আলোচ্য বইটিতে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ মুখবন্ধটি আর এক বন্ধুত্বের বৃত্তান্ত - তাঁর সঙ্গে গিরিশ কারনাডের। এই আখ্যানে অনেক প্রাসঙ্গিক তথ্যও পেয়ে যান পাঠক। শমীকবাবু জানিয়েছেন: “গিরিশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জড়িয়ে আছে আমাদের দুজনের সমান্তরাল কর্মজীবনের সঙ্গে। ১৯৭০ সালে গিরিশ প্রাচীন বিদেশি প্রকাশনা সংস্থা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস-এর মাদ্রাজ কার্যালয়ে অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার-এর পদে ইস্তফা দেন। তিনি কাজ করেছেন রয় হকিন্স-এর ম্যানেজারি আধিপত্যে। হকিন্স-এর সঙ্গে সরাসরি বিরোধে গিয়েই তিনি রামানুজনের প্রথম ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ দ্য স্ট্রাইডার্স ‘ও ইউ পি’-র লন্ডন দপ্তরের সম্পাদক স্বনামধন্য জন স্টলওয়র্দি-কে পাঠিয়ে তার প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ‘ও ইউ পি’ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত জানালে, রামানুজন গিরিশকে লেখেন, ‘আমার জীবনে যে গুটিকয়মাত্র ব্যক্তিগত সুখকর ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে এটি একটি।’... ‘ও ইউ পি’-তে সাত বছরের কর্মজীবনে রামানুজনের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগে ও সার্থকতায় আনন্দ ও তৃপ্তি ছাড়া গিরিশ তেমন কোনো ‘বুদ্ধিবৃত্তিগত পরিতৃপ্তি’ পাননি।”
শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখবন্ধটি পড়ে আমরা জানতে পারি, অনন্য নাট্যব্যক্তিত্ব বাদল সরকারের কাছে গিরিশ কারনাডের নাট্যঋণের কথা। শমীকবাবু জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে কলকাতায় একটি বক্তৃতায় গিরিশ বলেছিলেন, তিনি তাঁর নাটক ‘হয়বদন’ লেখার ফর্ম পেয়েছিলেন বাদল সরকারের নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’-এ।
সাক্ষাৎকারের শুরুতেই রামানুজনকে গিরিশ তাঁর গুরু বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন: “...এক কথায় বলতে গেলে, তিনি ছিলেন আমার গুরু। অনেক আইডিয়াই আমি ধার নিয়েছি তাঁর থেকে।” এই বন্ধুত্বের সূচনার কথাও কথাপ্রসঙ্গে এসেছে: “১৯৫৫ সালে রামানুজনের সঙ্গে আমার পরিচয়। তখন আমি সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ধারওয়াড় শহরে কর্ণাটক কলেজে ঢুকেছি। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ আমি সেখানে ছিলাম, গণিতে বি এ পড়তাম।... যখন আমি কর্ণাটক কলেজের ছাত্র, তিনি তখন প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে বেলগাঁও শহরে লিঙ্গরাজ কলেজে ইংরেজির লেকচারার। তখনকার দিনে এই দুটো কলেজকে কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বলে ভাবা হত।... বয়েস তখন কত হবে, ১৭ হয়তো। আমি একজন গুরু খুঁজছিলাম, যিনি আমাকে পথ দেখাবেন; নীরস কলেজ সিলেবাসের বাইরের বৃহৎ জগতে হাত ধরে নিয়ে যাবেন আমাকে। সেই সময়ে দুজন মানুষের প্রভাব আমার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ - একজন বেলগাঁও-এর রামানুজন, এবং অন্যজন কে জে শাহ, তিনি ভিটগেনস্টাইন-এর ছাত্র এবং দর্শনশাস্ত্র পড়াতেন কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি সাহিত্য বা দর্শন কোনোটারই কেতাবি ছাত্র নয়, কিন্তু সুযোগ পেলেই এঁদের দুজনের সঙ্গ ছাড়তাম না।”
রামানুজনের নানাবিধ ভালোবাসার বিষয়ের কথা বলতে গিয়ে গিরিশ জানিয়েছেন: “...সাহিত্য ছাড়াও তিনি আরও নানান বিষয়ের অনুরাগী ছিলেন। তিনি ম্যাজিক দেখাতে পারতেন। আড্ডা জমানোর নানা জমাটি খেলা খেলতে ভালোবাসতেন। তাঁকে অতি সহজেই নিমন্ত্রণ করা যেত কোনও বাচ্চার জন্মদিনের পার্টিতে এসে ম্যাজিক শো করতে। শিশুসুলভ অনেক দক্ষতাও ছিল তাঁর। চলতি ভাষার বাগধারা, ধাঁধা, হেঁয়ালি, কুইজ - এসব ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। কাটাকুটি খেলতে ভালোবাসতেন তিনি...। যে ব্যাপারটায় তিনি তখন আমাদের সবচেয়ে ধাঁধায় ফেলেছিলেন সেটা হল কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যে রচিত তাঁর একটি গ্রন্থ, নাম Proverbs (প্রবাদ)।” গিরিশ কারনাডের সাক্ষাৎকার থেকে আমরা আরও জানতে পারি যে রামানুজন কবি এজরা পাউন্ডের ভক্ত ছিলেন: “...তাঁকে পুরোপুরি দখল করে ফেলেন এজরা পাউন্ড। তাঁর অনুবাদ ধারণা গড়ে উঠেছিল পাউন্ডের রচনা থেকেই। মনে আছে, চিনে ভাষা থেকে পাউন্ডের অনুবাদ পড়ে শোনাতেন।...আমার জানাশোনার মধ্যে তিনিই একমাত্র পাউন্ডে নিমজ্জিত মানুষ।”
রামানুজনের ইংরেজিতে কবিতা লেখা প্রসঙ্গে গিরিশ বলেছেন: “রামানুজনই প্রথম ভারতীয় কবি যিনি ইংরেজিতে কবিতা লেখার সমস্যাটি অনুধাবন করেছেন। এই বিপদের চিন্তাটা সবসময়েই তাঁর মাথায় ছিল কারণ তামিল বা কন্নড় সাহিত্যের তুলনায় ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি ঘনিষ্ঠ ও ব্যক্তিগত।...যদিও তামিল তাঁর মাতৃভাষা, এই ভাষার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে অনেক ফাঁক রয়েছে বলে সন্দেহ হয়।...বাড়িতে শৈশব থেকেই তাঁর তামিলজ্ঞান ছিল চলনসই, মাতৃভাষার যেমন হয়, কিন্তু তামিল সাহিত্যে তাঁর নিবিষ্ট, আকন্ঠ নিমজ্জন ঘটেছে শিকাগোতে আসার পরে।”
কর্নাটকে রামানুজনের কলেজ-এ অধ্যাপনার জীবনে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে কী চোখে দেখতো, তার অনবদ্য বর্ণনা আছে গিরিশের সাক্ষাৎকারে: “...কলেজে আমরা তাঁর মেয়েলি স্বভাব নিয়ে বলাবলি করতাম ...কিন্তু, আসল কথাটা কি - তরুণী ছাত্রীদের চোখে একেবারেই ধরা পড়ত না তাঁর মেয়েলি স্বভাব... মারিয়া (কুটো) আমাদের সঙ্গেই কলেজে পড়তেন এবং রামানুজনকে ভালোই চিনতেন। তিনি বলেন, ‘পুরো মিথ্যে কথা! যেভাবে তিনি মেয়েদের দিকে তাকাতেন, সেই চোখের চাওয়াতেই বোঝা যাবে তাঁর পৌরুষ। ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর আচরণে কোনো আড়ষ্টতা বা ইনহিবিশান ছিল না। বরং তাঁর ব্যক্তিত্বে ছিল কামনা বাসনার প্রাচুর্য’।”
গিরিশের কথায় শোনা যাক, রামানুজনের কবিতা-বোধের কথা: “কবিতা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে তাঁর একটি যথাযথ ধারণা ছিল। কাউকে ‘আবেগপ্রবণ’, ‘কোমল’ বা ‘উচ্ছ্বাসবহুল’ অবস্থায় দেখলে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। ঘৃণা করতেন মর্মস্পর্শী বক্তৃতা বা নাটুকে অভিনয়কে। ‘কবিতা ঘরের তাপমাত্রাতেই কার্যকরী হওয়া উচিত’ - তিনি তর্কের ছলে বলতেন।”
গিরিশ কারনাড মনে করেন, রামানুজনের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটেছিল তাঁর বিদেশজীবনে: “১৯৫৯ সালে তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে ইন্ডিয়ানায় যাবার সুযোগ পেলেন - তাঁর বয়েস তখন তিরিশ ছুঁয়েছে। আমেরিকায় তাঁর পরিবেশটি পেলেন মনের মতো। পরিবারের চিন্তা বা অর্থনৈতিক চিন্তা মাথায় না রেখে তিনি প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর গবেষণার কাজে। এর ফলও ফলল ভালো। মিল্টন সিঙ্গার তাঁকে শিকাগোতে ডেকে নিলেন। এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় রামানুজনের সব প্রিয় বিষয়গুলি একই মোহনায় এসে মেশে শিকাগোতে - বাগধারা নিয়ে তাঁর কাজকর্ম, শ্রুতিকাহিনিতে তাঁর গভীর আগ্রহ, নারীদের লেখা কবিতা নিয়ে তাঁর গবেষণা, ভক্তিমূলক ও তামিল কবিতার অনুবাদ - সবকিছু, এটা খুব সৌভাগ্যের ব্যাপার। শেষে সব বিষয়গুলিকে এক নকশি কাঁথায় বুনে দেন তিনি, যাকে বলে ভারতীয় সংস্কৃতির সম্পূর্ণ তত্ত্ব। অবিশ্বাস্য!”
সাক্ষাৎকারের শেষ পর্বে সাক্ষাৎকারী - অঞ্জলি নেরলেকার- গিরিশের নিজের নাট্যকার হয়ে ওঠার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। পাঠক সেই কথোপকথন পড়েও সমৃদ্ধ হবেন।
রামানুজন ও গিরিশের চিন্তাভাবনার মিল-অমিল নিয়ে নেরলেকারের শেষ প্রশ্নের উত্তরে গিরিশ কারনাড যেভাবে গুরুপ্রণাম জানিয়েছেন, তা আমাদের মুগ্ধ করে: “তিনি ছিলেন কবি ও ভাবুক; আমার জগৎ ছিল নাটকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।...আমাকে প্রভাবিত করেছেন অনেক পূর্বসূরি, কিন্তু রামানুজন সবার থেকে আলাদা; তিনি সেই অল্প কয়েকজনের দলে যাঁরা সম্পূর্ণ নতুন পথ দেখিয়েছেন আমাকে। তা হলেই দেখো, যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে এসেই শেষ করলাম আবার।”
সাবলীল বাংলায় রামানুজন-বিষয়ক গিরিশ কারনাডের এই খোলামেলা সাক্ষাৎকারটি পাঠককে উপহার দেওয়ার জন্য অনুবাদক শ্রী অংকুর সাহা ও ‘পরবাস’-কে সাধুবাদ জানাই।