• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • সামনের স্টপ : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

    ইউনিভার্সিটি ক্যামপাসে কোনও খবরই চাপা থাকে না। আর সে খবর যদি মুখরোচক হয়, তা হলে তো আর কথাই নেই, দাবানলের মতো হু-হু করে ছড়িয়ে পড়ে। বিকেলবেলা ক্যানটিনে কফির টেবিলে গিয়ে শুনলাম প্রোফেসর পশুপতি রায়ের সঙ্গে তাঁর তরুণী ছাত্রী রায়া সিনহাকে নাকি যথেষ্ট আপত্তিজনক অবস্থায় দেখা গেছে। রায়া প্রোফেসর রায়ের কাছে পিএইচডি করে। লাঞ্চ পিরিয়ডে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট গোবিন্দ তাড়াহুড়োয় দরজায় নক না-করে প্রোফেসরের কেবিনে ঢুকে পড়েছিল। দেখে কী, রায়া স্যরের কোলে বসে তাঁকে কাঁটাচামচে গেঁথে আপেল খাইয়ে দিচ্ছে। গোবিন্দ জানে ক্যানটিনের খাবার স্যরের মুখে রোচে না। স্যরের স্ত্রী নিজে ভালমন্দ রান্না করে লাঞ্চবক্স ভরে পাঠিয়ে দেন, সঙ্গে ফলমূল। লাঞ্চের পরে রকমারি ফল খাওয়া স্যরের বহু কালের অভ্যেস। গোবিন্দ দেখেছিল বটে সামনে টেবিলে একখানা অর্ধেক খাওয়া ফলের প্লেট পড়ে আছে। তাতে আঙুর আর বেদানাও ছিল। তবে সে রায়াকে অন্য কোনও ফল নয়, শুধু আপেল খাওয়াতেই দেখেছে। এবং তৎক্ষণাৎ জিভ কেটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

    দেবস্মিতা রাগত গলায় বলল, “এই পারভার্টগুলোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। মেয়েটাও বলিহারি…”

    কিংশুক মাথা নেড়ে বলল, “কিস্যু হবে না, রায়-সাহেব ডাইরেক্টরের পা-চাটা লোক, ঠিক চেপে দেবে।”

    অরুণাংশু মুখে চুকচুক শব্দ করে বলল, “স্যরের ঘরে কি চেয়ার ছিল না? মেয়েটা আর বসার জায়গা পেল না?”

    “দেখ অরুণ, সব বিষয়ে ফাজলামি ভাল লাগে না,” দেবস্মিতা কটমট করে তাকাল। আমরা সবাই পিএইচডি স্কলার। আমি অ্যাস্ট্রোফিজিক্স, কিংশুক আর অরুণাংশু কেমিস্ট্রি। দেবস্মিতা বায়োকেমিস্ট্রি, দেখতে-শুনতে মন্দ নয়, কিন্তু ভয়ানক রাগী স্বভাবের মেয়ে। মুখটা সব সময় পাথরের মতো কঠিন করে রাখে। আমার খুব ইচ্ছে করে কোনও পূর্ণিমার রাতে ওকে একবার আমাদের হোস্টেলের ছাতে টেনে নিয়ে যাই। কাছ থেকে নজর করে দেখি জ্যোৎস্না পড়ে ওর মুখের শক্ত রেখাগুলো নরম হয়ে আসে কি না। জানি সেটা কোনওদিনই সম্ভব হবে না। ছেলেদের হোস্টেলে মেয়েদের ঢোকা বারণ। কবে যে আমরা সাবালক হব!

    কিংশুক বলল, “কেউ অফিসিয়াল কমপ্লেইন না করলে কোনও অ্যাকশন হবে না।”

    আমি বললাম, “কে আর কমপ্লেইন করবে? রায়-রায়া দু’জনেই তো সুবিধেভোগী। বাকি রইল গোবিন্দ…”

    কিংশুক কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার কথা উড়িয়ে দিল, “গোবিন্দ চুনোপুঁটি, ওর কথা কে বিশ্বাস করবে?”

    দেবস্মিতা অসহিষ্ণু গলায় বলল, “তাই বলে লোকটা পার পেয়ে যাবে?”

    অরুণাংশু হাত তুলে বলল, “মেয়েটা যদি নিজের ইচ্ছায় ফল খাওয়ায় কার কী বলার আছে?”

    কিংশুক অরুণাংশুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “খাওয়াক না। প্রোফেসরের ঘরে গিয়ে খাওয়াক। দিঘা মন্দারমনিতে হোটেল

    ভাড়া করে সেখানে গিয়ে খাওয়াক। আমরা দেখতে যাব না। কিন্তু ইউনিভার্সিটি ক্যামপাসে বসে নোংরামি করাটা বেআইনি, সেটা তো মানবি?”

    অন্য দিন সৌম্য সবার আগে এসে টেবিলে বসে থাকে। আজ তার পাত্তা নেই। আমরা সবাই যে হোস্টেলে থাকি এমন নয়, যাদের দূরে বাড়ি তারাই শুধু… বাকিদের ফেরার তাড়া থাকে। যেমন সৌম্য থাকে সোনারপুরে। কিংশুক নিউ টাউনে। ওরা কফি শেষ করেই দৌড় দেয়। আজকের আলোচনাটা লাট খেয়ে বেড়েই যাচ্ছিল। চোখে পড়ল সৌম্য ক্যানটিনের দরজা দিয়ে ঢুকছে। হাত তুলে ডাকলাম। কাউন্টার থেকে কফি নিয়ে সৌম্য টেবিলে এসে বসল। জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, কোথায় ছিলি?”

    সৌম্য বলল, “হাসপাতালে… দুপুরবেলা পেশেন্ট নিয়ে গেছি, এতক্ষণে অ্যাডমিট করল।”

    আলোচনাটা ঘুরে গেল। কার কী হল আবার?

    সৌম্য কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, “আমাদের কম্পিউটার সেন্টারের সুকুমারদাকে তো চিনিস। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে এসে হঠাৎ বুকে হাত চেপে একটা চেয়ারের ওপর থপ করে বসে পড়ল। কাছে গিয়ে দেখি গলগল করে ঘামছে। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আমি আর অনির্বাণ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। বেড পেতে পেতে পাঁচটা বেজে গেল। তাও অনির্বাণের কাকার সঙ্গে কোন মন্ত্রীর চেনাজানা আছে, তিনি ফোন করে দিয়েছিলেন বলে… না-হলে এখনও মেঝেতেই ফেলে রাখত।”

    সুকুমারদা কনট্র্যাক্ট এমপ্লয়ি, কোনও একটা প্রাইভেট কোম্পানির থেকে কাজে বহাল হয়েছে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক মেন্টেনেন্সের কাজ করে। যে কোম্পানিই অ্যানুয়াল মেন্টেনেন্স কনট্র্যাক্ট পাক না কেন, সুকুমারদা ঠিক ম্যানেজ করে জুটে যায়। মিশুকে লোক। আমাদের সকলের সঙ্গেই আলাপ আছে। দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছে সুকুমারদা এখন? ডাক্তার কী বলল?”

    “বলল তো গ্যাসের থেকে হয়েছে। ভাল করে দেখল কি না কে জানে! এনিওয়েজ সুকুমারদা আপাতত সামলে নিয়েছে। কিছু টেস্ট-ফেস্ট করবে। ক’দিন অবজারভেশনে রাখবে, তারপর… ” সৌম্যর গলা অনশ্চিত শোনাল একটু।

    কিংশুক জিজ্ঞেস করল, “কাছাকাছি কোনও নার্সিংহোমে নিয়ে গেলি না কেন?”

    সৌম্য বলল, “তাই নিয়ে যেতাম। সুকুমারদাই বারণ করল। মেডিক্যাল ইনসিওর‍্যান্স নেই… নার্সিংহোম মানেই তো একগাদা খরচ।”

    সৌম্য একটু ধাতস্থ হতে অরুণাংশু খবরটা ভাঙল, বলল, “এদিকে শুনেছিস কী কাণ্ড!”

    দেখা গেল সৌম্য রায়-রায়া কেচ্ছাটার ব্যাপারে কিছুই জানে না। সম্ভবত ঘটনাটা জানাজানি হওয়ার আগেই সে বেরিয়ে গেছে। অরুণাংশু ঘটনাটার একটা রসাল বিবরণ দিতে যাচ্ছিল, দেবস্মিতা ওকে থামিয়ে দিল। সৌম্য বলল, “ভাব একবার, খবরটা পশুপতি রায়ের বৌ-মেয়ে যখন জানতে পারবে, কতটা বাওয়াল হবে! ইউনিভার্সিটি ক্যামপাসেই তো থাকে, কোয়ার্টারে… কোনও না কোনও শুভানুধ্যায়ী খবরটা ঠিক ওদের কানে তুলে দিয়ে আসবে।”

    অরুণাংশু বলল, “তার দরকার পড়বে না, যা দিনকাল, সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে আসবে, সন্ধের আগেই…”

    কিংশুক বলল, “শুনেছি পশুপতির মেয়েটা ব্রিলিয়ান্ট, প্রেসিডেন্সিতে পড়ে, ফিজিক্স অনার্স…”

    আমার খারাপ লাগছিল, মেয়েটার ফালতু হয়রানি হবে হয়তো, বললাম, “মেয়েটার কী দোষ? লুজ ক্যারেকটার বাপের হয়ে তাকে জবাবদিহি করতে হবে নাকি?”

    কিংশুক বলল, “না, তা নয়। তবে আশপাশের লোক, চেনা-পরিচিত, বন্ধুবান্ধব ঠারেঠোরে জানতে চাইবে, বাঁকা চোখে তাকাবে…”

    দেবস্মিতা বলল, “ইগনোর করলেই হল। আজকের দিনে কে কার তোয়াক্কা করে? আর কেউ খিল্লি করতে এলে কানের নিচে ঠাঁটিয়ে একটা দিয়ে দিলেই চুপ করে যাবে।”

    “তুই হলি সাক্ষাৎ মা রণচণ্ডী! সবাই কি পারে?” অরুণাংশু ছদ্ম ভক্তি দেখিয়ে হাত জোড় করে কপালে ঠেকাল। আমি আড়চোখে দেখলাম ক্যানটিনের খোলা জানলা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়েছে দেবস্মিতার মুখে। কপালের মাঝখানে… না, তিন নম্বর চোখ-টোখ নয়, ছোট্ট একটা কালো টিপ। সেটা কি একবার ঝলসে উঠল? দেবস্মিতা ঠান্ডা গলায় বলল, “তোদের মনে হয় না অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত?”

    আমি কিছু বলার আগেই কিংশুক বলল, “অবশ্যই…”

    আমি বিমর্ষ হয়ে ভাবলাম এই জন্যই আমার কিছু হল না। ঠিক সময়ে জোর দিয়ে ঠিক কথাটা বলতে পারি না বলে দেবস্মিতা আমায় ধর্তব্যের মধ্যে ধরে না। ক্বচিৎ কদাচিৎ আমার দিকে তাকালে আমায় দেখছে না পিছনের দেওয়ালে ঝুলন্ত ক্যালেন্ডার দেখছে বুঝতে পারি না। অনেক বার ভেবেছি কপাল ঠুকে বলে দেব, শোন, তোর জন্য আমার একটা অন্যরকম ফিলিং আছে। সাহস পাইনি। যদি একেবারে নাকচ করে দেয়! যদি জিজ্ঞেস করে বসে কীরকম ফিলিং? কী জবাব দেব? নিজেই কি জানি ছাই! তার চেয়ে এই ভাল, এই আলগা বন্ধুত্ব, এক টেবিলে বসে কফি খাওয়া, আড্ডা, তর্ক, ইয়ার্কি-ঠাট্টা। হোস্টেলে ফেরার পথে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, টুকটাক দু’-চারটে কথা। যদি এগুলোও বন্ধ হয়ে যায়!

    দেবস্মিতা বলল, “কী রে, অমন ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছিস কেন? কিছু বলবি?”

    আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিলাম, ঘাড় নেড়ে বললাম, “কিছু না।”

    কেউ নালিশ না জানালেও খবর ঠিকই ওপরওয়ালাদের কানে পৌঁছয়। দুর্নামধন্য ব্যক্তিদের শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব থাকে না। তারা জায়গা বুঝে গুনগুন করে বন্ধুর গুণকীর্তন করতেই থাকে। শোনা গেল ভাইস চ্যান্সেলর-সাহেবের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে অধ্যাপকদের নৈতিক চরিত্র নিয়ে বেশ খানিক আলোচনা হয়েছে। মিটিঙের অ্যাজেন্ডায় যদিও রায়-রায়ার পয়েন্টটা ছিল না, তবু আলোচনাটা নাকি সুদীর্ঘ হয়। উপসংহারে আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর-সাহেব ঘটনাটার সত্যতার ব্যাপারে যথাবিহিত সন্দেহ প্রকাশ করেন। শেষে বলেন, উপযুক্ত প্রমাণ ব্যতিরেকে কাউকে শাস্তি দেওয়া মুশকিল। আর গুজবের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে শুরু করলে তো গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তখন ক্লাস নেবে কে?

    স্টাফ ইউনিয়নও দ্বিধায় পড়ে গেল। ঘটনাটা তাদের এক্তিয়ারে পড়ে কি না সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারল না। বস্তুত এই সব ফালতু ঘটনা নিয়ে আওয়াজ তুলে আখেরে কার লাভ হবে সে ব্যাপারে কোনও ঐকমত্যে আসতে পারল না। ঘটনাটার প্রতিবাদে মিটিং-মিছিলের আয়োজন করলে টিফিনের খরচ স্যাংশন হবে কি হবে না সেই নিয়েও দু’-একজন প্রশ্ন তুলল। যার ফলে তারাও আন্দোলনে নামা থেকে বিরত রইল।

    কয়েক বছর আগে হলেও কেচ্ছাটা ধামাচাপা পড়ে যেত। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পার করা পৃথিবীতে সোশ্যাল মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করে কার বাপের সাধ্যি? অরুণাংশুর ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হল। প্রোফেসর রায় ও রায়া সিনহার কুকীর্তির বৃত্তান্ত ইন্টারনেটের সৌজন্যে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। প্রতিটি পোস্টেই অধ্যাপক-ছাত্রীর অবৈধ সম্পর্কের চাক্ষুষ এবং রোমহর্ষক বিবরণ। এত জনের চোখের সামনে তাঁরা কী করে নির্লজ্জ লীলাখেলায় লিপ্ত হলেন সে প্রশ্ন অবশ্য কেউ করল না। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, গুজরাট থেকে অরুণাচল কোনও বাঙালির জানতে বাকি রইল না যে কোলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কী সাংঘাতিক অসৈরন ঘটে চলেছে। এমনকি অভিবাসী বাঙালি মহলও ছিছিক্কার-মুখরিত হয়ে উঠল।

    অনেক নেট-নাগরিক এই নৈতিক অধঃপতনের জন্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করলেন। তাঁরা দাবি করলেন যে শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্যর জন্যই বিকৃত মানসিকতার লোকেরা এত আস্কারা পাচ্ছে। বিরুদ্ধ-ভাবাপন্ন একটি বুদ্ধিজীবীর গোষ্ঠী অবশ্য সেই বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে পোস্ট দিলেন। তাঁরা জানালেন যে উপরোক্ত পোস্টগুলি অভিসন্ধিমূলক এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এই চরম নিন্দনীয় ঘটনার সঙ্গে যারা দলীয় রাজনীতির যোগাযোগ দেখতে পায় তাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে ওরাংওটাঙের মস্তিষ্কের কোনও তফাত নেই।

    দু’-একদিন পর ব্যাপারটা একটু থিতিয়ে পড়লে সৌম্য প্রস্তাব দিল আমাদের একবার সুকুমারদাকে দেখতে যাওয়া কর্তব্য। আগেই যাওয়া উচিত ছিল, ডামাডোলে হয়ে ওঠেনি। ঠিক হল লাঞ্চের পর আমি সৌম্য আর অরুণাংশু হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেব। কিংশুকের সকালে কী কাজ ছিল, আসেনি, ফোন করতে বলল, সরাসরি হাসপাতালে পৌঁছোবে। দেবস্মিতার একটা জরুরি প্রেজেন্টেশন আছে বলে আসতে পারল না। গিয়ে দেখলাম সুকুমারদা বালিশে হেলান দিয়ে বসে মোবাইল দেখছে। আমাদের দেখে তার চোখ চকচক করে উঠল। বলল, “এই তো এবার ‘আঁখো দেখা হাল’ শোনা যাবে।”

    আমি বললাম, “কীসের ‘আঁখো দেখা হাল’? তুমি কেমন আছ বলো। ডাক্তাররা কী বলছে?”

    ডাক্তারদের মতামত নিয়ে সুকুমারদা খুব একটা উদ্বিগ্ন মনে হল না। দায়সারা ভাবে বলল, “ডাক্তাররা আর কী বলবে? ঠিক আছে সব,” তারপর ঝুঁকে পড়ে জানতে চাইল, “হ্যাঁ রে, পশুপতি এখনও ইউনিভার্সিটি আসছে?”

    “আসবে না কেন? ক্লাসও নিচ্ছে। শোননি, দু’-কান কাটারা গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে যায়!” সৌম্য বলল।

    “আর সেই মেয়েটা?”

    “রায়াকে অবশ্য দেখছি না ক’দিন,” কথা বলতে বলতে সৌম্য দরজার দিকে তাকাল। কিংশুক ঢুকছে। সুকুমারদা বলল, “আর গোবিন্দ? ছেলেটাকে ফোন করেছিলাম, ধরল না।”

    অরুণাংশু বলল, “গোবিন্দ তো এখন হিরো হয়ে গেছে। সকাল বিকেল প্রেস কনফারেন্স করছে। তোমার ফোন ধরার সময় কোথায়?”

    সুকুমারদা স্তিমিত গলায় বলল, “এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, আর আমি হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে…”

    তার মুখ দেখে মনে হল অকুস্থলে থাকতে না পেরে ভয়ানক দুঃখে আছে। অরুণাংশু বলল, “সত্যি সুকুমারদা, তোমাকে খুব মিস করছি।”

    সুকুমারদা বলল, “খুলে বল দেখি ব্যাপারটা ঠিক কী ঘটেছিল।”

    অরুণাংশু আবার তিন দিনের বাসি কেচ্ছার ঝাঁপি খুলে বসল। ছেলেটার ক্ষমতা আছে। যতবার ঝাঁপি খোলে ততবারই নতুন-নতুন বিড়াল বেরোয়। একটা হলদে ডোরাকাটা, তো অন্যটা পাঁশুটে রঙের, গায়ে ছোপছোপ কালো দাগ। কারও লেজ মোটা, কোনওটা ঘাড়ে-গর্দানে। অরুণাংশু তাদের আদর করে। গলা চুলকে দেয়, পিঠে হাত বুলোয়।

    শুনতে শুনতে সুকুমারদার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছিল। মুখ হাঁ হয়ে ঠোঁটের পাশ দিয়ে লালা গড়াচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল সুকুমারদা ভেক বদলে গোবিন্দ হয়ে গেছে, ভেজানো দরজার আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভিতরে কী চলছে। কিংশুক আমার কানে কানে বলল, “অসুস্থ শরীরে এত উত্তেজনা ভাল নয়।”

    সুকুমারদা এত উৎসাহ নিয়ে শুনছে যে অরুণাংশুকে আমরা থামতে বলতেও পারছিলাম না। দেবস্মিতা থাকলে হয়তো এতক্ষণে দাবড়ানি দিয়ে চুপ করিয়ে দিত। সে নেই বলে অরুণাংশু ফাঁকা মাঠে গোল দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সৌম্য আর ধৈর্য রাখতে পারল না, বলল, “চল অরুণ, চা খেয়ে আসি।”

    সুকুমারদা বিরক্ত হয়ে বলল, “আঃ! থাম না। শুনতে দে… তারপর কী হল? গোবিন্দ চলে যাওয়ার কতক্ষণ পরে মেয়েটা ঘর থেকে বেরোল?”

    যত দূর জানি সুকুমারদা বিয়ে-থা করেনি। উত্তর কোলকাতায় কোথাও একটা এক কামরার বাসা ভাড়া করে থাকে। সারাদিন এক মনে ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার নেটওয়ার্কের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। প্রয়োজনে মলম-পট্টি লাগায়। দিনের বেলা ক্যানটিনে খায়। রাত্তিরে পাড়ার দোকান থেকে হাতে গড়া রুটি আর আলু-কপির তরকারি কিনে বাড়ি ফেরে। পনেরো দিনে একবার দাড়ি কামায়। দেখে মনে হত সাধু-সন্ত টাইপ। সেই মানুষের ভিতরে এতখানি যৌনগন্ধী গল্প শোনার স্পৃহা জমে আছে কে জানত? তাও আবার হাসপাতালের বেডে সাদা চাদরের ওপর শুয়ে শুয়ে! এ-ও বোধহয় এক ধরণের মানসিক বিকৃতি।

    টুং করে একটা মেসেজ ঢুকল মোবাইলে। দেবস্মিতা জানতে চাইছে, সুকুমারদা কেমন আছে। লিখলাম, ভালই দেখছি। অসুস্থ বলে তেমন বোঝা যাচ্ছে না। দেবস্মিতা জিজ্ঞেস করল, কবে ছাড়বে। এটা তো জানা হয়নি। জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, একজন নার্স এসে দাঁড়াল। গম্ভীর মুখে রক্তচাপ মেপে নিয়ে গেল। সুকুমারদা বেজার গলায় বলল, “এই এক হয়েছে! ইসিজিতে নাকি ঝামেলা আছে। আরও কী সব টেস্ট করাতে হবে। কবে ছাড়বে কিছুই বলছে না। খালি ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্রেশার মেপে নিয়ে যাচ্ছে। টাকা-পয়সার শ্রাদ্ধ!”

    সুকুমারদাকে ছাড়ছে না কেন কে জানে? সরকারি হাসপাতাল, মিছিমিছি আটকে রাখার প্রশ্নই ওঠে না। ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে ডাক্তার রাউন্ডে আসবে। তার আগে কিছুই জানা যাবে না। কিংশুক বলল, “আমি বসছি, তোরা যা। ফিরতে দেরি হলে মেসে খাবার পাবি না।”

    হোস্টেলে যখন ঢুকছি দেবস্মিতার ফোন এল, বলল, “কী রে! মেসেজ দেখেও উত্তর দিস না কেন?”

    মনে পড়ল দেবস্মিতার শেষ মেসেজটার উত্তর দেওয়া হয়নি। বললাম, “স্যরি রে, একদম ভুলে গেছি। সুকুমারদাকে কবে ছাড়বে কিছু বলেনি। কিংশুক আছে হাসপাতালে, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে বেরোবে। রাত্তিরে ওর সঙ্গে কথা বলে নিস।”

    “ঠিক আছে, ঠিক আছে,” বলে দেবস্মিতা ফোন কেটে দিল।

    মোবাইলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখলাম জানলায় ভাল করে ভোরের আলো ফোটেনি। ফোনটা কানে লাগাতেই অন্যদিকে কিংশুকের গলা পেলাম, “আসতে পারবি একবার? হাসপাতাল থেকে ফোন করেছিল, সুকুমারদার একটা মাইল্ড অ্যাটাক এসেছে। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ। আই-সি-ইউতে নিচ্ছে।”

    আমি বললাম, “সে কী! কাল সন্ধে পর্যন্ত তো ঠিক ছিল।”

    কিংশুক বলল, “তোরা চলে যাওয়ার পর ডাক্তার এসেছিল, বলেছিল হার্টে ব্লক আছে, অ্যাঞ্জিও করার কথা ভাবছে। আমার ফোন নম্বর ছেড়ে এসেছিলাম। আমাকেই খবর দিল। সৌম্যকে ফোন করেছি, ওর আসতে একটু সময় লাগবে। আমি পৌঁছোচ্ছি। তুই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আয়।”

    বাসে উঠে দেবস্মিতাকে ফোন করলাম। ও বলল, আমিও আসছি।

    হাসপাতালে ঢোকার মুখেই কিংশুক দাঁড়িয়েছিল। আমাকে হাত তুলে ডাকল। কাছে যেতে নিচু স্বরে বলল, “সুকুমারদা আর নেই রে।”

    “নেই মানে?”

    “এই মাত্র আমায় রিসেপশান ডেস্ক থেকে ডেকে বলল, চলে গেছে… আবার একটা অ্যাটাক এসেছিল, ম্যাসিভ ওয়ান… নিতে পারেনি।”

    আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। কয়েক ঘণ্টা আগেই যে লোকটা যৌনকেচ্ছা শোনার জন্য আকুলিবিকুলি করছিল সে আচমকা নেই হয়ে গেল, ভাবা যায়! বেঁচে থাকা ব্যাপারটা এতই ঠুনকো! সুকুমারদাকে মানসিক বিকৃতির রোগী ভেবেছিলাম বলে নিজেরই খারাপ লাগল। হয়তো লোকটা ভীষণ ভাবে বাঁচতে চেয়েছিল। পারিপার্শ্বিকতার চাপে পেরে ওঠেনি। তাই অন্যের জ্বালা আগুনে শীত-হাত সেঁকে নিতে চেয়েছিল। বললাম, “সুকুমারদার বাড়ির লোকেদের খবর দেওয়া দরকার। ঠিকানা, ফোন নম্বর জানিস কিছু?”

    কিংশুক বলল, “তিন কুলে কেউ নেই। সুকুমারদার দূর-সম্পর্কের এক বোন থাকে বারাসাতে। সৌম্য ফোন করেছিল গতকাল। সে নাকি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছে। বুঝতেই পারছিস, যা করার আমাদেরই করতে হবে।”

    আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কখন বডি দেবে?”

    “বলল তো ঘণ্টা চারেক পরে। সরকারি ব্যাপার, ঠিক কতক্ষণ লাগাবে কেউ জানে না,” কিংশুক বলল, “মোড়ের দোকানটা কি খুলেছে? চা খেয়ে আসি চল।”

    একটা সেমিনার আছে। বারোটা থেকে। উপসালা ইউনিভার্সিটি থেকে একজন প্রোফেসর আসছেন। শোনার ইচ্ছা ছিল। তার আগে যেতে পারব কি না কে জানে! কিংশুককে বললাম সে কথা। কিংশুক বলল, “আমাকেও ফিরতে হবে। জানিস তো বাবা ডিমেনশিয়ার পেশেন্ট। নিউরোসায়েন্সে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। সাড়ে তিনটেয়…”

    চা খেতে খেতেই দেখলাম অনির্বাণ আসছে। অনির্বাণ এসেই কিংশুককে দু’-চারটে প্রশ্ন করে পরিস্থিতিটা বুঝে নিল। তারপর বলল, “আমি দেখছি।”

    অনির্বাণ করিতকর্মা ছেলে। একবার ‘দেখছি’ বলেছে মানে আর চিন্তা নেই। সব কিছু সামলে নেবে। কাল সন্ধে অবধি দুশ্চিন্তা হচ্ছিল সুকুমারদা কবে সুস্থ হয়ে ফিরবে। আজ সকালে আমরা চেষ্টা করছি কত তাড়াতাড়ি সুকুমারদার বডি হাসপাতাল থেকে বার করে বার্নিং ঘাটে নিয়ে যাওয়া যায়। স্বার্থপরের মতো নিজেদের কাজের কথা ভাবছি। জানি অসুবিধে হবে না। সৌম্য, অরুণাংশু চলে আসবে। আরও অনেকেই আসবে। কাঁধ দেওয়ার লোকের অভাব হবে না। সুকুমারদা আত্মীয়-পরিজন নয়, কেবল মাত্র পরিচিত। তবু, কারও আকস্মিক মৃত্যু মানুষকে দার্শনিক করে দেয়। মনে হয় মৃত্যুকে আর একটু সময় দেওয়া উচিত।

    হাসপাতাল চত্বরে দু’-একটা চেনা মুখ চোখে পড়ছে। সুকুমারদাকে অনেকেই পছন্দ করত। ক্যানটিনে দেখা হয়ে যেত। দিনের মধ্যে দশবার চা খেত। সকলের সঙ্গে হেসে কথা বলত। বার বার মনে হচ্ছে সুকুমারদার এই বিনা নোটিসে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। গত কালকের সন্ধেটা একটা ব্যতিক্রম। হাসপাতালে শুয়ে থেকে সুকুমারদা হয়তো বোর হয়ে গিয়েছিল। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য মশালাদার গল্প শুনতে চাইছিল। কিংশুক চায়ের ভাঁড়টা ছুড়ে ফেলে বলল, “ধ্যুর! সুকুমারদার দুম করে মরে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।”

    আমি বললাম, “একদম। অ্যাঞ্জিও-ফ্যাঞ্জিও যা করার একটু আগে যদি করত…”

    পিঠে কেউ হাত রাখল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম দেবস্মিতা। সাধারণ একটা সালোয়ার কুর্তা পরে এসেছে, কোমরের কাছে কুঁচকে আছে। চোখে মুখে প্রসাধন নেই। জিজ্ঞেস করলাম, “কখন এলি?”

    দেবস্মিতা বলল, “একটু আগে। বাসে অরুণের সঙ্গে দেখা হল। খবর পেলাম। কী করে হল? এত তাড়াতাড়ি?”

    কিংশুক হাত ওলটাল, বলল, “কে জানে? অনির্বাণ ভিতরে গেছে। আরএমও-র সঙ্গে কথা বলছে...”

    দেবস্মিতা বলল, “দেখেশুনে মনে হচ্ছে বডি পেতে পেতে বিকেল হয়ে যাবে।”

    কাল রাতে ভাল ঘুম হয়নি। মাথাটা টিপটিপ করছিল। একটু অস্থির লাগছিল। শারীরিক কোনও সমস্যা নয় মনে হয়। সুকুমারদার মৃত্যুর খবরটা পাওয়ার পর থেকে কেবলই মনে হচ্ছে কিছু যেন ভুলে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে কোনও জরুরি কাজ করার কথা ছিল। না করলে বিরাট একটা ক্ষতি হয়ে যাবে। অথচ কী কাজ সেটাই মনে পড়ছে না। আমি চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে নিজের মনেই বললাম, “অতক্ষণ হাসপাতালে বসে থেকে কী করব?”

    আমাকে কি অসুস্থ দেখাচ্ছিল? দেবস্মিতা কী বুঝল কে জানে। আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর ইউ ওকে? তোর শরীর ঠিক আছে তো?”

    আমি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম, “আয়াম ফাইন। অ্যাবসলিউটলি ফাইন…”

    কিংশুক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এক কাজ কর। এখন ফিরে যা। বিকেলের দিকে আয়। ততক্ষণ আমি আছি। আগে দরকার হলে আমি ফোন করব।”

    দেবস্মিতা আমায় তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। বলল, “তোর ভাবগতিক সুবিধের মনে হচ্ছে না। একটু দাঁড়া, আমিও যাব তোর সঙ্গে। এমনিতেও এখানে কোনও কাজ নেই আপাতত।”

    অফিস যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়নি বলে আমরা বাসে উঠে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। দেবস্মিতা জানলার ধারে, আমি ওর পাশে। রোদ সবে চড়া হতে শুরু করেছে। খোলা জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। আমার মাথাটা পরিষ্কার হচ্ছে আস্তে আস্তে। মানিকতলা আসার ঠিক আগেই আমার মনে পড়ে গেল। দেবস্মিতার হাতে টান দিয়ে বললাম, “চল, নামতে হবে, সামনের স্টপে…”

    দেবস্মিতা বাইরে একবার তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, “এখানে কেন?”

    আমি বললাম, “নেমে আয়… বলছি কেন।”

    সামনের মানুষদের টপকে বাসস্টপে নেমে দেবস্মিতাকে রাস্তার উলটো দিকে টেনে নিয়ে গেলাম। দেবস্মিতা মৃদু প্রতিবাদ করল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?”

    আমি বললাম, “ এইখানে একটা গলি ছিল, কারবালা ট্যাঙ্ক লেন…”

    দেবস্মিতা বলল, “সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস কেন?”

    নদীর খাতে পলি পড়ে যেমন চর তৈরি হয়, স্মৃতি জমে জমেই তো একটা মানুষ। মানুষ কি শুধুই রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া হয়? গলিটার একটা নিজস্ব গন্ধ ছিল। সাত দিন সাত রাত ব্যাপী সাইকেল চালানোর প্রতিযোগিতা হত। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বড়মামা ফুটবল খেলত। মা হাত ধরে বাগবাজারে সর্বমঙ্গলা কালী বাড়ি নিয়ে যেত। বললাম, “আমার মামার বাড়ি ছিল গলিটার মধ্যে…”

    দেবস্মিতা বলল, “ছিল বলছিস কেন? এখন আর নেই?”

    আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আঙুল তুলে দেখালাম উঁচু ফেন্সিং-এর ভিতর কতগুলো কংক্রিটের খাম্বা। তাদের ওপর রিইনফোর্সমেন্টের লোহার রডগুলো কদর্য ভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, “নাঃ, নেই। পুরনো চারতলা বাড়িটা ভেঙে প্রোমোটার ফ্ল্যাট তুলছে…”

    দেবস্মিতা ভুরু তুলল, “তাহলে?”

    আমি বললাম, “কে জানে কবে ঐ বাড়িটার মতো… সুকুমারদার মতো… ফট করে নেই হয়ে যাই। তার আগে তোকে একটা কথা বলা ভীষণ জরুরি।”

    দেবস্মিতা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, “কী?”

    দু’-চারটে পথ-চলতি লোক আমাদের দিকে ড্যাবডেবিয়ে দেখছে। দেবস্মিতার একটা হাত আমার হাতের মধ্যেই ধরা ছিল। অন্য হাতটাও মুঠোর মধ্যে নিয়ে বললাম, “তোকে দেখলেই আমার মরে যাওয়া মায়ের কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে এখানে আসতাম। তাই তোকে নিয়ে এলাম। আমাকে তুই মায়ের মতো আগলে রাখতে পারবি? আমি না তাড়াতাড়ি মরতে চাই না।”

    দেবস্মিতা হাত ছাড়িয়ে নিল না। আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “এই কথাটা বলার জন্য এই হট্টমেলার থেকে ভাল আর কোনও জায়গা পেলি না? এই জন্যই তোকে ভ্যাবা গঙ্গারাম বলি।”

    আমি বললাম, “সে তুই যাই বলিস, আমার কিছু যায় আসে না। কথাটা তোকে বলার দরকার ছিল, বলে দিলাম। ব্যস, আমার কাজ শেষ।”

    দেবস্মিতা বলল, “অনেক হয়েছে। এবার চল। নইলে তোর সেমিনার মিস হয়ে যাবে।”

    বাসস্টপ থেকে আসার সময় আমি দেবস্মিতার হাত ধরে টেনে এনেছিলাম। বাসস্টপে ফিরে যাওয়ার সময় দেবস্মিতা আমার হাতে হাত জড়িয়ে নিল। আমি পাশাপাশি হেঁটে যেতে যেতে দেবস্মিতার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “দেখিস, একদিন ঠিক তোকে প্রেমিকের মতো ভালবাসব।”

    দেবস্মিতা ঘাড় ফিরিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দিল, “অনেক হয়েছে। চুপ কর।”



    অলংকরণ (Artwork) : পরবাস ডিজিটাল আর্ট
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments