• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • পরবাস ও ছোটগল্পের রূপরেখা : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

    পরবাসে যে গল্পগুলি প্রকাশিত হয় সেগুলি স্বভাবতই একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। আমার ধারণা প্রত্যেকটি ভাল পত্রিকারই একটি নির্দিষ্ট নির্বাচক-মণ্ডলী থাকে। পরবাসেরও আছে। পরবাসে আমার অনেকগুলি গল্প ছাপা হয়েছে। পরবাসের আর্কাইভে সেগুলি সুসংরক্ষিত। সৌভাগ্যক্রমে দু’-একটি ছাড়া আমার গল্প বিশেষ অমনোনীত হয়নি। তাই বোধহয় পরবাস সম্পাদক আমাকেও মাঝে মধ্যে গল্প ‘রিভিউ’ করার জন্য আহ্বান জানান। বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কারও লেখা না হলে আমি আমার সাধ্যমতো মতামত দিই।

    বলতে দ্বিধা নেই এত সৎ এবং স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া আমি খুব বেশি দেখিনি। সম্পাদক শুধু— মনোনীত বা অমনোনীত— সিদ্ধান্ত নয়, সেই সিদ্ধান্তের কারণও জানতে চান। উপরন্তু জানতে চান অল্পস্বল্প পরিবর্তন করে গল্পটির মনোনয়ন করা যায় কি না। এবং সে ক্ষেত্রে কী ধরণের পরিবর্তন প্রয়োজন। যাঁরাই পরবাসে লেখা পাঠান তাঁদের নিশ্চয়ই “রিভিউ কমেন্ট” পেতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এবং আমার সঙ্গে সহমত হবেন যে এই প্রক্রিয়া তাঁদের যথেষ্ট উপকারে লেগেছে।

    পরবাস ১০০ সংখ্যার ক্রোড়পত্রের জন্য লিখতে বসে এই বিষয়টাই মাথায় এল। ভাবলাম আমার সীমিত জ্ঞানের মধ্যে ছোটোগল্প নিয়েই কিছু লিখি। হয়তো যাঁরা নতুন লিখতে আসছেন তাঁদের সাহায্য হবে। তবে প্রথমেই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরন দিয়ে রাখা ভাল যে ছোটোগল্প নিয়ে নিচের মতামতগুলি একদমই আমার নিজস্ব। সম্পাদক এবং নির্বাচক-মণ্ডলীর সদস্যরা অন্য রকম ভাবতেই পারেন। এবং সেটাই স্বাভাবিক। ভাবনাচিন্তা মতামতে যত বিভিন্নতা থাকবে পরবাসের পাতা ততই নানা রকম জনরার গল্পে সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। স্বল্প পরিসরে কিছু আদর্শ বাংলা ছোটোগল্পের উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টাও করব। সেগুলি যদিও এই শতাব্দীতে লিখিত নয়, কিন্তু আমার মতে ভয়ানক রকমের আধুনিক।

    শেষের থেকেই শুরু করা যাক। ছোটোগল্পের সমাপ্তি ঠিক কেমন হওয়া উচিত? ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি আদর্শ ছোটোগল্প হল সেই লেখা যা পড়ে ‘অন্তরে অতৃপ্তি র’বে সাঙ্গ করি’ মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ।’ যে সে নয় আধুনিক বাংলা ছোটোগল্পের অবিসংবাদিত জনক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন। উপরোক্ত চরণের শেষ দিকটা ‘জাক্সটাপজিশনের’ মতো দেখালেও নিগূঢ়ার্থ বুঝতে অসুবিধে হয় না। একটা ভাল ছোটোগল্প পড়ে ওঠার পর রাত্তিরে ঘুম আসবে না। গল্পটা উপদ্রব করবে। ইচ্ছা না হলেও ঘটনাগুলো জ্বালিয়ে মারবে। মাথার মধ্যে গল্পের চরিত্রগুলো ট্রেসপাস করবে। কেউ কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় জর্জরিত। কেউ থোড়াই কেয়ার! কেউ আত্মপক্ষ সমর্থন করার জন্য মাথা খুঁড়বে তো কেউ শুধু দুঃখী-দুঃখী মুখ করে চোখের এক কোণে চুপ করে বসে থাকবে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়ব। জল খাব। ঘাড়ে মাথায় জল দিয়ে এসে আবার শোব। তারপরও অনেক ক্ষণ জেগে থাকব।

    সুবোধ ঘোষের “সুন্দরম” গল্পের শেষের লাইনটা ভাবুন। এক বার পড়লে ভোলা অসম্ভব। চিরজীবনের মতো মাথার মধ্যে গেঁথে থাকবে। ক্ল্যাসিকাল সমাপ্তি। পুরো গল্পটা লঘু পায়ে চলতে চলতে আচমকা একটা কঠিন দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। ময়না-ঘরে কৈলাস ডাক্তার কুষ্ঠী ভিখারি হাবু আর তার কানি বৌ হামিদার মেয়ে তুলসীর শব ব্যবচ্ছেদ করতে সময় নিচ্ছেন। যদু ডোম শুকনো রসিকতা করে নিতাই সহিসকে বলছে— শালা বুড় নাতির মুখ দেখছে। ভদ্র-সভ্য সুশীল সমাজের গালে একখানা বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়! অবশ্য তুলসীর মৃত্যুটা খুন না আত্মহত্যা সেটা নির্ণয়ের ভার লেখক পাঠকের ওপর ছেড়ে দেন। সেই ভাবে দেখলে “মুনিদের মতিভ্রম” কোনও নতুন প্লট নয়। নতুনত্ব থাকে লেখকের দৃষ্টিপাতের কৌণিক অবস্থান এবং আলো প্রক্ষেপণের কৌশলে। কাহিনির কোথায় আলো পড়বে, কোন অংশ ছায়াবৃত থাকবে, লেখকের ‘ক্লাস’ চিনিয়ে দেয়। “সুন্দরম" গল্পে অসুন্দর ঘটনাগুলি পাঠকের দৃষ্টির অগোচরে ঘটে যায়। পাঠক সেগুলির আন্দাজ পায় মাত্র। আবার উলটোদিকে ব্যবচ্ছিন্ন শবের “সৌন্দর্য” বর্ণনার যে বিস্তারিত বিবরণ পাই তা বাংলা সাহিত্যে বিরল।

    কিংবা ধরুন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের “বেদেনী"। কিষ্টোর তাঁবুতে আগুন দিতে এসে বেদেনী রাধিকার মন বদলে যায়। সে কিষ্টোর সঙ্গে পালিয়ে যেতে চায়। যাওয়ার আগে কেরোসিন ঢেলে পুরোনো সঙ্গী শম্ভুর তাঁবুতে আগুন লাগায়, খিলখিল করে হেসে বলে, মরুক বুড়্যা পুড়ে। মন মজলে বাকি সব তুচ্ছ হয়ে যায়। নাকি প্রবৃত্তি বড়ো বালাই! একটা ভয়ঙ্কর পরিণতির সামনে দাঁড়িয়ে পাঠক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। রাধিকার অপরাধ অনুমোদন করবে কিনা সেই ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। জগদীশ গুপ্তর “পয়োমুখম", মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “প্রাগৈতিহাসিক”, কমল কুমার মজুমদারের “আমোদ বোষ্টুমি” সবগুলিই এই জনরার গল্প। গল্পগুলি খুঁড়তে খুঁড়তে মানুষের জৈব অস্তিত্বের একদম অন্তঃস্থলে পৌঁছে যায়।

    মোদ্দা কথা হল একটা ভাল ছোটগল্প পড়া শেষ হলেই ফুরিয়ে যায় না। খাদের ধারে দাঁড়িয়ে ঈষৎ উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত শব্দের মতো সামনের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে অনুরণিত হতে থাকে। পাঠকের ভাল লাগা, না লাগার তোয়াক্কা না করে ফিরে আসে, চলে যায়, আবার ফিরে আসে। এই ভাবে অনন্তকালের দিকে প্রসারিত হয়। বহুদিন পরেও অকারণে সেই সব গল্প মনে পড়ে যায়। বা খুব জ্বর হলে, যখন যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যায়, হঠাৎ উপশমের মতো আসে। শুশ্রূষার জন্য প্যারাসিটামলের দরকার পড়ে না।

    প্রায়ই শুনি আধুনিক গল্প “ওপেন এন্ডেড” হবে। মানে “আমার কথাটি ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল” গোছের হবে না। যত পাঠক তত মন। ভিন্ন মনের চাহিদাও ভিন্ন। কোনও মন সুখ-সমাপ্তি চায় তো কোনও মন দুঃখ-বিলাস। তাই গল্প শেষের দায়িত্ব পাঠকের হাতে ছেড়ে দেওয়াই নাকি ভাল। সে তার নিজের মনের মতো করে গল্প শেষ করে নিক। প্রকৃত ছোটোগল্পের একাধিক সমাপ্তি-সম্ভাবনা থাকবে। লেখক অবশ্যই একটা ইঙ্গিত দেবেন গল্পটা কীভাবে শেষ হলে ভাল হয়। কিন্তু সেই অভিমুখে চিন্তা করা বা না করা পাঠকের অভিলাষ। পাঠকের বুদ্ধির উপর ভরসা না করে লেখক যদি সবটুকু বলে দেন অনেক সময় গল্প মাটি হয়ে যায়। সেরকম উদাহরণ পত্রপত্রিকার পাতায় আজকাল ভুরি ভুরি চোখে পড়ে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে চক্ষুশূল হব। তাই উদাহরণ দিচ্ছি না।

    অনেক গল্পে দেখি লেখক নিজে বড্ড বেশি উপস্থিত। যেন লেখক নিজেই একটি চরিত্র। আধুনিক গল্পের নিরিখে এটা একটা দোষ বলে মনে করা যায়। লেখকের কাজ চরিত্র তৈরি করা। তাদের একটা ঘটনার মধ্যে ঠেলে দেওয়া, অবশ্যই যদি গল্প ঘটনা-নির্ভর হয়। তারপর তারা নিজেদের মতো করে কথাবার্তা বলবে, প্রতিক্রিয়া জানাবে, গল্পটাকে নিজেরাই এগিয়ে নিয়ে যাবে। লেখকের কাজ ধরতাই দেওয়া। কথায় কথায় চরিত্রদের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করতে বসলে গল্পের গতি শ্লথ হয়ে যায়। চরিত্রদের বার্তালাপ, বাহ্যিক আচার-আচরণের বর্ণনাই তাদের মনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে সাহায্য করবে। এই প্রসঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “সর্পিল" গল্পটির কথা মনে পড়ছে। আদ্যন্ত মনস্তাত্বিক এই গল্পটির কোথাও একবারের জন্যও মানিকবাবু গল্পের কোনও চরিত্রের মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণের দায়িত্ব লেখকের কলমে তুলে নেননি। যেটুকু বলা হয়েছে তা অন্য চরিত্রদের পর্যবেক্ষণ ও অনুমানের ভিত্তিতে।

    অবশ্য ছোটোগল্পের সংজ্ঞা বদলে যাচ্ছে ক্রমাগত। পৃথিবী জুড়ে অনেক নিরীক্ষামূলক গল্প লেখা হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। কোনও নিরীক্ষা উৎরোচ্ছে, কোনওটা মুখ থুবড়ে পড়ছে। বাংলা সাহিত্যে অনেক গল্পই লেখা হয়েছে যেসব গল্পে প্লট প্রায় নেই বললেই চলে। সেই সব গল্পকে মনে করা হয় এক টুকরো জীবনযাপনের ছবি যার সঙ্গে পাঠক একাত্ম হতে পারেন। মূল কথা হল রিলেট করা, পড়ে যেন বিস্মিত হতে হয়— কী আশ্চর্য! লেখক কোন মন্ত্রবলে আমার মন জেনে ফেললেন! গল্পের শেষ লাইনে— তার পর তাহারা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করিতে থাকিল— এমন না থাকলেও চলে। আধুনিক জীবন পরিণামহীন, আধুনিক গল্পেও তাই বোধহয় পরিণতির প্রয়োজন ফুরিয়েছে। সুবক্তা চন্দ্রিল ভট্টাচার্যর একটি ইউ টিউব ভিডিও আছে যেখানে তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অনেকগুলি “গল্পহীন গল্পের” (ডাকগাড়ী, খোশগল্প, তুচ্ছ ইত্যাদি) উল্লেখ করেছেন।

    পরবাসের জন্য গল্প বাছতে বসে আমরা মূলত খুঁজি নতুন ভাবনা। নতুন আইডিয়া। আঙ্গিক এবং গঠনের প্রক্রিয়ায় নতুনত্ব অবশ্যই স্বাগত। কিন্তু সেই সব কলা-কৌশল যেন পাঠ-বিমুখতার কারণ না হয়। গ্রাজুয়েশন করার সময় আমি লিনিয়ার অ্যালজেব্রার বই খুলে পড়তে বসলেই অবধারিত ভাবে ঘুমিয়ে পড়তাম। তাই আমার আর ভেক্টর স্পেসের সীমা ছোঁয়া হল না। যতই নিজেকে প্রবোধ দিই হয়তো জানার স্পেসটা অনন্ত, অনুমান ও প্রকৃত অবয়বের একটা কাছাকাছি ধারণা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জানি ফাঁকি মেরেছি। সে যাক! সাধারণ পাঠকও যদি তেমনই গল্প পড়তে গিয়ে নিদ্রাগতি প্রাপ্ত হয় তা হলে সে গল্পের রসাস্বাদন করবে কী করে? তাই লেখকের প্রথম কাজ হল পাঠককে জাগিয়ে রাখা, একবার পড়তে শুরু করলে সে যেন দু’চোখের পাতা এক করতে না পারে, গল্প ছেড়ে উঠতে না পারে।

    বলাই বাহুল্য মেদহীনতা আধুনিক গল্পের একটি অপরিহার্য্য অঙ্গ। গল্পের চেহারাটি যেন হয় ঋজু, সুঠাম, দর্শনীয়। কথায় বলে— পহলে দর্শনধারী, তার পর গুণ বিচারি। তাই বলে সেই গল্প যেন মাংসপেশীর আস্ফালন মাত্র না হয়ে ওঠে। আমরা চলতি বাংলায় বলি— টানটান লেখা। আশকথা পাশকথা যত কম থাকে ততই ভাল। তবে তাকে বহতা হতে হবে। আর আমরা তো জানিই বহতা মানেই নদী। ছোটোনদী কি আর অল্পস্বল্প না বেঁকে চলতে পারে? সেটুকু স্বাধীনতা তার প্রাপ্য।

    তবে যেসব গল্পে ঘটনার পারম্পর্য থাকে না, কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে না, সেই সব গল্পকে বড়ো কৃত্রিম মনে হয়। মনে হয় যুক্তি সাজাতে না পেরে লেখক অপশৈলীর প্যাঁচ কষছেন। চিন্তার স্বচ্ছতা এবং নিরঙ্কুশ প্রবহমানতা গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জরুরি। নতুন শৈলী চর্চার নামে যদি কেউ প্রলাপ বকে তবে সেই লেখাকে গল্প বলতে আমি অন্তত রাজি নই। অনেকে এই ধরণের লেখাকে গল্প নয়, “মুক্তগদ্য" বলে অভিহিত করেন। আমার ব্যক্তিগত মত হল, এই শ্রেণির লেখাকে “মুক্তকচ্ছ গদ্য” বললেও বোধহয় সত্যের অপলাপ হয় না।

    অনেক সময় দেখি সাহিত্য অন্যান্য মাধ্যম থেকেও প্রকরণ ধার করছে। খুঁজলে পেনটিং থেকে অনুপ্রাণিত গল্প নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। না-হলে কোনও কোনও গল্প পড়ে ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীর আঁকা ছবির কথা মনে পড়ে কেন? চলচিত্র ও সাহিত্যের যোগাযোগও অনেক দিনের। অনেক বিখ্যাত গল্পের চলচিত্রে রূপায়ন হয়েছে। চলচিত্রের ভাষা অবশ্য আলাদা। তার প্রকাশ-ভঙ্গি স্বতন্ত্র। মাঝে মধ্যে সেখান থেকেও প্রকাশ-প্রকরণ ছোটগল্পে আহরিত হতে দেখি। সময় ভাঁজ করে আগে-পিছে যাওয়া একটা বহু-ব্যবহৃত টেকনিক। “জাম্প কাট”, “ফেড” ইত্যাদির ব্যবহার দেখেছি। গল্পের বিভিন্ন কুশীলবদের চোখ দিয়ে দেখা ‘মাল্টি-থ্রেড’ ছোটোগল্প পড়েছি যদিও একাধিক ‘থ্রেডের’ ব্যবহার উপন্যাসের জন্যই বেশি উপযুক্ত। সেসবে অসুবিধে নেই। তবে কথা হল এই যে গল্প লিখতে বসে প্রয়োগ-প্রকরণ লুকিয়ে রাখাই লেখকের কর্তব্য। সেগুলি যদি অতি মাত্রায় প্রকট হয়ে পড়ে তা হলে গল্পের রসহানি হয়। প্রকরণের ব্যবহার হওয়া উচিত গল্পের প্রয়োজনে। নাটকে বা জাদুতে যেমন ‘প্রপের’ ব্যবহার হয় একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে।

    অনেক লেখক মনে করেন অতিবাস্তব বা জাদু বাস্তব লেখার সময় সব যৌক্তিকতা শিকেয় তুলে রাখা যায়। তাঁরা ভুলে যান প্রকৃত ইন্দ্রজাল পাঠককে সম্মোহিত করে, বোকা বানায় না। পাঠক জানে ইন্দ্রজালিকের টুপির মধ্যে খরগোস নেই। পাতলুনের পকেটে পায়রা নেই। তবু সে সেই অবিশ্বাস্য ঘটনাক্রমকে বিশ্বাস করে আনন্দ পায়, হাততালি দেয়। সে জানে খরগোসটা লুকিয়ে রাখা ছিল টেবিলের নিচে। কিংবা পর্দার আড়ালে রাখা ছিল পোষা পায়রার খাঁচা। তবু সে চ্যালেঞ্জ করে না। কারণ সে জানে রহস্য ভেঙে দিলে সৌন্দর্য ভেঙে যাবে। বস্তুত সব ছোটোগল্পই এক অর্থে রহস্য গল্প। রহস্যের কুয়াশা ছোটোগল্পকে রমণীয় করে। আকর্ষণীয় করে তোলে। যদিও সেসময় আলাদা করে শ্রেণীবিভাজনের চল ছিল না, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক গল্পই, বিশেষ করে বরদা সিরিজের গল্পগুলি এই গোত্রের বলে আমার মনে হয়।

    চেষ্টা করলাম ছোটোগল্পের কিছু বাঞ্ছিত এবং কিছু অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্যর সন্ধান করতে। সবাইকে একমত হতে হবে এমন মাথার দিব্যি দিচ্ছি না। “রিভিউ কমেন্ট” মেনে নিয়ে অনেক লেখকই গল্পের সংশোধন করেন। সম্পাদকের দপ্তরে পুনর্বার প্রেরণ করেন। অনেকে সংশোধন করা থেকে বিরত থাকেন। অন্য গল্প পাঠান। আপত্তি নেই। রিভিউয়ার হিসেবে সতর্ক থাকতে হয় বদলের আইডিয়া যেন লেখকের ঘাড়ে বেতালের মতো চেপে বসে হুকুম না চালায়। লেখাটি যেন নিজস্বতা এবং স্বকীয়তা না হারায়। লেখাটির সম্পূর্ণ দায় এবং স্বত্ব লেখকের। শেষ পর্যন্ত রদবদল পছন্দ হলে সম্পাদক লেখাটি ছাপান।

    পরবাস নতুন এবং যোগ্য লেখকদের আশ্রয়স্থল। চুপিচুপি বলে রাখি ভবিষ্যতে ভাল লেখার প্রতিশ্রুতি দেখতে পেলে সম্পাদক অনেক সময় অপরিণত লেখক ও এলোমেলো লেখাকেও প্রশ্রয় দেন। গত দশ-বারো বছরে দেখেছি পরবাস আমার মতো অনেক লেখককেই বিবর্তিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এমন কাজ বাংলা সাহিত্যে কতগুলি পত্রিকা করেছে জানি না।



    অলংকরণ (Artwork) : পরবাস ডিজিটাল আর্ট
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments