• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | রম্যরচনা
    Share
  • কেমন আছেন? : নিবেদিতা দত্ত

    ‘কেমন আছেন?’ পথে ঘাটে চেনা পরিচিতের এ প্রশ্নে আলগা উত্তর দিই ‘হ্যাঁ, এই চলছে।’ কেউ আবার আর একটু বিশদে বলেন ‘ঠিক-ই আছি, তবে প্রেশারটা বেড়েছে, সুগারটাও হাই, চায়ে চিনিটাও গেল বোধ হয়!’ স্বনামধন্য ভাষাবিদ শ্রীজ্যোতিভূষণ চাকী ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নের উত্তরে তাঁর টক-মিষ্টি ভাষায় বলতেন ‘বলতে পারেন ভাল-মন্দ মিশিয়ে ভাম অবস্থান--অর্থাৎ ভালর ‘ভা’ আর মন্দর ‘ম’—'(১)

    কোনো ভাষাতেই কেউ বলে না বোধ হয় ‘তোমার মন কেমন আছে?’ ওটা তো মাপা যায় না, দেখাও যায় না, তাই ধর্তব্যের মধ্যেও আসে না। ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নে মনের খবর থাকা বা না থাকাটা তাই জরুরিও নয়। কিন্তু কেউ যদি সোজা বলেন ‘আমি ডিপ্রেসড’ তার জন্য আছেন মনস্তাত্বিক। আছে কাউন্সেলিং। আমাকে একবার এক পরিচিতকে নিয়ে যেতে হয়েছিল কাউন্সেলিং-এর জন্য। স্পষ্টতই সে ভালো ছিল না, কেমন জানি উদাস উদাস, সাড়া দেয় না, রাতে ঘুমায় না। এটা ঠিক কোভিডের পরপরই। যাইহোক গেলাম নিয়ে। ঝাঁ-তকতকে ক্লিনিক, ঘষা কাঁচ ঘেরা খোপে খোপে কাউন্সেলাররা বসেন, চড়া ফিজ। ওঁরা বাতলাবেন নানান উপায় মন ঠিক রাখার। কখনো ঘুম আসার জন্য একশ গোনা, তার সাথে জুড়ে দেবেন ঘুমের ওষুধ, বলবেন ওতে ক্ষতি নেই। ঘরের বাইরে ঝিমিয়ে পড়া কালিবর্ণ সব মানুষ। সঙ্গে আত্মীয় পরিজন? অবশ্যই আছেন।

    মাস খানেক গিয়ে ইতি টানলাম। ভাবতে বসলাম এই অব্দি মানুষটা এল কেন। উত্তর পেলাম, হয়ত অবহেলা--ক্রনিক তো মনে হয় না। সদাই বলা নিজের খুশি নিজে খুঁজে নাও, আমরা ব্যস্ত টিভিতে, নয় খবরের কাগজে যাদের মূল বস্তু খুন রাহাজানি ধর্ষণ, বা রংদার গুলিগোলা-ভরা সিনেমা। আর তা নয়ত রয়েছি অধুনা আত্মার আত্মীয় মোবাইলে মশগুল। অথচ বাড়িতে ক্যারম, চাইনিজ চেকার, ব্রেনভিটা এমনকি নেহাত সাদাসিধে সাপলুডো ও মজুত রয়েছে। কিন্তু হইহই করে বসা আর হয় না, দুবার জোরে ‘লে ছক্কা’ বলেই, লুডোর ঘুঁটি পায়ের তলায় লুকিয়ে ভালো মানুষ সেজে কলা দেখানো হয় না, কই আর বলি ‘আমার সব ঘুঁটি ঘরে গ্যাছে আর কি খেলবি তোরা!’ এতো ছার; কেউ কারো পাশেই বসি না, চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে টেবিল চাপড়ানো? দূর অস্ত। কেনই বা এসবে মাতব, ওতো ছেলেমানুষি। আর কীসেরই বা অভাব--আর্থিক স্বাচ্ছল্য, তার জোরে রান্নামাসি, ডাস্টিং দিদি, মালি-দা, গাছে জল দেওয়ার ছোট ছেলে—সব সওব ব্যবস্থা ছিদ্রহীন। কেবল জেনে নেওয়া রাতে ঘুম হয়েছে তো? বা ঘুম ভেঙে গেছে, তবে কি প্রেশার বাড়ল? জানা হয় না মন খারাপ কিনা। কারণ মনের দোসর তো কেউ কারো নই।

    তবু সারিয়ে তুলেছিলাম সেই মানুষটিকে আমার নিজের প্রেসক্রিপশনে। পোর্চের তলার জঙ্গুলে বাগানে সিঁড়ির ধাপে বসে চা বিস্কিট ধরিয়ে দিয়েছিলাম হাতে। গাছের ফাঁকে নেউলের আনাগোনা (এই শহরেও), মৌটুসির দোল, হুলোর আড়মোড়া ভেঙে চোখ মটকে তাকানো; সারিয়ে দিল তাকে। কখনো বিকেলে মার্কেটে গিয়ে কবেকার তেলে ভাজা বিট নুন ছড়ানো বেগনি, কাগজের বাক্সে ঠেসে পোরা স্ট্রীট চাউ ঝরঝরে একেবারে ম-ম ম-- পরমানন্দে সাবড়েছি, বা ফুচকাআলার টাকা গোনা ঘাম মোছা হাতে আলু চটকান, কালোচিটে তেঁতুল জলে ডোবানো গোলগাপ্পা হুস-হাস শব্দে নিঃশেষ করেছি। আবার কখনো কাছেপিঠে রথের মেলায় গেছি ঝুটো মুঠো কানের দুল গলার হার কিনতে; বা শুধুমুধুই রিকশা চেপে রাতের আলো দেখে বেড়িয়েছি। স্বাস্থ্যের কি হয়েছিল জানি না তবে মন ছাড়া পেয়েছিল, হাসি ফুটেছিল মুখে।

    কিন্তু বিপত্তি তো সবেতেই থাকে। আর ঝাঁপি যখন খুলে বসেছি বলি বর্ষার রূপ দেখতে গিয়ে আমি এই হালেই পড়ে গিয়েছিলাম পার্কের শ্যাওলা-ধরা ওয়াক স্পেসে। ডাক্তারবাবুর কাছে তো যেতেই হ’ল। দেখবেন, এক্স-রে করতে বলবেন। সবই বললেন আবার কিছু ফাউও পেলাম। নিজে টয়লেট ব্যবহার করতে পারব তো? প্রশ্নে বললেন ‘প্রকৃতি তো আর একটা পা-ও দিয়েছে, হাত-ও আছে দুটো বাড়তি, ভয় কি? তাই দিয়েই নিজে সব করবেন। এক্স-রে প্লেট দেখে বললেন হেভি স্প্রেন, পা উঁচুতে রাখতে হবে। উনি বললেন আমিও মানলাম। কিন্তু কেমন যেন মনোবলও বাড়িয়ে দিলেন বাড়তি হাত পায়ের কথা বলে। খুলে বসলাম কবেকার ফেলে রাখা হাতের কাজ, সাথে সাথে চলল পরবাস ১০০-র লেখা, বাকি সময় লীলা মজুমদারের ছোটদের অমনিবাসে নেপোর বই, গণশার চিঠিতে ডুব মারা, আর ছিলেন প্রিয় সখা উডহাউস। ব্যাস মন যেন মেঘের ভেলায় ভেসে গেল-- এক দিকের গতি বন্ধ কিন্তু অন্যদিকে যে ছিল সুদূরপ্রসারী দিগন্ত। চার পাশের সবাই ধরে নিয়েছিল আমি সূর্যের অভাবে নুয়ে পড়া সূর্যমুখী হব। কিন্তু আমি বিন্দাস ছিলাম। মনকে স্বীকার করেছি তাকে খুশি রেখেছি যে। সবাই যারা খোঁজ নিয়েছেন সান্ত্বনা দিয়েছেন ‘ভাঙেনি তাই খুব বেঁচেছেন এই বয়সে।’ মনটা ধাক্কা খেল কিনা সে উদ্‌বেগ কারু মধ্যে ধরা পড়েনি। এই যে সাত দশ দিন শুধু কি আকাশ বাতাস? ধুলো ধোঁয়া ছাড়া গাড়ি-বাস না দেখা, দোকানিদের ‘কী দোব মাসিমা?’ না শুনতে পাওয়া, সুফলা সব্জির ভ্যানের সামনে থলে হাতে লাইন দিতে না পারা, এও কি কম ক্ষতি? কিন্তু কে মানে? ভাগ্যিস মনের দরজাটা খুলেছিলাম।

    তাই বলি আসুন মনকে মানি। তাকে শুধাই ‘কেমন আছ?’ নিজেকে দিয়েই শুরু করি। পাশের মানুষকে শুধু বলব না ‘ওষুধ খেয়েছ তো?’ বলব ‘চলো এক্ষুনি! আগের মতো চণ্ডীর স্টলে মাটির ভাঁড়ে চা মেরে আসি, হোক না বেলা বারোটা, লাঞ্চ টাইম। থাক পড়ে বাড়ি ঘর তালা চাবি, বয়স মানিয়ে সাদা পাঞ্জাবি, চাপিয়ে নাও তো দেখি আমার দেওয়া আঁকিবুকি কাটা নীল শেরওয়ানি।’

    পুনঃ-লেখা শেষ করে মনে হল সহজ সমাধান বোধহয় তত সহজ নয়, কারণ মন যদি অনড় থাকে তাহলে সহজকে মানতে সময় লাগে। মনের অস্তিত্ব প্রকট করার এও আর এক উপায়। তখন একমাত্র সহায় ইচ্ছাপূরণ দেবীর বরাভয়। শেষ সমাধান পাঠকের উপরই ছাড়লাম।

    ---০---

    ১) ; ‘শব্দ রসিক মাষ্টারমশাই’--অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়; রবিবাসরীয়, ১ জুন ২০২৫



    অলংকরণ (Artwork) : লেখক
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments