( এক )
আরম্ভেরও যেমন আরম্ভ থাকে, প্রতিটি মাইলস্টোন পৌঁছানোর মধ্যে সুপ্ত থাকে কোনও নতুন কিছু শুরু হওয়ার সম্ভাবনার বীজ।
আর দু’মাস পরে মনপাখি পত্রিকার একশোতম সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। একশোতম সংখ্যায় নতুন কী করা যায়, সেই বিষয়ে চিন্তা করছিলেন সম্পাদক সোমেশ চৌধুরী। সোমেশ চৌধুরী তো শুধুমাত্র মনপাখি পত্রিকার সম্পাদক নন। মনপাখি পত্রিকা হল তাঁর ব্রেন চাইল্ড। আর মনপাখিকে হাত ধরে একশোতম সংখ্যা অবধি পৌঁছে দেওয়া সোমেশবাবুর জন্য তীব্র আনন্দের তো বটেই, সাহিত্য জগতের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শুরুতে মনপাখি পত্রিকা অবশ্য সোমেশবাবুর একার পরিকল্পনা ছিল না। ওটা বহুবচনে হবে। মনপাখি পত্রিকা ছিল তাঁদের তিন বন্ধুর স্বপ্ন। সোমেশ চৌধুরী, অরুণ মজুমদার আর অরবিন্দ পাল। তিনজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মনপাখির জন্ম, আলোর মুখ দেখা। সেই প্রথম দিনই মনপাখি ডানা ঝাপটে উড়ে এসে বসেছিল এই বারো বাই পনেরো ফুট মাপের ঘরটায়। যে ঘরটা আজ পত্রিকা অফিস।
আলাদা করে অফিস নেওয়ার কোনওদিনই পয়সা ছিল না তাঁদের। আজও নেই। সোমেশবাবু নিজের বসতবাটির একতলার একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন পত্রিকার কাজ চালানোর জন্য। গত কুড়ি বছর ধরে সেই ঘর থেকেই মনপাখির কাজ চলছে। তাতে অবশ্য আজকাল সুবিধাই হয়। চা তেষ্টা লাগলে বা একটু গড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছে হলে তিনি দোতলায় চলে যান। যখন মন চায়, নেমে আসেন একতলায়, কাজ শুরু করেন।
মনপাখির একশোতম সংখ্যা নিয়ে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে গিয়ে ক-দিন ধরেই সোমেশবাবুর বারবার মনে পড়ছে পুরনো দিনের কথা। গত সপ্তাহে তিনি অরুণকে ফোন করেন। অরবিন্দকেও। দুজনকেই জিজ্ঞাসা করেছেন। মনপাখির একশোতম সংখ্যায় নতুন কী করা যায় তাই নিয়ে মতামত জানাতে।
অরুণের আইডিয়াটা মনে ধরেছে সোমেশবাবুর। আগামী সংখ্যা থেকে শুরু হবে। প্রতি সংখ্যায় কিছু পুরনো লেখা রিপাবলিশ।
পুরনো লেখা রিপাবলিশ প্রসঙ্গে দুই বন্ধু ফিরে গিয়েছিলেন যৌবনে। তাহলে তো অরুণ, অরবিন্দ আর তাঁর নিজের লেখাও প্রকাশ করতে হয়! আনন্দ হয়, আবার ভয়ও। এতদিন পর পাঠকের দরবারে আবার তাঁদের লেখা! পাঠক নেবে তো?
অরুণ অবশ্য খুবই ভালো কবিতা লিখত, আর স্কেচও করতো দারুণ। অরবিন্দর ছিল ফ্যান্টাস্টিক রম্যরচনার হাত। তাঁর নিজের ঝোঁক ছিল প্রবন্ধ লেখার প্রতি। তবে প্রথমদিকে তিনি আর অরবিন্দ মনপাখিতে নিয়মিত গল্প লিখতেন। মনপাখির প্রথম সংখ্যার প্রতিটি ইলাস্ট্রেশন করেছিল অরুণ।
অবশ্য প্রথম সংখ্যায় আর ক’টা লেখাই বা ছিল। প্রথম সংখ্যার জন্য লেখা জোগাড় করা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। প্রথমত, পত্রিকার নাম জানে না কেউ। দ্বিতীয়ত, অনলাইন পত্রিকা। তখনও অনলাইন পত্রিকা অত পপুলার হয়নি। লেখক পাঠক কেউই অনলাইন পত্রিকার সঙ্গে ঠিকমতো অভ্যস্ত নয়। তাই অনলাইন পত্রিকার পাঠক সংখ্যা নিয়েও তাঁরা তিন বন্ধু চিন্তিত ছিলেন। তবে তাঁরা দমেননি। তাঁদের স্বপ্নের সামনে হার মেনেছিল সবরকমের বাধাবিপত্তি।
তিন চনমনে যুবকের স্বপ্ন। এক নতুন পত্রিকার। নতুন ধাঁচের। নতুন লেখকদের সঙ্গে নিয়ে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সেই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ দিয়েছিল। নাহলে প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের বহু খরচ। প্রিন্টেড ম্যাগাজিন বার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
মনপাখির অফিস ঘরে বসে কাজ করছিলেন সোমেশ। ল্যাপটপ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলেন। আজকাল তিনি আর সিগারেট খান না। সম্প্রতি চুরুট ধরেছেন। চুরুটে একটা লম্বা টান দিয়ে তাকালেন জানালার দিকে।
জানালায় এখন পড়ন্ত রোদ্দুরের ছায়া। মাধবীলতার ফুলে ভরা ডালগুলো মৃদুমন্দ হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে। দু’মাস পর মনপাখির একশোতম সংখ্যা প্রকাশিত হতে চলেছে। সোমেশ ভাসছেন, ডুবুরির ন্যায় ঘুরছেন, বর্তমান আর অতীতের দরিয়ায়, নস্টালজিয়ায়...
মনপাখির দশম সংখ্যা অবধি তাঁরা তিন বন্ধু একসঙ্গে কাজ করেছেন। প্রথমে অরুণ চলে গেল সুদূর অ্যামেরিকায়। শুরু শুরুতে ফোনে, ইমেলে পত্রিকার সঙ্গে অনেকটাই যুক্ত ছিল অরুণ। তবে ওই যা হয় আর কী। আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড। ঠিক তাও নয় বোধহয়। নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়া, কাজের চাপ, সব মিলিয়ে অরুণ আর পেরে উঠত না। তবে অরুণের কানেকশন ছিল সাঙ্ঘাতিক। খ্যাতনামা লেখকদের লেখা মনপাখিতে আসা শুরু করেছিল অরুণের সাহায্যেই।
অরবিন্দ আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, “আমাদের এই নবীন পত্রিকা অজানা, অখ্যাত লেখকদের প্ল্যাটফর্ম। কিছু লেখা থাকে যা কমার্শিয়াল পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। কিন্তু গুণে মানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, ভালো লেখা। তেমন লেখার খোঁজই তো আমাদের উদ্দেশ্য। লেখকের অন্ধকার ড্রয়ার থেকে বার করে আলোর ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। তাহলে নামীদামি ব্যক্তিদের লেখা নেওয়ার প্রয়োজন কী?”
অরুণ ভালো কবি হলেও চিন্তাভাবনায় চিরকালই প্র্যাক্টিক্যাল। অরুণ বলেছিল, “দরকার আছে। ছোট গাছ বেড়ে ওঠার জন্য যেমন দরকার বড় গাছের ছায়া। নবীন পত্রিকারও প্রয়োজন আছে খ্যাতনামা লেখকদের কৌলীন্যের স্পর্শ। তাতে পত্রিকার মান বাড়ে, নাম ছড়ায় দ্রুত, পাঠক তৈরি হয়।”
অরুণ দেশ ছাড়ার পরের বছরই অরবিন্দ চলে গেল লন্ডনে। লন্ডনে মুভ করার পর অরবিন্দ আর মনপাখির সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখেনি।
অরুণ আর অরবিন্দ চলে গেল বিদেশে। সোমেশ একা লেগে রইলেন মনপাখির সঙ্গে। চাকরি, সংসার হাজারটা ঝামেলার মধ্যেও তিনি মনপাখির দায়িত্ব ছাড়েননি। দু-হাতে সামলেছেন পত্রিকা।
তবে একা সোমেশের পক্ষে কি সম্ভব ছিল এই দীর্ঘ পথ চলা? এই দীর্ঘ যাত্রায় ধীরে ধীরে বেশ কয়েকজন সহৃদয় সহযাত্রী পেয়েছেন তিনি। তাঁরাও সোমেশের মতোই, মনপাখির হিতাকাঙ্ক্ষী, মনপাখির অন্দরমহলের একজন।
বর্তমানে, তৃষা আর রাজেশ নামে দুটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে খুব কাজ করছে এই পত্রিকায়। ভালো লাগে ইয়াং ব্লাডের বাংলার প্রতি টান দেখে।
( দুই )
ড্রয়িং-রুমে সোফায় বসে আছেন সুনীতি। তাঁর হাতে একটা বই। বইটি এই মুহূর্তে বন্ধ। তবে বইয়ের চুরাশি পাতায় তাঁর একটা আঙুল ঢুকিয়ে রাখা। দেখলেই বোঝা যায় এতক্ষণ তিনি ওই চুরাশি নম্বর পাতায় মগ্ন ছিলেন। কোনও কারণে তিনি বইটি পড়া আপাতত স্থগিত রেখেছেন, তবে কারণটি অপসারিত হলেই তিনি আবার বইতে ডুব দেবেন।
তাঁর সামনে মুখোমুখি উলটোদিকের সোফায় বসে আছে বুবাই, সুনীতির একমাত্র ছেলে...
এই মুহূর্তে সুনীতি আর বুবাই দু’জনেই সামান্য উত্তেজিত। সুনীতির মুখে উত্তেজনার থেকে বেশি অভিমান। চোখের কোণে সামান্য হলেও জলের আভাস।
বুবাইয়ের গলায় অসন্তোষ, “ডোন্ট ফোর্স মি মা। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আমি বাংলা পড়তে ভালোবাসি না। বেঙ্গলি ল্যাঙ্গোয়েজ ইজ গোয়িং টু ডাই। তুমি সবসময় দাদুর কথা বল। কিন্তু দাদুর লেখা কবিতা ক’জনে পড়েছে বলতে পারো?”
সুনীতির চোয়াল সামান্য শক্ত হয়। বলেন, “আমার বাবার লেখা দুটো বই আছে বুবাই। দেখাইনি তোমাকে আমি সেই বই? দেখাইনি? দেখিয়েছি তো। পারিবারিক ট্র্যাডিশন বলে একটা কথা আছে, বুঝলে? তোমার দাদু কবি ছিলেন। বাংলায় কবিতা লিখতেন। আর তাঁর নাতি হয়ে তুমি বাংলা পড়তে চাও না? ছিঃ বুবাই, ছিঃ।”
বুবাইয়ের মুখটা লাল হয়ে ওঠে। বলে, “হোয়াই আর ইউ টকিং লাইক দিস, মা? দাদুর বই আছে, সেটা জানি আমি। কিন্তু ক’জনে পড়েছে দাদুর বই? ক’জনে জানে দাদুর নাম? দাদু কবিতা লিখতেন এ শুধু তোমার আর দিদার মুখে শুনেছি। কোনও কাগজ বা পত্রিকায় দাদুর নাম দেখিনি। কেউ মনে রাখেনি অজয় গুপ্তকে। দাদু ছিলেন শখের কবি।”
“সে তুমি যা খুশি বলতে পারো বুবাই। তুমি বলছো, শখ। আমি বলবো, প্যাশন। লেখালেখি ছিল আমার বাবার বেঁচে থাকার রসদ। দু’দণ্ড জিরোনোর অবসর। নিজেকে ফিরে দেখার উপায়। সংসারের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে রক্তাক্ত ‘আমি’-র উপর চন্দনের প্রলেপ। সারাজীবন তো মানুষটা সংসারেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। শুধু লেখার খাতাটুকুই ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব।”
“হোয়াই মা, হোয়াই? উনি যদি সত্যি কবি হতেন, মানে লেখাই হতো ওঁর জীবনের উদ্দেশ্য, সংসারে নিজেকে অত জড়াতেন কি? তাহলে সংসার ছেড়ে লেখা নিয়েই থাকতেন। সেজন্যই বললাম, শখের কবি।”
সুনীতির স্বর শান্ত শোনায়। তিনি ধীর গলায় বলেন, “ব্যপারটা সেরকম নয় বুবাই। এভরিওয়ান ইজ নট অ্যাজ লাকি অ্যাজ ইউ। তুমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তোমার বাবা একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার। অর্থের টানাটানি তুমি কখনও চোখে দেখোনি, ফিল করোনি। তাহলে বুঝতে। এরকম নিষ্ঠুরের মতো একজন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনা করতে না।”
“দিস ইজ ইয়োর প্রবলেম, মা। আমাদের আলোচনাকে পার্সোনালি নিয়ে নিলে। আমি দাদুকে মিন করে কিছু বলতে চাইনি। আমার মন্তব্য কবিসত্ত্বা নিয়ে, কবিকে নিয়ে নয়।”
“বলার কথাও নয় বুবাই। বলা উচিতও নয়। ওঁদের বোঝা তোমার আমার সাধ্যের বাইরে।” “কেন, এরকম বলছ কেন?”
“দ্যাখো, ওঁরা ছিলেন একটা রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভিক্টিম। আমার বাবারা কোলকাতায় এসেছিলেন দেশ ভাগের সময়। বাবার তখন অল্প বয়স। আমার বাবার বাবা, মানে আমার দাদু, পূর্ববঙ্গে পাবনা জেলায় এক জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন। বড় বাড়ি, চাকরবাকর, খুবই অবস্থাপন্ন ছিলেন। শুনেছি, বিয়েতে মালাবদলের সময় হাঁটু অবধি লম্বা তিরিশ ভরি সোনার চাঁদমালা দিয়ে দাদু নাকি মালাবদল করেছিলেন। সুতরাং বুঝতেই পারছ পূর্ববঙ্গে তাঁদের পারিবারিক অবস্থান কেমন ছিল। কিন্তু পার্টিশনের কারণে চলে আসতে হল পশিমবঙ্গে। পূর্ববঙ্গের অবস্থাপন্ন পরিবারটির রাতারাতি পশ্চিমবঙ্গে স্ট্যাটাস দাঁড়াল, রিফিউজি। ওই ক্রাইসিস টাইমে, আমার মাঝবয়সী দাদুর নতুন করে চাকরি পাওয়া কতটা কঠিন ছিল আন্দাজ করতে পারো? যে মানুষটা জমিদারি সেরেস্তায় কাজ করতেন, চাকরবাকরের সেবায় অভ্যস্ত, তিনি সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি ঘুরে ঘুরে শেষমেশ একটা চাকরি জোগাড় করেছিলেন, স্কুল শিক্ষকের। তখন ক’টাকা মাইনে ছিল স্কুলে? আমার অল্পবয়সী বাবাকে দাদুর পাশে দাঁড়িয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়। সংসারকে বাঁচাতে গিয়ে বিসর্জন দিতে হয় নিজের শখ, প্যাশন। তবুও বাবা লেখা ছাড়েননি। লিখতেন কখনসখনও। অনেক পরে, সংসার একটু স্থিতু হলে, বাবা আবার নিয়মিত লেখা শুরু করেন। ততদিনে আমি বড় হয়ে গিয়েছি। কলেজে পড়ি। বাবার শরীরও ভেঙে গিয়েছে। তবে দেখেছি, অবসর সময়ে দরজা ভেজিয়ে বাবা খাতা নিয়ে বসতেন। বন্ধ দরজার পাহারায় থাকতেন মা। হাসি হাসি মুখে বলতেন, ভিতরে ঢুকিস না, তোর বাবা এখন লিখছেন। যেদিন মনের মতো একটা কবিতা লেখা হতো, মা-কে পাশে বসিয়ে কবিতা শোনাতেন বাবা। মা ছিলেন বাবার কবিতার আগ্রহী পাঠক। মা-র উৎসাহেই বাবার কবিতার বই বেরিয়েছিল।”
বুবাইয়ের মুখের অসন্তোষ প্রশমিত হয়ে এখন সেখানে স্মিত হাসি। বলে, “একটানা কত কিছু বলে গেলে মা! দাদুর কবিতা নিয়ে দিদা খুব পজেসিভ ছিল। সে গল্প কতবার শুনেছি তোমার মুখে। আচ্ছা মা, তখন বই পাবলিশ করতে টাকা লাগত না?”
“অত জানি না বাপু। তবে আমার বাবার তো লেগেছিল। হাতের চুড়ি বিক্রি করে মা টাকা দিয়েছিলেন বাবাকে।”
“দ্যাটস নট গুড! দিদার চুড়ি বিক্রি করে দাদু নিজের বই পাবলিশ করেছিলেন? সাউন্ডস সেলফিস।”
“আমার বাবা সেলফিস? কথাটা দিদার সামনে একবার বলে দেখো তো! তোমরা একালের ছেলেমেয়ে। ওসব মানসিকতা বুঝবে না। বাবার কবিতার বই পাবলিশ করার ইচ্ছে বাবার থেকেও বেশি ছিল মা-র। স্বামীর কবিতার বই ছিল মা-র অহংকার। মাসিমনি, পিসিভাইদের অবস্থা চিরকালই আমাদের থেকে বেটার। মা-র ভাবখানা ছিল যে, ওঁদের স্বামীরা দু-পয়সা বেশি উপার্জন করে ঠিকই। কিন্তু ক’জনে কবিতা লিখতে পারে? ক’জনের নিজের নামে বই আছে?”
কথাটা বলতে বলতে সুনীতি হেসে ফেলে। তাঁর মুখের অভিমান সরে হেসে ওঠে রোদ।
হো হো করে হেসে ওঠে বুবাইও। বলে, “উফ, কী সলিড প্রেম ছিল বুড়ো-বুড়ির। হ্যাটস অফ টু দিদা! ক’জনে এমন করে ভাবতে পারে?”
সুনীতি বলেন, “যা বলেছিস। ইন ফ্যাক্ট, আমি নিজে হলে করতাম কি না সন্দেহ। ওই জেনারেশনটাই আলাদা ছিল জানিস। ক্ষমা, ত্যাগ, ভালোবাসা ছিল ওঁদের ধর্ম।”
“হাবির বই ছাপাতে এত উৎসাহ ওল্ড লেডির। দু-চারটে কবিতা তো পাঠাতে পারত পত্রপত্রিকায়। তাহলে দাদুর খ্যাতি হতো। সবাই জানতো দাদুর নাম।”
“পুরোটা আমি জানি না। পাঠিয়েছিল হয়তো। সিলেক্ট হয়নি। তখন সুযোগও কম ছিল। সেটা তো আর ডিজিটাল এরা নয়। হাতে গুনে কয়েকটা ম্যাগাজিন। আজকাল তো ওয়েব ম্যাগের ছড়াছড়ি।”
“দাদুর লেখাও তো কোনও একটা ওয়েব ম্যাগে বেরোত, তাই না?”
“হ্যাঁ। অনলাইন পত্রিকায়। অনেক বছর আগের কথা। মনপাখি হল বাংলা ভাষার প্রথম অনলাইন ম্যাগাজিন। কত প্রতিষ্ঠিত লেখক মনপাখিতে লিখতেন। আজও লেখেন। তবে মনপাখি চিরকালই নতুন ট্যালেন্টদের জায়গা দেয়। বাবা মনপাখিতে কবিতা পাঠিয়েছিলেন। সিলেক্ট হয়। তারপর নিয়মিত বাবার কবিতা বেরোত মনপাখিতে। মনপাখির একশোতম সংখ্যা বেরোচ্ছে দু-মাস পরে। সময় করে পড়ে দেখিস। ভালো লাগবে।”
( তিন )
কলেজ ক্যান্টিনের সিঁড়িতে বসে জোরকদমে আড্ডা চলছে। বুবাই এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। তানিয়া একটু সরে বসে নিজের পাশে জায়গা করে ডাকল, “রাজর্ষি, এখানে আয়।”
স্বদেশ, অর্ক, পাপিয়া, প্রভাকর, সোমনাথ, আরও অনেকের গা বাঁচিয়ে রাস্তা করে বুবাই গিয়ে বসল তানিয়ার পাশে, বন্ধুদের মাঝখানটিতে। তানিয়া একটা হাত রাখল বুবাইয়ের কাঁধে। আর তানিয়ার কোমর ধরে একটু নিজের দিকে টেনে নিল বুবাই।
বুবাই বা তানিয়ার দিকে কেউ ফিরেও দেখল না। আড্ডা যেমন চলছিল চলতেই থাকলো। এরকম আড্ডায় কোনও টপিকই স্থায়ী হয় না। কথা চলতে থাকে, ঘুরতে থাকে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে।
শাহরুখ খানের নতুন মুভি এসেছে শহরে। শুরু হল মুভি যাওয়ার প্ল্যান। কে বা কারা যেতে চায়, কোন শোয়ে যাওয়া বেশি উপযুক্ত, তাই নিয়ে শুরু হল টানাটানি। অচিরেই হয়ে গেল দুটো গ্রুপ। এক দল আজ বিকেলের শো’তেই মুভি দেখার জন্য উদগ্রীব। অন্য দল একটু রয়েসয়ে যেতে চায়, নেক্সট স্যাটারডে, রিল্যাক্স মুডে।
বুবাই আর তানিয়া অবশ্য পাশ কাটিয়ে গেল। তারা দু’জন গ্রুপে নয়, জুটিতে যাবে আইনক্সে।
একটাই পপকর্নের বাকেট। বুবাইয়ের হাতে ধরা। তানিয়ার মাথা হেলানো বুবাইয়ের কাঁধে। একই পাত্র থেকে জোড়া শালিখ খুঁটে খুঁটে খায়। কখনও পুরুষটি ঠোঁট নামিয়ে আনে। জোড়া শালিখের অপরটি উঁচু করে ধরে ঠোঁট।
টুং করে আওয়াজ হয় প্রভাকরের ফোনে।
প্রভাকর একবার ফোনের দিকে তাকায়, তবে মেসেজ খোলে না, সে তখন আড্ডাতেই মগ্ন।
পাপিয়া জিজ্ঞাসা করে, “কার মেসেজ রে? রিয়ার? রিয়াকেও ডেকে নে মুভি দেখতে। আজকাল তো রিয়ার প্রেমে হাঁসফাঁস অবস্থা তোর।”
পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে সোমনাথ উইঙ্ক করে। বলে, “রিয়ার নতুন ফেসবুক পিপিটা দেখেছিস? কী হট মাইরি! সামলে রাখিস প্রভু। পকেট না কাটা যায়।”
পাপিয়া আর সোমনাথের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকায় প্রভাকর। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজটা খুলতে খুলতে বলে, “যার যেদিকে চিন্তা। পাপিয়া আজকাল তোকে খুব ল্যাজে খেলাচ্ছে, তাই না সোমনাথ। ফর ইয়োর ইনফর্মেশন, রিয়া এখানে নেই। সাত দিনের জন্য দিল্লী গেছে। মামাতো দিদির বিয়ে। এই দ্যাখ, রিয়ার মেসেজ নয়, মাসি পাঠিয়েছে।”
প্রভাকরের মাসিকে তার বন্ধুরা চেনে। প্রভাকরের মাসি টিভিতে খবর পড়েন।
মাসির ফরওয়ার্ডেড মেসেজটা খুলে এক মিনিট সময় নেয় প্রভাকর, মেসেজটা পড়ে। ফরওয়ার্ডেড মেসেজে আছে কোনও কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি।,
প্রভাকরের ফোনটা ধরে টানে পাপিয়া। বলে, “দেখি, দেখি, মাসি কী মেসেজ পাঠাল।”
প্রভাকর ফোনটা দিয়ে দেয় নাছোড়বান্দা পাপিয়ার হাতে। পাপিয়া মেসেজটা দেখে। তারপর উঁচু গলায় আবৃত্তির স্টাইলে কবিতার লাইনগুলো পড়ে।
কলেজ ফেস্টে রেগুলার আবৃত্তি করে পাপিয়া। স্বদেশ মন দিয়ে পাপিয়ার কবিতা পড়া শোনে। বলে, “এটা আমিও পেয়েছি। আমার পিসতুতো দাদা পাঠিয়েছে।”
অর্ক বলে, “হ্যাঁ, আমিও পেয়েছি। এই মেসেজটা এখন ভাইর্যাল। সবার ফোনে ফোনে ঘুরছে। পুরো কবিতাটা বেরিয়েছে মনপাখি পত্রিকায়। মনপাখির একশোতম সংখ্যায়।”
মনপাখি শব্দবন্ধ কানে যেতেই বুবাই একটু সতর্ক হয়। জিজ্ঞাসা করে, “তাই নাকি? কার লেখা? কবির নাম কী?”
অর্ক উত্তর দেয়, “অজয় গুপ্ত। মনপাখি তার একশোতম সংখ্যায় অনেক পুরনো লেখা রিপাবলিশ করেছে। তারই মধ্যে এই কবিতাটা আছে। অজয় গুপ্তের কবিতা প্রথম পড়লাম। দারুণ লেখেন।”
স্বদেশ কাঁধ ঝাঁকাল, “পুরনো লেখা বিভাগে ওঁর কবিতা আছে। আগে লিখতেন। আজকাল বোধহয় আর লেখেন না। অজয় গুপ্ত নামে কোনও কবির লেখা আমি ইদানীংকালে কোথাও দেখিনি।”
বুবাই পড়ে যায় দোলাচালে। সে কোনওদিন বন্ধুদের বলেনি যে, তার দাদু কবি ছিলেন, দাদুর লেখা কবিতার বই আছে। আজ দাদুর কবিতা ভাইর্যাল হওয়ার পর সে কথা জানানো কি শোভনীয়?
তবে অর্ক আর স্বদেশের তর্কের কেন্দ্রে কবি অজয় গুপ্ত। অজয় গুপ্ত যে তার নিজের দাদু, একসময় নিয়মিত মনপাখিতে লিখতেন, বারো বছর হল চলে গেছেন, সে কথা বুবাই বলেই দিল।
এক মুহূর্ত নীরবতা নেমে আসে আড্ডায়। তারপর সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে ওঠে, “হুররে! আমাদের রাজর্ষি কবি অজয় গুপ্তের নাতি!”
বুবাইয়ের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে তানিয়া তাকায় বুবাইয়ের দিকে। বলে, “হোয়াট আ সারপ্রাইজ রাজর্ষি! আয়াম সো প্রাউড অফ ইউ!”
সোমনাথ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, “কবির নাতির মুখ থেকে আমরা কবির জীবন সম্পর্কে শুনতে আগ্রহী।
উজ্জ্বল মুখে বুবাই শোনায় দাদুর কবি হয়ে ওঠার কাহিনী। দাদুর দুটো বইয়ের নামও বলে।
অর্ক হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়। ঘোষণার ভঙ্গিতে বলে, “টুডে নো মোর শাহরুখ খান। লেট আস গো টু কলেজ স্ট্রীট। কলেজ স্ট্রীট থেকে দাদুর বই কেনা হবে। তারপর কফি হাউস। কফি হাউসে বসে কবিতা পাঠ। হাউ ইজ দ্য প্ল্যান?”
( চার )
কফি হাউস থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে আজ একটু রাত হয়ে গেল বুবাইয়ের...
কফি হাউসে বসে কবিতা পাঠ, কবিতার গভীরে ঢুকে অনুসন্ধান, বিশদ আলোচনার পরে, ফরওয়ার্ডেড মেসেজের চার লাইন কবিতা কখন যেন তার মাথায় চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছে...
তবু বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে যেতে যেতে বুবাই আরও একবার নিজের মনে আউড়ে নেয় - অজয় গুপ্তর কবিতা ‘জীবন’ থেকে উদ্ধৃত চার লাইন।
নাহ, আজ মা-র সামনে কোনওরকম ভুল করবে না বুবাই।
বুবাইয়ের মুখে বাংলা কবিতা শুনে মা কি অবাক হয়ে যাবে?
না কি নাতির মুখে দাদুর কবিতা শুনে আনন্দে আটখানা?