সেবারে কলকাতা যাবার সময়ে প্লেনে আমার সামনে এসে বসলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক যাঁর মাথায় সাদা বাবরি চুল, বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি আর মুখে একটা গা-জ্বালানি হাসি। ভদ্রলোকের পরনে কালো ধুতি, কালো পাঞ্জাবি ও তার ওপর জড়ানো সোনালি জরি দেওয়া কালো চাদর। তখন যদিও কার্তিক মাস ছিল না কিন্তু আমি ধরে নিয়েছিলাম ভদ্রলোক অবাঙালি কারণ দক্ষিণ ভারতে কার্তিক মাস জুড়ে পুরুষরা অমন পোষাক পরেন ও নানা নিয়ম-কানুন মেনে চলেন। যাহোক, ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি তিনি একজন চলমান গয়নার বিজ্ঞাপন – তাঁর গলায় রুদ্রাক্ষ ছাড়া কয়েকটি মোটা সোনার হার আর হাতে চওড়া চওড়া সোনার চুড়ি ও বালা। আমার কর্তা নিচু গলায় বললেন, ‘ভদ্রলোকের গায়ে বোধহয় আড়াই কেজি সোনা রয়েছে। কে জানে কত লোকের মাথায় হাত বুলিয়ে উনি এই ধনসম্পদ সংগ্রহ করেছেন।’ অত সোনার বাহার দেখে আমরা তাঁর নাম দিলাম ‘স্বর্ণানন্দ’।
প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছিল। তখন শুরু হল ফোন কানে দিয়ে স্বর্ণানন্দের উচ্চমানের ইংরিজিতে আলাপ। আর আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে বোকা বানানো ও ধন আহরণ করা পাপ কি পাপ নয়, তাই নিয়ে। প্লেন উড়ল। এক সময় স্বর্ণানন্দ নবাবী আচরণ শুরু করলেন; ‘খাবারের ট্রে এখনই ফেরত দেবো না, কফি যথেষ্ট গরম ছিল না -- আরেক কাপ আনো’, ইত্যাদি নানা বায়না করে এয়ার-হস্টেসদের তিনি নাস্তানাবুদ করতে লাগলেন। ঐ ধরনের আচরণ দেখে আমার খুব বিরক্ত লাগতে লাগল। আমার কর্তাকে আমি নিচু গলায় বললাম, ‘এত ধনবান ব্যক্তির তো বিজনেস ক্লাসে যাওয়া উচিত।’ ভদ্রলোক শুনতে পেলেন কিনা কে জানে!
হঠাৎ আমার নজর গেল স্বর্ণানন্দের বাঁ-হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটির দিকে। সেটি এত বড় ও উঁচু যে তার পাশে লেখা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নির্মাতার নাম আমি পেছনে বসেও দেখতে পাচ্ছিলাম। যদিও জানি যে আজকাল হাতঘড়ি পরলে লোকে হয় পরে স্বাস্থ্যসচেতক ঘড়ি নাহলে সেটি হয় অর্থ-সম্পদ প্রদর্শনের উপায়। ধনী-ব্যবসায়ীর পুত্রের কুড়ি কোটি টাকা দামের ঘড়ি বা কোনও কোনও ক্রিকেট খেলোয়াড়ের লাখ বা কোটি টাকা মূল্যের ঘড়ির কথা আজকাল খবরের কাগজের অনেকখানি জুড়ে থাকে। এও জানি, আমাদের শৈশব-কৈশোরে যে জিনিসগুলোকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অপরিহার্য অঙ্গ বলে জানতাম তার থেকে বর্তমানে যা কিছু বাতিল হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে একটি হল হাতঘড়ি। তার কারণ অবশ্যই আমাদের জীবনে সর্বগুণে গুণান্বিত সেলফোনের আগমন।
মনে পড়ছিল, ১৯৬৩ সালে আমার দাদা তার পৈতেতে তিনখানা হাতঘড়ি উপহার পেয়েছিল। সেই সময় পৈতের অনুষ্ঠানে ঘড়ি ও পেন উপহার দেওয়ার রীতি ছিল। দাদা তখন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ে, তাই শুধু পরীক্ষার সময়ে ঘড়ি পরে যাওয়ার অনুমতি ছিল। ফলে, ঘড়িগুলো বিশেষ ব্যবহৃত হয়নি যতদিন না আরও কয়েক বছর পরে দাদা কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। তারও কয়েক বছর পরে আমি যখন ক্লাস নাইন বা টেন-এ উঠলাম, দাদা ওর একটা ঘড়ি আমাকে দিয়ে দিল। সে যে কী আনন্দের ব্যাপার! তখনও শুধু পরীক্ষার সময়ে ঘড়ি পরে স্কুলে যেতে পারতাম। অথচ সেটি হাতে পরবার জন্য আমার প্রচুর আগ্রহ। আমাদের যৌথ পরিবারে অনেক সদস্য। বড়রা যদি দেখে ফেলে ঘড়ি পরে আমি ‘ফ্যাশন’ করছি তাহলে নির্ঘাত বকুনি দেবেন। তাই, তাঁদের চোখ এড়িয়ে ঘড়ি-পরা হাত ঠাকুমার আদ্যিকালের চেস্ট অফ ড্রয়ার্স-এর ঘষে যাওয়া আয়নায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতাম আর প্রভূত আনন্দ পেতাম!
আরেকটা মজার কথা মনে পড়লো। আমার বন্ধু মহাশ্বেতার বাবা হঠাৎ একদিন অফিস থেকে এসে ঘোষণা করলেন, ‘তৈরি থাকিস তোরা, কাল সুপ্রিয়া আসবে।’ আমরা তখন সদ্য কলেজে ঢুকেছি আর ওর ছোট বোন তুলি পড়ে ক্লাস টেন-এ। কাকুকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেও আমরা জানতে পারলাম না সুপ্রিয়া কে আর কেনই বা তার জন্য তৈরি থাকতে হবে। কাকিমা সংসার নিয়ে ব্যস্ত, কাকুর ঐসব হেঁয়ালিতে তিনি বিচলিত হতেন না। পরদিন কাকুর অফিস থেকে ফেরার সময় আমরা বন্ধুরাও মহাশ্বেতাদের বাড়িতে গিয়ে বসে আছি সুপ্রিয়াকে দেখব বলে। কাকু একাই বাড়িতে ঢুকলেন। বাবাকে চা-জলখাবার গুছিয়ে দিয়ে মহাশ্বেতা আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘সুপ্রিয়া এল না?’ কাকু হেসে বললেন, ‘আমার অফিসের ব্যাগটা নিয়ে আয়।’ আমরা সবাই দমবন্ধ করে আছি। কাকু ব্যাগ থেকে HMT-র একটা ঘড়ির বাক্স বের করে তুলির হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোর জন্য আনলাম।’ হতভম্ব তুলির হাত থেকে ছোঁ মেরে ঘড়িটা নিয়ে আমরা দেখলাম তার নাম ‘সুপ্রিয়া’।
হাতঘড়ি হোক বা দেওয়াল ঘড়ি, ঘড়িতে দম দেওয়া ও সময় মিলিয়ে রাখা তখনকার দিনে একটা বড় কাজ ছিল। আমাদের পরিবারে আমার বাবা যত্ন-সহকারে সেই কাজটি করতেন। ব্যাটারি-চালিত ঘড়ি আসায় একটা কাজ যেন কমে গেল। ঘড়ি যেমন স্বয়ংক্রিয় হল তেমনই কালের গতিতে একদিন সে Analogue থেকে Digital হল। ফলে, ছোটবেলায় আমাদের যে ঘন্টার ও মিনিটের কাঁটা দেখে সময় বলা বা ঘড়ি-দেখা শিখতে হতো সেই পাট উঠে গেল, মানুষ ভুলে গেল পৌনে সাতটা বা সোয়া সাতটার মানে কী। আজকাল সময় জানিয়ে দেয় ঘড়িতে বা সেলফোনে জ্বলজ্বল করতে থাকা সংখ্যার সমষ্টি। সম্প্রতি তাই নিয়ে এক মজার ব্যাপার হলো। একদিন আমার কর্তাকে আমাদের পাড়ার স্কুল-ফেরত এক বারো-তেরো বছরের বালক সময় জিজ্ঞাসা করলো। উনি হাতের Analogue ঘড়ি দেখে বললেন, ‘Ten to six.’ বালকটি আড়চোখে ঘড়ির দিকে তাকালো আর তারপর অপ্রতিভতা কাটিয়ে বলে ফেলল, ‘Show me the time on your phone, please.’ সেখানে 5:50 লেখা দেখে হাসিমুখে আমাদের ধন্যবাদ দিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল। আরেকটি কথা মনে এল, ফোনে যেমন সময় দেখা যায়, অ্যালার্ম দেওয়া যায় তেমনই তথাকথিত কিছু স্মার্ট হাতঘড়িকে ফোন হিসেবেও ব্যবহার করা সম্ভব।
এমন ধারা নানা কথা ভাবতে ভাবতে দেখলাম গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি। কলকাতায় প্লেন নামতেই ফোনে স্বর্ণানন্দ স্পষ্ট বাংলায় কাউকে গাড়ি পাঠাতে বললেন। তারপর যখন উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ঘুরলেন, আমি ওঁর গলার একটি হার থেকে ও হাতের একটি বালা থেকে এক দেবী মূর্তির মুখের লকেট দেখতে পেলাম। প্লেনের দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে আবার তিনি বসে পড়লেন এবং শুরু করলেন ফোনালাপ। কাউকে মাখো মাখো গলায় ইংরিজিতে বলতে লাগলেন, ‘আমি তখন থেকে তোমার কথা ভাবছি। তোমার অপরূপ সৌন্দর্য যেন আমার চোখের সামনে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। তোমার শরীরের ঘ্রাণ আমাকে অবশ করে দিচ্ছে… ।’ খোলা গলায় ভদ্রলোককে ওভাবে রসসিক্ত কথা বলতে শুনে আমি চোখ বড় বড় করে কর্তার দিকে চাইলাম – তিনি মৃদু হেসে ফিসফিস করে আমাকে বললেন, ‘আরও কিছু সোনার গয়নার ব্যবস্থা হয়ে গেল!’