• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ১০০ | অক্টোবর ২০২৫ | গ্রন্থ-সমালোচনা
    Share
  • লোকে বলে অলৌকিক--পাঠ প্রতিক্রিয়া : রঞ্জন রায়

    লোকে বলে অলৌকিক — ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত ; পরবাস; প্রথম সংস্করণ: বইমেলা ২০২৩, ISBN: 978-1-946582-30-0

    ইন্দ্রনীল দাশুগুপ্ত মশায়ের লেখার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে “পরবাস” প্রকাশিত ছোটগল্প সংকলনের প্রথম খণ্ডের পাতা ওলটাতে গিয়ে। গল্পটি একটু বড়, সংকলনের অধিকাংশ ছোটগল্পের চাইতে। গল্পের বিষয় দেশভাগ, দাঙ্গার স্মৃতি বা ফলশ্রুতি—আজকের সময়ে। কিন্তু বঙ্গ নয়, এ হল পাঞ্জাবের বিভাগ, বাঁটোয়ারা এবং দাঙ্গা।

    পড়তে গিয়ে গোড়াতেই হোঁচট—এ তো কোনওমতেই আমাদের চিরপরিচিত দেশভাগের গল্পের ছক নয়! এ একেবারে অন্যরকম অন্যজাতের গল্প। খানিকক্ষণ পরে বুঝতে পারি—দেশভাগ, দাঙ্গা এসব গল্পটার মুখ্য বিষয় নয়, বড়জোর একটা প্রেক্ষিত দিয়েছে। স্টেজের ব্যাকড্রপের মত। এ গল্প অন্য কোনও দেশে বা কালে ঘটতে পারে।

    ক্রমশ গল্পের মধ্যে সুনিপুণ হাতে বোনা ফাঁদে আটকা পড়ে যাই।

    অবশেষে, স্বীকার করি এটি জাদুবাস্তবের এক সফল রূপায়ণ। না, আমি কোন লেবেল লাগিয়ে লেখকের সিদ্ধিকে ছোট করব না। এত ভাল কাজ যে আঙ্গিক গৌণ হয়ে যায়।

    আগে অনেক পেয়েছি লাতিন আমেরিকার জাদুবাস্তব ঘরানার অক্ষম অনুকরণ। নকল বড্ড বেশি করে নিজেকে জাহির করে।—এই দ্যাখ্‌, আমিও জাদুবাস্তব সৃষ্টি করতে পারি।

    কিন্তু সবাই কি পারে? ইন্দ্রনীল পেরেছেন। তখনই ঠিক করি—এঁর উপন্যাস পড়তে হবে। গদ্যলেখকের আসল জাত চেনা যায় তাঁর লেখা উপন্যাসে।

    পড়ে ফেললাম লোকে বলে অলৌকিক

    কেমন লাগল? আরে, এ তো অন্য এক দুনিয়া! দিল্লির বাঙালিদের জীবন—অনেকটাই ছোটদের চোখ দিয়ে দেখা। অনেকটা মার্ক টোয়েনের তৈরি দুনিয়ার মতন। আছে দুই থাক চরিত্র—শিবু, গদাই, প্রজ্ঞা ও প্রমার দুনিয়া, আবার বড়দের চরিত ও জীবনযাপন। কিন্তু দুই দুনিয়ার মধ্যে পাঠকের অবাধ যাতায়াত।

    কিন্তু এত চরিত্র! এত চরিত্র! সবাই বর্ণময়।

    ভয় হয়—লেখক সামলাতে পারবেন তো?

    কিন্তু সব সন্দেহ খারিজ করে লেখক উত্তীর্ণ হন, উইথ অনার্স।

    অধ্যাপক বাগচী “বিপন্ন বিজ্ঞান” সাপ্তাহিক ক্লাব চালান। অংকের মাস্টারমশাই সাহা স্যার বিপদে পড়লে মনে মনে বড় বড় সংখ্যার বর্গমূল কষতে থাকেন। আবার সিনেমা অভিনেত্রী নাজমার বাংলোতে কফি খেতে খেতে আড্ডা মারেন অথচ থানায় গিয়ে এমন সব সরল কথা বলেন যে তাঁকেই ক্রিমিনাল চক্রের মাস্টারমাইন্ড মনে করা হয়। পুলিস অফিসার মিস সারাভাই ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হতে হতে ঘটনাচক্রে দুঁদে আই পি এস হয়ে যান।

    যুক্তিবাদী অধ্যাপক বাগচী দুই মেয়ের নাম রাখেন প্রমা এবং প্রজ্ঞা। পাড়ার কুকুরের নাম অথর্ব। গল্পকে টেনে রাখে স্কুলের মধ্যে একটি অমীমাংসিত খুন এবং অথর্ব ও আরও কুকুরের বেপাত্তা অথবা কিডন্যাপ হওয়ার রহস্য।

    পাশাপাশি দুটো স্কুল—তাদের মধ্যে রেশারেশি, ছেলেগুলো আদৌ গোপালের মত নয়, বরং রাখালের মত। তারা ছাদের পাঁচিল থেকে স্যারের মাথায় ইঁট ফেলে দেয়।

    হেডমাস্টার স্কুলের সম্মান রক্ষার্থে পাশের মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের প্রিন্সিপালের কামরায় কান ধরে ওঠবোস করেন। কোলাশপের আব্দুল মাদারী কা খেল দেখায়।

    আর সবার মধ্যে মাঝে মাঝে ভর করে কোন প্রেতাত্মার ছায়া, তারা রহস্যের জট খুলে দেয়।

    বাকিসব বলে, ধরুন স্কুল বিল্ডিং-এ সিনেমার শ্যুটিং নিয়ে অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানা—না, রসভঙ্গ করব না।

    কিছু খুঁটিনাটি বর্ণনা থেকে মনে হোল লেখক বোধহয় প্রবাসী বাঙালি, হয়ত দিল্লির। আমরা এক অন্য সমাজের সন্ধান পেলাম। কিন্তু নিশ্চিন্ত হলাম—ওঁরা হরে দরে সব প্রবাসী বাঙালিদের মতই।

    শেষে একটা কথা। অলৌকিক কাকে বলব? যা চেনা দুনিয়ার মধ্যে ঘটছে অথচ যুক্তি দিয়ে বোঝা যাচ্ছে না, তাই তো? হ্যাঁ, সেরকম ঘটনা আছে বটে, কিন্তু লৌকিক-অলৌকিকের সূক্ষ্ম সীমানায় - নো ম্যানস্‌ ল্যান্ডে।

    বইটা পড়া শেষ করে ভাবতে থাকি—আমাদের নিত্য পরিচিত দুনিয়াতেও এমন অনেক ঘটনা রোজ ঘটছে, যা ঘটা উচিত নয়, কোন যুক্তি নেই। আমরা খেয়াল করি না, চোখ খুলে দেখি না। ইন্দ্রনীল দেখেছেন। ওনার জন্য টুপি খুললাম।

    শেষে ধন্যবাদ “পরবাস” বাংলা ওয়েবজিন তথা প্রকাশন সংস্থাকে—এমন কলমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য।

  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments