ভাবতে ভালো লাগে জীবনের শুরুতে দীর্ঘ সময় গ্রামে যেন আশ্রমিক জীবন যাপন করেছি, যেন বৈদিক যুগে ছিলাম। যেখানে পাঠ্যপুস্তক তেমন নেই কিন্তু শ্রুতিতে সবই আছে। আজ আমার জীবনের চতুরাশ্রম-এর তৃতীয় ধাপে অর্থাৎ বানপ্রস্থে এসে হঠাৎ লেখালেখির সাধ হলো। হতেই পারে। জীবনের আয়ু কমে এলে সাধ শখগুলো মিটিয়ে নেওয়াই ভালো। কী লিখি তার মাথা মুন্ডু নেই, বলব না। কারণ কথক আমি চিরকালই ছিলাম। কথা, কাহিনি আমাদের ছোটবেলা থেকে আজ অব্দি সঙ্গে সঙ্গেই এসেছে।
আমাদের ছোটবেলায় সময় পেলে ঘুমপাড়ানি গল্প বলত, বাবা, আর মায়ের ছিল ছড়া। একটা ছকে, সুন্দরভাবে পরিবেশ সাজিয়ে বাবার গল্প বলা। মায়ের গল্প ছিল, তবে তা নিজের জীবনের কথা। গাছপালা, নদী-নালা, মামাবাড়ির স্মৃতি।
মা ছিল ডাক্তারবাবুর মেয়ে। সংসারের অনেক ভাইবোনের মধ্যে একজন। মায়ের জীবনের ছোটবেলার অনেকটা কেটেছে তার মামাবাড়িতে। মামাবাড়ি মানেই ছিল ভালবাসা আর আদর। সেখানে মেয়ে ও ছেলেদের সমান স্বাচ্ছন্দ্য। গাছে চড়া, পুকুরে সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, সব কিছুতেই ছিল মায়ের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। খাওয়ার নানা আবদার। প্রিয় খাবার, গলদা চিংড়ির কমলা রঙের মাথার ঘিলু দিয়ে ভাতমাখা আর কালো পাথরের বাটিতে পুরু সরওলা সাদা দুধভাত। সেসব গল্প শুনে আমাদের শিশু মনে আনন্দ জেগে উঠত।
মা গান গাইতে পারত। তবে তা আধুনিক গান নয়, গ্রামীণ যাত্রাপালার কিংবা আঞ্চলিক পুরোনো দিনের গান। আর ছিল ছড়া,কবিতা। সেইসব ছড়ার কবিদের নাম মা জানত না, সুরেলা কণ্ঠে আবৃত্তি করত প্রাণ ভরে। বাবার গল্পের যেমন ছিল জাদু, তেমনি মায়ের গান-ছড়ারও ছিল নিজস্ব এক জগৎ।
মায়ের আর এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল, পুতুল বানানো। মাটির ছোট ছোট পুতুল আমরাও মায়ের সঙ্গে বানাতাম। কাঠের উনুনের আগুনে পুড়িয়ে নিলে সেই পুতুল পেত এক লালচে আভা। পুতুল গড়ার কায়দাও ছিল অভিনব। ছোট্ট মাথা, গোল চোখ, আর সবচেয়ে মজার ছিল হাত। মাথার নীচে ডাইনে-বাঁয়ে দুটো হাত, সামনেও দুটো। আমরা বলতাম, মা, পুতুলের চারটে হাত কেন? মা হেসে উত্তর দিত, এটা হচ্ছে মেয়ে পুতুল। শাড়ি পরালে সুন্দর দেখায়।
পুরোনো শাড়ি কিংবা রঙিন জামাকাপড়ের টুকরো কেটে বানানো হতো শাড়ি-ব্লাউজ, ধুতি-পাঞ্জাবী। বিছানা বালিশও ছিল ওদের। সাজানো পুতুলের বিয়ের খেলাও হতো। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সবাই এসে যোগ দিত। তখনকার দিনে নাকি ধনী বাড়িতে পুতুলের বিয়ে নিয়ে মহাভোজের আয়োজনও হতো,একেবারে মানুষের বিয়ের মতো। সে গল্প শুনতেও আমাদের বেশ মজা লাগত।
বাবার মুখে শোনা গল্পগুলো ছিল একেবারেই অন্য রকম। বাবা ছিল প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বইয়ের প্রতি তার ঝোঁক, পড়াশোনার প্রতি আলাদা ভালবাসা। পরবর্তীকালে আমার বয়স বাড়লে বুঝতে পেরেছি, বাবার গল্পগুলো যেন বই থেকে উঠে আসা, দেশ-বিদেশের নানা কাহিনির মতো। কিন্তু বই থেকে আসা হলেও সেগুলোর মধ্যে প্রাণসঞ্চার করত বাবা নিজেই। তার ছিল গল্প বলার স্বতন্ত্র ভঙ্গি, নাটকীয় পরিবেশনা আর শব্দের জাদু। আমরা কেবল গল্প শুনতাম না, গল্পের ভেতর ঢুকেও পড়তাম।
গল্প বলা আর গল্প শোনার মধ্যে আসলে দুটো আলাদা মানসিকতার খেলা। তখনকার দিনে বুঝিনি, এখন বুঝি। সে কথা কখনো বাবা মাকে বলা হয় না। বাবা যত ভালো করে বলতেন, আমরা তার চেয়েও বেশি ভালো করে শুনতাম। শুনতে শুনতে গল্পে নিজেরা ডালপালা জুড়ে দিতাম। ছেলেবেলায় সেই দিনগুলোতে, যখন গল্প শুনতাম, তখন যদি বলা হত জঙ্গলের কথা, আমরা কল্পনা করতাম আমাদের বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়। রাজপুত্র যখন পক্ষীরাজে উড়ে যেত, আমাদের চোখে ভেসে উঠত স্কুলবাড়ি কিংবা আমাদের গাঁয়ের ছোট্ট নদীর উপর দিয়ে তার উড়ে যাওয়ার ছবি। গল্পকারের বর্ণনার সঙ্গে আমাদের কল্পনার বর্ণনা মিলে মিশে একাকার হয়ে যেত।
বিদেশি অনুবাদের গল্পগুলো ছিল অন্য জগতের। বাবার মুখে যখন সিন্দাবাদের গল্প শুনতাম, সমুদ্র, জাহাজডুবি, হীরে-মুক্তো আর বিশাল পশু-পাখি, তখন আমরা হতবাক হয়ে যেতাম। আমাদের ছোট্ট পুকুর আর মাঠ-ঘাটের অভিজ্ঞতায় সেই অচেনা বিস্তারের কল্পনা দাঁড়াত না। তবুও বারবার শুনতাম, কারণ সেই গল্পগুলো একরকম মায়াজালে টেনে নিত। অনেক সময় কল্পনা ভেঙে যেত, কিন্তু শব্দের সুর, বর্ণনার ঝংকার বেঁধে রাখত আমাদের।
রামায়ণ-মহাভারত বা পৌরাণিক গল্পে ছিল আর এক ভিন্ন আবহ। বনবাস, যুদ্ধ, কঠিন নীতিকথা। এসবের বর্ণনা বাবার মুখে যেন অচেনা বহমান পরম্পরার মতো কিছু মনে হত। এখন ভাবি, বাবা যখন তৎসম শব্দ উচ্চারণ করত, তখন শব্দের মাধুর্য আমাদের কানে নতুন এক আবহ তৈরি করত। হিরণ্যকশিপুর মৃত্যুর কাহিনিতে মৃত্যুর শর্ত ছিল। না দিবস না রজনী, না মর্ত্যে না অন্তরীক্ষে, না মানব না পশু, না কোন বস্তু বা অস্ত্রশস্ত্রে মৃত্যু হবে। তবুও বিষ্ণু সমস্ত শর্ত মেনেই নরসিংহ মূর্তিতে অসুররাজের হত্যার কাণ্ডটা সম্পন্ন করলেন। বর্ণনা শুনে আমরা যতটা না দৃশ্য কল্পনা করতাম, তার চেয়ে বেশি শুনতাম শব্দের সঙ্গীত।
রাজা বিক্রমাদিত্য কিম্বা কালিদাসের কাহিনি। রাজপুত্রের, মন্ত্রীপুত্রের অভিযানে রাতের অরণ্যভয়। এসব গল্পে আমরা টের পেয়েছিলাম মানুষের বুদ্ধি আর কল্পনার অসীম ক্ষমতা। আর হরিশচন্দ্রের সততার কাহিনি। যেখানে রাজা নিঃস্ব হয়ে চণ্ডালরূপে শ্মশানে কাজ করছেন। পত্নী শৈব্যা চাকরানী অপরের বাড়িতে। পুত্র, রোহিতাশ্ব সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছে। এসব বর্ণনায় আমরা বারবার ভেঙে পড়তাম। শীতের রাতে লেপের ভেতর ভাইকে জড়িয়ে ধরে আমরা হাউমাউ করে কেঁদেছি। অথচ সেই গল্পই আবার শুনতে চেয়েছি, বারবার। কারণ বাবার কণ্ঠে, ঝড়-বৃষ্টির রাতে, পুত্রের সৎকারের উদ্দেশ্যে শ্মশানের পথে শৈব্যার যাত্রা কেবল গল্প ছিল না, ছিল জীবনের এক করুণ নাট্যচিত্র।
এইভাবে বাবার গল্প আমাদের শেখায়, সাহিত্য আসলে শুধু লেখা নয়, কল্পনার আরোপও। বাবার গল্পে ছিল সেই কল্পনার জগত, আর মায়ের গল্পে ছিল জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। একদিকে রূপকথার বিস্তার, অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনের টুকরো কথা—দুই মিলেই তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম সাহিত্যচেতনা।
পাড়ার কালিপদ কাকার গল্পে আর এক অপরূপ মায়া! তিনি ছিলেন আমাদের কাছে এক অদ্ভুত কাহিনিকার। যাঁর কথায় রাজা-রানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ আর সুখ-দুঃখের অপূর্ব জগৎ। আমাদের পাশের বাড়ি রাসবিহারীবাবুর আস্তানায় রাতের তাস খেলা আর আড্ডায় নিয়মিত আসতেন কালিপদ কাকা। ফেরার পথে আমাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে কিছুক্ষণ গল্প গুজব। সেই ছোট্ট আসরে আমাদের ভাইবোনদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতেন তাঁর গল্পের জাদুতে।
মনে আছে, এক রাতে গল্পে এক রাজপুত্রের কথা হচ্ছে। গল্প এগোচ্ছে। একসময় রাজপুত্র তার ঘোড়া গাছে বেঁধে, বন্য জন্তুর ভয়ে গাছের ডালে রাত কাটাচ্ছে জঙ্গলে। কালিপদ কাকা থামলেন, বললেন, এই ঘোড়া বাঁধা আর রাজপুত্রের গাছে শোয়ার কথা মনে রেখো, কাল আবার এখান থেকে শুরু হবে। পরের রাতে ঠিক সেই জায়গা থেকে গল্পের সুতো ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন। রাজপুত্রের রাত কাটানোর গল্প থেকে শুরু করে একসময় তিনি পৌঁছে গেলেন নদীর ধারে। সেখানে রাজপুত্র দাঁড়িয়ে ভাবছে, কীভাবে নদী পেরিয়ে ওপারে যাবে, কারণ ওপারেই তার বাড়ি ফেরার পথ। কিন্তু ঠিক সেখানেই কাকা থামলেন, বললেন, আজ এই পর্যন্ত। নদীর ধারে থাক। কাল আবার শুনিস এর পরের অংশ।
এভাবেই রাতের পর রাত, খণ্ড খণ্ড করে গল্প বলে যেতেন তিনি। এখন বুঝি, এ ছিল ধারাবাহিক কাহিনির এক অপূর্ব রূপ, যেন আজকের দিনের কলাম, সিরিজ কিম্বা সিরিয়াল। প্রতি রাতে আমরা উৎসুক হয়ে বসে থাকতাম। কালিপদ কাকা কখন আসবেন, গল্পের পরের অংশে কী ঘটবে? রহস্যের জালে জড়িয়ে থাকত আমাদের কিশোর মন। তাঁর গল্পের ধারাবাহিকতা, এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে যাওয়ার সেই অপেক্ষা, আমাদের কাছে ছিল এক অদ্ভুত আনন্দের উৎস। কালিপদ কাকার কথায় গল্প জীবন্ত হয়ে উঠত, আর আমাদের মনে গেঁথে যেত সেই রাজপুত্র, সেই নদী, সেই জঙ্গল আর রহস্যের ধাঁধা।
তখন আমাদের নিজের ঠাকুমার পাশাপাশি পাড়ার বন্ধুদের দিদিমা-ঠাকুমাদের কাছ থেকেও কত গল্প শুনতাম! সে সব গল্প বেশিরভাগই ছিল রূপকথা, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, পরে যখন আমরা রূপকথা পড়েছি, বুঝেছি, সেগুলোর সঙ্গে সেই শৈশবের গল্পগুলোর কোনো মিলই ছিল না। যেন একেবারেই আলাদা জগৎ।
কোথা থেকে আসত সেই রূপকথা, কে জানে! কিন্তু তার ভেতরে থাকত প্রকৃতির অফুরন্ত রং। নদী থাকত, সমুদ্র থাকত, আগুন থাকত, রাজপুত্র আসত, ছোট ছোট জন্তু-জানোয়ার আর পাখিরা এসে গল্পে ভিড় করত। কেউ হারিয়ে গেলে তারা পথ দেখিয়ে দিত, প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়াত। এদের সবারই অদ্ভুত নাম। বাঘের নাম আলাদা, শিয়ালের নাম আলাদা, এমনকি নৌকা, জাহাজ, সমুদ্র, সবকিছুরই আলাদা নাম। নামগুলো ছিল অচেনা অথচ মায়াভরা, যেন ঠাকুমাদের কল্পনার বা লোকমুখে শোনা কোনো শব্দের অপভ্রংশ, এক আলাদা আঞ্চলিক শব্দমালা।
শুধু ঠাকুমাদের মুখেই থেমে থাকেনি গল্প। আমাদের চেয়ে বড় কিশোরী দিদি, মাসি, পিসিরাও গল্প বানাত। যা ছিল একেবারেই আলাদা। না বইয়ের গল্প, না একেবারে রূপকথা, বরং যেন তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে গড়া কাহিনি। কাঁচা আম, কুল, তেঁতুল, চালতার ফুল। যবের শীষ, আমের মুকুল। সরস্বতী পুজো, ইতু পূজো, ঘেঁটু পুজো। নানা রকম তাদের ব্রত। প্রকৃতি থেকে নানা রকম সরঞ্জাম সংগ্রহের গল্প। হঠাৎ বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় কী দেখে এসেছে, করে এসেছে, সে সব নিয়ে তাদের গল্প তৈরি হত। আজকের ভাষায় বলতে গেলে, সেটা ছিল এক ধরনের ব্যক্তিগত গদ্য। নিজেদের জীবনের আড়ালে লুকোনো, নিষিদ্ধ অথচ মধুর কাহিনি। বাবা-মাকে না জানিয়ে যেসব দুঃসাহসিক কাজ করে এসেছে, তার সবটা আমাদের মতো ছোটদের জন্যই রয়ে যেত গোপন ভাণ্ডারে। যেন একেবারে নিষিদ্ধ সাহিত্য, যা বড়দের শোনানো যায় না।
কিশোর ছেলেদের গল্প ছিল আলাদা স্বাদের। তারা রূপকথা বানাত না, বরং জোগাড় করত “ইনফরমেশন”। কোথায় কোন গাছে কাঁঠাল পেকেছে, জঙ্গলের কোন পুকুরে কই মাছের সন্ধান পাওয়া গেল কিংবা কোথায় সার্কাসের তাবু খাটিয়েছে। তারাও বাঁশ পুঁতে সার্কাসের আয়োজন করত। পাড়ার কুকুর-বিড়ালকে শেখাত সার্কাসের মত খেলা। তাদের গল্প মানে, সাহস, খেলাধুলো আর কসরতের রোমাঞ্চ।
এইসব মিলিয়ে আমাদের শৈশবের গল্পের ভাণ্ডার ছিল অফুরন্ত। একদিকে ঠাকুমাদের রূপকথার জাদু, অন্যদিকে দিদিদের কিশোরী-গদ্য, আর ছেলেদের সাহসিকতার কাহিনি। সবই ছিল সমান সত্যি, সমান কাল্পনিক, যেন জীবন আর কল্পনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তৈরি এক বিস্ময়-ভরা সাহিত্য।
সত্যি বলতে, বাংলা সাহিত্যের চর্চা, তার শিকড় সেই প্রকৃতির কোল থেকে শুরু হয়ে আজকের আধুনিকতার দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। এই অমোঘ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় কোথায়? সেই রসের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন কত না কবি, সাহিত্যিক, আর জীবনের নানা রঙের মানুষেরা।
বাড়িতে বইয়ের সমারোহ ছিল না, পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাই বলে কি জীবনের পাঠশালার অভাব ছিল? স্কুলের পাঠ্যপুস্তকগুলো কি শুধু কাগজের পাতা ছিল, নাকি তাদের মধ্যে লুকিয়ে ছিল এক অপার জ্ঞানের ভাণ্ডার? আমরা কেন তাদের উড়িয়ে দিয়েছি মাথা থেকে? শহুরে শিক্ষিত বন্ধুদের বাড়িতে দেখেছি ঠাকুরদার আমলের বিশাল আলমারি, বইয়ে ঠাসা, যেখানে বড়দের বই ছোট্ট বয়সেই তাদের হাতে এসে পড়েছে। এই কথা শুনে হীনমন্যতায় ভুগেছি বটে, কিন্তু আবার ভেবেছি, আমাদের সিলেবাসের বই, স্কুলের পাঠ্যপুস্তক, সেগুলো কি বই নয়? সেখানেই তো প্রথম চিনেছি রবীন্দ্রনাথের অপরূপ কাব্যরস, নজরুলের আগুনঝরা বিদ্রোহ। কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র। কখনো গভীর চিন্তার স্পর্শ, কখনো বিবরণধর্মী সরলতা। সেখানেই তো পেয়েছি, ‘বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই‘ আর ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে‘। কেন যেন পাঠ্যপুস্তক আর তার বাইরের বইয়ের জগৎকে আমরা সব সময় আলাদা করে দেখি!
গল্প-কবিতা-ছড়ার শব্দভাণ্ডার শুধু পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মাঠে-ঘাটে, জলে-স্থলে, আকাশে-বাতাসে, ফুলে-ফলে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য শ্রুতির মধুর স্মৃতি। রস কষ সিঙ্গাড়া বুলবুলি, পুণ্যি পুকুরের পুজোর ছড়া, ইতু পুজোয় উমনো ঝুমনোর গল্প। এসব যে ছিল আমাদের চারপাশে, প্রকৃতির কোলে, খেলার ছলে। প্রকৃতির এই রসময় পাঠশালায় এত কিছু শিখেও আমরা কেন না-শেখার ভান করে বসে আছি? কেন নিজেদের মূর্খ ভেবে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকি? এই সাহিত্যের রস, এই জীবনের সুর, হৃদয়ে ধারণ করলে কোনো পাঠই অপূর্ণ থাকে না।
ছোটবেলা থেকে নিজেকে বোকাই ভাবতাম। তবে এখন মনে হয়, মূর্খতা ততটা ছিল না, না হলে ষষ্ঠীদাদু কি আর আমাকে ডাকতেন? বয়স তখন দশ কিংবা এগারো। একদিন পাড়ার ষষ্ঠীদাদু ডেকে বললেন, খোকা, রামায়ণের এখান থেকে দুটো পাতা পড়ে শোনা দেখি।
ষষ্ঠীদাদু আমাদের পাড়ার একেবারে আলাদা মানুষ। সন্ধে নামার আগেই তিনি মাটির বাড়ির উঁচু দাওয়ায় বসে যেতেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে আস্তে আস্তে টানতেন হুঁকোতে ভরা তামাকের ধোঁয়া। সামনে থাকত কাঠের একখানা বই রাখার জায়গা। সেখানে শোভা পেত বিশাল একখানা গ্রন্থ, রামায়ণ। ভারী, মোটা, যেন অচেনা কোন জগৎ থেকে চলে এসেছে। কোথা থেকে এল, সে আমি জানতাম না। তবে এটুকু বুঝতাম, বইখানা সাধারণ বই নয়। এর ভেতরে আছে এমন এক জাদু, যা ষষ্ঠীদাদুকে প্রতিদিন সন্ধেবেলা ডেকে আনে।
দাদু বলতেন, এই এক বই, যতবার পড়া যায়, ততবার তার মানে আলাদা হয়ে ওঠে। বইটা সবসময় খোলা থাকত, কেউ যেন পড়তে পড়তে কয়েক পাতা উল্টে রেখে দিয়েছে। পাতার ভাঁজে গুঁজে রাখা থাকত পরিপাটি কাটা একটা তালপাতার টুকরো। তখন জানতাম না, ওটা আসলে ছিল বুকমার্ক।
আমরা খেলতে বেরোলে দাদুর উঠোন দিয়েই যেতে হতো। তিনি সস্নেহে ডাক দিতেন। বলতেন, খোকা শোন, এই দিকে আয়। যেখানে খোলা আছে, সেখান থেকে দু’পাতা অন্তত পড়ে শোনা। চোখে তখন আর ভালো দেখতেন না তিনি। অথচ একই বই নিজের জীবনে কতবার পড়েছেন তার হিসেব নেই। তবু আবারও শুনতে চাইতেন। যেন তাঁর কাছে গল্পের মানে বদলে যেত, নতুন করে খুলে যেত অরণ্য, যুদ্ধ আর রাজকাজের রহস্য।
অনর্গল বই দেখে পড়ে যাওয়ার ক্ষমতা তখন আমার ছিল। এই দক্ষতাটাই কাজে লাগল ষষ্ঠীদাদুর কাছে। তিনি পড়ে শোনাতে বলতেন, আমি পাতার যেখানে খোলা থাকতো, সেখান থেকেই দু'লাইন দু'লাইন পড়তে শুরু করতাম। বাংলা যুক্তাক্ষরের জট, কঠিন বড় বড় শব্দ, সবই তখন আমার আয়ত্তে আসতে শুরু করেছে। ফলে তেমন অসুবিধা হত না। খেলার সময় ডাক পড়লে যদিও বিরক্ত হতাম, মাঠে যাওয়ার দেরি হত কিংবা খেলাধুলো শেষে ঘরে ফিরতে দেরি করে ফেলতাম। তবুও দাদু বলতেন, আরও, দুটো পাতা পড়ে দে। পড়া শুরু করলে আমিও যেন গল্পে ডুবে যেতাম। কোনো অংশ বুঝতে অসুবিধা হলে দাদু ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করতেন। দাদু চোখের দোষে পড়তে না পারলেও, আমার গলায় শুনে সব বুঝে নিতেন। তখন মনে হত, শব্দই যেন আর এক রকম আলো।
সেদিন পাতার খোলা অংশে ছিল ‘অরণ্যকাণ্ড‘। আমার মনে হলো, কী আশ্চর্য মজা এখনকার গল্পে! সেখানে প্রবেশ করেছে শূর্পণখা, রাবণের ভয়ঙ্করী বোন। অরণ্যের নির্জনতা ভেঙে সে রামের কাছে প্রস্তাব এনেছে, তাকে বিয়ে করতে হবে। রাম হেসে বোঝালেন, আমি বিবাহিত, আমার সীতা আছে। তবে তুমি চাও তো, ভাই লক্ষণের কাছে কথা বলো।
লক্ষণও রাজি হলেন না। তখন ক্রুদ্ধ শূর্পণখা সীতার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন গ্রাস করবে তাঁকে। আর সেই মুহূর্তেই ঘটল মহাসংঘাত। লক্ষণ রাগে তার নাক কেটে দিলেন। ভয়ঙ্কর রাক্ষসী, অথচ সুদর্শন রাজপুত্রকে বিয়ে করার সাধ। যেন ভয়ঙ্করতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক রসিকতার ঝলক।
কিন্তু তখন কি জানতাম, এই নাক কাটার ঘটনাই একদিন লঙ্কার ভয়াবহ মহাযুদ্ধের সূত্রপাত করবে? আজ ভাবলে বিস্ময় জাগে, কী এক অদ্ভুত বাঁক এনে দিলেন মহাকবি বাল্মিকী। আর কৃত্তিবাস, তাঁর অনুবাদে এই ঘটনার বর্ণনা দিলেন এমন ভাবে যেখানে ভয় আর হাসি, রূপ আর বিকৃতি, রাগ আর ভালোবাসা, সব এক সঙ্গে মিশে গিয়েছে। শিশুমনে যা ছিল নিছক হাস্যরস, পরে বুঝলাম, সেটাই আসলে এ মহাকাব্যের এক বিশাল টার্নিং পয়েন্ট।
পয়ার ছন্দে লেখা কৃত্তিবাসী রামায়ণ। এই নামটি প্রথমে আমার কাছে কেবলই একটি শোনা শব্দ ছিল। পরে ধীরে ধীরে জেনেছি তার গঠন, ছন্দ। যেমন জেনেছি মহাকবি বাল্মিকীর রামায়ণ কিন্তু কৃত্তিবাস সেই অর্থে অক্ষরে অক্ষরে অনুবাদ করেননি। তিনি সেখানে মিশিয়েছেন নিজের রস, নিজের অভিজ্ঞতা, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার আলোছায়া। কোথাও নতুন কাহিনী, কোথাও ভিন্ন পরিণতি, আবার কোথাও এমন বর্ণনা, যা নিছক কৃত্তিবাসের সৃষ্টি। এ যেন এক পুরোনো মূর্তিকে নতুন অলঙ্কারে সাজানো, তবু তার গরিমা অনন্য।
আসলে, কে-ই বা জানে রামায়ণ প্রথম কোন ভাষায়, কেমন ভাবে লেখা হয়েছিল! বহু যুগ আগে, হয়ত লিখিত নয়, ছিল শ্রুতি আকারে। একজন বলতেন, আর একজন শুনে মনে রাখতেন, আবার অন্য আর একজনকে শোনাতেন। আর সেই শোনা এবং বলার ভেতরেই অজান্তে বদল ঘটত ভাষায়, কাহিনিতে। সুতরাং বাল্মিকীর সেই মূল বাণী যখন কৃত্তিবাসের কলমে এসে পৌঁছল, তখন তার মধ্যেও হলো নানা অদলবদল, নানা রসের মেলবন্ধন। সে সব নিয়ে আমার আসলে খুব একটা মাথাব্যথা নেই। আমার কাছে রামায়ণ মানেই এক অনবদ্য গল্প, অনন্য বর্ণনা, আর সেই বর্ণনার ভিতর দিয়ে বয়ে চলা অসাধারণ এক অনুভূতি। ছোটবেলাতেই তা টের পেতাম। গল্পের চেয়েও বড় কিছু, একটা গভীর আবেগ, একটা সাংঘাতিক টান।
সবচেয়ে মজার বিষয় হল, কৃত্তিবাসী রামায়ণ যে পয়ার ছন্দে লেখা, তার ভিতরে আছে এক ধরনের পাঁচালির সুর। আমি যখন পড়তাম, চেষ্টা করলেও সুর পুরোপুরি দমন করতে পারতাম না, অবচেতনেই সুর ভেসে আসত। যেন শব্দগুলো নিজে থেকেই গাইতে চায়।
আমাদের বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার মা লক্ষ্মীপূজা করত। এমনি প্রতিদিন সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বালানো, শঙ্খ বাজানো ছিলই। বৃহস্পতিবারে ছিল এক বিশেষ গাম্ভীর্য। ছোট্ট উপকরণ সাজিয়ে রেখে মা শাড়ির আঁচলটা মাথার পেছনে ঘুরিয়ে সামনে টেনে এনে দু’হাত জোড় করে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে বসত। আমার কাজ ছিল, লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া। সেই পাঁচালী আমি সুর করেই পড়তাম। মার কাছেই শিখেছিলাম সেই ভঙ্গি। আজ মনে হয়, সেই পাঁচালী পাঠের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল ছন্দের বীজ, মাত্রার বীজ, সুর ও তাল। শব্দ, সুর, ছন্দ আর ভক্তির মিলনে যেন এক পাঠশালা খুলে গিয়েছিল আমাদের ঘরের কোণে।
যাঁরা কথক, যাঁরা রামায়ণ পাঠ করেন, তারা অনেক সময় বই না নিয়েই শুধু স্মৃতির জোরে বলে যান, গল্প সাজিয়ে তোলেন। যেন স্রোতের মতো ঝরে পড়ে শব্দ, আর তার ভিতর দিয়ে জন্ম নেয় এক নতুন সৃজন। কথকঠাকুরদের প্রত্যেকেই আসলে একটু-না-একটু রচয়িতা। তাদের কণ্ঠে যখন কাহিনি ওঠে, তখন তার ভেতর লুকিয়ে থাকে নিজস্ব রচনা-বাসনা, এক অদৃশ্য কবিমূর্তি। বিস্ময় লাগে, যখন দেখি, এঁরা মুখে মুখেই পয়ার ছন্দের মতো তাল মিলিয়ে পাঁচালির সুর বয়ে নিয়ে যান। কখনো গদ্যের মতো, কখনো আবার ছন্দের অঙ্কের মতো পরিমিত। তবুও সেই নির্দিষ্ট মাত্রা, সেই নিখুঁত মিল বজায় রেখেই নিজের শব্দও ঢুকিয়ে দেন, নিজের কল্পনা মিশিয়ে দেন। যেন রামায়ণের শরীরে ঢেউ খেলে যায়, অথচ তার ছন্দ ভাঙে না।
প্রত্যেক সাহিত্যসচেতন, সংস্কৃতিসচেতন মানুষের ভেতরেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকে এক রচয়িতা। সে গ্রাম হোক বা শহর, ভেদ নেই কোথাও। প্রতিটি মানুষের অন্তরে যেন জন্মগত এক ছন্দবোধ আছে, শব্দের সমাহারকে ধরবার এক স্বতঃসিদ্ধ ক্ষমতা আছে। বড় হতে হতে যখনই এ নিয়ে ভেবেছি, প্রতিবারই বিস্মিত হয়েছি। সত্যিই, মানুষ জন্মগতভাবে শিল্পী। কেউ তা ভাষায় বলে, কেউ তা সুরে, আর কেউ শুধু হৃদয়ের ভেতরে লালন করে।
তরুণ বয়সের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হঠাৎই মনে হল, আমরাও লিখতে পারি। আর সেই স্বপ্নকেই ডানা দিল আমাদের পাড়ার ছেলেদের দলবদ্ধ উদ্যোগ, এক টুকরো দেওয়ালপত্রিকা। তখন আমরা হাই স্কুলে পড়ি। টাউনে যাওয়া, বইপাড়া ঘুরে চার্ট পেপার কিনে আনা। সেই চার্ট পেপারের উপরেই শুরু হলো হাতে লেখা পত্রিকার যাত্রা। ছোট ছোট ছড়া, কিশোরোচিত গল্প, টুকরো টুকরো স্বপ্নের শব্দমালা। আমাদের সম্পাদক হলেন শিবু কাকা, শিবপ্রসাদ রায়। তিনি ইংরেজিতে এম.এ. করা শহরের কলেজের অধ্যাপক। বড় মাপের শিক্ষক, জ্ঞানী মানুষ, তাই তিনিই আমাদের পত্রিকার সম্পাদনার গুরুদায়িত্ব নিলেন। আমার হাতের লেখা ভালো ছিল। পুরো পত্রিকা হাতে লেখার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। পাড়ার ছেলেমেয়েদের মাথায় তখন সৃজনশীলতার উন্মাদনা। কেউ আঁকছে ছবি, কেউ লিখছে। আমাদের কাছে সেই ছিল আসল সাহিত্যচর্চার প্রথম পাঠ।
একটু বড় হতেই, পাড়ায় নজরুল জয়ন্তী, রবীন্দ্র জয়ন্তীর নামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করতাম আমরা। সেখানে গান, আবৃত্তি আর নাটকের চর্চা চলত আমাদের সামর্থ্য আর গ্রামের অবস্থা অনুযায়ী। তবে নাটকের জায়গাটাতেই হতো সবচেয়ে বেশি গোলমাল। কারণ, প্রায় সব নাটকেই স্ত্রী-চরিত্র বাদ পড়ে যেত। আমাদের পাড়ার তরুণীরা কেউ নাটকে অংশ নিত না, রিহার্সাল করার অনুমতি ছিল না বাড়ির তরফে। ফলে আমরা বাধ্য হতাম স্ত্রী-চরিত্রহীন নাটক করতে।
উৎসাহে ঘাটতি ছিল না। বড়দের কেউ কেউ কলকাতায় পড়ত। ছুটিতে এলে তারা ক্লাবের জন্য কিনে আনত বিশেষ ভাবে স্ত্রী-চরিত্রবর্জিত নাটকের বই। আবার অনেক সময় নাটকের বই না পেলে আমরা দু'-এক বন্ধু মিলে পুরোনো দিনের জনপ্রিয় অভিনীত নাটকের অংশ জুড়ে দিয়ে তৈরি করতাম নতুন নাটক। সংলাপও বানিয়ে নিতাম নিজেরা, দর্শকদের রুচি ও আনন্দের মেজাজ বুঝে। যেন নাটক নয়, এক ধরনের খেলা, কিন্তু সেই খেলায় ছিল আমাদের সৃজনশীলতা আর গ্রামের মানুষের আনন্দ।
আমরা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম, কিন্তু ভেতরের ছেলেমানুষি তেমনই থেকে যাচ্ছিল। স্কুলে পাঠ্যসাহিত্যের ভার বাড়ছিল বটে, তবু সমান ভাবে আমাদের চারপাশে বেঁচে ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির নানা রূপ। পালাগান, যাত্রাপালা, কবির লড়াই, তরজা গান। মহিলাদেরও ছিল আলাদা জগৎ। গ্রামে ছিল মহিলা ভাসান গান। বিশেষ করে মনসামঙ্গল কাব্যের বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনিকে তারা নিজেদের ভঙ্গিতে পরিবেশন করত। সেখানে গান থাকত, গল্প থাকত, কিন্তু সঙ্গে থাকত সমাজের কথা, মহিলাদের সুখ-দুঃখের কথা। সাহিত্য, সমাজ ও গৃহজীবন মিশে যেত আপন ঘরানায়।
শৈশবে ভক্তিগীতির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে কীর্তনের আসরে। কীর্তন আমার কাছে এক অনির্বচনীয় ভালোলাগার অভিজ্ঞতা। ছোট্ট আমি, বাবার হাত ধরে গ্রীষ্মের দুপুরে কীর্তন শুনতে যেতাম। সেই আসর যেন ছিল আনন্দ আর ভক্তির এক অনন্য মিলনক্ষেত্র। কাহিনি ছিল রাধা-কৃষ্ণের লীলা। অপরূপ রঙে রঙিন। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবাই মুগ্ধ হয়ে বসত সেই আসরে। আমি বাবার পাশে থেকে যা ঘটত তার সবই শুনতাম, দেখতাম।
গ্রামের কোন ধনীর বাড়িতে শামিয়ানা টাঙিয়ে তৈরি কীর্তন-মণ্ডপ। মাঝখানে আসন জুড়ে বসতেন কীর্তনীয়া। হাতে হারমোনিয়াম, পাশে তবলা। মানুষ ভিড় করত চারপাশে, যেন মহোৎসব। ভিড়ের বাইরে আবার জীবন্ত হয়ে উঠত এক ছোট্ট মেলা। রাস্তার ধারে ধারে লিচু, তালশাঁস, বরফ-দেওয়া শরবতের দোকান। আর ছিল তালপাতার পাখা। এই তালপাতার পাখাগুলোই যেন গ্রীষ্মের আসল সম্পদ। নকশা আঁকা, হাতে তৈরি, শীতল বাতাসের সঙ্গে বহন করত গ্রামের হস্তশিল্প। অনেকেই কীর্তন শুনতে শুনতে সেই পাখা দিয়ে হাওয়া খেতেন, যেন ভক্তির সঙ্গে মিশে যেত গ্রীষ্মের প্রশান্তি।
কিছু বয়স্ক গ্রামবাসী সঙ্গে আনতেন গামছা। মাথায় দিয়ে হাঁটার সময় গামছা যেমন রোদ থেকে বাঁচাত, তেমনি কীর্তন শুনতে শুনতে অঝোরে কান্নায় যখন ভিজে যেত চোখ, সেই অশ্রু মুছতেও গামছাটিই হত অবলম্বন। আমি দেখেছি, কৃষ্ণলীলার কাহিনি কিংবা কোনো ভক্তিগীতির সুরে মানুষ কত সহজেই ভেসে যেত। তাদের চোখের জল যেন ছিল পরম ভক্তির অর্ঘ্য। ছোটবেলায় তাদের কান্না দেখে আমারও চোখ ভিজত। প্রথমে অন্যদের দেখে, পরে বুঝেছি, আসলে সেই সুর, সেই ছন্দ, সেই গল্পের পরিবেশনা আমাকে সত্যিই স্পর্শ করেছিল।
কীর্তনের শব্দ ছিল জাদুকরী। কখনো প্রায়-সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দ, কখনো টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়া ছন্দ। সব মিলিয়ে যেন সাহিত্যের এক নতুন রূপ। শুধু গান নয়, শব্দের মূর্ছনায়, ধ্বনির খেলায়, ছন্দের তরঙ্গে অনুভব করেছি সাহিত্যের গূঢ় সৌন্দর্য।
কীর্তনের আঙ্গিকের একটি ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যায়। কীর্তনীয়া কখনো নিছক গল্পকারের মতো গদ্যে বর্ণনা করেন, কখনো হালকা ছন্দে কাব্যের স্বাদ মিশিয়ে বলেন, আবার হঠাৎ গদ্য ভেঙে চলে যান সুরে। সেখানেই জন্ম নেয় কীর্তনের আসল অঙ্গ। এক অদ্ভুত শিল্পরীতি, যেখানে কথার সরল গদ্য আস্তে আস্তে ভেসে যায় সাধুভাষার ধ্বনিতে, তৎসম শব্দের ঝংকারে, কাব্যিক আবৃত্তির আভায়, আর তারপরেই গদ্য থেকে সুরে, কাহিনী থেকে কীর্তনে।
কাহিনিতে ধরা পড়ছে রাধিকার ঘরবন্দি জীবন বৃত্তান্ত। জটিলা আর কুটিলা সর্বদা চোখে চোখে রাখছে বউমাকে। বাইরে বেরোতে দেবে না, যেন ঐ রাখাল ছোঁড়ার সঙ্গে একটুও দেখা না হয়ে যায়। কীর্তনীয়া রাধার ছুতোর, অজুহাতের অভিনয়ের আভাষ দিচ্ছেন কীর্তনে। রাধা ভান করলেন যেন অসুখে কাতর, ব্যাথায় জর্জরিত, আর অনুনয় করে বলছেন, আমায় একটু সাহায্য করো, একজন ডাক্তার এনে দাও।
শুরু হলো কীর্তনীয়ার শিল্পীসুলভ খেলা। তিনি বললেন, রাধিকা কাঁদছেন, ডাক্তার, ডাক্তার বলে। কিন্তু সুরে, ভঙ্গিতে, উচ্চারণের টানে শব্দটি হয়ে উঠল ডাক তার। অর্থাৎ ডাকো তার, তাকে ডাকো। শ্রোতাদের কারোই বোঝার অসুবিধে হল না, ডাক্তার নয়, কেষ্টকে ডাকারই ফন্দি।
এই অভিনব রসকৌতুকের ভিতরেই হঠাৎ ঢুকে পড়ল সমকালীন বাস্তবতা। পাড়ার লোকেরা জটিলা-কুটিলাকে বলল, লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে তোমাদের বউ কালাজ্বরে পড়েছে। আসামের কালাজ্বর। আসাম থেকে এসে যেটা তখন বাংলায় ছড়াচ্ছে। তার ওষুধ জানে নাকি শুধু মাঠের ঐ রাখাল দলের মোড়ল।
কীর্তনীয়া তখন গানে গানে সেই কথাই তুললেন—
এ যে আসামের কালাজ্বর…
এ যে আসামের কালাজ্বর…
শ্রীখোলের তালে তালে যখন বারবার উঠল এই কথা, তখন কীর্তনীয়া শব্দ ভাঙতে ভাঙতে এক আশ্চর্য খেলা দেখালেন। ‘আসামের কালাজ্বর‘ হয়ে উঠল — আঃ শ্যামের কালা জ্বর।আসাম মিলল শ্যামের সঙ্গে, কালাজ্বর মিশল কালার জ্বরে। এখানে কিন্তু কোনো কৃষ্ণভক্তির অতিনাটকীয়তা নেই। নেই প্রেমতৃষ্ণার বাড়াবাড়ি। আছে কেবল শব্দের খেলা, উচ্চারণের কৌশল, সুর ও ধ্বনির এমন এক শিল্পময় ব্যবহার, যেখানে আসামের কালাজ্বরই রূপান্তরিত হয়ে যায় শ্যামের অর্থাৎ কালার জ্বরে। ভাষা, সুর, কাহিনি আর অভিনয় মিলে গড়ে ওঠে এক বিরল সাহিত্যসৃষ্টি। সেই মুহূর্তে শ্রোতাদের সঙ্গে সঙ্গে আমারও কান্না পেয়ে যায়, গামছা ভিজে যায় অশ্রুজলে।
আমরা আবার যখন দেখছি শ্রীরাধিকার অঙ্গসজ্জার জন্য গানে গানে তার পরিচারিকাকে বলছেন:
দাও লিখে দাও মাথায় আমার, মোহন।
গলায় লিখো, গোবিন্দ নাম, হোক না গলার মালা,
কলঙ্কিনী পোড়া কপাল, তাতে লিখো, কালা।
দাও লিখে দাও....
শুধু কি ছবি তৈরি হচ্ছে? শুধু কি ভাব? তার মধ্যে শব্দ তৈরির খেলা নেই? গলায় গোবিন্দ ‘গ‘ দিয়ে কপালে কালা ‘ক‘ দিয়ে আর মাথায় মোহন ‘ম‘ দিয়ে তৈরি হচ্ছে যে শব্দের খেলা, তাও তো অনেকেরই মাথায় ঢোকে এবং তারই জন্য সেটা হয়ে ওঠে আরো অনুভূতিশীল। যত না বিষয় চিন্তা তার চেয়েও ছাপিয়ে যায় পরিবেশনা। তখনই সার্থক হয় রচনা।
রচয়িতার মন তৈরি করতে হলে তাকে পেরোতে হয় নানা শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে। কিছু হতে চাইলেই হওয়া যায় না। ছোটবেলায় নিমাই সন্ন্যাস পালার জগাই মাধাইয়ের অভিনয় ক্ষমতা দেখে মাতাল হতে চেয়েছিলাম। দেওয়াল পত্রিকার সময়ে হতে চেয়েছিলাম কবি। পিসি সরকারের ম্যাজিক দেখে জাদুকর হতে চেয়েছিলাম। নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলাম অথবা কীর্তনীয়া। সবশেষে, স্কুল পেরিয়ে শহরের আর্ট কলেজে পৌঁছে চিত্রকলার শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল এক সৃজনশীল মানস। অন্য এক রচয়িতার মন। শিল্পী হতে চেয়েছিলাম। হওয়া হয়নি কিছুই। নিয়ম-নিষ্ঠার শাসন দীর্ঘদিন সহ্য করার পর চর্চা একসময় অন্তরে জারিত হওয়ার পর আসে আবেগ, ঝোঁক আসে, বেড়ে ওঠে সৃষ্টির তাগিদ। তখনই বারবার প্রশ্ন মাথা তোলে, কী আঁকব? কেন আঁকব? কাদের জন্য আঁকব? লেখালিখির বেলাতেও সেই একই প্রশ্ন—কী লিখব? কেন লিখব?