আমার জন্ম সত্তর দশকের গোড়ার দিকে। ভাবতে অবাকই লাগে, কত্তগুলো বছর কাটিয়ে ফেললাম এই ধরাধামে!
দক্ষিণ কলকাতার একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পাড়ায় জন্ম, পড়াশোনা কাছেরই একটি স্কুলে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও, বাংলাটা শেখানো হত অতি যত্নে, চালচলন কথাবার্তা সবেতেই বাঙালিয়ানার ঘাটতি ছিল না কোথায়ওই। স্কুলে সরস্বতী পুজোর চল ছিল না, তবে পুজো হত বৈকি। আমাদের সেই ঠাকুর ছিলেন রবি ঠাকুর, রবীন্দ্রজয়ন্তী ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় উৎসব।
পাড়ার দুর্গাপুজোর মণ্ডপটি বাঁধা হত একেবারেই আমাদের বাড়ির সামনেটিতে। পাঁচদিন পর মা নিজের ঘরে ফিরলে মনে হত যেন আমার ঘরটিই শূন্য হয়ে গেল। সাধারণ সুতির জামা, ফুচকা, রোল, আর বড় জোর হলে গিয়ে একটি সিনেমা দেখা, সাধারণ মধ্যবিত্তের পুজো তখন ছিল এমনই সাদামাটা।
একটু বড় হয়ে, মানে আশির দশকের মাঝামাঝি শুরু হল বন্ধুদের সঙ্গে হা হা হি হি করে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার পালা। তাতে ঠাকুর দেখা কম, বক বক বেশি। আর বড় হয়ে গেছি ভাবটা দেখানোর জন্য বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ধাবায় খেতে যাওয়া, যার জন্য অবধারিত একঘন্টা রাস্তার ওপর লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। আমাদের অবশ্য তাতে কোন আপত্তি নেই, রাস্তায় দাঁড়িয়েই আড্ডা চলছে।
স্কুল পেরিয়ে কলেজ, সেও সেই দক্ষিণ কলকাতাতেই। গার্লস কলেজ, মর্নিং ক্লাস। ভোরবেলা বাস ছুটছে, বিশেষ করে শীতকালে যাত্রী শুধু আমি আর কলেজের দুয়েকটি মেয়ে। কোনদিন ভয় হয়নি, কারণ বাসের ড্রাইভার কন্ডাক্টরকে তখনও আমরা ভরসার মানুষ বলেই জানি, চলন্ত বাসে বীভৎস নৃশংস নারী নিপীড়নের ঘটনা তখনও দেড় দশক দূরে।
এর মধ্যে ঘটে যায় বিশ্বায়ন, বাহির বিশ্ব তার অঢেল বিনোদন পণ্য ও আকর্ষণ নিয়ে হাজির হয় আমাদের দোরগোড়ায়। পাল্টে যায় আমাদের অনেক অভ্যাস আকাঙ্ক্ষা চাহিদা।
তবে অনেক কিছু পাল্টালেও, মধ্যবিত্ত মন কিছু অভ্যাস আঁকড়ে থাকে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি অবধিও কারো বাড়িতে কোনো কলেজে পড়া মেয়ে থাকলে আত্মীয়প্রতিবেশীরা বেশ দায়িত্ব নিয়ে তার বাবামাকে বোঝাতে বসতেন যে এবার ছেলে দেখা শুরু করার সময় এসেছে। সাধারণত, 'আমার জানা একটা ভালো ছেলে আছে...তবে...ইয়ে,তারা একটু ফর্সা মেয়ে চাইছে...' এই বলে আড়চোখে শ্যামলা মেয়ের বাবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তাঁরা কথা শেষ করতেন।
আমি কিন্তু বেঁকে বসেছিলাম,আগে চাকরি,তারপর অন্য কথা। মা বললেন, মনে রেখো চাকরি করলেও কিন্তু মেয়েরা সংসারের দায়িত্ব থেকে রেহাই পায় না, করতে হলে সরকারি চাকরির চেষ্টা দেখো, ঘরবার দুটো সামলাতে সুবিধা হবে।
শুরু হল সরকারি চাকরির জন্য যুদ্ধ। তখন পার্ট ওয়ান পাশ করলেই পাস গ্রাজুয়েট বলা হত, কলেজের থার্ড ইয়ার পড়তে পড়তেই শুরু করে দিলাম ফর্ম ভরা। আমার বন্ধুরা কেউই আগ্রহী ছিল না, তাই একটু একলা চলো রে গোছের দাঁড়িয়েছিল ব্যাপারটা। এক দাদা সদ্য চাকরি পেয়েছে, তার থেকে অনেক উৎসাহ পেলাম, আর পেলাম একগাদা competition success review ম্যাগাজিন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অফিস চেনা হল। বাপ্ রে...সে কি লাইন !
একে একে লিখিত পরীক্ষার চিঠি আসতে শুরু হল, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ছুটতাম সারা শহরের নানা পরীক্ষাকেন্দ্রে। বাবা সঙ্গে যেতেন। এবং আমার বারণ না শুনে বাইরে দাঁড়িয়েও থাকতেন পুরো সময়টা ।
কিছুদিন এভাবে ছোটাছুটির পর একটা লিখিত পরীক্ষা পাশ করে টাইপিং টেস্টের চিঠি এল। সমস্যা হচ্ছে, টাইপিং ক্লাসে ভর্তি হলেও, ব্যাপারটা আমার বিশেষ সড়গড় হয়নি। ফলে, টেস্টের দিন সবার মেশিন চলছে ঝড়ের গতিতে, আর আমারটা খট্...খট্ ...খট্। ফলে...ফেল! সেই দাদা শুনে কপাল চাপড়াচ্ছে, টাইপিং টেস্টে নাকি এর আগে কেউ কোনোদিন ফেল করেনি!
কিছুদিন পরে আরেক জায়গা থেকে চিঠি এল, এবার আর টাইপ না বাবা, সোজা ইন্টারভিউয়ের চিঠি। ইন্টারভিউয়ের আগের রাতে মাথা ঠাণ্ডা করে ভালো ঘুম হবে ভেবে মা ঘুমের ওষুধ দিলেন, আমি সেটা হজম করে ফেলে সারা রাত প্যাটপ্যাট করে চেয়ে আছি। উফ্, সে কী টেনশন!
তখন আমার লেডি প্যালারামের মত চেহারা। যাতে একটু ভারিক্কি লাগে, লোকে যাতে একটু সিরিয়াসলি নেয়, এই আশায় মায়ের তাঁতের শাড়ি পরে, টেনে চুল বেঁধে গেছি। ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকে দেখি চারজন ইন্টারভিউ বোর্ডে। দুটো প্রশ্ন মনে আছে, computerisation এর ভালো দিক মন্দ দিক, আর caveat emptor মানে কী। শেষ প্রশ্ন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম কী।
কিছুদিন পরে ইন্টারভিউ পাস করে মেডিকেল টেস্টের চিঠি এল। আবার আমি সারারাত জাগা। যা রোগাপটকা, নিশ্চয়ই ওজন কম বলে বাতিল করে দেবে! নির্দিষ্ট দিনে অফিসে পৌঁছে দেখি ছেলেদের আর মেয়েদের আলাদা আলাদা ঘরে ডাকছে। ছেলেরা যাচ্ছে আর চটপট বেরিয়ে আসছে, মেয়েরা গেছে তো গেছেই। কী হচ্ছে রে বাবা! আমার যখন পালা এল তখন দেরির কারণ বুঝলাম...যে ডাক্তার ছিলেন তিনি নাড়ী দেখতে গিয়ে নাড়ী খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আমি তো তখন নিশ্চিত, ভয়ে টেনশনে আমি নিশ্চয়ই মরেই গেছি, তাই আর আমার নাড়ী পাওয়া যাচ্ছে না!
বেশ খানিকটা যুদ্ধের পরে, শেষে আন্দাজে একটা সংখ্যা বসিয়ে উনি আমায় রেহাই দিলেন।
এর পর বেশ কিছুদিন বারে বারে ডাকবাক্স হাতড়ানোর পরে অবশেষে হাতে এল সেই অতি মহার্ঘ্য বস্তু, সরকারি চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার।
চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় প্রথমেই ছিল দু সপ্তাহের ট্রেনিং। সেবার একসাথে প্রচুর ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছিলাম... কলেজের মত মজা করে ক্লাস করতাম সবাই। জীবনবীমার নানা দিক নিয়ে আলাদা আলাদা ক্লাস হত। দুপুরে এলাহি খাবার ব্যবস্থা, মেয়েরা কেউই পুরোটা খেয়ে উঠতে পারতাম না, ছেলেরা নিতান্ত নিঃস্বার্থ ভাবে অবলা নারীর সাহায্যে এগিয়ে আসতো, নিজেদের প্যাকেট শেষ করে আমাদেরটাও শেষ করে ফেলতো। একবার তো লাঞ্চের পরের ক্লাস নিতে এসে তীব্র আমিষ গন্ধের ঠেলায় এক দক্ষিণ ভারতীয় নিরামিষাশী ম্যানেজার বেরিয়েই চলে গেলেন, রুম ফ্রেশনার ছড়িয়ে-টড়িয়ে আবার ক্লাস শুরু হল। ট্রেনিং শেষে পোস্টিং।
সবে কাজ শুরু করেছি, একটু একটু করে নতুন জীবন নতুন রুটিন বুঝতে শুরু করেছি, পায়ের তলার মাটি শক্ত হতে না হতেই মাথার ওপর থেকে ছায়া চলে গেল, চাকরিতে যোগ দেওয়ার মাস খানেকের মাথায় বাবা চলে গেলেন। একদমই সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া একজনের প্রতি সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যে সহানুভূতি ও সাহায্য পেয়েছি ওই দিনগুলোতে, সেটা কখনও ভোলার নয়।
আমি যাওয়াআসা করতাম বাস বা অটোতে। অফিস টাইমের ভিড় কথাটা এতদিন শুধু শুনেই এসেছি, কারণ চিরকাল মর্নিং স্কুল কলেজ ছিল, এবার হাড়ে হাড়ে টের পেতে লাগলাম। একটা কথা মানতেই হবে, অটোচালক বা বাসের কন্ডাক্টর দাদাদের থেকে আমি কখনো অশালীন ব্যবহার পাইনি, বরং সে তুলনায় কিছু তথাকথিত ভদ্রলোক অফিসবাবু...যাকগে ...থাক্ সে কথা !
এবার আসি কাজ ও কাজের পরিবেশের কথায়। নব্বইয়ের দশকের শেষার্ধের জীবনবীমা ইন্ডাস্ট্রিতে তখন ইউনিয়নেরই একছত্র আধিপত্য। এমন আন্দোলন করবো যে privatisation হতে দেবো না, একথা সবাই বলতেন। এমন কাজ করবো, এমন সার্ভিস দেবো যে গ্রাহকরা বাধ্য হয়ে নয় বরং স্বেচ্ছায় আমাদের কাছে থাকবেন, প্রাইভেট কোম্পানির কাছে যাবেন না, একথাটা একজনকেও বলতে শুনিনি। মিটিং মিছিল কর্মবিরতি, নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল তখন।
তবে এই আন্দোলনের উত্তপ্ত আবহাওয়াতেও কখনো কখনো বসন্ত বাতাস বইতো বৈকি, ভাললাগা থেকে ভালবাসা, ভালবাসা থেকে পরিণয়। আমরা দল মিলে নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। দিনকয়েক বেশ কিছু মুখরোচক গল্পের জন্ম দিয়ে শেষমেশ হতে হতেও ব্যাটে বলে হল না, এমন অধুরি প্রেম কহানিও ঘটলো দুয়েকটা। তারপর সেই গল্পের পাত্রপাত্রীর অন্য অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেল, আমাদের বাছবিচার নেই, খেতে পেলেই হল, আমরা সেই বিয়েবাড়িতেও জুটে যেতাম।
মন ভালো করে দেওয়া অন্যরকম দিনও আসতো কখনো কখনো ... কাজের ফাঁকে রবীন্দ্র জয়ন্তী বা বিজয়ার অনুষ্ঠান। আবৃত্তিটা খারাপ করতাম না, আমার ওপর ভার পড়তো অনুষ্ঠান পরিচালনার। অবাক লাগতো দেখে, অন্য দিনের খিটখিটে বদমেজাজি দাদা আজ বাঁশিতে কী মিঠে সুর তুলছেন! সংসার সন্তান চাকরি সামলে ক্লান্ত বিধ্বস্ত দিদি আজ আবার তাঁর ভুলতে বসা হারমোনিয়ামের রিড-এ আঙুল ছোঁয়াচ্ছেন, রবি ঠাকুর একদিনের জন্য হলেও তাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন তাঁর নির্ভার মেয়েবেলা।
সত্যি কী পরিশ্রম করতেন এই মেয়েরা, কতটা সাহায্য সহমর্মিতা পেতেন জানি না। এমনও শুনেছি. সকালে উঠে যৌথ পরিবারের রান্নাবান্না সেরে বাচ্চাকে নিজের মায়ের কাছে রেখে কাজে আসছেন। অর্থাৎ, বাড়ীর লোক রোজ তার শ্রম, মাস শেষে তার মাইনে নেবে...কিন্তু বাচ্চার দায়িত্ব নেবে না। বাচ্চার স্কুল থেকে ফোন এসেছে, বাচ্চা পড়ে গিয়ে চোট পেয়েছে, মা অফিসারকে জানিয়ে ব্যাকুল হয়ে স্কুলে ছুটছেন, উটকো মন্তব্য উড়ে এল...এই জন্যই মেয়েদের চাকরি পাওয়া উচিত না। (ফোনটা কিন্তু মায়ের অফিসেই আসতো, বাচ্চার বাবার অফিসে নয়।)
একটি ঘটনা মনে থেকে গেছে। আমাদের খুব প্রিয় এক দিদি, যেমন মধুর স্বভাব তেমনি কাজের, ইন্টারভিউ দিয়ে প্রমোশন পেলেন। আমরা খুব আনন্দ করে তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানালাম। যেদিন নতুন পোস্টে জয়েন করার কথা, অবাক হয়ে দেখলাম সেই পুরনো টেবিলে পুরনো পোস্টে তিনি কাজ করছেন... মাথা নীচু, মুখ লাল। সামনে যাবার সাহস আমার হয়নি। কানাঘুষো শুনলাম, তাঁর স্বামী অন্য ব্রাঞ্চে একই পোস্টে কাজ করেন, তিনিও চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু প্রমোশন পাননি। স্ত্রী স্বামীর থেকে উঁচু পোস্টে কাজ করবেন এই সম্ভাবনায় বাড়িতে কী দৃশ্য অভিনীত হয়েছিল জানি না, তবে ভদ্রমহিলা প্রমোশনটি নেননি, বলা ভাল...নিতে দেওয়া হয়নি।
অনেকগুলি বছর কেটে গেছে, অনেক পরিবর্তন এসেছে সারা দুনিয়া জুড়ে। পরিবর্তন এসেছে আমার জীবনেও, ভৌগোলিক, পারিবারিক, মানসিক। গত শতাব্দীর শেষ দশকের শেষ বছরে বিয়ে হয় আমার। তাই বলা চলে সত্তর থেকে নব্বই দশক আমার শৈশব, মেয়েবেলা, কুমারীজীবন। স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে দিনগুলি।
সেই দিনগুলি, সোনার খাঁচায় রইলো না যারা।
সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।