• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গল্প
    Share
  • মেঘের 'পরে : শ্রীতমা মাইতি

    একটা গাছ দাঁড়িয়েছিল। সে লম্বাও না, বেঁটেও না, রোগাও না, মোটাও না, দেখতে তেমন ভালোও না, মন্দও না। কিন্তু সে মনের খুশিতে থাকে। আজও সে আকাশের দিকে চেয়ে মেঘ দেখছিল। কালো মেঘ, বৃষ্টির জলে ভরা। এমন সময় একটা রোগা মতো, লম্বা মতো গাছ চটপট করে হেঁটে এল। এসেই শুরু হল খোঁজখবর।

    — বৃষ্টি কি হবে?

    — কী জানি, মনে তো হয়।

    — মনে হলে তো হবে না, বৃষ্টিটা হওয়া দরকার।

    — তা তো অবশ্যই।

    — না না, ওটা তো আমিও জানি। বৃষ্টিটা হচ্ছে কখন সেটা বলুন।

    — তা আমি কী করে জানব?

    — কেন? আবহাওয়া দপ্তরের রিপোর্ট শোনেননি?

    — না।

    — কেন? (ভীষণ মেজাজে বিরক্ত হয়ে) ওটাই তো আগে শোনা দরকার ছিল।

    — আমি মেঘ দেখছিলাম। বলে আমাদের গাছ আবার মুখ তুলে মেঘের দিকে চাইল।

    — আশ্চর্য! কোনও বুদ্ধিও কি আছে এদের? মেঘের মধ্যে আবার দেখার কী আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি গজগজ করতে করতে রোগা গাছ সামনের দিকে চলে গেল।

    প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই এল মোটা বেঁটে মতো গাছ। এসেই ঠোঁট চেপে, গালভরা হাসি হেসে চোখ নাচিয়ে বলল — কী বন্ধু, কেমন আছ?

    — ভালোই।

    — বাঃ, তুমি ভালো থাকতেও পারো কিছু। আমার অবস্থাটা যদি দেখতে না, তবে বুঝতে!

    — ও, তাই বুঝি?

    — আরে, জিজ্ঞেস করো না। সত্যি বলছি জিজ্ঞেস করো না।

    — ও, বেশ।

    — না না, বলছি তো, থামো...। তা হয়েছে কী, আমার একটা ক্লাস রয়েছে, ওটা তুমি ভাবতেই পারবে না। সত্যি বলছি, ওটা অ্যাটেন্ড করা সকলের কম্ম নয়। আমি তো বলি--ব্রেনজিম। পুরোপুরি ব্রেনজিম, এতখানি মাথা খাটাতে হয় যে তুমি ভাবতেই পারবে না, একটু ঝিমোনোর সময়ই পাই না। তারপর ক্লাস করে ঘেমেনেয়ে বেরিয়েছি, এমন সময় গায়ের ওপর টিকটিকি পড়ল। তুমি তো জানোই, টিকটিকি, গিরগিটি, পোকামাকড় এসব আমার সহ্য হয় না, আমাদের বাড়িতে এসব কোনদিন দেখে বড় হইনি তো, এখানে এসেই প্রথম দেখা। আমি তো একেবারে আঁতকে উঠে, হাত পা ছুঁড়ে...

    — চোখগুলোও গোল হয়ে গেছিল আশা করি।

    — হ্যাঁ, ...মানে সে তো হয়েই ছিল নিশ্চয়ই। তুমি আমার অবস্থাটা একবার কল্পনা করো ভাই, তার সঙ্গে এই বিচ্ছিরি গরম...।

    — হ্যাঁ, বেজায় গরম। একটু বৃষ্টি হলে ভালো লাগত...।

    — আরে না না, এখানের বৃষ্টির কথা বোলো না। ছিঃ ছিঃ, বৃষ্টি দেখতে হলে আমার মামাবাড়ি যেয়ো। ওখানের বৃষ্টি যেমন, জলও তেমন। এখানে বৃষ্টিও যেমন হতে চায় না, জলও তেমনি বিচ্ছিরি স্বাদ। আমি তো জিরে দিয়ে ফুটিয়ে খাই। জল হয় তো আমার মামাবাড়ির জল...

    — তোমার মামাবাড়ি ঘুমড়িতে বুঝি?

    — ঘুমড়ি? না তো, চন্দননগর তো! ঘুমড়ি কেন হতে যাবে?

    — ঘুমড়ি কিনা আদত জলের জায়গা, তাই বলছিলাম।

    — আরে না না, চন্দননগর। এই যে চন্দননগরের আলো দেখো না তোমরা, সবই এই জলের গুণ।

    — নাহ, আমায় আলো দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না।

    — তা লাগবে কেন? চন্দননগরের আলো হল একটা আর্ট, ওর মর্ম যদি সবাই বুঝত, ছ্যাঃ, যত্তোসব!!

    "যাকগে," মনে মনে এই বলে আমাদের গাছ আবার আকাশ দেখতে লাগল। মেঘটা ঘন কালো হয়ে গেছে, একটা বেগুনি মেশানো গভীর কালো রং। আর চারপাশটা একটা উদাস আলো মেশানো অন্ধকার দিয়ে ঢেকে গেছে। আনন্দে আমাদের গাছের পাতাগুলোয় ঢেউ খেলে গেল।

    আর ঠিক তখনই ওদিক থেকে চশমা পরা মিটিমিটি চোখ রোগা মতো একটি গাছ গুটিগুটি পায়ে আসতে আসতে হঠাৎ তরতর করে এগিয়ে এসে বলল— হ্যাঁ, তারপর সব ঠিকঠাক তো?

    — হ্যাঁ, সবই ঠিকঠাক।

    — তাহলে কোন অসুবিধা নেই? সবই ভালো?

    — বেশ তো আছি। আপনি কেমন আছেন?

    — আমার তো সবই ভালো চলছে।

    — ও, আচ্ছা।

    ব্যাস, সব চুপচাপ। চশমা আঁটা গাছ চুপটি করে সোজা দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর থতমত খেয়ে আমাদের গাছ বলল,

    — বেজায় গরম!

    কোনও সাড়া নেই। শুধু চোখ দুটো মিটমিট করল।

    — সবাই একটু বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে আছে। একটু বৃষ্টি হলে...

    — সবকিছুর জন্যই তো দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয় জীবনে, তাই না, না হলে কি ভালো কিছু পাওয়া যায়?

    — সে তো ঠিকই। একেবারেই।

    আচ্ছা, আমার কাজ আছে। আমি যাই তবে।

    এই বলে আমাদের গাছ দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। একটু পর সেটা দৌড়ে পাল্টে গেল আর আস্তে আস্তে ডালপালাগুলো দুদিকে ভাগ হয়ে দুটো ডানা তৈরি হয়ে গেল। তাই দিয়ে গাছ উড়ে চলল আকাশে জল ভরা মেঘের দিকে।

    এসেই যখন পড়েছি, ভাবল গাছ, তবে মেঘের ওপর বসা যাক। মেঘটা যদিও বড়ই অস্থির, মেঘের মাঝে মাঝে বিদ্যুৎও ছুটছে এদিক ওদিকে, তাও একটু একা তো বসা যাবে চুপটি করে। তাছাড়া মেঘের ওপর থেকে নীচের দুনিয়াটা কত্ত সুন্দর দেখাচ্ছে। গাছ ভাবছিল, এখানেই পার্মানেন্ট থেকে যাওয়া যায় কি না, ঠিক তখনই মেঘ বলে উঠল,

    — তা এখান থেকে কখন যাওয়া হবে?

    — তা তো এখনও ভাবিনি।

    — তা হলে তাড়াতাড়ি ভাবুন!

    — আচ্ছা, আমাদের ওখানে একটু বৃষ্টি করে দিতে পারবেন?

    — ওভাবে তো হয় না। ওর একটা প্রসেস আছে।

    — তাই?

    — আজ্ঞে হ্যাঁ! আপনাকে একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে আমাদের এখানকার হাওয়া অফিসে মেল করতে হবে। ওরা অ্যাপ্রুভ করার পর ফরোয়ার্ড করবে IMD-এর কাছে। ওখান থেকে অ্যাপ্রুভাল এলে পর ওটা যাবে এখানকার বৃষ্টি বোর্ডে। ওদের ততক্ষণে লাঞ্চটাইম চলবে। সেকেন্ড হাফে ডিসিশন হবে। বুঝতে পারলেন?

    — বুঝেছি।

    গাছ চুপচাপ মনের আনন্দে মেঘে চড়ে বসে রইল। কী বিশাল এই মেঘের রাজ্য। এখান থেকে নীচের দুনিয়াটাকেও আর ততটা খারাপ লাগছিল না। হঠাৎ মেঘের প্রশ্ন— কী ব্যাপার? মেল করছেন না যে?

    — করব না।

    — নামবেন কখন?

    — নামব না।

    কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর মেঘ বলল, তা আপনাদের জায়গাটা যেন কোনটা বলছিলেন?

    — ওই যে শহরতলির প্রান্তে বিশাল বড় বাগানের মতো দেখা যাচ্ছে যে, ঘর বাড়িও আছে...

    — বুঝেছি।

    এই বলে মেঘ চলল আমাদের গাছ যেখানে থাকে সেখানে বৃষ্টি দিতে। গাছের মনে খুশি আর ধরে না। বলল— কী বলে যে ধন্যবাদ দিই!

    — ঘাড় থেকে নামলে খুশি হই।

    — আচ্ছা, এই যে নেমে যাচ্ছি।

    আমার দারুণ লাগল এখানে। বোধহয় এবার নীচেও ভালো লাগবে। বৃষ্টির জল পেয়ে বাকিদের মাথাও ঠাণ্ডা হবে আশা করি।

    — আজ্ঞে না, তার আশা নেই, মেঘ বলল গাছকে, তবে চাইলে মাঝে মাঝে আমার এখান থেকে ঘুরে যেতে পারো।



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments