সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় দ্বারা নির্বাচিত ও সম্পাদিত, 'পরবাস গল্প সংকলন' নিঃসন্দেহে সমকালীন গল্প সংকলনে এক অনন্য সংযোজন। বাংলা সাহিত্যের প্রথম আন্তর্জালিক পত্রিকা, 'পরবাস', ১৯৯৭ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ যদি ধরে নিই, প্রকাশ কালের অব্যবহিত আগে লেখা গল্পই সাধারণত একজন লেখক পত্রিকার দপ্তরে পাঠান, তাহলে এই পত্রিকায় নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়েছে গত দুই দশকাধিক কালে লেখা এমন বহু গল্প যা এই সময়কালে ঘটমান পরিবর্তনের চিহ্নগুলিকে সফলভাবে ধারণ করতে পেরেছে। অর্থাৎ এই সংকলনটি বাস্তবিকই এই মিলেনিয়ামের প্রথম পঁচিশ বছরে বাংলা গল্পের গতিপ্রকৃতির একটা দলিল হয়ে থাকবে, হয়তো। হ্যাঁ, 'হয়তো' শব্দটা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করলাম কারণ গল্পগুলির শেষে পত্রিকার কোন সংখ্যায় প্রকাশিত তা উল্লেখ করা থাকলেও, প্রকাশের কোনও সাল তারিখের উল্লেখ না থাকাতে প্রকাশের সময়কাল নিশ্চিত ভাবে নির্ধারণ করতে পারলাম না। তবে সংকলিত গল্পগুলোর মধ্য দিয়ে গল্পের বিষয় ও প্রকরণের একটা ক্রমপরিবর্তন শুধু নয়, গত বিশ-পঁচিশ বছরে আমাদের চারপাশের ক্রমবিকাশের কিছু চিহ্ন, বৈশিষ্ট্যও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। পাওয়া যে যাবেই, একথা আরও নিশ্চিত করে বলা যেত যদি সংকলনের জন্য গল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে 'পূর্বে কোনও সংকলনভুক্ত না হওয়ার' শর্তটি না থাকত। অনুমান করতে পারি যে গত সাতাশ বছর পরবাসে প্রকাশিত এমন বহু গল্প, শুধুমাত্র ওই শর্তের কারণে, এই সংকলনের জন্য বাছাই করা যায়নি যেগুলো বিষয় ও শৈলীর নিরিখে হয়তো ছিল ঢের উৎকৃষ্ট। সে সব গল্প এই সংকলনে রাখতে পারলে প্রবহমান সমাজবাস্তবতার নানান অনুষঙ্গ, মানুষের সংকট ও সংগ্রাম, অনুভব ও অভিঘাত হয়তো খুঁজে পাওয়া যেত আরও একটু নিবিড় করে।
তবে, একথা বলা সত্ত্বেও, মানতেই হবে, প্রকাশকের ভাষায়, 'পাঠককে এক গণ্ডূষ পরবাস-সাহিত্যের আস্বাদ' দেওয়ার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। গল্পগুলোর পটভূমির যে ভৌগোলিক ব্যাপ্তি, যে বিভিন্ন শ্রেণী ও সময়ের চরিত্রসমাহার, অতি সাধারণ কাহিনিমাত্র থেকে কিছু গল্পের জটিলতর মনস্তাত্ত্বিক ও আধুনিকোত্তর নির্মিতি এই সংকলনকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
সংকলনের প্রথমেই বরিষ্ঠ গল্পকার দিবাকর ভট্টাচার্যের গল্প 'অবিকল্প' আমাদের নিয়ে যায় এক বেদে-বেদেনির রূপকথায়, এক অবিকল্প মুহূর্তের খোঁজে। এ গল্প যেমন পাঠককে মানব-মানবীর প্রেম নিয়ে এক গভীর দার্শনিক প্রশ্নে ভাবিত করবে, ঠিক তেমনই 'চিরস্থায়ী প্রেম'-এর স্বরূপ নিয়েও ভাবতে বাধ্য করবে সংকলনের দ্বিতীয় গল্প দয়মন্তী বসু সিং-এর 'চতুর্থ পুরুষ'।
তিনটি অনুবাদ গল্প বাদ দিলে, এই সংকলনের তিরিশটি মৌলিক গল্পের লেখক সূচিতে মাত্র পাঁচ জন মহিলা। প্রয়াতা দয়মন্তী বসু সিং ছাড়াও লুনা রাহনুমা, গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য, রুমঝুম ভট্টাচার্য এবং যশোধরা রায়চৌধুরী। চোখে পড়ার মতো সংখ্যালঘু হলেও, এঁদের লেখা গল্পগুলো কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর গল্প 'শরণার্থী'-তে দেশভাগ নিয়ে কোনো তত্ত্বকথা বলেননি, গল্পে তা বলার কথাও নয়, অথচ দেশভাগ ও দেশত্যাগের স্মৃতির তাড়না বিদ্ধ করবে পাঠককে। দেহে হঠাৎ করে বসিয়ে দেওয়া তীক্ষ্ণ শলাকার মতো, যা রক্ত ঝরায়, তবু তৎক্ষণাৎ বোঝা যায় না।
গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্যের গল্প 'জিগোলো', অত্যন্ত সংযমের সঙ্গে আলো ফেলেছেন এক কম-চর্চিত বিষয়ে। হ্যাঁ, আলোই ফেলেছেন। একদম শেষে যখন জিগোলো পুরুষ ও তার উপভোক্তা নারীর ছায়া একই বিন্দুতে মিলে যায়, তখন দুজনের পশ্চাৎপটও যেন কোথাও এক হয়ে পাঠকের কাছে ধরা দেয়।
রুমঝুম ভট্টাচার্যের 'নুনে পোড়া'-র বিষয়ও বাংলা গল্পে অভিনবই বলা চলে। দেশের এক বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে প্রচলিত পেশার মানুষের আর্তি ও আর্তস্বর ফুটিয়ে তুলেছেন এক অত্যন্ত পরিমিত পরিসরে।
সংকলনে আছে বিভিন্ন ধরনের গল্প, প্রায় প্রতিটিই সুখপাঠ্য ও বিষয়ে ভিন্ন। তার মধ্যেও ব্যক্তিগত পক্ষপাত থেকে গেল সম্বিত বসুর 'দা লাস্ট সোনাটা', রঞ্জন রায়ের 'আহার-নিদ্রা-মৈথুন', ভবভূতি ভট্টাচার্যের 'পরি', সুবীর বোসের 'উত্তরবাহিনী', অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দরজা', অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর 'অব্যক্ত', অনিরুদ্ধ সেনের 'ন্যাড়ার বেলতলা', পরন্তপ বসুর 'অবন্ধু' গল্পগুলোর প্রতি। গত দু-আড়াই দশকে লেখা গল্প বলেই প্রযুক্তির অগ্রগতির পদচিহ্ন লেখকের অজান্তেই আখ্যানদেহে ছাপ ফেলে গেছে অবধারিত ভাবে। তাই বিভিন্ন গল্পে আমাদের জীবনে ক্রমে অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠা মোবাইল তার ফেসবুক-মেসঞ্জার নিয়ে উঠে আসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। সময়ের নিজস্ব বলিরেখা ছোটগল্পের মুখে সুস্পষ্ট হওয়াই তো কাঙ্ক্ষিত। তবে ২০২৫ সালে প্রকাশিত, তিরিশটি গল্পের একটি সংকলনে, বিষয়ে বা প্রেক্ষাপটে, বিশ্বজুড়ে অতিমারির মতো এক মানবসংকটের কোনো অভিঘাতের ছায়া পড়েনি দেখে বিস্মিত হলাম। থাকলে সংকলনটি আরও একটু সাম্প্রত হয়ে উঠত।
আর হ্যাঁ, রঞ্জন রায়ের লেখা প্রথম পড়লাম, এবং এখন থেকে খুঁজে পড়ার ইচ্ছে রইল।
কিছু গল্পে লেখক বাস্তব জগতের পাশাপাশি অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে এক সমান্তরাল কল্পজগৎ এমনভাবে বয়ন করেছেন, যে পাঠক মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সেই নির্মিত জগতে, যার অবস্থান ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, ন্যায়-অন্যায়ের মতো সব বাইনারির বাইরে। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্য অন্যতম হল, ইন্দ্রনীল দাশগুপ্তের 'বুধ বুখারের ইচ্ছে স্বপ্ন', যা আমার থেকে একাধিক পাঠ আদায় করে নিয়েছে। ফয়সাল রাব্বির 'ওমর আলির আন্দালুসিয়ান ঘোড়া', পাঠকের কানে ঘোড়ার খুরের টগবগ টগবগ গুঞ্জরিত হতে থাকে পাঠ সমাপ্ত হওয়ার পরেও। এবং সংকলনের শেষ গল্প, সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের 'নয়ন জেলের নৌকো', মহুয়া এবং সায়নের সম্পর্ক, তার নাগরিক জটিলতা, তৃপ্তিত-অতৃপ্তির দ্বন্দ্ব ও তাদের মনস্তাত্ত্বিক জাদুময়তায় পাঠককে একদম পেড়ে ফেলে।
গল্পগুলো এই সংকলনের সম্পদ বিশেষ।
ভাল লাগল, অংকুর সাহার অনুবাদ গল্প, এক মুঠো খেজুর (মূল: তায়েব সালিহ)। এই লেখা আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় আক্ষরিক অর্থেই এক অচেনা জগতের সঙ্গে।
প্রায় তিনশ পাতার বইয়ে বানান বা ছাপার কোনো ভুল চোখে পড়ল না, তার জন্য অবশ্যই সম্পাদক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাতে চাই। প্রচ্ছদ আকর্ষণীয়, বাঁধাইও টেকসই।
আশা করব 'পরবাস গল্প সংকলন'-এর প্রথম খণ্ড পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সফল হবে।