‘আজ পূর্ব-পশ্চিমে জলভরা মেঘ অবিকল এক দেখতে। কাচের ভেতর-বাইরে মিলিয়ে অনেক মিল। আকাশ একটাই। ঘরের মধ্যেটা ঠাণ্ডা করতে বাধ্য হয়ে এ-সি চালিয়েছি, ভয়ানক হিউমিড! ন্যাচার্যাল আর্টিফিশিয়াল মিলে যুগ্ম শীতাতপনিয়ন্ত্রণ।’
লিখল অরিন্দম। মেঘের থমথমে পাহাড় গলে সামান্য দু-চার ফোঁটা ঝরছে। হাওয়া একটুও নেই। সাততলার ফ্ল্যাট থেকে অনেক দূর দেখা যায়। মোটাসোটা ময়াল সাপের আকারের বাইপাসের দু-দিক। পাটুলির জলমার্কেটের ওধারে গিজগিজে অ্যাপার্টমেন্টস। মানুষকে ভবিষ্যৎ দায়িত্ব-কর্তব্য বোঝানো ‘বালাই ষাট’ করে বেঁচে-থাকা ঢ্যাঙা গাছ ক-জন। হাইরাইজের পাঁচিলের গা ঘেঁষে কৃষ্ণচূড়া, উচ্চতা ফুট-চল্লিশ মতো। অরিন্দম দেখে। বাইরে নালা, ডাইনে ঘুরে যাওয়া সরু পিচরাস্তা। দুঃখী ঝিমন্ত গাছে ভর দিয়ে ছোটো দোকান।
কলেজের ক্লাস অফ থাকলে বাড়িতে অরিন্দম ভেজা শামুক, ল্যাদ খায় পড়ে পড়ে। ডায়েরির মতো কী লেখে, নিজেই পড়ে। এখন দুপুর। দরজা খুলে সে ব্যালকনিতে এল। চেয়ারে বসে মাথার নীচে ভাঁজ করে দু-হাত রাখল।
‘এখান থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছটা ছুঁতে পারি না। নীচে হাত পৌঁছায় না। মাটিতে ঝরা ফুল, ছড়ানো পাপড়ি চেপ্টে থেঁতলে কালো – মৃত সম্পর্কের মতো। কিছু সদ্য ঝরেছে বলে এখনও রঙ মোছেনি। মেঘ কাটিয়ে প্লেন উড়ে গেল নিঃশব্দে। কুকুরদুটো টিনের শেডের তলায় গায়ে-গা লাগিয়ে আস্তানা নিয়েছে। মানে জল পছন্দ করে না। নুপূর অরিনের স্কুলে গেছে। আশা করা যায় ছাতা আছে সঙ্গে।’
নরম ছায়ামাখা ঘরোয়া পিচরাস্তা ঘুরে ভেতরে গেছে। দশ-বারো মিনিট হাঁটলে অরিন্দমের পুরনো পাড়া। তার বাবার একতলা বাড়ি শখের বাগান বদলে গেটওয়ালা পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্টস—‘অমিয় এনক্লেভ’। বাবা মারা যাওয়ার পর পাড়াতুতো প্রোমোটার পঞ্চাদাকে দিয়ে মা নিজে করিয়েছে। নিজের অংশের ফ্ল্যাটে মা একা। অরিন্দমের ফ্ল্যাটটা ভাড়ায়। ক-মাস ধরে পুরনো কথা মা ভুলে যাচ্ছে। ধরিয়ে দিলে আবছা মনে করতে পারে। অরিন্দম চেষ্টা করে রোজ দেখা করে আসতে, নূপুর যায় সপ্তাহে দু-একবার।
‘ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ জানালার বাইরে টিনের চালায়। আজকাল বৃষ্টির দিনগুলো আগের মতো স্যাঁতসেতে হয় না? গাছটা কৃষ্ণচূড়া না হয়ে শিমুল হলে? সিঁদুরের চেয়েও গাঢ় লাল পাপড়ি। গুরু নিতম্বের মতো ফোলা মোটা বৃন্ত। বসন্ত শেষ হলে ফুল ঝরবে মাটিতে—ঢপ, ঢপ, ঢপাৎ। তুলোর আঁশ উড়বে। সুনিধিদের বাড়ির পেছনে বিরাট গাছটা ছিল। কলকাতা শহরে শিমুলগাছ আছে কি?’ লেখে অরিন্দম। মনে পুরনো ছবিদের ঝালিয়ে নেয়। মা-র অবস্থা হলে রিলটা মাথায় আটকে থাকবে।
মা-র পাশে কাত হয়ে শুল সে। জানতে চাইল,
‘‘তুষারকাকুকে মনে আছে মা?’’
“না তো। কে রে?’’
মা ভ্রূ কুঁচকে মাথা নাড়ল। অরিন্দম অন্যমনস্কভাবে বলল,
‘‘মনে নেই? সেই যে আমার এম-এস-সির পরে তুমি-আমি গেলাম। ছিলাম!’’
“ও!”
মা-র কিছু মনে পড়ল না, বুঝল অরিন্দম।
বাবা তারই মতো ছিল, চুপচাপ। এম-এস-সি লাস্ট পরীক্ষাটার পরে বলল,
“তোমাদের নিয়ে কোথাও যাওয়া হয়নি। অনেক খেটেছ দেখলাম—। রেজাল্ট বেরনোর আগে মাকে নিয়ে ঘুরে আয় যা, তুষারকে চিঠি লিখে দিয়েছি।”
তুষারকাকা বাবার কেমন ভাই—এক্সটেণ্ডেড পরিবার।
‘হাওড়া থেকে রাতের ট্রেন, বাবা তুলে দিতে গিয়েছিল। জীবনে প্রথম দূরে বেড়াতে যাওয়া—হোল্ড-অল, স্যুটকেস, লটবহর। ঠাকুমার বানানো লুচি-তরকারির কৌটো, মোটাসোটা জলের বোতল—। সুস্বাদ জিভে নয়, মগজে সেঁটে যায়। ফাঁকা ট্রেন থেকে খুব ভোরে নামলাম, স্টেশনের নাম নামকোম। হালকা শিরশিরানি। স্টেশন ঘিরে ঝাপসা ঢেউ-খেলানো মালভূমির নীলচে রঙ। প্ল্যাটফর্মে তুষারকাকা নিতে এসেছিল, মাথায় হ্যাট। মিলিটারিতে ছিল, কী করত জানা হয়নি। প্রথম দেখলাম, প্রণাম করলাম। মা ঘোমটা দিয়ে বলল,
“ভালো আছেন ঠাকুরপো?”
স্টেশন থেকে জিপযাত্রা আধঘন্টা। যেদিকে তাকাই যেন স্বপ্ন দেখছি। হাতে চিমটি কেটে দেখছি। জিপ থামল এক সময়ে। ঢুকতেই গেটের মুখে বিরাট শিমুলগাছ। ছড়ানো একতলা বাড়ি, খোলা বারান্দা। সামনে উঠোনে দড়ির খাটিয়ায় বসা বুড়িমতো একজন। তুষারকাকার তিন ছেলেমেয়ে—সুনন্দ, সুনিধি, সুরভি। পরিচয় হল। মাটির মতো সহজ, সরল। আমার মতো বুকিশ্ ইন্ট্রোভার্ট নয়।’
আকাশ সিল্কের মতো নীল। শালগাছেদের বিশাল সবুজ খসখসে পাতা। পায়ের নীচে ছোটো ঘাসের মৃদুল পাপোশ। মাইল-কে-মাইল অবাধ। এখানে যানবাহন চলে না তেমন, না চলুক। রিক্সা-প্রধান জায়গা, মাঝে-মাঝে বড়ো-অটো বিক্রম। গাছের নীচে হাঁড়ি গেলাস নিয়ে ঢুলুঢুলু চোখ, হাড়িয়া কেনা-বেচা। অরিন্দমের দৃষ্টিতে অন্য পৃথিবী। অরণ্যের দিনরাত্রির সত্যিকারের সেট্! আলো ফুরোলে বাগানের খাটিয়ায় একঢাল অন্ধকার সইয়ে নেয় তার শহুরে চোখ। ছিট-ছিট তারা দেখা যায়। ক-দিন একা-একা এলোমেলো ঘুরে বেড়াল হেঁটে হেঁটে। বাবার কথামতো সিরিয়াসলি সায়েন্স না পড়ে অন্য কিছু পড়া যেত—ভাবল। চার-পাঁচদিন কাটতে না কাটতে তার মা অস্থির,
“বাড়ি যাই এবার। তাদের অসুবিধে হচ্চে। অরু এবার চল ফিরি।”
তুষারকাকার বউ মীরাকাকী বলল,
“আর ক-টা দিন থেকে যান দিদি, কিছুই দেখলেন না! সবাই ফলস্ দেখতে গেল পরশু, আপনি গেলেন না!”
“না না, এই ভালো। আমার ঘরেই ভালো লাগে।”
“তাহলে অরু থাকুক?”
“তা কেমন করে—? অরুর রেজাল্ট বেরোবে। কেমন হবে, কী পড়বে – ভাবনা আছে না? ফেরার টিকিট কাটা।”
“সে ক্যান্সেল করে মিলিটারি-কোটায় ব্যবস্থা হয়ে যাবে’খন—।”
“না না বাবা—তা দরকার নেই!”
মা যেন কঁকিয়ে উঠল। পাশে দাঁড়িয়ে গুমরোচ্ছিল অরিন্দম। ইচ্ছে নেই, এখন ফেরার ইচ্ছে নেই—। জীবনে প্রথম একা অদেখা আশ্চর্য জায়গায় সে, অন্যরকম লোকজন—! অবাধ্য কোনওদিন ছিল না, তবে এবার বলল,
“রেজাল্ট অনেক দেরি মা। আমি পরে ফিরব। বাবা থাকতেই বলেছিল।”
মা আড়ালে বলল,
“ধু-ধু জঙ্গল অন্ধকার, এত্ত মশা—এখানে ভালো লাগছে তোর?”
“হ্যাঁ।”
“কে জানে বাবা!”
‘মা ফিরে গেল। আমি থাকলাম। থাকার ব্যবস্থা হল সুনন্দর ঘরে। আমার চেয়ে অল্প বড়, গ্র্যাজুয়েশন করে একটা মারোয়াড়ি কন্সার্নে কাজ করে। সুনিধি কাছেই প্রাইভেট স্কুলে পড়ায়। সুরভি বোধহয় কলেজে ঢুকেছে, তিনজনের মধ্যে ও-ই চুপচাপ। তিন ভাইবোনকে দেখতে এদিকের লোকেদের মতো। ভাব হল ওদের সঙ্গে। খাচ্ছি, ঘুরছি, বেড়াচ্ছি। দু-একদিন কাছাকাছি গ্রুপ পিকনিকও হল। ওদের কাছে হিন্দী বলতে শিখছি। ভুলভাল বলি, ওরা মজা পায়। আমিও হাসি। ওরা কলকাতা গেছে দু-একবার। বলে, ভালো লাগেনি। আর যেতে চায়ও না। রেজাল্টের টেনশন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। বাবার পোস্টকার্ড এসেছে, ভাসা-ভাসা উত্তর দিলাম। এবার ফিরতে হবে। বাবা চায় এম-ফিল করে কলেজে পড়াই। পরে পি-এচ-ডি করব। জানি না! সব আমার নম্বরের ওপর ডিপেণ্ড করছে। তুষারকাকাকে বললাম টিকিটের ব্যবস্থা করে দিতে। বললেন, দু-একদিনের মধ্যে হয়ে যাবে। ফিরে আবার আদা-জল খেয়ে লাগব।’
সন্ধের পর উঠোনে অন্ধকারে বসে টুকটাক গল্প করে সকলে, হাসাহাসি। কাছে-দূরে শালগাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়ার শব্দ, ট্রেন যাওয়া-আসার শব্দ। রান্নাঘর থেকে আটারুটির গন্ধ। সুনিধি বড়ো গোল চোখ, লণ্ঠনের আলো চিকচিক করছে মণিতে। বলল,
“অরুদাদা, একটা কথা বলতে পারি?”
ছোটখাট, গোলমাটোল মেয়ে। গায়ের রঙ কালো, মাথার চুল কোঁকড়ানো। মুখের হাসি বুঝি চিরস্থায়ী। অরিন্দম একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল,
“কী, বলো?”
“আমার স্কুলে টেন-ইলেভেনের জন্য সায়েন্স টিচার খুঁজছে। পড়াবে?”
অরিন্দম চমকে গেল। নার্ভাসভাবে বলল,
“সেটা কী করে হবে? আমার তো—,”
“না না পার্মানেন্ট না। ফিফটিন ডেজ্ বা ওয়ান মান্থ ম্যাক্সিমাম—ডে বেসিসে পয়সা মিলবে, যদিও খুব কম। পার্মানেন্ট টিচার খোঁজা চলছে। এটা স্টপগ্যাপ হচ্ছে।”
অরিন্দম ভাবছিল। পড়াতে তার ভালো লাগে। বি-এস-সির পর থেকে গোটাচারেক টিউশন করে পাড়াতে। সিরিয়াস টিচার বলে সুনাম আছে। এর বেশি এক্সপেরিয়েন্স নেই। সুনিধি উৎসাহ দিল,
“সেভেন ডেজ পড়িয়ে দ্যাখো তো—, ভালো না লাগলে ছেড়ে দিয়ো?”
“ইংলিশ মিডিয়াম? কিন্তু আমি—,”
“হিন্দীই চলবে, খালি বইগুলো ইংলিশে। সি-বি-এস-ই। অত ভাবছ কেন? ক-দিনের মামলা তো। থোড়ি লিটারেচার পড়াতে হবে? হাই স্ট্যাণ্ডার্ড স্টুডন্টও নেই আমাদের। আমি ইয়েস করে দিচ্ছি।”
ওর বলার ধরনে উৎসাহ, নরম আন্তরিকতা। অরিন্দম রাজি হল,
“ঠিক আছে।”
খুশি ফুটল সুনিধির লালচে রঙের মুখে। হয়ত প্রেমে পড়েছিল অরিন্দমের, বুঝতে দেয়নি। অরিন্দমের অবশ্য তেমন কোনও অনুভূতি ছিল না।
‘আশ্চর্য, স্কুলটা ভালো লেগে গেল। ছোটো সি-বি-এস-ই স্কুল, ছাত্রসংখ্যা কম। তবে বাউণ্ডারির বাইরে এমন ধু-ধু মাঠ কলকাতায় বসে কল্পনা করা যায় না। ডিসিপ্লিন মোটামুটি। ভুল হিন্দী আর খোঁড়ানো ইংরেজিতে আমার পড়ানো বেশ বুঝে যাচ্ছিল ছেলেমেয়েরা। অধিকাংশই ফার্স্ট জেনারেশন বা সেকেণ্ড জেনারেশনের শিক্ষার্থী। আমি অবশ্য আপ্রাণ চেষ্টা করতাম, বোর্ড-ওয়ার্ক করতাম বেশি। স্কুলের স্টাফদের সঙ্গে হৃদ্যতা হল। হয়ত আমার বয়স, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া হ্যাণ্ডসম চেহারা, কলকাতার পালিশ আমাকে পপ্যুলার করে তুলছিল। স্কুলের আয়া, মালী সবার চোখে সমীহ দেখতাম, যেন আমি কেউকেটা বা সিনেমার নায়ক।
অবাক হয়ে ভাবতাম, সো-কল্ড আদিবাসী এরা! এদের জীবন নিয়ে লেখেন বুদ্ধদেব গুহ! কত পড়েছি আগে বইগুলো।’
সময় বয়ে যাচ্ছিল। অরিন্দমের বাবার চিঠি এল। এবারে ফিরে যেতে লিখেছেন। ইউনিভার্সিটিতে কী কারণে অচলাবস্থা, রেজাল্ট বেরোতে দেরি হতে পারে। বাবার নির্দেশ অমান্য করার ইচ্ছে বা সাহস নেই অরিন্দমের। স্কুলের প্রিন্সিপ্যালের কাছে গেল অস্বস্তি নিয়ে,
“স্যার আমি আর কন্টিনিউ করতে পারব না। বাবা চাইছেন ফিরে যাই।”
স্বল্পভাষী বয়স্ক বিহারি ভদ্রলোক কথায় স্নেহমাখা, যেন বাঙালি বাবা।
“জানি আমি তোমাকে যেতে হবে। পার্মানেন্ট করে রাখতে তো পারব না। বহুত বড়ো হবে, অনেক পড়ালেখা করবে, পয়সা কামাবে—! তবে আর দুটা সপ্তাহ যদি থাকো—আমাদের টিচার এসে যাবে। স্টুডণ্টরা খুব পছন্দ করছে তোমাকে, আমি রিপোর্ট পেয়েছি।”
আপ্লুত অভিভূত হয়ে গেল সে। শহরের মধ্যে এস-টি-ডি বুথে গিয়ে ফোন করল তার বাবাকে,
“রেজাল্ট বেরোলেই যাবো বাবা। স্কুলটায় মাইনে কম, কিন্তু বাকি সব খুব ভালো।”
‘ঝুন্নু টিচার্সরুমে চা দিত। ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। বুদ্ধি ছিল মেয়েটার, বেশ স্মার্ট। আমি ভ্রূ কুঁচকে তাকালেই মুখ টিপে হেসে চোখ সরিয়ে নিত।
আবার বাবার চিঠি পেলাম। অচলাবস্থা কেটেছে, আগামী সপ্তাহে সম্ভাব্য রেজাল্ট। পরিবেশ, ভালো-লাগা সব ঠেলে সরিয়ে থিতিয়ে-পড়া টেনশন ফিরে এল। যত ভালো পরীক্ষাই দিই না কেন, এক্সপেক্টেড নম্বর থাকবে কি? দেন্ হোয়াট নেক্সট? বনজঙ্গলের দেশে পার্মানেন্ট টিচার কবে আসবে আসুক। আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না, প্রিন্সিপ্যালকে জানিয়ে এলাম।’
পরদিন প্রিন্সিপ্যালের ঘরে ফাউণ্ডেশন-ডে অনুষ্ঠানের মিটিং। অস্থায়ী শিক্ষক বলে অরিন্দমের ভূমিকা নেই। পায়ে-পায়ে বেরিয়ে এল। মালী মাটি খোঁচাচ্ছে। আয়ারা ঝাঁট দিচ্ছে। প্রতিদিনের বিশেষত্বহীন দৃশ্য থেকে চোখ সরিয়ে গেটের বাইরে এল, দাঁড়িয়ে রইল। অখ্যাত এই অতি সাধারণ স্কুলটার জন্য খারাপ লাগছে। স্বপ্নময় প্যাকেজ-ট্যুরের মতো ফোকটে পাওয়া এখানকার আরণ্যক জীবন, অনাবিল – কষ্ট হচ্ছে ছেড়ে যেতে! অরিন্দম অবাক হয়ে নিজেকে খুঁজতে লাগল। নিজের কাছে কৈফিয়ত দিল, কেন আর এখানে থাকা চলে না!
খানিক এগিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়ত ভাবছিল কিছু। কাছে ছোট্ট জলা, জল টলটল করছে। শাপলা ফুটেছে লাল সুতোর ফোঁড়ের মতো। আশে-পাশের মাঠে ছাগলগুলো হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠছে। জলভরা কালো মেঘ একবস্তা ঝুলে আছে। আচমকা পেছন থেকে টী-শার্টের হাতায় ছোট্ট টান। তাকিয়ে দেখে, ঝুন্নু। চমকে উঠল সে,
“কী ব্যাপার?”
“তোকে দেখতে এলাম।”
“কী!”
“তুই কি চলে যাবি স্যার?”
“হ্যাঁ।”
আঞ্চলিক হিন্দীতে বলছে ঝুন্নু। ছোট্টখাট্ট মেয়েটা তার গায়ের কাছাকাছি এসেছে, চাইলেই ছুঁতে পারে। অরিন্দমের বুক দুরদুর করছে। বোজা গলায় বলল,
“তোমার ডিউটি অফ এখন?”
“না তো—”
“তবে?”
“আমাকে কেউ দেখেনি স্যার। খুব মন করছিল তোকে দেখতে—সামনে থেকে। আর কিছু না।”
অরিন্দমের বুকের মধ্যে ফুলে-ফুলে উঠছে। সাজগোজ নেই, কালো রোগা এক মেয়ে। আয়াদের জন্য স্কুলের পোশাকের সবুজ শাড়ি পরা। মুখ উঁচিয়ে দেখছে নায়কের মতো চেহারার অরিন্দমকে। খুব জীবন্ত দুচোখের একটায় জল, আর একটায় বুঝি বিস্ময়।
কলকাতার ধুলোপড়া রোজদিন এবারে ঝেড়ে-ঝুড়ে পরিষ্কার করতে হবে। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল অরিন্দম। পরের দিন ফেরা। বৃষ্টি হয়েছে সন্ধেবেলা, বৃষ্টি হয়েছে সারারাত। ভোরের দিকে বৃষ্টি নেই, হলুদ আলোও নেই। লোহার রঙের মেঘ থেমে আছে। দু-চারফোঁটা টিপটিপ।
ওরই মধ্যে স্কুলের ফাংশন, সুনিধির সঙ্গে গেল অরিন্দম। নিজেদের মতো কম-বেশি সাজগোজ করে এসেছে সকলে। পরিচালন-কমিটির সদস্যেরা এসেছে। বক্তৃতা ইত্যাদি, ছেলেমেয়েদের নাচগান। স্টুডন্টস্ চলে গেলে টিচার্স – গান, কবিতা, বক্তব্য। ছোটো অডিটোরিয়ামের কোণে দরজার পাশে বসেছিল অরিন্দম, অন্যমনস্ক।
হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে দেখে দরজা আগলে ঝুন্নু, তার দিকে চোখ। একটু হাসল মেয়েটি, তারপর পায়ে ছন্দ তুলে এগিয়ে গেল সামনে। অরিন্দম চোখ সরিয়ে নিয়েছে বাইরে। আকাশের অবস্থা দেখছে।
হঠাৎ অল্পস্বল্প সোরগোল। অরিন্দম দেখে ঝুন্নু উঠছে স্টেজে। পেছনে সার বেঁধে বাকিরা—সন্তোষী চন্দু অনিতা। জনাদশেক কি আরো বেশি। প্রত্যেকের পরনে সবুজ শাড়ি-ব্লাউজ ইউনিফর্ম, রোজকার হাতখোঁপা, বেণী। পালক-ফুলটুল কিছুই দেয়নি মাথায়, স্রেফ এমনিই। হাসিখুশি কালো রোগা ছোটোখাট—ওরা যেমন হয়। রোজ ফাইফরমাশ খাটে, চা দেয়, খাতা পৌঁছায়, বকুনি খায়, নিজেরা আড্ডা দেয়। করিডর ধোয়, টয়লেট সাফ করে।
অরিন্দমের কাছে ক্যামেরা নেই, দু-চোখ আছে।
‘পায়ে পা মিলিয়ে হাতে হাত ধরে বৃন্দ নাচ দেখেছি পিকনিক বা বেড়াতে বেড়াতে। ওরা এসেছে তাদের দলে ড্যাম বা জলপ্রপাতের পাশে। শাল পলাশের সবুজ আবহ, ঝরনার ঝরঝর, পাখপাখালির সঙ্গত।
দেশী মাংসভাতের শেষে নাচে ওরা। পায়ে পা, হাতে হাত। হাতধরাটা বেশ আলাদারকম ইন্টারেস্টিং। কিন্তু পোশাক-টোশাক ওই-ই--মানে চুড়িদার-কুর্তি, জিন্স-টি, শাড়ি-স্কার্ট। সাজগোজ করে স্টেজে উঠলে। ফুল-পালক, বাঁশি-মাদল নেই, দরকারও নেই। সিডি আছে আর নাচ, বলিউড ভেজাল থাকলে ধরার সাধ্য নেই - কিন্তু ওদের নাচতেই হবে। নাচবেই ওরা কেননা ওদের রক্তে, সত্তায় ফুটফুট করে নাচ। একসঙ্গে তালে-তালে পা মিলবে হাত মিলবে ক্লান্তিহীন। জন্মেই প্রকৃতি থেকে এই গুণটা এসে যায়, পেয়ে যায় কেমন করে। সবাই ওরা সব্বাই।
সরহুল বা যাই পরব হোক হাতে হাতে পায়ে পা মিলিয়ে ঝুম ঝুমকে নাগরিক রাস্তা ধরে বৃন্দনাচ—আকাশটাও সঙ্গে দোলে।
ছাত্রছাত্রী যারা, টুডু, তির্কী, মুণ্ডা, টোপনোরা, ওদের শেখাতে হয় না। বললেই তৈরি। এত সহজ, নমনীয়, বারবার খুব সুন্দর, ভালো লাগছে বলে উৎসাহ দেওয়ার দরকার পড়ে না।
ছাত্রেরা চলে যাওয়ার পরে নিজেদের আড্ডা-গল্প এইসব। গান হয়েছে ভালো ভালো, অনেকেই গাইতে পারেন, বেশ জমবে খেলা-খাওয়া - তখন কে বললেন, নাচ হোক, নাচ হোক।
হাতে-হাত, পায়ে তাল, ধীর লয় ঝুন্নু আর ওর সহেলীরা ঘুরে ঘুরে নাচছে। আর একটু পরে কী অদ্ভুত! মনে হল অডিটোরিয়ামে স্টেজের মাথায় ছাত নেই। সিলিং উধাও, মাইক-পোডিয়াম সব ভ্যানিশ। আকাশ খোলা আর শালবনে শুরু হয়েছে গ্রুপড্যান্স। হাতে-হাত পায়ে-পা, ওরা দুলছে ধীরে, গান বাজছে, গতি বাড়ছে।
মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ - হাসিমুখে স্টেজে উঠে যাচ্ছে কেউ কেউ। সুনিধির মুখ মনে পড়ে এখনও। পর পর হাতে হাত পায়ে পায়ে তালে মিল...। দৃশ্যটা দেখতে পাই, হন্ট করে আজও, এখনও।’
খাতা-পেন বন্ধ, কোলের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে অরিন্দম। স্বপ্নে ছুটির টিকিট কাটা, সেই প্যাকেজ।