'পরবাস' আন্তর্জাল পত্রিকার শততম সংখ্যা প্রকাশিত হল। এটা সমস্ত বাংলা সাহিত্যে এক গর্বের ঘোষণা। গত দুই দশকে 'পরবাসের' সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আমার ইচ্ছা এবিষয়ে একটি রাশভারী, তথ্যসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লেখার। কিন্তু আমার বাংলা সাহিত্যিক পত্রিকার ইতিহাস বা আন্তর্জাল, বাংলা ফন্ট ইত্যাদি বিষয়ে প্রযুক্তিবিদ্যাগত কোনো জ্ঞান নেই। আমি পেশাদারী সাহিত্যিকও নই। এখানে এসে মোটামুটি মানিয়ে নিলেও কখনো সখনো আর সবার মতই বাংলা বই, গান, খাবার ইত্যাদির জন্য মন কেমন করে। আমি নিতান্তই সাদামাটা বাঙালি, তাই এই লেখাটাও হবে আমার মতই সাদামাটা, আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেই।
প্রবাস আর পরবাসে তফাৎ কী? আমি ছোটবেলা থেকেই (ষাট-এর দশকে) দিল্লীতে প্রবাসী/পরবাসী। বন্ধুদের মধ্যে কোনো বাঙালি ছিলো না। বাংলায় কথাবার্তা শুধু বাড়িতেই হতো। রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরি থেকে কিছু বাংলা বই পেতাম। রেডিওয় কখনো সখনো বাংলা গান, আর ছিল বাংলা সাহিত্য, খবর, ইত্যাদির সঙ্গে একমাত্র যোগাযোগ -- 'দেশ' সাপ্তাহিক পত্রিকা, মা নিতেন আর আমরা ছোটোরা লুকিয়ে-চুরিয়ে পড়তাম।
'দেশ' শুধু বাংলার নয়, সারা ভারতে এক প্রধান, ঐতিহ্যশালী সাহিত্যিক পত্রিকা যার শুরু ১৯৩৩ সাল থেকে--স্বাধীনতারও আগে-- এবং এখনও মোটামুটি একই রূপে চলে আসছে এত বছর। সারা ভারতে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি এত পুরোনো পত্রিকা আছে, ইংরাজি, হিন্দি ও মারাঠি ভাষায়। (বাংলায় অবশ্য আরও পুরনো পত্রিকা আছে --বঙ্গদর্শন, সমাচার দর্পণ ইত্যাদি।) আমার 'বর্ণপরিচয়ের' সঙ্গে সঙ্গেই 'দেশের' সঙ্গে পরিচয়। মা বলতেন 'বড়োদের বই, হাত দিবি না।' ব্যস, তার মানেই মুখরোচক পড়া। লেপের তলায় টর্চ জ্বেলে পড়তাম, খাটের নীচে লুকিয়ে পড়তাম, পড়ার বইখাতার নীচে ঢেকে পড়তাম, এখন এদেশে এসেও 'দেশ' পড়ে চলেছি সেই একইভাবে দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে।
অনেক ভারতীয় প্রবাসীদের মত আমিও সত্তরের দশকে এই দেশে থিতু হলাম। কিন্তু নিউ ইয়র্ক, বস্টন বা ক্যালিফোরনিয়ার মত চেনাজানা জায়গায় নয়, এলাম মিড ওয়েস্টের এক শহরে যার নামও আগে কখনো শুনিনি। এমনকি, আমেরিকানরাও নেব্রাস্কা শুনলে ভাবেন আলাস্কার আশেপাশে কোনো জায়গা!
সত্তরের গোড়ায় এখানে মাত্র পাঁচ-ছ ঘর ভারতীয়, বাঙালির নামগন্ধও নেই। নেই কোনও মন্দির, রেস্তোরাঁ, ডাল-মশলার বা শাড়ী-ব্লাউসের দোকান। আমরা মাসকাবারে লিস্ট বানিয়ে শিকাগো বা ডেনভারের দোকানে মেল করে পাঠাতাম। বাংলা বই, গান, খাবারের তো প্রশ্নই ওঠে না। ইচ্ছে করলে নিজে নিজেই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে পোস্ত চচ্চড়ি রাঁধা ছাড়া উপায় ছিলো না।
অবস্থার উন্নতি হল ২০০০ সাল থেকে, Y2K-এর কল্যাণে। ভারতীয় তথা বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ল, সেইসঙ্গে হিন্দু মন্দির, দুর্গা পূজা, বাঙালি সমিতি, ভারতীয় দোকানপাতি ইত্যাদি সবই হল। কিন্তু বাংলা বই, পত্রিকা পড়ার সাধ তখনো মেটেনি। 'দেশ' কিনতাম, ছ'মাসে, ন'মাসে মেলে পেতাম। দুবছর অন্তর দেশে গিয়ে একগাদা বই কিনে আনতাম, গোগ্রাসে বাংলা, হিন্দি ছবি দেখা, গান রেকর্ড করা --মনে আছে হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট আমেরিকান টিভিতে চলত না? অবশ্য সে সময় সংসার, নতুন কাজ, দুই মেয়ে সব সামলে নিঃশ্বাস ফেলারও সময় ছিলো না।
পরবাসেরও শুরু সেই সময় থেকেই (১৯৯৭)। আমারও তার সঙ্গে কম্পিউটারের পর্দায় আকস্মিক পরিচয় তার দু-এক বছর পরেই। আন্তর্জাল তখনো নতুন। বাংলা পত্রিকা তো নেই-ই। মনে আছে কম্পিউটারে বাংলায় ছাপা অক্ষর দেখে কী আনন্দ! তবুও নিয়মিত পড়া হতো না, হয়তো প্রথম দিকের অনিয়মিত প্রকাশনার জন্য। কখনো সখনো নানা কাজের মধ্যে মনে পড়লে খুলে দেখতাম। উপন্যাস, গল্প, কবিতা যে কতদিন পড়িনি। ছোট গল্পগুলোই বেশি পড়তাম। ঘুরে ফিরে পুরনো সংখ্যাগুলোও যখন ইচ্ছে পড়ে ফেলা যায়। নতুন সংখ্যার জন্য হা পিত্যেশ করতে হয় না। তার ওপর ফ্রি, কোনো বিজ্ঞাপনের বালাই নেই। সম্পাদনা, উপস্থাপনা সবই 'দেশের' মতই সুনিপুণ ও রুচিসম্মত। শুধু 'দেশের' সাহিত্য-সংস্কৃতির সাময়িক খবরাখবর নেই, তাতে কিছু এসে যায় না। আমি অভিভূত হলাম।
ততদিনে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে, আমিও দেশে বিদেশে যাতায়াত শুরু করেছি। অ্যামাজনে দু-সপ্তাহ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার পর ভাবলাম বাংলায় একটা ভ্রমণকাহিনী লেখার। সেই আমার প্রথম বাংলায় লেখা। ভাবলাম আমার বাল্যপরিচিত 'দেশেই' পাঠাই। ওমা, সঙ্গে সঙ্গেই ছাপা হয়ে গেল! এক অক্ষরও না বদলিয়ে। লেখা এতই সোজা বুঝি? আমার মা তো তাঁর প্রিয় পত্রিকায় আমার বাংলা লেখা পড়ে ভীষণ খুশি। তাও 'দেশে' ছাপিয়েছে! আমার ইংরেজি ডাক্তারি পেপারে মার কোনো উৎসাহ নেই। মার মতে এই প্রথম আমি একটা কাজের কাজ করলাম। মা তো কম্পুটার ব্যবহার করতে পারেন না, তাই আমি বাংলা লেখাগুলো ছাপা হলে কপি করে মাকে মেলে পাঠাতাম। কতো খুশি হতেন সেগুলো পড়ে। পরে আমার ভ্রমণ কাহিনীগুলির সংকলন 'তাড়োবা থেকে টিমবাকটু' বই হয়ে বেরোয়। কিন্তু মা আর সেটা দেখে যেতে পারলেন না। এই আফসোস।
বাংলা লেখায় উৎসাহ পেয়ে আমার পরবর্তী শিকার অবশ্যই হল 'পরবাস'। ইচ্ছা হল একটা লেখা পাঠিয়ে দেখাই যাক না। সদ্য গালাপাগোস ঘুরে এসেছি, মাথার ভেতর গল্পগুলো গজগজ করছে। কাউকে তো বলতেই হবে। লিখে দিলাম ২০০৭ সালে 'পরবাসে' আমার প্রথম ভ্রমণকাহিনী। ততদিনে পরবাসের চল্লিশটা সংখ্যা বেরিয়ে গেছে। শুরু হল পরবাসের সঙ্গে আমার আগামী কুড়ি বছরের সম্পর্ক যা এখনও অটুট। অনেকগুলো ভ্রমণকাহিনী লিখেছি, সঙ্গে কিছু প্রবন্ধ, আর গল্পও। কে জানতো বাংলা লেখা এত আরামের। এর জন্য পরবাসের সম্পাদকমশাইকে ধন্যবাদ জানাতেই হবে। আমার বাংলা লেখা ও অনুবাদ পরবাসের সমসাময়িক। পরবাসের ক্যানভাসেই আমি আমার লেখা ও অনুবাদ মকশো করেছি।
টেকনোলজি সম্পর্কে আমার জ্ঞান সীমিত, তাই বিশেষ কিছু বলব না। মনে আছে প্রথম প্রথম লেখা পাঠিয়েছি হাতে লেখা কাগজে, মেল করে, এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে নিশ্চয়ই প্রাগৈতিহাসিক মনে হবে। তারপর এল বাংলা ফন্টে লেখা। সেটা আবার ম্যাক কম্পুটার পছন্দ করে না। আমি কম্পুটারে একেবারেই পারদর্শী নই। আমার ম্যাকে বাংলা ফন্ট খাপ খাওয়াতে কী কষ্টেই না ভুগতে হয়েছিলো। রাতবিরেতে সম্পাদক মশাইকে জ্বালাতন করেছি কতবার। এখন অভ্র ফন্ট বেশ ঝরঝরে। হাতে লেখার মত চটপট না হলেও অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে।
পরবাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ--বাংলা বই, পত্রিকা ও চলচ্চিত্রের বিরাট বিপণি। অনেক বছর পর আমি বাংলা বই কিনছি আর নিয়মিত 'দেশ' ও শারদীয়া পত্রিকা (যেগুলি ছাড়া পুজোই অসম্ভব) পড়তে পাচ্ছি। এটাও কম আনন্দের নয়।
শুরুর কয়েকবছর পরেই (২০০১ সালে) পরবাসে যোগ হয় অনুবাদ বিভাগ। অনুবাদ আমার করতে ভালো লাগে আর পড়তেও। মেয়েদের ছোটবেলায় রবি ঠাকুরের অনেক গল্প ওদের অনুবাদ করে পড়িয়েছি। আবার উল্টো দিকে হ্যারি পটার- এর পুরো সিরিজ হাতে লিখে অনুবাদ করেছি মার জন্য। (মা ইংরেজি জানতেন না কিন্তু হ্যারি পটারের গল্প শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন।) তাই পরবাসে অনুবাদের কলমে মনের মত গল্প, উপন্যাস অনুবাদ করেছি। সেই সঙ্গে ভালো, পেশাদারী অনুবাদের রীতিনীতিগুলোও শিখেছি সম্পাদকের কাছে। এটা আমার নিজস্ব উপরি পাওনা। ইদানীং বাংলা থেকে ইংরেজি ছাড়াও অনেকে অন্যান্য ভাষা থেকেও অনুবাদ করছেন। বহুভাষীদের এই সুবিধে। আমিও হিন্দি থেকে বাংলায় কিছু গল্প ও উপন্যাস অনুবাদ জুড়ে দিয়েছি।
এই অনুবাদের বিভাগটি পরবাসের এক অনন্য সম্পদ। এমনটি আর কোনও পত্রপত্রিকায় পাওয়া যাবে না। 'দেশের' কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এই ব্যাপারে 'পরবাস' 'দেশ'-কে ছাড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রচেত গুপ্ত, সব যুগের, সব genre-এর বিশিষ্ট, বিখ্যাত লেখক লেখিকাদের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, জীবনী, সাক্ষাৎকার, এসবের সাবলীল, সুন্দর অনুবাদ একসঙ্গে কোথায় পাবেন? তার ওপর বিনামূল্যে, বিনা পরিশ্রমে, বাড়িতে বসে একটু আঙুল চালিয়েই এসব পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতে গবেষণার কাজে এর অবদান অসামান্য। পরবাসের পাঠকরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে, অনেকেই অবাঙালি, বা বাংলা পড়তে পারেন না। অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরাও বাংলা সাহিত্যের স্বাদ পেতে পারেন। এই বিশাল ধনভাণ্ডার সবার জন্য বাছাই করা, শ্রেণিবদ্ধ রাখা এবং সহজপ্রাপ্য করে দেওয়া সহজ কাজ নয়। এর জন্য সম্পাদক ও তাঁর সহকারিদের প্রভূত প্রশংসা ও ধন্যবাদ।
উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, জীবনী, সমালোচনা, কবিতা, ছবি, ছোটদের লেখা, ভ্রমণকাহিনী (আমার প্রিয়), অনুবাদ, সব মিলিয়ে 'পরবাস' শুধু একটি আন্তর্জাল পত্রিকাই নয়, বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম ধনসম্ভার। এই পত্রিকায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ। আশা করি এইভাবেই পরবাস আরও ফুলে ফলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক। শততম সংখ্যায় আমার অনেক শুভেচ্ছা ও সেই সঙ্গে সম্পাদক ও তাঁর সহকারিদের জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন।