎ কিনা গানের চেয়ে বড়ো আর কিছু নেই। তার প্রমাণ তো আদি যুগ থেকেই। নারদের গান শুনে ভগবান বিষ্ণু বিগলিত হতে শুরু করেছিলেন, যার থেকে উৎপত্তি সুরধুনী গঙ্গার। তানসেন মল্লার ধরলে বৃষ্টি নামত। তাঁর গুরু হরিদাস গোস্বামী গান গাইলে বনের পশুপাখিরা স্তব্ধ হয়ে শুনত। আবার, ইদানীংকালে রক গানের তালে তালে হাজার হাজার শ্রোতাকে উত্তাল হয়ে উঠতে দেখা যায়। সবই গাইয়ের এলেম। গাইয়ে যখন কাশীনাথের মতো ওস্তাদ, তখন তিনি কন্ঠে সাতটি সুরকে পোষাপাখির মতো খেলিয়ে সভাগৃহ মন্দ্রিত করে আমজনতার সমীহ আদায় করেন। আবার, বৃদ্ধ বরজলালের ক্ষীণ কণ্ঠের সূক্ষ্মতাকে অনুভব করতে পারেন রাজার মতো কতিপয় শ্রোতা, তাঁরা জানেন –
একাকী গায়কের নহে তো গান, মিলিতে হবে দুইজনে –
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা, আরেকজন গাবে মনে।
এ তো গেল সেইসব গাইয়ের কথা যাঁরা শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে জানেন বা পারেন। এঁদের পাশাপাশি এমন গাইয়েও তো আছেন যাঁদের কথা ভেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও লিখতে হয়েছিল –
পায়ে পড়ি, শোনো ভাই গাইয়ে,
মোদের পাড়ার থোরা দূর দিয়ে যাইয়ে।
ভীষ্মলোচন শর্মার গানের গুঁতোয় শূন্যমাঝে পক্ষীকে ডিগবাজি খেতে হয়েছিল, আর পাড়ার লোককে সমস্বরে বলতে হয়েছিল ‘আর না দাদা, গানটা থামাও, লক্ষ্মী!’
অনুমান করতে পারি, এইসব গাইয়ের বাসনা ছিল ওস্তাদ হয়ে ওঠার। তাই তাঁদের সুরসাধনার জন্যে স্বরতন্ত্রীর এ-হেন পরিশ্রম, শুধু পড়শিরা বেরসিক হবার কারণে যত বিপত্তি। এরকমই কোন এক গাইয়েকে উদ্দেশ্য করে লেখা এক গান –
গানে ক্ষান্ত দাও হে ভ্যাবাকান্ত –
তব তান শুনে তানসেন লুঙি ফেলে ভেগে যায়
পড়শিরা বেঁকে যায় রাগে বঁড়শির প্রায়;
ধরিয়া সুরের কাছা করিছ গামছা-কাচা
বেচারি সুরের যেন করিছ বাপান্ত।
‘দাদাঠাকুরের’ জীবনীকার বিখ্যাত হাস্যরসিক নলিনীকান্ত সরকার একবার রেডিয়োতে গেয়েছিলেন
ভেড়ার গোয়ালে আগুন লেগেছে
বহে পশ্চিমে হাওয়া,
শুনি নাই কভু শুনি নাই
এমন বিকট গাওয়া।
গানটি রবীন্দ্রনাথের একটি জনপ্রিয় গানের নিরীহ লালিকা বা প্যারডি। উদ্দেশ্য, শ্রোতাদের কিছু নির্মল আনন্দদান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, নলিনীকান্তের অনুষ্ঠানের ঠিক আগেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত পেশ করে গেছেন এক ওস্তাদজি। এই গান শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি মানহানির মামলা করবেন বলে শাসিয়ে চিঠি লিখলেন। আকাশবাণীর পরিচালকরা তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে ব্যাপারটাকে সামাল দিতে পেরেছিলেন।
ওস্তাদের প্রসঙ্গই যখন উঠল তখন শরৎচন্দ্রের সেই বিখ্যাত উক্তির কথা স্মরণ করা যাক। একদিন তাঁর পরিচিত কেউ এসে বললেন সন্ধ্যায় এক ওস্তাদ গাইবেন কোন অনুষ্ঠানে, খুবই ভাল গান করেন, শরৎবাবু সেখানে যাবেন কিনা। শরৎচন্দ্র তখনই প্রশ্ন করলেন, ‘বলছ তো ভালো গায়, থামতে জানে তো?’ থামতে জানাটা অবশ্যই জরুরি, না হলে অনেক রসিক শ্রোতারও ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে। কোন এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গাইছেন এক গাইয়ে। ঘর মোটামুটি ভর্তি। উৎসাহ পেয়ে গাইয়ে গেয়েই চলেছেন। এরই মধ্যে একজন দুজন করে লোক উঠতে শুরু করেছে। তবু গাইয়ে নিরুৎসাহ নন। শেষ পর্্যন্ত দেখা গেল হলঘরের এককোণে শুধুমাত্র একজন লোক বসে আছে। গান শেষ করে গাইয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমার খুবই আনন্দ হচ্ছে যে একজন যথার্থ শ্রোতা পেয়েছি।’ লোকটি খুবই কাঁচুমাচু ভাবে জানাল যে-শতরঞ্চির উপর বসে গাইয়ে গাইছেন সেটা তার।
ওস্তাদ গাইয়ের কাছে গান শেখার জন্যে হবু গাইয়েদের আনাগোনা। এদিকে আবার বেশির ভাগ ওস্তাদই তাঁর নিজের ঘরানা আর গায়কির বাইরে অন্যদের বিশেষ পাত্তা দিতে চান না। কেউ কেউ তো অন্যদের নস্যাৎ করে দিয়ে কিঞ্চিৎ আত্মশ্লাঘা অনুভব করেন। এমনই এক ওস্তাদের কাছে দুজন অর্বাচীন এসেছে গান শিখতে। ওস্তাদ জানতে চাইলেন তাদের গানের শিক্ষা কতদূর। একটি ছেলে জানাল তার কোন পাঠই নেই সঙ্গীতে, অন্যজন জানাল কোন এক ওস্তাদের কাছে সে বছ্রর দুয়েক তালিম নিয়েছে। ওস্তাদজি বললেন তিনি দুজনকেই শেখাবেন, তবে দ্বিতীয়জনের কাছ থেকে দ্বিগুণ দক্ষিণা নেবেন। দ্বিতীয়জন তো হতবাক। তার গর্ব ছিল কিছুটা গান শিখেছে বলে। ওস্তাদজি তখন ব্যাখ্যা করে বললেন, সে যেসব ভুল শিখে এসেছে সেগুলো ভুলিয়ে তাকে নতুন করে তৈরি করতে হবে, এতে মেহনত দ্বিগুণ, তাই দক্ষিণাও দ্বিগুণ।
গাইতে বসে গলা ছেড়ে গাইবেন নাকি মাইক ফিটিং গলায় গাইবেন সেটা গায়কের নিজস্ব পছন্দ।এর সঙ্গে তাঁর তালিমের ব্যাপারটাও জড়িত। অঙ্গভঙ্গি করবেন কি করবেন না সেটাও তাঁরই ব্যাপার্। ষাটের দশকে যাঁরা উদীয়মান তারকা ভীমসেন জোশীর গান সামনে বসে শুনেছেন তাঁরা মনে করতে পারবেন গানের তান আর বিস্তারের সঙ্গে তাঁর হাত এবং মুখের ভঙ্গির অনর্গল বদলে যাবার দৃশ্য। আমার এক সুরসিক সহপাঠী তার বর্ণনা দিয়েছিল যে জোশীজি শূন্য থেকে সুর ধরছেন, কাটছেন এবং কিমা বানাচ্ছেন। আবার, আমির খাঁ সাহেব গেয়ে যেতেন প্রায় নিশ্চল ধ্যানের ভঙ্গিমায়। এমনকি তাঁর তারানাও ছিল শান্ত মেজাজের। নিসার হোসেন খাঁ সাহেব তারানায় রেলগাড়ি ছোটাতেন। যিনি যে ভাবেই পেশ করুন না কেন শ্রোতাদের সঙ্গে একাত্মতা একটা তৈরি হতই, আর শ্রোতারা ‘ওহাহ্’ ‘ওহাহ্’ বলেই হোক, হাততালি দিয়েই হোক কিংবা নীরবেই হোক, তাঁদের গান আর গায়কির তারিফ করতেন। বরেণ্য দুই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীকে দেখেছি যাঁদের একজন নিজেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে উদাত্ত ভঙ্গিমায় একের পর এক গান গেয়ে যেতেন স্মৃতি থেকে, অন্যজন হারমোনিয়াম ছুঁতেন না, কিন্নরকন্ঠে উজাড় করে দিতেন গীতিমাধুরী্ অন্যের সঙ্গতে, চোখ কিন্তু নিবদ্ধ থাকত হাতের গীতবিতান কিংবা খাতার দিকে।
এতো গেল ওস্তাদ গাইয়ে, মাঝারি ওস্তাদ গাইয়ে আর হবু ওস্তাদ গাইয়েদের কথা। সবাই তো আর গান গেয়ে ওস্তাদ হতে পারবে না, আর হতে চায়ও না। পাড়ায় একটু গাইয়ের তকমা পেলেই খুশি, কিংবা গান করে নিজের একটু তৃপ্তিলাভ। ভীষ্মলোচন শর্মা হয়তো এই দ্বিতীয়টাই চেয়েছিলেন, স্বরগ্রাম কিঞ্চিৎ উচ্চ হওয়াতেই বিপত্তি। কিন্তু কেউ যদি সমুদ্রযাত্রার সান্ধ্য অবসরে জাহাজের ডেকের উপর বসে একটু গলা খুলে গান ধরে তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় কি? অথচ শরৎচন্দ্র শ্রীকান্তকে দিয়ে মন্তব্য করিয়েছেন ঃ ‘শুনিয়াছি, ইংরাজের মহাকবি সেক্সপীয়র নাকি বলিয়াছিলেন, সঙ্গীতে যে মুগ্ধ না-হয়, সে খুন করিতে পারে, না, এমন কী একটা কথা। কিন্তু মিনিটখানেক শুনিলেই যে মানুষের খুন চাপিয়া যায়, এমন সঙ্গীতের খবর বোধ করি তাহাঁর জানা ছিল না।…না হইলে, কাবুলিওয়ালা গান গায়, একথা কে ভাবিতে পারে?’ কাবুলিওয়ালা তার দেশোয়ালি গান নিজের মতো করে গাইতেই পারে, কিন্তু ভাবা যাক সেই সব অভাজনদের কথা যারা হৃদয়ের কথা গাহিতে ব্যাকুল, অথচ গাইতে গেলেই যাদের প্রাক্বরপ্রাপ্তি পর্বের গুপি গায়েনের মতো তৃতীয় স্বরের জায়গায় ষষ্ঠ স্বর লাগে। রবীন্দ্রনাথ তাদের কথাও ভেবেছিলেন, আর লিখেছিলেন –
বান্ধবীকে গান শোনাতে ডাকতে হয় সতীশকে,
হৃদয়খানা ঘুরে মরে গ্রামোফোনের ডিস্কে।
কণ্ঠখানার জোর আছে তাই লুকিয়ে গাইতে ভরসা না পাই –
স্বয়ং প্রিয়া বলেন তোমার গলা বেজায় রুক্ষ।
আমাদের আর কী বলার আছে!